বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস ‘আলালের ঘরের দুলাল’; এবং প্রথম ঔপন্যাসিক প্যারীচাঁদ মিত্র। উপন্যাসটি তিনি লিখেছিলেন টেকচাঁদ ঠাকুর ছদ্মনামে। বাংলা গদ্যে সাধু ভাষা যখন প্রতিষ্ঠিত হয়ে উঠেছিল, তখন টেকচাঁদ ঠাকুর উপন্যাস লিখলেন চলিত ভাষায়, একেবারে লোকমুখে ব্যবহৃত ভাষায়। পণ্ডিতেরা হতভম্ব হলেও উপন্যাসটি প্রকাশলগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত আলোচনা-সমালোচনার রয়েছে সমান তালে। টেকচাঁদ ঠাকুর বাংলা গদ্যের অবয়ব নির্মাণ এবং বিবর্তনের ইতিহাসে এক বিশেষ উল্লেখযোগ্য নাম; তাঁর আলালের ঘরের দুলালে ব্যবহৃত ভাষাই প্রকৃত বাংলা ভাষার উদাহরণ। বিগত আড়াইশ বছরে বাংলা গদ্য সাহিত্যের ভাষারীতিতে বিস্তর বিবর্তন লক্ষ্য করা গেলেও আলালের ঘরের দুলালের ভাষা এবং বর্তমান লোকজ ভাষার পার্থক্য যৎসামান্য। তিনি বাংলা সাহিত্যে উপন্যাসের স্ফুটনোম্মুখ যুগে পুরোপুরি না হলেও অন্ততঃ অংশত জীবনের সাথে শিল্পের সংযোগ ঘটাতে পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। ভাষা ব্যবহারে কথ্যরীতির অনুসরণ তাকে বাংলা সাহিত্যে বিশিষ্টতা এনে দেয়।
প্যারীচাঁদ মিত্রের সমস্ত সাহিত্যকর্ম নিয়ে আমাদের আয়োজন ‘প্যারীচাঁদ রচনাবলী’; এটি নূতন বা মৌলিক কাজ নয়, বরং ১৩৭৮ বঙ্গাব্দের ১২ই অগ্রহায়ণ মুতাবিক ২৯ নবেম্বর ১৯৭১ সালে ডক্টর অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় মণ্ডল বুক হাউস, ৭৮/১, মহাত্মা গান্ধী রোড, কলিকাতা -৯ থেকে প্রকাশিত ‘প্যারীচাঁদ রচনাবলী’র অনলাইন/ডিজিটাল সংস্করণ মাত্র। সেই সংস্করণে ডক্টর অসিতকুমার যে ‘ভূমিকা’টি লিখেছিলেন তা এই রকম—
ভূমিকা
প্রাককথন॥
বাংলাদেশ, বাংলা সাহিত্য ও বাঙালী-মানসিকতার দিক থেকে উনিশ শতক, বিশেষতঃ এর দ্বিতীয়ার্ধ একটি ঐশ্বর্যবান কাল প্রবাহরূপে বিবেচিত হতে পারে। উনিশ শতকের গোড়া থেকে পাশ্চাত্য শিক্ষাদীক্ষা, জীবনাদর্শ, সমাজপ্ৰণালী ও চিত্তপ্রকর্ষ সুখসুপ্ত মধ্যযুগীয় বাঙালীর নিদ্রানিমীল নয়নে প্রথম সূর্যালোকের জ্ঞানাঞ্জনশলাকা বুলিয়ে মাথার উপরে সীমাহীন আকাশ এবং পায়ের তলায় সীমাবদ্ধ পৃথিবীর নতুন পরিচয় উদ্ঘাটিত করল।
মধ্যযুগে বাঙালী-মানস বিশেষভাবে ছিল গোষ্ঠিসচেতন, গ্রামীণ ও ধর্মীয় ভাবাবেগে আত্মলীন। চৈতন্যদেবের প্রভাবে নতুনভাবে মানুষের মহিমা প্রতিষ্ঠিত হল বটে, কিন্তু সে-মানুষ বৈকুণ্ঠের দিকেই হাত বাড়িয়েছিল, ভৌমবৃন্দাবনকে ভাববৃন্দাবনের তুরীয়লোকে তুলে ধরেছিল। মধ্যযুগ অতিক্রান্ত হল ইতিহাস-দেবতার অনিবার্য অঙ্গুলিসঙ্কেতে। আধুনিক যুগ বাঙালী-মানসে নতুন ছায়াপাত্ত করল। বাংলা গল্পই হল নবযুগের উজ্জীবনমগ্ন। দেশে ও কালে বাঙালী চেতনার সম্প্রসারণে বাংলা গদ্য অসাধারণ ক্রিয়াশীল হল। সাময়িকপত্রে, প্রবন্ধনিবন্ধে, রংতামাসা-ভাঁড়ামিতে, ধর্মান্দোলনে এবং সামাজিক আচার-ব্যবহারে নানা প্রশ্ন উত্থাপন করে বাংলা গদ্য চেতনার জড়ত্বের মধ্যে প্রাণসঞ্চার করল। সর্বোপরি কথা-সরিৎসাগরে আখ্যানের তরঙ্গ তুলে বাংলা গদ্য উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধেই যৌবনের দার্ঢ্য অর্জন করল। বাংলা গদ্যই বাঙালীর যথার্থ বঙ্গদর্শন, আত্মদর্শনও বটে। সেই প্রসঙ্গে স্বনামধন্য প্যারীচাঁদ মিত্রের (টেকচাঁদ ঠাকুর) নাম সর্বাগ্রে মনে পড়বে, মনে পড়বে তাঁর রচিত কৌতুকরসসিঞ্চিত গল্প-কাহিনী, নীতি-মার্গীয় আখ্যান, আধ্যাত্মিক রূপক উপন্যাস, আরও নানাধরনের ছোটবড়ো প্রবন্ধনিবন্ধের কথা। ‘টেকচাঁদ ঠাকুর’ এই ছদ্মবেশে আবির্ভূত হয়ে ‘ইয়ং বেঙ্গল’দের নেতৃস্থানীয়, ডিরোজিওর শিষ্য, কলকাতার বিশিষ্ট নাগরিক প্যারীচাঁদ বাংলা গদ্যসাহিত্যে সরস রচনার গুণে স্থায়ী আসন লাভ করেছেন। সাহিত্যের কথা ছেড়ে দিলেও, আরও নানা দিক দিয়ে তিনি বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতিতে বিশেষভাবে স্মরণীয়।