হেমেন্দ্রকুমার রায়
ঐতিহাসিক সমগ্র
বর্গি এল দেশে : এক
‘খোকা ঘুমুলো, পাড়া জুড়ুলো
বর্গী এল দেশে’—
আমাদের ছেলেভুলানো ছড়ার একটি পঙক্তি।
মনে করুন, বাংলাদেশের শান্ত স্নিগ্ধ পল্লিগ্রাম। দুপুরবেলা, চারিদিক নিরালা। শ্যামসুন্দর পল্লিপ্রকৃতি রৌদ্রপীত আলো মেখে করছে ঝলমল ঝলমল। বাতাসে কোথা থেকে ভেসে আসছে বনকপোতের অলস কণ্ঠস্বর।
চুকে গিয়েছে গৃহস্থালির কাজকর্ম। মাটিতে শীতলপাটি বিছিয়ে খোকাকে নিয়ে বিশ্রাম করতে এসেছেন ঘুম ঘুম চোখে খোকার মা। কিন্তু ঘুমোবার ইচ্ছা নেই খোকাবাবুর। বিদ্রোহী হয়ে তারস্বরে তিনি জুড়ে দিলেন এমন জোর কান্না যে, ঘুম ছুটে যায় পল্লির এ-বাড়ির ও-বাড়ির সকলের চোখে, ছিঁড়ে যায় বনকপোতের শান্তিগান, তরুলতার কলতান, সচকিত হয়ে উঠে নির্জন পথের তন্দ্রাস্তব্ধতা।
ঘুমপাড়ানি সঙ্গীতের তালে তালে খোকার মাথা আর গা চাপড়ে চলেন খোকার মা। সেই আদর-মাখা নরম হাতের ছোঁয়ায় খানিক পরে খোকাবাবুর চোখের পাতা জড়িয়ে এল ঘুমের ঘোরে, ধীরে ধীরে। অবশেষে মৌন হল ক্রন্দনভরা কণ্ঠস্বর।
পাড়া গেল জুড়িয়ে।
আচম্বিতে অগাধ স্তব্ধতার নিদ্রাভঙ্গ করে দিকে দিকে জেগে উঠল অত্যন্ত আতঙ্কিত জনতার গগনভেদী আর্ত চিৎকার!
পথে পথে পাড়ায় পাড়ায় ভীত উচ্চরব শোনা গেল—’পালাও, পালাও! এল রে ওই বর্গি এল! সবাই পালাও, বর্গি এল!’
ধূলিপটলে দিগবিদিক অন্ধকার। উল্কাবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে ধেয়ে আসে হাজার অশ্বারোহী—ঊর্ধ্বোত্থিত হস্তে তাদের শাণিত কৃপাণ, বিস্ফারিত চক্ষে নিষ্ঠুর হিংসা, কর্কশ কণ্ঠে ভৈরব হুংকার!
বর্গি এল দেশে—ঘরে ঘরে হানা দিতে, গৃহস্থের সর্বস্ব লুঠতে, গ্রামে গ্রামে আগুন জ্বালাতে, পথে পথে রক্তস্রোত ছোটাতে, আবালবৃদ্ধবনিতার প্রাণ হরণ করতে!
পাড়ায় পাড়ায় ঘরে ঘরে ধড়মড় করে উঠে বসল আবার ঘুমভাঙা খোকাখুকিরা। কিন্তু আর শোনা গেল না তাদের কান্না, বনকপোতের ঘুমপাড়ানি সুর এবং তরুলতার মর্মররাগিণী।
এমনি ব্যাপার হয়েছে বারংবার। তখন অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি কাল। বাংলার মাটিতে ইংরেজরা শিকড় গাড়বার চেষ্টা করছে ছলে বলে কৌশলে।
‘বর্গি’ বলতে কী বোঝায়?
আভিধানিক অর্থানুসারে যার ‘বর্গ’ আছে সে-ই হল ‘বর্গি’। ‘বর্গে’র একটি অর্থ ‘দল’। যারা দল বেঁধে আক্রমণ করত তাদেরই বর্গি বলে ডাকা হত।
ইতিহাসেও ‘বর্গি’ বলতে ঠিক ওই কথাই বুঝায় না। ‘বর্গি’ নাকি ‘বারগীর’ শব্দের অপভ্রংশ। মহারাষ্ট্রীয় ফৌজে যে-সব উচ্চ শ্রেণির সওয়ার ছিল নিজেদের ঘোড়ার ও সাজপোশাকের অধিকারী, তাদের নাম ‘সিলাদার’। কিন্তু ‘বারগীর’ বলতে বোঝায় সবচেয়ে নিম্নশ্রেণির সওয়ারদের। তারা অস্ত্রশস্ত্র ও অশ্ব লাভ করত রাজ-সরকার থেকেই।
প্রাচীনকালে অনার্য হুনজাতীয় ঘোড়সওয়াররা দলে দলে পূর্ব-ইউরোপে এবং উত্তর-ভারতে প্রবেশ করে দিকে দিকে লুণ্ঠন ও হত্যাকাণ্ড চালিয়ে ইতিহাসে ভয়াল নাম অর্জন করেছিল। বর্গিরাও সেই জাতীয় হানাদার; তবে তাদের অত্যাচার অতটা ব্যাপক হয়নি, ‘বর্গির হাঙ্গামা’ হচ্ছে বিশেষভাবে বাংলাদেশেরই ব্যাপার।
সত্য কথা বললে বলতে হয়, পরবর্তীকালের বর্গির হাঙ্গামার জন্যে এক হিসাবে দায়ী হচ্ছেন ভারতগৌরব ছত্রপতি শিবাজীই। প্রধানত লুণ্ঠনের দ্বারাই তিনি নিজের সৈন্যদল পোষণ করতেন। তিনি স্বয়ং উপস্থিত থেকে সদলবলে লুণ্ঠনকার্য চালিয়েছেন দক্ষিণ-ভারতের নানা স্থানেই; তার ফলে কেবল মুসলমান নয়, কত সাধারণ নিরীহ হিন্দুও যে নির্যাতিত হয়েছিল, ইতিহাসে তার সাক্ষ্য আছে। তখনকার মারাঠিরাও জানত, লুণ্ঠনই হচ্ছে সৈনিকের অন্যতম কর্তব্য।
আরম্ভেই যেখানে নৈতিক আদর্শ এমনভাবে ক্ষুণ্ণ হয়, পরবর্তীকালে তা উন্নত না হয়ে অধিকতর অবনমিত হয়ে পড়বারই কথা। এক্ষেত্রেও হয়েছিল ঠিক তাই। শিবাজীর কালের মারাঠি সৈনিকদের চেয়ে বর্গিরা হয়ে উঠেছিল আরও বেশি নিষ্ঠুর, হিংস্র ও দুরাচার।
কম-বেশি এক শতাব্দীর মধ্যে মোগলদের শাসনকালে হতভাগ্য বাংলাদেশকে দু-দুবার ভোগ করতে হয়েছিল ভয়াবহ নির্যাতন।
সপ্তদশ শতাব্দীতে ফিরিঙ্গি ও মগ বোম্বেটেদের ধারাবাহিক অত্যাচারের ফলে নদীবহুল দক্ষিণ ও পূর্ব-বাংলার কতক অংশ জনশূন্য শ্মশানে পরিণত হয়েছিল বললেও অত্যুক্তি হবে না। সুন্দরবন অঞ্চলে আগে ছিল সমৃদ্ধিশালী জনপদ, পরে তা পরিণত হয়েছিল হিংস্র জন্তুর জঙ্গলাকীর্ণ বিচরণ ভূমিতে এবং পূর্ববঙ্গের কোনও কোনও অঞ্চলে নাকি আকাশ দিয়ে পাখি পর্যন্ত উড়তে ভরসা করত না।
এমনি সব অরাজকতার জন্যে দায়ী কোনও কোনও লোককে ইতিহাস মনে করে রেখেছে। যেমন পোর্তুগিজদের গঞ্জেলেস ও কার্ভালহো এবং মারাঠিদের ভাস্কর পণ্ডিত। শক্তির অপব্যবহার না করলে এঁদেরও স্মৃতি আজ গরীয়ান হয়ে থাকত।
পোর্তুগিজ বোম্বেটেরা বিজাতীয় বিদেশি। তারা মানবতার ধর্ম ক্ষুণ্ণ করেছিল বটে, কিন্তু স্বজাতির উপরে অত্যাচার করেনি। আর মারাঠি হানাদার বা বর্গিরা ভারতের বাসিন্দা হয়েও ভারতবাসীকে অব্যাহতি দেয়নি, তাই তাদের অপরাধ হয়ে উঠেছে অধিকতর নিন্দনীয়।