[আজ থেকে উনিশ বছর আগে যে সংলাপ পথে-প্রান্তরে শুনেছিলাম।]
ভাইসব! আমরা কি চেয়েছিলাম। কি পেয়েছি।
আমরা চেয়েছিলাম একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। যেখানে সুখ থাকবে, শান্তি থাকবে। কিন্তু আমরা কি পেয়েছি।
কিছু না।
কিছু না।
কিছু না।
ওরা আমাদের সুখ কেড়ে নিয়েছে।
আমাদের ভাইদের ধরে ধরে জেলখানায় পুরেছে।
জেলখানার ভেতর গুলি করে দেশপ্রেমিকদের হত্যা করেছে ওরা।
আমার মাকে কাঁদিয়েছে।
আমার বাবাকে বরখাস্ত করেছে।
আমার ভাইবোনদের লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়েছে।
এখন ওরা আমাদের ভাষাও কেড়ে নিতে চায়!
না।
না।
না।
আমরা তা হতে দেব না।
আমাদের মুখের ভাষাকে আমরা কেড়ে নিতে দেব না।
হরতাল।
সারা দেশব্যাপী আমরা হরতাল করবো।
না না, সেটা ঠিক হবে না। তারচেয়ে এসো আমরা সারা দেশব্যাপী স্বাক্ষর সংগ্রহ করি।
কি হবে হরতাল করে।
ওরা একশো চুয়াল্লিশ ধারা জারি করেছে।
হরতাল হবে না।
মিছিল বের করতে পারবে না।
না।
না।
বেআইনী আইনকে আমরা মানি না।
আমরা একশো চুয়াল্লিশ ধারা ভাঙবো।
ভাঙবো।
ওরা গুলি করেছে।
শুনেছো ওরা গুলি করেছে।
ওরা গুলি করে কয়েকটি ছাত্র মেরে ফেলেছে।
কোথায়?
মেডিক্যাল কলেজের মোড়ে।
আশ্চর্য।
এজন্যে আমরা স্বাধীনতা চেয়েছিলাম।
এজন্যে আমরা পাকিস্তান এনেছিলাম।
এই সরকারকে আমরা মানি না।
খুনী ডাকাতদের আমরা মানি না।
পদত্যাগ চাই।
ওদের পদত্যাগ চাই।
বরকতের খুন আমরা ভুলবো না।
রফিক আর জব্বারের খুন আমরা ভুলবো না।
বিচার চাই।
ফাঁসি চাই ওই খুনীদের।
ভাইসব। সামনে এগিয়ে চলুন।
ওদের গোলাগুলি আর বেয়নেটকে উপেক্ষা করে এগিয়ে চলুন।
[আজকের সংলাপ। পথে-প্রান্তরে যে সংলাপ শুনছি।]
কি চাই?
একুশে ফেব্রুয়ারির চাঁদা।
কি করবেন?
একটা ম্যাগাজিন বের করবো।
ম্যাগাজিন বের করে কি হবে?
বাঙলা একাডেমি থেকে ওরা পুরস্কার দেবে বলেছে। ওখানে জমা দেব।
নাহ্। তোমাদের দিয়ে কিছু হবে না। ওরা নামজাদা সব গায়ক গায়িকাদের বুক করে বসে আছে। আর তোমরা সব আলসের হদ্দ, চুপ করে ঘরে বসে গরুর গোস্ত খাচ্ছো?
চিন্তা করবেন না স্যার। আয়োজন আমরাও কম করিনি। ওদের চেয়ে আমাদের ফাংশন, আপনি দেখবেন অনেক ভালো হবে।
ভালো হবে কি। ভালো হতেই হবে। এর সঙ্গে আমার মান-সম্মান জড়িয়ে রয়েছে। বুঝলে না, আমি হলাম তোমাদের প্রেসিডেন্ট। আর হ্যাঁ। আমার বক্তৃতাটা ভালো করে লিখে দিও কিন্তু। একুশে ফেব্রুয়ারির ইতিহাসটা যেন থাকে ওর মধ্যে। আর শহীদদের নামগুলো।
দেখো, গতবারের মতো আবার উল্টাপাল্টা লিখে রেখো না। না, না, তুমি চিন্তা করো না। আমি দিন কয়েকের মধ্যে বাড়ি আসছি। তারপর ওদের মাথা ভাঙবো।
কিন্তু তুমি আসবে কি করে ?
কেন?
তুমি না বললে ছুটিছাটা নেই।
আছে, আছে, ওইতো দিন কয়েক পরে একুশে ফেব্রুয়ারি ছুটির দিন। তুমি একটুও বোঝ না আমি আগের দিন রাতেই এখান থেকে রওনা হয়ে যাবো। তারপর দেখো না শালাদের মাথা যদি না ভেঙ্গেছি। কি সাহস ওদের, আমার ক্ষেতের কুমড়ো চুরি করে নিয়ে যায়।
ওরা কোথায় মিটিং করবে?
পল্টনে।
আর তারা?
তারা করবে বায়তুল মোকাররমে।
ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট খালি নেই?
নেই ৷
বাঙলা একাডেমি?
ওখানেও কারা যেন সেমিনার করছে।
তাহলে?
কি যে করবো বুঝতে পাচ্ছি না।
শোন এক কাজ করো। আমাদের মিটিংটা আমরা রেসকোর্সেই করবো।
আল্লা যা করে ভালোর জন্যেই করে। রেসকোর্সে মিটিং করলে এমন জমা জমবে না, বাকি সবার চোখে ধাঁধা লেগে যাবে।
এই শোন। আজ বেশিক্ষণ থাকতে পারবো না।
কেন?
দেরি হলে প্রভোষ্ট ভীষণ রেগে যাবে। শেষে আর কোন দিনও বাইরে আসতে দেবে না।
কিন্তু আমার যে তোমার সঙ্গে অনেক অনেক কথা ছিলো।
ছিলো তো বুঝলাম। কিন্তু। আচ্ছা এক কাজ করলে হয় না?
কি?
কাল রাতে শহীদ মিনারের ওখানে এসো না।
ওখানে কেন?
আমরা সবাই ওখানে আলপনা আঁকতে যাবো। অনেক রাত পর্যন্ত থাকবো। ইচ্ছে মতো কথা বলা যাবে।
তোমাদের প্রভোষ্ট কি অত রাত পর্যন্ত বাইরে থাকতে দেবে?
দেবে না মানে। বিশ আর একুশে বাধা দিলে ওর হাল খারাপ করে দেবো না আমরা।
স্যার।
কি?
ছাত্ররা সব ঘন ঘন আসছে যাচ্ছে।
কেন? কেন? ছাত্ররা কেন আসছে?
বিজ্ঞাপন চাইছে?
কিসের বিজ্ঞাপন?
একুশে ফেব্রুয়ারিতে সবাই সংকলন বের করছে কিনা।
হুঁ। এক কাজ করুন। এ বছরটা জয় বাংলার বছর। কাউকে ফিরিয়ে দেয়া যাবে না। আমি একটা ফান্ড স্যাংশন করে দিচ্ছি। ওখান থেকে সবাইকে কিছু কিছু ভাগ বাটোয়ারা করে দিয়ে দেন। এতে আমাদের কোম্পানির গুডউইল আরো বেড়ে যাবে। আর শুনুন।
ইয়েস স্যার।
আপনার পরিচিত কোন কবিটবি আছে?
কেন স্যার?
না, ভাবছিলাম, শহীদদের ওপরে চার লাইন কবিতা লিখে বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করলে—
সেটা নিয়ে ভাববেন না স্যার। সেটা আমি নিজেই লিখে দিতে পারবো স্যার। আপনি জানেন না স্যার, আমারও একটু আধটু লেখার অভ্যাস আছে স্যার।
তাহলে তাই করুন।
আরেকটা কথা ছিলো স্যার।
কি?
আমাদের ওই পিয়নটা স্যার। এবারের ঘূর্ণিঝড়ে ওর ঘর বাড়ি সব শেষ হয়ে গেছে স্যার। ও এক মাসের বেতন এডভান্স চাইছে স্যার।
কিসের মধ্যে কি নিয়ে এলেন। যা বললাম তাই করুন গিয়ে এখন। ওসব-আজেবাজে ব্যাপার নিয়ে আমাকে ডিস্টার্ব করবেন না। বলে দিন হবে না।
কটা ভেঙ্গেছিস?
চারটা।
তুই?
আমি পাঁচটা গাড়ির নম্বর প্লেট। আর সতেরোটা সাইনবোর্ড।
জানিস, আমাদের পাড়ার সেই মোটা সাহেবটা, ওইযে সেই লোকটা যার মেয়ের কাছে একটা চিঠি লিখেছিলাম বলে আমাকে থাপ্পড় মেরেছিল মনে নেই তোর? সেই তখন থেকে ঘাপটি মেরে বসে আছি। দাঁড়াও একুশে ফেব্রুয়ারি আসুক। গাড়িতে ইংরেজি নম্বর প্লেট। নাক খসে দেবো না? দিলাম, শালার গাড়ি সুদ্ধু ভেঙ্গে দিয়েছি।
ঠিক করেছিস। শালার আমরা সংস্কৃতি সংস্কৃতি করে জান দিয়ে ফেললাম। আর ব্যাটারা ইংরেজি নম্বর লাগিয়ে ঘুরে বেড়াবে।
ঠিক করেছিস।
[আগামী দিনে যে সংলাপ শুনবো। পথে-প্রান্তরে যে সংলাপ মুখে মুখে উচ্চারিত হবে।]
বছরে কতদিন?
তিনশ’ পয়ষট্টি দিন।
তিনশ’ পয়ষট্টি দিনে ক’টা শহীদ দিবস?
দু’শো বিরানব্বইটা।
বাকি থাকে ক’টা?
তিয়াত্তরটা।
তিয়াত্তরটা আর বাকি রেখে কি হবে?
ওগুলোও ভরে ফেলো।
আগুন জ্বালো।
আবার আগুন জ্বালো।
পুরো দেশটায় আগুন জ্বালিয়ে দাও।
সাত কোটি লোক আছে।
তার মধ্যে না হয় তিন কোটি মারা যাবে।
বাকি চার কোটি সুখে থাকুক। শান্তিতে থাকুক। পুরো বছরটাকে শহীদ দিবস পালন করুক ওরা।
রচনাকাল : ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১