ওরা আমার কি ছিল? বন্ধু-বান্ধব? কিছুই নয়, তবু ওদের স্মৃতি আমার দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে প্রাণহীন করে তুলেছে কেন? মানুষের মৃত্যু! সেতো এক চিরন্তন সত্য। মৃত্যু আছে বলেই সৃষ্টির প্রয়োজন আছে। আবার নব নব সৃষ্টিই মানুষকে যুগে যুগে উৎসাহ, উদ্দীপনা আর প্রেরণা দিয়ে এসেছে।

কিন্তু তবুও ওদের মৃত্যুতে আমি এত ব্যথাতুর কেন? কত শত দুর্ভিক্ষ, মহামারী আমি ডিঙ্গিয়ে এসেছি, কত লাখো হাজার মাংসহীন দেহকে রাস্তার আনাচে-কানাচে পড়ে থাকতে দেখেছি, দু’মুঠো ভাতের অভাবে, দিনের পর দিন তিলে তিলে শুকিয়ে শুকিয়ে মানুষ কেমন করে মরে, তাও আমি দেখেছি। দীর্ঘশ্বাসের অগ্নিকুণ্ডে দাঁড়িয়ে আমি কতবার প্রত্যক্ষ করেছি— আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধব, পাড়া পড়শী অনেকেই চলে যাচ্ছে মৃত্যুপথের মিছিল ধরে, চোখের জল চোখে শুকিয়ে; নতুনকে আলিঙ্গন করে নিয়েছি, পুরাতনের সমাধির পাশে বসে, জীবনকে প্রাণহীন হতে দিইনি কিছুতেই। কিন্তু আজ আমি এত দুর্বল হয়ে পড়েছি কেন? যুদ্ধক্ষেত্রের এই বীভৎস রঙ্গমঞ্চে প্রতিটি সৈনিকের রক্ত উষ্ণ হয়ে উঠেছে শত্রু সৈন্যের রক্ত পানেচ্ছায়। আমি এত নিস্তেজ কেন?

অনেক কষ্ট করে কতগুলো ফুলের চারাগাছ সংগ্রহ করেছি, ওদের কবরের শিয়রে। যেখানে ক্রুশগুলো গাড়ানো আছে, আর এক পাশে পুঁতে দেব বলে। এ গাছগুলো একদিন বড় হবে। ওতে ফুল ফুটবে, তার সে ফুলগুলো এক একটা করে ঝরে পড়বে ওদের কবরের ওপর; ফুলের সুমিষ্ট গন্ধে কবরের মানুষগুলো সব জেগে উঠবে, ফুল ওদের শোনাবে শান্তির আগমন বাণী; ওদের বিক্ষুব্ধ আত্মা শান্তি পাবে, ওরা শান্তি পাবে। স্পষ্ট মনে আছে, সেদিন রাত্রেও আজকের মতো ভীষণ শীত পড়েছিলো। গরমের দেশের লোক আমরা, এত শীত আমাদের সইবে কেন? দুটোর ওপর চারটে কম্বল চাপিয়েও বিছানায় শুয়ে ঠক ঠক করে কাঁপছিলাম।

ফ্রন্ট থেকে মাত্র অল্প কয়েক মাইল দূরে মিলিটারি হাসপাতালের ডাক্তার আমি। রাত্রে মাত্র চার ঘণ্টার বিশ্রাম। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুম চলে আসে। কিন্তু সেদিন এর ব্যতিক্রম হলো, ঘুম এলো না। নানা রকম এলোমেলো চিন্তা এসে মাথায় গিজ গিজ করতে লাগলো। রেডিয়াম ঘড়িতে স্পষ্ট দেখতে পেলাম একটা ঘণ্টা এর মধ্যেই কেটে গেছে। আর মাত্র তিনটে ঘণ্টা বাকি আছে, কিন্তু ঘুম এখনো এলো না। চমকে উঠলাম, ঘুম! আমি জানি, নিশ্চিত করে জানি, একজন ষোল বছরের কচি ছেলে আজ রাত ভোর হবার আগেই চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে পড়বে। পৃথিবীর সমস্ত গোলা-বারুদ যদি একসাথে শব্দ করে ওঠে, তবুও তার সে ঘুম ভাঙবে না।

যেদিন তাকে প্রথম দেখেছিলাম, সেদিন থেকেই জানতাম, ওর বাঁচবার কোন আশা নেই। সকরুণ দৃষ্টিতে ও আমার দিকে তাকিয়ে ব্যথিত স্বরে বলেছিল— ডাক্তার, আমার বাঁচবার কি কোন আশা নেই, ডাক্তার! জানতাম, বুকের পাঁজরে গুলি লাগলে সে রোগীকে বাঁচানো সম্ভবপর হয়ে ওঠে না, তবুও তাকে সান্ত্বনা দিয়েছিলাম— ভয় করবার কিছু নেই, নিশ্চয়ই তুমি ভাল হয়ে যাবে।

বেদনায় ভরা মুখখানা ওর আশার ক্ষীণ আলোকরশ্মিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল; কিন্তু পরক্ষণেই তা ম্লান হয়ে গেলো। যখন সে একটা অসহনীয় বেদনা অনুভব করলো বুকের নিচে, এক গ্লাস জল। ওর ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠলো, জল নিয়ে এলো নার্স, কিন্তু এক ফোঁটা জলও তার ভাগ্যে জুটলো না, গ্লাস ভরে গেলো উষ্ণ রক্তে, রক্ত বমন আরম্ভ হলো ওর, ভীত বিহ্বল চোখ দুটো বেয়ে এবার নামলো অশ্রুর বন্যা, কিছুতেই তাকে সান্ত্বনা দেওয়া গেলো না, বললাম— কেঁদো না জর্জ, কাঁদলে শরীর আরও খারাপ হয়ে যাবে।

আমায় সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করো না ডাক্তার! আমি জানি, আমার বাঁচবার কোন আশা নেই, ক্ষুব্ধ অভিমানে ও চাপা আর্তনাদ করে উঠলো।

ষোল বছরের এক কচি বালক। ফুল সবেমাত্র পাপড়ি মেলছিলো, ওর সম্মুখে ছিল আশা-আকাঙ্ক্ষা ভরা উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। কিন্তু— না ফুটতেই পাপড়ি ঝরে গেলো। পুওর জর্জ।

উঃ। ওর কথাগুলো আজও বার বার আমার কানের ওপর মর্মর বেদনা সৃষ্টি করছে,— জানো ডাক্তার। এরা আমায় জোর করে আমার মায়ের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে এসেছে।

কথা বলো না জর্জ। কথা বলা নিষেধ। কিন্তু আমার মানা সত্ত্বেও সে থামলো না স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম, কথা বলতে ওর কষ্ট হচ্ছে, তবুও সে আপন মনে বলে চললো—হ্যাঁ, আমি নিশ্চয়ই মরে যাবো। আমার মা, ছোট ভাই-বোন, কাউকে আমি আর দেখবো না, কাউকে আমি আর দেখবো না। কান্নায় ওর গলার স্বর বন্ধ হয়ে এলো।

ঘুম আর আসবে না জানি, যা একটু তন্দ্রা এসেছিল, তাও ছুটে গেলো, চিন্তা স্রোতের গতি পরিবর্তনের ধাক্কায়, গুলির শব্দে হতচকিত হয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু যে দৃশ্যটা দেখলাম, সে দৃশ্য দেখে পাষাণেরও চোখে জল আসে।

এডোয়ার্ড বলেছিলো নিজ হাতে সে তার জীবনের যবনিকা টেনে দেবে!

যে বাঁচার ভেতর সার্থকতা নেই, যে জীবনের ভেতর এতটুকু মধুরতা নেই, সে জীবনের ঘানি টেনে কি লাভ ডাক্তার? বার বার আক্ষেপ করেছিলো এডোয়ার্ড। বেচারা তার দুটো চোখই হারিয়েছিলো, শুধু তাই নয়, মুখটা এমন কদাকার হয়ে গিয়েছিলো যে, দেখলে ভয় হতো। এক সময় সে যে খুব সুশ্ৰী ছিলো তা তার মুখের এক পাশেকার সুস্থ স্থানটুকু দেখলেই বোঝা যেতো। এডোয়ার্ড বলেছিলো, গত জুলাই মাসে ওর বিয়ে হবার কথা ছিলো ম্যারিয়ানার সাথে। ম্যারিয়ানা! রুদ্ধ হয়ে এলো এডোয়ার্ডের কন্ঠস্বর। লাজুক মেয়ে ম্যারিয়ানা, ছোটকাল থেকে এক সাথেই আমরা বড় হয়েছিলাম। জানালার বাইরে অন্ধ দৃষ্টি মেলে এডোয়ার্ড বললো, … … আমরা পরস্পরকে ভালবাসতাম। আমাদের গার্জেনরা তার যথোচিত মর্যাদা দিয়েছিলেন। আমাদের বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করে। বার কয়েক ঢোক গিললো এডোয়ার্ড, ডাক্তার, তুমি নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছো, তখন আমাদের অন্তরে কেমন খুশির বন্যা বয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু— কিন্তু! দাঁতে দাঁত চেপে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো সে। কিন্তু একি হলো ডাক্তার! আমার সে জীবন কোথায় গেলো? আমি জানি, আমার সে জীবন আর ফিরে আসবার নয়, সে আর ফিরে আসবে না। জর্জের মতো এডোয়ার্ড অল্পবয়স্ক ছিল না, তাই চোখের জলকে সে সামলে নিয়েছিলো।

—যুদ্ধে এলে কেন? হঠাৎ প্রশ্ন করে বসেছিলাম।

—হ্যাঁ যুদ্ধে কেন এলাম। মাথা নাড়তে নাড়তে আপন মনেই বললো সে। কিন্তু, তুমি ম্যারিয়ানার কথাটারই পুনরাবৃত্তি করলে ডাক্তার। ম্যারিয়ানাও বলেছিলো, কেন যুদ্ধে যাবে? যুদ্ধ করে তোমার কি লাভ? সে দিন প্রথম ম্যারিয়ানার চোখে জল দেখেছিলাম, ও ভীষণ কেঁদেছিল আর বলেছিল, যুদ্ধে যেয়ো না এডোয়ার্ড। যুদ্ধে আমাদের কোন দরকার নেই। কিন্তু ম্যারিয়ানা জানতো না যে, আমাদের সরকার সৈন্যবৃত্তি গ্রহণ করাটাকে বাধ্যতামূলক করে দিয়েছে, যুদ্ধ করবার ইচ্ছা থাকুক কিংবা না থাকুক সবার গলায় একটা করে ব্রেনগান ঝুলিয়ে, যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠিয়ে দেয়া চাই-ই। আজ বার বার মনে হচ্ছে, ম্যারিয়ানা ঠিকই বলেছিলো, যুদ্ধে আমাদের কি লাভ? বুলেটের সামনে, কুকুর বেড়ালের মতো মরা, তীব্র সেলের আঘাতে হাত পা আর চোখ হারিয়ে চিরতরে অকর্মণ্য হয়ে যাওয়া ছাড়া আর কি পুরস্কারই আমরা পেয়ে থাকি?

একটুখানি চুপ করে এডোয়ার্ড আবার বললো— আমি জানি ম্যারিয়ানা আর আমায় গ্রহণ করবে না।

—নিশ্চয়ই সে গ্রহণ করবে। আমি তাকে আশ্বাস দিলাম।

—না-না-না, কি বলতে গিয়ে এডোয়ার্ড থেমে গেলো। তারপর অনেকক্ষণ কি চিন্তা করে ধীরে ধীরে বললো, হ্যাঁ, ম্যারিয়ানা হয়ত আমায় গ্রহণ করবে। কিন্তু নিশ্চয়ই সে আমায় নিয়ে সুখী হতে পারবে না, উঃ! আমি সব কিছু হারিয়েছি।

তখন বিশ্বাস হয়নি এডোয়ার্ডের কথা; কিন্তু যখন রক্তাপ্লুত মেঝের ওপর তাকে রিভলবার হাতে পড়ে থাকতে দেখলাম, তখুনি বিশ্বাস করতে পারছিলাম যে, এডোয়ার্ড আত্মহত্যা করেছে। রিভলবারের গুলিতে মাথার হাড়গুলো চারদিকে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পড়ে আছে।

এডোয়ার্ডের উত্তপ্ত মস্তিষ্কগুলোকে যখন মেঝের উপর থেকে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করা হচ্ছিল, তখনি জর্জ প্রলাপ বকতে আরম্ভ করলো। এরা আমার বাবাকে মেরেছে, আমার চার ভাইকে ধরে এরা কামানের মুখে জুড়ে দিয়েছে, আমায়ও মারলো এবং এরা আমায় বাঁচতে দিলো না। এরা কাউকে বাঁচতে দেবে না। সবাইকে মেরে ছাড়বে এরা। সবাইকে।

দুয়ারে মৃদু শব্দ হতে চমক ভাঙলো আমার। ঘড়িতে তিনটা বেজে গেছে। আমার পাওনা চারটে ঘণ্টার মধ্যে তিনটেই শেষ, এবার কে যেন দুয়ারে আরো জোরে শব্দ করলো, ওয়ার্ড ইনচার্জ-এর গলা শুনতে পেলাম, মিঃ চৌধুরী শীঘ্রি আসুন। চল্লিশ নম্বর সিটের রোগীটার অবস্থা ভীষণ খারাপ, ও আপনাকে খুঁজছে।

চল্লিশ নম্বর সিট। হ্যাঁ, জর্জের সিট নম্বর চল্লিশ। কিন্তু, সে আমায় খুঁজছে কেন? দেরি নয়, আলেস্টারটা গায়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। মৃত্যুর ক্রিয়া আরম্ভ হয়ে গিয়েছে ওর উপর, নিস্তেজ হয়ে এসেছে ওর দেহ। ওর মাথার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম, অতি জোর করেই বুঝি ও চোখ দু’টিকে মেলে, একবার চারদিকে চাইলো। আমার সাথে চোখাচোখি হতেই এক টুকরো ম্লান হাসি হেসে, ঈশারা করে কাছে ডাকলো। আমার মুখটাকে জোর করে টেনে নিয়ে ও-ওর মুখের উপর রাখলো। তারপর শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে মৃদু স্বরে কানে কানে বললো, আশীর্বাদ করো ডাক্তার। এরপর যেন এমন একটা দেশে জন্মাই, যেখানে ছোট ছেলেমেয়েদের ধরে ধরে এমন করে বলি দেয়া হয় না। আশীর্বাদ করো ডাক্তার। আ…..। কথা বন্ধ হয়ে গেলো চিরতরে। আরও কি বলতে চেয়েছিলো ও, কিন্তু পারলো না। আশ্চর্য হলাম আমি, এ কয়টা কথা বলতেই কি সে এতক্ষণ মৃত্যুর সাথে লড়াই করে বেঁচে ছিল? কিন্তু এ তো শুধু কথা নয়, ওর অন্তিম মুহূর্তের একটা বাসনা।

এডোয়ার্ড আর জর্জের আত্মা চলে গেছে দূরে সমুদ্র পারে; তাদের ছোট্ট গ্রামগুলোতে, বিরাটকায় সমুদ্র পোতের গহ্বরে ভরে যেখান থেকে তাদের চালান দেয়া হয়েছিল, দেয়া হয়েছিল যুদ্ধের শিকার হিসেবে বধ্যভূমির দিকে। উঃ! হে বিধাতা, যদি সত্যিই তুমি থেকে থাক, তা’হলে ওদের ক্ষমা করো না। উগ্র সাম্রাজ্যলোলুপতায় যারা লাখো সহায়-সম্বলহীন নিষ্পাপ মানুষকে হত্যা করে। কোটি কোটি নারীকে বৈধব্যের বেশ পরিয়ে দুঃখের হোমানলে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারে। তাদের তুমি ক্ষমা করো না। বিস্ময়ে রোষান্বিত হয়ে উঠেছিল প্রশস্ত কপাল। অবাক হয়ে গিয়েছি বৃদ্ধ লুইয়ের কথায়।

আর, রক্ত পিপাসুক, সাম্রাজ্যবাদের হাত থেকে নিজের দেশকে মুক্ত করার জন্য যাঁরা লড়াই করে, তাদের তুমি আরও শক্তি দাও প্রভু! তাদের তুমি আরও সাহস দাও।

কিন্তু আর দেরি নয়। রাত্রি প্রভাত হয়ে এলো প্রায়। ঘণ্টা কয়েক মাত্র বাকি, যুদ্ধশ্রান্ত সৈনিকরা সব এখন বিশ্রাম নিচ্ছে, সকালের আক্রমণ আরো শক্তিশালী করবার জন্য।

ফুলের চারা গাছগুলো হাতে নিয়ে বেরিয়ে এলাম, বাইরের উন্মুক্ত প্রান্তরে। বাঁ দিকে একটু এগিয়ে গেলেই সৈন্যদের গোরস্থান, সেখানেই আছে জর্জ, এডোয়ার্ডের কবর ও লুইয়ের সমাধি।

কে………ও? সরে গেলো জর্জ, এডোয়ার্ড আর লুইয়ের কবরের পাশ থেকে?

আশেপাশে কোন জনবসতি নেই জানি, কিন্তু এ কিশোরী মেয়ে কোত্থেকে এলো এখানে?

আমাকে কিছু ভাবতে না দিয়েই ও হাত দিয়ে আমায় কাছে ডাকলো। তারপর চোখ দিয়ে ইশারায় বললো, পিছে পিছে এসো। ও চলতে আরম্ভ করলো। কিন্তু, এক অপরিচিত মেয়ের পেছনে পেছনে আমি যাবো কেন?

চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। ও ফিরে দাঁড়ালো, ধীরে স্থির দৃষ্টিতে তাকালো আমার দিকে। উঃ কি তীব্র চাহনি। চোখ দুটো ঝলসে উঠলো আমার, চাপা আর্তনাদ করে উঠলাম, আসছি। তারপর পিছে পিছে এগিয়ে চললাম। একটা কথাও বললো না কিশোরী মেয়েটি। রীতিমত ভয় পেয়ে গেলাম। কোথায়? এবং কেন নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আমাকে?

কিসের পচা ভেপসা গন্ধ ভেসে এলো নাকে, হাত দিয়ে রুমালটা বের করে আনলাম পকেট থেকে, ক্রমশ আরও তীব্রতর হয়ে আসছে গন্ধটা। বমি করবার উপক্রম হলো আমার। তবুও এগিয়ে চললাম ধীরে ধীরে।

এক সময়ে মেয়েটা পিছন ফিরে দাঁড়ালো। অবাক হলাম, একটু আগে যে চোখ দিয়ে আগুনের ফুলকি ঠিকরে বেরিয়ে আসছিলো এখন সে চোখ দুটোকে কত শান্ত, স্নিগ্ধ আর আবেগপূর্ণ বলে মনে হচ্ছে, তুমি এখানে কি কাজ করো? মেয়েটির গলার স্বর আমার কানে সেতারের ঝঙ্কার দিয়ে গেলো, বিস্ময়ে কপালের রেখাগুলো কুঁচকে এলো আমার। কে……এ নারী। সাধারণ মহিলা না দেবী? মাথা নেড়ে উত্তর দিলাম।

—আমি এখানে ডাক্তারী করি।

—ডাক্তারী করো? আমাকে ডাক্তার বলে মেয়েটির যেন বিশ্বাস হলো না, এমনি ভাব করলো সে, তারপর বললো—

—ডাক্তার হয়ে তুমি এ গন্ধটা কিসের বলতে পারছো না?

—হ্যাঁ, হ্যাঁ নিশ্চয়ই। নাকের উপর থেকে রুমালটা সরিয়ে নিয়ে ভালো করে গন্ধটা পরীক্ষা করে দেখলাম আমি, তারপর বললাম, নিশ্চয়ই কোন জন্তু জানোয়ার মরে পচে আছে।

হাঃ! হাঃ! হাঃ! মেয়েটির বিকট হাসিতে শিউরে উঠলাম আমি, মনে হলো যেন রূপকথার কোন এক রাক্ষুসে মূলোর মতো দাঁত বের করে আমাকে ব্যঙ্গ করলো। হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছো, কতগুলো জন্তু জানোয়ার ওখানে মরে পচে আছে। ভ্রূ কুঁচকে কথা কয়টি বলে, এক অদ্ভূত বিজাতীয় হাসি টানলো মেয়েটি। দাঁতে দাঁত চেপে চাপা আক্রোশে বার বার উচ্চারণ করলো সে, জানোয়ার! জানোয়ার! তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। হাঃ! হাঃ! হাঃ! পূর্ণ দৃষ্টিতে মেয়েটি আবার তাকালো আমার দিকে। ভয়ে কাঠ হয়ে এলো সমস্ত শরীর। একি সেই শান্ত স্নিগ্ধ নারীমূর্তি। না এক জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ড!

হ্যাঁ, ওরা জানোয়ারই তো! নইলে এমন করে মরবে কেন? মেয়েটি আবার বললো। এতক্ষণে খেয়াল ভাঙলো আমার। কোথায় চলেছি আমি? কোন্ মরীচিকার পথে? ফিরে দাড়ালাম আমি, কিন্তু এগোতে পারলাম না এক পা-ও। পেছন থেকে ডাক এলো, ডাক্তার কি অদ্ভুত করুণায় ভেজা সেই আহ্বান। তুমি বড্ড অস্বস্তি বোধ করছো, নয় কি ডাক্তার? কিন্তু তোমায় আমার বড্ড প্রয়োজন আছে ডাক্তার।

মেয়েটির চোখে অসংখ্য অনুরোধ।

সামনে এগিয়ে চলতে চলতে মেয়েটি আবার বললো, ওই যে, ওই দেখ ডাক্তার! জানোয়ারগুলো কেমন করে পড়ে আছে।

শিউরে উঠলাম আমি। সামনে যতদূর দেখা যায়, শুধু মৃতের স্তূপ। কোন এক সময় হয়তো এরা মানুষ ছিলো, কিন্তু, সঙ্গীনের খোঁচায় আর বুলেটের আঘাতে দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এমন বিকৃতি লাভ করেছে যে ওদের মানুষ বলে ভাবা দুঃসাধ্য।

হঠাৎ মনে পড়ে গেলো, হাঃ! হাঃ হাঃ! সেই বিকট হাসি, মেজর কলিনসের দাঁত বের করা সেই প্রবল অট্টহাসি —হাঃ! হাঃ! হাঃ! আর টেবিলে চপেটাঘাত করে বলা সেই কথাগুলো—Struggle for existence। বাঁচবার জন্য আমরা সংগ্রাম করে যাবো! আর যত পারবো শত্রুদের হত্যা করবো। মানুষের কোন প্রয়োজন নেই আমাদের। মানুষ চাই না আমরা। আমরা, চাই মধ্যপ্রাচ্যের পেট্রোলিয়াম খনিগুলো। সোনা ফলানো শস্যভূমি আর বড় বড় কারখানাগুলো, আর চীন ভারতের মতো কলোনিগুলো, যেখানে আমরা আমাদের সমস্ত রদ্দি মালগুলো চালাতে পারবো। তার জন্য প্রয়োজন হলে আমরা রোগজীবাণু ছড়িয়ে দেবো ওদের ঘরে ঘরে। এটম বোম মেরে নিশ্চিহ্ন করে দেব ওদের। আর মেশিন গান দিয়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবো, ওদের শান্তির কপোতকে।

কোন্‌ পাপিষ্ঠরা এ নিষ্পাপ মানুষগুলোকে এমন করে হত্যা করেছে? নিজের অজ্ঞাতসারেই আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো কথা কয়টি।

—কি বললে ডাক্তার! মেয়েটি চকিতে আমার দিকে ফিরে চাইলো। তুমি ওদের পাপিষ্ঠ বললে? কিন্তু ওরা এ কথা শুনলে তোমাকেও এমনি করে মারবে। এরা তোমার চেয়েও অতি সামান্য কথা বলেছিলো, এরা শুধু বলেছিল আমরা যুদ্ধ চাই না। এ না চাওয়াটাই এদের কাল হয়েছে, ওরা এদের এক একটা করে ধরে এনে এখানে জড়ো করলো; আর নির্বিবাদে টিপে দিল মেশিন গানের ট্রিগার।

কিছুক্ষণ চুপ রইলো মেয়েটি। দূর সমুদ্রের বাতাসে ওর চুলগুলো উড়তে আরম্ভ করেছে। দাঁত দিয়ে ঠোঁট দুটোকে কামড়িয়ে ধরে, পায়ের নিচেকার রক্তে ভেজা মাটির দিকে চোখ দুটো নামিয়ে কি যেন ভাবলো, তারপর এক সময়ে আবার বলতে আরম্ভ করলো, কিন্তু কেন? কেন আমরা যুদ্ধ করবো? ওরাওতো আমাদের মা, ভাই, বোনের মত, ওদেরো ছেলেমেয়ে আছে, বাড়িতে সুন্দর ফুটফুটে বউ আছে, আরো আছে আত্মীয় পরিজন। ওদের আশা-আকাঙ্ক্ষা আছে, সাধ, স্বপ্ন আছে, যেমনটি আমাদের আছে, মানুষের কল্পিত একটা সীমারেখার এপারে, ওপারে বলেই কি আমরা পরস্পর শত্রু। তুমিই বলো ডাক্তার! সভ্যতার একি নিষ্ঠুর পরিহাস। মানুষকে সে মানুষের বিরুদ্ধে লড়বার জন্য প্ররোচণা দেয়।

আবার কিছুক্ষণ থামলো মেয়েটি, দূরে পূর্বাকাশে শুকতারাটা জ্বল জ্বল করছে, মেয়েটি একবার সে দিকে ফিরে চাইলো, তারপর ক্ষুদ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ব্যর্থতার তীব্র হুতাশনে ভেজা কণ্ঠে বললো, জীবনটা এ রকম হলো কেন ডাক্তার? কত স্বপ্ন ছিল আমার। যা নারীর চিরন্তন স্বপ্ন, একটা সুন্দর সুঠাম স্বামী, ফুটফুটে স্বাস্থ্যবান ছেলে, আর ফুর্তির জোয়ারে ঘেরা ছোট্ট একটা ঘর। কিন্তু একি হলো ডাক্তার? একি হল? যুদ্ধ আমাদের একি সর্বনাশ করলো। টপ টপ করে জল পড়ছিলো ওর চোখ দিয়ে। সান্ত্বনা দেবার কোন ভাষা খুঁজে পেলাম না— দেখ, দেখ ডাক্তার! ওই দু’বছরের ছেলেটি, সে ওদের কাছে কি অপরাধ করেছিলো, যার জন্য এ ক্ষুদ্র দেহটাকে ওরা বুলেটের আঘাতে ছিন্ন ভিন্ন করে দিয়েছে। দু’হাত দিয়ে চোখ ঢাকলাম, এ দৃশ্য দেখবার নয়, কিছুতেই নয়।

এই মুহূর্তে আট বছর আগেকার আর একটা ছবি, পাশাপাশি ভেসে উঠলো আমার চোখের সামনে।

পথে পথে মোড়ে মোড়ে আর রাস্তার আনাচে-কানাচে বসে বসে ঠুকছে, রক্ত মাংসহীন শবের দল, এক নয় দুই নয় হাজার হাজার। পথের কুকুর আর আকাশের শকুনদের ভোজসভা বসেছে নর্দমার পাশে। আধমরা মানুষগুলোকে টানা-হেচড়া করে মহা-উল্লাসে ভক্ষণ করছে ওরা। দ্বিতীয় মহাসমর। আর দুর্ভিক্ষ জর্জরিত সোনার বাংলা, চারদিকে শুধু হাহাকার, অন্ন নেই। বস্ত্র নেই! নেই! নেই! কিছু নেই! শুধু আছে দুর্ভিক্ষ, মহামারী, আর অভাব অনটন।

বলতে না বলতেই বাজার থেকে চালডাল সবকিছু গেলো অদৃশ্য হয়ে, আর হু হু করে বেড়ে গেলো জিনিসপত্রের দর। কালকের দু’ পয়সার পাউরুটি রাত না পোহাতেই হয়ে গেলো দু’আনা। তারপর চার আনা। পাঁচ টাকা মণের চাল তা কিনা চোখের পলক না ফেলতেই গিয়ে ঠেকলো পঞ্চাশের কোঠায়।

চিতার পর চিতা জ্বলে উঠলো সোনা ফলানো দেশের পল্লীতে পল্লীতে, মাটি খুঁড়ে কবর দেবার অবসর কই? খরস্রোতা নদীগুলোও যেন ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, মরা টানতে টানতে।

শান্তিপ্রিয় মানুষ সব ভীত, ত্রস্ত এই বুঝি সাইরেন বাজবে, আর সাথে সাথে আরম্ভ হবে নরহত্যা যজ্ঞ। এক মুহূর্তে বুঝি ধ্বংস হয়ে যাবে মানুষের বহু কষ্টে গড়া ওই সুন্দর শহর, বহু মূল্যবান মিউজিয়াম আর বহু সাধনার পর সৃষ্ট ওই বিশাল পাঠাগার।

এই বুঝি পুড়ে ছাই হয়ে গেলো কৃষকের রক্ত দিয়ে বোনা পাটের গাছগুলো, আর শ্রমিকের একমাত্র মাথা গুঁজবার সম্বল খোলার ঘরটি। বহু কথা, বহু ছবি, এক নিমেষে, চলচ্চিত্রের মত রেখাপাত করে গেলো আমার মানসপটে |

গরিব চাষী রহিম শেখের চোখে ঘুম নেই। ঘুম নেই ওর লিকলিকে বৌটির চোখে, আর অবলা মেয়েটির চোখে, পেটের অশান্ত পোকাগুলোর তীব্র দংশনে ছটফট করছে ওরা, ঘুম কি করে আসবে।

ইজ্জত গেল! ইজ্জত গেল ওদের। মান-সম্মান নিয়ে বাঁচা বুঝি দায় হয়ে পড়লো এবার। শিকারি কুকুরের মত ওঁত পেতে আছে গোরা সৈন্যগুলো সব। বদ্ধ দোরের আড়াল থেকে দুরু দুরু বুকে কাঁপছে গ্রাম্য তরুণীরা। মাতৃময়ী বাঙ্গালি নারীর দেহ নিয়ে চারদিকে চলছে ছিনিমিনি খেলা, অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তানরা সব ইতস্তত ছড়িয়ে আছে। আঁস্তাকুড়ের ছাইয়ের গাদায়, শহরের নর্দমায়, আর জলপচা খানা ডোবায়।

এক হাত কাপড়। শুধু এক হাত কাপড় আর এক মুঠো ভাতের জন্য ওরা বিক্রি করে দিচ্ছে ওদের আপন পেটের ছেলেমেয়েকে আর কলমা পড়ে বিয়ে করা বৌকে।

কি একটা অদ্ভুত পরিবর্তন। শুধু একটা মহাসমর। আর মানুষগুলোকে পৌঁছিয়ে দিয়ে এলো আদিম যুগের নরখাদকের দেশে।

জানো ডাক্তার? মেয়েটির গলার স্বরে হঠাৎ চিন্তার স্রোতটা মাঝপথেই বাধাপ্রাপ্ত হলো, চেয়ে দেখলাম মেয়েটি আবার বলতে আরম্ভ করেছে— এ পৃথিবীতে বিচার বলে কিছু নেই। বিচার যদি থাকতো, তাহলে এ বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের অপরাধীদের কেউ বিচার করলো না কেন? ওদের রচিত আইনে আছে, প্রাণের পরিবর্তে প্রাণ, যার আশ্রয় নিয়ে ওরা দৈনন্দিন কত নিরাপরাধীকে ফাঁসে ঝুলিয়ে মারে। কিন্তু ওদের বেলায় এ আইন কোথায় গেল? তুমিই বল ডাক্তার! পৃথিবীর ইতিহাসে এতবড় হত্যাকাণ্ড আর কোনদিন ঘটেছিল কি? দেখো, সেই খুনী আসামীদের মানুষগুলো সব মাথায় তুলে নাচছে, গলায় মালা পরিয়ে বলছে— পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বীর! অদ্বিতীয় মহামানব।

আবার কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো ও, বাতাসের মৃদু প্রতিধ্বনি ছাড়া আর কোন শব্দ নেই, দূরে ফ্রন্টের সৈন্যদের ঘুম আরো ঘনীভূত হয়ে এসেছে, ভোরের হিমেল হাওয়ার মৃদু পরশে।

ডাক্তার। আবার ওর কণ্ঠস্বর শোনা গেলো, তোমার কাজের খুব ক্ষতি করে ফেললাম ডাক্তার। কিছু মনে করো না, ভোর হয়ে এলো প্রায়। দেখছ না। আকাশের তারাগুলো সব একে একে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে?

আমি চুপ, ও আবার বললো— আচ্ছা ডাক্তার, বর্তমানে পৃথিবীতে মানুষের সবচেয়ে মারাত্মক ব্যাধি কোন্‌টা বলতে পারো?

হঠাৎ এ প্রশ্নের হেতু? নিজের মনকেই নিজে প্রশ্ন করলাম প্রথমে, তারপর উত্তর দিলাম— হ্যাঁ, প্লেগ, যার দ্বারা আক্রান্ত হলে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে মানুষ মারা যায়!

—অদ্ভুত কথা শুনালে ডাক্তার। ভ্রূজোড়া কপালে উঠে এলো মেয়েটির। প্লেগ! প্লেগ একটা রোগ তা জানি, সে রোগের ঔষধ আবিষ্কার করবার জন্যও তোমরা অনেক চেষ্টা করছো। কিন্তু আশ্চর্য ডাক্তার, যুদ্ধ নামক যে ব্যাধিটা ঘণ্টায় হাজার হাজার মানুষের জীবন নাশ করে চলেছে, তার প্রতিরোধের জন্য তোমরা কি করছো? তোমরা রোগের চিকিৎসা করো, একটা মানুষকে বাঁচাবার জন্য তোমাদের কত সাধ্য সাধনা, কত সংগ্রাম। কিন্তু লাখো মানুষের মৃত্যুকে তোমরা নির্লিপ্তের মতো উপেক্ষা করে যাচ্ছো কেন?

শুধু বিস্মিত হলাম না, অবাকও হলাম, এ নারী বলে কি?

ও আবার বললো— একটা কাজ করতে পারবে ডাক্তার। একটা মহৎ কাজ।

মুখ ফুটে কিছু বলতে হলো না আমার চোখ দুটোই জানিয়ে দিল— কি কাজ, আগে সেটাই বলো, পারিতো নিশ্চয়ই করবো।

—ভয় পেয়ো না ডাক্তার। তোমায় আমি এমন কোন কাজের ভার দেবো না, যা তুমি বইতে পারবে না। ও এবার আমার দিকে পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। আমি অবাক হলাম, ওর চোখের পলক পড়ে না কেন? ও বলতে আরম্ভ করলো— তোমায় আমি বলবো না যে, তুমি যুদ্ধটা থামিয়ে দাও, শান্তিপ্রিয় মানুষগুলোকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাও। কারণ তা তোমার একার কাজ নয়। তুমি একা তা পারবে না।

ওর দৃষ্টি তখন দূর দিগন্তের সীমারেখার দিকে প্রসারিত। চোখের তারায় তারায় স্ফুলিঙ্গ দেদীপ্যমান। ও আবার বলে চললো— কিন্তু একটা কথা জানো ডাক্তার? মাটির মানুষগুলো নিশ্চয়ই একদিন জাগবে। আর শয়তানদের মুখোশ খুলে ফেলবে তারা। তাদের জাগরণের দুর্বার স্রোতে কোথায় ভেসে যাবে যুদ্ধের দালালরা আর অত্যাচারী ধনকুবেররা তখন একটা নূতন পৃথিবীর সৃষ্টি হবে, যেখানে দুঃখ, দুর্দশা অভাব অনটন বলে কিছু থাকবে না, মানুষে মানুষে এত ভেদাভেদ, এত হিংসা-বিদ্বেষ, সব কিছুর অবসান হবে।

আর পৃথিবীতে স্বর্গের প্রতিষ্ঠা হবে, নয় কি ডাক্তার।

—কি কাজ তা তো এখনো বললে না তুমি। ওর কথার মাঝখানেই বাধ দিলাম। যদিও ওর কথাগুলো বাঁচবার উদ্দীপনা আর নূতন সৃষ্টির প্রেরণা দিচ্ছিল আমাকে। কিন্তু সময় বড্ড কম।

—হ্যাঁ ডাক্তার। কাজের কথাটাই বলবো এবার তোমায়। মেয়েটি এবার ডান দিকে ঘুরে দাঁড়ালো, তারপর সামনে একটা ঝোপের দিকে আঙ্গুল নির্দেশ করে বললো— ওই যে ডাক্তার, চেয়ে দেখ, গাছের আড়ালে একটা দালানের ভাঙ্গা কার্নিশ দেখা যাচ্ছে, দেখতে পাচ্ছ না? ও জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো আমার দিকে, হ্যাঁ, আবছা দেখতে পাচ্ছি। আমি সায় দিলাম।

তোমাকে সেখানে যেতে হবে ডাক্তার।

কিন্তু কেন?

আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে এক অদ্ভুত হাসি খেলে গেলো মেয়েটির দু’ঠোঁটের মাঝপথ দিয়ে, আমি শপথ করে বলতে পারি, অমন ব্যথাতুর হাসি আমার জীবনে আমি কাউকে হাসতে দেখিনি।

বললো, যাও ডাক্তার! নিজ চোখে দেখবে।

—কি ভাবছো ডাক্তার? আমার অন্যমনস্ক মুখের দিকে তাকিয়ে ও আবার প্রশ্ন করলো।

—হুঁ!—কই কিছু না তো!

হ্যাঁ, নিশ্চয়ই তুমি কিছু ভাবছিলে।

—ভাবছিলাম? ও … …. … হ্যাঁ, ভাবছিলাম তোমার কথা।

… … … আমার কথা?

হ্যাঁ, ভাবছিলাম পৃথিবীর প্রত্যেকটা লোক যদি তোমার মতো হতো, তাহলে কি সুন্দরই না হতো এ পৃথিবীটা।

—ও … … …! মেয়েটি এবার আমার দিকে থেকে মুখ ফিরিয়ে ধীরে ধীরে পূর্ব দিকে তাকালো, অন্ধকার দূর হয়ে ফর্সা হয়ে আসছে আকাশ। আর দাঁড়ালাম না সেখানে, এগিয়ে চললাম সেই ভাঙা কার্নিশটা লক্ষ্য করে। কিছুদূর এসে একবার পিছন দিকে ফিরে চাইলাম, ও দাঁড়িয়ে আছে, নিথর নিষ্কম্প, পলকহীন চাহনি, তারপর গুনে গুনে আরও গোটা পঞ্চাশেক পদক্ষেপ সামনে এসে আর একবার ফিরে চাই, নেই ও নেই, ওর চিহ্নও নেই।

কাদের পদশব্দ। মাটির ওপর ভারি বুট জুতার আওয়াজ না? এক নয়, অনেক। গাছের আড়ালে আত্মগোপন করে দাঁড়ালাম, থাকি ইউনিফর্ম পরা সৈন্যগুলো হুড়োহুড়ি আর ধাক্কাধাক্কি করে ঘরের ভেতর গিয়ে ঢুকলো, তারপর … … … অনেকক্ষণ … … … অনেক উদ্বেগপূর্ণ মুহূর্ত কেটে গেলো, অপেক্ষায় আছি, ওরা কখন বেরুবে। হ্যাঁ, এক সময় ওরা বেরিয়ে এলো, এলোমেলো উস্কখুস্ক চুল, খেলাহীন পদবিক্ষেপে ওরা একের গায়ের উপর অন্যে হেলে পড়লো আর মাঝে মাঝে এমন বিশ্রী কতগুলো শব্দের উচ্চারণ করতে লাগলো, যা সভ্য মানুষকে বলতে আমি কোনদিনও শুনিনি।

রুদ্ধ নিঃশ্বাসে আরো কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে রইলাম। ওরা ধীরে ধীরে কুয়াশার ভেতর অদৃশ্য হলে গেলো।

অনেক দিনের পুরোনো বাড়ি। দেয়ালে চুনকাম পড়েনি, তাও কয়েক বছর হবে। মরচে পড়া জানালা দরজাগুলো কোন রকম ঝুলে আছে। ঘরের দেয়ালে অসংখ্য মাকড়সার জাল। দেয়ালে টাঙানো একখানা ফটো। কে? … … … চমকে পিছিয়ে এলাম দু’হাত। আধভাঙা ডেসিং টেবিলের উপর দাঁড়িয়ে ফটোটা নামিয়ে নিলাম, অতি সন্তর্পণে। রুমাল দিয়ে ধুলোবালিগুলো ঝেড়ে নিলাম, তারপর দু’চোখে ভরে তার দিকে তাকালাম। সেই অপরূপা তরুণী, মুখের কোণে স্নিগ্ধ হাসির রেখা, নিচে ছোট করে লেখা নাম-লু-ই-সা।

ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারটা টানতেই খুলে গেলো, অনেকগুলো খাতা-পত্র সাজানো রয়েছে, থাকে থাকে, শুধু ধুলোবালি জমে আছে চারপাশে। একখানা খাতা হাতে তুলে নিলাম, কবিতার খাতা, প্রথম পৃষ্ঠাতেই লাল কালিতে লেখা বড় বড় করে কটা লাইন।

যুদ্ধ আমি চাই না, কারণ, যুদ্ধ এমন একটা ব্যাধি যে শুধু দুর্বল এবং রোগা লোকের জীবন হরণ করে না, সুস্থ সবল এবং সতেজ মানুষকেও হত্যা করে।

আমি শান্তি চাই, কারণ—শান্তি মানুষকে—তারপর পাতার পর পাতা উল্টে গেলাম। আর দেখে গেলাম, কবিতার পর কবিতা; শেষের কবিতা একটু শব্দ করেই পড়লাম—

হে আমার ভীরু মন

চলার পথে কভু যদি—

উন্মত্ত সাগর কিবা—

ক্ষুধিত ব্যাঘ্রেরও

সম্মুখীন হই।

তুমি আমারে পিছিয়ে এনো না।

শক্তি দিয়ো সাহস দিয়ো!

যেন— সে সাগর আমি ডিঙ্গাতে পারি।

সে বাঘ যেন হত্যা করতে পারি।

আর— আমার

রুটি, রুজি আর অধিকারের

দাবি নিয়ে যখন

আমি এগিয়ে যাবো।

সামনে উদ্ধৃত রাইফেল দেখে,

তুমি আমার মাথা নত করে দিও না।

আমার রুগ্ন মায়ের কথা চিন্তা করে

আমার নগ্ন বৌ-এর

সকরুণ চাহনির কথা মনে করে

আর— আমার হতভাগা

শিশুর শোচনীয় মৃত্যুর

কথা স্মরণ করে

তুমি আমাকে রুখে

দাঁড়াবার সামর্থ্য দিয়ো!

শক্তি দিয়ো!

যদি ওরা গুলি চালায় চালাতে দাও।

ভীত হয়ো না তুমি— কত

মারবে ওরা?

শত?…….হাজার? লক্ষ? কোটি?

এরচেয়েও বেশি?

না-গো-না, ওদের গুলি

ততক্ষণে ফুরিয়ে যাবে।

আর— এক কোটি প্রাণের

পরিবর্তে শতকোটি

প্রাণ মুক্তি পাবে—

শোষণের জিঞ্জির হতে।

পড়া শেষ করে খাতাগুলো ড্রয়ারের ভেতর রেখে দিলাম। হাতঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠলাম, বেলা এগারোটা। খক্ ….. খক্ করে কে যেন কাশলো, আশেপাশে কোথায়। তারপর অস্পষ্ট কাতরানির শব্দ— মাগো।….আর যে পারি না মা।

পাশের রুমে ঢুকতেই মেঝের উপর অনেকগুলো বোতলের ভগ্নাবশেষ ইতস্তত বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখলাম। মেঝেটা একেবারে ভিজে স্যাঁতসেঁতে হয়ে আছে। পকেট থেকে রুমাল বের করে নাকে চাপলাম, পচা মদের গন্ধ বাতাসে বিষ ছড়াচ্ছে।

তারপর যে রুমটিতে পা দিলাম, সেটা একটা লম্বা হল রুম। সামনে একটা জ্যান্ত বাঘ দেখলেও বুঝি এত চমকাতাম না আমি যেমন করে চমকে উঠলাম। শুধু অবাক হলাম না, শরীর যেন হিম হয়ে এলো আমার। শরীরের তন্ত্রীগুলো এক মুহূর্তের জন্য অচল থেকে আবার সচল হয়ে এলো, পা দুটো দু’বার ঠক্‌ঠক্‌ করে কেঁপে তারপর স্থির হলো। ঝাপসা দৃষ্টিশক্তিকে আরো প্রসারিত করে আমি ওদের দিকে তাকালাম।

উলঙ্গ। একেবারে উলঙ্গ, বিবস্ত্রা নারী দেহ সব ছড়িয়ে আছে মেঝের উপর, এখানে ওখানে, ইতস্তত বিক্ষিপ্ত মাটির ঢেলার মতো। শেকল দিয়ে বাঁধা রয়েছে ওদের শীর্ণ হাতগুলো, দেয়ালের আটার সাথে। কাতরাচ্ছে ওরা— মাগো! আর যে সইতে পারি না মা।

কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। উঃ! বার কয়েক ঘুরপাক দিয়ে উঠলো মাথাটা। মানুষগুলো সব কি পশু হয়ে গেল নাকি? মনুষ্যত্বের এতটুকু নিদর্শনও কি তাদের ভেতর অবশিষ্ট নেই। অসংযত পা দুটো খুট করে শব্দ করে উঠলো, ক্ষুধিত সিংহের সামনে পড়লে, নিরস্ত্র মানুষ যেমন ভয়ার্ত চিৎকার করে ওঠে, ওরাও ঠিক তেমনি আর্তনাদ করে উঠলো, মাগো। এবার আর বাঁচবো না। আর, তারপর— কোটরে ঢোকা চোখগুলো উলঙ্গ করে, আমার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ওরা। অজস্র অভিশাপ ঝরে পড়ছে ওদের ও চোখগুলো থেকে। ওরা অভিশাপ দিচ্ছে, ওদের জন্মদাতাকে; মানুষের আদিম বন্যতাকে, আর— ওদের জীবন-যৌবন হরণকারীদিগকে।

—হাঃ —হাঃ! হাঃ! আবার মেজর কলিনসের সেই অট্টহাসি। আবার রক্তাক্ত সূরা হাতে বলে যাওয়া, মেজর কলিনসের সেই কথাগুলো, — হাঃ! হাঃ!! হাঃ! ইরান, তোরান আর মিসরের নেকাব পরা মেয়ের মোমের মতো দেহগুলো আমাদের স্থায়ী সম্পত্তি হয়ে রইবে। রাশ্যার উজবেকি আর কাজাকি তরুণীর শালীনতাকে বুকে ছুরি হেনে, ওদের ন্যাংটা নাচাবো আমরা, ভারতের লজ্জাবতী মাংস-পিণ্ডগুলোর ঘোমটা উল্টিয়ে আমরা চুমো খাব। আর আমাদের কামনা চরিতার্থের জন্য ওদের আমরা ব্যবহার করবো। ঠিক জুতো আর মুজোকে আমরা যে রকম ব্যবহার করে থাকি।

যন্ত্রচালিতের মতো এসে দাঁড়ালাম ওদের পাশে। অবাক হলো ওরা, যখন আমি ওদের বাঁধনগুলো একে একে খুলে দিতে লাগলাম। ওদের ভয় দূর হলো, লজ্জা এসে পূরণ করলো ভয়ের স্থান, ওরা শীর্ণ হাত দুটো দিয়ে বুকটাকে ঢেকে, পাশের ঘরটাতে পালিয়ে গেলো। সব শেষ, শুধু আর একটি মাত্র বাকি, ওর বাঁধনটা খুলতে গিয়ে ইলেকট্রিকের সক্ পাওয়ার মতো আমি লাফিয়ে উঠলাম। এত ঠাণ্ডা, এত শীতল।

—হতভাগী মেয়েটা মারা গেছে। গলার স্বরটা কেঁপে উঠলো আমার। আর সাথে সাথে একটা মেয়ের করুণ চিৎকার শোনা গেলো পাশের ঘর থেকে— দিদিগো! দি—দি। ঝড়ের বেগে সে ছুটে এলো আমার সামনে মৃতা মেয়েটির পাশে, আর তার উপুড় হয়ে পড়ে থাকা দেহটাকে ধরে চিৎকার দিলো প্রথমে, তারপর ওর বুকের ভেতর মুখ গুঁজে কান্নার জোয়ারে ভেসে পড়লো মেয়েটি। কে?—লু-ই-সা? অবাক বিস্ময়ে বোবা হয়ে রইলাম আমি। হ্যাঁ, লু-ই-সাই বটে। মৃতা তরুণীটি লুইসারই প্রতিকৃতি স্মরণ করিয়ে দিয়েছে আমায়।

ওঘর থেকে একজন চিৎকার করে বললো ওর নাম, লু-ই-সা, আজ দু’দিন ধরে ভীষণ ছটফট করছিলো ও।

—কাল বিকেলে ওকে আমি ‘একফোঁটা জল, এক ফোঁটা জল’ বলে চিৎকার করতে শুনেছি। বললো, আর একজন।

গায়ের আলেস্টারটা খুলে লুইসার নগ্ন দেহটা ঢেকে দিলাম আমি। প্রচণ্ড শীতের ভেতরেও আমার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের ফোঁটা দেখা দিল। হতবিহ্বল নেত্রে আমি চেয়ে রইলাম, লুইসার শুকনো মুখটার দিকে। ওর জিভটা এখনও বেরিয়ে আছে, দাঁতের ফাঁক দিয়ে। মনে হলো সে চিৎকার করে বলছে— এক ফোঁটা জল। এক ফোঁটা জল। ওর ছোট বোনটা তখনও কাঁদছে, আরও চেঁচিয়ে আরও করুণ গলায়। আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে ওকে সান্ত্বনা দিতে চাইলাম, ফোঁস করে ও সাপের মতো ফণা তুলে দূরে সরে গেলো। উঃ! এ খাকি পোশাকের প্রতি কি অদ্ভুত ঘৃণা জমে আছে ওদের বুকের পাঁজরে পাঁজরে।

আবার পদশব্দ! বেশি নয় অল্প কয়েকটা। পাশের ঘরের মেয়েগুলো নিঃশ্বাস নেওয়াও বন্ধ করে ফেললো নাকি? নইলে এত গভীর নীরবতা কেন? কিন্তু ডাকবার অবসর কোথায়। লুইসার ছোট বোনটা, বার কয়েক হুমড়ি খেয়ে ঘর ছেড়ে পালিয়েছে তার মৃতা বোনটিকে ফেলে। নরখাদকের গন্ধ পেয়েছে তাই তারা পালাচ্ছে।

চোখ ফিরাতেই চেয়ে দেখলাম সামনে দাঁড়িয়ে মেজর কলিনস্। মেজর কলিনস্ হাসছে আর বলছে—হাঃ! হাঃ! তুমিও ফুর্তি করতে এসেছো ডাক্তার? হ্যাঁ ফুর্তি করো, ফুর্তি করো ডাক্তার! আমাদের সৈন্যরা ওদের ত্রিশটা গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। ফুর্তি করো ডাক্তার। ফুর্তি করো।

হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। অনুভব করলাম জর্জ, এডোয়ার্ড আর লুইয়ের আত্মা এসে ঘিরে দাঁড়িয়েছে আমায়, লুইসা আমার কানে কানে বলছে, ডাক্তার। —লাখো হাজারো মানুষের ছিন্নভিন্ন দেহের কথা কি এত শিঘ্রই তুমি ভুলে গেলে?

শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে প্রচণ্ড বেগে মেজর কলিনসের মুখে আমি বসিয়ে দিলাম চড়।

শান্তি সংগ্রামে আমার প্রথম পদক্ষেপ।

 

রচনাকাল : নভেম্বর, ১৯৫২