অসংখ্য বই পুস্তকে সাজানো ট্রলির বাবার লাইব্রেরি। দেখে অবাক হল আসলাম। সত্যি, বাসায় এতবড় একখানা লাইব্রেরি আছে, ট্রলি তো এ কথা ভুলেও কোনদিন বলেনি তাকে।
একটু হাসলেন ট্রলির বাবা। বলেন, দৈনিক কমপক্ষে ঘণ্টা আটেক এখানেই কাটে আমার। রীতিমত একটা নেশা হয়ে গেছে। কেবল পড়া পড়া আর পড়া। জীবনটা বই পড়ে পড়ে কাটালাম।
লিনেনের শার্ট আর ট্রপিকেলের প্যান্ট পরা সৌম্যকান্তি ভদ্রলোক যুগল ভ্রূ-জোড়ার নিচে তীক্ষ্ণ একজোড়া চোখ। কপালে বার্ধক্যের জ্যামিতিক রেখা। কেন জানি প্রথম সাক্ষাতেই ভদ্রলোকের প্রতি একটা গভীর শ্রদ্ধা জন্মে গেলো আসলামের। মেহগিনি কাঠের রঙিন সেল্ফ থেকে মরক্কো লেদারে বাঁধাই মাসিক ‘মাহে নও’য়ের বাৎসরিক সঙ্কলনখানা নামিয়ে নিয়ে পাতা উল্টাতে উল্টাতে ভদ্রলোক আবার বলেন, কিন্তু, একটা কথা কি জানো আসলাম এদেশে শিক্ষার কোন কদর নেই।
শিক্ষা আছে যে তার কদর থাকবে? বাবার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে ওপাশ থেকে উত্তর করলো ট্রলি।
ট্রলির সাথে আসলামের পরিচয় আজকের নয়। বছরখানেক আগের। ভার্সিটির লনে, প্রথম পরিচয় মুহূর্তে কোন এক মন্ত্রীর নাম উল্লেখ করে ট্রলি বলেছিলো, আমি তার ভাগনী।
মন্ত্রীর ভাগনী? মানে আপনার মামা মিনিস্টার? প্রথমটায় অল্প একটু অবাক হয়েছিলো বইকি আসলাম।
সরু ঠোঁটের ওপর লিপিস্টিকের ডগাটা নিখুঁতভাবে বুলিয়ে নিয়ে ট্রলি বলেছিলো, জ্বী হ্যাঁ। আমার এক মামা মিনিস্টার। আর, এক মামা এ্যামবাসেডার।
মামা যার মিনিস্টার, দুনিয়া তার তামার মতো উজ্জ্বল বলে জানতো আসলাম। তাই বলেছিলো, আপনার বাবাও কি তাহলে—।
না না, ওসব মন্ত্রীগিরির মধ্যে বাবা নেই। তিনি আমদানি রপ্তানির ব্যবসা করেন। ট্রলি বলেছিলো।
বাবা ব্যবসা করেন। মামা মিনিস্টার। সত্যি কেন যেন সেদিন বড্ড ভালো লেগেছিলো ট্রলিকে। ফিনফিনে বাতাসের ভেতর বাগানে বেড়াতে বেড়াতে ট্রলির বাবা বললেন, জানো আসলাম, এই যে গাড়ী বাড়ি আর ধন-দৌলত দেখছো, এ সব কিছু স্রেফ ব্রেইন দিয়ে আয় করা।
ভাষাটা দ্রষ্টব্য না হলেও ঠিক বোঝা গেলো না। কপালে বিস্ময়ের ঢেউ তুলে আসলাম তাকালো ট্রলি আর তার বাবার দিকে।
মুখ টিপে হাসলো ট্রলি।
হাসলেন ট্রলিরা বাবা।
দিনটা ছিলো রোববার। আরামকেদারায় হেলান দিয়ে বসে বসে কি একটা মার্কিনী পত্রিকার পাতা উল্টাচ্ছিলো ট্রলি। সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই কৈফিয়তের সুরে প্রশ্ন করলো, এতদিন আসনি যে?
আসবো কেমন করে বলো। তোমার মামা যে ঘর থেকেই বেরুতে দিলেন না এ কয়দিন।
তার মানে?
মানে একশ’ চুয়াল্লিশ ঘার কারফিউ।
ওঃ ভ্রূ-জোড়া নেচে উঠলো ট্রলির।
হঠাৎ বলে উঠলো আসলাম, আচ্ছা ট্রলি, তুমিই বলো। এতগুলো নিরীহ ছেলেকে গুলি করে মারা কি উচিত হয়েছে?
হুঁ, কি বললে? বই থেকে মুখ তুললো ট্রলি।
ওই গুলি ছোড়ার কথা বলছিলাম। তুমি কি কোন খোঁজ রাখ না ট্রলি?
রাখি। মাথা দুলিয়ে বললো ট্রলি, যদি বলি গুলি ছেড়াটা ন্যায়-সঙ্গত হয়েছে তাহলে?
হ্যাঁ তাহলে? দোরগোড়া থেকে গম্ভীর গলায় বললেন ট্রলিরা বাবা। আসলে কি জানো আসলাম। এদেশের ছেলেমেয়েগুলো সব গোল্লায় গেছে। উচ্ছন্নে গেছে সব। নইলে ইসলামী ভাষা ছেড়ে দিয়ে ওই কুফুরি ভাষার জন্য এতমাতামাতি কেন? কথা তখনও শেষ হয়নি ট্রলির বাবার। ইসলামী দেশে ইসলামী ভাষাই রাষ্ট্রভাষা হবে এতে কোন সন্দেহ নাই। টেবিলে একটা প্রচণ্ড ঘুষি পড়লো তার। আসলাম, আমি যা কিছু বলি থরো স্টাডি করেই বলি। আমি বলছি তোমায়। অনেক স্টাডি করে আমি দেখেছি।
বাংলা ভাষার নিজস্ব ঐতিহ্য বলতে কিছুই নেই। একেবারে নাথিং। নট এ সিংগল ফাদিং। বাবার সাথে তাল মিলিয়ে বললো ট্রলি।
প্রতিবাদে কি বলতে যাচ্ছিলো আসলাম। থামিয়ে দিল সে, হয়েছে থাক। তোমার মাথায় শয়তান বাসা করেছে। ওগুলো তাড়াতে হবে। ওঠো, উপরে চলো।
টেনে তাকে উপরে নিয়ে এলো ট্রলি। বসো। জোর করে চেপে বসিয়ে দিল চেয়ারের উপর। তারপর বৈদ্যুতিক পাখাটাকে ঘুরিয়ে দিয়ে কাছে এসে দাঁড়ালো সে। মাথার এলোমেলো চুলের ভেতর পরম আদরে ওর নরম আঙুলগুলোকে বুলিয়ে দিয়ে ট্রলি বললো, তুমি এরকমটি হবে তা কোনদিনও ভাবতে পারিনি আসলাম। ঠোঁটের কোণে এক টুকরো করুণ হাসি ট্রলির।
ট্রলির বাবার পুরোনো চাকরের সাথে আলাপ হলো বৈঠকখানায়। বুড়োকে দেখে যেন জর্জ বার্নাড শ’র কথা মনে পড়ে গেলো আসলামের। সুদূর বিলেতের মৃত বার্নাড শ’র সাথে অদূর রমনার এই বুড়ো ভৃত্যের আকৃতিক সামঞ্জস্য সত্যি বড় অদ্ভূত ব্যাপার।
কৌতূহল বশেই হয়ত জিজ্ঞেস করে আসলাম, কতদিন আছ এখানে?
তা সাহেব অনেক দিন। বুড়ো হেসে বললো, সেই যুদ্ধের আমল থেকে।
বল কিহে। সেতো বছর দশেকেরও বেশি।
হ্যাঁ সাহেব। বছর দশেকের মতই প্রায়। বুড়ো বললো, তখন কিন্তু এদের অবস্থা অতো ভালো ছিল না। কলকাতায় সার্কুলার রোডের উপর রেশনের দোকান ছিল একটা। গলাটাকে একটু খাড়ে নিল বুড়ো। এখন যা কিছু দেখছেন— এসব তো পাকিস্তান হবার পরেই—। কথাটা শেষ করতে পারলো না সে। ভেতর থেকে ট্রলির ডাক পড়তেই ভেতরে চলে গেলো।
দীর্ঘ অনুপস্থিতির পর, ভার্সিটির লনে আবার দেখা হল ট্রলির সাথে।
কেমন আছ ট্রলি? জিজ্ঞেস করলো আসলাম।
এই এক রকম। ট্রলি বললো, আগামী মাসে বিলেত যাচ্ছি।
কেন, হঠাৎ?
ট্রলি বললো, তুমিতো জান, মেজ আপা ওখানেই আছেন। তাঁর বাসায় কিছুদিন বেড়াবো। তারপর সেখান থেকে যাবো কালিফোর্নিয়াতে বড় আপার কাছে।
ফিরছো কখন?
বলতে পারছি না ঠিক। টানা চোখের ভ্রূ-জোড়া নেচে উঠলো ট্রলির। বললো, বড় আপা গিয়ে আর ফেরেননি। ওখানেই বাসা বাড়ি করে রয়ে গেছেন। মেজ আপার অবস্থাও প্রায় সে রকম হতে চলেছে। আমারও হয়ত—
কথাটা শেষ করলো না ট্রলি। কেন যেন হঠাৎ থেমে গেলো। কিছুক্ষণ নীরব থেকে বললো, সময় করে একবার বাসায় এসো তোমার সাথে একটা জরুরি কথা আছে।
আরেক দিন কি একটা কাজে রাস্তায় বেরিয়েছিল আসলাম। পেছন থেকে ট্রলির কন্ঠস্বর শুনে ফিরে দাঁড়ালো। কেডিলাকের হুইল ধরে বসে আছে ট্রলি। কাছে আসতেই বললো, খবরটা নিশ্চয়ই শুনেছো।
কোন খবর? অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো সে।
কেন, আজকের কাগজ পড়নি? ট্রলি অবাক হলো।
না, এখনও পড়িনি।
পড়নি? তাহলে মোটরে উঠ। একটু অবাক করিয়ে দিই তোমায়। জোরে হেসে উঠলো ট্রলি।
বাসার সামনে অসংখ্য মোটরের সার দেখে সত্যি অবাক হল আসলাম। বললো কি ব্যাপার ট্রলি?
বুঝতে পারছো না কিছু? ট্রলির চোখে রহস্যঘন হাসি। ট্রলি হেসে বললো, বাবা শিঘ্রী সেন্টালের এডুকেশন বিভাগের বড় কর্তা হয়ে যাচ্ছেন, বুঝলে?
ও, তাই নাকি?
হ্যাঁ তাই, ট্রলি বললো। তোমাদের পছন্দ হবে তো?
নিশ্চয়ই হবে। তাঁর মত একজন ইন্টালেকচুয়াল লোক—
কথাটা কেন যেন গলায় আটকে গেলো। ঠোঁটের কোণে তৃপ্তির হাসি তুলে ট্রলি বললো, একটা দরখাস্ত লিখে রেখোতো আসলাম। বাবার একজন প্রাইভেট সেক্রেটারীর দরকার হতে পারে। আমি তোমায় রিকমেন্ড করে দিয়ে যাব। বুঝলে?
মোটর থেকে নামতেই ট্রলির বাবাকে দেখা গেল। বন্ধু-বান্ধব নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত তিনি। তাই হয়ত আসলামের উপস্থিতি তাঁর চশমায় ঘেরা চোখে ধরা পড়লো না সহজে।
ট্রলি বললো, লাইব্রেরিতে গিয়ে বস তুমি। আমি একটা কাজ সেরে আসি। কেমন? বলে উপরে চলে গেলো সে।
সেল্ফ থেকে একটা বই নামিয়ে পড়তে বসলো আসলাম। রবি ঠাকুরের গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ।
কে আসলাম? ট্রলির বাবার চমকে ওঠা কণ্ঠস্বরে বই থেকে মুখ তুলে তাকলো সে।
কখন এলে তুমি? উচ্ছ্বসিত গলায় জিজ্ঞেস করলেন ট্রলির বাবা।
এইতো মিনিট পনেরো আগে। ধরা গলায় উত্তর দিল আসলাম।
কি পড়ছো ওটা? আরো কাছে এগিয়ে এলেন তিনি। তারপর বইটার উপর ঝুঁকে পড়ে বললেন, ও গীটাজ্ঞলী? এ নাইস, নাইস বুক। প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠলেন দেশের ভাবী শিক্ষাকর্তা, ট্রলির বাবা। বললেন, গীটাজ্ঞলী, ওঃ! চমৎকার বই! মিলটনের একখানা শ্রেষ্ঠ উপন্যাস।