মন্দিরের রক্ষক
[ইলোরা] হলো সত্যিকারের, অতিলৌকিক শিল্পীর [অর্থাৎ খোদা] নিপুণ হাতে গড়া বিস্ময় –ইলোরার হিন্দু, জৈন ও বৌদ্ধ মন্দিরগুলো সম্পর্কে আওরঙ্গজেবের ভাষ্য
আওরঙ্গজেবের সাম্রাজ্যজুড়ে ছড়িয়ে ছিল অসংখ্য হিন্দু ও জৈন মন্দির। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারি সুরক্ষা পাওয়ার দাবিদার ছিল, এবং আওরঙ্গজেব সাধারণভাবে সেগুলোর সমৃদ্ধির দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। আবার মোগল দৃষ্টিকোণ থেকে ওই কল্যাণকামী ধারণা বাতিল হতে পারত যদি নির্দিষ্ট মন্দির বা সেগুলোর সাথে সম্পৃক্তরা রাজকীয় স্বার্থের পরিপন্থী কাজ করত। এই নীতির আলোকে সম্রাট আওরঙ্গজেব তার পুরো শাসনকালে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হওয়া মন্দির ধ্বংস ও অবমাননা করেছেন ।
আধুনিক অনেক লোক কিছু মন্দিরের ক্ষতি করার আওরঙ্গজেবের নির্দেশগুলোকে হিন্দুদের বিরুদ্ধে বৃহত্তর প্রতিহিংসার প্রতিফলন হিসেবে দেখে থাকে। এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির মূলে রয়েছে উপনিবেশ আমলের গবেষণা ৷ এই গবেষণায় সময়োত্তীর্ণ হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতিকে ব্রিটিশ ভাগ করে জয় করার কৌশলের আলোকে উপস্থাপন করা হয়। বর্তমানে অনেক ওয়েবসাইটে হিন্দুদের বিরুদ্ধে আওরঙ্গজেবের ‘নৃশংসতার’ তালিকা তুলে ধরে (ভাসা ভাসা তথ্য উপস্থাপন এসব সাইটের অন্যতম বৈশিষ্ট্য) সাম্প্রদায়িক উত্তেজনায় ইন্ধন দিয়ে থাকে। আওরঙ্গজেব হিন্দুদের প্রতি ঘৃণা থেকে কতটি মন্দির ধ্বংস করেছিলেন, তার প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে বিস্তর মতভেদ রয়েছে। সবচেয়ে চোখ ধাঁধানো ব্যাপার হলো, আওরঙ্গজেব তার সাম্রাজ্যে হাজার হাজার মন্দির গণনা করলেও বাস্তবে তিনি সর্বোচ্চ মাত্র গুটি কতেক মন্দির ধ্বংস করেছিলেন। এই অসমঞ্জস্যতা অর্থপূর্ণ মনে হবে না যদি এই বদ্ধমূল ধারণা পোষণ করা হয় যে আওরঙ্গজেব ছিলেন ভারতকে হিন্দু উপাসনা স্থান শূন্য করার একনিষ্ঠ এজেন্ডায় পরিচালিত ব্যঙ্গচিত্র ধর্মান্ধ। তবে আওরঙ্গজেবের ঐতিহাসিকভাবে যুক্তিসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্যই ব্যাখ্যা করতে হবে, কেন তিনি যত হিন্দু মন্দির ধ্বংস করেছিলেন, তার চেয়ে বেশি মন্দির তিনি সুরক্ষিত রেখেছিলেন।
আওরঙ্গজেব আসলে অমুসলিম ধর্মীয় নেতা ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে রক্ষার ব্যবস্থা করার ইসলামি আইন অনুসরণ করেছিলেন। অষ্টম শতক থেকে ইন্দো মুসলিম শাসকেরা হিন্দুদেরকে জিম্মি তথা ইসলামি আইনে সংরক্ষিত শ্রেণি গণ্য করতেন। এর ফলে হিন্দুরা বিশেষ কিছু অধিকার ও রাষ্ট্রীয় রক্ষাকবচের অধিকারী হতো। অবশ্য, হিন্দু ও জৈন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতি আচরণের ক্ষেত্রে আওরঙ্গজেব ইসলামি আইনের সীমারেখা ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। বরং আওরঙ্গজেবের কাছে মন্দির সুরক্ষিত রাখা ও মাঝে মাঝে ধ্বংস করার কাজটি মোগল সাম্রাজ্যজুড়ে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার কারণ হিসেবে ব্যবহৃত হতো ।
আওরঙ্গজেবের ন্যায়বিচারের ধারণার মধ্যে ধর্মীয় স্বাধীনতার নির্দিষ্ট কিছু ব্যবস্থাও ছিল। এ কারণেই তিনি হিন্দু উপাসনার বেশির ভাগ স্থানকে সুরক্ষিত রেখেছিলেন। সাধারণভাবে মোগল শাসকেরা প্রজাদেরকে তাদের নিজস্ব ধর্মীয় ধারণা ও প্রবণতা অনুসরণ করার জন্য বিপুল আনুকূল্য প্রদর্শন করতেন। এটি ছিল ওই আমলে অনেক ইউরোপিয়ান দেশের কঠোর বিধানের সম্পূর্ণ বিপরীত 1 ওইসব দেশে শাসকদের ধর্মই অনুসরণ করতে হতো প্রজাদের। অবশ্য, রাষ্ট্রীয় স্বার্থ মোগল ভারতে ধর্মীয় স্বাধীনতায় চাপ সৃষ্টি করত। আর আওরঙ্গজেবও তার মনে হওয়া বিদ্রোহ বা অনৈতিক আচরণের ক্ষেত্রে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও নেতাদের বিরুদ্ধে কঠোর আঘাত হানতে দ্বিধা করতেন না। তবে এ ধরনের উদ্বেগ না থাকলে সব ভারতীয়ের প্রতি সমান আচরণ করার ব্যাপারে নিজের বিশ্বাসই আওরঙ্গজেবকে মন্দিরের প্রতি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে দিতে উদ্বুদ্ধ করত।
—
মেবারের হিন্দু রাজপুত শাসক রানা জয় সিংয়ের কাছে ১৬৫৪ সালে পাঠানো এক রাজাদেশে (ফারসিতে নিশান) আওরঙ্গজেব মন্দির ও অন্যান্য অমুসলিম ধর্মীয় স্থাপনার প্রতি একজন ভালো রাজার আচরণ সম্পর্কে একটি রূপরেখা দিয়েছেন। এতে তিনি লিখেছেন : ‘মহান রাজারা খোদার ছায়া হওয়ায় খোদার দরবারের স্তম্ভ এসব উচ্চ মর্যাদার লোকের নজর নিবেদিত থাকে এই কাজে যাতে : বিভিন্ন ধরনের ও বিভিন্ন ধর্মের (মাজাহিব) লোকজন শান্তির ছায়াতলে বাস করতে পারে, সমৃদ্ধিতে তাদের দিন গুজরান করতে পারে, কেউ যেন অন্যদের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে না পারে।’ আদব দুরস্ত ফরাসির মনোরম রীতি থেকে সরে এসে আমরা আওরঙ্গজেবের বক্তব্য হিসেবে যা পাই তা হলো : রাজারা হলো দুনিয়াতে আল্লাহর প্রতিনিধি এবং এ কারণে ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে শাস্তি নিশ্চিত করার দায়িত্ব রয়েছে তাদের।
ওই একই রাজাদেশে ‘গোঁড়ামির (তাসুর) আশ্রয় নেওয়া’ সব রাজার নিন্দা করেছেন এ কারণে যে ওই শাসক ‘খোদার সমৃদ্ধ সৃষ্টিকে গুঁড়িয়ে দিচ্ছেন এবং ঐশী ভিত্তিকে ধ্বংস করছেন।’ সিংহাসনে আসীন হলে আওরঙ্গজেব এ ধরনের অনৈপ্লামিক ব্যবস্থার দিকে থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে এর বদলে নিজের ‘পূর্বসূরিদের শ্রদ্ধামূলক রীতি ও প্রতিষ্ঠিত বিধান’ অনুসরণ করে ‘চার কোণযুক্ত বসতিময় বিশ্বকে দীপ্তিময়’ করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। আওরঙ্গজেবের দৃষ্টিতে ইসলামি শিক্ষা ও মোগল ঐতিহ্য তাকে হিন্দু মন্দির, তীর্থযাত্রীদের তীর্থস্থান ও সাধু পুরুষদের রক্ষা করতে বাধ্য করেছে।
আওরঙ্গজেব মোগল সাম্রাজ্যে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা পরিচর্যা করার ব্যাপারে তার রাজকীয় প্রতিশ্রুতির প্রতি বিশ্বস্ততা থাকার জন্য ৪৯টি বছর পেয়েছিলেন এবং তিনি শুরু করেছিলেন দৃঢ়ভাবে। সম্রাট হিসেবে আওরঙ্গজেবের প্রথম দিকের একটি কাজ ছিল বেনারসের স্থানীয় মোগল কর্মকর্তাদের এই রাজকীয় নির্দেশ (ফরমান) প্রদান যে স্থানীয় মন্দিরগুলোর কার্যক্রমে যেন কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ না হয়। ১৬৫৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে আওরঙ্গজেব লিখেন যে তিনি জানতে পেরেছেন যে ‘কিছু লোক বিদ্বেষপরায়ণতা ও তিক্ততার কারণে বেনারস ও কাছের কয়েকটি এলাকায় সেখানকার প্রাচীন মন্দিরগুলোর দায়িত্বে থাকা একদল ব্রাহ্মণসহ হিন্দু অধিবাসীদের হয়রানি করছে।’ সম্রাট এরপর কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন : ‘ব্রাহ্মণ বা অন্য হিন্দুরা যাতে তাদের ঐতিহ্যবাহী এলাকায় অবস্থান করে সাম্রাজ্যের ধারাবাহিকতার জন্য দোয়া করতে পারে, সেজন্য তোমাকে অবশ্যই নজর রাখতে হবে সেখানে তাদেরকে কেউ যেন অন্যায়ভাবে হয়রানি করতে না পারে।’
মন্দির ও সেগুলোর তত্ত্বাবধায়কদের রক্ষার জন্য আওরঙ্গজেবের ১৬৫৯ সালের বেনারস ফরমানের শেষ অংশটি তার লেখা অনেক রাজকীয় আদেশের সাধারণ ধ্রুববাক্যে পরিণত হয়। তিনি তাতে বলেছিলেন, তাদেরকে তাদের মতো করে রাখতে হবে, যাতে মোগল সাম্রাজ্যের দীর্ঘস্থায়িত্বের জন্য ব্রাহ্মণরা দোয়া করতে পারে।
—
রাজ্য শাসনকালের পুরো সময়জুড়ে আওরঙ্গজেবের অবিচ্ছেদ্য নীতি ছিল হিন্দু ধর্মের প্রতিষ্ঠান ও তাদের নেতাদের কল্যাণ নিশ্চিত করা। তিনি অনাকাঙ্ক্ষিত হস্তক্ষেপ থেকে মন্দিরগুলোকে রক্ষা করার জন্য, হিন্দু সম্প্রদায়কে ভূমি মঞ্জুর করার জন্য এবং হিন্দু আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্বদের বৃত্তি প্রদান করার জন্য অনেক নির্দেশ জারি করেছিলেন।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, শাসনকালের নবম বছরে গৌহাটির উমানন্দ মন্দিরকে পূর্ববর্তী ভূমিদান ও রাজস্ব সংগ্রহের অধিকার বহাল রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করে একটি ফরমান জারি করেন। ১৬৮০ সালে তিনি নির্দেশ দেন যে বেনারসে গঙ্গার তীরে বসবাসকারী হিন্দু সন্ন্যাসী ভগবন্ত গোসাহঁকে যেন হয়রানিমুক্তভাবে থাকতে দেওয়া হয়। ১৬৮৭ সালে তিনি বেনারসের একটি ঘাটে থাকা কিছু ফাঁকা স্থান (ঘটনাক্রমে ওই জমি ছিল একটি মসজিদের কাছে) রামজীবন গোসাইঁকে দেওয়ার নির্দেশ দেন, যাতে তিনি ‘ধার্মিক ব্রাহ্মণ ও পবিত্র দরবেশদের’ জন্য ঘর তুলতে পারেন। ১৬৯১ সালে বালাজি মন্দিরকে সহায়তার লক্ষ্যে চিত্রকূটের মহন্ত বালক দাস নিবানিকে আটটি গ্রাম ও বেশ ভালো পরিমাণ করমুক্ত ভূমি মঞ্জুর করেন আওরঙ্গজেব। ১৬৮৮ সালে মধ্য ভারতের পূর্ব খানদেশে নেক ভট্টের ছেলে রং ভট্ট নামের এক ব্রাহ্মণকে তিনি করমুক্ত ভূমি মঞ্জুর করেন। তালিকাটি বেশ বড় এবং এতে এলাহাবাদ, বৃন্দাবন, বিহার ও অন্যান্য স্থানে মন্দির ও ব্যক্তিদের নাম রয়েছে।
হিন্দু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অনুকূলে মঞ্জুরি প্রদান করার পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্য বহাল রাখেন আওরঙ্গজেব। এই ধারাবাহিকতা ফুটে ওঠে জঙ্গম নামের এক শৈব গ্রুপের সাথে তার আচরণে। গ্রুপটি আকবরের আমল থেকে মোগল আদেশ থেকে উপকৃত হয়ে আসছিল। আকবরই ১৫৬৪ সাল থেকে ভূমিতে তাদের আইনত অধিকার নিশ্চিত করেন। এ গ্রুপটি আওরঙ্গজেবের কাছ থেকে বেশ কিছু ফরমান লাভ করেন। এসবের ভিত্তিতে তারা অন্যায়ভাবে বাজেয়াপ্ত হওয়া ভূমি ফিরে পায় (১৬৬৭), স্থানীয় মুসলিমদের বাধা থেকে সুরক্ষা প্রাপ্তি ঘটে (১৬৭২) ও অবৈধভাবে ধার্য কর ফেরত পেয়ে যায় (১৬৭৪)। এসব পদক্ষেপে নিশ্চিত হওয়া যায় যে ধার্মিক ব্যক্তিরা তাদের ধর্মীয় কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে পারতেন। আর তা ছিল আওরঙ্গেেজবর ন্যায়বিচার অন্তঃদৃষ্টির একটি অনুষঙ্গ ।
আওরঙ্গজেব জৈন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিও একই ধরনের অনুকূল নীতি বাস্তবায়ন করেছেন। এখানেও আকবরের উদাহরণ অনুসরণ করে ১৬৫০ এর দশকের শেষ দিকে শত্রুঞ্জয়, গিরনার ও মাউন্ট আবুতে (তিনটি স্থানই ছিল জৈন তীর্থযাত্রীদের গন্তব্য) ভূমি মঞ্জুর করেন। তিনি সম্ভবত ১৬৮১ সালের আগে কোনো একসময় জৈন সন্ন্যাসী লাল বিজয়কে একটি আখড়া (পশাল) এবং ১৬৭৯ সালে একটি বিশ্রামাগার (উপাশ্রয়) মঞ্জুর করেন। ১৭০৩ সালের দিকে আওরঙ্গজেব জনৈক জৈন ধর্মীয় নেতা জিনা চন্দ্র সুরিকে হয়রানি থেকে রক্ষা করার নির্দেশ জারি করেন। এ ধরনের নির্দেশনার ফলে এই সময়কালের জৈন সাহিত্যে সম্রাটের উচ্ছ্বসিত প্রশংসার কারণ বুঝতে পারি। একটি স্থানে বলা হয়েছে, ‘আওরঙ্গজেব শাহ সাহসী ও শক্তিশালী রাজা’ (মারদানো আওর মহাবলী আওরঙ্গশাহি নারান্দা)।
—
আওরঙ্গজেব ১৬৭২ সালে হিন্দুদের দেওয়া সব ভূমি ফিরিয়ে নেওয়া ও এ ধরনের সব বন্দোবস্তু কেবল মুসলিমদের জন্য নির্ধারিত করার একটি আদেশ জারি করেন। সম্ভবত আলেমদের দাবির প্রতি এটি ছিল একটি ছাড়। এই নির্দেশ কঠোরভাবে পালন করা হলে তা হতে পারত হিন্দু ও জৈন সম্প্রদায়ের জন্য বড় ধরনের আঘাত। কিন্তু ঐতিহাসিক প্রমাণ বলে ভিন্ন কথা।
ভূমি দানের নতুন নীতি বিশেষ করে সাম্রাজ্যের দূর প্রত্যন্ত এলাকায় বাস্তবায়ন করা হয়নি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বাংলার মোগল কর্মকর্তারা ১৬৭২ সালের নির্দেশ জারির আগে হিন্দুদেরকে যত ভূমি বন্দোবস্তু দিয়েছিলেন, পরে দিয়েছিলেন তার চেয়ে বেশি। স্বতন্ত্র ঘটনাগুলোর প্রাচুর্যও ইঙ্গিত দেয় যে ভূমি ফিরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ ছিল কাগজে-কলমে, বাস্তবে নয়। উদাহরণ হিসেবে গুজরাতের কথা বলা যেতে পারে। আওরঙ্গজেবের শাসনকালের শেষ দিকে চিকিৎসকদের একটি পারসি পারিবার ১৭০২ সালের আগে পাওয়া ভূমি মঞ্জুরের নিশ্চয়তাপত্র পেয়েছিল। একইভাবে আগেই অন্যান্য অঞ্চলের যে বিপুলসংখ্যক উদাহরণ আমি উল্লেখ করেছি, তাতে ওই নীতির সীমিত বাস্তবায়নের ইঙ্গিত দিচ্ছে। প্রমাণের ভিত্তিতে আধুনিক অনেক ইতিহাসবিদ মনে করছেন যে ১৬৭২ সালের নির্দেশটি কার্যত সাম্রাজ্যের কোথাও বাস্তবায়িত হয়নি, পাঞ্জাবের মতো কিছু নির্দিষ্ট এলাকা ছাড়া তা ‘কাগজপত্রেই থেকে যায় ৷
আরো অনেক সময় হিন্দু মন্দিরগুলোর প্রতি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন আওরঙ্গজেব। উদাহরণ হিসেবে আগেই উল্লেখ করা ১৬৫৯ সালের বেনারস নির্দেশের কথা বলা যায়। এতে আওরঙ্গজেব জানিয়েছেন, ইসলামি আইনের বিধান অনুযায়ী, ‘প্রাচীন কোনো মন্দির ভাঙ্গা যাবে না।’ তবে এতে আরো যোগ করা হয়েছে, ‘নতুন কোনো মন্দির নির্মাণ করা যাবে না।’ রিচার্ড ইটন উল্লেখ করেছেন, এটি বেনারসের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল, আওরঙ্গজেবের শাসনকালে সাম্রাজ্যের অন্যত্র অসংখ্য মন্দির নির্মিত হয়েছে। কিন্তু তবুও এ নির্দেশটি ছিল আগেকার মোগল নীতির থেকে সরে যাওয়া। উল্লেখ্য, এ নীতিটি আওরঙ্গজেবের হিন্দু মন্দির রক্ষার জটিলতা (এবং সেইসাথে সীমা) প্রকাশ করে।
মন্দির ধ্বংসকারী
কোনো প্রাচীন মূর্তির মন্দির ভেঙ্গে ফেলা বৈধ নয় এবং প্রাচীন কাল থেকে প্রথা হিসেবে চালু থাকা সরোবরে প্রক্ষালন নিষিদ্ধ করাও দায়িত্ব আপনার নয় ৷
–ভবিষ্যত দিল্লির সুলতান সিকান্দার লোদির (শাসনকাল ১৪৮৯-১৫১৭) প্রতি মুফতিদের উপদেশ
মোগল সাম্রাজ্যজুড়ে থাকা লাখ লাখ মন্দিরের সবগুলো না হলেও বেশির ভাগই আওরঙ্গজেবের আমলের শেষ সময় পর্যন্ত টিকে ছিল।
আওরঙ্গজেবের নির্দেশে ঠিক কতটি মন্দির ধ্বংস বা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তা কেউ জানে না, আমরা কখনো জানতেও পারব না। আওরঙ্গজেবের শাসনকালে মন্দির ধ্বংসের নিশ্চিত সংখ্যা মাত্র এক ডজনের সামান্য কিছু বেশি বলে উল্লেখ করেছেন এ বিষয়ক শীর্ষস্থানীয় বিশেষজ্ঞ রিচার্ড ইটন। আর এগুলোর মধ্যে সরাসরি সম্রাটের নির্দেশে ধ্বংস করা হয়েছে আরো কম । অন্যান্য বিশেষজ্ঞ ইটনের উল্লেখ না করা আরো কয়েকটি মন্দির ধ্বংসের কথা উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে ১৬৫৯ ও ১৭০৬ সালে সোমনাথ মন্দির ধ্বংস-সংক্রান্ত দুটি নির্দেশ (দ্বিতীয় নির্দেশটির অস্তিত্ব থাকার অর্থ হচ্ছে, প্রথম নির্দেশটি বাস্তবায়িত হয়নি)। আওরঙ্গজেব নিজেও মন্দির অপবিত্রকরণ তদারকি করেছেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৬৪৫ সালে তিনি জৈন বণিক শান্তিদাসের নির্মিত আহমদাবাদের চিন্তামনি পার্শ্বনাথ মন্দিরে মিরহাব (মুসলিমদের মসজিদে নামাজের নির্দেশসূচক) তোলার নির্দেশ দেন। কিন্তু এমনকি এ ধরনের ক্ষেত্রেও ইটন উদ্ধৃতি হলো, ‘প্রায় সবসময়ই প্ৰমাণ অতিরঞ্জিত, অসম্পূর্ণ ও এমনকি সাংঘর্ষিক।’ এমন প্রেক্ষাপটে বলা যায়, আমরা যতগুলো সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারি, আওরঙ্গজেবের আমলে সম্ভবত তার চেয়ে বেশি মন্দির ধ্বংস করা হয়েছিল (হয়তো মোটে কয়েক ডজন?), কিন্তু এখানে আমরা অজ্ঞাত অতীতের ওপর টেনে দেওয়া কালো পর্দার মুখোমুখি হই ।
অবশ্য, ক্ষীণ যে কয়েকটি রশ্মি আছে, তার আলো থেকে আমরা ধরে নিতে পারি যে আওরঙ্গজেবের ভারতবর্ষে মন্দির ধ্বংস ছিল তুলনামূলকভাবে অনেক কম। উদাহরণ হিসেবে সাকি মস্তাইদ খানের মাসির-ই আলমগিরে (আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর সামান্য পরে লিখিত ফারসি ভাষায় ইতিহাসপুঞ্জি) ১৬৭০ সালে মথুরার কেশব দেব মন্দির গুঁড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশের কথা বলা যেতে পারে। এটিকে দৃশ্যত একেবারে ভিত্তিহীন বিরল ও অসম্ভব ঘটনা’ হিসেবে অভিহিত করা যেতে পারে। সার্বিকভাবে মাসির-ই আলমগিরি হলো ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা আওরঙ্গজেবের শাসনকাল। এখানে অনেক সময় লেখকের অভিরুচি অনুযায়ী তথ্য পরিবর্তন করা হয়েছে। এই প্রবণতার মানে হলো এই যে এ গ্রন্থটি (এটি ইতিহাস নয়, বরং বাগাড়ম্বড়তার শিল্পকর্ম) থেকে উদ্ধৃতি দেওয়ার সময় চরম সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। মাসির-ই আলমগিরিতে আওরঙ্গজেবের হাতে ভাঙ্গা মন্দিরের সংখ্যা বাড়িয়ে দেখানোর বিষয়টি প্রমাণিত। এতে এমন সব গাল-গল্প উল্লেখ করা হয়েছে যেসব ঘটা অস্বাভাবিক ও অপ্রত্যাশিত ।
উপনিবেশ-পূর্ব আমলের ভারতবর্ষে মন্দির ভাঙ্গার ব্যাপারটি ইটনের মতে, “সংখ্যার খেলায় কাটাকাটিতে মেতে ওঠা’ একটি পণ্ডশ্রম। আওরঙ্গজেব কেন সুনির্দিষ্ট কিছু হিন্দু মন্দিরকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছিলেন, আর বিশালসংখ্যক মন্দিরকে স্পর্শ করার বাইরে রেখেছিলেন. তা নিয়ে যুক্তি পুনঃগঠনের জন্য আমরা আরো দৃঢ় ভিত্তির ওপর অবস্থান করছি।
—
রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের কারণেই নির্দিষ্ট হিন্দু মন্দিরগুলোর ওপর হামলা চালাতে প্ররোচিত হয়েছিলেন আওরঙ্গজেব। আওরঙ্গজেব ১৬৬৯ সালে বেনারসের বিশ্বনাথ মন্দির ধ্বংস করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তারপর ১৬৭০ সালে কেশব দেব মন্দির গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। উভয় ক্ষেত্রেই আওরঙ্গজেব মন্দিরের সাথে সম্পৃক্তদেরকে তাদের রাজনৈতিক ভুল পদক্ষেপের শাস্তি দিতে চেয়েছিলেন এবং মোগল রাষ্ট্রের প্রতি তাদের ভবিষ্যতের আনুগত্য নিশ্চিত করতে চেয়েছেন ।
ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো রাজনৈতিক কারণে ধ্বংস করার ধারণাটি আধুনিক অনেক লোকের কাছে অগ্রহণযোগ্য বিবেচিত হলেও প্রাক-আধুনিক ভারতবর্ষে ধর্ম ও রাজনীতির মধ্যে এ ধরনের জোরালো রেখা টানা ছিল না। বরং এর বিপরীতে হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ই মন্দিরকে ব্যাপকভাবে রাজনৈতিক পদক্ষেপের সাথে সম্পর্কিত মনে করত। সম্ভবত ষোড়শ শতকে লিখিত সংস্কৃত গ্রন্থ বৃহতসংহিতায় সতর্ক করা হয়েছে যে ‘দৃশ্যমান কারণ ছাড়া যদি কোনো শিবলিঙ্গ, ছবি বা মন্দির ভেঙ্গে যায়, সরে যায়, ঘাম নির্গত হয়, কাঁদে, কথা বলে বা অন্য কিছু করে, তবে ওই রাজা ও তার রাজ্য ভেঙে পড়ার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হচ্ছে।’ ধর্মীয় প্রতিমার রাজনৈতিক শক্তি থাকার এই বক্তব্যের আলোকে হিন্দু রাজারা সপ্তম শতক থেকে একে অন্যের মন্দিরগুলো লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করতেন, নিয়মিতভাবে দুর্গা, গনেশ, বিষ্ণু ইত্যাদি দেব-দেবীর মূর্তি লুটপাট করতেন, ভেঙে ফেলতেন। তারা নিয়মিতভাবে একে অপরের মন্দিরগুলো ধ্বংস করতেন। কোনো কোনো হিন্দু রাজা এ ধরনের কাজকে উদযাপন ও স্মরণে রাখার জন্য সংস্কৃত কবিতা রচনা করতেন। আওরঙ্গজেবের মতো ইন্দো-মুসলিম শাসকেরা এর আলোকে শাস্তিমূলক রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ হিসেবে হিন্দু মন্দিরগুলোকে বৈধ লক্ষ্যবস্তু বিবেচনা করতেন।
আওরঙ্গজেব ১৬৬৯ সালে বেনারসের বিশ্বনাথের মন্দিরের বড় অংশ ভেঙ্গে ফেলেন। আকবরের আমলে রাজা মানসিং মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন । অনেকে মনে করেন, মানসিংহের নাতির ছেলে জয় সিং ১৬৬৬ সালে মোগল দরবার থেকে শিবাজি ও তার ছেলে শম্ভুজিকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিলেন। এই জয় সিংই এর আগে পুরান্দারে শিবাজির বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালিয়েছিলেন । এছাড়া ১৬৬৯ সালে বিশ্বনাথ মন্দিরের সাথে সম্পর্কিত বেনারসের অনেক জমিদারদের মধ্যে একটি বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। তাদের অনেকেও শিবাজির পলায়নের সাথে জড়িত ছিলেন।
আওরঙ্গজেব ১৬৭০ সালে মাথুরার কেশব দেব মন্দিরটি নিশ্চিহ্ন করার নির্দেশ দেন। ১৬১৮ সালে বীর সিং বুন্দেলার নির্মিত এ মন্দিরটি ভাঙ্গার পেছনেও ছিল রাজনৈতিক কারণ। মাথুরার ব্রাহ্মণরা সম্ভবত ১৬৬৬ সালে শিবাজির আগ্রা থেকে চলে যেতে সহায়তা করেছিলেন। অধিকন্তু কেশব দেব মন্দিরটির পৃষ্ঠপোষকতা করতেন সিংহাসনে আওরঙ্গজেবের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দারা শুকোহ। আরো কাছাকাছি সময়ে, তথা ১৬৬৯ ও ১৬৭০ সালে ওই অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়া জাট বিদ্রোহে মোগলদের ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটে। পরে বছরগুলোতে যোধপুর, খান্দেলা ও অন্যান্য অঞ্চলে একই কারণে মন্দির ধ্বংস করার নির্দেশ দেন আওরঙ্গজেব ।
বিশ্বনাথ ও কেশব দেব মন্দিরের উভয়স্থানেই মসজিদ নির্মিত হয়, তবে তা ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে। বিধ্বস্ত মন্দিরটির প্রাচীরের কিছু অংশ ভবনটির সাথে একীভূত করে নির্মিত জ্ঞানবাপি মসজিদটি এখনো দাঁড়িয়ে আছে। এই পুনঃব্যবহারের কারণ সম্ভবত এটি মোগল কর্তৃত্ব বিরোধিতার ভয়ঙ্কর পরিণাম সম্পর্কে ধর্মীয় আবরণে দেওয়া একটি বিবৃতি। ব্যবহার করায় সুবিধা থাকাও সম্ভবত পুনঃব্যবহারের একটি কারণ। জ্ঞানবাপি মসজিদটি আওরঙ্গজেবের আমলে নির্মিত হলেও এর পৃষ্ঠপোষকের নাম জানা যায় না, কাঠামোটির কথাও মোগল নথিপত্রে নেই ।
মাথুরার কেশব দেবের মন্দিরের স্থানে নির্মিত মসজিদটির পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন আওরঙ্গজেব। জাট বিদ্রোহের সময়কার মোগল কমান্ডার ও মাথুরার প্রধান মসজিদের পৃষ্ঠপোষক আবদুল নবি খানের মৃত্যুর ঘটনার মাধ্যমে এর ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। আবদুল নবির মৃত্যুর (এতে মাথুরার মসজিদগুলোর পৃষ্ঠপোষতা হ্রাস পেয়েছিল) মাত্র আট মাস পর কেশব দেব মন্দিরটি ধ্বংস করা হয়।
—
আমরা মোগল মন্দির ধ্বংস নিয়ে রাজনীতি পুনঃনির্মাণ করতে পারলেও মধ্য যুগের পর্যবেক্ষকেরা, যদি করেও থাকেন, খুব কমই কখনো কিছু স্থানে হামলার বাস্তব রাজনৈতিক যুক্তির ওপর জোর দিয়েছিলেন। অনেক হিন্দু ও জৈন চিন্তাবিদ মন্দির ধ্বংসকে কলি যুগ বা বর্তমান সময়ের আবির্ভাব হিসেবে দেখেছেন। মন্দির ধ্বংসের বর্ণনা করার সময় মুসলিম লেখকেরা সাধারণভাবে জিহাদ বা অন্য কোনো ধর্মভিত্তিক ধারণা তুলে ধরেছেন। ইসলামি প্রবণতাটির মূল সম্ভবত নিহিত রয়েছে এই ধারণায় যে ইসলামি আইনে সরকারের স্বার্থে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ক্ষতিসাধন অনুমোদন করে না। ফলে ইসলাম বিস্তারের যুক্তি উপস্থাপন ছিল ওই কাজের যৌক্তিকতা প্রতিপন্ন করা। এই যুক্তি সাংস্কৃতিকভাবে যথাযথ হলেও আওরঙ্গজেবের ভারতবর্ষে মন্দির ধ্বংসের ঐতিহাসিকভাবে ব্যাপকভিত্তিক ব্যাখ্যা দিতে পারে না।
আওরঙ্গজেব কেন কিছু মন্দির ধ্বংস করলেন এবং অন্যগুলো একেবারে অক্ষত রেখে দিলেন তার ব্যাখ্যা ইতিহাসের আলোকে কলি যুগ ও জিহাদ তত্ত্ব দিতে না পারলেও বিকল্প ধর্মীয় কারণও বিরাজ করতে দেখা যায়। আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর ইতিহাস রচনাকারী মুস্তাইদ খান বলেছেন যে ১৬৬৯ সালে আওরঙ্গজেব জানতে পারেন যে ‘থাট্টা, মুলতান ও বেনারসের কিছু বিচ্যুৎ ব্রাহ্মণ তাদের প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ভ্রান্ত বই পড়াচ্ছেন। তাদের কাছ থেকে ভ্রষ্ট শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য দূর দূরান্ত থেকে হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের লোকজন সেখানে যাচ্ছে।’ মাথুরার কেশব দেব মন্দিরের ক্ষেত্রেও একই বিষয় প্রযোজ্য হতে পারে। সেই জাহাঙ্গীরের আমলেও এ মন্দিরটির দিকে মুসলিমরা আকৃষ্ট হয়েছিল।
মোগল বাদশাহদের কয়েকটি প্রজন্ম নির্দিষ্ট কিছু ধর্মীয় আচরণ, বিশেষ করে মোগলদের দৃষ্টিতে অপেক্ষাকৃত কম মার্জিত হওয়ার সুযোগ গ্রহণকারী ভ্রান্ত ব্রাহ্মণদের দমন করার চেষ্টা করেছেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আকবর নিম্নবর্ণের লোকদের কাছে হিন্দু গ্রন্থগুলোর ভুলভাবে উপস্থাপনের জন্য ব্রাহ্মণদের দায়ী করেছিলেন। তিনি আশা করেছিলেন যে সংস্কৃত পুস্তকগুলো ফারসিতে অনুবাদ করা হলে (তার দৃষ্টিতে) এসব ঔদ্ধত্যপূর্ণ নেতা তাদের পথ সংশোধন করতে উদ্দীপ্ত হবেন ।
আওরঙ্গজেবও সাধারণ হিন্দুদের প্রতারিত করার লক্ষ্যে ব্রাহ্মণদের নিজেদের ধর্ম সম্পর্কে বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করতেন, এবং সম্ভবত বিশেষভাবে আতঙ্কিত ছিলেন এই ভেবে যে, মুসলিমরা ভণ্ড লোকদের খপ্পরে পড়ে যাচ্ছে। এ ধরনের প্রতারণার মাধ্যমে ব্রাহ্মণরা আর্থিকভাবেও লাভবান হতেন। ফরাসি পর্যটক জ্যাঁ ডি থেভেনট অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে বেনারসে ব্রাহ্মণদের সংখ্যা অনেক এবং তারা বিপুলসংখ্যক লোককে টেনে আনা বড় বড় অনুষ্ঠান থেকে ‘লাভবান হওয়ার পথ খোঁজে। এ ধরনের ক্ষেত্রে মোগল রাজকীয় বাধ্যবাধকতা ছিল তাদের প্রজাদেরকে প্রতারিত হওয়া প্রতিরোধ করার জন্য দায়িত্বশীল ভূমিকা গ্রহণ। বেনারস ও অন্যান্য স্থানের বেশির ভাগ মন্দিরে ভ্রান্ত কার্যকলাপ হয় কিনা তার অনুসন্ধান করার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন আওরঙ্গজেব। তবে বিশ্বনাথ ও কেশব দেব মন্দিরের ক্ষেত্রে তার মনে হয়েছিল, ধ্বংস করাই হবে যথাযথ ।
—
আওরঙ্গজেবের লক্ষ্যবস্তু হওয়া বেশির ভাগ মন্দির ছিল উত্তর ভারতে। গুটিকতেক ব্যতিক্রম ছাড়া আওরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্যের কোনো মন্দির ধ্বংস করেননি। অথচ এখানেই তার জীবনের শেষ তিন দশক মোগল সাম্রাজ্য সম্প্রসারণের কাজে তার সেনাবাহিনী নিয়োজিত ছিল। মধ্য ও দক্ষিণ ভারতে অসংখ্য মন্দির ভেঙ্গে ফেলা সম্ভব ছিল। কারণ মোগলরা এসব এলাকায় তাদের সামরিক শক্তি দুর্গ ও অন্যান্য সামরিক লক্ষ্যবস্তুগুলোর বিরুদ্ধে প্রয়োগ করেছিল। কিন্তু আওরঙ্গজেব মোগল সাম্রাজ্যে নতুন নতুন এলাকা সফলভাবে একীভূত করার সাথে মন্দির ভাঙ্গাকে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে বিবেচনা করেননি।
এমনকি আওরঙ্গজেব যখন দক্ষিণ দিকে মোগল শাসন সম্প্রসারণের পথে ব্যাপক প্রতিরোধের মুখে পড়েছিলেন, তখনো তিনি প্রয়োজনের আলোকে অন্যান্য কৌশল অবলম্বন করেছিলেন। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে বোঝা যাচ্ছে, আওরঙ্গজেব ও তার কর্মকর্তারা মনে করতেন যে মন্দির ভাঙ্গা হলো চরম পদক্ষেপ, তাই এর ব্যবহার করতে হবে খুবই কম!