লোকটাকে দেখলেই গা জ্বালা করে রহমতের।

গর্বে মাটিতে যেন পা পড়তে চায় না লোকটার। লম্বা সুঠাম দেহ। দেড় হাত চওড়া বুক। মাংসল হাত দুটো ইস্পাত-কঠিন। বড় বড় চোখ দুটোতে সব সময় রক্ত যেন টগবগ, টগবগ করে। গায়ের রঙটা কালো কুচকুচে। চামড়াটা ঠিক কাকের পাখনার মতো মসৃণ আর তেলতেলে। গর্বে মাটিতে যেন পা পড়তে চায় না লোকটার। সকালে ভোরে ভোরে উঠে কাজে বেরিয়ে যায়। রাত দশটায় ঘরে ফেরে। হাতমুখ ধুয়ে ভাত খায়। তারপর নিজ হাতে তৈরি আমকাঠের ইজিচেয়ারটাকে দাওয়ায় টেনে এনে হাত-পা ছড়িয়ে বসে। বসে বসে ‘কিংস্টর্ক’ সিগারেট ফোঁকে।

লোকটাকে দেখলেই গা-জ্বালা করে উঠে রহমতের। মনে মনে ঈর্ষা হয়, শুধু তার প্রতি নয়; তার গোটা পরিবারটাই ওর কাছে ঈর্ষার বস্তু।

সেদিন রাতের ভাত খেয়ে বারান্দায় বসে বসে লোকটা যখন সিগারেট ফুঁকছিলো, তখন জানালার ফাঁক দিয়ে সেদিকে তাকিয়ে রাগে গজগজ করছিলো রহমত। স্ত্রী মেহেরুনকে ডেকে এনে দেখাচ্ছিল। দেখ দেখ শা’র বাবুয়ানা দেখ। পায়ের উপর পা তুলে কেমন চুরুট টানছে। যেন নবাব সলিমুল্লার নাতি আর কি।

ইস্। দেমাক কত। মেহেরুন তার ঠোঁট মুখ বিকৃত করেছিল। দেমাকের আর জায়গা পায় না। এত দেমাক থাকবে না, থাকবে না। তারপর একটু থেমে আবার বলেছিল, বাসের ড্রাইভার, তার আবার এত দেমাক কেন? রহমত এর উত্তরে কিছু বলেনি। শুধু নীরবে দাঁতে দাঁত ঘষেছিল একটানা অনেকক্ষণ। আর মনে মনে লোকটার বংশ নিপাত করেছিল।

লোকটাকে সবাই চেনে এ পাড়ার। বাস ড্রাইব্রার রহিম শেখ। রহিম শেখ বাস চালায়। টাউন সার্ভিসের বাস। ওর কোন ধরাবাঁধা বেতন নেই। দৈনিক যা টিকেট বিক্রি হয় তা থেকে পেট্রোল খরচ আর মালিকে কমিশন বাদ দিয়ে বাকি টাকাটা কন্ডাক্টর, সে আর যে ছোকরাটাকে নবাবপুর-ষ্টেশন-হাইকোর্ট বলে চিৎকার করবার জন্যে রাখে, সে ভাগ করে নেয়। টাকা যে খুব পায় তা নয়। তবু সেই অল্প ক’টা টাকা কাপড়ের ব্যাগে পুরে যখন সে বাসায় ফেরে, তখন এক অদ্ভুত তৃপ্তিতে মন-প্রাণ ভরে থাকে রহিম শেখের। কাজ তার গর্ব। কাজ করেই খায় সে। পরের কাছে হাত পাতে না। অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে না। কিংবা তাদের ওই বাসের মালিকটার মতো পুঁজি খাটিয়ে বসে বসে মুনাফা লুটে না। কাজ করেই খায় সে। কাজ তার গর্ব।

বাসায় বউ আছে তার। আমেনা। বাড়িতে অবসর সময় বেতের ডালা, বাস্কেট আর মাদুর তৈরি করে সে। পরে স্বামীর হাতে বাজারে বিক্রি করতে পাঠায়। ছেলেমেয়েও কম নয়। তিন মেয়ে, দুই ছেলে। বড় মেয়ে মুন্নির বয়স এবার চৌদ্দতে পড়লো। ওর পায়রা পোষার সখ। সেই বছর তিনেক আগে মেয়ের আবদার রাখতে গিয়ে বাজার থেকে একজোড়া খয়েরি রঙ-এর পায়রা এনে দিয়েছিল রহিম শেখ। সেই একজোড়া বংশানুক্রমিকভাবে বৃদ্ধি পেতে পেতে এখন বার জোড়ায় পৌঁছেছে। সারাদিন ওদের নিয়েই ব্যস্ত থাকে মুন্নি। ওদের ঘরগুলো ঝেড়ে মুছে পরিষ্কার করে দেয়া। খাওয়ানো। নতুন বাচ্চাগুলোর দেখাশোনা করা। সকাল আর বিকেলে পায়রাগুলোকে একবার করে আকাশে উড়িয়ে দেয়া। সন্ধ্যাবেলা বাসায় ঢুকলে সযত্নে খোপের দরজাগুলো একে একে বন্ধ করে দেয়া। ওদের নিয়েই সারাদিন ব্যস্ত থাকে মুন্নি। কিন্তু পায়রাগুলো ওর বড় বজ্জাত। মাঝে মাঝে দল বেঁধে মেহেরুনের ঘরে ঢুকে ওর চালডাল খেয়ে ফেলে। দেখলে রেগে আগুন হয়ে যায় মেহেরুন। প্রথমে পায়রাগুলোকে গালিগালাজ করে। যমের হাতে দেয়া, তারপর উঁচু গলায় পায়রার মালিকের উপর আক্রমণ চালায়। সব শেষে গোটা পরিবারটার উপরই রাগে ফেটে পড়ে মেহেরুন। এ তার রোজকার অভ্যেসে পরিণত হয়েছে। এইতো সেদিন ভরদুপুরে কি গালাগালিটাই না পাড়ছিলো সে। মুন্নি তখন সবে গোসল সেরে ভেজা চুলগুলো রোদে শুকুচ্ছিলো বসে বসে। হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললো, এই মেয়ে, সামলে কথা বল বলছি, নইলে ভালো হবে না, কবুতরে চাল খেয়েছে তো আমরা কি করবো অ্যাঁ?

কি করবো মানে, বেঁধে রাখতে পার না?

ওগুলো কি গরু-ছাগল যে বেঁধে রাখবো?

বেঁধে না রাখতে পারলে, পুষবার এত সখ কেন শুনি? অন্যের ঘরে ঢুকে যখন তখন চালডাল খেয়ে ফেলে নষ্ট করে, বলি চালডালগুলো কিনতে কি পয়সা লাগে না, না মাগনায় পাই?

এরপর আরো কিছুক্ষণ উভয়ের তরফ থেকে তর্কবিতর্ক চলেছিলো। সবশেষে খোদাকে সাক্ষী রেখে মেহেরুন প্রতিজ্ঞা করেছিলো। দেখ মুন্নি, এবার যদি তোর কবুতর আমার চালডাল খায়, তাহলে সেই কবুতরের জান আমি রাখবো না হুঁ।

মুন্নি ঠোঁট উলটিয়ে বলেছিল, ইস এত সস্তা না।

কিন্তু মেহেরুনের কাছে ব্যাপারটা খুব যে সস্তা তা বিকেলেই টের পেয়েছিল মুন্নি। সাদা-কালো রঙ মেশানো পায়রা জোড়া বাসায় ফেরেনি। এদিক ওদিক তালাশ করলো মুন্নি। আমেনাও নিজের কাজ ফেলে রেখে মেয়ের সাথে তালাশে নামলো। অন্ধকার ঘন হয়ে এলো তবু পায়রা জোড়ার কোন খোঁজ পাওয়া গেল না। কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছিল মুন্নির। মেহেরুনের ঘরের চারপাশে সতর্কভাবে বারকয়েক ঘুরাফেরা করলো সে। জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখলো। কিন্তু ঘরের ভেতর জমাট অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলো না সে।

রাতে রহিম শেখ বাসায় ফিরলে আমেনা সবকিছু খুলে বললো তাকে। মুন্নি তখন পায়রার শোকে বসে বসে কাঁদছিলো দাওয়ায়। সবকিছু শুনে মেয়ের দিকে এক পলক তাকালো রহিম শেখ। রাগে ছ’ ফুট লম্বা দেহটা তার থরথর কেঁপে উঠলো। অন্ধকার দাওয়ায় দাঁড়িয়ে গালিগালাজ যা কিছু জীবনের সঞ্চয় সব উজাড় করে দিলো সে রহমত আর মেহেরুনের উদ্দেশ্যে। পরে রাগটা একটু কমে এলে শ্বাস টেনে টেনে বললো, হারাম খেতে খেতে এদের হারাম খাওয়ার একটা অভ্যেস হয়ে গেছে। শক্ত সমর্থ জোয়ান মানুষ, কাজকর্ম একটা কিছু করে খাবে না—তো চুরিচামারি করে মানুষকে ধোঁকা দিয়ে খায়। শা— যাবি সব জাহান্নামে।

হয়েছে যাক তুমি এসো, মেয়েকে নিয়ে এখন ভাত খাও। আমেনা স্বামীকে একপাশে টেনে নিয়ে গেলো।

অনেক রাতে, জানালা আর কপাট বন্ধ করা পাকের ঘরটায় বসে কবুতরের ঝোল দিয়ে মজা করে ভাত খেয়েছিল সেদিন রহমত আর মেহেরুন। একমুখ ভাত চিবুতে চিবুতে মেহেরুন বলেছিল, যা করেছি, ঠিক করেছি, কি বলো?

হ্যাঁ, ঠিক। রহমত সায় দিয়েছিল। ব্যাটা বাসের ড্রাইভার বলে কিনা আমরা হারাম খাই। শা—তুমি যেমন ড্রাইভারি করে রোজগার কর; আমিও তেমন মানুষের হাত দেখে পয়সা কামাই। তোমারটা যদি হালাল হয়, আমারটা হারাম হতে যাবে কেন?

ঠিকই তো। মেহেরুন সমর্থন জনিয়েছিল তাকে। আর লোকটার দেমাক দেখো না। কালকে দাওয়ায় দাঁড়িয়ে মেয়েকে বলছিলো, ভিক্ষে করা পয়সা নয় আমার। গায়ে খেটে রোজগার করি। একটা ফুটো পয়সারও আমার দাম আছে। শা—দেমাকে মাটিতে পা পড়ে না। রহমত মুখ বিকৃত করেছিলো। কথায় কথা বেড়েছিলো, আলাপ চলেছিলো অনেকক্ষণ।

 

মাঝখানে অনেকগুলো দিন।

দুটি পরিবারের জীবন এমনি করেই এগুচ্ছিলো। হঠাৎ দুর্ঘটনা ঘটলো। দুর্ঘটনা ঘটলো রহিম শেখের জীবনে। প্রথম দূর্ঘটনা। এর আগে পর পর ক’টা দিন একটানা ধর্মঘট করেছিলো ওরা। কমিশন কমানোর দাবিতে ধর্মঘট। আর ধর্মঘট শেষ হবার দিন চারেক পর সকালে, আর আর দিনের মত বাস নিয়ে বেরিয়েছিল রহিম শেখ। লম্বা, সুঠাম দেহ মাংসল হাত দুটো ইস্পাত কঠিন। বড় বড় চোখ দুটো রক্তজবার মত লাল। বাসটা ঠিকই চালাচ্ছিলো রহিম শেখ। কিন্তু হঠাৎ সামুনের ট্রাককে পাশ কাটাতে যেতেই, তীব্রবেগে বাসটা গিয়ে ধাক্কা খেলো রাস্তার পাশের একটা ল্যাম্পপোস্টের সাথে। পরক্ষণেই সামনের কাঁচভাঙ্গার ঝনঝন শব্দ। দু’হাতে চোখ দুটো চেপে ধরে আর্তনাদ করে উঠলো রহিম শেখ। লাল চোখ বেয়ে লাল রক্তের স্রোত নেবে এলো তার।

বাসায় সবাই যখন এ খবর পেলো তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে।

মুন্নিকে সাথে নিয়ে হাসপাতালে তাকে দেখতে গেলো আমেনা।

অনেক খোঁজ খবরের পর সন্ধান মিললো তার। চোখেমুখে ব্যান্ডেজ আঁটা, নিসাড় হয়ে শুয়ে আছে সে। পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই কাতর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, কে?

আমি। গলা দিয়ে কথা সরছিলো না আমেনার।

একটু নড়েচড়ে রহিম শেখ আবার বললো, সাথে আর কেউ আসেনি?

এসেছে।

আমি বাবা। মুন্নি এগিয়ে বাবার একখানা হাত মুঠোর মধ্যে তুলে নিলো। চোখ দুটো তার পানিতে টলমল করছে। এরপর বেশ কিছুক্ষণ কেউ কোন কথা বলতে পারলো না। অনেকক্ষণ পরে হঠাৎ ব্যান্ডেজ বাঁধা চোখ দুটো দু’হাতে চেপে ধরে আর্তকণ্ঠে রহিম শেখ বলে উঠলো উঃ! আমি সব হারিয়েছি। সব হারিয়েছি। এবার আমি কি করে বেঁচে থাকবো?

কাপড়ের খুঁটে চোখের পানি মুছে নিয়ে আমেনা বললো, ওগো, খোদা না করুন, সত্যিই যদি তেমন কিছু হয়; তুমি ঘাবড়িয়ো না। আমি আছি, দু’বেলা চারটে ভাত জোটে সে বন্দোবস্ত হয়ে যাবে।

আমেনার কথায় মনকে সান্ত্বনা দিতে পারলো না রহিম শেখ। প্রশান্তভাবে বার কয়েক মাথা নাড়লো সে।

খবর পেয়ে রহমতও দেখতে এসেছিল তাকে। মেহেরুন বলেছিল লোকটার সাথে যত শত্রুতাই থাক না কেন, হাজার হোক, সে আমাদের প্রতিবেশী, তাকে একবার দেখে আসা উচিত।

হ্যাঁ, কথাটা মিথ্যে বলনি। রহমত সায় দিয়েছিলো তার কথায়। আজকাল কিন্তু রহিম শেখকে দেখলে তার প্রতি আর ঘৃণা বোধ হয় না রহমতের। আর ভয় লাগে না তাকে। বরঞ্চ তার প্রতি আজকাল অনুকম্পা জাগে ওর। করুণা হয়। হবেই বা না কেন? লোকটা তো আগের মতো আর দেমাক দেখিয়ে বেড়ায় না। দুটো চোখই হারিয়েছে সে। চোখ গেলে আর দুনিয়াতে কী-ই বা থাকে মানুষের। চাকরিটাও গেছে তার। এখন তো ভিক্ষে করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই রহিম শেখের। এখন তো আর দশজনের বোঝা ছাড়া আর কিছুই নয় সে। এই ভেবে তার প্রতি করুণা জাগে রহমতের। দয়া হয়। সেই লম্বা সুঠাম দেহটা যেন কেঁচোর মতো কুচকে একটুখানি হয়ে গেছে। মাথা উঁচিয়ে আজকাল আর চলতে পারে না সে। দাওয়ায় বসে ঝিমোয়। ক’দিন থেকে রহমত লক্ষ করছিলো, ভোর সকালে উঠে ছোট ছেলেটার কাঁধে হাত দিয়ে কোথায়, যেন বেরিয়ে যায় রহিম শেখ। অনেক রাত বাসায় ফিরে। তারপর দাওয়ায় পিদিমের আলোতে বসে বসে, মুন্নির হাতে থলে থেকে বের করা ফুটো পয়সা, আধ আনি, এক আনি সব হিসেব করায়।

ব্যাপার কি, অ্যাঁ? মেহেরুনকে একদিন জিজ্ঞেস করলো রহমত। মেহেরুন গালে হাত দিয়ে বললো, খোদা মালুম। আমি কি জানি। তারপর কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বললো, কি আর করবে, ভিখ মাগতে যায় আর কি। বলতে গিয়ে এক টুকরো হাসি দোল খেয়ে উঠলো ঠোঁটের কোণে। রহমতও হাসলো। সুক্ষ্ম সূতোর মতো মিহি হাসি।

সে দিনটা ছিলো রোববার। রোববারে অফিস-আদালত সব বন্ধ থাকে। আর তাই ও দিনটা রহমতের রোজগার বেশ বেড়ে যায়। কেরানি বাবুরা সব হাত দেখাবার জন্য ভিড় জমিয়ে ফেলে। কারো বা প্রমোশন। কারো বিয়ে। আবার কেউ কেউ ছেলেপুলের সংখ্যাও জানতে চায়। সবদিন এক জায়গায় বসে না রহমত। ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় বসে।

সেদিন সদরঘাটের মোড়ে বসবে বলেই ঠিক করলো সে। জায়গাটা খুব ব্যস্তসমস্ত। লোকজনের চলাফেরা খুব বেশি। ছুটির দিনে তো এমন ভিড় লাগে, মনে হয় যেন একটা হাট বসেছে।

রাস্তার পাশে একটা ভালো জায়গা ঠিক করে নিয়ে বসে পড়লো রহমত। পাশেই একটা খোঁড়া আর একটা শীর্ণকায় মেয়ে ছোট্ট একটা টিন হাতে ভিখ মাগতে বসেছে। এ বাবু, চারটে পয়সা দাও বাবু, দু’দিন কিছু খাইনি বাবু, চারটে পয়সা দাও।

অদূরে খবরের কাগজের হকাররা সব চিৎকার জুড়ে দিয়েছে, ইত্তেফাক-আজাদ-মর্নিং নিউজ। হঠাৎ একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে চমকে উঠলো রহমত; তাকিয়ে দেখলো, চৌরাস্তার মোড়ে ল্যাম্পপোস্টটার নিচে দাঁড়িয়ে রহিম শেখ। হাতে তার এক গাদা কাগজ। ঊর্ধ্বে একখানা কাগজ তুলে ধরে সে জোর গলায় হাঁকছে, গরম খবর সার—গরম খবর।

ইস, দেমাকে যেন পা মাটিতে পড়তে চায় না লোকটার!