» » ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি

মাঝে মাঝে ভাবি কতগুলো কুষ্ঠ রোগীকে নিয়ে একটা ছবি বানাবো। যাদের সারা দেহে পচন ধরেছে— তবু তারা চিৎকার করে বলছে না না। আমাদের কিছু হয়নি তো!

তাদের হাত পা’গুলো সব গলে গলে খসে পড়ছে। তবু তারা উগ্রকণ্ঠে বলছে— ও কিছু না, ও কিছু না। আমাদের কিছু হয়নি তো। ওদের পুঁজভরা দেহ থেকে অসহ্য দুর্গন্ধ বেরুচ্ছে। তবু তারা আতর আর গোলাপ জলে আকণ্ঠ ডুবিয়ে চিৎকার করছে— কিছু হয়নি তো! তারা মরে ভূত হয়ে গেছে। তবু তাদের প্রেতাত্মা দুর্বার আক্রোশে আর্তনাদ করে বলছে— আমরা মরিনি তো!

ইচ্ছে করে আমার পাশের বাড়ির ছোট বউটিকে নিয়ে একটা ছবি বানাই। ছোট বউটি, যার স্বামী আজ দশ বছর ধরে জেলখানায় পচে মরছে।

কি অপরাধ তার, কেউ জানে না।

কি দোষে তাকে বিনা বিচারে আটক করে রাখা হয়েছে তা তার পাষাণ বউটিকে জিজ্ঞেস করলেও সে মুখ ফুটে কিছু বলে না।

অথচ বউটি কি গভীর যন্ত্রণায় ডাঙ্গায় তোলা গাছের মতো তড়পায়। দিনে, রাতে নীরবে।

তবু চিৎকার করে সে কাঁদবে না।

তবু মুখ ফুটে সে কিছু বলবে না।

ইচ্ছে করে আমার এক বন্ধুকে নিয়ে ছবি তৈরি করতে।

বহুদিন আগে যাকে প্রথমে আরমানিটোলায় পরে পল্টনে গলা ফাটিয়ে বক্তৃতা দিতে দেখেছিলাম। দেখেছিলাম সহস্র জনতার মিছিলের মাঝখানে। সেই একুশের ভোরে যে আমার কানে কানে বলেছিল— বন্ধু, যদি আজ মরে যাই তাহলে আমার মাকে কাঁদতে নিষেধ করে দিও। তাকে বলো সময়ের ডাকে আমি মরলাম।

সময় পাল্টে গেছে হয়তো তাই আজ সেই বন্ধু আমার আমলাদের ঘরে ঘরে যুবতী মেয়েদের ভেট পাঠায় দু’টো পারমিটের লোভে।

আহা, তাকে নিয়ে যদি একটা ছবি বানাতে পারতাম।

আমার ছোট বোনটি!

সে একটা ছায়াছবির বিষয়বস্তু হতে পারতো।

তার বড় আশা ছিলো, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে। দু’ দু’বার কঠিন রোগ ভোগের পর ডাক্তার তার লেখাপড়া বন্ধ করে দিলো।

বললো ব্রেন এফেক্ট করতে পারে।

কিন্তু সে শুনলো না। রাত জেগে জেগে পড়লো সে।

পাস করলো। ভালোই পাস করলো সে— প্রথম বিভাগে।

তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ে আনাগোনা শুরু হলো তার।

রোজ যায়, রোজ আসে।

একদিন দেখলাম সিঁড়ির গোড়ায় বসে বসে কাঁদছে।

বললাম। কিরে, কি হয়েছে তোর?

বললো। আমায় ভর্তি করলো না ওরা।

কেন?

আমার কথার উত্তর দিতে গিয়ে অনেকক্ষণ দেরি করলো সে। তারপর ধীরে ধীরে বললো, কলেজে পড়ার সময় স্টাইক করেছিলাম তাই। এর কিছুদিন পরে ব্রেনটা সত্যি সত্যি খারাপ হয়ে গেলো তার।

বোনটা আমার পাগল হয়ে গেলো।

আহা, বড় সখ ছিল তার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে।

মাঝে মাঝে ভাবি, কতগুলো অসংস্কৃত লোককে নিয়ে একটা ছবি বানাবো যারা দিনরাত শুধু সংস্কৃতির কথা বলে।

কালচারের কথা বলে।

ভাষার কথা বলে। ঐতিহ্যের কথা বলে।

বলে আর বলে।

কারণে বলে।

অকারণে বলে।

বলে বলে এক সময় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে তাল তমালের স্নিগ্ধ ছায়ায়। তারপর স্বপ্ন দেখে। ধূসর মরুভূমির স্বপ্ন।

তৈমুর লং আর চেঙ্গিস খাঁর স্বপ্ন।

হিটলার আর মুসোলিনীর স্বপ্ন।

আহা, কি সুন্দর সুন্দর স্বপ্ন দেখে ওরা।

ইচ্ছে করে সেলুলয়েডে কয়েকটি মানুষের ছবি আঁকি। যাদের মুখগুলো শূকর শূকরীর মতো। যাদের জিহ্বা সাপের ফণার মতো।

যাদের চোখ জোড়া ইঁদুর ছানার মতো।

যাদের হাতগুলো বাঘের থাবার মতো।

আর যাদের মন মানুষের মনের মত সহস্র জটিলতার গিঁটে বাঁধা। যারা শুধু পরস্পরের সঙ্গে কলহ করে আর অহরহ মিথ্যে কথা বলে।

যারা শুধু দিনরাত ভাতের কথা বলে।

অভাবের কথা বলে।

মাংসের ঝোলের কথা বলে।

আর মরে। গিরগিটির মতো। সাপ-ব্যাঙ-কেঁচোর মতো।

মরেও মরে না।

গণ্ডায় গণ্ডায় বাচ্চা বিইয়ে বংশ বৃদ্ধি করে রেখে যায়। আহা, আমি যদি সেই তরুণকে নিয়ে একটা ছবি বানাতে পারতাম। যার জীবন সহস্র দেয়ালের চাপে রুদ্ধশ্বাস।

আইনের দেয়াল।

সমাজের দেয়াল।

ধর্মের দেয়াল।

রাজনীতির দেয়াল।

দারিদ্র্যের দেয়াল।

সারাদিন সে ওই দেয়ালগুলোতে মাথা ঠুকছে আর বলছে— আমাকে মুক্তি দাও। আমাকে মুক্তি দাও। আমার ইচ্ছাগুলোকে পায়রার পাখনায় উড়ে যেতে দাও আকাশে। কিম্বা সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলে দাও। সেখানে তারা প্রাণভরে সাঁতার কাটুক।

সারাদিন সে শুধু ছুটছে, ভাবছে— আবার ছুটছে।

এক দেয়াল থেকে অন্য দেয়ালে।

ঈর্ষার দেয়াল।

ঘৃণার দেয়াল।

মিথ্যার দেয়াল।

সংকীর্ণতার দেয়াল

কত দেয়াল ভাঙবে সে?

তবু সে আশাহত হয় না। ইচ্ছার আগুন বুকে জ্বেলে রেখে তবু সে ছুটছে আর ভাঙছে।

সহস্র দেয়ালের নিচে মাথা কুটে কুটে বলছে— মুক্তি দাও।

আমাকে মুক্তি দাও।

যদিও সে জানে মানুষের আয়ু, অত্যন্ত সীমিত।

Leave a Reply