জীবনকে অস্বীকার করিস না মনো! অস্বীকার করিসনে তোর আপন সত্তাকে, অনেক কিছু তোর করবার আছে এ জীবনে।

অনেক চেষ্টা করেছে মনোয়ারা, কিন্তু কিছুতেই ভুলতে পারেনি জামানের এ কথা কয়টি। সংসারের নিত্য নৈমিত্তিক কাজের ফাঁকে ফাঁকে, বার বার মনে পড়ে যায়। আর ক্ষণিকের জন্য আনমনা হয়ে পড়ে সে।

সেদিনের সেই ফ্রক পড়া ছোট মেয়েটি শাড়ির পোঁচ লাগতে না লাগতেই যে কখন যৌবনের রোজনামচায় নাম লিখিয়ে ফেললো তা নিজেও ভাবতে পারে না মনোয়ারা। বুড়ি দাদীর চোখেই প্রথম ধরা পড়ছিল সে। পান খাওয়া লাল দাঁতগুলোকে ফাঁক করে ভর্ৎসনার সুরে ছেলেকে বলেছিলেন তিনি, আমি মরে গেলে তোদের যে কি হবে তাই ভাবছি।

সদ্য অফিস ফেরত ছেলে অবাক হয়েছিল মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে— কেন, কি হয়েছে মা? মেয়েটার যে বিয়ে দেবার বয়স হয়ে গেছে তার কি কোন খোঁজ রেখেছিস? রাখবিই বা কেন, তুই কি কোন দিন সংসারের ভেবেছিস, না ভাবিস? যাই বল বাবা, মেয়ের জন্য এবার একটা ভাল দেখে জামাই দেখ।

জামানতো ওকে প্রথমে দেখে চিনতেই পারলো না, চিনবেই বা কি করে? চার বছর পর সে জেল থেকে বেরিয়ে এসেছে; এ চার বছরের ভেতর অনেক পরিবর্তন এসে গেছে মনোয়ারার শরীরে, চেহারায়।

অবাক হচ্ছো যে, চিনতে পারছো না? আমাদের মনো, মনোয়ারা গো। মা ওর সংশয় দূর করলেন।

ও! ঠোঁটের কোণে একটু হাসি টেনে, নিজ অজ্ঞতাকে ঢাকতে চাইলো জামান।

ক্লাশ সেভেনে পড়ে। গত বছর বৃত্তি পেয়েছিল। মায়ের কথায় আবার মুখ তুলে মনোয়ারার দিকে তাকাল জামান ৷ সে ততক্ষণে সরে গেছে পর্দার আড়ালে। তার এই আড়ালের ঘটনাকে আর একদিন জামান বলেছিলো, পর্দাই তোমাদের পৃথিবী থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে মনো। এ রহস্যঘেরা পৃথিবীর রূপ-রস-গন্ধ থেকে তোমাদের বঞ্চিত করেছে। জামানের কথায় অবাক হয়েছিলো মনোয়ারা, কিন্তু কোন উত্তর দেয়নি। শুধু চেয়েছিলো ওর দিকে, কাজল কালো চোখ দুটো মেলে।

জানো ও খুব ভালো রান্না করতে জানে। মা বললেন।

হুঁ। মৃদু হাসলো জামান।

ওই যে টেবিল ক্লথটা দেখছ না। ওটা মনোয়ারা সেলাই করেছে। বেশ সুন্দর হাতের

কাজও জানে ও।

মায়ের মুখে নিজের প্রশংসা শুনে খুশি হতে পারে না মনোয়ারা। বরং পর্দার এ পাশ থেকে রেগেছে মনে মনে— মা যেন কেমন! মনোয়ারা জানে জামানের কাছে এ সবের কোন মূল্য নেই। মনোয়ারার আন্দাজ অহেতুক নয়। কেননা, একটু পরে চায়ের পেয়ালাটা যখন সে জামানের দিকে এগিয়ে দিল তখন চায়ে একটা চুমুক দিয়েই জামান হেসে উঠলো— চা তো তৈরি করেছিস খাসা করে। লেখাপড়ায়ও নাকি বৃত্তি পেয়েছিস। হাতের কাজেও বেশ ভালো। কোন পলিটিক্যাল ফাংসনে টাংসনে যাস?

ফিক করে হেসে উঠে একটু দূরে সরে দাঁড়াল মনোয়ারা।

পটেন কাল ফা-সা-নটা কি বাবা, তাতো বুঝলাম না। মায়ের অজ্ঞতা পীড়াদায়ক হয়ে উঠেছিল মনোয়ারার কাছে। তাই সে সরে যেতে চেয়েছিল।

যাচ্ছিস কোথায়? বস, তোর সাথে কথা আছে। আদেশের সুরে বললো জামান।

আঁচলটা গুটিয়ে নিয়ে মনোয়ারা বসলো। সামনের একখানা চেয়ারে উপর।

পলিটিক্যাল ফাংসনটা বুঝলে না মামী, ওটা হচ্ছে রাজনীতি করা। মানে সভাসমিতি করা; বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে বক্তৃতা দেওয়া—।

অ-বক্তিতা দেওয়া? ওতো ব্যাটা ছেলেরা করে। মা অবাক হন।

না, মেয়েরাও করে। মায়ের অজ্ঞতা দূর করতে চেষ্টা করে জামান। এতক্ষণ চুপটি করে মনোয়ারা চেয়েছিল জামানের মুখের দিকে। এবার দৃষ্টি বিনিময় হলো ওদের; জামান আর মনোয়ারার। মনোয়ারা চোখ সরিয়ে নিল) কিন্তু জামান পারলো না, চোখ দুটো ওর মুখের উপর রেখেই বললো— বেশ সুন্দর হয়েছিল তো দেখতে। লজ্জায় আরক্ত হয়ে উঠলো মনোয়ারার মুখখানা।

অথচ এই সেদিনের কথা। যখন ওরা ছোট ছিল, একসাথে হুড়ো-হুড়ি আর খেলাধূলা করতো, ওরা ঘর বাঁধতো, বর বধূ সাজাতো। কই সেদিন তো মনোয়ারা রাঙা হয়ে উঠেনি। অদ্ভুত মানুষের জীবন।

হ্যাঁ, অদ্ভুতই তো নইলে ভাবতেও তো পারছে না মনোয়ারা, কেমন করে এতগুলো বছর পেরিয়ে গেলো? কেমন করে যে কৈশোর আর যৌবন ছাড়িয়ে প্রবেশ করলো প্রৌঢ়ত্বের কোঠায়। বিছানার চাদরটা গুটিয়ে ফেললো। ময়লা হয়ে গেছে ভীষণ। না কাঁচলে আর নয়। আবুলকে পাঠিয়ে দোকান থেকে সাবান আনিয়ে নিতে হবে একটা। কিন্তু— কি যেন ভাবছিল সে একটু আগে।

ও-হ্যাঁ, তার ছোটবেলাকার কথা, আর জামানের কথা— এরপর আরও দু’ একটা দিন গেছে অসহ্য পরিবেশের ভেতর দিয়ে। তারপর তৃতীয় দিনে স্বাভাবিক হয়ে এসেছে দু’জনাই।

চল সিনেমায় যাবো? জামান বললো, সাথে কিন্তু আর কাউকে নিতে পারবি না, শুধু তুই একা?

মা যেতে দিলে তো।

কেন যেতে দেবে না? মাকে শুনিয়ে শুনিয়েই জোর গলায় বললো জামান, চোরের সাথে যাচ্ছিস তো না, আমার সাথে যাচ্ছিস, নে-কাপড় পরে নে, সময় হয়ে এলো।

বাঁধা দেবার কোন পথ রাখেনি জামান, মা এসে শুধু বোরখাটা এগিয়ে দিলেন— নে, সময় হয়ে এলো।

রিক্সা আনতে গিয়েছিল জামান, ফিরে এসে মনোয়ারার হাতে বোরখা দেখে অবাক হলো— ওটা আবার কেন?

মা বলেছেন। মুখ নিচু করে উত্তর দিল মনোয়ারা।

ওর হাত থেকে বোরখাটা টেনে নিয়ে বারান্দায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে, এক হাতে ওর একখানা হাত ধরে, হেঁচকা টান দিল জামান।

চল—

রিক্সায় চড়তে এসে অবাক হলো মনোয়ারা— রিক্সার পর্দা লাগানো হয়নি যে? প্রয়োজন নেই বলে। নিস্পৃহের মতো উত্তর দিল জামান।

বাবা আর চাচা জানতে পারলে কিন্তু ভীষণ গাল দেবেন। মনোয়ারার কণ্ঠে ভয়ের আভাস।

বিরক্তি বোধ করে জামান। নে নে, উঠবি তো ওঠ। বাবা বকবে, চাচা বকবে, কেন বকবে বলতো? তোদের কি বাইরে বেরুতে নেই নাকি?

আর কথা কাটাকাটি করেনি মনোয়ারা। আসলে কোন কথাই যেন সে অবিশ্বাস করতে পারেনি যুক্তিহীন বলে। চুপটি করে রিক্সায় এসে বসেছে, রিক্সা ছেড়ে দিয়েছে।

জামান নামলো প্রথমে— নেমে আয়! দরজায় কড়া নাড়তে নাড়তে মনোয়ারাকে ইশারা করলো জামান।

ভীষণ ভয় পেয়েছিল মনোয়ারা। অজানা অচেনা এ কোন জায়গায় জামান তাকে নিয়ে এলো, পরক্ষণে যার সামনে গিয়ে তাকে দাঁড়াতে হলো তাকে দেখে আরো ঘাবড়ে গেল সে। আধ পাকা চুল, খোঁচা খোঁচা দাড়ি, তীক্ষ্ণ চোখ, উন্নত নাসিকা গৌরবর্ণ দেহ এক বলিষ্ঠ পুরুষ। এর কথাই কি তুমি বলেছিল জামান? উঃ কি কর্কশ গলা। মনোয়ারা আর একবার ফিরে তাকালো ভদ্রলোকের দিকে।

হ্যাঁ, এর কথাই বলেছিলাম।

নামকি তোমার! আবার সে কর্কশ গলায় প্রশ্ন। নামটা বলবার সঙ্কোচও কাটিয়ে উঠতে পারছিলো না মনোয়ারা, জামানই ওর হয়ে বললে— নাম মনোয়ারা।

কিন্তু ও এতো লজ্জা করছে কেন? ওকে বুঝিয়ে দাও, যে পথে এসেছে, সে পথে লজ্জা সঙ্কোচ সব কিছু ঝেড়ে ফেলে মাথা উঁচিয়ে চলতে হবে ওকে।

যে পথে এসেছে? কোন পথ? রীতিমত ঘেমে উঠলো মনোয়ারা। লোকটা কি হিংস্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর বুকের দিকে। না-না, ঠিক বুকের দিকে নয়, গলার সাথে ঝুলানো নেকলেসটার দিকে।

অলঙ্কার পরাটাকে তুমি খুব পছন্দ কর বলে মনে হচ্ছে।

হঠাৎ এ প্রশ্নের হেতু? মাথাটা যেন ঘুলিয়ে যাচ্ছে মনোয়ারার। কিন্তু ও অলঙ্কারের ইতিহাসটা যদি তুমি জানতে তাহলে নিশ্চয়ই, ওগুলোকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে। না ইতিহাস জানবার কোন দরকার নেই ওর। জামানের প্রতি ভীষণ রাগ হয় মনোয়ারার। ভদ্রলোক আবার ততক্ষণে বলে চলেছেন— প্রাচীনকালে, প্রাচীনকালে কেন? মধ্যযুগেও পুরুষেরা নারীর উপর অমানুষিক উৎপীড়ন চালাতো। যখন তখন যথেচ্ছাভাবে তাদের মারপিট করতো। শুধু তাই নয়। কোমরে, গলায়, হাত পায়ে শিকল বেঁধে ঘরের ভেতর ফেলে রাখতো ওদের। পাছে ওরা পালিয়ে যায়। নারী সে ট্র্যাডিশন ক্ষুণ্ণ করলো না। আজও তাই তারা হাতে, পায়ে, গলায় শেকল— অবশ্য আগে লোহার ছিল, এখন সোনার পরে গর্ব অনুভব করে। সেদিনই ঘরে ফিরে মনোয়ারা তার সমস্ত অলঙ্কার আলমারীতে তুলে রেখে দিয়েছে। আর পরেনি।

মা আর দাদী অবাক হলেন।

কিরে? এত কান্নাকাটি করে বাপের কাছ থেকে ওগুলো আদায় করে নিলি কি আলমারীতে তুলে রাখার জন্য?

সেদিন কোন উত্তর দেয়নি মনোয়ারা। উত্তর আর কবে, কখন, কোন কথারই বা দিয়েছে সে? অফিস থেকে ফেরার পর স্বামী যখন আবোল তাবোল আরম্ভ করে, তখন কি মনোয়ারা ইচ্ছা করলে তার উত্তর দিতে পারে না? কিন্তু কৈ, দেয়নি তো কোনদিন? স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে সে কিছু বলতে পারে না। লোকটা কেমন ভেঙ্গে পড়ছে দিন দিন। সারাদিন হিসাবের খাতায় সারি সারি অঙ্ক কষলে কারই বা মেজাজ ঠিক থাকে?

ওই যা, চাদরটা এবার কি করে কাঁচবে মনোয়ারা? পানিটা যে চলে গেলো, তিনটার আগে কি আর আসবে?

আকাশে তখন বিবর্ণ মেঘের ছুটোছুটি। এলোমেলো হাওয়ায় চুলের গোছা বার বার কপালে লেপ্টে আসছে সাবানের পানিতে।

আবার আনমনা হয়ে পড়ে মনোয়ারা।

মাঝে কিছুদিনের জন্য কোথায় চলে গিয়েছিল, ফিরে এসে মনোয়ারাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে সব বুঝিয়ে দিল। তাকে কি করতে হবে। মাথা নাড়লো মনোয়ারা, না সে পারবে না। রাগে ফেটে পড়লো জামান— এটা পারবিনে, ওটা পারবিনে, পারবি কি বলতো?

রান্না করতে। আঁচলের আড়ালে মুখ টিপে হেসেছিলো মনোয়ারা।

হ্যাঁ, ওটা ছাড়া আর পারবিই বা কি? কিন্তু এমন একদিন আসবে সেদিন আমাদের বলার আগেই নারী এগিয়ে আসবে পাশে। রাগের মাত্রা বাড়লো বই কমলো না জামানের, পাকঘরের ভেতরেই তো তোরা তোদের বন্দি করে রেখেছিস। আচ্ছা বলতো মনো, এই সারাটা দিন পাকঘরের ভেতর রান্না করতে তোদের একটুও বিরক্তি আসে না নাকি?

দূর ছাই চুলোর উপরে তেলটা কখন থেকে ফুটছে তো ফুটছেই। বড্ড অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছে মনোয়ারা। কি দরকার পুরোনো কাসুন্দি ঘাঁটাঘাঁটি করে, জীবনটা তো তার রান্না করেই গেলো। তবুও কি সে খাইয়ে কোনদিন সন্তুষ্ট করতে পেরেছে? তেল হয়েছে তো মসলা হয়নি। মসলা হয়েছে তো নুন বেশি পড়ে গেছে। নিত্য নতুন অভিযোগ।

হ্যাঁ, নতুন নতুন জিনিস পাক করতে আমাদের খুব ভাল লাগে। জামানকে রাগাবার জন্যই কথাটা বলেছিল মনোয়ারা।

দম বন্ধ করে ফুলতে লাগলো জামান। তারপর এক সময় চিৎকার করে বেরিয়ে গেলো— বছরে বছরে ছেলের মা হতেই আসলে তোদের ভালো লাগে।

অন্যায় কিইবা বলেছিস জামান। একটা কেন? এইতো সে বছর দুটোই হয়ে বসলো তার। এ নিয়ে সবাই কত হাসাহাসি করলো। হাসুক ওরা। কি আছে তাতে মনোয়ারার? খোদা যদি দেয়, মনোয়ারা কি করতে পারে তাতে। হ্যাঁ, খোদা কম দেয়নি তাকে এই ক’টি বছরে; মোট ছ’টি দিয়েছে। সন্তান বেড়েছে, কিন্তু আয় বাড়েনি। যে একশ’ পঁচিশ সেই একশ’ পঁচিশই রয়ে গেছে। মনোয়ারা যদি চাকরি করতে পারতো তাহলে হয়তো সংসারটা কিছু স্বচ্ছল হয়ে আসতো। কিন্তু, ঘর সামলাবে, না বাইরে চাকরি করতে যাবে মনোয়ারা? কোনটা করবে।

জামান বলেছিল কি একটা দেশের কথা, সেখানে নাকি ছেলে-মেয়েদের কিন্ডারগার্টেন না কিসে রাখা হয়। আর মা-বোন বেরিয়ে যায় কাজে। সে রকম হলে মন্দ হতো না হয়ত।

আবার ভাবনার অতলে ডুবে পড়লো মনোয়ারা।

সেই যে সকালে বেরিয়ে গেলো লোকটা, রাত দশটার আগে ফিরলো না। দোরগোড়ায় মনোয়ারার সাথে একেবারে মুখোমুখি।

রাগ পড়লো তো? মুচকি হাসলো মনোয়ারা।

ফাজলামো করিসনে, বুঝলি? হাতের বান্ডিলটা টেবিলের উপর রাখলো জামান।

ওগুলো আবার কি? বান্ডিলটা হাতে নিয়ে— কাগজের মোড়কটা খুলে ফেললো মনোয়ারা, অনেকগুলো ফটো, দেশে-বিদেশের মেয়েদের।

ওগুলো তোর জন্য এনেছি, দেখ—একবার দু’টো চোখ দিয়ে ভাল করে দেখ। মনোয়ারা ঘাড়ের উপর একখানা হাত রেখে, ওর দৃষ্টিকে ফটোগুলোর উপর আরো নত করে বলেছিলো জামান— তোদের মতো ওদেরও ঘর সংসার আছে, ছেলেমেয়ে আছে; কিন্তু সাহিত্য, বিজ্ঞানে ওরা কত উন্নত একবার দেখে নে।

সত্যি অবাক হয়েছিল মনোয়ারা। শুধু অবাক নয়। প্রেরণা এসেছিল ওর অবচেতন মনের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে ওদের মতো হবার জন্য। কিন্তু ইচ্ছা থাকলেই কি আর এ দেশে সব কিছু করা যায়? মাথার ওপর বাপ-মা রয়েছে, আর রয়েছে সমাজ।

তরকারিটা নামিয়ে নিয়ে, ডালের কড়াইটা তুলে দিল মনোয়ারা। না, একটু ভাল করে ভাবতে পারবে তারও উপায় নেই। জামানেরও বা চলে যাওয়া ছাড়া আর কি উপায় ছিল?

ওতো কম করেনি মনোয়ারার জন্য। ওরই উৎসাহে মনোয়ারা লিখতে আরম্ভ করেছিলো— গল্প, প্রবন্ধ, কবিতা। প্রথম প্রথম লেখায় একটু জড়তা ছিল বইকি। তাও কাটিয়ে উঠতে পেরেছিল সে জামানের প্রচেষ্টায়। উঃ। সেদিনটার কথা কিছুতেই ভুলতে পারছে না মনোয়ারা। তার প্রথম লেখা, প্রথম গল্প যেদিন ছাপার অক্ষরে পত্রিকায় প্রকাশিত হলো। চারদিক থেকে প্রশংসা পত্র এলো, চমৎকার গল্প। বলিষ্ঠ লেখনী। উজ্জ্বল ভবিষ্যত।

জামান বললো— দেখ, তোর ভেতর এমন একটা প্রতিভা ঘুমিয়ে আছে, তা কি তুই জানতি? আসলে, সব কিছুর মূলে ওই চেষ্টা থাকা চাই, সাধনা করতে হয়, তাহলেই প্রতিভা বিকাশ পায়, বুঝলি।

কিন্তু, বুঝেও কি করতে পারলো মনোয়ারা? আর লিখতে পারেনি সে, লিখতে পারবেও না। প্লট আসে, ভালো ভালো প্লট, কিন্তু— মা, ভাত দেবে না? স্কুলের যে সময় হয়ে এলো।

শুধু খাই, খাই খাই।

নে, খা। ভাতের গামলাটা ছেলের দিকে এগিয়ে দিয়ে কাপড়ের আঁচলে মুখের ঘাম মুছলো মনোয়ারা। ভোর না হতেই স্কুলের—অফিসের তাগিদ। দু’হাতে কাজ করে কুলিয়ে উঠতে পারে না সে। হাঁফিয়ে উঠে, মাথা ঘুরায়; শরীরে ক্লান্তি নেমে আসে। তবুও রেহাই নেই, নিস্তার নেই, করতেই হবে।

দেখো জামান, তুমি আমার ভাগনে, অতি আপনার জন, তোমাকে আর কি বলবো, অবুঝ নও তুমি।

সেদিন মামার মুখের দিকে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়েছিলো জামান। তারপর বলেছিলো— কেন কি ব্যাপার মামা?

মানে, লোকে কি সব আজেবাজে কথা বলাবলি করছে।

আজেবাজে কথা!

হ্যাঁ, বোঝত, ঘরে বয়স্কা মেয়ে থাকলে, অনেকেই অনেক কথা বল, তাই বলছিলাম— কথাটা আর শেষ করেননি তিনি। হয়তো শেষ কথাটা উচ্চারণ করতে ভদ্রতায় বাঁধছিলো তার। কিন্তু মনোয়ারার দাদী ওসব ভদ্রতার ধার ধারেন না। তাই সহজ এবং সরল ভাষায় তিনি বলেছিলেন— ন্যাকামো! আরে বুঝতে তো পাচ্ছ সবই।

এবার সব সত্যিই বুঝলো জামান। ছোট্ট চামড়ার সুটকেসটাকে হাতে নিয়ে নির্বিকারভাবে বেরিয়ে গেলো সে। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছিল তখন, সে বৃষ্টির ভেতর ভিজেই চলে গেলো। কেউ বাধা দিলো না, এমন কি মনোয়ারাও না। নিশ্চল পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়েছিল সে। চোখের পলকগুলো কি ভিজে উঠছিল মনোয়ারার? নইলে আঠা আঠা লাগছিলো কেন চোখের চারপাশটা।

তারপর— একটা বছর না ঘুরতেই বিয়ে। নূতনজীবন। নূতন করে ঘর বাঁধবার দিন। স্বামীর বলিষ্ঠ দেহের সবল পেশীর ভেতর নিজেকে হারিয়ে ফেলার পালা। তারপর এক ঝড়ো রাতে আকস্মিক ভাবেই খবরটা শুনলো মনোয়ারা— জামানকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে। আর কিছুদিন পরেই শুনলো ওকে আন্দামান না কোথায় চালান দেওয়া হয়েছে। খবরটা শুনে খুবই দুঃখ হয়েছিল তার কিন্তু ভাববার অবসর পায়নি সে। কারণ আবুল তখন সাত মাসের। তাকে নিয়েই ব্যস্ত ছিল সে।

কিন্তু আজকাল প্রায়ই ভাবনায় পড়ে মানোয়ারা। সেই যে লোকটাকে নিয়ে গেলো ওরা। আজও সে ফিরে আসেনি। দেশ স্বাধীন হবার পরেও না। তবে কি ওকে ওরা মেরে—

মা, মাগো, দেখো না আবুল ভাই ওরা বিকেলে আরমানিটোলা মিটিং-এ যাচ্ছে, আমায় নেবে না বলছে। মা আমি যাবো। মেয়ে সেলিনা এসে গলা জড়িয়ে ধরেছে তখন।

ধিঙ্গী মেয়ে, আজ বিয়ে দিলে কাল ছেলের মা হবে, পুরুষদের মিটিং-এ রূপ দেখাতে যাবেন উনি। মেয়ের মুখের উপর খুন্তি নাড়ে মনোয়ারা।

কেন, মেয়েদের বুঝি সভা-সমিতিতে যেতে নেই? আমি যাবো। সেলিনা গোঁ ধরে।

অবাক মনোয়ারা। বড্ড বেশি অবাক। জামানের কথা, ঠিক জামানের কথাটাই ধ্বনিত হয়েছে সেলিনার কণ্ঠে। কিন্তু কোত্থেকে এসব শিখছে ও। কেমন একটা অজানা আক্রোশে সারা শরীর ফুলতে থাকে মনোয়ারার। দু’হাতে মেয়ের দু’কাধে ঝাঁকুনি দিয়ে বলে, আজকাল দজ্জাল মেয়েদের সঙ্গে মেশা হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে পটাপট থাপ্পড় পড়ে মেয়েটার গালে।

কিন্তু আবার অবাক হতে হয় মনোয়ারাকে। সেলিনা সরে দাঁড়ায় না এক পাও। বোবা চোখে সে তাকিয়ে আছে মায়ের মুখের দিকে— কি এমন অন্যায় দাবি তার বুঝতে পারে না। মনোয়ারার উদ্যত হাত মাঝপথেই থেমে যায়। সেলিনার আয়ত পানিভরা চোখে ঝড়ো মেঘের বিপ্লবী প্রতিজ্ঞার ছায়া কি ঘন হয়ে উঠছে না।

না, না, একি করছে সে। কেন, কেন, কি অধিকার তার রয়েছে এ পরিবর্তনকে অস্বীকার করার? দূরে বহু দূরে, কোনও নির্জন দ্বীপের নিরালা তটে যেন একটা স্বপ্নমাখা আবছা শৃঙ্খলিত মূর্তি তার চোখে ভেসে উঠে!

না, না, সে স্বীকার করবে একে— এই পরিবর্তনকে, এই বিপ্লবী ঝড়ো হাওয়াকে। ছুটে গিয়ে বিছানায় লুটিয়ে সে ফুলে ফুলে কাঁদতে থাকে। দেহটা থেকে থেকে দমকে দমকে কাঁপতে থাকে তার।

Leave a Reply