ভয় কাকে বলে বুঝল মাসুদ রানা আজ। শুনেছে ও, প্রাণভয়ে কেউ দৌড় দিলে হানড্রেড মিটার স্প্রিন্টের রেকর্ড হোল্ডার ওয়ার্লড চ্যাম্পিয়ানও তার কাছে নস্যি। গল্পের বইয়ে পড়েছে প্রাণভয়ে ভীত মানুষ অদ্ভুত সব কাজ করে বসেছে: বারো ফুট উঁচু দেয়াল টপকে চলে গেছে ওপারে, বাঁকিয়ে ফেলেছে মোটা লোহার শিক। আজ বুঝল সে-কথার মধ্যে কিছুটা হলেও সত্যতা আছে, একেবারে গাঁজাখুরি নয়।

সোজা গিয়ে বিঁধল ছুরিটা গুংগার বুকে।

আশ্চর্য! আধ ইঞ্চিও ঢুকল না ছুরি ওর গায়ে। সামান্য একটু বিধে বাঁটটা ঝুলতে থাকল ওর নাভির কাছে। এক মুহূর্ত সময় লাগল গুংগার বিস্ময় সামলাতে। কিন্তু তারই মধ্যে এক লাফে কাছে এসে দাঁড়িয়েছে রানা। দড়াম করে লাগল চেয়ারের ভাঙা হাতলটা গুংগার নাক বরাবর। যত মুগুর পেটা শরীরই হোক না কেন, এই প্রচণ্ড আঘাতে নাকের জল আর চোখের জল এক হয়ে গেল গুংগার। হাত দিয়ে নাক ঢেকে ফেলায় মনে হলো দ্বিতীয় বাড়িটা পড়ল গিয়ে কাঠের ওপর। তৃতীয় বার আঘাতের চেষ্টা না করে খোলা দরজা দিয়ে ছুটল রানা। দশ সেকেণ্ডের মধ্যেই পেছনে একটা ক্রুদ্ধ গর্জন শোনা গেল। ছুটতে ছুটতে একবার পিছন ফিরে চাইল রানা। আস্ত একটা পাহাড় ঝড়ের বেগে ছুটে আসছে ওর দিকে।

নিস্তার নেই, বুঝল ও। ঘুরে দাঁড়িয়ে ছুঁড়ে মারল হাতলটা। একটা দিয়াশলাইয়ের কাঠি যেন লাগল গিয়ে গুংগার গায়ে। ঠক করে উরুতে লেগে ছিটকে চলে গেল হাতল একদিকে। গতি কমল না একটুও।

আবার ছুটল রানা। এঁকেবেঁকে এ-গলি, ও-গলি, এ-বাঁক ও-বাঁক ঘুরে ছুটল গুংগার কাছ থেকে আত্মরক্ষার তাগিদে। এই গোলক ধাঁধার কি শেষ নেই? পেছনে গুংগার ক্রুদ্ধ গর্জন। ব্লাড হাউণ্ডের মত গন্ধ শুঁকে এগিয়ে আসছে সে। হাত-পা পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে নিয়ে কুঁকড়ে বসে পড়তে ইচ্ছে করল রানার।

একটা বাঁক ঘুরেই দেখল, পরপর দুটো ঘরের দরজা খোলা, ভারী পর্দা ঝুলছে। চট করে দ্বিতীয় ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল রানা। খালি ঘর। পর্দাটা দুলছে, হাত দিয়ে ধরে স্থির করে দিল। তারপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে থাকল ঘরের ভেতর।

সামনে দিয়ে সাঁ করে বেরিয়ে গেল গুংগা। একটা দমকা হাওয়া পর্দা দুলিয়ে দিয়ে ঘরের ভেতর প্রবেশ করল। থপথপ পায়ের শব্দ দূরে চলে গেল। রানা ভাবল, দৌড়ের ঝোঁকে কিছুদূর এইভাবে চলে যাবে গুংগা, কিন্তু ব্যাপারটা বুঝতে তার বেশি দেরী হবে না। এক্ষুণি আবার ফিরে আসবে সে সামনে তাকে দেখতে না পেয়ে।

ঘরের চারদিকে চাইল রানা। কিছুই নেই অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা যায়। অনেকগুলো শামুক স্তূপ করা আছে এককোণে, আর কয়েকটা ছোট ছোট জাল। আর কিছুই নেই ঘরটায়। হঠাৎ দরজার কোণে চৌকাঠের সঙ্গে ঝোলানো একটা লোহার রডের দিকে দৃষ্টি পড়ল রানার। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করবার হুড়কো, একদিক চৌকাঠের সাথে আটকানো। অসুরের শক্তি এসে গেল রানার দেহে দূরে গুংগার থপথপ পায়ের শব্দ এগিয়ে আসতে শুনে। দুই হ্যাঁচকা টানে খুলে এল রডটা কব্জা থেকে। কাছে এসে গেছে গুংগার পায়ের শব্দ। ডাণ্ডা হাতে বেরিয়েই ছুট দিল রানা উল্টো দিকে।

রানাকে দেখতে পেয়েই হুঙ্কার ছাড়ল গুংগা। তুফানের মত আসছে এবার এগিয়ে। বিশাল বুকটা শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে সাথে দ্রুত ওঠা-নামা করছে। বাক ঘুরতেই দেখল রানা একটা ঘর থেকে বেরিয়ে এল দুজন লোক। বেরিয়েই রানা যেদিকে যাচ্ছিল সেদিকেই রওনা হচ্ছিল ওরা, পায়ের শব্দে ঘুরে দাঁড়াল। মরিয়া হয়ে এগোল রানা। প্রস্তুত হবার আগেই বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়ল ও লোকদুটোর ওপর। মাথার ওপর রডের বাড়ি খেয়েই ‘ইয়াল্লা’ বলে বসে পড়ল একজন। দ্বিতীয়জন ধরে ফেলল রডটা। প্রচণ্ড এক লাথি চালাল রানা ওর তলপেটে। সামনের দিকে বাঁকা হয়ে গেল শরীরটা। তারপর একটা নকআউট পাঞ্চে ছিটকে পড়ল দেয়ালের ওপর।

আর পনেরো হাত দূরে এখন গুংগা। আবার ছুটল রানা। অল্পদূর গিয়েই একটা বাঁক। বাঁকটা ধরে আর না এগিয়ে বসে পড়ল ও মাটিতে। তারপর লোহার রডটা ওপাশের দেয়ালে ঠেকিয়ে শক্ত করে ধরে বসে থাকল নৌকার বৈঠার মত। উত্তেজনায় দাঁত বেরিয়ে গেছে রানার, ঠোঁটের দুই কোণ পিছিয়ে এসেছে কিছুটা।

তিন সেকেণ্ড পরেই তুফানের বেগে বাঁক ঘুরল গুংগা। রানাকে দেখতে পেল না। পা দিল সে রানার ফাঁদে সম্পূর্ণ অসতর্ক অবস্থায়। গুংগার পায়ের বাড়ি লেগে রানার হাত থেকে ছিটকে বহুদূরে চলে গেল রডটা। সেই সঙ্গে দড়াম করে মাটিতে আছড়ে পড়ল গুংগা। তুমুল গতিবেগ সামলাতে না পেরে উল্টে পাল্টে দেয়ালে ঠোক্কর খেয়ে বেশ খানিকটা দূরে গিয়ে থামল ওর দেহটা ঘাড় গুঁজে।

বুকের ভেতর একটা অদম্য আবেগ অনুভব করল রানা। জয়ের উল্লাসে চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছে করল ওর। পরমুহূর্তেই শিউরে উঠল ও। প্রাণ উড়ে গেল ভয়ে। আশ্চর্য! আবার উঠে দাঁড়াচ্ছে দানবটা! এই পতনের ফলে কিছুই হয়নি ওর।

এইবার? আর রক্ষা নেই। খোদা! ধরা পড়তেই হলো!

হঠাৎ একটা কথা মনে হতেই ঘুরে দাঁড়িয়ে ছুটতে আরম্ভ করল রানা। পৌঁছল যে-ঘরটা থেকে লোক দুজন বেরিয়েছিল সেই ঘরের সামনে। ঘরে ঢুকেই বুঝল ওর আন্দাজটা ঠিক। চিনতে পারল ঘরটা। টিপে দিল বোতাম।

গুংগার ক্রুদ্ধ গর্জন কানে এল। দ্রুত উঠে এল লিফট ওপরে। এই পথ দিয়েই নামানো হয়েছিল ওদের। লাফিয়ে বেরিয়ে এল রানা লিফট থেকে।

দোকানটা খালি। থরে থরে সাজানো রয়েছে অ্যাকুয়েরিয়াম। নিশ্চিন্ত মনে তার মধ্যে খেলে বেড়াচ্ছে মাছগুলো। নিঃশব্দে। কোনও ভয় নেই, ভাবনা নেই। এত ঘটনার কোনও খবরই রাখে না ওরা।

টেবিলের তলায় রানার গানটা নেই। এখন? রানা লক্ষ্য করছে, ও লিফট থেকে বেরোতেই আবার নেমে গেছে লিফট নীচে। এখনই উঠে আসবে গুংগা। কোন দিকে যাবে ও এখন? দোকানের কোলাপসিবল গেট বাইরে থেকে নিশ্চয়ই তালা মারা। ওদিকে গিয়ে লাভ নেই। ছুটল রানা শো-রুমের দিকে। অ্যাকুয়েরিয়ামের ফাঁক দিয়ে এক ঝলক দেখা গেল গুংগার ভয়ঙ্কর মুখটা। ধক ধক্ করে জ্বলছে ওর ছোট ছোট চোখদুটো। মুখটা কুঁচকে গেছে পৈশাচিক আক্রোশে। কালো পর্দা ছিঁড়ে ঢুকে পড়ল রানা শো-রুমের ভিতর।

কাঁচের ভিতর থেকে পরিষ্কার ফুটপাথ দেখতে পেল রানা। রাত কত হয়েছে? বারোটার বেশি নিশ্চয়ই নয়। এখনও হয়ত ট্যাক্সি পাওয়া যেতে পারে। ঝন ঝন করে ভেঙে পড়ল শো-রুমের কাঁচ রানার এক লাথিতে। লোহার ফ্রেম থেকে খানিকটা প্লাস্টার খসে পড়ল নীচে। একলাফে বেরিয়ে এল রানা বাইরে। ভাঙা কাঁচের টুকরো লেগে কেটে গেছে কপাল, সেদিকে ভ্রূক্ষেপও করল না। বুকের মধ্যে হাতুড়ি পিটছে, হাঁপাচ্ছে ও হাপরের মত। বাইরে ঠাণ্ডা বাতাসে বেরিয়ে এসে নতুন প্রাণশক্তি ফিরে পেল ও। ফুটপাত ধরে ছুটল বাম দিকে।

গাড়ি আসছে না একটা? খুশি হয়ে উঠল রানার মন। যাক এ যাত্রা বেঁচে গেল তা হলে। আধঘণ্টার মধ্যেই ফিরে আসবে ও ফোর্স নিয়ে–বারোটা বাজাবে এদের হাতেনাতে ধরে।

একটা গাড়ি আসছিল সামনে থেকে এই দিকে। কাছে এসে পড়েছে। রাস্তায় নেমে হাত দেখাল রানা।

ডাকাতের মত চেহারার একটা লোককে মাঝ রাত্তিরে এভাবে হাত তুলতে দেখে ভড়কে গেল ড্রাইভার। অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে-বো করে বেরিয়ে গেল সে রানার পাশ দিয়ে বাউলি কেটে। অ্যাক্সেলারেটর পুরো টিপে ধরেছে সে। লাল রঙের একটা করোনা ডিলাক্স।

অতি দুঃখেও হাসি পেল রানার। কিন্তু পরমুহূর্তেই মিলিয়ে গেল সে হাসি। পেছন ফিরে দেখল, শো-রুমের ভাঙা কাঁচের মধ্য দিয়ে ফুটপাতের ওপর বেরিয়ে এসেছে গুংগা।

আঁৎকে উঠে আবার ছুটল রানা। পিছনে গুংগা। আধ মিনিট ছুটবার পর পিছন দিক থেকে জ্বলে উঠল আরেকটা গাড়ির হেড-লাইট। গুংগার ছায়াটা বিকট দেখাচ্ছে আলোতে।

এই অবস্থায় গাড়িকে থামতে বললেও যে থামবে না, ভাল করেই জানা আছে রানার। তাই মিছে সময় নষ্ট না করে প্রাণপণে দৌড়ে চলল ও। টপ টপ ঘাম পড়ছে কালো পিচের রাস্তার ওপর। বিশ হাত পিছনে গুংগা। আর আধ মিনিটেই ধরা পড়ে যাবে রানা। কিন্তু যতক্ষণ দেহে শক্তি আছে, এগোতে হবে। আশ্চর্য! একটা পুলিশ বা নাইটগার্ড নেই কেন! এতবড় একটা শহরের উন্মুক্ত রাজপথের ওপর খুন করা হচ্ছে ওকে, কারও কাছ থেকে কোনও সাহায্য পাবে না ও?

রানার পাশ কাটিয়ে কয়েক হাত সামনে এগিয়েই হঠাৎ ব্রেক কষল গাড়িটা। ঝটাং করে খুলে গেল এদিকের দরজা।

‘জলদি উঠে পড়ো, রানা! কুইক!’

পরিষ্কার ইংরাজিতে বলল কেউ গাড়ির ভেতর থেকে। নারী কণ্ঠ। রানা দেখল সেই লাল করোনাটা। বিস্মিত হবার সময় নেই। একলাফে উঠে পড়ল ও ড্রাইভারের পাশের সিটে। অনীতা গিলবার্ট। নিজেই ড্রাইভ করছে। আর কেউ নেই গাড়িতে।

ফার্স্ট গিয়ার দিল অনীতা। কিন্তু এক ইঞ্চিও এগোল না গাড়ি। চট করে রানা দেখে নিল হ্যাণ্ড ব্রেকটা তোলা আছে কি না। না তো! লাফিয়ে সিট ডিঙিয়ে পেছনের সিটে চলে গেল ও। পেছনের কাঁচ দিয়ে দেখল, যা ভেবেছে তাই। পেছনে বাম্পার টেনে ধরে আছে গুংগা। দূরে রাস্তার ওপর চোখ পড়ল, চারজন লোক দৌড়ে আসছে এদিকে। ওদের লোক, সন্দেহ নেই।

‘ব্যাক গিয়ার দাও, অনীতা। পেছন থেকে টেনে ধরেছে গুংগা। খানিকটা পিছিয়ে হ্যাঁচকা টান দিয়ে সামনে চালাতে হবে। পারবে না?

‘তোমার জন্যে সব পারব।’

অবাক চোখে চাইল রানা মেয়েটির দিকে। এই বিপদেও মাথা ঠাণ্ডা রেখেছে মেয়েটা। অবলীলায় রসিকতা করছে। আশ্চর্য মেয়ে তো!

ততক্ষণে ব্যাক গিয়ার দিয়ে জোরে চালিয়ে দিয়েছে অনীতা পিছনে। খানিকটা পিছিয়েই এক ঝটকায় গুংগার হাত থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল ওরা। পাঁচ সেকেণ্ডে স্পীড মিটারের কাঁটা উঠে গেল পঁচিশে, দশ সেকেণ্ডে পঁয়তাল্লিশ। মিলিয়ে গেল পিছনে গুংগার চেহারাটা দুঃস্বপ্নের মত।

হু-হু করে ছুটে চলেছে লাল করোনো ডিলাক্স নির্জন রাস্তা দিয়ে। সামনে চলে এলো রানা। ঠাণ্ডা হাওয়ায় অনেকখানি সুস্থ বোধ করছে এখন। হেলান দিয়ে বসে সামনে যতদূর সম্ভব পা ছড়িয়ে দিল।

‘তুমি হঠাৎ কোত্থেকে, অনীতা?’ জিজ্ঞেস করল রানা।

‘আমার এক বোনকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিয়ে ফিরছিলাম। সিনেমা স্টার। লাহোর যাচ্ছে। ওরই গাড়ি। তুমি তো প্রথমে আমাকে ভয় লাগিয়ে দিয়েছিলে একেবারে। পাশ কাটিয়ে ভেগেছিলাম ডাকাত মনে করে। চেনা চেনা লাগছিল, কিন্তু একটু দূরেই যখন গুংগাকে দেখলাম, তখনই বুঝলাম লোকটা তুমি ছাড়া আর কেউ না। তারপর গাড়ি ঘুরিয়ে আবার এলাম ছুটে।’

‘তোমার সাহস আছে বলতে হবে।’

‘সাহস দেখাবার সুযোগ পেয়ে ধন্য হয়েছি আমি। প্রশংসা করে লজ্জা দেবার চেষ্টা কোরো না। এখানে কী করছিলে শুনি? অবস্থা তো রীতিমত সঙ্গীন হয়ে উঠেছিল দেখলাম। রেল ইঞ্জিনের মত ফোঁশ ফোঁশ করছিলে গাড়িতে উঠে। ব্যাপার কী? রণেভঙ্গ দিয়ে পালাচ্ছিলে মনে হলো? না না, এক্ষুণি উত্তর দেয়ার দরকার নেই। আগে বিশ্রাম নিয়ে নাও।’

দপ দপ করছে রানার কপালের দু’পাশের শিরাগুলো। কিছুক্ষণ চুপচাপ পড়ে থাকল ও। আর কান খালি পেয়ে অনর্গল বক বক করতে থাকল অনীতা গিলবার্ট।

‘আজই ছুটেছিলে বুঝি প্রতিশোধ নিতে? তুমি দেখছি একেবারে সিনেমার হিরোর মত শিভালরাস হয়ে উঠেছ। ভাবছি তোমার প্রেমেই পড়ে যাব কি না। একে হ্যাণ্ডসাম, তার ওপর নারীত্রাতা! রক্ষে আছে আর? কিন্তু দেখো তো, কী বিপদে ফেললাম তোমাকে গায়ে পড়ে সাহায্য চেয়ে! তোমার জন্যেই তো। আমার চাকরিটা ঘুঁচিয়ে না দিলে আমিই প্রতিশোধ নিতাম সুযোগ মত—তোমার কাছে নাক-কান্না কানতে যেতাম না। এইসব বিপদ-আপদের চেয়ে বিকেল বেলা আমার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলেই কি ভাল হত না?’

হেসে উঠল অনীতা খিল খিল করে। লাইট পোস্টের আলোয় ঝিক্ করে উঠল সোনা বাঁধানো একটা দাঁত। একটু চাঙ্গা হয়ে পকেট থেকে সিগারেট কেস বের করল রানা। একটা সিগারেট লাগিয়ে দিল অনীতার ঠোঁটে। নিজে একটা নিয়ে আগুন ধরাল দুটোতেই।

‘এখন যাচ্ছ কোন্ দিকে, অনীতা? কাছাকাছি কোনও ট্যাক্সি-স্ট্যাণ্ড পাওয়া যাবে না?’

‘তুমি যাবে কোথায়? হোটেলে?’

‘না। আমার এখন অনেক কাজ পড়ে আছে। এক্ষুণি কয়েক জায়গায় ফোন করা দরকার। তারপর যেতে হবে নাজিমাবাদ। তুমি আমাকে যে কোনও ট্যাক্সি স্ট্যাণ্ডে ছেড়ে দিয়ে বাড়ি চলে যাও।’

‘গাড়িটা হপ্তাখানেক আমার অধীনে থাকছে। এটাকে ট্যাক্সি হিসাবে ব্যবহার করো না এই কদিন? আর আমিও গায়ে-পড়া বেহায়া মেয়েলোক-পুরুষের সান্নিধ্য লাভ করে ধন্য হই।’

হাসল রানা। মেয়েটির বলিষ্ঠ মানসিকতা মুগ্ধ করতে আরম্ভ করেছে রানাকে। অদ্ভুত সহজ, সাবলীল, স্বচ্ছন্দ অনীতার কথাবার্তা, চালচলন, দৃষ্টিভঙ্গি।

‘বেশ। সাতদিন বেঁচে থাকব কি না কে জানে। আর সাতদিনের মধ্যে আমাকে কোথায় যে ড্রাইভ করে নিয়ে যাবে তুমি তারও ঠিক নেই। তবু অ্যাপয়েন্ট করলাম তোমাকে। আজ আমাকে নাজিমাবাদে নামিয়ে দিয়ে বাড়ি চলে যাও। কাল বিকেলে এসো হোটেলে। রোজকার মজুরি রোজ। আজকের মজুরি হিসেবে গত দুদিনের সব ঘটনা সংক্ষেপে বলছি তোমাকে। রাজি?’

‘রাজি।’

গল্প শেষ হতেই পৌঁছে গেল ওরা নাজিমাবাদ। বাড়িটা অন্ধকার। কোথাও কোনও আলো নেই দেখে মনটা দমে গেল রানার। অনীতাকে বিদায় দিয়ে কলিং বেল টিপল ও। মিনিট দুয়েক পর চোখ ডলতে ডলতে বেরিয়ে এল সাঈদ খান।

‘চাচাজি কোথায়?’ রানাকে একা দেখে জিজ্ঞেস করল সাঈদ। ‘গাড়িটাও দেখছি না যে?’

‘জিনাত কোথায়?’ পাল্টা জিজ্ঞেস করল রানা।

‘কেন, ঘুমাচ্ছে ওর ঘরে!’ রানার কপালে কাটা দাগ দেখে ঘুমের রেশ কেটে গেল ওর।

‘কেউ এসেছিল রেডিয়োগ্রাম নিয়ে?’

‘হ্যাঁ। আপনি পাঠিয়েছিলেন তো? সে তো প্রায় ঘণ্টাখানেক আগেই দিয়ে গেছে। কিন্তু চাচাজি কোথায়?’

‘সর্বনাশ হয়ে গেছে, সাঈদ। জিনাতের ঘরটা কোনদিকে?’

সাঈদকে ঠেলে ঢুকে পড়ল রানা ঘরের মধ্যে। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সাঈদও এল পিছু পিছু। বলল, ‘দোতলায় উঠেই প্রথম ঘরটা। কেন, কী ব্যাপার?’

তিন লাফে দোতলায় উঠে এল রানা। ঠেলা দিতেই খুলে গেল দরজা। বাতি জ্বালতেই চোখ পড়ল রানার চমৎকার একখানা রেডিয়োগ্রামের উপর। স্টেরিওফোনিক। দাম সাত আট হাজার টাকার কম না।

ও ঘরে কেউ নেই। ঘর খালি। বিছানার চাদরে ভাঁজ পড়েনি একটুও। অর্থাৎ কেউ শোয়নি আজ ওই বিছানায়। বাথরুমে খোঁজ করা নিরর্থক, যা বোঝার বুঝে নিয়েছে রানা। তবু একবার দেখে এল বাথরুমটা। সাঈদও এসে দাঁড়িয়েছে ঘরের মধ্যে। একদম বোকা বনে গেছে সে। কিছুই বুঝতে পারছে না। জিনাত গেল কোথায়? তার সঙ্গে রেডিয়োগ্রামের কী সম্পর্ক? রানাই বা এত রাতে একা এসে হাজির হলো কোত্থেকে? চাচাজি কোথায়? সব প্রশ্ন একসাথে ভিড় করে আসে ওর মনের মধ্যে।

‘ব্যাপারটা একটু খুলে বলুন, মিস্টার রানা।’

‘বলছি। তার আগে একটা ফোন করা দরকার। আপনি ছুটে গিয়ে গ্যারেজ থেকে জিপটা বের করুন।’

সাঈদ বুঝল জরুরী ব্যাপার। ছুটে বেরিয়ে চলে গেল সে বাইরে।

একতলার বৈঠকখানায় গিয়ে বসল রানা ফোনের সামনে। একটা সিক্স ডিজিট নাম্বারে ডায়াল করল।

‘আমি মাসুদ রানা বলছি। …এক্ষুণি পঞ্চাশ জনের আমড় মিলিটারি ফোর্স, পাঠাবার ব্যবস্থা করুন এই ঠিকানায়। পেন্সিল নিয়েছেন? লিখুন ফিশ এমপোরিয়াম, ২৩৪ ভিক্টোরিয়া রোড। স্টেনগান আর টর্চ নিলেই চলবে। আমিও আসছি ওখানে। পুরো বিল্ডিংটা ঘিরে ফেলতে বলবেন। আমি এসে বাকি ব্যবস্থা করব। একটি প্রাণীও যেন বেরুতে না পারে। আমার কোড নাম্বার হচ্ছে। এম আর নাইন। রাইট?’

সাঈদ এসে ঢুকল ঘরে। ফোনটা নামিয়ে রেখে রানা বলল, ‘চলুন। গাড়িতেই সব কথা বলব।’

‘এক সেকেণ্ডে কাপড় পরে আসছি আমি।’

‘আমার জন্যে একটা এক্সট্রা রিভলভার আনবেন সাথে করে। আমারটা খোয়া গেছে।’

‘আরও লোক নেব?’

‘না। দরকার হবে না।’

পথে সমস্ত ঘটনা শুনে পাথরের মত স্থির হয়ে গেল সাঈদ খান। তারই চোখের সামনে দিয়ে জিনাতকে ধরে নিয়ে গেল দুর্বৃত্তেরা, সে কিছুই করতে পারল না! চাচাজিকে কী উত্তর দেবে সে? জিনার কাছেই বা মুখ দেখাবে কী করে? ক্ষোভে দুঃখে মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে ওর।