প্যারীচাঁদ মিত্র : ফিরে দেখা১
উনিশ শতকের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক প্যারীচাঁদ মিত্র (১৮১৪-৮৩)। প্যারীচাঁদকে আমি স্রষ্টা এবং কর্মযোগী মানুষ হিসেবেই দেখতে ভালোবাসি। জন্মের পর দুশো বছর অতিক্রান্ত, মৃত্যুর পরও আমরা পেরিয়ে এসেছি একশ বত্রিশ বছর–তবু বাংলাভাষী মানুষের কাছে এখনো তিনি এক স্মরণীয় নাম। ভাষাবিদ্রোহী, সমাজনিষ্ঠ, কথাকার, মানব-উন্নয়ন সংগঠক, সাংবাদিক, অধ্যাত্মচিন্তক–কতভাবেই তো তাঁকে স্মরণ করতে পারি আমরা। দ্বিশততম জন্মবর্ষের এই শুভ-মুহূর্তে দাঁড়িয়ে প্যারীচাঁদের কর্ম ও সাহিত্য-সাধনা বিচার করতে বসলে তাঁকে অনায়াসেই উন্মথিত উনিশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলোকিত মানুষ হিসেবে শনাক্ত করা যাবে।
রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর আর ‘ইয়ংবেঙ্গল’দের সমকালে বাংলাদেশে আবির্ভূত হয়েছিলেন প্যারীচাঁদ মিত্র। তাঁর সময় কেটেছে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আর মাইকেল মধুসূদন দত্তের সাহিত্যিক-সাহচর্যে। প্যারীচাঁদ মিত্র এমন এক সময়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন, যখন প্রগতিশীল চিন্তা, উদার মানবতাবাদী দর্শন, ব্রাহ্ম ধর্ম-আন্দোলন এবং নাস্তিকতার পাশাপাশি রক্ষণশীল হিন্দুসমাজের দাপট, সামাজিক অসঙ্গতি ও সনাতন মূল্যচেতনার যুগলস্রোতে বাংলাদেশের সমাজ ছিল গতিচঞ্চল, দ্বন্দ্বক্ষত এবং আসন্ন পরিবর্তনমুখী। হিন্দু কলেজে ডিরোজিওর ছাত্র ছিলেন প্যারীচাঁদ—ফলে তাঁর মানসলোকে উদার মানবতাবাদী চেতনা ও মুক্ত জীবনদৃষ্টির বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিল প্রথম যৌবনেই। লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও এবং ডেভিড হেয়ারের সঙ্গে তিনি কাজ করেছেন, সহকর্মী ছিলেন উনিশ শতকের আলোকিত মানুষ রামতনু লাহিড়ীর। বস্তুত, উনিশ শতকের ‘সীমাবদ্ধ নবজাগরণে’র সদর্থক সব গুণই ক্রিয়াশীল ছিল প্যারীচাঁদের মানসলোকে।
শিক্ষা, সমাজ ও ব্যবসাসংক্রান্ত নানা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন প্যারীচাঁদ মিত্র। ১৮৩৬ সালে হিন্দু কলেজের পাঠ সমাপ্ত করে ক্যালকাটা পাবলিক লাইব্রেরিতে সাব-লাইব্রেরিয়ান পদে যোগ দেন প্যারীচাঁদ। ১৮৩৯ সাল থেকে চাকরির পাশাপাশি ব্যবসার দিকে ঝুঁকে পড়েন। বস্তুত, বিদ্যা ও বিত্তের সাধনার এক উজ্জ্বল উদাহরণ প্যারীচাঁদ মিত্র। ক্যালকাটা পাবলিক লাইব্রেরিতে কর্মনিষ্ঠার জন্য তিনি লাভ করেন আজীবন কিউরেটর ও কাউন্সিলরের পদ; অন্যদিকে আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের জন্য তিনি প্রতিষ্ঠা করেন উল্লেখযোগ্য অনেক ব্যবসায়-প্রতিষ্ঠান। ‘কালাচাঁদ শেঠ অ্যান্ড কোম্পানি’তে আমদানি-রফতানির কাজ করেন প্যারীচাঁদ, ছেলেদের নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ‘প্যারীচাঁদ মিত্র অ্যান্ড সন্স’ নামে কোম্পানি।
স্বাধীন বাণিজ্যে তাঁর সিদ্ধি রীতিমতো বিস্ময়কর। ‘গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল কো. লি.’, ‘পোর্ট ক্যানিং ল্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি’, ‘হাওয়া ডকিং কোম্পানি লিমিটেড’–এসব বিদেশি কোম্পানির পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন প্যারীচাঁদ। ‘বেঙ্গল টি কোম্পানি’, ‘ডারা টি কোম্পানি লিমিটেড’–এসব সংস্থারও পরিচালক ছিলেন তিনি।
উনিশ শতকে কলকাতার আলোকিত সমাজে প্যারীচাঁদ ছিলেন গতিশীল এক মানুষ। নানা কর্ম ও আন্দোলনের সঙ্গে তাঁর ছিল প্রত্যক্ষ সংযোগ। ১৮৩৮ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় ‘দ্য সোসাইটি ফর দি একুইজিশন অব জেনারেল নলেজ’ নামে জ্ঞানচর্চার ব্যতিক্রমী এক প্রতিষ্ঠান। প্যারীচাঁদ মিত্র ও রামতনু লাহিড়ী এই প্রতিষ্ঠানের যুগ্ম-সম্পাদক নির্বাচিত হন। ‘দ্য বেঙ্গল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি’র (১৮৪৩) অবৈতনিক সম্পাদক ছিলেন প্যারীচাঁদ। ‘দ্য ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’ (১৮৫১), ‘বিটন সোসাইটি’ (১৮৫১), ‘দ্য ক্যালকাটা সোসাইটি ফর দ্য প্রিভেন্শন অফ্ ক্রুয়েল্টি টু অ্যানিম্যালস’ (১৮৫১) ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন প্যারীচাঁদ মিত্র। ১৮৬৭ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘দ্য বেঙ্গল সোশ্যাল সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশনে’র যুগ্ম-সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন প্যারীচাঁদ। ১৮২০ সালে কেরি-প্রতিষ্ঠিত ‘এগ্রিকালচার অ্যান্ড হর্টিকালচার সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া’র সদস্য ছিলেন তিনি। সদস্য হিসেবে এ-সময়ে সোসাইটির জার্নালে প্যারীচাঁদ কৃষি-বিষয়ে অনেক প্রবন্ধ লেখেন। প্যারীচাঁদ-রচিত কৃষিবিষয়ক মৌলিক ও অনূদিত রচনাসমূহ ভারতবর্ষে কৃষিশিক্ষার ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য অবদান হিসেবে উত্তরকালে স্বীকৃতিলাভ করেছে।
১৮৬০ সালে স্ত্রী বামাকালীর মৃত্যুর পর প্যারীচাঁদ প্রেততত্ত্ব তথা থিওসফির প্রতি প্রবলভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। প্রসঙ্গত স্মরণ করা যায় প্যারীচাঁদের এই ভাষ্য: ‘I became a theisist or a Brahma… In 1860, I lost my wife, which convulsed me much. I took to the study of spiritualism which, I confess, I would not have thought of otherwise nor relished its charms.’ (Peary Chand, 1881: 9)। তিনি সমমনাদের নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ভারতীয় থিওসফিক্যাল সোসাইটি। দেশি-বিদেশি বহু থিওসফিক্যাল সংস্থার সঙ্গে প্যারীচাঁদের ছিল গভীর সম্পর্ক। ১৮৬০-উত্তর তাঁর সকল রচনাতেই থিওসফির প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।
দুই
প্যারীচাঁদ মিত্রের কর্মজীবন যেমন বৈচিত্র্যমুখী, তেমনি তাঁর সাহিত্যজীবনও চমৎকারিত্ব আর বিদ্রোহে ঋদ্ধ। সাহিত্যকর্মের জন্যই উত্তরকালের বাঙালির কাছে তিনি সমধিক পরিচিত। টেকচাঁদ ঠাকুরের ছদ্মাবরণে প্যারীচাঁদ মিত্র সাহিত্যক্ষেত্রে যে সাহস ও দ্রোহের পরিচয় দিয়েছেন, উত্তরকালীন বাঙালি আজো কি তা যথার্থভাবে মূল্যায়ন করতে সচেষ্ট হয়েছে? সাহিত্যের বিষয় ও ভাষা, ভাবসম্পদ ও প্রকরণস্বাতন্ত্র্য–উভয় দৃষ্টিকোণেই প্যারীচাঁদের দ্রোহ মূল্যায়ন কিংবা পুনর্মূল্যায়নের দাবি রাখে।
এ-কথা লেখার অপেক্ষা রাখে না যে, প্যারীচাঁদ মিত্রের সাহিত্যিক খ্যাতির প্রধান উৎস হচ্ছে আলালের ঘরের দুলাল (১৮৫৮)। তিনি লিখেছেন আরো সতেরোটি গ্রন্থ; কিন্তু এই একটি বই-ই বাঙালির কাছে তাঁকে স্মরণীয় করে রেখেছে। নানামাত্রিক বিতর্ক থাকলেও আলালের ঘরের দুলালকেই বলা হয় বাংলাসাহিত্যের প্রথম উপন্যাস। বাংলা উপন্যাসসাহিত্যের প্রধান সব সমালোচকই আলালের ঘরের দুলালকে, সব সীমাবদ্ধতা আমলে নিয়েই, বাংলা ভাষার প্রথম উপন্যাস বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। প্রসঙ্গত হ্যানা ক্যাথারিন ম্যুলেন্স-রচিত করুণা ও ফুলমণির বিবরণ (১৮৫২) গ্রন্থের কথা উল্লেখ করতে হয়। একাধিক সমালোচক এ-গ্রন্থটিকে বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস বলে বিবেচনা করেছেন। কিন্তু উপন্যাসের কোনো শর্তই পূরণ করে না করুণা ও ফুলমণির বিবরণ–এটি একান্তই খ্রিষ্টধর্মের মাহাত্ম্য-প্রচারক একটি রচনা মাত্র। এ-প্রসঙ্গে স্মরণযোগ্য সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য:
…ঔপন্যাসিকের মানসদৃষ্টি, বিস্তৃত জীবনপটে অভিজ্ঞতার বিন্যাস ও উপন্যাসোচিত সমস্যা–একটি উপন্যাসের এই প্রধান ত্রি-শর্তের একটিও এ পুস্তকে [করুণা ও ফুলমণির বিবরণ] রক্ষিত হয়নি।… ‘ফুলমণি ও করুণা’য় চরিত্রের কোনো বালাই নেই। নীতি-প্রচারকের সুমতি-কুমতির গল্পের মতো এ-গল্পে লেখিকার উদ্দেশ্যপোষকভাবে যে-কোনো ঘটনা যে-কোনোভাবে ঘটে। মানুষের মৃত্যুদৃশ্যও এ-উপন্যাসে মানুষের মৃত্যুদৃশ্য না হয়ে খ্রিস্টানের মৃত্যুদৃশ্য হয়ে উঠেছে। (সরোজ, ২০০৩: ৫৭)
উপন্যাস হয়ে-ওঠার সমুদয় শর্তই পূরণ করেছে আলালের ঘরের দুলাল। উপন্যাসোচিত সমস্যা, দেশজ জীবনপট, মানুষ ও প্রকৃতির আন্তঃসম্পর্ক, রক্তমাংসময় চরিত্র, স্বকীয় ভাষা এবং লেখকের জীবনদৃষ্টি–উপন্যাসের এসব বৈশিষ্ট্যের সবটাই পাওয়া যাবে আলালের ঘরের দুলালে। এ-উপন্যাসের শিল্পগুণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন: ‘আলালের প্রতিবেশ… পূর্ণাঙ্গ ও তথ্যবহুল, জীবনের নানামুখিনতাকে অবলম্বন করিয়া রচিত। ইহাতে কেবল রাস্তাঘাটের কর্মব্যস্ততা ও সজীব চাঞ্চল্য নাই, আছে পারিবারিক জীবনের শান্ত ও দৃঢ়মূল কেন্দ্রিকতা, আইন-আদালতের কৌতূহলপূর্ণ কার্য-প্রণালী, নবপ্রতিষ্ঠিত ইংরেজশাসনের যে সুকল্পিত বহির্ব্যবস্থা ধীরে ধীরে ব্যক্তিজীবনের গতিছন্দকে নিয়ন্ত্রণ করিয়া আনিতেছে, তাহার সম্পূর্ণ চিত্র। চরিত্রাঙ্কনে ইহার শ্রেষ্ঠত্ব আরও সুপ্রকট। মানুষ যে ঘটনাপ্রবাহে ভাসমান খড়কুটামাত্র নয়, তাহার ব্যক্তিত্ব যে নদীতরঙ্গ-প্রহত পর্বতের ন্যায় কম্পিত হইলেও স্থানভ্রষ্ট হয় না–ইহাতে চরিত্র-চিত্রণের এই আদর্শই অনুসৃত হইয়াছে’ (শ্রীকুমার, ১৯৯৬: ২৭)।
আলালের ঘরের দুলাল উপন্যাসের নায়ক মতিলালের আখ্যানে সমকালীন জীবনের বহুমাত্রিক সমস্যা শিল্পরূপ পেয়েছে, যাকে আমরা উপন্যাসোচিত সমস্যা হিসেবেই বিবেচনা করবো। মানবধর্ম থেকে বিচ্যুত হলে মানবজীবন যে বিপন্ন হয়, এ-কথাটাই বলতে চেয়েছেন প্যারীচাঁদ। এ-সমস্যাটি উনিশ শতকের মধ্যপাদে কলকাতা-জীবনকে বিপন্ন করে তুলেছিল। প্যারীচাঁদ ধর্মের মানুষকে খুঁজতে চাননি, তিনি সন্ধান করেছেন মানুষের ধর্মকে। উনিশ শতকের মানবময় চেতনার সঙ্গে এ-বোধের নিবিড় সংযোগ উপলব্ধি করতে পারলেই প্যারীচাঁদের ঔপন্যাসিক-সাফল্য আবিষ্কার করা সম্ভব।
আলালের ঘরের দুলালে প্যারীচাঁদ আমাদের পরির গল্প শোনাননি, শুনিয়েছেন দেশজ জীবনপটে বিস্তৃত রক্ত-মাংসময় মানুষের গল্প। মতিলাল, বরদা-বেণীবাবু, ঠকচাচা-ঠকচাচী–এসব চরিত্র উনিশ শতকের দ্বন্দ্বময় সমাজের কথাই আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন: ‘সমকালের জীবন সম্বন্ধে প্রবল স্পৃহা এবং সেই জীবনের বহু ব্যত্যয়ে প্রবল বেদনায় ‘আলালের ঘরের দুলালে’র জন্ম’ (সরোজ, ২০০৩: ৬০)। ঔপন্যাসিকের ইতিবাচক জীবনার্থ এবং ‘পরম মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি’ ‘আলাল’কে, বহুবিধ সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও, শিল্প করে তুলেছে। ঠকচাচার কারুণ্য, ঠকচাচীর অসহায়তা কিংবা কাশীর গঙ্গাতীরে প্রাচীন ভারতবর্ষের ছায়ায় মতিলালের আত্মোপলব্ধি–এ সমস্তই ঔপন্যাসিকের মানবচেতনার ভাষিক-প্রকাশ। প্রসঙ্গত স্মরণীয় উপন্যাসের অন্তিম বাক্যটি: ‘ঠকচাচী কোনো উপায় না দেখিয়া চুড়ীওয়ালী হইয়া ভেটিয়ারি গান ‘চুড়িয়ালের চুড়িয়া’ গাইতে গাইতে গলি গলি ফিরিতে লাগিল।’ কোনো ধরনের নীতিবাক্য দিয়ে ‘আলালে’র সমাপ্তি ঘটেনি, বরং অনাসক্ত জীবনপ্রীতিই এর পরম ব্যঞ্জনা।
বাস্তববোধ প্যারীচাঁদ মিত্রের ঔপন্যাসিক-প্রতিভার বিশিষ্ট লক্ষণ। সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন: ‘প্যারীচাঁদ ঊনবিংশ শতাব্দীর একমাত্র বাঙালি লেখক যিনি আঁকাড়া বাস্তবকে উপন্যাসে উপস্থিত করতে পেরেছিলেন’ (সরোজ, ২০০৩: ৬১)। এটি যেমন প্যারীচাঁদের গুণ, তেমনি দোষেরও আকর। কেননা, অনেক স্থলেই বাস্তব-বর্ণনা শিল্পিত হয়ে ওঠেনি ‘আলালে’, কখনো কখনো চরিত্র হয়ে উঠেছে টাইপ, উপন্যাস সংগঠনে, সচেতন পাঠকের চোখে ধরা পড়বে, কখনো ঘটেছে কেন্দ্রানুগ শক্তির নিয়ন্ত্রণহীনতা। এতসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও অখন্ড সমাজদৃষ্টি আর মানবমুখীনতার কারণে প্যারীচাঁদের আলালের ঘরের দুলালকেই আমরা বাংলা ভাষার প্রথম উপন্যাস হিসেবে শনাক্ত করতে চাই এবং বলতে চাই এ-কথা–আলালের ঘরের দুলালই প্রথম ‘আমাদের’ উপন্যাস। বাঙালি হিসেবে আমাদের গৌরব এই যে, উপনিবেশিত সমাজ-কাঠামোতে বেড়ে-ওঠা প্যারীচাঁদ মিত্র ঔপনিবেশিক রূপকল্প (form) অগ্রাহ্য করে নিজস্ব রীতিতে উপন্যাস লিখেছেন। উপনিবেশের শিক্ষায় বেড়ে-ওঠা সমালোচক তাই আলালের ঘরের দুলাল উপন্যাস মূল্যায়নে তেমন আগ্রহ দেখাননি, ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির ধারক-বাহকদের কাছেও প্যারীচাঁদ মিত্র পাননি তেমন পাত্তা। অথচ, যেমন বলেছেন বঙ্কিমচন্দ্র, আলালের ঘরের দুলালই আমাদের জাতীয় সাহিত্যের আদি সৃষ্টি (বঙ্কিমচন্দ্র, ১৩৯০: ৮৬৩)।
সূচনাসূত্রেই ব্যক্ত হয়েছে যে, ১৮৬০ সালে স্ত্রীর মৃত্যুর পর প্যারীচাঁদের মানসলোকে ক্রমশ প্রবল হয়ে ওঠে অধ্যাত্মচেতনা ও প্রেতজ্ঞান। আলালের ঘরের দুলাল উপন্যাসে যে সমাজনিষ্ঠা ও মানবচেতনার পরিচয় প্রকাশিত হয়েছিল, ১৮৬০-উত্তর প্যারীচাঁদের রচনায় তা অবসিত হলো; পক্ষান্তরে সেখানে প্রধান হয়ে উঠলো অধ্যাত্মচেতনা, পরজাগতিকবোধ এবং প্রেততাত্ত্বিক জ্ঞান। প্যারীচাঁদের এই মানস-রূপান্তরের প্রতিফলন ঘটেছে গীতাঙ্কুর (১৮৬১), যৎকিঞ্চিৎ (১৮৬৫) অভেদী (১৮৭১), আধ্যাত্মিকা (১৮৮১)–এসব রচনায়। প্রসঙ্গত আমরা স্মরণ করব ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত প্যারীচাঁদের সমাজ ও সমকালনিষ্ঠ অন্য একটি রচনার কথা। মদ খাওয়া বড় দায়, জাত থাকার কি উপায়? গ্রন্থে প্যারীচাঁদ সমকালীন সমাজজীবনকে যেভাবে ধরতে চেয়েছিলেন, এক বছরের ব্যবধানে তার যে রূপান্তর ঘটল, তা ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। সমকালীন সমাজ-সংগঠনেই ছিল এই পশ্চাৎমুখী রূপান্তরের টান। রামতনু লাহিড়ী, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রাজনারায়ণ বসু–কার মধ্যে ছিল না এই রূপান্তরের বাসনা? উপনিবেশের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে গড়ে-ওঠা উনিশ শতকী নব-জাগরণের এই সীমাবদ্ধতাই কি প্যারীচাঁদের মানস-রূপান্তরের মৌল কারণ? সব সমালোচকই প্যারীচাঁদের স্ত্রী-বিয়োগজনিত বেদনার কথা বলেছেন। আমাদের মনে হয়, বামাকালীর মৃত্যু আপাতকারণ হলেও মৌল কারণ ক্রিয়াশীল ছিল ‘ভিখিরির মাথায় জরি-জহরত দেওয়া পাগড়ির মতো’ কিম্ভূতকিমাকার সমাজ-সংগঠনে। সমাজ-সংগঠনের পশ্চাৎগতি প্যারীচাঁদের জীবনচেতনাকে দ্বিধান্বিত করেছিল এবং এই দ্বিধা ও দ্বন্দ্বের ফলেই প্যারীচাঁদের সমাজময় বাস্তবতা রূপান্তরিত হলো অধ্যাত্ম-পরমার্থচেতনায়।
উচ্চাঙ্গসংগীত-সাধনার মধ্য দিয়ে আধ্যাত্মিক উন্নয়ন ছিল প্যারীচাঁদের পরম অভীষ্ট (মনিরুজ্জামান, ১৯৬৮: ২০)। গীতাঙ্কুরের অনেক গানেই ইহজাগতিকতা অতিক্রান্ত আত্মিক কল্যাণ ও অধ্যাত্মচেতনা পরিস্ফুট হয়েছে (বীণাপাণি, ১৯৯৩: ১১৩)। যৎকিঞ্চিৎ, অভেদী ও আধ্যাত্মিকা রচনাত্রয় অধ্যাত্মচেতনা ও ঈশ্বরজ্ঞানে মুখর–এসব রচনায় প্যারীচাঁদ গভীর থিওসফিতে নিজেকে নিমগ্ন করেছেন। জীবনচেতনায় রূপান্তর সত্ত্বেও প্যারীচাঁদের এসব রচনার রয়েছে ভিন্ন এক তাৎপর্য। সনাতন ভারতীয় সংস্কৃতির কথা আছে এসব রচনায়, উপনিবেশের সংস্কৃতি ও ধর্মের বিপ্রতীপে প্যারীচাঁদের এই অবস্থান তাঁর দ্রোহীমনের ভিন্ন এক প্রকাশ হিসেবে বিবেচনা করা যায় কি? ঔপনিবেশিক সংস্কৃতিতে যুগ্ম-বৈপরীত্যের (binary-opposition) ধারণায় প্রাচ্যের সবকিছু খারাপ–ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির বিরুদ্ধে এভাবেই কি প্যারীচাঁদ একটা শক্ত অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন? প্রসঙ্গত স্মরণ করতে পারি শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই দূরসঞ্চারী ইঙ্গিত:
প্যারীচাঁদের রূপক বা আধ্যাত্মিক উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে একক ও অদ্বিতীয়–কোন পরবর্তী ঔপন্যাসিক তাঁহার ধারার অনুবর্তন করেন নাই। তাঁহার মনোভাব যুগোচিত প্রগতিশীলতা ও সুপ্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতিনিষ্ঠতার এক আশ্চর্য সমন্বয়। (শ্রীকুমার, ১৯৯৬: ২৯)।
– হ্যানা ক্যাথরিন ম্যুলেন্স যে খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের জন্য কলম ধরেছিলেন, প্যারীচাঁদের প্রয়াস কি তার বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদ? এমন কথা কি ভাবা যায়?
তিন
উনিশ শতকের আলোকিত মানুষ ছিলেন প্যারীচাঁদ মিত্র। তিনি ছিলেন ডিরোজিওর ছাত্র, ছিলেন রামতনু লাহিড়ীর সহকর্মী। উনিশ শতকী ‘সীমাবদ্ধ’ নবজাগরণের অনেক গুণই প্যারীচাঁদের মানসগঠনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করেছে। প্রসঙ্গত সমর্থক ও ইতিবাচক নারী-ভাবনার কথা এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। প্যারীচাঁদ মিত্র প্রাকৃতিক লৈঙ্গিক দৃষ্টিকোণে নারীকে বিবেচনা করেননি, বরং তাঁর চেতনায় উঁকি দিয়েছিল সামাজিক জেন্ডার দৃষ্টিকোণে নারীকে মূল্যায়নের সদিচ্ছা। নারী-উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষা নিয়েই তিনি প্রকাশ করেছিলেন মাসিক পত্রিকা (১৮৫৪)। পত্রিকার প্রতি সংখ্যার সূচনাতেই লেখা থাকতো এই কথা:
এই পত্রিকা সাধারণের বিশেষত স্ত্রীলোকের জন্য ছাপা হইতেছে, যে ভাষায় আমাদিগের সচরাচর কথাবার্তা হয়, তাহাতেই প্রস্তাব সকল রচনা হইবেক। পন্ডিতেরা পড়িতে চান পড়িবেন, কিন্তু তাঁহাদিগের নিমিত্তে এই পত্রিকা লিখিত হয় নাই।
(উদ্ধৃত: বীণাপাণি, ১৯৯৩: ৭৬)
বাঙালি নারীসমাজের মানসিক, নৈতিক ও পারিবারিক উৎকর্ষ সাধনে মাসিক পত্রিকা পালন করেছে ঐতিহাসিক ভূমিকা। নারীসমাজের নানামাত্রিক উন্নতির জন্য মাসিক পত্রিকায় প্যারীচাঁদ একের পর এক ধারাবাহিকভাবে লিখেছেন রামারঞ্জিকা (১৮৬০), এতদ্দেশীয় স্ত্রীলোকদিগের পূবর্বাবস্থা (১৮৭৯), অভেদী (১৮৭১), আধ্যাত্মিকা (১৮৮০), যৎকিঞ্চিৎ (১৮৬৫), বামাতোষিণী (১৮৮১) ইত্যাদি রচনা।
প্যারীচাঁদ মিত্র বাল্যবিবাহের বিরোধী ছিলেন, ছিলেন বহুবিবাহের বিপক্ষে। তিনি মনেপ্রাণে প্রত্যাশা করেছেন নারীর সামূহিক উন্নতি। বাংলা ভাষায় নারী-বিষয়ে গ্রন্থ-রচনায় তিনি অন্যতম পথিকৃৎ। নারী-পুরুষের ভেদ তিনি মান্য করেননি; নারীকে তিনি করতে চেয়েছেন পুরুষ-নিরপেক্ষ। মানবাধিকার, সাম্য ও পরস্পর সহযোগ-বাসনা প্যারীচাঁদের নারী-পুরুষ ভাবনার কেন্দ্রীয় প্রত্যয়। বর্তমান সময়ে নারীবাদী ভাবনার যে-প্রতিষ্ঠা, সার্ধশত বছর পূর্বেই প্যারীচাঁদের হাতে তার বীজ উপ্ত হয়েছিল–এ-সূত্রেও তিনি স্মরণীয়।
চার
সাংবাদিক হিসেবেও প্যারীচাঁদ মিত্র, সার্ধশত বছরের ব্যবধান সত্ত্বেও, আজো স্মরণীয় এক নাম। ইতিপূর্বেই ব্যক্ত হয়েছে, ১৮৫৪ সালে প্যারীচাঁদ নারী-উন্নয়নের বাসনা নিয়ে প্রকাশ করেছেন মাসিক পত্রিকা। এ-কাজে তাঁর নিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন রাধানাথ সিকদার। মাসিক পত্রিকার প্রতিটি সংখ্যায় থাকত বারো পৃষ্ঠা। এই পত্রিকার রচনাসমূহ সাধারণত মানুষ বিশেষত নারীসমাজের বোধগম্য ভাষায় রচিত হতো। মাসিক পত্রিকার ভাষা প্রসঙ্গে সুকুমার সেনের বিশ্লেষণ প্রণিধানযোগ্য। সুকুমার সেন লিখেছেন:
‘মাসিক পত্রিকা’র ভাষা বাঙ্গালা সাহিত্যে এক অভিনবত্ব দেখাইল। কথ্যভাষার রীতিতে বাক্যরচনা, প্রচুর তদ্ভব এবং চলিত ফারসি শব্দের ব্যবহার, এবং ক্রিয়াপদে তৎসম ও চলিত পদের মিশ্রণ–ইহাই হইতেছে ‘মাসিক পত্রিকা’র রচনা-রীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য (সুকুমার, ১৯৯৮: ৬৩)।
লেখ্য ও কথ্যরীতির শিল্পিত মিশ্রণই ছিল মাসিক পত্রিকায় প্রকাশিত রচনাগুচ্ছের প্রধান ভাষিক বৈশিষ্ট্য। রাধানাথ সিকদার সহযোগী থাকলেও, পত্রিকার এই ভাষিক দর্শন প্যারীচাঁদ মিত্রের তা বুঝতে আমাদের অসুবিধা হয় না।
মাসিক পত্রিকা ছাড়াও আরো কিছু পত্রিকার সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্ট ছিলেন প্যারীচাঁদ মিত্র। দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়-সম্পাদিত সাপ্তাহিক জ্ঞানান্বেষণ (১৮৩১) পত্রিকার অন্যতম সাংবাদিক ছিলেন প্যারীচাঁদ মিত্র। মাত্র পনেরো বছর বয়সেই প্যারীচাঁদ মিত্র জ্ঞানান্বেষণ পত্রিকার সম্পাদকীয় লিখতে আরম্ভ করেন। প্যারীচাঁদের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় কৃষি-বিষয়ক ক্ষণজীবী পত্রিকা Agriculture in Bengal (1881)। বাংলাদেশে কৃষিশিক্ষার ইতিহাসে এ-পত্রিকার রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। Agriculture in Bengal পত্রিকায় কৃষি-বিষয়ে প্যারীচাঁদ অনেক প্রবন্ধ লিখেছেন, যা সংকলিত হয়েছে তাঁর Agriculture in Bengal (1881) শীর্ষক গ্রন্থে। এখানে উল্লেখ করা যায়, কৃষি-বিষয়ক তাঁর আরো একটি গ্রন্থ রয়েছে, যার নাম কৃষি পাঠ (১৮৬১)। কর্নেল ওলকট এবং মাদাম ব্লাভাটস্কি-সম্পাদিত Theosophist (1879) পত্রিকার সঙ্গেও ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন প্যারীচাঁদ মিত্র।
পাঁচ
বাংলা রচনার পাশাপাশি প্যারীচাঁদের ইংরেজি রচনার কথাও এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক বিবেচনা করি। ইংরেজি ভাষায় প্যারীচাঁদ রচনা করেন আটটি গ্রন্থ। এছাড়া অগ্রথিত অবস্থায় রয়েছে তাঁর অনেক ইংরেজি রচনা। প্যারীচাঁদের ইংরেজি রচনার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য A Biographical Sketch of David Hare (1877), Stray Thoughts on Spiritualism (1880), Life of Dewan Ramcomul Sen (1880), On the Soul: Its Nature and Development (1881), Agriculture in Bengal (1881) ইত্যাদি। এসব গ্রন্থে এবং অগ্রথিত ইংরেজি রচনায় প্যারীচাঁদ ভারতবর্ষের সংস্কৃতি, ধর্ম, বাঙালি নারীর আতিমক জাগরণ, বাংলার অর্থনীতি এবং কৃষি-বিষয়ক নানামাত্রিক বিবেচনা উপস্থাপন করেছেন। ইংরেজি রচনায় প্যারীচাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি নিরপেক্ষ, শিল্পীসুলভ এবং গভীর অনুসন্ধিৎসু (বীণাপাণি, ১৯৯৩: ১৫৭)। ইংরেজি রচনাসমূহ পাঠ করলে অনুধাবন করা সম্ভব প্যারীচাঁদের অধ্যয়ন-ব্যাপ্তি, তথ্যনির্ভরতা, তত্ত্বজ্ঞান এবং মননচর্চার বহুমাত্রিকতা। প্যারীচাঁদ মিত্রের ইংরেজি রচনাসমূহ নিয়ে বিস্তৃত গবেষণার অবকাশ আছে বলে আমাদের মনে হয়েছে।
ছয়
কর্মনিষ্ঠ ও সাহিত্যসাধকের পর এবার পরিচয় নেওয়া যাক ভাষাদ্রোহী প্যারীচাঁদ মিত্রের। বস্তুত, উত্তরকালীন বাঙালির কাছে সাহিত্যশিল্পী প্যারীচাঁদ নন, বরং ভাষাশিল্পী প্যারীচাঁদই সমধিক স্মরণীয়। প্রাক্-প্যারীচাঁদ বাংলা গদ্য লৌকিক বাংলাকে অগ্রাহ্য করেছে, সাহিত্য-রচনায় গ্রহণ করা হয়নি লোকজীবনের কথ্যভাষা। ঈশ্চরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও অক্ষয়কুমার দত্ত সংস্কৃতানুসারী বাংলা ভাষাকে খানিকটা সহজবোধ্য করলেও তাঁদের রচনায় মান্য হয়নি বাঙালির লোকভাষা। সংস্কৃত সাহিত্য এবং সংস্কৃত ভাষার শৃঙ্খল থেকে মুক্তিলাভের জন্য বাংলা সাহিত্য এবং সাহিত্যের ভাষাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে প্যারীচাঁদ মিত্রের আবির্ভাব পর্যন্ত। বঙ্কিমচন্দ্র মন্তব্য করেছেন, সংস্কৃত সাহিত্য ও ভাষার শৃঙ্খল থেকে বাংলা সাহিত্যিক ভাষাকে প্রথম উদ্ধার করেন প্যারীচাঁদ মিত্র। বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন:
যে ভাষা সকল বাঙালির বোধগম্য এবং সকল বাঙালি কর্তৃক ব্যবহৃত, প্রথম তিনিই তাহা গ্রন্থ প্রণয়নে ব্যবহার করিলেন। এবং তিনিই প্রথম ইংরেজি ও সংস্কৃতের ভান্ডারে পূবর্বগামী লেখকদিগের উচ্ছিষ্টাবশেষের অনুসন্ধান করিয়া, স্বভাবের অনন্ত ভান্ডার হইতে আপনার রচনার উপাদান সংগ্রহ করিলেন। এক ‘আলালের ঘরের দুলাল’ নামক গ্রন্থে এই উভয় উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইল। ‘আলালের ঘরের দুলাল’ বাঙ্গালা ভাষায় চিরস্থায়ী ও চিরস্মরণীয় হইবে। উহার অপেক্ষা উৎকৃষ্ট গ্রন্থ তৎপরে কেহ প্রণীত করিয়া থাকিতে পারেন অথবা ভবিষ্যতে কেহ করিতে পারেন, কিন্তু ‘আলালের ঘরের দুলালে’র দ্বারা বাঙ্গালা সাহিত্যের যে উপকার হইয়াছে আর কোন বাঙ্গালা গ্রন্থের দ্বারা সেরূপ হয় নাই এবং ভবিষ্যতে হইবে কিনা সন্দেহ।
(বঙ্কিমচন্দ্র, ১৩৯০: ৮৬৩)
– স্মরণে রাখা প্রয়োজন যে, বঙ্কিমচন্দ্র যখন এ-কথা লিখেছেন, তখন প্রকাশিত হয়ে গেছে তাঁর অনেক উল্লেখযোগ্য রচনা। নিজে সংস্কৃতানুসারী গদ্য লিখলেও ‘আলালে’র ভাষাকেই বঙ্কিমচন্দ্র সাহিত্য-রচনার ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন:
আমি এমন বলিতেছি না যে ‘আলালের ঘরের দুলালে’র ভাষা আদর্শ ভাষা। উহাতে গাম্ভীর্যের এবং বিশুদ্ধির অভাব আছে এবং উহাতে অতি অল্প ভাব সকল, সকল সময়ে, পরিস্ফুট করা যায় কিনা সন্দেহ। কিন্তু উহাতেই প্রথম এ বাঙ্গালা দেশে প্রচারিত হইল যে, যে বাঙ্গালা সবর্বজনমধ্যে কথিত এবং প্রচলিত, তাহাতে গ্রন্থ রচনা করা যায়, সে রচনা সুন্দরও হয় এবং যে সবর্বজন-হৃদয়-গ্রহিতা সংস্কৃতানুযায়িনী ভাষার পক্ষে দুর্লভ, এ ভাষার তাহা সহজ গুণ।
(বঙ্কিমচন্দ্র, ১৩৯০: ৮৬৩)
উন্মথিত উনিশ শতকের গদ্যময় বাস্তবতা নির্মাণে প্যারীচাঁদের ভাষা রীতিমতো এক বিদ্রোহ। তাঁর পূর্বের, এমনকি পরবর্তীকালের, লেখকবৃন্দও উপনিবেশ-সৃষ্ট জনবিচ্ছিন্ন ভাষাতে সাহিত্যচর্চা করেছেন। বাস্তব-অভিজ্ঞতার তলের সঙ্গে কোনো সঙ্গতি না রেখেই, বলা যায়, বাস্তব-নিরপেক্ষভাবে তৈরি হচ্ছিল কথা, রচিত হচ্ছিল সাহিত্য। দেবেশ রায় একে বলেছেন ‘অনুবাদ গদ্য’। তিনি লিখেছেন: ‘একটি ভাষা তৈরি হচ্ছে যার প্রাথমিক ব্যবহার ঘটেছে অনুবাদে–ভাষার অনুবাদে নয়–বর্তমান অভিজ্ঞতার অনুবাদ, ইতিহাসের ব্যাখ্যার অনুবাদ, আর এই দুইয়ের মিশ্রণে চৈতন্যের অনুবাদ’ (দেবেশ ১৯৯০: ৬৯)। নতুন গদ্য জন্মলগ্নেই আক্রান্ত হয়েছিল জীবনবিচ্ছিন্নতার বীজাণুতে (আজম, ২০১৪: ১৮৩)। ভাষিক এই জনবিচ্ছিন্নতার বীজাণুর বিরুদ্ধেই ছিল প্যারীচাঁদের বিদ্রোহ। ‘আলালে’র ভাষা দিয়ে ঔপনিবেশিক ভাষিক-কাঠামোকেই আঘাত করেছিলেন প্যারীচাঁদ। সাধুভাষার বিপরীতে ‘অপর ভাষা’কে সাহিত্যের আসরে স্থান দিয়ে উত্তরকালীন বাঙালি লেখকদের কাছে প্যারীচাঁদ রেখে গেছেন অপার সাহসের উৎস। বাংলা ভাষার উপনিবেশায়ন-প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধেই ছিল প্যারীচাঁদের যুদ্ধ। বাংলা ভাষার সংস্কৃতায়ন প্রক্রিয়াকে ধাক্কা দিয়েছিলেন প্যারীচাঁদ। এখানেই বোধকরি সাহিত্যসাধক এবং ভাষা-সংগ্রামী হিসেবে প্যারীচাঁদের ঐতিহাসিক সার্থকতা।
সাত
উনিশ শতকের লেখক হলেও প্যারীচাঁদ মিত্র বহুমাত্রিক কারণে এখনো আমাদের কাছে প্রাসঙ্গিক বলে বিবেচিত হতে পারেন। সাহিত্যের বিষয় ও ভাষা যে সমকালীন জীবন ও জনসাধারণের কথ্যভাষা থেকে গ্রহণ করা যায়–বাঙালি লেখককে তো এ-কথা শিখিয়েছেন প্যারীচাঁদ মিত্র। ভাষা ও সাহিত্যের উপনিবেশায়ন প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে ছিল তাঁর সংগ্রাম। তাই হালের উত্তর-ঔপনিবেশিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্যারীচাঁদ মিত্রের সাহিত্যকর্ম বিশ্লেষণ করলে আমরা আবিষ্কার করতে পারব নতুন এক প্যারীচাঁদকে।
গ্রন্থপঞ্জি
- দেবেশ রায়: ১৯৯০, উপনিবেশের সমাজ ও বাংলা সাংবাদিক গদ্য, প্যাপিরাস, কলকাতা।
- বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়: ১৩৯০, বঙ্কিম-রচনাবলী–দ্বিতীয় খন্ড, সাহিত্য সংসদ, কলিকাতা।
- বীণাপাণি বাগচী: ১৯৯৩, প্যারীচাঁদ মিত্রের জীবন ও সমাজভাবনা, বাংলা একাডেমি, ঢাকা।
- মোহাম্মদ আজম: ২০১৪, বাংলা ভাষার উপনিবেশায়ন ও রবীন্দ্রনাথ, আদর্শ, ঢাকা।
- মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান (সম্পাদক): ১৯৬৮, প্যারীচাঁদ রচনাবলী (ভূমিকাংশ), কথাকলি, ঢাকা।
- শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়: ১৯৯৬, বঙ্গসাহিত্যে উপন্যাসের ধারা, মডার্ন বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা।
- সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়: ২০০৩, বাংলা উপন্যাসের কালান্তর, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা।
- সুকুমার সেন: ১৯৯৮, বাঙ্গালা সাহিত্যে গদ্য, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা।
- Peary Chand Mitra: 1881, On the Soul, Modern Publisher, Calcutta.