লোকটাকে এর আগেও ক’দিন দেখেছে মন্তু। হ্যাংলা রোগাটে দেহ। তেলবিহীন উস্কোখুস্কো চুল। লম্বা নাক, খাদে ঢোকা ক্ষুদে ক্ষুদে দু’টি চোখ; সেক্রেটারিয়েট থেকে বেরিয়ে ক্লান্ত দেহটা টেনে টেনে নবাবপুরের দিকে এগোয়। কদাচিৎ বাসে চড়ে।
বাস স্টান্ডের পাশে দাঁড়িয়ে আপন মনে একটা আধপোড়া বিড়ি টানছিলো আর লোকটাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিলো মন্তু।
পঞ্জিকার হিসেবে মন্তু এবার পনের-এর ব্যূহ ভেদ করবে। অর্থাৎ নাবালকের ডিঙ্গি থেকে সাবালকের ডাঙ্গায় পা দেবে। বয়স সবে পনের হলেও নিদেনপক্ষে বার পাঁচেক জেলের হাওয়া খেয়ে এসেছে মন্তু-মন্তু শেখ।
ভাবতে গেলে জীবনটাই অদ্ভুত মন্তুর।
আরও অদ্ভুত লাগে, যখন সে নিজে বসে বসে তার ফেলে আসা দিনগুলোর কথা ভাবে।
সুখীয়াল স্বপ্নে ভরা দিন।
তখন নেহায়েৎ বাচ্চা ছিলো মন্তু। সূর্য উঠতেই ক্ষেতের আইলে বাবার জন্য হুঁকো আর পান্তা নিয়ে হাজির হতো সে। বাবা জমিতে হালচাষ করতেন; মই দিতেন; আর ধান বুনতেন!
বছর শেষে যা ফসল ঘরে আসতো, তা দিয়ে কোন রকমে দিন চলে যেতো ওদের। বাবা বলতেন, মন্তুরে আমার লেখাপড়া শিখামু। ইসকুলে পাঠামু ওরে।
কি যে কও মিয়া! লেখাপড়ার আবার কদর আছে নাকি আজকাইল। নূরু চাচা বোঝাতেন বাবাকে। উয়ার চাইতে ক্ষেতের কাজ ভালা। ভালা কইরা চাষ কইরলে সোনা ফলে। মন্তুরে ক্ষেতের কাজ শিখাও।
না বাপু, তা অইবার নয়। মৃদু মৃদু ঘাড় নাড়তেন বাবা।
বাবার চোখে স্বপ্ন ছিলো।
সে স্বপ্ন ভাঙতে দেরি হলো না।
তখন যুদ্ধের মওসুম। সৈন্যরা এসে জমিগুলো সব দখল করে নিলো ওদের। সেখানে ঘাঁটি করবে ওরা। প্লেন ওঠানামার ঘাঁটি।
সৈন্যরা এলো।
সাথে নিয়ে এলো অসংখ্য ট্রাক, লরি আর বুলডোজার।
আরো যে দুটো জিনিস সাথে করে এনেছিল ওরা, তা হলো দুর্ভিক্ষ আর মহামারী।
দুর্ভিক্ষের করালগ্রাসে বাবা, মা, ভাই, বোন সবাইকে হারালো মন্তু। গাঁও ছেড়ে দলে দলে লোক ছুটছে শহরের পথে। সারি সারি লোক চলছে তো চলছেই। তেমনি একটা দলের সাথে শহরে চলে এলো মন্তু।
শহর নয়তো প্রেতপুরী। পথে ঘাটে, ডাস্টবিনে মৃতের ছড়াছড়ি। অলিতে গলিতে অসংখ্য ক্ষুধিতের মিছিল। সে মিছিলে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল মন্তু। এমনি সময় দেখা ওর জুলমত সিকদারের সাথে। শহরে তখন পকেটমারের এক বিরাট ব্যবসা ফেঁদে বসেছে জুলমত। মন্তুকে দেখে বললো, এখানে কেন পড়ে পড়ে মরছিস বাপু। আয় আমার সাথে আয়। রোজগারের বন্দোবস্ত করে দেবো!
জুলমতের কাছেই প্রথম হাতেখড়ি পড়লো মন্তুর। কালু, মতি, হীরা ওরাও ছিলো ওর সাথে। মতি নাকি সম্প্রতি ব্যবসা ছেড়ে কোন এক মন্ত্রীর কনফিডেন্সিয়াল এ্যাসিস্ট্যান্ট হয়েছে। চালাক ছেলে বটে, লোকে বলে মানিকে মানিক চেনে। একবারে খাঁটি কথা।
বিড়িটা শেষ হতে কায়দা করে সেটা নর্দমায় ছুড়ে ফেলে দিয়ে চকের দিকে এগুতে লাগলো মন্তু।
হোটেলে ঢুকে পেট ভরে ভাত খেয়ে নিল সে। তারপর ওহিদ আলীর পানের দোকান থেকে কিমাম দেয়া একটা পান মুখে পুরে আর একটা বিড়ি ধরালো।
কিরে মন্তু, আইজকা কিছু রোজগার অইল? ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করলো ওহিদ আলী। আরে, মরদ কি কোন দিন খালি হাতে ফেরে। মুখের কোণে গর্বের হাসি টেনে পকেট থেকে একটা জ্বলজ্বলে আংটি বের করে ওহিদ আলীকে দেখালো মন্তু।
বিস্ময়ে চকচক করে উঠলো ওহিদ আলীর চোখ দুটো। মন্তু তখন আবার চলতে আরম্ভ করেছে।
আংটিটার জন্য আজ সারাটি সকালটা হয়রান হতে হয়েছে ওকে। বাব্বাঃ যেমন ছেলে তেমনি মেয়ে। আংটি একটা কিনবে তো তিন ঘণ্টা ধরে তিনশ তিরিশটা আংটি পরখ করে তারপর কিনলো এটা। ছেলেটা বললো, নাও, হাতে পরে নাও তোমার।
না, এখন না, পরে পরবো। মেয়েটা বললো, কোটের পকেটে রেখে দাও তোমার।
মন্তুর বরাত! বরাত জোরই বলতে হবে। নইলে এই পকেটমারের যুগে কোটের পকেটে ভুলেও কেউ অলঙ্কার রাখে।
জেল রোডের মোড়ে এসে আংটিটাকে আর একবার পরখ করে দেখলো মন্তু। উঁচু দেয়ালে ঘেরা জেলটার দিকে চোখ পড়তে বিনয়ের সাথে জেলকে একটা সালাম ঠুকলো সে। জেল তার গুরু। এ কথা স্বীকার করতেই হবে।
একবার জেলে গেছে পাঁচ দশটা নতুন রকমের প্যাঁচ, নতুন রকমের কলা-কৌশল আয়ত্ত করে রেখেছে সে। গুরু মানবে না কেন? গুরুই তো। গুরুকে আর একটা সালাম ঠুকলো মন্তু। আংটিটা তখনও মুঠোর মধ্যে ওর।
পরীবানুর ছবিটা চোখের পাতায় ভেসে উঠছে এখন।
নবী সিকদারের লাল টুকটুকে নাতনী পরীবানু। একদিন এ আংটিটা আঙুলে পরেই মন্তুর পাশে এসে দাঁড়াবে সে। পরীবানু। পরীবানু নয় ফুলপরী। ও নামেই ওকে ডাকে মন্তু। ও নামেই আদর করে ওকে। সিকদার ব্যাটা বড় মিটমিটে লোক। সেদিন বললে, এত ফুচুর-কাছুর ভালো লাগে না মিয়া। বিয়ে করতে চাও তো বলো। মোল্লা ডেকে কলমা পড়িয়ে দিই।
হক কথা। এই তো চায় মন্তু।
চাইলেই হলো। অলঙ্কার পত্তর নেই, কিছু নেই, মেয়ে কি মাগনা নাকি? ব্যাটা সিকদার এক মুখে চার কথা বলে। তিনপদ অলঙ্কার ফেলে দাও দিখিনি। এখনই নাতনীকে হাতে তুলে দিচ্ছি তোমার। শালা— চামার, চামার।
মন্তুকে বুঝেছে কি সে? তিনপদ অলঙ্কার বুঝি জোটাতে পারবে না মন্তু। এইতো আজকেই জুটিয়ে ফেলেছে সে একপদ। আর দু’পদে কয়দিন লাগবে। এক হপ্তা কি পনেরো দিন। বড় জোর এক মাস তারপর— তারপর ভাবতে ভাবতে রোমাঞ্চিত হলো মন্তু।
বংশালের মাথায় এসে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়ালো সে।
মুকুলে একটা ছবি এসেছে। কালু বলেছে বড়ো মজাদার ছবি। শেষ শো’তে একটি চান্স নিলে মন্দ হয় না। আপন মনে কয়েকটা শিস্ দিলো মন্তু।
শো শেষ হলো রাত বারোটায়। কালো মেঘে ঢাকা গাঢ় অন্ধকার আকাশ বেয়ে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে তখন। হল থেকে বেরিয়ে, সোজা রাস্তায় এসে নামলো মন্তু। বগলে ওর সদ্য হাত সাফাই করা একটা বাঘ মার্কা ছাতা।
ছাতাটা মেলে ধরে জনশূন্য নবাবপুর রোড বেয়ে এগিয়ে চলতে বেশ লাগছিলো মন্তুর। গুনগুন করে সদ্য দেখা সিনেমার দু’কলি গান ভাজতে লাগলো সে।
হঠাৎ পেছনে কার পায়ের শব্দে ফিরে তাকানো মন্তু। একটু ভালো করে তাকাতে চিনলো সে। সেই লোকটা— সেক্রেটারিয়েট থেকে বেরিয়ে ক্লান্ত দেহটা টেনে টেনে রোজ যে নবাবপুরের দিকে এগোয়। হ্যাংলা—রোগাটে দেহ। তেলবিহীন রুক্ষ্ম চুল। লম্বা নাক। খাদে ঢোকা ক্ষুদে ক্ষুদে দু’টি চোখ। মন্তুর মনে হলো লোকটা যেন পিটপিট করে তাকাচ্ছে ওর দিকে। না, ঠিক ওর দিকে নয়, ওই ছাতাটার দিকে।
ছাতার বাটটা শক্ত করে চেপে ধরলো মন্ত্ৰ।
বৃষ্টিটা আরও একটু জোরে আসতেই লোকটা পা চালিয়ে ছাতার নিচে এসে দাঁড়ালো মন্তুর। উঃ এ বৃষ্টিতে ভেজা মানে নির্ঘাত নিউমোনিয়া। একটা ম্লান হাসি ছড়িয়ে মন্তুর দিকে তাকালো সে। গা-টা জ্বলে উঠলো মন্তুর। ইচ্ছে হলো এখনি ধাক্কিয়ে লোকটাকে রাস্তার একপাশে ফেলে দিতে। কিন্তু লোকটার হ্যাংলা দেহটার কথা ভেবে তা করলো না মন্তু। শুধু বার কয়েক চোখ পাকিয়ে পাকিয়ে দেখলো তাকে।
আপনি কোনটায় গেছলেন। কথা না বলাটা অভদ্রতার পরিচয়, তা ভাল করেই জানে মন্তু।
কোনটায় মানে?— আপনি কি বলছেন আমি ঠিক বুঝতে পারছিনে।
লোকটার বোকা বোকা মুখের দিকে তাকিয়ে হাসি পেলো মন্তুর। এরাত বারোটার সময় মানুষ কোত্থেকে ফিরতে পারে, লোকটা মন্তুকে এত অবুঝ মনে করলো নাকি?
আসছেন কোত্থেকে। সোজা পথেই এবার জিজ্ঞেস করলো সে।
দৈনিক দেশের কথা অফিস থেকে।
সেখানে কাজ করেন বুঝি?
হ্যাঁ। কিন্তু আপনাকে সেক্রেটারিয়েটের ওখানে দেখেছি বলে মনে হচ্ছে।
হ্যাঁ, ওখানেও কাজ করি আমি। এল, ডি, ক্লার্ক। সকাল ন’টা থেকে বিকেল পাঁচটা। ওখান থেকে আর বাড়ি যাইনে, সোজা চলে আসি পত্রিকা অফিসে। কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত বারোটা বেজে যায়।
দিন পনেরো ঘণ্টা কাজ করেন! বলেন কি সাহেব? তাহলে তো বেশ সুখেই আছেন। অনেক টাকা রোজগার হয়। এত টাকা করেন কি? মুরুব্বিয়ানা চালে কথাগুলো বললো মন্তু।
ম্লান হাসলো লোকটা। পরিবারটা তো আর নেহায়েত ছোট নয়, ভাইবোন সবাই মিলে মোট বারো জন। তা— দেড়শো টাকায় কিই বা হয়।
মাত্র দেড়শো টাকা। চোখ দুটো কপালে উঠলো মন্তুর। একটা লোক দিন পনেরো ঘণ্টা কাজ করে মাসের শেষে পায় মাত্র দেড়শো টাকা!
বোকা, বোকা, লোকগুলো সব কি বোকা। হো-হো করে হাসতে ইচ্ছে হলো মন্তুর।
আপনি কি করেন? এবার মন্তুর উত্তর দেবার পালা।
আমি? আমি বিজিনেস— মানে ব্যবসা করি। কিছুক্ষণ ইতস্তত করে জবাব দিলো মন্তু।
কিসের?
এই ছোটখাট— মানে সামান্য কারবার।
কথার ফাঁকে একটা জীর্ণ দালানের সামনে এসে দাঁড়ালো ওরা। চুনকাম পড়েনি সে দালানে, কতদিন, কত বছর হবে তা কে জানে!
নড়বড়ে দরজার কড়াটা বারকয়েক নাড়তেই একটা বিদ্ঘুটে শব্দ করে খুলে গেলো দরজাটা। দরজার ওপাশে একটা নারী ছায়ামূর্তির অস্তিত্ব অনুভব করলো মন্তু।
আরে দাঁড়িয়ে রইলেন যে, আসুন। বৃষ্টিটা থামুক, তারপর যাবেন। আসুন।
দ্বিরুক্তি না করে বারান্দায় উঠে দাঁড়ালো মন্তু।
তখন শুধু বৃষ্টি নয়। বৃষ্টির সাথে সাথে প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়তে শুরু করেছে। রাস্তায় পানি জমেছে অল্প অল্প।
কিন্তু ঘরে যা অন্ধকার, সামনে এগোনোই বিপজ্জনক। তাই দোরগোড়াতেই দাঁড়িয়ে রইলো মন্তু। লোকটা ভেতরে চলে গেলো। কিছুক্ষণ পর তার চাপা কণ্ঠস্বর শোনা গেলো ভেতরে। একটা বাতি না হলে চলবে কি করে, ভদ্রলোক এসেছেন।
কিন্তু কি করবো বলো। ঘরে যে এক ফোঁটা তেলও নেই।
কারো কাছ থেকে অল্প একটু ধার আনা যাবে না?
ধার করে করেই তো এ তিন দিন চলেছি। মেয়েলী কণ্ঠে মিনমিনে আওয়াজ। একটা অজানা পৃথিবী যেন ধীরে ধীরে উন্মোচিত হচ্ছে মন্তুর চোখের পর্দায়। স্থির পাথরের মতো তখনও বারান্দায় দাঁড়িয়ে রয়েছে সে।
আরে দাঁড়িয়ে রইলেন যে, আসুন— আসুন। অন্ধকারের ভেতরে ওর দিকে একটা হাতলভাঙ্গা চেয়ার এগিয়ে দিলো লোকটা। ভাগ্যিস আপনি ছিলেন। নইলে পথের মধ্যে বৃষ্টিতে কি যে অবস্থা হতো। হাত দুটো বারকয়েক কচলালো লোকটা।
মন্তু বসলো।
বাতি এলে, ঘরের চারপাশে আলতো চোখ বুলিয়ে নিলো মন্তু।
ছোট্ট অপরিসর ঘর। মাঝখানে একটা চটের বেড়া দিয়ে দু’ভাগ করা হয়েছে ঘরটাকে। আসবাবপত্র বলতে তেমন কিছু নেই। একটা দড়ির খাটিয়া। একটা পুরোনো টেবিল, একটা চেয়ার আর দেয়ালে একটা ছোট্ট আলনা।
বার কয়েক ভ্রূ কোঁচকালো মন্তু।
এ্যা! মা, আমার টাকা! টাকা গেলো কোথায় মা? বুকফাটা চাপা আর্তনাদে চমকে উঠে ফিরে তাকালো মন্তু। লোকটা কি হার্টফেল করবে নাকি? নইলে অমন করছে কেন?
টাকা! টাকা! টাকা! কি সর্বনাশ হলগো আমাদের। কি সর্বনাশ হলো! সরু মোটা অনেকগুলো কণ্ঠের চাপা গোঙানির শব্দ যেন চাবুক মেরে গেলো মন্তুর বুকে, পিঠে, পেটে। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সে।
কি হয়েছে। আপনারা অমন করছেন কেন? ঠিক নিজেও বুঝতে পারলো না মন্তু। কখন সে সবার মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছে।
লোকটা কঁকিয়ে যা বললো, তা শুনে রীতিমত ঘামিয়ে উঠলো সে। সেক্রেটারিয়েট থেকে পাওয়া একশ’টি টাকা বেমালুম উধাও হয়ে গেছে পকেট থেকে। বাসে করে যখন সংবাদপত্রের অফিসে গিয়েছিলো, তখন বোধ হয় কেউ পকেট থেকে তুলে নিয়েছে বলে তার ধারণা।
ওইতো, আপনার বুক পকেটেই তো রয়েছে টাকাগুলো। আনন্দে আটখানা হয়ে পড়লো মন্তু, যেন এভারেস্টের চূড়োয় উঠেছে।
না না, ওগুলো ‘দেশের কথা’ থেকে পেয়েছি। ওখানে পঞ্চাশ টাকা। সরবে প্রতিবাদ জানালো লোকটা। তারপর নির্বিকারভাবে মুখের লাগাম খুলে দিলো সে পকেটমারের চৌদ্দ পুরুষের পিণ্ডি চটকাবার উদ্দেশ্যে।
মন্তু তখনো নির্বাক।
বাইরে তখন ঝড় বইছে। বাজ পড়ছে প্রচণ্ড শব্দে।
রাস্তায় হাঁটুর উপর পানি।
বৃষ্টি থামলো না। বরং আরো বেড়ে গেলো।
আর, তাই মন্তুর যাওয়া হলো না।
টাকার শোকে একেবারে মুষড়ে পড়লেও, অতিথি সৎকার করতে ভুললো না লোকটা। ছেঁড়া কাঁথার ওপর বৌ-এর একখানা পুরোন শাড়ি বিছিয়ে দিয়ে মন্তুর শোবার বন্দোবস্ত করে দিলো।
হ্যাঁ না কিছুই বললো না মন্তু। সোজা শুয়ে পড়লো সে।
শুলো কিন্তু ঘুমালো না। জেগেই রইলো মন্তু। আর অপেক্ষা করতে লাগলো সবাই কতক্ষণে ঘুমায়।
দেয়ালের সাথে ঝুলান সাটের বুক পকেটে পঞ্চাশটা টাকা। পাঁচখানা দশ টাকার কড়কড়ে নোট! কিছুতেই ভুলতে পারছিলো না সে।
দূরে কাদের দেয়ালঘড়িতে ঢং করে একটা শব্দ হলো। নিরালা পৃথিবী, নিঃশব্দ তন্দ্ৰায় নিমগ্ন।
অতি সাবধানে উঠে দাঁড়ালো সে। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল সামনে। আর একটু এগুতেই, কান্না মেশানো স্বরে কে যেন বললো, মাগো, হাঁড়িতে কি একটা ভাতও নেই। পেটটা যে পুড়ে গেলো।
অজানা পৃথিবীর আর এক পাঠ!
রীতিমত শিউরে উঠলো মন্তু।
বাচ্চা মেয়েটা এখনও ঘুমোয়নি। পেটে ক্ষুধা নিয়ে কেমন করেই বা ঘুমোবে সে। মায়ের সান্ত্বনাবাক্য শোনা গেলো একটু পরে। কি আর করবে মা! রাতটা যে কোনমতে কাটাতেই হবে।
একটা কচি মেয়ে কিছু না খেয়েই রাত কাটাবে? পকেটে হাত দিয়েও টাকাগুলো নিতে পারলো না মন্তু। মোট দেড়শ’টি টাকা। এ দিয়েই এদের কোনমতে মাস কাটাতে হয়। এবার মাত্র পঞ্চাশটা টাকা দিয়ে কেমন করে চলবে এরা? মরে যাবে নির্ঘাত, মরে যাবে! মরে যাবে ওই কচি মেয়েটা! এর হাড় বের করা বউটা। আর ওই বাকি যে ক’জনা আছে সবাই। সবাই ওরা মরে যাবে। উঃ! ভাবতে গিয়ে মন্তুর কাঠিন্যে ভরা প্রাণটাও যেন কেমন করে উঠলো আজ। নিজের অভাব ভরা অতীত মনে পড়লো।
দূরে কার দেয়ালঘড়িতে আরো দুটো শব্দ হলো।
আর দেরি করলো না মন্তু। নিঃশব্দে পকেটের ভেতর হাতটা ঢুকিয়ে দিলো সে। সোনার আংটিটা এ আঁধারের ভেতরও কেমন চিক্চিক্ করছে। দু’হাতে আংটিটা অনেকক্ষণ নাড়াচাড়া করলো সে। পরীবানুর মুখটা ভেসে উঠলো চোখের পর্দায়।
মত চোখ বুজলো।
চোখ খুললো।
তারপর আস্তে আংটিটা ছেড়ে দিলো দেয়ালে ঝোলান শার্টের বুক পকেটে। খস করে একটা শব্দ হলো সেখানে। তাও কান পেতে শুনলো। তারপর একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাইরে বেরিয়ে এলো সে।
বৃষ্টিটা তখন থেমে গেছে। আর রাহুমুক্ত চাঁদ খল-খলিয়ে হাসছে আকাশে।