এখন শীতের দিন। জমি থেকে সব ফসল উঠে গেল বলে মাঠ ফাঁকা। কেবল নরেন দাস অথবা মাঝি-বাড়ির শ্রীশচন্দ্র, প্রতাপ চন্দ কামলা দিয়ে নিচু জমিতে তামাকের চাষ করছে। আর সব উর্বরা জমি থাকলে সেখানে পেঁয়াজ, রসুন এবং চীনাবাদামের গাছ দেখা যাচ্ছে। এই পথে কেউ বড় এখন আসবে না। এলেও ঝোপের ভিতর যে একটা মানুষ শিকারী বেড়ালের মতো ওৎ পেতে আছে টের পাবে না। জালালির শরীরটা এখন মাঠের শেষে অদৃশ্য হয়ে গেছে। পুবের বাড়ির মালতী গরু নিয়ে এসেছে গোপাটে। সে গোপাটে গরুর খোঁটা পুঁতে চলে যাচ্ছে।
সরকারদের ঘাট পাড়ে তেমনি ঢাক বাজছে, ঢোল বাজছে। মাঠে মাঠে বাস্তুপূজার নিশান উড়ছে। ঠাকুরবাড়ি, পালবাড়ি এবং বিশ্বাসপাড়া যেদিকে তাকানো যাচ্ছিল সব দিকে সেই ঢোলের বাজনা আর মেষ অথবা মোষের আর্তনাদ। মোষ বলির সময় হলে সরকারদের পঞ্চাশজন ঢাকি একসঙ্গে ছররা ছোটাবে। সে একবার একটু কাৎ হয়ে গলাটা কচ্ছপের মতো যেন বাড়িয়ে দিল। মনে হল মাইজলা বিবির মুখ শরীর ঝোপের অন্য পাশে–ঠিক ঘাটের মধ্যে নেমে আসছে। ভেসে উঠেও উঠল না। মরীচিকার মতো ঝিলিমিলি করছে শুধু। আহা, ভেতরটা কেমন করছিল ফেলুর।
তখন হাইজাদির সরকারেরা করজোড়ে নতুন গামছা গলায় দাঁড়িয়ে আছে। মোষের ধড় এবং মুণ্ডু নিতে যারা শীতলক্ষ্যার পার থেকে এসেছিল, তারা ঘাটের অন্য পাড়ে দাঁড়িয়ে। মাঠে মাঠে উৎসব আর ঝোপের ভিতর ফেলু। সে মাইজলা বিবির মরীচিকা দেখার জন্য ঝোপের ভিতর কচ্ছপের মতো গা তুলে রাখল।
মালতী গোপাটে গরুর খোঁটা পুঁতে তাড়াতাড়ি শোভা আবুকে নিয়ে ঠাকুরবাড়ির ঘাটে স্নান করতে চলে গেল। বাস্তুপূজা বলে সকাল সকাল আভারানী স্নান করেছে। মাঠে অমূল্য কলাগাছ পুঁতে এসেছে। এবং দুর্বাঘাস চেঁচে চারদিকটা পরিচ্ছন্ন করে শুকনো আমের ডাল বেলপাতা সব পেড়ে এনে বারকোষে রেখে দিয়েছে। গোটা তিনেক জমি পার হলে ঠাকুরবাড়ির ভিটা জমি। সেখানে বড়বৌ ধনবৌ সকাল সকাল স্নান করে চলে এসেছে। সোনা, ঠাকুরঘর থেকে কাঁসি নিয়ে ছুটছে। সোনা কাঁসিটা জোরে জোরে বাজাচ্ছিল। পুকুরের জলে কচুরীপানা কলমিলতা এবং শীতের সময় বলে গাছে কোনও ফল নেই, ফুল বলতে কিছু শীতের ফুল ঝুমকোলতা, শ্বেতজবা, রাঙাজবা। বাস্তুপূজায় রাঙাজবা দিতে নেই। শ্বেতজবা কে ভোর না হতেই গাছ থেকে চুরি করে নিয়ে গেছে। বড়বৌ সাজিতে সামান্য ফুল সংগ্রহ করতে পেরেছেন। খুঁজেপেতে কিছু শ্বেতজবা, কিছু পলাশ ফুল আর টগর। গাঁদা ফুল কিছু আছে। শীতের জন্য শ্বেতজবা তেমন ফোর্টে না ভালো, ফুলগুলি কুঁকড়ে আছে—অসময়ের ফুল বড় হতে চায় না।
তখন জালালি সমস্ত গরিবদুঃখী মানুষের সঙ্গে সেই বড় বিলে, প্রকাণ্ড বিলে—এ-পাড়ে দাঁড়ালে যার ও-পাড় দেখা যায় না, যে বিলে ভিন্ন ভিন্ন সব কিংবদন্তী রয়েছে, বিলের চারপাশে নলখাগড়ার বন, মাঝে মাঝে উঁচু ডাঙা, আবার দু’দশ একর নিয়ে গভীর জল, কালোজল বড় গভীর—যেখানে মানুষ যেতে, নৌকা বাইতে ভয়, তেমন বিলে নেমে যাচ্ছে জালালি। জলের ভিতর কি এক দৈত্য থাকে বুঝি, কিংবদন্তীর দৈত্য। ওর পেট পিঠ জ্যোৎস্না রাতে ময়ূরপঙ্খী নৌকার মতো। নৌকা যেন এক জলে ভাসে, জলে ভেসে নৌকা যায়, ময়ূরপঙ্খী ভেসে যায়। তারপর মানুষের সাড়া পেলে টুপ করে জলের নিচে ডুবে যায়—হায়, মানুষের অগম্য বুদ্ধি। অজ্ঞ মানুষের বিশ্বাস, অলৌকিক ঘটনার মতো ঘটনা নেই। দুপুর রাতে চরাচরে যখন মানুষ জেগে থাকে না, যখন সারা বিলটা পাঁচ-দশ ক্রোশ জুড়ে জলের ভিতর ডুবে থাকে, যখন জ্যোৎস্নায় ফসলের মাঠ ভরে থাকে তখন জলে এক ময়ূরপঙ্খী নাও ভাসে—ভিতরে রাজকন্যা এক, চাঁদবেনের পুত্রবধূ হবে হয়তো, বেহুলা লখীন্দরের পাঁচালি মানুষের প্রাণে বিহ্বলতা জাগায়।
নৌকা বিলের জলে ভেসে উঠলে আলোতে আলোময়। যেন মাঝ বিলে আগুন ধরে গেছে। তেমন বিলে নেমে যাবার আগে জালালি জলটা প্রথম মাথায় দিল, পরে মুখে জল দিল, তারপর গোসাপের মতো জলে ভেসে গেল। শীত কনকন করছে—কিন্তু পেটের জ্বালা বড় জ্বালা, জ্বালা নিবারণ হয় না জলে। কবে আবেদালি গেছে, মাস পার হয়ে যাবে প্রায়, ঘুরে এল না এখনও। এলেও দু’চার হপ্তা পেট পুরে খাওয়া। তারপর ফের উপোস। জালালি জলে ভাসতে থাকল। ফুৎ করে জল মুখে নিয়ে হাওয়ার ভিতর জল ছুঁড়ে দিতে থাকল।
সব মানুষ সাঁতার কেটে যেখানে শাপলা-শালুকের পাতা ভেসে আছে সেদিকটায় চলে যেতে থাকল ক্রমশ। বড় শালুকের জন্য সকলের লোভ বেশি। এ-জলে কি আছে কি নেই,কেউ বড় জানে না। বরং কী নেই, কী থাকতে না পারে এই বিস্ময়। সেই এক সালে হাজার হাজার মানুষ পুরীপূজার মেলা থেকে ফিরে আসার সময় দেখেছিল—বিলের ঠিক মাঝখানে কালো রঙের এক মঠ ভেসে উঠেছে। ভেসে উঠতে উঠতে কিছু ওপরে উঠে থেমে গেল। তারপর ফের নিচে নেমে অদৃশ্য হয়ে গেল। প্রায় স্বপ্নের মতো ব্যাপারটা। যারা দেখেছে, তারা মন্ত্রের মতো বিশ্বাস করেছে, যারা দেখেনি তারা আজগুবি গল্প মনে করেছে। আর যাদের অলৌকিক ঘটনায় বিশ্বাস আছে তারা, খবরটাকে নিয়ে নতুন কিংবদন্তী সৃষ্টি করেছে। মনে হয় বুঝি ঈশা খাঁ সোনাই বিবিকে নিয়ে এ-বিলে লুকিয়ে রয়েছে। সেই জাহাজের মতো হালের দাঁড় কালো রঙের মঠের মতো জলের ওপর ভেসে ওঠে মাঝে মাঝে। শুধু একটু দেখিয়েই যেন ডুব দেয়। যেন বলে, দ্যাখো, দ্যাখো আমি এখনও বুড়ো বয়সে সোনাইরে নিয়ে বড় সুখে আছি বিলের ভিতর। তোমরা আমার অনিষ্ট করলে, আমিও তোমাদের অনিষ্ট করব। সেই ভয়ে ভরা ভাদরে সোজা বিলের মাঝ বরাবর কেউ নৌকা ছাড়ে না। এ-বিল বড় ভয়ঙ্কর। বিলের তল নেই, জলের নিচে মাটি নেই। শুধু যেন অন্ধকার আর প্রাচীন সব লতাগুল্ম নিয়ে চুপচাপ জলের ভিতর ডুবে আছে। ভয়ে এ-বিলে কেউ নৌকায় বাদাম দেয় না। বড় নিভৃতে যেতে হয়, যেন ঈশা খাঁর কালঘুম ভেঙে না যায়।
অঞ্চলের মানুষেরা এ-বিলকে দানবের মতো ভয় পায়। ঈশম যে ঈশম, সে পর্যন্ত এ বিলের পাড়ে এসে পথ হারিয়ে ফেলেছিল। কি এক জীনপরী পিছু লেগে ওকে রাতের বেলায় অজ্ঞান করে দিয়েছিল। সেই বিলে গরিবদুঃখী মানুষেরা পেটের জ্বালা নিবারণের জন্য জলে নেমে গেল।
পেটের জ্বালা বড় জ্বালা, জ্বালা মরে না জলে। জলের ভিতর ভেসে ছিল জালালি, যেন নেমে গেলেই পেটের জ্বালা নিবারণ হবে। কিন্তু হায়, জলের ভিতর কাদার ভিতর কোথাও শালুকের নাম গন্ধ নেই। রোজ রোজ তুলে নিয়ে গেলে কি আর থাকে! কিছু মরা শাপলা পাতা সামনের জলে উল্টে আছে। শীতের দিনে শাপলা ফুল আর ফোটে না। শাপলা ফুলে কালো কালো ফল হয়েছে। সে দুটো ফল সাঁতরাতে সাঁতরাতে সংগ্রহ করে ফেলল। এবং জলের ভিতরই জালালি ভাসতে ভাসতে খেতে থাকল। ভিতরে এক ধরনের কালো কালো বীচি, এক ধরনের সোঁদা সোঁদা গন্ধ, স্বাদ বলতে মরি মরি কিছু না, খেতে হয় বলে খাওয়া। পেটের ভেতর জ্বালা থাকলে কী খেতে না সখ যায়। লাল আলুর মতো সেদ্ধ করে খেতে হয় শালুকের ভেতরটা। একটু নুন দিয়ে, কোনও কোনও সময় তেঁতুলের অল্প গোলা ফেলে দিলে প্রায় অমৃতের মতো স্বাদ। লোভে সাঁতার দিতে থাকল জালালি। সামনে দুটো শালুক পাতা জলের ভিতর ডুবে আছে। লতা দুটো ধরার জন্য সে জলের ভিতর ডুব দিল। জলের নিচে নেমে গেল। অনেক নিচে, লতা ধরে ধরে আলগোছে তা ধরে ধরে—জোরে টান দিলে লতাটা ছিঁড়ে যাবে, লতা ছিঁড়ে গেলে সব গেল, জাদুর ঘরে নেমে যাবার সিঁড়িটা তুলে নেবার মতো হবে। সুতরাং খুব সন্তর্পণে জলে ডুবে যাবার জন্য, অন্ধকার মাটিতে হাতড়ে বেড়ানোর জন্য, ডুবুরির মতো বুড়বুড়ি তুলে প্রায় হারিয়ে গেল। জলের নিচে বড় ভয়। ভয়ে চোখ খুলছে না জালালি। চোখ খুললেই মনে হয় কোন জাদুকরের দেশে সে পৌঁছে গেছে। জলের নিচে জলজ ঘাসেরা তাকে নেচে নেচে ভয় দেখায়। নীল অথবা সবুজ মনে হতে হতে একটা কালো কুৎসিত অন্ধকার চারপাশ ঢেকে ফেলে। সে এক শ্বাসে জলের নিচে ডুবে নিমেষে জল কেটে আবার ওপরে ভেসে উঠল। তারপর কত দীর্ঘকাল পর যেন আকাশ মাটি এবং সূর্য দেখতে পেয়েছে এমন নিশ্চিন্তে শ্বাস নেবার সময় মুখটা খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে—সোনার চেয়েও দামী একটা বড় শালুক ওর হাতে।
পাতিলটা ঢেউ খেয়ে একটু দূরে সরে গেছে। সে পাতিলটাক টেনে এনে শালুকের শেকড়গুলি প্রথম কামড়ে ছিঁড়ে দেখল শালুকটা যত বড় ভেবেছিল—ঠিক তত বড় নয়। শালুকটা বোধ হয় রক্ত শাপলার। পেতি শাপলার সালুক বেশ মিষ্টি। সাদা শাপলার শালুকে কষ বেশি। রক্ত শাপলার শালুকে অল্প তিতাভাব থাকে। তবু শালুকটাকে পরিচ্ছন্ন করে খুব যত্নের সঙ্গে পাতিলের ভিতর রেখে পাড়ের দিকে তাকাল। কেউ আর পাড়ে দাঁড়িয়ে নেই। যে যার মতো শালুকের খোঁজে জলে ভেসে দূরে চলে যাচ্ছে। আবেদালি আসে না, কতকাল আসে না, সেই কবে গয়না নৌকার মাঝি হয়ে চলে গেল—আর আসে না। জব্বর আসে না। সে বাবুর হাটে তাঁতের কাজ নিয়ে চলে গেছে। জোটন এসেছিল একটা মুরগি নিয়ে আবেদালিকে খাওয়াবে বলে, মুরগিটা উড়াল দিয়ে সেই যে হাজিসাহেবের বাড়িতে চলে গেল, আর এল না। হাজিসাহেবের ছোট বিবি কোতল করে ফেলল মুরগির গলাটা।
বিলের জলে দুঃখী মানুষেরা শালুকের খোঁজে ভেসে বেড়াচ্ছিল। চারপাশের গ্রাম থেকে দুঃখী মানুষেরা হেঁটে এসে নেমে গেল জলে। বেলাবেলিতে সকলে জল ছেড়ে উঠে যাবে। এই শীতের শেষে আর যখন শালুক থাকবে না, যখন জলের ওপর আর কোনও শালুক পাতা ভাসবে না অথবা এই বিলের জল শান্ত নিরিবিলি, তখন ঝোপেজঙ্গলে অথবা জলের ওপর বালিহাঁস ভাসবে। নানা রকমের পাখি, লাল-নীল পালকের পাখি, জলপিপি এবং ভিন্ন ভিন্ন সব বক ছোট বড় চকাচকিতে প্রায় বিলটা ছেয়ে যাবে। তখন মুড়াপাড়ার জমিদারবাবুর ছেলেরা হাতিতে চড়ে আসবেন, তাঁবু ফেলবেন বিলের ধারে এবং ভোরে অথবা জ্যোৎস্নায় পাখি শিকার করে তাঁবুতে পাখির মাংস, ওরা শীতের শেষে মাসাধিক কাল পাখির মাংসে বন মহোৎসব চালাবে।
গ্রীষ্মকালটাই জালালির বড় দুঃসময়। প্রায় মাটিতে পেট দিয়ে পড়ে থাকতে হয়। বর্ষা এলে ধানের জমিতে, পাটের জমিতে আবেদালির কাজের অন্ত থাকে না। বর্ষা শেষ হলে জল কমতে থাকলে, শাপলা ফুল ফুটতে থাকলে মাটির নিচে অন্নের মতো প্রিয় এই শালুক, দুঃখী মানুষদের, নিরন্ন মানুষদের একমাত্র সম্বল এই শালুক, বর্ষা এলেই মাটির ভিতর জন্ম নিতে থাকে। এই জলা জমি আর মাটির অন্তরে শালুক আপনার প্রিয় ধন—যেন ফেলতে নেই, অবজ্ঞা করতে নেই। বসে থাকলে পাপ, ভেসে বেড়ালে পুণ্য। জালালি পাতিলটার সঙ্গে সঙ্গে ভেসে বেড়াতে থাকল। ডুব দিলে তখন অন্য কেউ হাত বাড়িয়ে পাতিল থেকে শালুক তুলে নিতে পারে।
সামনে শুধু জল, প্রায় অনন্ত জলরাশি। শালুকের লোভে সে খুব দূরে চলে এসেছে। বোধ হয় এর পর আর শালুক নেই। ডান দিকে পদ্মফুলের বন। বাঁ দিকে স্ফটিক জল। সামনের জলে কি যেন সব ভেসে বেড়াচ্ছে। কি হবে আর–বড় গজার মাছ হবে হয়তো। বড়-বড় মাছ, থামের মতো লম্বা গজার মাছ। কালো কুচকুচে, মাথায় মুখে লাল সিঁদুর গোলা রঙ, গায়ে অজগর সাপের মতো চক্র। ওর ভয় লাগছিল। তবু মনে হয়, ভয়ে হোক বিস্ময়ে হোক কেউ এতদূর আসেনি। কেউ আসেনি বলেই বোধ হয় কিছু ইতস্তত শালুক এখনও পড়ে আছে। সে ভয় থেকে রেহাই পাবার জন্য চোখ বুজে জলের নিচে ডুব দিল। কিন্তু জলের নিচে চোখ খুলতেই মনে হল—বড় একটা গজার মাছ ওর দিকে তাকিয়ে আছে। লেজ নাড়ছে। স্থির। গজার মাছটা জালালিকে দেখছে। জলের নিচে আজব একটা জীব, বোধ হয় মনুষ্যকুলের কেউ হবে—প্রায় ব্যাঙের মতো নিচে নেমে আসছে। প্রাচীন সব জলজ ঘাস এবং লতার ভিতর মাছটা মুখ বার করে রেখেছে। জালালি চোখ খুলতেই শুধু মাছটার মুখ দেখতে পাচ্ছে। কালো ভয়ঙ্কর মুখ একবার হাঁ করছে, আবার জল গিলে মুখ বন্ধ করছে। জালালিকে মাছটা এতটুকু ভয় পাচ্ছে না। বরং জালালিকেই ভয় পাইয়ে দিচ্ছে।
হায়, পেটের জ্বালা, বড় জ্বালা, জ্বালা সহে না প্রাণে। ভয়ে বিস্ময়ে জালালি জলের নিচে এতটকু হয়ে আছে। তবু লোভ সামলাতে পারল না জালালি। আর একটু নিচে গেলেই মাটিতে হাত লেগে যাবে এবং শালুকটা আয়ত্তে চলে আসবে। দমে আসছিল না। সে তাড়াতাড়ি শ্বাস নেবার জন্য জল কেটে ভেসে উঠল। দম নিল, একটু সময় ভেসে থেকে বিশ্রাম নিল। ফের ডুবে জলের নিচে চলে যেতে থাকলে দেখতে পেল, সবুজ এক দেশ, নীল জলের গালিচা পাতা। অন্ধকার, ক্রমে অন্ধকার আরও ঘন হয়ে আসছে। তারপরই লতার গোড়ায় ঠিক মাটিতে যেখানে শাপলা পাতার লতা এসে থেমে গেছে সেখানে হাতটা ঠেকে গেল। অন্ধকারেও টের পাচ্ছিল জালালি, মাছটা মুখ হাঁ করে এগিয়ে আসছে। অতিকায় মাছ। তবু একটা মাছ, সে যত অতিকায় হোক, বড় হোক, সে মাছ। একটা মাছ, সামান্য মাছ, তুমি মাছ যত বড়ই হও—আমি মনুষ্যকুলে জন্মে তোমাকে ভয় পাব! বোধ হয় সে এমন কিছু ভাবতে ভাবতে শালুকের গোড়া চেপে ধরল। তারপর সে দেখল মাছটা সবুজ রঙের ঘাসের ভিতর মুখটা নাড়ছে। খুব সন্তর্পণে নাড়ছে আর জালালিকে দেখছে। শালুকটা হাতে পেয়ে জালালির সাহস বেড়ে গেল। সে ভ্রূক্ষেপ করল না। সে আর একটু এগিয়ে গেল। মাছটা এবার পিছু হটে যাচ্ছে। সে এবার আর দেরি করল না। যখন মাছটা ভয় পেয়ে যাচ্ছে তখন আর ডুবে থেকে কি হবে। সে ভোঁস করে জল কেটে শুশুকের মতো পিঠ ভাসিয়ে দিল।
সেই কবে একবার জালালি জলের নিচে হাঁস চুরি করে গলা টিপে ধরেছিল, কবে একবার মালতীর পুরুষ হাঁসটাকে ঝড়ের রাতে পুড়িয়ে নরম মাংস এবং ঠ্যাঙ চিবিয়ে আল্লার দুনিয়া বড় সুখের ভেবে বড় একটা ঢেকুর তুলেছিল—এখন শুধু তার কথা মনে আসছে। সেই মৃত হাঁসটার মতো মাছ, মাছটার চোখ সারাক্ষণ জলের নিচে স্থির হয়ে ছিল। যেন এক বড় অজগর সাপ ওকে গিলতে আসছে এমন মনে হল। কিন্তু সাপ হলে সব জায়গাটা এতক্ষণে প্লাবনের মতো তোলপাড় হতে আরম্ভ করত। এত স্থির থাকত না। সে এটাকে মনের ভয় ভাবল। জলের নিচে চোখ খুললেই মনে হয় সব বিচিত্ৰ গাছগাছালি যেন প্রাণ পেয়ে তার দিকে ধেয়ে আসছে। সে সহজে সেজন্য চোখ খুলতে চায় না।
সবুজ রঙের কদম ফুলের মতো ঘাসের অন্ধকারে জালালি বুঝতে পারেনি কী তার দিকে এগিয়ে আসছে। সে বেশ সুখে একটার পর একটা ডুব দিয়ে গভীর জলের ভিতর চলে যেতে থাকল। ঠিক ডুবুরীর মতো জলের নিচে ডুবে যাচ্ছে, জলের ওপর ভেসে উঠছে। তেমন অসংখ্য মানুষ এখন পাড়ে দাঁড়ালে দেখা যাবে, জলের ভিতরে তারা ডুবে যাচ্ছে, জলের ওপর ভেসে উঠছে। কখনও শালুক পাচ্ছে, কখনও পাচ্ছে না। আর ঠিক কখন পাবে কেউ বলতে পারছে না। সব শাপলালতার গোড়ায় শালুক থাকে না। ফলে শালুক তোলার দলটা বিলের জলে ছড়িয়ে পড়ছিল। সুর্য ওপরে উঠে গেছে। দুরে চোখ মেলে তাকালে, শুধু গভীর জল—শান্ত এবং কালো। সেখানে এক শীতল ঠাণ্ডা ঘর রয়েছে যেন। ওপার দেখা যাচ্ছে না। অনন্ত জলরাশি কত প্রাচীনকাল থেকে ভিন্ন ভিন্ন কিংবদন্তী নিয়ে বিলের ভিতর ভেসে বেড়াচ্ছে। শীতের সময় জলের রঙটা আরও কালো হয়ে ওঠে। শীতের সময় চারপাশের নলখাগড়ার ঝোপ থেকে পাখিরা অন্যত্র উড়ে যায় এবং ঝোপের ভিতর যেখানে জল থেকে জমি ভেসে উঠেছে সেখানে বিষাক্ত সাপেরা গর্তের ভিতরে মরার মতো শীতের ঠাণ্ডায় পড়ে থাকে। গ্রীষ্মের জন্য, বর্ষার জন্য ওদের প্রতীক্ষা। বর্ষা পড়লেই অথবা বসন্তকালে যখন সূর্য মাথার উপর কিরণ দেয় তখন বিষাক্ত সাপ সব মাঠ থেকে জলে নেমে যায়। জলের ওপর ভেসে বেড়ায়। দূরের গজারী বন থেকে তখন কিছু ময়াল সাপ পর্যন্ত এই বিলের জলে নেমে আসে। জালালি জলের ভিতর দেখছিল লাল চোখ দুটো ওর দিকে সারাক্ষণ তাকিয়ে থাকছে। কিছুই স্পষ্ট নয়। কারণ অন্ধকার বড় প্রকট জলের গভীরে। নীল অথবা সবুজ রঙের ঝোপের ভিতর যদি আরও দুটো শালুক খুঁজে পাওয়া যায়—প্রলোভনে জালালি একটা পাতিহাঁস হয়ে গেল আর জলের ভিতর ডুবে-ডুবে লাল চোখ দুটোকে মরণ খেলা দেখাতে থাকল।
.
তখনও ফেলু ঝোপের ভিতর শুয়ে আছে। নেমে আসছে, আসছে না। এলেই খপ করে ধরে ঝোপের ভিতর টেনে নেবে। কামরাঙা গাছের ছায়ায় বিবির শরীর দেখা যাচ্ছে, যাচ্ছে না। এদিকে রোদ মাথার ওপর উঠে এল। অথচ বিবির মুখ দেখা গেল না, অঙ্গ দেখা গেল না। মাঠের ভিতর বাস্তুপূজার ঢাক-ঢোলের বাজনা কখন থেমে গেছে। পুকুরপাড়ে বড়বৌ। সোনা মাঠের ওপর দাঁড়িয়ে কথা নেই বার্তা নেই কাঁসি বাজাচ্ছে—ট্যাং ট্যাং। পূজা পার্বণ শেষ। এখন সব তিল তুলসী, বারকোষ, নৈবেদ্য এবং তিলা কদমা আর অন্যান্য ভোজ্যদ্রব্য বাড়ি নিয়ে যাওয়া। বড় সাদা পাথরে পায়েস—ধনবৌ সাদা পাথরে পায়েস নিয়ে যাচ্ছে। ফল ফুল, নতুন গামছা, ঘট আর নারকেল নিয়ে যাচ্ছে রঞ্জিত। মাঠের ভিতরই প্রসাদ বিতরণ হচ্ছে। গ্রামের যুবা পুরুষেরা, বৃদ্ধ, বৃদ্ধারা প্রসাদ নিয়ে চলে যাচ্ছে। তারপর হ্যাজাকের আলো জ্বলবে রাতে। সরকাররা পুকুরের পাড়ে চার পাঁচটা হ্যাজাক জ্বালাবে। পথের ওপর ডে-লাইট জ্বলবে। তখন মাঠে মাঠে আরও সব হ্যাজাকের আলো, আলোতে এই মাঠ এবং গ্রাম সকল একসময়, মাত্র এক রাত্রির জন্য ডুবে থাকবে আর ভেড়ার মাংস এবং আতপ চাউলের সুগন্ধ মাঠময় কী যে গন্ধ ছড়াবে! ফেলুর জিভে জল এসে গেল। রঞ্জিত এখন অন্য জমিতে মালতীকে দেখছে। মালতী বড় ব্যস্ত। সে কিছু লোককে বসিয়ে খিচুড়ি পায়েস খাওয়াচ্ছে। শীতের রোদে বেশ আমেজ ছিল। উত্তুরে ঠাণ্ডা হাওয়ায় বেশ শীত-শীত ভাব। সকলে পেট পুরে খেয়ে রোদের ভিতর ঘাসের ওপর যেন প্রায় গড়গাড়ি দিচ্ছে।
আর সোনা তখন কাঁসি ফেলে গোপাট ধরে ছুটছে। ফতিমা গোপাটে ছাগল দিতে এসে ইশারাতে সোনাকে ডাকল। যেন ফতিমা শীতের ঠাণ্ডায় একটা কচ্ছপ আবিষ্কার করে ফেলেছে। কচ্ছপটাকে ধরার জন্য সে সোনাকে ডাকছে। এখন শীতকাল। শীতের জন্য কচ্ছপেরা বেশিক্ষণ জলে থাকতে পারে না। পাড়ে উঠে রোদ পোহায়। অথবা জমির ভিতর কচ্ছপেরা লুকিয়ে থাকে। লাঙ্গলের ফালে মাটির ভিতর থেকে কচ্ছপ উঠে আসতে পারে। কিন্তু ফতিমা সোনাকে সে-সবের কিছুই দেখাল না। অশ্বত্থ গাছটার নিচে সোনাকে টেনে নিয়ে গেল। ঝোপের ভিতর কি আছে দ্যাখেন। বলে ফতিমা চুপি দিল। বুঝি মানুষ হবে, পাগল ঠাকুর হবে। ফতিমা অন্তত তাই ভেবেছিল। সোনাবাবুর পাগল জ্যাঠামশাই যিনি রাত-বিরাতে, কোনওদিন খুব ভোরবেলা উঠে মাঠ পার হয়ে সোনালী বালির নদী পার হয়ে নিরুদ্দেশে চলে যান, সেই মানুষই হয়তো আজ বেশি দূর না গিয়ে এই অশ্বত্থের নিচে মটকিলা ঝোপের ভিতর শুয়ে শুয়ে পাখির সঙ্গে গল্প করছেন। ছোট মেয়ে ফতিমা, সামুর একমাত্র মেয়ে ফতিমা জানে না—এই মানুষ পাগল মানুষ নন, এ অন্য মানুষ—ফেলু শেখ। ফেলু শেখ এখনও চুপচাপ সেই পরাণের চেয়ে প্রিয়, মরণে যার স্মৃতি ভোলা দায়—সেই এক পরমাশ্চর্য যুবতীকে খপ করে ঝোপের ভিতর টেনে নেবার জন্য আত্মগোপন করে আছে।
সোনা ঝোপের ভিতর উঁকি দিয়ে ডাকল, জ্যাঠামশয়। কারণ যখন সব দেখা যাচ্ছে না তখন পাগল মানুষ ব্যতীত আর কে হবেন। এই অঞ্চলে তিনিই তো একমাত্র মানুষ যাঁর কাছে এই মাঠ, গাছগাছালি এবং পরবের দিনে উৎসব সব সমান।
ফেলু এত নিবিষ্ট যে কতক্ষণ থেকে অপেক্ষা করছে খেয়াল নেই। কার যেন গলা, কে যেন ঝোপে উঁকি দিয়ে পিছনে ডাকছে। হাত পিঠ মুখ ফেলুর দেখা যাচ্ছে না। ঘন ঝোপের বাইরে শুধু পা দুটো দৃশ্যমান, এই পা দেখে ধনকর্তার ছোট পোলা টের পেয়েছে মানুষ আছে ঝোপের ভিতর। ওরা এখন হামাগুড়ি দিয়ে ভিতরে ঢুকছে। আগে সোনা পিছনে ফতিমা। সে তাড়াতাড়ি ধড়ফড় করে উঠে বসল। ঝোপ থেকে পাগলের মতো ছুটে বের হয়ে যাবে ভাবল, কিন্তু তাড়াতাড়ি করলে ধরা পড়ে যাবে, সে কি যেন হাতড়াতে থাকল। তার কি যেন হারিয়ে গেছে।
সোনা এবং ফতিমা বুঝতেই পারেনি, এমন একটা নীরস মানুষ ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে থাকতে পারে। সোনা বলল, আপনে!
ফেলুর কি হারিয়ে গেছে এমন চোখমুখ। সে বলল, ঝোপের ভিতর শিকড়-বাকড় খুঁজতাছি।
—কি হইব?
—হাতটা জোড়া লাগব।
সোনা বলল, পাইলেন নি?
—না রে কর্তা, পাইলাম না। কৈ যে সব লুকাইয়া থাকে, বলে ফেলু ফতিমার দিকে কটমট করে তাকাল। ঝোপের ভিতর ফতিমা এবং সোনা। ফেলু সোনাবাবুকে কিছু বলল না। শুধু ফতিমার দিকে তাকিয়ে মনে-মনে গজরাতে থাকল, সামু মাইয়াটারে বড় আসকারা দ্যায়। মাইয়াটারে ইংরাজি শিখায়। এত অধর্ম ভাল নয় মনে হল ফেলুর। আর সঙ্গে সঙ্গে পাগল ঠাকুরের মুখ ভেসে ওঠে, মুখ ভেসে উঠলেই ভিতরের সেই অধম্মটা জেগে ওঠে। হাতের দিকে তাকালে ক্ষোভের সীমা থাকে না। ফেলুর প্রতিপত্তি কমে যাচ্ছে। সেই যে বিবি আন্নু সে পর্যন্ত তেলের নাম করে হাজিসাহেবের ছোট বিবির কাছে চলে গেল। ছোট বিবির কাছে গেল কি ছোট সাহেবের কাছে গেল কে জানে! এখনও সে ফিরছে না। ফেলু তাই ভাবল একটু তাড়াতাড়ি করা যাক। বিবির কথা মনে হতেই সে পা চালিয়ে হাঁটল। তাড়াতাড়ি করতে গেলে বড় বাগের ভিতর দিয়ে সোজা উঠে যেতে হয়। পথ নেই, শুধু বাঁশের জঙ্গল। কিছু বেতগাছ এবং চারপাশটা অন্ধকার। দিনের বেলায় হেঁটে যেতে গা ছমছম করে। পাশেই গ্রামের কবরখানা। ফেলু হন হন করে হাঁটছিল। বাঁ হাতে একেবারে শক্তি নেই। কব্জিতে মন্ত্রপড়া কড়ি ঝুলছে। যদি বিবি এখনও সং করে বেড়ায় সে বিবির পেটে এক লাথি মারবে। তার শরীর এবং দাঁত শক্ত হয়ে যাচ্ছে। আর তক্ষুনি দেখল বিবি তার বাগের অন্ধকার থেকে বের হয়ে আসছে। কিন্তু হাতটা—পঙ্গু হাত নিয়ে কিছু করতে পারল না। বাগের অন্ধকার থেকে বের হতেই সে মুখের উপরে ভয়ঙ্কর চিৎকার করে উঠল, তুই আন্নু!
আন্নু দাঁড়াল না। এমন মানুষটাকে সে আর ভয় পায় না। পাশ কাটিয়ে যাবার সময় বলল, তুমি মানুষটা ক্যামনতর! কইলাম হুস করতে কাওয়া আর তুমি বাগের ভিতর ঘোরতাছ!
—তুই এহানে ঝোপে-জঙ্গলে কি করতাছস?
—সঙের লাইগ্যা তোমারে খোঁজতাছি।
—আঃ। বিবিটাও ইতর কথা কইতে শিখা গ্যাছে। কারে লাথি মারে ফ্যালু! নিজের পেটে লাথি মারে! ফেলু রাগে দুঃখে নিজের পেটে একটা লাথি মারতে চাইল। বিবিটা পর্যন্ত ধরে ফেলেছে ফেলু পঙ্গু হয়ে গেছে। সুতরাং কে কার পেটে এখন লাথি মারে। আন্নু পরম কুলীন এক যুবতী কন্যার মতো বাগের ভিতরে ডুব দিয়ে জল খাচ্ছে, একাদশীর বাপও টের পাচ্ছে না। ফেলু কেমন কাতর গলায় বলল, তুই মনে করস আমি কিছু বুঝি না! হালার কাওয়া।
—আর তুই মনে করস আমি-অ কিছু বুঝি না। ফেলুর মুখের ওপর ঝামটা মারল আন্নু।
—তুই যুবতী মাইয়া, তর বোঝনের না আছে কি ক’। বলে ফেলু কথা আর বাড়াল না। একটু দূরে কাঁঠাল গাছে সোনা, ফতিমা নিচে। কাঁঠাল পাতা অথবা ডাল ভেঙে দিচ্ছে ফতিমার ছাগলটাকে। গোলমাল বাধালে অথবা চিৎকার চেঁচামেচি করলে এখানে ওরা ছুটে আসতে পারে। ছুটে এলেই সব ফাঁস হয়ে যাবে। সে অশ্বত্থের ঝোপে আত্মগোপন করেছিল, গাছে তখন কাক উড়ছিল না, মেলায় গরু যাচ্ছে, গলায় ঘণ্টা বাজছিল আর ঘাসের ভিতর পড়ে থেকে মাইজলা বিবির সনে সঙ—সব টের পাবে যুবতী মেয়ে আন্নু। সে চুপচাপ অন্নুর শরীরের আঁশটে গন্ধটা এবারের মতো হজম করে গেল। সে পাগলের মতো চিৎকার করতে থাকল, গোসল কইরা বাড়ি ঢুকবি। না হয়, তর একদিন কি আমার একদিন। আর এই হজম করার যাবতীয় রাগ গিয়ে পড়ল পাগল-ঠাকুরের ওপর, সে এক হাতিতে চড়ে ওর দুই হাত ভেঙে এখন মাঠে ময়দানে পাখি ওড়াচ্ছে, এবং বাতাসে ফুঁ দিয়ে চলে যাচ্ছে। সেই মানুষকে বাগে পেলে পীর না বানিয়ে ছাড়ছে না। রাগ এবং বিদ্বেষ ওকে কুরে কুরে খাচ্ছে। বিবি আন্নু এই ঝোপ-জঙ্গলের ভিতর এতক্ষণ তেল আনার নাম করে, ওকে মাছ পাহারায় রেখে এসে কী করছিল সব যেন জানা।
কিন্তু অসহায় ফেলু দু’হাত ওপরে তুলতে গিয়ে দেখল, সে নাচারি, বেরামি মানুষ। এমন জবরদস্ত বিবির সঙ্গে সে বুঝি ইহজীবনে লড়তে পারবে না। লড়তে পারলে বোধ হয় এই অন্ধকার বাগের ভিতর এখন এক প্রলয়ঙ্কর খণ্ডযুদ্ধ বেধে যেত। অগত্যা ভালো মানুষের মতো আন্নুর পিছনে পিছনে, যেন সে এবং আন্নু, মেমান বাড়ি থেকে বাগের ভিতর দিয়ে ফিরছে—কোনও তঞ্চকতা নেই, পরস্পর তেমনভাবে হাঁটছে, মাঠে তখনও ঢাক বাজছে, ঢোল বাজছে। মালতী প্রসাদ বিতরণ করছে মাঠে। কাগজের লাল নীল পতাকা উড়ছে বাতাসে। মাঠের ভিতর সাদা ধবধবে গরদ পরে মালতী, নিষ্ঠাবতী, ধর্মাধর্ম যার একমাত্র সম্বল, যে সকলের মতো হাঁস পুষে বড় করছে, পুরুষ হাঁসটার জন্য যার মমতা আর বর্ষায় যে চুপচাপ নিঃশব্দে বৃষ্টিতে ভেজে সারারাত ধরে, সেই মালতী, বিধবা মালতী এখন বাস্তুপূজার পায়েস খাওয়াচ্ছে সকল মানুষকে।
গাছের ডালে সোনাবাবু। ফতিমা দুষ্টু প্রজাপতির মতো চারা কাঁঠাল গাছটার চারপাশে ঘুরছে এবং লাফাচ্ছে। ছাগলটার জন্য সে ডালপাতা সংগ্রহ করছে। সোনা ছাগলটার জন্য ডাল ভেঙে দিচ্ছিল গাছের। কাঁঠাল পাতা খাবার জন্য ছাগলটা, ছোট্ট এক বাচ্চা ছাগল দু’পায়ে ভর করে লাফ, দিচ্ছিল। সোনা ছাগলটার পাতা খাবার আনন্দে, গাছের সব কচিকাঁচা ডালপাতা ভেঙে ছাগলটার দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছে। ছাগলটার পাশে এখন পাতার ডাঁই। সোনা লাফ দিয়ে গাছ থেকে নেমে পড়ল। পড়তেই কানের কাছে মুখ এনে ফতিমা ফিসফিস করে বলল, যাইবেন সোনাবাবু?
—কোনখানে?
—বকুল ফল আনতে যাইবেন?
— কতদূর?
—বেশি দূর না। বলে, আঙুল তুলে দেখাল—ঐ যে দ্যাখছেন না হাসান পীরের দরগা। দরগার ডাইনে ট্যাবার পুস্কনি, আমরা যামু পুস্কনির পাড়ে।
—ছোটকাকা বকব।
—যামু আর আমু।
সোনা চারিদিকে তাকাল। পূজা-পার্বণের দিনে কারো কোনও লক্ষ নেই। লালটু, পলটু ছোটকাকার সঙ্গে চরু রান্নার জন্য গেছে। ছোটমামা গেছে সরকারদের বাস্তুপূজাতে। শোভা, আবু, কিরণী বাস্তুপূজার প্রসাদ খেয়ে বেড়াচ্ছে। পূজা-পার্বণের দিনে কে কোথায় যায়—কে কার খবর রাখে! পাগল জ্যাঠামশাই ভোরে কোনদিকে বের হয়ে গেছেন, কেউ টের করতে পারেনি। সোনা মনে মনে ভাবল, বেশি দেরি হলে সকলে ভাববে, সোনা গেছে জ্যাঠামশাইর লগে। সুতরাং সোনা বোঁ বোঁ শব্দ করতে থাকল মুখে। তারপর ওরা মাঠের ওপর দিয়ে ছুটতে থাকল। বড় মাঠ, উত্তরে গেলে হাসান পীরের দরগা। দরগার পাশ দিয়ে সাইকেলে গোপাল ডাক্তার নেমে আসছে। গোপাল ডাক্তার ওদের দেখে ফেলবে ভয়ে ওরা দালানবাড়ির খালের ভিতর নেমে গেল। দু’জনে চুপচাপ মাথা গুঁজে উবু হয়ে বসে থাকল। এত বড় মাঠের ভিতর সোনা এবং ফতিমাকে একা একা ঘুরতে দেখলে আশঙ্কার কথা। তুমি সোনা, সেদিনের সোনা, একা একা এত বড় বিশাল বিলেন মাঠে নেমে এসেছ—কি সাহস তোমাদের! চল চল বাড়ি চল। অথবা কিছু তিরস্কার। কিংবা বাড়িতে খবরটা পৌঁছে দিলে ছুটবে ঈশম, তার প্রিয় তরমুজ খেত ফেলে ছুটবে। আর মাঠের ভিতর দাঁড়িয়ে অথবা বিলেন মাঠে নেমে গিয়ে ডাকবে, সোনাবাবু কৈ গ্যালেন! অঃ সোনাবাবু।
কবে একবার সোনা একা-একা তরমুজ খেতে নেমে গিয়েছিল—কবে, সেই কতকাল আগে সোনা প্রথম গ্রামের বাইরে বের হয়ে দক্ষিণের মাঠে—সোনালী বালির নদীর চরে তরমুজ খেতের ভিতর হারিয়ে গিয়েছিল সঠিক মনে নেই, কিন্তু সেই তরমুজ খেত, মালিনী মাছ এবং বড় মিঞার দুই বিবি—দুর্গাঠাকুরের মতো মুখ, নাকে নথ দুলছিল, কি এক রোমাঞ্চ যেন জীবনে, সোনা এখন সেই এক রোমাঞ্চকর লোভে ছুটছে। ফতিমা কাপড়টা গামছার মতো করে প্যাঁচ দিয়ে পরেছে। শরীরে ফতিমার জামা নেই। কোনও ফ্রক নেই। খালি গা। নাকে নথ দুলছে ফতিমার। কানে পেতলের মাকড়ি। নাকের বাঁশিতে সোনার নাকচাবি। চাবির মুখটা চ্যাপ্টা চাঁদের মতো। কথা নেই বার্তা নেই সোনা ফতিমার নাকটা চ্যাপ্টা করে ধরে নাকের ভিতর সেই চ্যাপ্টা চাঁদ কি করে বাঁশিতে আটকে আছে দেখল। ফতিমার খুব লাগছিল নাকে। কিন্তু সোনাবাবু, ছোট্ট সোনাবাবু…শরীরে যার চন্দনের গন্ধ লেগে থাকে আর মাথায় কি সুমধুর গন্ধ! সোনাবাবু তার নাক উল্টে বাঁশিতে এখন চ্যাপ্টা চাঁদের মুখ উঁকি দিয়ে দেখছে
ফতিমার শরীর শিরশির করে আনন্দে কাঁপছিল। সে বলল, সোনাবাবু চলেন। গোপাল ডাক্তার গ্যাছে গিয়া। দূরে মাঠের আলে গোপাল ডাক্তারের ঘণ্টি বাজছে। আর প্রান্তরে যখন শস্য নেই, যখন মাঠ ফাঁকা, শুধু মাঝে মাঝে ছোট ছোট ঝোপ-জঙ্গল দাঁড়িয়ে আছে তখন ছুটে যাওয়া ভালো। ওরা ছোটার সময়ই দেখল, ট্যাবার পুকুরের নিচে যে মাঠ আছে সেখানে পাগল জ্যাঠামশাই। তিনি হনহন করে বিলের দিকে হেঁটে যাচ্ছেন। সোনা আর মুহূর্ত দেরি করল না। সে যেন জ্যাঠামশাইকে মাঠের ওপর আবিষ্কার করে ফেলেছে তেমন গলায় ডাকল, কিন্তু মানুষটা হনহন করে হেঁটে যাচ্ছেন তো যাচ্ছেনই। ঢাক ঢোল বাজছে তো বাজছেই। বাস্তুপুজোর মোষ বলির রক্ত খাঁড়াতে লাগছে তো লাগছেই। আর সোনা, ফতিমা মাঠের ওপর দিয়ে ছুটছে তো ছুটছেই। ওরা ছুটছিল আর ডাকছিল। ওরা ঢিবির ওপর উঠে ডাকল, জ্যাঠামশয়! কে কার কথা শোনে! জ্যাঠামশাই পুকুরটার পাড়ে পাড়ে যে বন আছে তার ভিতর অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
সংসারে কত কিছু ঘটে, কত কিছু ঘটে না। ফসল ফলে না সব সময় মাঠে। এখন কোথাও রুক্ষ মাঠ, কোথাও জমিতে তামাকের পাতা দেখা যাচ্ছে। পেঁয়াজ, রসুন, আলু, বাঁধাকপি উঁচু জমিতে পুকুর থেকে জল তুলে পেঁয়াজ আলু-বাঁধাকপির চাষ করছে বড় গেরস্থ প্রতাপ চন্দ। আলে আলে দুই বালক-বালিকা ছুটছে। ঢিবি থেকে নেমে মাঝিদের বড় জমি পার হয়ে ছুটছে। অকালের ফল বকুল ফল বনের ভিতর। ওরা বকুল ফলের অন্বেষণে ছুটে যাচ্ছে। ফতিমা ফল কুড়াবে, সঙ্গে সোনাবাবু আছে, ভরদুপুরের রোদ রয়েছে, আর শীতে সূর্য মাথার ওপর বলে ওদের এতটুকু শীত করছে না। খালি গায়ে খালি পায়ে ছুটছে। যেন দুটো খরগোশ তাড়া খেয়ে বনের দিকে পালাচ্ছে।
সহসা মনে হল সোনার, ওরা বড় বেশি দূরে চলে এসেছে। এতবড় বন সামনে! সোনা ভয়ে এতটুকু হয়ে গেল! ওরা আর বাড়ি ফিরে যেতে পারবে না।