সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা
(এক)[১]

বাঙলার হিন্দু জনগণের আজকের এই সম্মিলনী যাঁরা আহ্বান করেছেন, আমি তাঁদের একজন। এই বিশাল সভা কেবলমাত্র এই নগরের নাগরিকগণের নয়। আজ যাঁরা সমবেত হয়েছেন, তাঁরা বাঙলার বিভিন্ন জেলার অধিবাসী। সকলের বর্ণ হয়ত এক নয়, কিন্তু ভাষা এক, সাহিত্য এক, ধর্ম এক, জীবনযাত্রার গোড়ার কথাটা এক,—যে বিশ্বাস যে নিষ্ঠা আমাদের ইহলোক পরলোক নিয়ন্ত্রিত করে, সেখানেও আমরা কেউ কারও পর নয়। পর করে দেবার নানা উপায়, নানা কৌশল সত্ত্বেও বলব, আমরা আজও এক। যুগ-যুগান্ত থেকে যে বন্ধন আমাদের এক করে রেখেছে, সত্যিই আজও তা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়নি।

বাঙলার সেই সমগ্র হিন্দু জাতির পক্ষ থেকে, যাঁরা এই সভার উদ্যোক্তা, তাঁদের পক্ষ থেকে আমি সবিনয়ে সসম্মানে রবীন্দ্রনাথকে আমন্ত্রণ করি—এই বিপুলায়তন সভার নেতৃত্ব গ্রহণ করতে।

একটা প্রথা আছে সভাপতির পরিচয় দেওয়া; কিন্তু রবীন্দ্রনাথের এই বিরাট নামের সম্মুখে পিছনে পরিচয়ের কোন্‌ বিশেষণ যোগ করা যায়? বিশ্বকবি, কবিসার্বভৌম ইত্যাদি অনেক কিছু মানুষে পূর্বেই আরোপ করে রেখেছে। কিন্তু আমরা—যাঁরা তাঁর শিষ্য-সেবক—নিজেদের মধ্যে শুধু ‘কবি’ বলেই তাঁর উল্লেখ করি।—বাইরে বলি রবীন্দ্রনাথ। জানি, সভ্যজগতের একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্ত পর্যন্ত এই ব্যক্তিটিকে বোঝাবার পক্ষে কারও অসুবিধা ঘটবে না। কবির মন ক্লান্ত, দেহ দুর্বল, অবসন্ন। এই বিপুল জনতার মাঝখানে তাঁকে আহ্বান করে আনা বিপজ্জনক। তবু তাঁকে আমরা অনুরোধ করেছিলাম। মনে মনে ইচ্ছে ছিল, দুনিয়ার কারও না অবিদিত থাকে এই সভার নেতৃত্বের ভার বহন করলেন কে? কবি স্বীকার করলেন, বললেন, ভাল, তাঁর বক্তব্য তাঁর নিজের মুখ দিয়েই তবে ব্যক্ত হোক।

তাঁকে আমাদের সকৃতজ্ঞ চিত্তের নমস্কার নিবেদন করি।

ভারত-রাজ্যশাসনের নূতন যন্ত্র বিলাতের মন্ত্রীগণ বহুদিনে বহু যত্নে প্রস্তুত করেছেন।

জাহাজে বোঝাই দেওয়া হয়েছে,—এলো বলে। তার ছোট-বড় কত চাকা, কত দণ্ড, কত কলকব্‌জা কোন্‌টা কোন্‌দিকে ঘোরে কোন্‌দিকে ফেরে কোন্‌ মুখে এগোয় আমার কেউ ঠিক জানিনে। এবং মূল্য তার শেষ পর্যন্ত যে কি দিতে হবে, সে ধারণাও কারো নেই।

যন্ত্র-নির্মাণের সময় মাঝে মাঝে শুধু খবর পাওয়া যেতো, এদেশ থেকে ওদেশে বহু বুদ্ধিমান চালান দেওয়া হয়েছে, বুদ্ধি দেবার জন্যে। কি বুদ্ধি তাঁরা দিলেন, সে সূক্ষ্ম তত্ত্ব আমরা সাধারণ মানুষে বুঝিনে, কেবল এইটুকু বোঝা গিয়েছিল, একপক্ষ তারস্বরে অনেক চীৎকার করেছিলেন, ও নূতন যন্ত্রে তাঁদের কাজ নেই এবং অপরপক্ষ ধমক দিয়ে বলেছিলেন, আলবত্‌ কাজ আছে—চেঁচিও না। অতএব কাজ আছে শেষ পর্যন্ত স্বীকার করতেই হলো। অনেকের ধারণা, সেটা নাকি মস্ত বড় আকমাড়া কলের মত। তার একদিকে জমা হবে ছিবড়ে, অন্য দিকে রস। শেষেরটা পাত্রে সঞ্চিত হয়ে কোন্‌দিকে চালান যাবে, সে প্রশ্ন শুধু বাহুল্য নয়, হয়ত বা অবৈধ। ভয় আছে। তথাপি প্রশ্ন করা চলে। রাষ্ট্রব্যবস্থায় ধর্মবিশ্বাসই কি হয়ে দাঁড়াল সকলের বড়? আর মানুষ হলো ছোট? যে ব্যবস্থা জগতের কোথাও নেই, কোথাও কল্যাণ হয়নি, এই দুর্ভাগা দেশে তাই কি হলো special and peculiar circumstances? আর সে কেউ বোঝে না—নাবালকের trusteeরা ছাড়া?

কিন্তু এ হলো politics, এ আলোচনা করবার ভার নেই আমার উপর। এ বিষয়ে যাঁরা ওয়াকিবহাল, তাঁরাই এ তত্ত্ব বুঝিয়ে দেবার যোগ্য পাত্র। আমি নয়।

তবুও পরিশেষে একটা কথা বলে রাখি। কারও কারও ধারণা—আমরা বিলেতে memorial পাঠিয়েছি সুবিচারের আশায়। সে বিশ্বাস আমাদের কারও নেই, আমরা পাঠিয়েছি অন্যায়ের প্রতিবাদ। নূতন শাসনব্যবস্থার আগাগোড়াই মন্দ। সেই অপরিসীম মন্দের মধ্যেও বাঙলায় হিন্দুরা ক্ষতিগ্রস্ত হলো সবচেয়ে বেশী। আইনের পেরেক ঠুকে তাঁদের ছোট করা হলো চিরদিনের মত। তথাপি এ কথা সত্য যে, দেশের মুসলমান ভাইয়েরা দশ-পনেরটা স্থান বেশী পেয়েছেন বলে তাঁদের বলতে চাই,—অন্যায়, অবিচার—একজনের প্রতি হলেও সে অকল্যাণময়। তাতে শেষ পর্যন্ত না মুসলমানের, না হিন্দুর, না জন্মভূমির—কাহারও মঙ্গল হয় না।

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. ‘বাতায়ণ’ ১ শ্রাবণ, ১৩৪৩।