» » বীরাঙ্গনা, পরাক্রমে ভীমা-সমা

বর্ণাকার

হেমেন্দ্রকুমার রায়

ঐতিহাসিক সমগ্র

বীরাঙ্গনা, পরাক্রমে ভীমা-সমা

রণরঙ্গে বীরাঙ্গনা সাজিল কৌতুকে;—

উথলিল চারিদিকে দুন্দুভির ধ্বনি;

বাহিরিল বামাদল বীরমদে মাতি,

উলঙ্গিয়া অসিরাশি, কার্মুক টংকারি,

আস্ফালি ফলকপুঞ্জে।

 —মাইকেল মধুসূদন

বীরাঙ্গনা, পরাক্রমে ভীমা-সমা : এক

দেশে দেশে রণরঙ্গিণী রমণীর কাহিনি শোনা যায়,—কেবল কল্পিত গল্পে নয়, সত্যিকার ইতিহাসেও। চলতি কথায় এমন মেয়েকে বলা হয় ‘রায়বাঘিনী’।

ভারতের রানী লক্ষ্মীবাঈ, রানী দুর্গাবতী, চাঁদ সুলতানা, ইংল্যান্ডের রোডিসিয়া ও ফ্রান্সের জোয়ান অব আর্ক প্রভৃতি রণরঙ্গিণী বীরনারীর কথা কে না শুনেছে?

কথিত হয়, সেকালের কাপ্পাডোসিয়ার বীরাঙ্গনারা বাস করত নারীরাজ্যে—যেখানে পুরুষের প্রবেশ ছিল নিষিদ্ধ! পুরুষদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে কোনওদিনই তারা পিছপাও হয়নি। আধুনিক নিউগিনিতেও এমন দেশের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। মাঝে মাঝে তারা আবার বাইরে হানা দিয়ে পুরুষ দেখলেই বন্দি করে নিয়ে যায়। একালের স্পেন, রুশিয়া ও চিন প্রভৃতি দেশে হাজার হাজার নারী-যোদ্ধার দেখা পাওয়া যায়। এবং এই অতি-আধুনিক যুগেও তিব্বতে শ্রীমতী রিপিয়েডোর্জেস প্রায় এক হাজার রণমুখো নারী-যোদ্ধা নিয়ে কমিউনিস্ট চিনের বিরুদ্ধে প্রবল বিক্রমে যুদ্ধে নিযুক্ত আছেন।

কিন্তু আর এক শ্রেণির বীরনারীদের কথা নিয়ে বড় বড় ঐতিহাসিকরা মাথা ঘামান না এবং তার কারণ বোধ হয় তাঁরা হচ্ছেন কালো আফ্রিকার কাজলা মেয়ে।

এঁদের প্রধানার নাম নান্সিকা। আজ এঁরই রক্তাক্ত কাহিনি বর্ণনা করব। কিন্তু তার আগে গুটিকয় গোড়ার কথা বলতে হবে।

প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে জনৈক পাশ্চাত্য লেখক The Rising Tide of colour নামক পুস্তকে সভয়ে এই মর্মে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন : ‘শ্বেতাঙ্গরা এখনও আন্দাজ করতে পারছে না, অশ্বেত জাতিরা (পীত, তাম্র ও কৃষ্ণ বর্ণের) ক্রমেই অধিকতর শক্তিশালী হয়ে শ্বেতাঙ্গদের নাগালের বাইরে চলে যাবে। অবিলম্বে তাঁদের সাবধান না হলে চলবে না।’

তারপর গত এক যুগের মধ্যেই তাঁর ভবিষ্যদবাণী সফল হয়েছে—গৌরাঙ্গরা সাবধান হয়েও পীতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গদের ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি।

প্রায় সমগ্র এশিয়া থেকেই তাম্র ও পীত বর্ণের প্রভাবে শ্বেতবর্ণ বিলুপ্তপ্রায় হয়েছে এবং তারপর বেঁকে দাঁড়িয়েছে এতকালের পশ্চাৎপদ আফ্রিকাও। একে একে শ্বেতাঙ্গদের বেড়ি ভেঙে স্বাধীন হয়েছে মিশর, সুদান, মরক্কো, ঘানা ও কঙ্গো প্রভৃতি আরও কয়েকটি প্রদেশ এবং আরও কোনও কোনও দেশ প্রস্তুত হয়ে আছে স্বাধীনতা অর্জনের জন্যে কিংবা ইতিমধ্যেই স্বায়ত্তশাসনের অধিকার লাভ করেছে।

সদ্য-স্বাধীন ঘানার প্রতিবেশী ডাহোমি। পশ্চিম আফ্রিকার টোগোল্যান্ড ও নাইজিরিয়ার মধ্যবর্তী আটলান্টিক সাগর-বিধৌত তটপ্রদেশে আটত্রিশ হাজার বর্গমাইল জায়গা জুড়ে ডাহোমির অবস্থান। তার লোকসংখ্যা প্রায় দশ লক্ষ। গত শতাব্দীর শেষভাগে ফরাসি দস্যুরা হানা দিয়ে ডাহোমির স্বাধীনতা হরণ করেছিল, কিন্তু সম্প্রতি কর্তার চেয়ার ছেড়ে আবার তাদের দর্শকের গ্যালারিতে সরে দাঁড়াতে হয়েছে।