ছটফট করছে রানা খাঁচায় বন্দি বাঘের মত।
নিরাশ হয়ে ফিরে আসতে হয়েছে ওকে। একটি প্রাণীরও চিহ্ন পাওয়া যায়নি ফিশ এমপোরিয়ামে। সব পালিয়েছে। অ্যাকুয়েরিয়াম আছে, মাছও আছে। যেমন ছিল ঠিক তেমনি। শুধু মানুষগুলো সব ভোজবাজির মত, অদৃশ্য হয়ে গেছে। প্রত্যেকটা ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজেও কিছুই পাওয়া যায়নি। পাহারা বসিয়ে দিয়ে রাত দুটোর সময় ফিরে এসেছে রানা হোটেলে।
এখন কিছুই করার নেই ওর, সব রকম খবরাখবর নেয়া হয়েছে ওয়ালী আহমেদের সম্পর্কে, সব রকম সম্ভাব্য জায়গায় খোঁজা হচ্ছে তাকে। রাওয়ালপিণ্ডিতে বেতারে খবর চলে গেছে। ওয়ালী আহমেদের ছদ্মবেশী অনুচরকে (যে পিআইএ করে সন্ধ্যার ফ্লাইটে রওনা হয়েছিল) সম্ভব হলে গ্রেপ্তার করার জন্যে।
কিন্তু বুঝতে পারছে রানা, আজই এক্ষুণি যদি ওয়ালী আহমেদের ওপর চরম আঘাত হানতে পারা না যায় তা হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে জিনাতের। কিন্তু কোথায় আঘাত করবে? শক্রর চিহ্নই তো নেই যে মোকাবেলা করবে। হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে যেন সবাই ভোজবাজির মত। জিনাত আর মোহাম্মদ জানেরও কোনও খবর নেই।
ঘরের মধ্যে বহুক্ষণ পায়চারি করল রানা। এই নিরুপায় অবস্থায় নিষ্ফল আক্রোশে গজরাতে থাকল ও। সব রাগ কেন জানি গিয়ে পড়ল নিজেরই ওপর। ও-ই এদেরকে টেনে এনেছে এই বিপদের মধ্যে। কেন ও পারছে না? কেন ও পারছে না জিনাতকে রক্ষা করতে, মোহাম্মদ জানকে মুক্ত করে আনতে? ওর জন্যেই তো আজ এদের এই অবস্থা।
ঘণ্টাখানেক এভাবে পায়চারি করার পর স্থির হলো রানা অনেকখানি। ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াল। জোর হাওয়া আসছে সাগর থেকে। সমুদ্রের শোঁ শো একটানা আওয়াজে জিনাতের কান্না।
রানা বুঝল, যা হবার হয়ে গেছে। এখন আপাতত ওর নিজের পরিশ্রান্ত দেহটাকে বিশ্রাম দেয়া ছাড়া আর কিছুই করবার নেই। কাল নব উদ্যমে এগোতে হবে নতুন পথে। বিশ্রামটা প্রয়োজন। এরকম অস্থির ভাবে সারারাত পায়চারি করে বেড়ালে নিজেকে আরও দুর্বল করে ফেলা ছাড়া আর কোনও লাভ হচ্ছে না।
ঘরে এসে দুটো স্লীপিং পিল খেয়ে নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল রানা বাতি নিভিয়ে। অনেকক্ষণ ছটফট করল বিছানায় শুয়ে, এপাশ-ওপাশ ফিরল কমপক্ষে পঞ্চাশবার। ধীরে ধীরে ঝিমিয়ে পড়ল ও। পাতলা একটা তন্দ্রার ঘোর নামল দুচোখে।
ভয়ঙ্কর একটা দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙল রানার। রিস্টওয়াচে দেখল পাঁচটা বাজে। সারা শরীর ঘেমে নেয়ে উঠেছে। টিপয়ের ওপর রাখা কাঁচের জার থেকে ঢেলে একগ্লাস ঠাণ্ডা পানি খেল ও। স্বপ্নের ঘোরটা কাটেনি।
ভাবল, ওয়ালী আহমেদের কথাগুলো অতিরিক্ত রেখাপাত করেছিল মনের ওপর, তাই বোধহয় এ দুঃস্বপ্নটা দেখল ও। স্বপ্নের ঘটনাস্থল হচ্ছে ‘রেপ চেম্বার’। কিন্তু ফিশ এমপোরিয়ামের সমস্ত চেম্বারই এখন মিলিটারির দখলে। কাজেই ঘটনাটা তাড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করল ও মন থেকে। আবার ভাবল, ওই ঘরটা ও দেখেছে বলে ওটারই স্বপ্ন দেখেছে। কিন্তু করাচি শহরের অন্য যে কোনও একটা ঘরে ঘটনাটা ঘটা কি একেবারেই অসম্ভব?
উঠে বসল রানা বিছানার ওপর। ভোর রাতের স্বপ্ন নাকি ফলে। এতদিন কথাটা হেসে উড়িয়ে দিলেও আজ কেন জানি রানার মনটা এই কুসংস্কারের প্রতি বিদ্রূপ করতে পারল না।
দর্শকের গ্যালারিতে বসে আছে ওয়ালী আহমেদ। তার পাশে যেখানে রানার বসবার কথা ছিল সেখানে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় বসানো হয়েছে মোহাম্মদ জানকে।
‘আব্বাজি! তুমি এদিকে চেয়ো না, আব্বাজি!’ ফুঁপিয়ে উঠল জিনাত।
এবার স্পষ্ট দেখতে পেল রানা জিনাতকে। শাড়ি ব্লাউজ ছিঁড়ে কুটি কুটি করে ফেলে দেয়া হয়েছে মাটিতে। চুলের মুঠি ধরে দড়াম করে আছড়ে ফেলল গুংগা ওকে বিছানার ওপর।
‘সাবাস!’ চেঁচিয়ে উঠল ওয়ালী আহমেদ।
ল্যাংগোঠ খুলে ফেলেছে গুংগা। ঝাঁপিয়ে পড়ল সে বিছানায়। তীক্ষ্ণ একটা আর্তনাদ বেরিয়ে এল জিনাতের মুখ থেকে। স্পষ্ট শুনতে পেল রানা সেই তীক্ষ্ণ গগনভেদী অমানুষিক চিৎকার। রক্তে ভেসে গেছে বিছানার সাদা চাদর।
এরপর সিনেমার ক্লোজ-আপের মত চারটে মুখ ভেসে উঠল রানার চোখের সামনে। কুঁচকে বিকৃত হয়ে গেছে জিনাতের মুখ, দাঁতে দাঁত চেপে দুই ঠোঁট ফাঁক করে রেখেছে সে। নীল হয়ে গেছে মুখটা বেদনায়। গুংগার মুখে পৈশাচিক কামোন্মত্ততা। ঘড়ঘড় করে শব্দ বেরোচ্ছে ওর গলা দিয়ে। মাথাটা নীচের দিকে ঝুলে পড়েছে মোহাম্মদ জানের। দাঁত দিয়ে নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরেছে সে। আর লালসা ঠিকরে বেরুচ্ছে ওয়ালী আহমেদের দুই চোখ থেকে। সমস্ত সত্তা দিয়ে উপভোগ করছে সে দৃশ্যটা।
আবার একটা তীক্ষ্ণ দীর্ঘস্থায়ী চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেছে রানার। জেগে উঠেও কিছুক্ষণ শুনতে পেয়েছে রানা সে চিৎকার। একটু পরেই ভুল ভাঙল। দূর থেকে ভেসে আসছে জাহাজের বাঁশি।
কিন্তু জিনাতের বেদনা-কাতর মুখটা কিছুতেই ভুলতে পারল না ও। উঠে গিয়ে বাথরুম থেকে চোখে-মুখে পানি ছিটিয়ে এসে আবার বিছানায় উঠতে যাবে, এমন সময় খুট করে দরজায় শব্দ হলো একটা।
মনের ভুল ভেবে শুয়ে পড়তে যাচ্ছিল, কিন্তু আবার খুট করে শব্দ হতেই লাফিয়ে উঠে বসল রানা। না, মনের ভুল নয়। রিভলভারটা বের করল ও বালিশের তলা থেকে। করিডোরে কয়েকটা দ্রুত পায়ের শব্দ শোনা গেল। পা টিপে এসে দাঁড়াল ও দরজার পাশে। দশ সেকেণ্ড কান পেতে থেকেও আর কোনও শব্দ শুনতে পেল না ও।
নিঃশব্দে বল্টু খুলে এক ঝটকায় দরজা খুলে বাইরে চাইল ও। হাতে উদ্যত রিভলভার। করিডোরটায় কম পাওয়ারের বালব জ্বলছে। হলদে ম্লান আলো। কই, কেউ তো নেই। মানুষ দেখতে পাবে বলে উঁচুতে চেয়ে ছিল রানা, চোখ নামাতেই দেখতে পেল, জিনিসটা দরজার সামনে রাখা আছে একটা লম্বা কাঠের বাক্স। দুই ফুট বাই এক ফুট ছয় ইঞ্চি—বাই ছয় ফুট সাইজ। ওপরে বড় বড় করে লেখা: GRUNDIG.
বুকের ভেতরটা কেপে উঠল রানার। তবে কি…
দুটো, পেরেক মেরে ডালা আটকানো। ঘরের বাতি জ্বেলে ঠেলে নিয়ে এল রানা বাক্সটা ঘরের ভেতর। ভারী। রক্তের একটা ধারা এল দরজা দিয়ে ঘরের মাঝখান পর্যন্ত। রক্ত কেন? ডালা ধরে টান দিতেই খুলে এল সেটা। ভেতরে চেয়েই চক্ষুস্থির হয়ে গেল রানার। যা ভেবেছিল তাই। ভেতরে শোয়ানো আছে একটা মানুষের দেহ। সারা দেহে ব্যাণ্ডেজ জড়ানো। রক্তে ভেজা লাল। মৃতদেহ কারও? কার? জিনাত, না মোহাম্মদ জান?
খাবলা খাবলা করে সারা মুখের মাংস খাওয়া-চোখের কোটর দেখা যাচ্ছে, চোখ নেই। নাকের সামনের অংশটুকু নেই। একটু নড়ল মনে হলো না?
দেহটা তুলে নিয়ে বিছানায় শোয়াল রানা। খান মোহাম্মদ জান! বুকের ওপর কান রেখে দুর্বল হার্ট বিট শুনতে পেল রানা। কয়েক পরতা ব্যাণ্ডেজ খুলে দেখল সারা দেহই মুখের মত খুবলে খাওয়া। বাঁচানো যাবে না। জ্ঞান আছে কি না দেখার জন্যে ডাকল রানা একবার নাম ধরে।
হঠাৎ নড়ে উঠল খান মোহাম্মদ জানের মুমূর্ষ দেহটা।
‘কে? মেজর?’ দুর্বল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল মোহাম্মদ জান। গলার ভেতর তার আসন্ন মৃত্যুর ঘড়ঘড় শব্দ। এ শব্দ রানা চেনে। এটা মৃত্যুর পূর্ব লক্ষণ।
‘হ্যাঁ! মাসুদ রানা, সর্দার।’ ব্যগ্র কণ্ঠে বলল রানা।
‘তোমার জন্যেই এখনও বেঁচে আছি আমি, রানা। জ্ঞান হারাইনি।’
‘এ অবস্থা কী করে হলো আপনার?’
এই কথার উত্তর দিল না মোহাম্মদ জান। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে শেষ কথা বলার জন্যে শক্তি সঞ্চয় করল। তারপর ফিশফিশ করে বলল। ‘প্রতিশোধ! প্রতিশোধ নিও!’
‘ঠিকানা বলতে পারবেন?’
‘জিনাতকে… জিনাতকে ওরা…’
‘আমি জানি সে কথা। ঠিকানা। ঠিকানাটা বলুন!’ মুখের কাছে কান নিয়ে গেল রানা। কিন্তু কথা আটকে গেল মোহাম্মদ জানের। উত্তর দিতে পারল না। মুখ দিয়ে ভুড়ভুড়ির মত গ্যাঁজলা বেরোল খানিকটা। কেঁপে উঠল শরীরটা দুবার। তারপর স্থির হয়ে গেল। রানা বুঝল, সব শেষ।
টেলিফোন রিসিভারটা তুলে নিল ও। কয়েকবার রিং-হতেই ওপাশে রিসিভার তুলল সাঈদ খান।
‘সাঈদ?’
‘জী, হাঁ।’
‘শিগগির চলে আসুন হোটেলে। আমি রানা বলছি।’
‘এক্ষুণি আসতে হবে?’
‘হ্যাঁ। এক্ষুনি।’
‘কোনও খবর পেলেন? নতুন কিছু?’
‘দুঃসংবাদ আছে। আসুন তারপর বলব।’
আর কোনও কথা না বলে ফোন নামিয়ে রাখল সাঈদ। এবারে আবার সেই ছয় ডিজিটের বিশেষ নাম্বারে ডায়াল করল রানা। মোহাম্মদ জানের খবর দিল। এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবার নির্দেশ দিল। তারপর বিছানার কাছে এসে বসল একটা চেয়ার টেনে নিয়ে।
হঠাৎ চোখে পড়ল রানার কাগজটা। বুকের কাছে ব্যাণ্ডেজের মধ্যে গোঁজা বের করে নিয়ে চোখের সামনে ধরল ও কাগজটা। অর্থহীন দৃষ্টিতে চেয়ে থাকল ওটার দিকে কিছুক্ষণ। বুঝতে পারল না কিছুই। তীব্র উত্তেজনায় এক মুহূর্তের জন্য ব্ল্যাক আউট হলো যেন রানার দৃষ্টি। পরমুহূর্তেই ফুটে উঠল লেখাগুলো স্পষ্ট। ইংরেজিতে টাইপ করা। বাংলা করলে দাঁড়ায়:
মাসুদ রানা,
তোমার জন্যও এই একই দণ্ডাদেশ।
অপেক্ষা করো।
পুনশ্চ:
জিনাত গুংগাকে তৃপ্তি দিয়েছে।
ধক-ধক করে জ্বলল রানার চোখ কয়েক সেকেণ্ড। কঠোর হয়ে গেল মুখের চেহারা। দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে স্থির করবার চেষ্টা করল ও। তারপর খান মোহাম্মদ জানের মৃতদেহের মাথায় রাখল ডান হাত। বলল, ‘প্রতিজ্ঞা করলাম, সর্দার প্রতিশোধ নেব!’
কথাটা বলেই রানা লক্ষ্য করল মোহাম্মদ জানের চুল ভেজা। পিরানহার ট্যাঙ্কে ফেলে হত্যা করা হয়েছে তাকে। কী মনে করে কয়েকটা চুল ছিঁড়ে নিল রানা লাশটার মাথা থেকে। চেটে দেখল, নোনতা। চট করে একটা কথা মনে পড়ল ওর।
ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াল রানা। ফর্সা হয়ে আসছে আকাশটা। সাগর থেকে আসা ঠাণ্ডা জোলো হাওয়া বয়ে আনছে সমুদ্রের কল্লোলধ্বনি। দূর থেকে আবার ভেসে এল জাহাজের বাঁশি—বুকের ভিতর কাঁপন ধরানো করুণ সুর। সাঈদ পৌঁছল প্রথম। ছুটে গেল বিছানার পাশে। দুই হাতে মুখ ঢেকে হু-হুঁ করে কেঁদে উঠল। একটু পরেই সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। শার্টের আস্তিনে চোখ মুছে নিয়ে ফিরল রানার দিকে।
‘চাচার খুনের বদলা নেব আমি।’
‘আমিও।’
স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছে রানা ওর চোখের দিকে। ডান হাতটা বাড়িয়ে দিল সাঈদ। রানাও চেপে ধরল সেই হাত। দুইজন শক্তিশালী পুরুষের মৈত্রী-স্থাপন হলো।
‘আজ সন্ধ্যায় এসো। একা।’
‘আচ্ছা।’
চোখে চোখে কথা হয়ে গেল দুজনের।
এরপর বাকি সব রুটিন মাফিক হয়ে গেল। ডাক্তার পরীক্ষা করে রায় দিল—মৃত। অ্যাম্বুলেন্সে করে লাশ চলে গেল মর্গে। পোস্টমর্টেম হবে। সাঈদ চলে গেল সেই সাথে। ঘর খালি হতেই আবার কাগজের টুকরোটা বের করল রানা। মোহাম্মদ জানের রক্ত লেগে আছে এক কোণে। উল্টোপিঠে আঠা লাগানো মাছের অ্যাকুয়েরিয়ামে লাগাবার লেবেল। বুক পকেটে রেখে দিল ও চিঠিটা। ফরাস এসে চাদর বদলে দিয়ে গেল বিছানার।
বাইরের ঘরে সোফার ওপর হেলান দিয়ে বসে একটা সিগারেট ধরিয়ে চোখ বন্ধ করল রানা। গভীর চিন্তায় ডুবে গেছে ও। ছোট্ট দু’একটা সূত্র ধরে লক্ষ্যস্থলে পৌঁছবার চেষ্টা করছে ও। সমস্ত মনোযোগ একত্রীভূত হওয়ায় দুই ভুরুর মাঝখানে কপাল খানিকটা ফুলে উঠেছে। আঙুলের ফাঁকে সিগারেটটা পুড়তেই থাকল—টানা হলো না একটিবারও! পুড়তে পুড়তে যখন ছোট হয়ে আঙুলে আঁচ লাগল তখন একটা টান দিয়ে ফেলে দিল রানা সেটা অ্যাশট্রেতে। সমাধান হয়ে গেছে সমস্যার।
কয়েকটা জায়গায় টেলিফোন করে কিছু নির্দেশ দিল ও। কিছু খবরও সংগ্রহ করল। সারাদিন ঘর থেকে বেরোল না।
চারটের সময় দুটো থারটি-ও-সিক্স রাইফেল এবং আরও কয়েকটা টুকিটাকি জিনিস পৌঁছে দেয়া হলো রানার কামরায় পাকিস্তান কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের এজেন্ট মারফত, গোপনে। প্রতিটি রাইফেলের জন্য একটা করে পাঁচ-গুলির এক্সট্রা ম্যাগাজিন। মেশিন রেস্টে জিরোয়িং করা আছে রাইফেলগুলো এক্সপার্টের হাতে। একটা টারগেটে পাঁচটা গুলির গ্রুপিং দেখানো আছে—স্লিং-এর সঙ্গে টুইন সুতো দিয়ে বাঁধা। গ্রুপিং দেখে খুশি হলো রানা। টু হানড্রেড ইয়ার্ডসে তিনটে বুলস আই। সোয়া ইঞ্চি গ্রুপিং।
রানার নির্দেশে সাগর পারের একটা গোডাউন খুঁজে বের করেছে সাধু বাবাজি। বিভিন্ন রকমের ব্যবসা আছে এই কোম্পানির। একটা ইয়ট আছে। করাচি-চিটাগাং যাতায়াত করে মাসে একবার করে। হরেক রকম মাল নিয়ে যায় এখান থেকে চিটাগাঙে। সাথে ঝিনুক, শঙ্খ এবং নানান জাতের সৌখিন রঙিন মাছও যায়। আর যায় কলেজ এবং ইউনিভারসিটিতে রিসার্চের জন্যে নানান রকম বিষাক্ত সামুদ্রিক সাপ ও মাছ। ফেরার সময় আদা এবং বেতের কাজ করা কুটির শিল্পের বিভিন্ন শখের জিনিস নিয়ে ফেরে করাচিতে। এ ছাড়া এক্সপোর্টও করে এই কোম্পানি বিরাট স্কেলে। প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি। পুলিশের কোনও খারাপ রিপোর্ট নেই। কাস্টমসেও অল ক্লিয়ার। পরিষ্কার ঝরঝরে ব্যবসা। বছর দুয়েক হলো শুরু করেছে—বেশ জমিয়ে নিয়েছে এরই মধ্যে। ম্যানেজিং ডিরেক্টর নাজির বেগ।
রাইফেল দুটো ভালমত পরীক্ষা করে দেখল রানা বোল্ট, টেনে। সব ঠিক আছে। এখন রাতের অপেক্ষা। একাই যেত ও, কিন্তু সাঈদকে সাথে না নিলে অন্যায় করা হবে ওর প্রতি। ওরও আছে প্রতিশোধ নেবার অধিকার।
গোপনে যেতে হবে। রানা মনে মনে জানে দল নিয়ে গেলেও চলত, কিন্তু তা হলে প্রতিশোধটা নেয়া হয় না। ওদের বুঝিয়েছে মিলিটারি বা পুলিশ মুভমেন্ট টের পেলেই পালিয়ে যাবে সে নাগালের বাইরে। তা ছাড়া মাছের ব্যবসার সঙ্গে সোনা চোরাচালানের সম্পর্ক বের করা যায়নি এখনও। ছোট ছোট মাছ, বড় নয় যে পেটের মধ্যে করে সোনা চালান দেয়া যেতে পারে।
বিকেলে করাচি ব্রাঞ্চ থেকে এল দুজন। রানার বর্তমান কার্যকলাপ আবছা ঠেকছে করাচি অফিসের কাছে। অথচ রানার নিরাপত্তার দায়িত্ব ওদেরই উপর। রানার ভবিষ্যৎ প্ল্যান জানতে চাইল ওরা। এড়িয়ে গেল রানা। কারণ, ঠিক কোন লোকটা বোঝা না গেলেও করাচি অফিসে অন্তত একজন দুমুখো সাপ আছে। তা না হলে এত সহজে রানাকে চিনে বের করা সম্ভব হত না মোহাম্মদ জান বা ওয়ালী আহমেদের পক্ষে।
‘সবকিছু এমন রহস্যাবৃত রাখার কারণ জানতে পারি?’ একজন প্রশ্ন করল।
‘হেড অফিস থেকে সেটা জানতে পারবেন।’
‘এটা কি আমাদের ওপর আপনার কনফিডেন্সের অভাব বলে ধরে নেব?’
‘সেটাও হেড-অফিস থেকেই জানতে পারবেন।’
‘আমাদের চীফ আপনার কার্যকলাপে অত্যন্ত…’
‘দেখুন, উঠে দাঁড়াল রানা সোফা ছেড়ে। আপনার চীফের বিরক্তি বা ঘৃণা যা-ই থাকুক, হেড-অফিসে জানাতে বলবেন। এ কাজের ভার ডিরেক্ট হেড অফিস থেকে পেয়েছি আমি। আপনার হেডের কাছে যে ইস্ট্রাকশন এসেছে সেটা যদি তিনি ভুলে গিয়ে থাকেন তা হলে আবার তাকে ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলবেন। এই কেসে আমি যেটুকু সাহায্য চাইব সেটুকু সাহায্য করতে তিনি বাধ্যতার; বেশি কৈফিয়ত চাওয়া তো দূরের কথা, কোনও প্রশ্ন করবার তার অধিকার নেই। আপনারা এবার আসতে পারেন।’
‘একটা কথা ভুলে যাচ্ছেন, মিস্টার মাসুদ রানা। আপনার রিপোর্ট করাচি চিফের কাছে দেয়ার কথা। এখান থেকে ঢাকায় রীলে করা হবে সেটা। কিন্তু…’
‘আমার রিপোট আমি সরাসরি হেড-অফিসে পাঠিয়ে দিয়েছি।’
বেরিয়ে যাচ্ছিল ওরা। রানা আবার বলল, ‘আমারই রিসিভ করার কথা ছিল, কিন্তু আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। আপনার চীফকে বলবেন আজ রাতের ফ্লাইটে করাচি আসছেন মেজর জেনারেল রাহাত খান কাউকে কিছু না জানিয়ে। ইচ্ছে করলে এয়ারপোর্টে গিয়ে তাঁকে রিসিভ করতে পারেন।’
বেরিয়ে গেল ওরা। সেই সঙ্গে রানার মেজাজটাও বিগড়ে দিয়ে গেল। সোজা আঙুলে ঘি ওঠে না। ঠিক করেছে ও আচ্ছামত ডাটিয়ে দিয়ে। রানার ভদ্রতার সুযোগ গ্রহণ করতে চাইছিল ব্যাটারা। প্রয়োজন হলে লোকের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হয় নিজের ক্ষমতা।
মিনিট পনেরো পরেই ঘরে ঢুকল অনীতা গিলবার্ট।
‘হ্যাল্লো, হিরো! এখনও বেঁচে আছ তা হলে?’
‘ভয়ে ঘর থেকে বেরোইনি সারাদিন,’ রানা মৃদু হেসে বলল।
‘উঁহু। বিশ্বাস করলাম না। ভয়ে পিছপা হবার লোক আলাদা। তোমার চেহারায় সংকল্প দেখতে পাচ্ছি, বন্ধু। ব্যাপার কী? আরও ঘটেছে কিছু?’
মাথা নাড়ল রানা। কফির অর্ডার দিয়ে মোহাম্মদ জানের পরিণতির কথা বলল অনীতাকে। সাঈদের কাছে জিনাতের পরিণতির কথা গোপন করেছিল। কিন্তু অনীতাকে পড়তে দিল চিঠিটা। ভুরু কুঁচকে গেল অনীতার।
‘এখনও চুপচাপ বসে আছ?’
‘এখনও আছি। কিন্তু সন্ধ্যের পর আর থাকব না।’
‘আমিও যাব তোমার সঙ্গে।’
‘অসম্ভব। মেয়েমানুষের কাজ এটা নয়।’
‘আমারও প্রতিশোধ নেবার আছে।’
‘সেদিক থেকে অবশ্য সাঈদের মত তোমারও দাবি আছে। কিন্তু তোমাকে সাথে নিলে কাজে বিঘ্ন হবে। অবশ্য অন্য কাজ দিতে পারি তোমাকে।’
‘কী কাজ?’
‘ঠিক রাত এগারোটায় সাগর পারের একটা স্টোর রুমের সামনের রাস্তায় ওই করোনা ডিলাক্স নিয়ে উপস্থিত হবে। গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করবে না। বারোটার মধ্যে যদি আমার দেখা না পাও তা হলে একটা বিশেষ নম্বরে ফোন করে খবরটা শুধু জানিয়ে দেবে। পারবে না?’
‘খুব পারব। ঠিকানা আর ফোন নম্বর লিখে দাও। ঠিক সময় মত পাবে আমাকে।’
এক টুকরো কাগজে লিখে দিল রানা ফোন নাম্বার ও ঠিকানাটা। ভ্যানিটি ব্যাগে রেখে দিল অনীতা সেটা। রানার প্যাকেট থেকে সিগারেট নিয়ে ধরাল কফির কাপ শেষ করে। রাইফেল দুটো দেখে চোখ-মুখে একটা ভঙ্গি করল।
‘যুদ্ধ হবে মনে হচ্ছে!’
মুচকি হাসল রানা। মেয়েটির কথা বলার ভঙ্গিতে কৌতুক আর বুদ্ধির ছটা। এমন অঙ্গভঙ্গি করে কথা বলে যে না হেসে পারা যায় না। সাধারণ কথা, তবু হাসি আসে। চলে গেল ও টাটা করে।
সন্ধ্যের পর এল সাঈদ খান।
‘হোটেল থেকে বেরোবেন কী করে? ঢুকবার সময়ই পরিষ্কার বুঝতে পারলাম চারপাশে ছড়িয়ে আছে ওদের লোক। লাউঞ্জের মধ্যেও।’
‘ওদের সাথে আমাদের লোকও মিশে আছে। আর বেরোবার ব্যাপারটা ভেবে রেখেছি আমি। ওদের দেখানো পথই অনুসরণ করব। কিন্তু তোমাকে যা বলেছিলাম করেছ? বিকেলে লোক পাঠিয়েছিলে ওখানে?’
‘আলবত। আপনি ঠিকই বলেছিলেন। দোতলার ওপর চিলেকোঠার ছাতে ফিট করা একটা লম্বা পোস্টের মাথায় ঘুরছিল রেইডার স্ক্যানার। পাঁচ শ গজ দূরের একটা অফিসের ছাত থেকে স্কোপ লাগানো রাইফেলের গুলি দিয়ে নষ্ট করে দেয়া হয়েছে ওটাকে। এখন বেহুদা ঘুরছে ওটা লাঠির মাথায়। এলাকাটা তিন দিক থেকে কাঁটাতারের জাল দিয়ে ঘেরা। গেটে সর্বক্ষণ পাহারা।
আটটার সময় কামরায় বসেই খেয়ে নিল ওরা সাপার। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখল টেবিলের ওপর। তারপর ঘরের সব আলো নিভিয়ে দিয়ে উইস্কির বোতল আর দুটো গ্লাস নিয়ে বসল গিয়ে ব্যালকনিতে, নিচু গলায় ওর প্ল্যান বুঝিয়ে দিল রানা সাঈদকে। মাথা ঝাঁকাল সাঈদ।
আধ বোতল শেষ করে উঠে পড়ল ওরা। রাইফেল দুটো কাঁধে ঝুলিয়ে নিল দুজন। ওয়েইস্ট ব্যাণ্ডে গুঁজে নিল রিভলভার। সবশেষে কী মনে পড়ে যাওয়ায় সুটকেস থেকে একটা বিশেষভাবে তৈরি অ্যাসিড পেন নিয়ে পকেটে গুজল রানা। কনসেনট্রেটেড নাইট্রিক এসিড ভরা তাতে-বোতাম টিপলেই পিচকারির মত বেরোয়। তারপর একগোছা ডিসেণ্ডিং রোপ নিয়ে কামরায় তালা লাগিয়ে। উঠে গেল সিঁড়ি বেয়ে ছাতে।
আধখানা চাঁদ আকাশে। সেই আলোয় খাঁ খাঁ করছে শূন্য ছাতটা। একটা লোহার হুকে বাঁধল রানা দড়ির এক প্রান্ত। দুই জোড়া ধাতুর তৈরি হাতলের মধ্যে দিয়ে গেছে শক্ত সরু রশিটা।
‘দুই হাতে মুঠো করে ধরবে হাতল দুটো। নিয়ম হচ্ছে, স্পিড বেশি চাইলে ওগুলো বেশি জোরে টিপে ধরবে। আর কমাতে চাইলে একটা হাত একেবারে ঢিল করে দেবে। বুঝেছ?’
মাথা ঝাঁকাল সাঈদ। এক মিনিটে নেমে এল ওরা হোটেলের পিছনের অন্ধকারে। সেইলরস ক্লাবের ওপাশ দিয়ে সোজা সাগরের দিকে চলে গেল ওরা। অপেক্ষমাণ স্পিড-বোটে রানার নির্দেশে বৈঠা রাখা রয়েছে দুটো। সাঈদ উঠে বসতেই ঠেলে পানিতে নামাল রানা স্পিড-বোট। তারপর উঠে বসে বৈঠা দিয়ে কিছুক্ষণ লগির মত ঠেলা দিয়ে বেশি পানিতে নিয়ে এল এবার। বিনাবাক্যব্যয়ে বৈঠা চালাল দুজন। ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল স্পিড-বোট পুব দিকে। মাথায় একরাশ ফেনা নিয়ে ঢেউ ভেঙে পড়ছে বোটের গায়ে। ছিটকে জলকণা এসে লাগছে চোখে-মুখে। দুলে দুলে উঠছে ছোট্ট বোট।
‘ডুবে যাবে না তো আবার?’ সাঈদ জিজ্ঞেস করল।
‘না, ডুববে না। কিন্তু সাঁতারটা শিখে নাও না কেন? কত সুইমিং পুল আছে শহরে। শিখে নিলে অনেক কাজে আসবে।’
‘ঠিক বলেছেন। কাল যদি সূর্যের মুখ দেখি তা হলে মেম্বার হয়ে যাব কোনও সুইমিং-ক্লাবের।’
বেশ অনেকদূর সরে এসেছে ওরা তীর থেকে। হোটেল ঢাকা পড়েছে একটা ঢিবির আড়ালে। এখন আর শব্দ পৌঁছবে না ওখানে। বৈঠা তুলে রেখে এভিনরুড ইঞ্জিনটা স্টাট দিল রানা। ফরওয়ার্ড গিয়ার দিতেই ছুটল স্পিড বোট তরতর করে পানি কেটে। বৈঠা তুলে একপাশে রেখে দিয়ে কাছে এসে বসল সাঈদ। জোর বাতাসে শীত শীত করছে। সিগারেট ধরাল দুজনে। পৌনে এক ঘণ্টার পথ।
‘তোমার চেয়ে ছোট নাকি জিনাত?’ জিজ্ঞেস করল রানা।
‘হ্যাঁ। দু’বছরের ছোট। পনেরো বছর একসাথে খেলাধুলা করে বড় হয়েছি আমরা। তারপর ও চলে গেল লাহোর।’
‘যেদিন পরিষ্কার বুঝতে পারলে যে ওকে ভালবাস, তখন নিশ্চয়ই ও অনেক দূরে সরে গেছে?’
চুপ করে থাকল সাঈদ। রানা যে হঠাৎ তার মনের কথাটা এভাবে বলে বসবে ভাবতেও পারেনি সে।
‘আপনাকে বলেছে ও কিছু?’
‘না। তোমার চোরা চাহনি দেখে বুঝেছি।’
আবার চুপ হয়ে গেল সাঈদ। ওর কাঁধের ওপর হাত রাখল রানা।
‘এমনই হয়, সাঈদ। জীবনটাই এরকম। সবকিছুর মধ্যেই গরমিল। মানুষ একান্ত করে যে জিনিসটা চায়, কেন জানি গোলমাল হয়ে যায়, পেতে পেতেও পায় না।’
‘কিন্তু এরকমটা হওয়ার কথা ছিল না, মি. রানা।’ সাঈদের কণ্ঠে অদ্ভুত একটা অভিমানের সুর ধ্বনিত হলো। হৃদয়ের অর্গল খুলে গেল ওর। ছোটকাল থেকেই আমি জানতাম ও আমার বউ। চার বছর বয়সে আমার আব্বাজি মারা যান। চাচাজিই আমাকে কোলে-পিঠে করে মানুষ করেছেন। চাচী আম্মা আমাকে প্রাণের চেয়ে বেশি ভালবাসতেন। আমার সব আবদার অত্যাচার সহ্য করতেন হাসিমুখে। আট বছর বয়স থেকে শুনে আসছি আমাদের বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। বড় হলে বিয়ে হবে। তখন থেকেই নিজের বৌ মনে করে কত যে অধিকার ফলিয়েছি আমি ওর ওপর!’ হাসল সাঈদ। কিন্তু পনেরো বছর বয়স হতেই ও যেন আমার চেয়ে অনেক বড় হয়ে গেল। বুদ্ধি বিবেচনায় অনেক পেকে গেল ও। দেহেও এমন বাড়ন্ত হয়ে উঠল যে ওর দিকে চাইতে লজ্জা লাগত আমার। নিজেকে ওর পাশে বড় অপরিণত, কাচাঁ মনে হত। চাচী আম্মা মারা গেলেন। চাচাজি মনে করলেন এখন ওকে লাহোরে কোনও বোর্ডিং স্কুলে রাখাই ভাল। নইলে চরিত্র খারাপ হয়ে যেতে পারে।’
কিছুক্ষণ চুপচাপ সিগারেট টানল সাঈদ। মোলায়েম, চাঁদের আলো বিছিয়ে পড়েছে সমুদ্রের উপর। কেবল জল আর জল। ঢেউয়ের মাথায় সাদা ফেনা। করাচি শহরের হাজার হাজার বাতি দেখা যাচ্ছে তারার মত বহুদূরে।
‘মাঝে মাঝে ছুটিতে যখন আসত বাড়িতে, উদগ্রীব আমি, কতবার বলতে চেয়েছি। কোথা থেকে একরাশ লজ্জা এসে কণ্ঠরোধ করেছে আমার। এখন বুঝতে পারি, যদি সেদিন সমস্ত দ্বিধা কাটিয়ে উঠে দাবি করতাম, তা হলে ও আজ এভাবে নষ্ট হয়ে যেত না। তারপর একসময় আমি এগিয়ে এলাম। ও হেসে উড়িয়ে দিল আমাকে। অন্য জগতের মানুষ হয়ে গেছে ও তখন। হঠাৎ বিয়ে করে বসল। এসব ঘটনা তো আপনি জানেন। তখন আমি বড় হয়ে গেছি। স্বামীর সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে সে যখন মারীতে, আমি গিয়ে উঠলাম, বললাম আমার মনের কথা। কদিন ও আমাকে খুব আদর যত্ন করে রাখল তারপর বলল, ‘সাঈদ ভাইয়া, আমি তোমার যোগ্য নই। তোমার মত একজন ভালমানুষের জীবনটা আমি নষ্ট করে দিতে পারব না। কাঙালের মত বললাম, দয়া করো আমাকে, জিনা। তোমার সমস্ত দোষ-ত্রুটি, পাপ-পুণ্য নিয়ে তুমি এসো আমার জীবনে। ধন্য করো আমাকে। তোমাকে ছাড়া আর যে কিছুই ভাবতে পারি না আমি।’ দুচোখ ভরে গিয়েছিল ওর পানিতে। বলেছিল, আগে বলোনি কেন? সময় থাকতে তুমি আমাকে জোর করে ছিনিয়ে আনলে না কেন ওই বিষাক্ত জীবনের মায়াবী আকর্ষণ থেকে? এখন আর হয় না, সাঈদ ভাইয়া। অনেক দেরী হয়ে গেছে।’
কথাগুলো মন দিয়ে শুনছিল রানা। কিছুটা ঢাকা বেতার কেন্দ্রের একঘেয়ে নাটকের মত শোনালেও রেডিওর ওপর বমি করে দিতে ইচ্ছে করল না রানার। কারণ এ নাটক রূপ লাভ করছে অতি সাধারণ হলেও একজন সত্যিকার প্রেমিকের হৃদয় মন্থন করা উপলব্ধি থেকে। শীত করছে রানার। ফ্লাস্ক থেকে খানিকটা উইস্কি ঢেলে সাঈদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে নিজেও খেল কয়েক ঢোক। দুই ঢোকে শেষ করল সাঈদ উইস্কিটুকু। তারপর গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে আবার আরম্ভ করল।
‘ফিরে এলাম আমি শূন্য পাত্র নিয়ে। অনেক অনুরোধ উপরোধেও, এমন কী চাচাজির হুকুমেও বিয়ে করিনি আমি। অপেক্ষা করেছিলাম। কিন্তু বাচ্চাটা মারা যাওয়ার পর আবার নষ্ট হয়ে গেল ও। তিক্ত হয়ে গেছে ও তখন জীবনের ওপর। অনেক চেষ্টা করলাম, কিন্তু ও কিছুতেই দেখা করল না আমার সঙ্গে। ওর পেছন পেছন লাহোর, পিণ্ডি, পেশোয়ার, করাচি ছুটে বেড়িয়েছি চাচাজির সঙ্গে পাগলের মত। তারপর আপনি এলেন ওর জীবনে। আমাকে ভুল বুঝবেন না, মি. মাসুদ রানা—আপনার প্রতি আমার কোনও বিতৃষ্ণা আছে ভাবলে ভুল হবে। আমি চাই ও সুখী হোক—ওর শান্তি হোক। আমার কপালে যা লেখা আছে, তাই হবে। এ লিখন তো কেউ খণ্ডাতে পারে না। কিন্তু আশ্চর্য কি জানেন? এত ঘটনার পরেও আমার স্নেহ-ভালবাসা এতটুকু কমল না। অদ্ভুত মেয়ে ও। কিছু দোষ নেই ওর। কারও ওপর কখনও অন্যায় করেনি জিনা। কিন্তু আমারই মত ওর ভাগ্যও বিরূপ। সুখ হলো না কিছুতেই। সবাই ঠকাল ওকে।’
এই ভাবপ্রবণ যুবক জানে না জিনাতের কপালে কী ঘটেছে। স্টিয়ারিং ধরে স্থির হয়ে বসে থাকল রানা। আর বেশি দূর নেই। প্রসঙ্গ পরিবর্তন করল রানা কৌশলে। নানান কথার পর মালাকান্দ স্মাগলিং সম্পর্কে কথা তুলতেই চুপ হয়ে গেল সাঈদ। মনে মনে হাসল রানা। ব্যাটা JMTT–জাতে মাতাল তালে ঠিক। এখন ও-ই ওদের গোষ্ঠীর সর্দার। চাচাজির সমস্ত অপকীর্তি চালু রাখার মহান দায়িত্ব তুলে নিতে হবে ওকে নিজের কাঁধে। এবং বোঝা যাচ্ছে যোগ্যতার সঙ্গেই সে কাজ চালাবে ও। এই একটা মানুষের মধ্যে কী অদ্ভুত ভাবে সরল প্রেম আর ব্যবসায়িক কুটিলতা, কোমল আর কঠিনের মিশ্রণ হয়েছে ভাবতে অবাক লাগল রানার।
এবারের সিগারেটটা মাথা নিচু করে খুব সাবধানে ধরাল রানা। হাতের মধ্যে আড়াল রেখে টানল, ফেলবার, আগে খানিকটা পানি হাতে তুলে নিভিয়ে তারপর ফেলল। ছোট ছোট আধডোবা পাহাড় দেখা যাচ্ছে দূরে।
হঠাৎ তীরের ওপর একটা সবুজ আলো জ্বলেই নিভে গেল। একটু বাঁয়ে কাটল রানা। পাঁচ মিনিট পর আরও কিছুদূর সামনে দু’বার জ্বলল আর একটা সবুজ বাতি। অনেকখানি সরে এল এবার রানা তীরের কাছে। তারপর বন্ধ করে দিল ইঞ্জিন। বেশ কিছুদূর আপনাআপনি চলল বোট। তারপর আবার বৈঠা চালাতে আরম্ভ করল ওরা। তীরের ওপর তিনবার জ্বলল সবুজ বাতি। আবছা মূর্তিটা চিনতে পারল রানা। দিল্লির খান।
‘বৈঠার শব্দ হচ্ছে, সাঈদ,’ ফিসফিস করে সাবধান করল রানা।
ধীরে ধীরে এগোল ওরা। নিঃশব্দে ইনফ্রারেড লেন্স লাগানো নাইট গ্লাসটা পরে নিল রানা চোখে। অনেক পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে এবার আঁধারের মধ্যে। দূরে একটা ইয়ট দেখা যাচ্ছে না? অর্ধেকটা আড়াল হয়ে আছে পাহাড়ের ওপাশে। তীরের দিকে দেখা গেল এরিয়ার মধ্যে বাঁধানো ঘাটে একটা লঞ্চ দাঁড়ানো। লোকজন দেখা গেল না। না ঘটে, না লঞ্চে।
এক শ’ গজ জায়গা খোলা আছে সমুদ্রের দিকে। ওখান দিয়েই ঢুকতে হবে। তীরে উঠে ঠেলে দিল রানা স্পিড-বোটটা বেশি পানিতে। হাওয়ার ধাক্কায় ধীরে ধীরে চলে গেল ওটা যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকে। দাঁড়িয়ে রইল পাড়ে রানা ও সাঈদ।
একটা ছোট মেঘের আড়ালে চলে গেল চাঁদটা। ছুটে লম্বা স্টোররুমের পাশে গিয়ে দাঁড়াল ওরা। এই লম্বা ঘরটার ওপাশে খানিকটা জায়গা ছেড়ে রাস্তার পাশের দোতলা বিল্ডিং। ওদিকে আপাতত কোনও ঔৎসুক্য নেই রানার। প্রথমে ঢুকতে হবে এই ঘরটার মধ্যেই।
বড়-সড় একটা দরজা দেখা গেল পিছন দিকে। এই দরজা দিয়েই বোধহয় লোডিং আনলোডিং হয়। তালা মারা। কব্জায় তারের অস্তিত্ব দেখে বুঝল রানা বার্গলার অ্যালার্মের ব্যবস্থা আছে সেখানে। তাতে রানার কিছুই এসে যায় না। এদিক দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করবে না, ও। মাছের কারবার যখন, তখন সামনে এগোলে নিশ্চয়ই কাঁচের দেয়াল থাকবে সূর্যের আলো আসবার জন্য। দরজাটা ছাড়িয়ে এগিয়ে গেল ওরা সামনে।
ঠিক। কিছুদূর এগিয়েই দেখা গেল লোহার ফ্রেমে কাঁচ বসানো আছে। কিন্তু বেশ অনেকখানি উঁচুতে। ভেতর থেকে ম্লান আলো আসছে। সাঈদের কাঁধে চড়ে কমার্শিয়াল ডায়মণ্ড বসানো কাঁচ কাটার স্টিক দিয়ে এক বর্গগজ আন্দাজ জায়গার কাঁচ তিন দিক থেকে কেটে ফেলল রানা। তারপর স্কচ টেপ দিয়ে অনেকগুলো স্টিচ লাগাল যাতে চতুর্থ দিকটা কাটলেই ঝন ঝন করে পড়ে না যায়। বাঁ দিক, ডান দিক আর উপর দিকে ভাল মত স্টিচ লাগিয়ে এবার একটানে নীচের দিকটা কেটে ফেলল রানা। সামান্য ঠেলতেই প্রায় নিঃশব্দে বেরিয়ে এল কাঁচ। দুই হাতে সাবধানে সেটাকে ধরে পায়ে ইশারা করতেই ধীরে ধীরে বসে পড়ল সাঈদ।
দেয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে রাখল রানা কাঁচটা। সাঈদকে ওখানে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবার নির্দেশ দিয়ে রাইফেলটা মাটিতে শুইয়ে রেখে লাফিয়ে ধরল ও লোহার ফ্রেম। তারপর পাকা জিমনাস্টের মত পা দুটো টেনে তুলে নিয়ে গেল ভেতরের দিকে।
কী যেন ঠেকল পায়ে। পা দিয়ে একটু নেড়েচেড়ে দেখল অ্যাকয়েরিয়াম একটা। হঠাৎ একটা শক খেয়ে চমকে উঠল রানা। আপনাআপনি ভাঁজ হয়ে গেল হাঁটু। কোনও বিষাক্ত মাছ কাটা মারল না তো? ফ্রেম থেকে বাঁ হাতটা সরিয়ে একটা পেন্সিল টর্চ বের করল রানা। মুখ ভোলা অ্যাকুয়েরিয়ামের মধ্যে অস্বাভাবিক ভাবে পানি নড়তে দেখে সত্যিই ঘাবড়ে গেল রানা। সাবধানে এক পা রাখল টেবিলের ওপর। বেশি ভর দিতে সাহস হলো না, ভেঙে পড়তে পারে। হালকা করে টেবিলের ওপর এক পায়ের ভর দিয়ে ছেড়ে দিল ডান হাত। আরেক পা পড়ল মাটিতে। সামান্য শব্দ হলো। সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে প্রথমেই লেবেলটা পড়ল রানা। ইংরেজিতে লেখা আছে: ‘ঈল’। যাক, বাঁচা গেল। বিষাক্ত কিছু নয়। সাউথ আমেরিকান এই মাছ শুধু ইলেকট্রিক শক দেয়। হর্স কিলার বলে একে। জুত মত পেলে অনায়াসে একটা মানুষ খুন করে ফেলতে পারে। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে টর্চ নিভিয়ে দিল রানা। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। কোথাও কোনও সাড়াশব্দ নেই।
পাশাপাশি কয়েক সারিতে অসংখ্য কাঁচের ট্যাঙ্ক চার পায়া টেবিলের ওপর রাখা। কয়েকটা ট্যাঙ্কে আলোর ব্যবস্থা আছে। কাঁচের দেয়াল ভেদ করে ম্লান চাঁদের আলো এসে পড়েছে ঘরের ভেতর। অদ্ভুত একটা স্তব্ধতা বিরাজ করছে চারদিকে।
বাম পাশের সারিতে কয়েকটা লেবেল পড়ল রানাঃ প্লেটি, সোর্ডটেইল, জার্মান ফাইটার, গাপ্পি, গোরামি, ব্ল্যাক মলি, নিয়ন, সিকলিড, প্যারাডাইস, অ্যাঞ্জেল, ল্যাবিরিন্থ, গোল্ড ফিশ, সিয়ামিজ ফাইটার আরও কত কী। আর ডান দিকের সমস্ত অ্যাকুয়েরিয়ামের গায়ে সাঁটানো কাগজে লাল কালিতে ছাপা:
DANGER
Poisonous Fish
ছোট বড় নানান সাইজের ট্যাঙ্ক-মাছের আকার অনুযায়ী।
কয়েকটা লেবেলে নাম পড়ল: গিটার ফিশ, মাড ফিশ, লায়ন ফিশ, ঈল, টর্পেডো স্কেটস, ওয়েস্ট ইণ্ডিয়ান স্করপিয়ন। এ ছাড়াও কিছু সামুদ্রিক বিষধর সাপের নামও পাওয়া গেল: হিমোফিস, হিমোডার্মা, হিমোসরাস, ইত্যাদি। রানা লক্ষ্য করল এদিকের সারির প্রত্যেকটা ট্যাঙ্কে একটা করে মাছ বা সাপ। দু শ’ আড়াইশ’ ট্যাঙ্ক আছে ডানধারের এই দুই সারিতে। চারদিকে কেমন একটা বোটকা মত গন্ধ।
বহুরকম মাছের খাবার রাখা আছে মেঝেতে টিনের ট্রের মধ্যে। কিছু পাউডার করে রাখা, কিছু জ্যান্ত। কয়েকটা চিনতে পারল রানা। ব্লাড-ওয়ার্ম, টিউবিফেক্স, মাইক্রো-ওয়ার্ম, হোয়াইটওয়ার্ম, ড্যাফনিয়া, ব্রাইন শ্রিম্প। কয়েকটা কাঁচের বোয়েমেও কয়েক পদের পাউডার ও ফ্লোটিং বল রাখা।
জায়গায় জায়গায় বিভিন্ন আকারের অসংখ্য সুদৃশ্য ঝিনুক আর শঙ্খ স্তূপ করা। এতেও আসে প্রচুর ফরেন কারেন্সি।
ঘরের ভিতর গরম। বদ্ধ আবহাওয়া। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে আরম্ভ করল রানার কপালে। বাইরের মুক্ত বাতাসের জন্য প্রাণটা চঞ্চল হয়ে উঠল ওর। ওদিকে সাঈদ নিশ্চয়ই অস্থির হয়ে উঠেছে ভেতরে আসবার জন্য।
বিষাক্ত মাছের কথা শুনেই একটা কথা মনে এসেছিল রানার। সেটা পরীক্ষা করে দেখতে হবে। তাই সাঈদকে বাইরে রেখে এসেছে।
হাঁটুর নীচে পায়ের সঙ্গে বাঁধা খাপ থেকে বের করল রানা অফিস থেকে পাওয়া নতুন ছুরিটা। ইঞ্চি পাঁচেক লম্বা একটা লায়ন মাছের জারের সামনে গিয়ে দাঁড়াল ও। টর্চের আলো মাছটার দিকে ধরতেই নড়েচড়ে উঠল সেটা। রানার জানা আছে এ মাছ আক্রমণ করে না, আত্মরক্ষার জন্যে ব্যবহার করে বিষ। না চুলে ভয়ের কিছু নেই।
ছুরিটা পানি স্পর্শ করতেই খাড়া হয়ে গেল ওর মেরুদণ্ডের ওপরের কাঁটাগুলো প্রাগৈতিহাসিক জানোয়ারের ছবির মত। চোখ দুটো বেরিয়ে এসেছে বাইরে। বিপদ টের পেয়ে গেছে সে। ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে পিছনে। ঘ্যাঁচ করে দুই চোখের মাঝখানে মাথার মাঝখানে গাঁথল রানা ছুরিটা। তারপর কাঁচের সাথে ঠেসে ধরেই ধীরে ধীরে উঠিয়ে আনল ওপরে। মাছটা ছটফট করছে আর লেজের বাড়ি মারছে ছুরিতে। একপাশে সরে দাঁড়িয়ে ওটাকে ফেলল রানা মেঝের উপর। তিড়িং তিড়িং করে লাফাতে থাকল মাছটা মাটিতে পড়ে। জুতো দিয়ে মাড়িয়ে ওটার ভব-যন্ত্রণা ঘুচিয়ে দিল ও। তারপর আস্তিন গুটিয়ে হাত ঢুকিয়ে দিল অ্যাকুয়েরিয়ামের তলায় বালু আর কাদার মধ্যে।
আছে। শক্তমত কী যেন ঠেকল রানার হাতে।
বিষাক্ত মাছ আর সাপের কারবার দেখে ওর মনে যে সন্দেহ হয়েছিল, তাই ঠিক। বালি আর কাদার মধ্যে থেকে বের করে আনল রানা অন্তত এক শ’ ভরি ওজনের একটা সোনার বার।
ওপরের অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে বাম হাতে নিল রানা সেটাকে। তারপর আবার হাত ঢুকিয়ে বাইরে না এনেই গুণে দেখল, আরও তিনটে আছে। এই ছোট ট্যাঙ্কেই যদি চারটে থাকে তা হলে বড়গুলোতে নিশ্চয়ই কমপক্ষে আটটা করে আছে। আন্দাজ করল রানা। আড়াই শ’ অ্যাকুয়েরিয়ামে কমপক্ষে দুই লক্ষ ভরি সোনা। এক শ তিরিশ টাকা হিসাবে দাম হচ্ছে কত কোটি টাকা? প্রতি ট্রিপে যদি এই পরিমাণ চালান যায় তা হলে বছরে? ওরেব্বাপ! বিরাট ব্যাপার!
চিন্তা করছে রানা খুব দ্রুত। আজকের এই অভিযানের ফলাফল অনিশ্চিত। হয়ত আজই ওর জীবনের শেষ দিন। কিন্তু এই সোনার ব্যাপারটা জানানো দরকার কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সকে। ভেবে দেখল, রাত বারোটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে অনীতা ফোন করবে। পনেরো মিনিটের মধ্যেই এসে হাজির হবে আর্মড ফোর্স। একটা জারে মাছ না দেখতে পেলেও ওরা আসল ব্যাপারটা এড়িয়ে যেতে পারে। কাজেই সোনার বারটা এমন জায়গায় রাখা দরকার যেখানে রাখলে সোয়া বারোটার আগে এদের চোখে পড়বে না, অথচ পাকিস্তান কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স-এর চোখে পড়বে এবং ব্যাপারটা বুঝতে পারবে ওরা।
ছুরির আগা দিয়ে সোনার বারটার ওপর M.R-9 লিখল রানা। তারপর মরা মাছটাকে ছুরিতে গেঁথে নিয়ে একটা অপেক্ষাকৃত অন্ধকার টেবিলের ওপর ট্যাঙ্কের আড়ালে রেখে দিল সোনা আর মাছ পাশাপাশি।
এবার ফিরে এল ও যেখান দিয়ে ঢুকেছিল সেইখানে। সঙ্কেত পেয়েই একটা রাইফেল চালান দিল সাঈদ ভেতরে। দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখল সেটা রানা। কিন্তু দ্বিতীয় রাইফেল চালান দেয়ার আগেই একসাথে জ্বলে উঠল ঘরের মধ্যে পঁচিশ-তিরিশটা এক শ’ পাওয়ারের বাল্ব। সেই সঙ্গে কানে এল ভয়ঙ্কর হিংস্র একটা গর্জন।