» » ভাঙ্গাচোরা

বর্ণাকার

টুনুর স্বামীকে দেখে এমনভাবে চমকাতে হবে তা কে জানতো।

তবু চমকেছিলাম, ভীষণভাবেই চমকে উঠেছিলাম হয়তো।

 

কাল রাতে যখন ট্রেন থেকে নেমেছিলাম তখন বাইরে শীত পড়ছিলো ভীষণ। কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস। বাতাসের বরফ ঝরছিল যেন। কোটের কলারটা তুলে দিয়েও কানটা ঢাকা যাচ্ছিলো না। উদলা হাত জোড়া জমে আসতে চাইছিলো শীতের প্রকোপে। স্টেশনে লোকজনের বিশেষ ভিড় ছিলো না। মাঝে মাঝে দু’একজন চা ভেণ্ডারের চিৎকার ছাড়া সাড়াশব্দও তেমন ছিলো না বললেই চলে। ব্যস্তভাবে হয়ত একটা কুলির জন্যই তাকাচ্ছিলাম এদিক-ওদিক, ঘন কুয়াশা ভেদ করে কাঁপতে কাঁপতে সামনে এসে দাঁড়ালো একটা লোক। পরনে একটা খাটো করে পরা লুঙ্গি। মাথা আর কান ঢেকে গায়ে একটা ময়লা চাদর জড়ান। পায়ে একজোড়া মোটর টায়ারের স্যান্ডাল। কিছুক্ষণ ইতস্তত করে সুটকেসটা হাতে আর হোল্ডারটা বগলে তুলে নিল ও। উঃ কি ভীষণ কুয়াশা পড়েছে। আসুন সাহেব; দাঁড়িয়ে রয়েছেন কেন। আরো মাল আছে নাকি? না, চলো। লোকটার আগাগোড়া আর এক পলক তাকিয়ে নিয়ে পিছু পিছু এগুতে লাগলাম ওর।

গেটের কাছাকাছি এসে লোকটা ফিরে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কোথায় যাবেন সাহেব?

আপাতত ডাকবাংলোয়। —এই শোন— রিক্সা টিক্সা পাওয়া যাবেতো এখন?

হ্যাঁ, আমার নিজেরই রিক্সা আছে। ও বললো। আর বলতে গিয়ে বারকয়েক কাশলো ও।

মফস্বল শহর।

স্টেশনের সামনের রাস্তাটা পেরিয়ে কিছুদূর গেলে বিজলী বাতির আর কোন বন্দোবস্ত নেই। সামনের ছোট্ট কেরোসিন বাতিটার উপর নির্ভর করেই চলে রিক্সা। দোকানপাটগুলো খোলা থাকলে তবু কিছু আলো আসে রাস্তায়। কিন্তু এ পৌণে বারোটায় দোকানপাট বন্ধ করে কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে তার মালিকরা। লোকজন কারো সাড়াশব্দ নেই। শুধু দু’একটা হ্যাংলা কুকুর মাঝে মাঝে চিৎকার করছে এখানে ওখানে। রাস্তাগুলো সব গর্তে ভরা। প্রতি গজ অন্তর একটা করে খাদ। এসব রাস্তায় রিক্সা চালাতে শুধু রিক্সা চালকেরই কষ্ট হয় না। আরোহীরও গা-হাত পা ব্যথা করে উঠে। বিরক্তি লাগে।

ইস রাস্তাগুলোর এই দুরবস্থা কেন? কেন যেন হঠাৎ বিড়বিড় করে উঠেছিলাম।

লোকটা একবার পেছনে তাকিয়ে নিয়ে বললো। বন্যায় সব ডুবে গিয়েছিল কিনা, তাই খাদ পড়ে গেছে।

তা— বন্যাতো কবে নেমে গেছে, এখন মেরামত করে নিলেই পারে।

কে করবে মেরামত—।  হঠাৎ যেন বলতে গিয়ে চুপ করে গেল লোকটা। রিক্সা থামিয়ে নিভে যাওয়া বাতিটা জ্বালিয়ে নিয়ে আবার চড়লো রিক্সায়।

ডাকবাংলোটা স্টেশন থেকে বেশি দূর নয়।

পৌঁছতে মিনিট বিশেক সময় নিয়েছিল মাত্র।

লোকটা নিজ হাতেই সুটকেস আর হোল্ডারটা তুলে রাখলো বারান্দায়।

তারপর বললো, আপনি দাঁড়ান। দারোয়ান বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছে। ওকে ডেকে আনি।

শীতের রাতে একবার ঘুমের কোলে ঢলে পড়লে সহজে উঠতে চায় না কেউ, তুলতে বেশ সময় নিয়েছিলো। তার মুখের দিকে তাকিয়ে বেশ বোঝা যাচ্ছিলো এমন আয়েশের ঘুমটা ভেঙ্গে যাওয়ায় মনে মনে ভীষণ বিরক্ত হয়েছে সে। তবু সে ভাবটা গোপন রেখে লম্বা একটা সালাম জানিয়ে মালপত্রগুলো ভেতরে নিয়ে গেলো দারোয়ান।

রিক্সাওয়ালাটা তখনও বারান্দায় দাঁড়িয়ে।

কত দিতে হবে তোমায়? পকেট থেকে ব্যাগটা বের করে এগিয়ে যাই তার দিকে। ও বললো, আপনার সাথে আর কি দরাদরি করবো। আপনার যা খুশি তাই দিন।

সে কি হয়। কত রেট তা না জানালে আন্দাজে কি দেবো আমি। আপনার যা খুশি দিন। আগের কথাটাই পুনরাবৃত্তি করলো সে। ব্যাগ থেকে একটা আধুলি বের করে হাতে তুলে দিলাম তার। এই নাও। হলতো?

জ্বী হ্যাঁ। ঘাড় নেড়ে সায় দিলো সে কথার। তারপর সালাম জানিয়ে গুটিগুটি পায়ে রিক্সাটা নিয়ে বেরিয়ে গেলো ধীরে।

অদূরে দাঁড়ান দারোয়ানটা এতক্ষণ দেখছিলো সব। ও চলে যেতে এগিয়ে এসে বললো, এ-বাবু। ইস্টেশনছে এঁহা চার আনা লেতা। আওর আপ একঠু আঠান্নি দে দিয়া উসোকো। এ-হে বহুত জাস্তি দে দিয়া আপ। বহুত জাস্তি। চার- চার আনা পয়সা। আপন মনে অনেকক্ষণ পর্যন্ত চার আনা পয়সার জন্য আপসোস করছিলো সে। ওর কথায় কান না দিয়ে, যেখানে শোবার বন্দোবস্ত করা হয়েছিল সেখানে এসে ঢুকলাম। পথেই জংশনে খেয়ে এসেছিলাম। তাই রাতে আর খাওয়ার কোন প্রয়োজন ছিলো না। শোবার আগে আগামী দিনের করণীয় বিষয়গুলো ঠিক করে নিয়েছিলাম মনে মনে। ভোরে উঠেই হাত মুখ ধুয়ে নাস্তা করে সরাসরি কাজগুলো সেরে নিতে হবে। এস, ডি-ওর সাথে দেখা করতে হবে। সার্কেল অফিসারের সাথে আলোচনা করতে হবে টাকা-পয়সার ব্যাপার নিয়ে। তারপর দুপুরে টুনুর বাসায়।

দীর্ঘ আট বছর পর কাল হঠাৎ দেখতে পেয়ে হয়ত প্রথমে চিনতেই পারবে না টুনু। অবাক হয়ে মুখের পানে তাকিয়ে বলবে, কাকে চান? পরে চিনতে পেরে হয়ত আনন্দে লাফিয়ে উঠে বলবে। উঃ এতদিনে বুঝি টুনুর কথা মনে পড়ল তোমার। এই দীর্ঘ আট বছর পরে?

দীর্ঘ আট বছর।

জীবনের মানচিত্রে আটটি বছর নেহায়েৎ কম নয়।

তবুও ভাবতে গেলে মনে হয় এই সেদিনের কথা।

কোলকাতায় একই পাড়াতে থাকতাম। পাশাপাশি বাসা।

টুনু তখন শাখাওয়াতে পড়তো ক্লাস সিক্সে কি সেভেনে।

আমি পড়তাম মিত্ৰয়। ওই একই ক্লাসে।

স্কুল ছুটির পর বিকেলে প্রায় ওদের বাসায় যেতাম।

ওরাও আসতো মাঝে মাঝে।

আনাগোনা মিলমিশ আর ঘনিষ্ঠ হৃদ্যতা ছিলো উভয় পরিবারের মধ্যে। আমাদের দু’জনকে একসাথে দেখলেই বুড়ি দাদী ফোড়ন কাটতো।

কি গো, কি কথা হচ্ছে দু’জনের মধ্যে। পিরীত টিরিত নয়তো। তাইলে বলো। এখন থেকেই ওকালতি শুরু করে দিই।

তারপর ক্লাস এইটের বছর সে পাড়া থেকে অন্য পাড়ায় উঠে গেলো টুনুরা। আর তার মাস আটেক পরেই তো শোনা গেলো; একটা ননম্যাট্রিক ছেলের সাথে কোথায় পালিয়ে গেছে টুনু। পালিয়ে গেছে— খবরটা প্রথমে মোটেই বিশ্বাস হচ্ছিল না। পরে অবশ্য বিশ্বাস না করে পারিনি। এরপর মাঝখানে দু’টি বছর।

দু’বছর পর হঠাৎ টুনুর সাথে দেখা ট্রেনে। দেশ বিভাগের পর কোলকাতা থেকে ঢাকা আসবার পথে।

দেখা হতে মৃদু হাসলো টুনু। বললো। কেমন আছ ভালোতো?

ভালো। তুমি কেমন?

আমি বে-শ ভালো। ঠোঁট টিপে হেসেছিল টুনু। আরো অনেক কথার পর হাতে একটা ঠিকানা গুঁজে দিয়ে বলেছিলো, মফস্বল শহরেই আছি। সময় পেলে একবার এসো। কেমন?

সময়ও হয়নি, আসতেও পারিনি কোনদিন।

এবার হঠাৎ সরকারী কাজে এখানে আসতে হওয়ায়; আসবার পথেই মনে মনে ঠিক করে নিয়েছিলাম টুনুর সাথে একবার দেখা করবো। কে জানে এ ক’বছরে কত পরিবর্তন এসেছে ওর দেহে-মনে চেহারায়।

 

পরদিন খুব ভোরে ভোরেই বিছানা ছেড়ে উঠলাম।

হাত মুখ ধুয়ে নাস্তা করলাম।

সরকারী কাজগুলো সেরে নিলাম একে একে।

তারপর ঠিকানাটা পকেটে গুঁজে টুনুর খোঁজে।

সার্কেল অফিসের পিওনটাকে বলতে ও বললো, পাড়াটা আমি চিনি। চলুন না স্যার আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।

কতদূর হবে পাড়াটা?

বেশি দূর নয় স্যার। আসুন না আমি পৌঁছে দিচ্ছি।

বেশি দূর নয় বললেও বেশি দূরই মনে হলো। ঠিকানাটা মিলিয়ে বাসার সামনে পৌঁছে দিয়ে পিয়নটা চলে গেলো। বলে গেলো। এইতো এই বাসা স্যার। আমি এখন যাই তাহলে।

যাও। ওকে যেতে বলে সামনে এগিয়ে গেলাম।

বাঁশে ঘেরা দেয়া মাঝারি গোছের একটা ঘর। ওপরে টিনের চালা। সামনে স্বল্প পরিসর। দু’তিনটে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে মাটি নিয়ে খেলা করছে সেখানে। আমায় দেখে, মুখে আঙ্গুল পুরে হা করে আমার দিকে তাকালো ওরা। বয়সে যে সবার চাইতে বড় সে এগিয়ে এসে বললো, কাকে চাই? মুখের আদলটা তার টুনুকেই স্মরণ করিয়ে দেয়।

বললাম, এটা কি তোমাদের বাসা খোকা?

হ্যাঁ।

তোমার মা বাসায় আছেন?

হ্যাঁ আছেন। কেন কি চাই আপনার? অনেকটা মাতব্বরি চালেই জিজ্ঞেস করলো ছেলেটা। মৃদু হেসে বললাম, দরকার আছে, তুমি যাওতো খোকা ভেতরে গিয়ে তোমার মাকে বলো তোমার সালাম মামা এসেছে।

এ কথায় একটু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো ছেলেটা। তারপর বললো। আচ্ছা আপনি দাঁড়ান। আমি খবর দিচ্ছি মাকে। বলে ভেতরে চলে গেলো সে।

একটু পরেই চট ঝোলান দরজার ফাঁক দিয়ে বাইরে উঁকি মারলো টুনুর মুখ।

কয়েকটি নীরব মুহূৰ্ত্ত।

তারপর খলখলিয়ে উঠলো টুনু। আরে সালাম তুমি, কি ভাগ্যি আমার। এসো এসো, ভেতরে এসো, ওখানে দাঁড়িয়ে কেন। ভিতরে এসো। অনেকটা হাত বাড়িয়ে ভেতরে এগিয়ে নিলো টুনু। কইরে বিনু। মামা এসেছে তোর, একটা মোড়া এনে বসতে দে। কইরে বিনু শুনছিস। মেয়েটা গেলো কই? মেয়ের কোন সন্ধান না পেয়ে নিজ হাতেই পাশের ঘর থেকে একটা মোড়া এনে আমায় বসতে দিলো টুনু। চোখ বুলিয়ে প্রথমে ঘরটাকেই দেখলাম। তারপর খুঁটে খুঁটে দেখলাম টুনুকে।

সত্যি, এ ক’বছরে অনেক বদলে গেছে টুনু। সেদিনের সেই তন্নী মেয়েটি আর নেই। ফর্সা রংটা তামাটে হয়ে গেছে। গোলগাল চেহারাটা গেছে ভেঙ্গে। কানের কাছের দু’একটা চুলে পাকও ধরেছে টুনুর।

তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে হঠাৎ টুনু বললো, কি দেখছো অমন করে?

তোমায় দেখছি টুনু। পরক্ষণেই জবাব দিলাম। সত্যিই তুমি অনেক বদলে গেছো।

তাই নাকি? টুনু মুখ টিপে হাসলো। তা বদলাবো না তো কি সারা জনম এক রকম থাকবো নাকি। বয়স হচ্ছে না? স্বল্পকাল থেমে আবার বললো, ভাগনে ভাগনীও তোমার কম হয়নি। মোট চারজন।

কই ওরা কোথায়, ওদের কাউকে তো দেখছি না।

ওরা কি আর এক মিনিটের জন্য ঘরে থাকে। সারাটা দিন পঁই পঁই করে ঘুরে বেড়ায় পাড়ার বখাটে ছেলেগুলোর সাথে। বলে ছেলেমেয়েদের খোঁজেই হয়তো বাইরে বেরিয়ে গেলো টুনু।

বসে বসে অতীতের কথাই ভাবছিলাম।

টুনু ফিরে এলো একটু পরে। সাথে একটা সাত আট বছরের ময়লা ফ্রক পরা মেয়ে আর দুটো ছেলে। মেয়েটাকে সামনে ঠেলে দিয়ে টুনু হেসে বললো, এই দেখো এটা হচ্ছে এক নম্বর। ডাক নাম বিনু। আসল নাম রেখেছি মনোয়ারা আর এটা হচ্ছে মেজ ছেলে। এটা সেজ। বড়টা কোথায় গেছে। দাঁড়াও না আসুক ফিরে। পিঠের চামড়া তুলে ফেলবো আজ। বোঝা গেল টুনু রেগেছে। আগে রাগলে খুব সুন্দর দেখাতো ওকে। আজ কিন্তু তেমন কিছু মনে হলো না। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে জিজ্ঞেস করলাম, কর্তা কোথায়?

কর্তা। তার কথা বল কেন ভাই, লোকটার কি শান্তি আছে। এইতো সেই সকালে বেরিয়ে গেছে কাজে। পোস্টাফিসে পিয়নের কাজ। জান তো ও কাজে কত খাটুনি। দুপুরে একবার শুধু আসে খেতে। তারপর খেয়েদেয়ে আবার বেরুবে। ফিরতে ফিরতে সেই রাত নিশুতি। টুনু থামলো। কিছুক্ষণ বাইরে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো চুপচাপ। তারপর আবার বললো, কি ব্যাপার, তুমি এক কাপড়ে এসেছো, নাকি, মালপত্র সাথে কিছু নেই?

এর উত্তর দিতে গিয়ে কিছুক্ষণ ভাবতে হলো বই-কি। মাটিতে চোখ নামিয়ে সত্য কথাটাই শেষে বললাম।

আর তা শুনে বড় অবাক হলো টুনু। সে কি। আমি থাকতে এখানে, তুমি উঠেছো ডাকবাংলায়। সে কি।

লজ্জায় লাল হয়ে এলাম। কিছু বললাম না।

টুনুও যেন এ নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করতে চাইল না। স্বল্পকাল নীরব থেকে বললো। যে ক’দিন আছো, খাওয়া দাওয়াটা কিন্তু এখানেই করো। বলে উঠে দাঁড়াল টুনু। মোড়াটা নিয়ে পাকঘরে এসো, চুলোর উপর ভাত চড়িয়ে এসেছি। এসো, ওখানে বসে গল্প করা যাবে তোমার সাথে।

পাক ঘরে এসে রাজধানীর কথা জিজ্ঞেস করলো টুনু। কে কোথায় আছে। কেমন আছে। এমনি আরও অনেক কথা।

তারপর পাড়লো নিজের কথা। শরীরটা দেখছো না কেমন দিন দিন ভেঙ্গে যাচ্ছে। রোগে ধরেছে আজ তিন বছর। এখানে ভালো ডাক্তার নেই। একবার ভাবছিলাম তোমার ওখানে গিয়ে চিকিৎসা করাবো। কিন্তু, যাবার কি কোন জো আছে। তিন চারটে ছেলে-মেয়ে ঘরে। ওদের কার কাছে রেখে যাই। ওর অবস্থাতো আরো খারাপ। লোকটা বোধ হয় বেশি দিন বাঁচবে না, সারাদিন যা খাটে, বেতনতো পায় মাত্র পঞ্চাশ টাকা। ওতে কিইবা হয় বলতে বলতে কেমন ম্লান হয়ে এলো টুনুর মুখখানা। আর কি যেন বলতে যাচ্ছিল সে। মেজ ছেলেটা কোত্থেকে ছুটে এসে বললো মা, মেস থেকে ওরা লোক পাঠিয়েছে। বলছে আজ নাকি তরকারিতে তুমি বড্ড বেশি লবণ দিয়ে দিয়েছ। আর ওরা তোমায় রাখবে না।

ছেলের এ আকস্মিক কথায় অপ্রস্তুত হয়ে গেলো টুনু। চোখাচোখি হতে লজ্জায় রাঙ্গা হয়ে উঠলো ওর মুখখানা। মাটিতে চোখ নামিয়ে নিয়ে বললো, তোমার কাছে আর লুকিয়ে কি লাভ বলো। বোঝতো, একমাত্র ওর আয়ে কিইবা হয়। পাশে পি, ডিব্লউ, ডির মেস আছে। সকাল বিকেল ওদের ভাতটা পাক করে দিই। বলতে গিয়ে লজ্জায় মুখখানা আরো নুয়ে এলো টুনুর। আরো বেশি অপ্রস্তুত হলো। সে আর সে ভাবটা কাটিয়ে উঠবার জন্যই হয়ত বললো, রান্না বান্নাই তো আমাদের কাজ। ঘরে যেমন রাঁধি। তেমনি ওদেরও রেঁধেদি। মাস মাস কুড়িটা টাকা। কমতো নয়। চুলোর উপর থেকে ভাতের হাঁড়িটা নামিয়ে হঠাৎ উঠে দাঁড়ালো টুনু। কাপড়ের আঁচলে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বললো। উনি বোধ হয় এলেন। দেখি, বলে পাকঘর থেকে বেরিয়ে গেলো সে। একটু পরেই শোবার ঘর থেকে তার গলার আওয়াজ শোনা গেলো উনি এসেছেন সালাম। এসো, দেখা করে যাও। টুনুর স্বামীকে দেখে এমনভাবে চমকাতে হবে তা কে জানতো।

তবু চমকালাম, ভীষণভাবেই চমকে উঠলাম হয়তো। পরনে একটা খাটো করে পরা লুঙ্গি, গায়ে একটা ময়লা চাদর জড়ানো। পায়ে একজোড়া মোটর টায়ারের স্যান্ডেল। লোকটাকে চিনতে একটুও ভুল হলো না। সেও চিনলো আমায়। আর, চিনলো বলেই তো মুখখানা কেমন ফেকাশে হয়ে গেলো তার। হাত মুখ ধুবার অছিলায় ছুটে কলতলায় চলে গেলো সে।

ও চলে গেলে কানের কাছে মুখ এনে চাপা গলায় টুনু বললো, পিয়নের কাজ করলে কি হবে। লোকটার প্রেসটিজ জ্ঞান বড় টনটনে। খবরদার। আমি যে মেসের ভাত পাক করে দিই; ঘুণাক্ষরেও একথাটা বলো না ওকে। তাহলে রেগে আগুন হয়ে যাবে। টুনুর কণ্ঠে অনুরোধের সুর। তুমি বসো। উনি হাত মুখ ধুয়ে আসুন। তারপর গল্প করবে। চুলোটা খালি যাচ্ছে। আমি তরকারিটা তুলে দিয়ে আসি।

হাত মুখ ধুয়ে টুনুর স্বামীও ততক্ষণে ফিরে এসেছে আবার। লজ্জা আর সঙ্কোচের ভাবটা তখনো কাটেনি। একখানা ছেঁড়া গামছায় হাত মুছতে মুছতে কাছে এগিয়ে এসে হঠাৎ সে বললো, মাসে পঞ্চাশ টাকা বেতনে সংসার চলে না। তাতো বোঝেনই। অফিস ছুটির পর অগত্যা তাই রাতে রিক্সা চালাই। বলতে বলতে হঠাৎ আমার হাতজোড়া আপন মুঠোর মধ্যে তুলে নিলো ও, তারপর চারদিকে সতর্কভাবে তাকিয়ে নিয়ে ধরা গলায় বললো, দোহাই আপনার সালাম সাহেব। ও কথাটা বলবেন না টুনুকে। প্রেসটিজ জ্ঞান বড় টনটনে ওর। জানতে পারলে কেলেঙ্কারি কিছু একটা ঘটিয়ে বসবে। দোহাই আপনার—।

Leave a Reply