» » সোনার হরিণ

বর্ণাকার

দীর্ঘ দশ বছর পর অকস্মাৎ আজ যদি তাদের একজনের সঙ্গে দেখা না হত, তাহলে হয়ত এ গল্পের জন্ম হতো না কোনদিন।

দশ বছর আগে, ফার্নিচারের দোকানে কিছুদিনের জন্য চাকরি নিতে হয়েছিল আমার। দোকানটা ছিল আকারে বেশ বড় আর প্রকারে অভিজাত। বাইরে, নাতি-প্রশস্ত সাইনবোর্ডে সুন্দর করে নাম লেখা ছিল তার, আর ভেতরে পরিপাটি করে সাজানো ছিল বিক্রয়ের সামগ্রীগুলো।

হয়ত তখন ভরদুপুর ছিল। কড়া রোদ পড়ছিল বাইরে, বেশ মনে আছে। আয়নার দরজাটা ঠেলে দোকানে এল তারা। প্রথমে যে এল, বয়স তার উত্তর-তিরিশের আশেপাশে হবে। দেহের রং কালো, তীক্ষ্ণ চেহারা, পরনে একটা ছাই রঙের প্যান্ট, গায়ে সাদা সার্ট। পেছনে যে এল, সে একটি মেয়ে। পাতলা গড়ন, মিষ্টি মুখ। চোখজোড়া কালো আর ডাগর।

চেয়ারে হেলান দিয়ে চুপচাপ বসে ছিলাম, উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, এই যে আসুন, বসুন।

ওরা কেউ বসল না। দুইজনে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে চারপাশে সাজানো ফার্নিচারগুলো দেখতে লাগল।

বললাম, আপনারা নিশ্চয় ফার্নিচার দেখতে এসেছেন?

দুইজনে একসঙ্গে সায় দিল। হ্যাঁ।

বললাম, তাহলে দেখুন যেরকমটি চাই আপনাদের সব রকমের জিনিস পাবেন এখানে। আর যদি তৈরী জিনিস পছন্দ না হয়, ইচ্ছে করলে আপনারা অর্ডার দিয়ে যেতে পারেন, আমরা ঠিক আপনাদের মনের মতো করে বানিয়ে দেব। ধড়িবাজ আমরা নই।

তারা দুইজনে এতক্ষণ নীরবে শুনছিল সব আর মাঝে মাঝে দুইজোড়া চোখ চরকির মতো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছিল চারপাশ। আমাকে থামতে দেখে লোকটা বলল, আমাদের অনেকগুলো ফার্নিচার দরকার বুঝলেন? মানে পুরো একটা ঘর সাজাতে যা লাগে— যেমন ধরুন একট আলমারি, একটা সুন্দর ড্রেসিংটেবিল, একখানা মজবুত খাট। একটা সোফাসেট। তাছাড়া বুঝলেন কিনা, একটা আরাম-কেদারার বড় শখ আমার— কী সুন্দর হাতপা ছড়িয়ে বসা যায় তাই না?

বললাম, ঠিক বলেছেন আপনি, তাই তো এর নাম আরাম-কেদারা। আরাম করে বসবার জন্যেই তো ওগুলো তৈরী। আর সত্যি বলতে কি, এই কিছুদিন আগে এক মাড়োয়ারি, পাঁচখানা আরাম-কেদারার অর্ডার দিয়ে গেছেন, দু-একদিনের মধ্যে এসে নিয়ে যাবেন। আসুন না, আপনারা নিজে চোখে দেখুন। না না বসায় কোনো আপত্তি নেই, বসুন। বসেই দেখুন।

একখানা কেদারার উপর লম্বা হয়ে বসল লোকটা। তার চোখমুখ যেন কেমন উজ্জ্বল হয়ে উঠল। একটু পরে সে প্রশ্ন করল, এর দাম কত পড়বে?

বললাম, আপনাদের কাছে বেশি দাম চাইব না। হাজার হোক আপনারা হলেন বাঙালি, জাত ভাই। মাড়োয়ারিটার কাছ থেকে দেড়’শ করে নিচ্ছি। আপনাদের সোয়া’শ টাকায় দিয়ে দেব।

লোকটা আঁতকে উঠল, সোয়া’শ!

বললাম, কী করব বলুন, আমরা তো ঠকাবার জন্যে ব্যবসা করছিনে। অনেক মাল-মসলা খরচ করে জিনিস তৈরি করি। দামটা একটু বেশি পড়বে বইকি। অন্য কোথাও গেলে—না খুব বেশি দূর যেতে হবে না আপনাদের, এই পাশের দোকানটিতে যান, দেখবেন কত মিষ্টি কথা বলে এর চেয়ে হয়তো কম দামে একখানা কেদারা গছিয়ে দেবে আপনাকে। আপনি তো ভাবলেন খুব জিতেছেন, কিন্তু বাড়ি নিয়ে যান, আমি হলপ করে বলছি, খুবজোর ছ’মাস কি এক বছর, তার পরেই দেখবেন এটা উইয়ে খেতে শুরু করেছে। আসলে কি জানেন—।

আরো কী যেন বলতে চাইছিলাম আমি। মেয়েটি মাঝখানে বাধা দিল। এতক্ষণ ডাগর চোখজোড়া মেলে একখানা ড্রেসিংটেবিল দেখছিল সে। হঠাৎ ডেকে বলল, দ্যাখো কী সুন্দর টেবিল। বলতে গিয়ে মুখখানা শিশুর সরল হাসিতে ভরে উঠল তার। কাচের ভেতরে নিজের চেহারাটা একনজর দেখে প্রশ্ন করল আমাকে, এটার দাম কত?

বললাম, বেশি না, দু’শ পঁচাত্তর টাকা।

মুহূর্তে মেয়েটির মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। ভ্রুজোড়া কপালে তুলে সে মৃদুস্বরে বলল, এত টাকা!

বললাম, হ্যাঁ… কিছু বলতে চাইলাম আমি। কিন্তু কেন যেন গলায় আটকে গেল কথাটা। অবশেষে বলতে হল— ‘দেখুন, দু’শ পঁচাত্তর টাকা নগদ দিলেও এ মুহূর্তে ও জিনিসটা দিতে পারব না আপনাকে। এক ভদ্রলোক তাঁর মেয়ের বিয়েতে প্রেজেন্ট করবে বলে স্পেশাল অর্ডার দিয়ে ওটা বানিয়েছেন। যদি বলেন আপনাদেরও ওরকম একখানা তৈরি করে দিতে পারি।’

ড্রেসিংটেবিলটাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আরো অনেকক্ষণ ধরে দেখল ওরা। তার পর একে একে একখানা খাট, কয়েকটা আলমারি আর একটা সোফাসেটের মূল্য জানতে চাইল ওরা।

যা সঠিক দর তাই শুধু বললাম, উত্তরে ওরা বিস্ময় প্রকাশ করল।

অনেক কিছু জেনে ফেললাম। বছর কয়েক হল বিয়ে হয়েছে ওদের। শহরেই থাকে। লোকটি চাকরি করে কোনো এক সরকারি অফিসে। বড় খাটুনির কাজ। তবু এ ক’বছরে কিছু অর্থ সঞ্চয় করেছে ওরা। এখন কিছু ফার্নিচার কিনে ঘরটাকে সাজাতে চায়। এইতো সময়। পরে ছেলেমেয়ের সংখ্যা বাড়তে থাকলে কি আর এসব কেনাকাটা করা সম্ভবপর হবে। মোটেই না।

আলাপের অবসরে পাশের রেস্তোরাঁয় দু’কাপ চা আর বিস্কিটের ফরমায়েশ দিয়েছিলাম। চা খেতে অনুরোধ করায় দু’জনেই যেন লজ্জা পেলেন। মেয়েটি কিছু বদল না। নীরবে চা খেল। চা খাওয়া শেষ হলে বললাম, তাহলে কি আপনারা এখন কিছু টাকা অ্যাডভান্স করে যাবেন?

এরা পরস্পরের মুখের দিকে তাকাল এক পলক, তারপর একটু ইতস্তত করে লোকটি বলল, এখন সাথে কোনো টাকা আনিনি আমরা। কাল সকালে এসে আলমারি, খাট, ড্রেসিংটেবিল আর কেদারাটার জন্যে কিছু টাকা অ্যাডভান্স করে যাব আপনাকে।

মেয়েটি বলল, দেখবেন, যেন খারাপ না হয়।

বললাম, সে কথা কি আর বলতে। জিনিস খারাপ হলে, আমাদেরই বদনাম। আপনারা ও-ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।

একটু পরে কাচের দরজাটা ঠেলে যেমনি এসেছিল তেমনি নীরবে বেরিয়ে গেল তারা!

 

তারপর সে দোকানে আরো তিন বছর ছিলাম আমি।

পরদিন লোকটা আসবে বলেছিল।

পরের বছরেও এল না।

তার পরের বছরেও না।

তারপর দীর্ঘ দশ বছর। অকস্মাৎ আজ যদি তাদের একজনের সঙ্গে দেখা না হয়ে যেত তাহলে হয়তো এ গল্পের জন্য হত না কোনোদিন।

মেয়েটি হয়তো মারা গেছে এতদিনে, তাই আজ তাকে সঙ্গে দেখলাম না লোকটির। দেখলাম, এক বন্ধুর ফার্নিচারের দোকানে। তার সঙ্গে দেখা করতে এসে হঠাৎ দেখলাম এ ক’বছরে রীতিমতো বুড়ো হয়ে গেছে লোকটা। মুখখানা ভেঙে গেছে, কানের গোড়ায় কিছু চুল সাদা। গায়ের জামা-কাপড়গুলো ময়লা। দোকানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে অনেকটা কান্নার মতো স্বরে সে বলছে, আমাদের অনেকগুলো ফার্নিচার দরকার, বুঝলেন? মানে, পুরো একটা ঘর সাজাতে যা লাগে। যেমন ধরুন, একটা সুন্দর ড্রেসিংটেবিল, একখানা মজবুত ঘাট—তাছাড়া বুঝলেন কিনা, একটা আরাম-কেদারার বড় শখ আমার। কী সুন্দর হাতপা ছড়িয়ে বসা যায়, তাইনা?