» » মহামৃত্যু

বর্ণাকার

লাশটাকে ধরাধরি করে উঠোন থেকে ঘরে নিয়ে এলো ওরা।

তারপর আস্তে শুইয়ে দিলো মেঝের উপর।

 

বাইরে তখন সন্ধ্যার আস্তরণে কালো রাত নেমে এসেছে ঘন হয়ে। শিয়রে দুটো মোমবাতি জ্বেলে দিয়ে চক্রাকারে বসলো ওরা, লাশটাকে ঘিরে। কারো মুখে কথা নেই, সবাই চুপচাপ। কাঁপা হাতে ওর রক্তভেজা বুক পকেট থেকে একটা খাম বের করে আনলো শমসের আলী, একখানা চিঠি, আর একখানা ফটো।

কার ফটো ওটা? কাঁধের উপর দিয়ে মুখ গলিয়ে চাপা স্বরে জিজ্ঞেস করলো রহমান, কার ফটো?

ওর ভাবী বধূর, আস্তে করে বললো শমসের আলী, এ মেয়েটার সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়েছিল ওর, আসছে বৈশাখে—।

ওটা রেখে দাও, বুক পকেটেই রেখে দাও ওটা। কে যেন বললো আশ্চর্য মৃদু গলায়। খবরটা ছড়িয়ে পড়েছিলো সারা পাড়ায়। আর দলে বেঁধে ওকে দেখতে আসছিলো সবাই। দোরগোড়ায় জুতোগুলো নিঃশব্দে খুলে রেখে ভেতরে ঢুকছিলো ওরা, যেন দেব দর্শনে এসেছে। দুটো মেয়ে এসে নীরবে বসলো ওঁর পায়ের কাছে।

আর একজন বসলো শিয়রের পাশে।

বুড়ো সুরেন উকিলের ছোট মেয়েটা হঠাৎ তার কানে আঙ্গুলটা কেটে রক্ত তিলক বসিয়ে দিলো ওপর পাণ্ডুর কপালে।

বাকি দু’জন পরম স্নেহভরে চুলের প্রান্তভাগ দিয়ে মুছে দিলো ওর পায়ের ধুলোগুলো। আর সবাই নির্বাক নিস্পন্দন।

ধূপদানিতে ধূপ জ্বলছে মৃদু। ক্ষয়ে আসা মোমবাতি দুটোর জায়গায় আরো দুটো মোমবাতি জ্বেলে দিলো শমসের আলী।

বুড়ো সগির মিয়া ঈশারায় বাইরে ডেকে নিয়ে গেল রহমানকে।

কবর দেবার কোন বন্দোবস্ত কিছু হয়েছে?

হচ্ছে।

গোরস্তানে কখন নিয়ে যাবে ওকে?

ভোরে।

কাপড় চোপড় কেনা হয়েছে?

না।

তবে, এই নাও, টাকা নাও, কাপড় কেনার জন্য পকেট থেকে পাঁচটে টাকা বের করে দিলো সগির মিয়া।

সুরেন উকিল দিলো আরও পাঁচটে টাকা।

ঝগড়াটে পল্টুর মা, হাড়কেঞ্জন বলে যার পাড়াময় খ্যাতি, সেও দুটো টাকা গুঁজে দিলো রহমানের হাতে।

ট্যাক্সি ড্রাইভার ফজল শেখ উজার করে দিলো ওর সারা দিনের পুরো রোজগারটা।

রহমান বললো, এত টাকা দিয়ে কি হবে?

ফজল শেখ বললো, ওর জন্য ভালো দেখে একটা কাপড় কিনো। দেখো, মিহি হয় যেন, বলতে গিয়ে গলাটা ধরে এলো এর।

আর দেখো, আতর আর কর্পূর একটু বেশি পরিমাণে কেনা হয় যেন। চোখ দুটো পানিতে ছলছল করে উঠলো সগির মিয়ার।

কিইবা সামর্থ্য আছে আমাদের। আমরা কিইবা করতে পারি ওর জন্য। ঘর আর বাহির।

বাহির আর ঘর।

সারা রাত এক লহমার জন্যও ঘুমালো না ওরা।

ঘুম এলো না ওদের, রাত জেগে বসে বসে হয়ত গত বিকেলটার কথাই ভাবছিলো ওরা।

 

অস্তগামী সূর্যের তির্যক আভায় আকাশের সাদা টুকরো টুকরো মেঘগুলো রক্তবর্ণ ধারণ করেছিলো তখন। কাঠের লম্বা বারান্দাটার এপ্রান্তে দাঁড়িয়ে বুড়ি দাদী তার বার বছরের নাতনীকে সে মেঘগুলো দেখাচ্ছিল আর বলছিলো, ও মেঘগুলো লাল কেন জান? ও- মা জান না বুঝি? তা জানবে কেন। আজকালকার মেয়ে কিনা; ধর্মকথাতো পড়ওনি; শোনও না । হোসেন কে চেন? হজরত আলীর ছেলে হোসেন। এজিদ তাঁকে অন্যায়ভাবে খুন করেছিলো কারবালায়, বড় কষ্ট দিয়ে খুন করেছিলো তাঁকে। সেই হোসেনের পাক রক্ত, রোজ বিকেলে জমাট বেঁধে দেখা দেয় পশ্চিমাকাশে বুঝলে?

নিচে, কলতলায় তখন পানি নিয়ে কাড়াকাড়ি করছিলো গুটি আটেক মেয়েমানুষ। পল্টুর মা তার মোটাসোটা দেহটা দেখিয়ে বারবার শাসাচ্ছিলো বাকি সবাইকে। আর আপন মনে বকবক করছিলো একটানা।

দোতলার কোণের ঘরে অফিস ফেরত বাবুরা তাস নিয়ে বসেছিলো সবে। পাশের ঘরে টেকো মাথা রহমানটা রোগা লিকলিকে বৌটাকে মারছিলো তখন। রোজ যেমনটি মারে।

সামনের বাড়ির বুড়ো উকিলের তম্বী মেয়েটা সেতারে ইমন কল্যাণের সুর ছড়াচ্ছিলো মৃদু।

বেশ কাটছিলো বিকেলটা।

রোজ যেমনটি কাটে।

ছেদ পড়লো অকস্মাৎ।

পশ্চিমমুখো লম্বা দোতালা বাড়ির বাসিন্দাদের চমকে দিয়ে সদর দরজা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলো একটা লোক। পেছনে আরো তিনজন। কাকে যেন ধরাধরি করে এনে নিঃশব্দে উঠোনে নামিয়ে রাখলো ওরা।

পাংশু মুখ; বাকহীন।

কলগোড়ায় যারা দাঁড়িয়েছিল, তারাই আর্তনাদ করে উঠলো সবার আগে। আ-হা-হা কার ছেলেগো! কার ছেলে এমন করে খুন হলো। আ-হা-হা কার ছেলেগো!

কোন মায়ের বুক খালি হলো গো। কার ছেলে খুন হলো!

ঝগড়াটে পল্টুর মা এক পা দু পা করে এগিয়ে এলো সামনে। কেমন করে মরলো গো ছেলেটা; আঁ? কেমন করে মরলো? লোকগুলো তখনো চুপচাপ।

দোতলায় যারা ছিলো তারাও ততক্ষণে নেমে এসেছে নিচে।

মৃত লোকটাকে ঘিরে তখন একটা ছোটখাট জটলা বেঁধে গেছে উঠোনে। রক্তাক্ত মৃতদেহটার ওপর ঝুঁকে পড়ে হঠাৎ চাপা আর্তনাদ করে উঠলো এল, ডি, ক্লার্ক শমসের আলী। হায় খোদা, একি করলে, এ যে আমাদের নূরুর ছেলে শহীদ।— কেমন করে মরলো?

কি যেন বলতে গিয়েও বলতে পারলো না লোকগুলো।

টিকো মাথা রহমান বললো, আরে— তাইতো এ যে দেখছি শহীদ, আপনার রুমেইতো থাকতো ও শমসের সাহেব। তাই না?

হাঁ, ও আমার রুমেই থাকতো। আস্তে বললো শমসের আলী। তার আবার ওকে বয়ে নিয়ে আসা লোকগুলোর দিকে মুখ তুলে তাকালো সে। এ যে রক্তে চপচপ করছে। কেমন করে মরলো?

চারজন লোকের একজন গিয়ে সদর দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে এলো আস্তে। ফিরে এসে চাপা গলায় ফিসফিস করে কি যেন বললো সে সবাইকে।

সে কি? চাপা আর্তনাদ কান্নার মত শোনা গেলো একসাথে আঁতকে উঠলো দোতলা বাড়ির বাসিন্দারা। সে কি?

ট্যাক্সি ড্রাইভার ফজল শেখ বললো সে কি, কে গুলি করতে গেল ওকে। কেন গুলি করলো?

আবার এজিদ নাজেল হলো নাতো দুনিয়ার ওপর? বুড়ি দাদী বিড়বিড় করে উঠলো।

তারপর এক সীমাহীন নিস্তব্ধতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়লো সবাই। ফেকাশে বিবর্ণ চোখগুলো তুলে পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলো ওরা। তারপর আবার তাকালো মাটিতে। শোয়ান রক্তলাল মৃতদেহটার দিকে।

কালো, মুখচোরা ছেলেটা বছর খানেকের উপর থেকেই ছিলো এ বাড়িতে। থাকতো। খেতোঁ। কলেজে যেতো।

কই, কোনদিনও তো চোখে পড়েনি কারো।

পড়বেই বা কেমন করে। বাহাত্তর গেরস্তের বাড়িতে কত লোক আসে, কত লোক যায়। কে কার খোঁজ রাখে। সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে সব সময়। কিন্তু, অকস্মাৎ আজ সবাই এক অদ্ভূত একাত্মতা অনুভব করলো ওই ছেলেটার সাথে। বেদনার্ত চোখ তুলে সবাই তাকালো ওর দিকে।

সারারাত তাকালো ওরা।

ভোরে গরম পানিতে ওর লাশটাকে ধুইয়ে যখন খাটের ওপর শোয়ান হলো, তখন সারা উঠোনটা গিজগিজ করছে লোকে।

পাড়ার ছেলেরা একটা লম্বা বাঁশের ডগায় পতাকার মতো ঝুলিয়ে নিয়েছে ওর রক্তে ভেজা জামাটা ৷ ওটা ওরা বয়ে নেবে শবযাত্রার পুরোভাগে। বুড়ো সগির মিয়া বলছিলো, ওকে আমরা গোরস্তান পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারবো কিনা আমার সন্দেহ হচ্ছে। বড় রাস্তায় ট্রাকভর্তি মিলিটারি আর পুলিশ দেখে এলাম। মাঝ পথে হয়তো ছিনিয়ে নেবে ওরা।

আমরা দেবো কেন? দৃঢ়কণ্ঠে বলে উঠলো ছেলেরা।

মা নেই, বাবা নেই, ভাই-বোন কেউ এখানে নেই ওর।

মা বাবা হয়ত ভাবছেন ছেলে তাদের নিরাপদেই পড়ালেখা করছে এখন। গ্রীষ্মের বন্ধে বাড়ি আসবে। কোলের মানিক ফিরে আসবে কোলে। শেষ দর্শনের জন্য মুখের বাঁধনটা খুলে দেয়া হলো ওর।

পল্টুর মা, ঝুঁকে পড়ে চুমো খেলো ওর কপালে। তারপর চোখে আঁচল চেপে সরে দাঁড়ালো এক পাশে।

বুড়ি বিড়বিড় করে বললো। হায় খোদা, এজিদের গোষ্ঠি বুঝি এখনও দুনিয়ার ওপর রেখে দিয়েছ তুমি। হায় খোদা!

আহা মা যখন মউতের কথা শুনবে— তখন কি অবস্থা হবে মা’র। বললো আর একজন।

মৃতের খাটটা কাঁধে তোলা নিয়ে কাড়াকাড়ি হলো কিছুক্ষণ।

ছেলেরা বললো, আমরা নেবো।

বুড়োরা বললো, আমরা।

শেষে রফা হলো। ঠিক হলো মিনিট দশেকের বেশি কেউ রাখতে পারবে না। শ’খানেক লোক পাড়ার। সবাইকে সুযোগ দিতে হবে তো!

খাটে শোয়ান শহীদকে নিয়ে যখন রাস্তায় নামলো ওরা। সূর্য তখন বেশ খানিকটা উঠে গেছে উপরে।

সবার সামনে বাঁশের ডগায় ঝোলান রক্তাক্ত জামা হাতে সুরেন উকিলের ছোট মেয়ে শিবানী। তার দু’পাশে হোসেন ডাক্তারের দুই নাতনী। রানু আর সুফিয়া। ওদের যেতে নিষেধ করছিলো অনেকেই। তবু জিদ ধরেছে ওরা— ওরা যাবেই।

যাক। যেতে চাইছে যখন যাক না, কি আছে। বলেছিলেন বুড়ো সগির মিয়া।

মিছিলটা তখন ধীরে ধীরে এগুচ্ছিল সরু গলি বেয়ে।

আর গলির দু’পাশের জানালা, ছাদ আর বারান্দা থেকে মেয়েরা-মায়েরা দু’হাতে কোঁচড় ভরা ফুল ছুঁড়ে মারছিলো ওর খাটিয়া লক্ষ্য করে। চামেলি। গোলাপ। রজনীগন্ধা।

ফুল আর গোলাপজল।

গোলাপজল আর ফুল।

ফুলে ফুলে আগাগোড়া ঢেকে গেলো শহীদ। ফুলের নিচে ডুবে গেলো ওর লাশটা। দোতলা বাড়ির সংকীর্ণ বারান্দা থেকে ফুল ছুঁড়ে মারতে মারতে আশ্চর্য মৃদু গলায় কে যেন বললো, আমাদের ভাষাকে বাঁচাবার জন্য প্রাণ দিয়েছে ও।

আমাদের জন্য প্রাণ দিয়েছে। বললো আর একজন।

কথাটা কানে আসতেই বোধ হয়; অকস্মাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো এল, ডি, ক্লার্ক শমসের আলী। দু’চোখে অশ্রুর বান ডাকলো ওর।

ছি, শমসের ভাই কাঁদছো কেন। এ সময় কাঁদতে নেই। মৃদু তিরস্কার করলো ওকে ফজল শেখ।

ওর কানের কাছে মুখ এনে চাপা স্বরে শমসের আলী বললো, বড় হিংসে হচ্ছে— বড় হিংসে হচ্ছে, ফজলুরে আমি কেন ওর মত মরতে পারলাম না।

Leave a Reply