আসার আশায়

জীবনটাকে কি গানের সঙ্গে তুলনা করা যায় না? ক্ষতি কি? গানের মত জীবনেরও একটা লয় থাক। সেই লয় কোনটায় দ্রুত—কোনটায় ঢিমে। কেউ যুদ্ধের বাজন বাজিয়ে দ্রুত তালে চলে যাচ্ছে—আর কেউ বা ঢিমে তালে দীর্ঘদিন ধরে পিছনে পড়ে থাকছে।

যারা একসঙ্গে পা ফেলে চলে যেতে পারে, তাদের ভাগ্য ভাল।

আমার ভাগ্যে তা হল না। তিনি বিজয়-গর্বে কবে চলে গেছেন—আর আমি! পোড়া কপাল আমার!

আমাকে দেখে তোমরা নিশ্চয় পাগল মনে করছ? তা করতে পার। আমার সাজের সঙ্গে জীবনের যে বিষম গরমিল রয়েছে!

আমার হাতে চুড়ি ঝকঝক করছে। আমার সিঁথেয় সিঁদুর ডগডগ করছে। আমার পরনে কস্তাপেড়ে শাড়ি!

কিন্তু যার জন্যে এই সব—তিনিই ত নেই!

সত্যি বলছি—ওগো তোমরা অমন করে হেসো না। গা-টেপাটিপি করে বলো না, আমি পাগল। সত্যি বলছি—আমি পাগল নই। তবে আমি কি? ওগো! ও-কথা বলতে যে আমি বড় ভয় পাই। বাস্তবিক তিনি কি নেই?

আমি কত লোককে জিজ্ঞাসা করেছি; কত সাধুসন্ন্যাসীর পায়ে মাথা খুঁড়েছি—কিন্তু কেউ কি আমার কথার জবাব দেবে না! তবে বুঝি এ কথার জবাব নেই!

তোমরা যদি কেউ বলতে পার ত—এই অভাগিনীর বড় উপকার হবে।

বলতে পারবে? আঃ—ভগবান তোমাকে সুখী করুন—আর কি বলব—দীর্ঘজীবী হও বলতে যে ভয় করে—ভয় হয়, আশীর্বাদ করতে না শাপ দিয়ে বসি।

তবে বলি, শোনো—

বোশেখ মাসে বেলের গাছ দেখেছ? কত পাতার আবরণে ঘন দলের বুকের মধ্যে কুঁড়িটি ঘুমিয়ে থাকে। বসন্তের কোকিলের ডাক তাকে জাগাতে পারে না। মলয় বাতাসের সব আরাধনাকে সে তুচ্ছ করে কেমন নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমিয়ে থাকে।

তারপর, বসন্ত যখন হায় হায় করতে করতে চলে যায়—তখন অভাগী কুঁড়ি ধড়ফড় করে তিনদিনের মধ্যে ফুটে উঠে। তখন তার সাত-শ’ খোয়ার। কড়া সূর্যির তাত তার উপর কি নির্দয়ভাবে পড়ে বিদ্রূপ করতে থাকে! দাঁড়কাকের হাহাক্কার শুনতে শুনতে দিনশেষে সে ডালের নীচে এলিয়ে পড়ে!

আমি ফুল নই। তাই এলিয়ে পড়লুম না। ঝরে পড়লে ত সব চুকেই যেত!

খুব গরীবের ঘরে আমার জন্ম হয়নি। বাবা এমন ডাকসাইটে বড়লোকও কিছু ছিলেন না। কিন্তু কাল হল আমার পোড়া রূপ।

শুনতে পাই—আমার দুধে-রঙে আলতার আভা ছিল। কালো চুল পা অবধি লুটিয়ে পড়ত। আরো কত-কি!

এ-সব আমার শোনা কথা। সত্যি-মিথ্যে ভগবান জানেন। তোমরা কি তার পরিচয় কিছু পাচ্ছ?

কি দেখছ? না, না—ও রং নয়—আমার ঠোঁট অমনিতরই। এটা? টিপ নয়—এটা একটা তিল! ওটা জন্ম থেকেই আছে।

তাই দেখেই ত সন্ন্যাসী মিন্‌সে বলেছিল যে, আমি হবো রাজরানী। আহা! যদি না বলত! মিন্‌সে যা বললে, তাই হল গা!

আহা, যদি না সেদিন সকালে সাজিহাতে বেরুতাম! গঙ্গাজলে কি শিবপূজো হয় না? মা’র ছিল সবটাতেই যেন বাড়াবাড়ি! ফুল তাঁর চাই-ই, নইলে শিবপূজো হবে না। আর তিনিই বা জানবেন কি করে? আর রাজারই বা কি আক্কেল! দুনিয়ার এত পথ থাকতে—তাঁর যাবার রাস্তা হল সেই আমাদের পুকুরের ধারের সরু গলিটা দিয়ে!

শুনলাম, রাজা আসছেন, রাজা আসছেন—হাঁ করে রাজা দেখছি। মনে করলাম, বুঝি বা তাঁর চারটে হাত দেখাব। হায় রে, তখন যদি ছুট মেরে বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ি!

রাজা ত বাপু কত লোক দেখেছিল। কপাল ত আর কারুর ধরল না!

সেদিন থেকে লোকের হাসি সইতে পারিনে। মনে হয়, ওই হাসির নীচে যেন ছুরির বাঁকা ধারটা ঝিকঝিক করছে।

রাজা হেসে বললেন, “মা, কি তোমার নাম?”—আমি ত লজ্জায় মরে গেলাম। ঘাড় গুঁজে দাঁড়িয়ে বাঁ-পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে মাটি খুঁড়তে লাগলাম। নাম মনে এল না। কানের মধ্যে ঝাঁঝাঁ করতে লাগল। নাকের উপর বিন্‌কি বিন্‌কি ঘাম দেখা দিলে।

রাজা বললেন, “কি শান্ত—কি লক্ষণ—কি শ্রী—এ যে শুধু আমার ঘরেরই উপযুক্ত!” সেদিন থেকে চারদিকে কানাঘুষো পড়ে গেল। আমার মনের মধ্যে ছটফটানি ধরল। কৈ, রাজার খবর আসে না কেন? হায় পোড়াকপালী!—শেষে তোর সাধ মিটল!

যখন ডাক পড়ল, তখন একেবারে চুলের মুটি ধরে। আর সবুর সইল না। জানিনে, কবে কোন্‌ ফাঁকে কুমার আমাকে দেখে নাওয়া-খাওয়া বন্ধ করে বসলেন।

পাঁজিপুঁথি ধরে গোণক্কার বিয়ের দিন ঠিক করেছেন,—শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমেতে।

কি জল, কি ঝড় সে রাতে! সত্যি বলছি—সে বাতাসে বিয়ের মন্তরগুলো সব উড়ে গেল। শুধু আমরা দু’জনে দু’জনকে দেখলাম মাত্র—একটিবার! তার পর ঝড়ে সব বাতি নিবে গেল—আমাদের গলার যুঁই-এর গোড়ে ছিঁড়েখুড়ে খণ্ড খণ্ড হয়ে কোথায় উড়ে চলে গেল।

আমি কুমারের বুকের কাছে জড়সড় হয়ে বললুম, “ওগো, আমার যে বড় ভয় করেছে” তিনি মুখের কাছে মুখ এনে বললেন, “আরো সরে এস—আমার এই বুকের মধ্যে।”

আমি কাঁপতে কাঁপতে—ঝড়ের মধ্যে পাখির ছানা যেমন তার নীড়ের মধ্যে ঘুমোয়,—তেমনি করে ঘুমিয়ে পড়লাম।

সকালে ঘুম-ভেঙ্গে দেখি, কৈ রাজকুমার,—এ যে আমাদের বুড়ো ঝির বুকের মধ্য রয়েছি।

তার মুখের দিকে চেয়ে দেখলাম, দু’চোখ বেয়ে তার জল পড়ছে। কথা কইতে সাহস হল না।

দেখলাম, বাইরে মেঘ থেকে অজস্র জল পড়ছে—দেখলাম, বাড়ির সকলের চোখ থেকে জল গড়াচ্ছে। গাছের মধ্যে দিয়ে সোঁ সোঁ করে বাতাস বইছে।

আমার বুকের মধ্যে মনে হল অনেকখানি বাতাস তেমনি করে গুমরে উঠছে। মনে হল কাঁদি। কান্না এল না। অবাক হয়ে রইলাম। একরাতের মধ্যে আমার বুকের সব রক্ত—চোখের সব জল এমন নিঃশেষ করে কে শুষে নিলে।

তার পর আর কুমারের সঙ্গে দেখা হল না। লজ্জায় কারুকে জিজ্ঞাসা করতে পারলাম না, তিনি কোথায়।

মস্তবড় বাড়ির মধ্যে খাঁচার পাখির মত আট্‌কা পড়ে রইলুম। যে আমাকে দেখে সেই কাঁদে—আমি অবাক হয়ে চেয়ে থাকি।

শেষকালে একদিন রাজপুত্তুর দেখা দিলেন। সেদিন কি ঘুমেই না পেয়েছিল আমাকে! কত তিনি বলেছিলেন; তার মানে তখন বুঝিনি। এখনই কি ছাই বুঝতে পেরেছি!

তিনি বললেন, আবার দেখা হবে; কবে তা বলেন নি। বলেছেন, তিনি আমাকে ছেড়ে কোথাও থাকতে পারবেন না। তিনি মানা করেছেন—আমাকে সিঁথির সিঁদুর মুছতে—আমার হাতের চুড়ি খুলে ফেলতে। তাই এই সিঁদুর—তাই আজও এই পোড়া হাত-দুটোতে সোনার চুড়ি ঝকঝক করে।

এখন তোমরা কি কেউ দয়া করে আমাকে বলতে পার, কবে তিনি আসছেন?

ও কি! তোমরাও যে অবাক হয়ে চেয়ে রইলে! চোখের অমন উদাস চাউনি যে আমি সইতে পারিনে।

ওগো, তোমরা কি সব ছবি? কথা কও না? হায় হায়—এ কোন্‌ দেশে তুমি আমায় রেখে গেছ কুমার! ও মা! চোখের কোণে তোমাদের ও কি গা? জল নয় ত! সে কি, তোমরাও কথা কইবে না? তবে কে আমায় বলে দেবে—কবে তুমি আসবে কুমার!

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. ‘আসার আশায়’ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত রূপকথা। জ্যৈষ্ঠ, ১৩২৪ বঙ্গাব্দ, ‘ভারতবর্ষ’ মাসিক পত্রে প্রকাশিত।