সোনালী বালির নদীর চরে রোদ হেলে পড়েছে। ঈশম শেখ ছইয়ের নিচে বসে তামাক টানছে। হেমন্তের বিকেল। নদীর পাড় ধরে কিছু গ্রামের মানুষ হাট করে ফিরছে। দূরে দূরে সব গ্রাম মাঠ দেখা যাচ্ছে। তরমুজের লতা এখন আকাশমুখো। তামাক টানতে টানতে ঈশম সব দেখছিল। কিছু ফড়িং উড়ছে বাতাসে। সোনালী ধানের গন্ধ মাঠময়। অঘ্রানের এই শেষ দিনগুলিতে জল নামছে খাল-বিল থেকে। জল নেমে নদীতে এসে পড়ছে। এই জল নামার শব্দ ওর কানে আসছে। সূর্য নেমে গেছে মাঠের ওপারে। বটের ছায়া বালির চর ঢেকে দিয়েছে। পাশে কিছু জলাজমি। ঠাণ্ডা পড়েছে। মাছেরা এখন আর শীতের জন্য তেমন জলে নড়ছে না। শুধু কিছু সোনাপোকার শব্দ। ওরা ধানখেতে উড়ছিল। আর কিছু পাখির ছায়া জলে। দক্ষিণের মাঠ থেকে ওরা ক্রমে সব নেমে আসছে। এ সময় একদল মানুষ গ্রামের সড়ক থেকে নেমে এদিকে আসছিল—ওরা যেন কি বলাবলি করছে। যেন এক মানুষ জন্ম নিচ্ছে এই সংসারে, এখন এক খবর, ঠাকুরবাড়ির ধনকর্তার আঘুনের শেষ বেলাতে ছেলে হয়েছে।

ঈশম শেষ কথাটা শুনেই হুঁকোটা ছইয়ের বাতায় ঝুলিয়ে রাখল। কলকে উপুড় করে দিল। তারপর হামাগুড়ি দিয়ে বাইরে বের হল। উপরে আকাশ নিচে এই তরমুজের জমি আর সামনে সোনালী বালির নদী। জল, স্ফটিক জলের মতো। ঈশম এই ছায়াঘন পৃথিবীতে পশ্চিমমুখো হয়ে দাঁড়াল। বলল, সোভান আল্লা। শেষে আর সে দাঁড়াল না। নদীর পাড় অতিক্রম করে সড়ক ধরে হাঁটতে থাকল। ধনকর্তার পোলা হইছে—বড় আনন্দ, বড় আনন্দ। সব খুদার মেহেরবানি। সড়কের দু’ধারে ধান, শুধু ধান—কত দূরে এইসব ধানের জমি চলে গেছে। ঈশম চোখ তুলে দেখল সব। বিকেলের এইসব বিচিত্র রঙ দেখতে দেখতে তার মনে হল, পাশাপাশি এইসব গ্রাম—তার কত চেনা, কতকালের মেমান সব-নিচে খাল, মাছেরা জলে লাফাচ্ছে। সে সড়কের একধারে গামছা পাতল। নিচে ঘাস, গামছা ঘাসের শিশিরে ভিজে উঠছে। সে এসব লক্ষ করল না। সে দু’হাঁটু ভেঙে বসল। খালের জল নিয়ে অজু করল। সে দাড়িতে হাত বুলাল ক’বার। মাটিতে পর পর ক’বার মাথা ঠেকিয়ে আকাশ দেখতে দেখতে কেমন তন্ময় হয়ে গেল। অঘ্রানের শেষ বেলায় ঈশম নামাজ পড়ছে। সূর্য অস্ত যাচ্ছে বলে ওর ছায়াটা কত দূরে চলে গেছে। খালের জল কাঁপছিল। ওর ছায়াটা জলে কাঁপছে। কিছু হলদে মতো রঙের ফড়িং উড়ছে মাথার উপর। সূর্যের সোনালী রঙে ওর মুখ আশ্চর্যরকমের লাল দেখাচ্ছিল। যেন কোন ফেরেস্তার অলৌকিক আলো এই মানুষের মুখে এসে পড়েছে। সে নামাজ শেষ করে হাঁটতে থাকল। এবং পথে যাকে দেখল তাকেই বলল, আঘুনের শেষ ফজরে ধনকর্তার পোলা হইছে। ওকে দেখে মনে হয় তরমুজ খেত থেকে অথবা সোনালী বালির চর থেকে একটি খবর সকলকে দেবার জন্য সে উঠে এসেছে। সে সড়ক অতিক্রম করে সুপারি বাগানে ঢুকে গেল। বৈঠকখানাতে লোকের ভিড়। বাইরে কেউ কেউ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। সে প্রায় সকলকেই আদাব দিল এবং ভিতরে ঢুকে নিজের জায়গাটিতে বসে তামাক সাজতে থাকল।

সোনালী বালির নদীতে সূর্য ডুবছে। কচ্ছপেরা ধানগাছের অন্ধকারে ঘাপটি মেরে আছে। এইসব কচ্ছপ এখন একটু শক্তমতো মাটি পেলেই পাড়ে উঠে ডিম পাড়তে শুরু করবে। অনেকগুলি শেয়াল ডাকল টোডারবাগের মাঠে। একটা দুটো জোনাকি জ্বলল জলার ধারে। জোনাকিরা অন্ধকারে ডানা মেলে উড়তে থাকল। পাখিদের শেষ দলটা গ্রামের উপর দিয়ে উড়ে গেল। নির্জন এবং নিরিবিলি এইসব গ্রাম, মাঠ। অন্ধকারেও টের পাওয়া যায়। মাথার উপর দিয়ে পাখি উড়ে যাচ্ছে। সে জানে ওরা কোথায় যায়। ওরা হাসান পীরের দরগাতে যায়। পীরের দরগায় ওরা রাত যাপন করে। শীতের পাহাড় নেমে এলে ওরা তখন দক্ষিণের বিলে চলে যাবে। ঈশম এবার উঠে পড়ল।

.

ঈশম ডাকল, ঠাইনদি আমি আইছি।

দরজার বাইরে এসে ছোটকর্তা দাঁড়ালেন।—ঈশম আইলি?

—হ, আইলাম। ধনকর্তারে খবর দিতে পাঠাইছেন? না পাঠাইলে আমারে পাঠান। খবর দিয়া আসি। একটা তফন আদাই কইরা আসি।

ছোটকর্তা বললেন, যা তবে। ধনদাদারে কবি, কাইলই যেন রওনা দেয়। কোনও চিন্তার কারণ নাই। ধনবৌ ভাল আছে।

—তা আর কমু না! কি যে কন! ঠাইনদি কই?

—মায় অসুজ ঘরে। তুই বরং বড় বৌঠাইনরে বল তরে ভাত দিতে

ঈশম নিজেই কলাপাতা কাটল এবং নিজেই এক ঘটি জল নিয়ে খেতে বসে গেল।

বড়বৌ বলল, পাতাটা ধুয়ে নাও।

ঈশম পাতাটার উপর জল ছিটিয়ে নিল। বলল, দ্যান।

বড়বৌ ঈশমকে খেতে দিল। ঈশম যখন খায় বড় নিবিষ্ট মনে খায়। ভাত সে একটাও ফেলে না। এমন খাওয়া দেখতে বড়বৌর বড় ভাল লাগে। ঈশমকে দেখতে দেখতে ওর বিবির কথা মনে হল। ঈশমের ভাঙা ঘর, পঙ্গু বিবি, নাড়ার বেড়া এবং জীর্ণ আবাসের কথা ভেবে বড়বৌ-এর কেমন মায়া হল। অন্যান্য অনেকদিনের মতো বলল, পেট ভরে খাও ঈশম। একটু ডাল দেব, মাছ? অনেক দূর যাবে, যেতে যেতে তোমার রাত পোহাবে।

ঈশম নিবিষ্ট মনে খাচ্ছে, আর হাত-দশেক দূরের অসুজ ঘরটা দেখছে। সেখানে ধনমামি আছেন, ঠাইনদি আছেন, ঈশম ঘরের কোণায় কোণায় বেতপাতা ঝুলতে দেখল। মটকিলা গাছের ডাল দেখল দরজাতে ঝুলছে। ঘরে প্রদীপ জ্বলছে। বাচ্চাটা দুবার ট্যাও ট্যাও করে কাঁদল, ভিজা কাঠের গন্ধ, ধোঁয়ার গন্ধ, ধূপের গন্ধ মিলিয়ে এ বাড়িতে একজন নবজাতকের জন্ম। টিনকাঠের ঘর, কামরাঙা গাছের ছায়া—ধনমামি, বড়মামি—এবং এ-বাড়ির বড়কর্তা পাগল, একথা মনে হতেই ঈশম বলল, বড়মামি, বড়মামারে দ্যাখতাছি না।

বড়বৌ বড় বড় চোখ নিয়ে ঈশমকে শুধু দেখল। কোনও কথা বলল না। বললেই যেন চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসবে। ঈশম যেন এই চোখ দেখে ধরতে পেরেছে বড়মামা এখন বাড়িতে নেই। অথবা কোথায় থাকে, কই যায় কেউ খোঁজখবর রখে না। রাখবার সময় হয় না। অথবা দরকার হয় না। ঈশম ডাল দিয়ে সবক’টা ভাত হাপুস করে মাকড়সার মতো গিলে ফেলল। বড়মামি এখন কাছে নেই। বৈঠকখানায় লোক পাতলা হয়ে আসছে। বড়মামির বড় ছেলে, ধনমামির বড় ছেলে রান্নাঘরে তাড়াতাড়ি খেয়ে নিচ্ছে।

ঈশম বৈঠকখানা থেকে লাঠি নিল একটা, লণ্ঠন নিল হাতে। ঈশম মাথায় পাগড়ি বাঁধল গামছা দিয়ে। এই আঘুন মাসের ঠাণ্ডায় কাদাজল ভাঙতে হবে। খাল পার হতে হবে, বিল পার হতে হবে। গামছা মাথায় সে পাঁচ ক্রোশ পথ হাঁটবে। কোথাও খালের পাড়ে পাড়ে,কোথাও পুলের উপর দিয়ে, কখনও চুপচাপ, কখনও গাজির-গীত গাইতে গাইতে ঈশম দীর্ঘপথ হাঁটবে। ঈশম রান্নাঘর অতিক্রম করবার সময় দেখল কুয়োতলার ধারে বড়মামি অন্ধকারে দাঁড়িয়ে কার জন্য যেন প্রতীক্ষা করছেন। ঈশমকে দেখে বড়বৌ বলল, ঈশম দেখবে তো তোমার বড়মামাকে ট্যাবার বটতলায় পাও কিনা, তুমি তো বটতলার পথেই যাবে।

ঈশম বাঁশঝাড় অতিক্রম করে মাঠের অন্ধকারে নেমে যাবার সময় বলল, আপনে বাড়ি যান। যাইতে যাইতে যদি পাই—পাঠাইয়া দিমু। এই বলে ঈশম ক্রমে অন্ধকার মাঠে মিশে যেতে থাকল। ঈশমকে আর দেখা যাচ্ছে না, শুধু মাঠের ভিতর লণ্ঠন দুলছে।

ঈশমের ডান হাতে লাঠি, বাঁ হাতে লণ্ঠন। অঘ্রান মাস। শিশির পড়ছে। এখনও ভাল করে ধানখেতের ভিতর আল পড়েনি। সরু পথ খেতের পাশে পাশে। পথ থেকে বর্ষার জল নেমে গেছে—পথের মাটি ভিজা, কাদামাটিতে পা বসে যাবার উপক্রম। অথচ পা বসে যাচ্ছে না—কেমন নরম তাল তাল মাটির উপর দিয়ে ঈশম হেঁটে যাচ্ছে। গাঢ় অন্ধকার বলে ঈশম চারদিকে শুধু লন্ঠনের আলো এবং তার অস্তিত্ব ব্যতিরেকে অন্য কিছু প্রত্যক্ষ করতে পারল না। এ অঞ্চলে হেমন্তে শীত পড়তে আরম্ভ করে। শীতের জন্য ঝোপজঙ্গলের কীট-পতঙ্গরা কেমন চুপচাপ হয়ে আছে। ঈশম লণ্ঠন তুলে এবার উঁচু জমিতে উঠে এল। পাশে করলার জমি। উপরে ট্যাবার পুকুর আর সেই নির্দিষ্ট বটগাছ। এখানে অনেক রাত পর্যন্ত বড়কর্তা বসে থাকেন। এখানে বড়কর্তাকে অনেকদিন গভীর রাতে খুঁজে পাওয়া গেছে। ঈশম লণ্ঠন তুলে ঝোপে-জঙ্গলে বড়কর্তাকে খুঁজল। ঝোপে ঝোপে জোনাকি। বটের জট মাটি পর্যন্ত নেমেছে। পুরানো জট বলে জটসকল ভিন্ন ভিন্ন ঘরের মত ছায়া সৃষ্টি করছে। সে ডাকল, বড়মামা আছেন? সে কোনও উত্তর পেল না। তবু লণ্ঠন তুলে গাছটার চারধারে খুঁজতে থাকল—তারপর যখন বুঝল তিনি এখানে নেই, তিনি অন্য কোথাও পদযাত্রায় বের হয়েছেন, তখন ঈশম ফের নিচু জমিতে নেমে হাঁটবার সময় দূরে দূরে সব গ্রাম, গ্রামের আলো, হাসিমের মনিহারি দোকানে হ্যাজাকের আলো দেখতে দেখতে নালার ধারে কেমন মানুষের গলা পেল।

সে বলল, কে জাগে?

অন্ধকার থেকে জবাব এল, তুমি ক্যাডা?

—আমি ঈশম শেখ। সাকিম টোডারবাগ। ঈশম যেন বলতে চাইল, আমি গয়না নৌকার মাঝি ছিলাম। এখন ঠাকুরবাড়ির খেয়ে মানুষ। অন্ধকার মানি না। বাবু ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার বাস। নদীর চরে তরমুজ খেত পাহারায় থাকি। ঠাকুরবাড়ির বান্দা আমি। বয়স বাড়ছে, গয়না নৌকা চালাতে আর পারি না।

—আমি আনধাইর রাইতে হাসিম ভূঁইঞা জাগি। সাকিম কলাগাইছা।

—অঃ, হাসিম ভাই। তা কি করতাছ?

—মাছ ধরতাছি। দ্যাখছ না জল নামতাছে। আমি কৈ মাছের জাল পাইতা বইসা আছি। ঘুট-ঘইটা আনধাইরে কই রওনা দিলা?

—য্যামু মুড়াপাড়া। ধনকর্তার পোলা হইছে। সেই খবর নিয়া যাইতাছি।

—ধনকর্তার কয় পোলা য্যান?

—এরে নিয়া দুই পোলা। তোমার কাছে কাঠি আছে, বিড়িটা আঙ্গাইতাম।

ঈশম বিড়ি ধরাল। ওর বড়কর্তার জন্য মনটা খচখচ করছে। বড়কর্তা রাতে বাড়ি না ফিরলে বড়মামি অন্ধকারে মানুষটার জন্য জেগে থাকবে। সে বলল, বড়মামারে দ্যাখছ?

—দুফরে দ্যাখছিলাম—নদীর চরে হাঁইটা যাইতাছে।

ঈশম কেমন দুঃখের গলায় বলল, ভাইরে, তোমার আমার ছোটখাটো দুঃখ। ঠাকুরবাড়ির দুঃখে চক্ষে পানি আসে। ঈশম ফের হাঁটতে থাকল। সে হন হন করে হেঁটে যাচ্ছে। ফাওসার খাল পার হবার জন্য সে হন হন করে হেঁটে যাচ্ছে। হাট ভাঙার আগে যেতে পারলে সে গুদারাঘাটে মাঝি পাবে। নতুবা এই শীতে সাঁতার কেটে খাল পার হতে হবে। ঠাণ্ডার কথা ভাবতেই ওর শরীরটা কেমন কুঁকড়ে গেল।

ইচ্ছা করলে ঈশম একটা সংক্ষিপ্ত পথ ধরে আরও আগে খালের পাড়ে পৌঁছাতে পারত। কিন্তু একটি অজ্ঞাত ভয়, বিশেষ করে বামন্দি-চকের বুড়ো শিমুল গাছটা এবং ওর বাজে-পোড়া মরা ডাল বড় ভয়ের কারণ। নিচে কবর, আবহমানকাল ধরে মানুষের কবর, হাজার হবে, বেশিও হতে পারে—ঈশম ভয়ে সেই পথে খালের পাড়ে পৌঁছাতে পারছে না।

ঈশম হাতের লাঠিটা এবার আরও শক্ত করে ধরল। সে ভয় পেলেই আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকায়। আল্লা মেহেরবান। সে যেন আসমানে তার সেই মেহেরবানকে খুঁজতে থাকে। অজস্র তারা এখন বিন্দু বিন্দু হয়ে জ্বলছে। নিচে সেই এক শুধু গাঢ় অন্ধকার। দূরে দূরে সব গ্রামের আলো, হ্যাজাকের আলো—গাছের ফাঁকে এবং ঝোপজঙ্গলের ফাঁকে এখনও দেখা যাচ্ছে। পরাপরদীর পথ ধরে কিছু লোক যাচ্ছিল জল ভেঙে—ওদের হাতে কোনও আলো নেই—জলে ওদের পায়ের শব্দ। কিছু কথাবার্তা ঈশমের কানে ভেসে আসতে থাকল।

সে ক্রমে খালের দিকে নেমে যাচ্ছিল। ওর হাঁটু পর্যন্ত ধানগাছ শিশিরে ভিজছে। ঈশম পরাপরদীর পথ থেকে ক্রমশ ডাইনে সরে যাচ্ছে। এ অঞ্চলে সে কোন মানুষের সাড়া পাচ্ছে না। নীরবে যেন একটা মাঠ গাভীন গরুর মতো অন্ধকারে শুয়ে আছে। পথ ধরে কোনও হাটুরে ফিরছে না। ফসলের ভারে গাছগুলি পথের উপর এসে পড়েছে। সে লাঠি দিয়ে গাছগুলি দুদিকে সরিয়ে দিচ্ছে এবং পথ করে নেমে যাচ্ছে। খালের পাড়ে গিয়ে দেখল গুদারা বন্ধ। মাঝি এপারে নৌকা রেখে চলে গেছে। নৌকাটা অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বাঁ পাশে সে কয়েক কদম হেঁটে গেল। অদূরে মনে হল আকাশের গায়ে একটা লণ্ঠন জ্বলছে। ঈশম জানত, এ সময়ে জেলেনৌকা থাকবে—বর্ষার জল খাল বিল ধরে নেমে যাচ্ছে। যে জল এ অঞ্চলে উঠে এসেছিল জোয়ারে—আঘুন মাসের টানে তা নেমে যাবে। জলের সঙ্গে মাছ এবং কচ্ছপ। জেলেরা এসেছে, খড়া জাল নিয়ে খালের ভিতর জাল পেতে অন্ধকারে ঘাপটি মেরে বসে আছে। ঈশম খালের পাড়ে সেই লণ্ঠনের আলো পর্যন্ত হেঁটে গেল। পাড়ে গিয়ে দাঁড়াল। ডাকল, আমি ঈশম। আমারে পার কইরা দ্যাও। আমি যাইতাছি এক খবর নিয়া। ধনকর্তার পোলা হইছে। তারপর সে কেন যে হঠাৎ ডাকল, বড়মামা আছেন, বড়মামা! বড়মামি আপনের লাইগা জাইগা বইসা আছে, বাড়ি যান। কোনও উত্তর এল না। শুধু একটা নৌকা ওপার থেকে ভেসে এল। বলল, ধনকর্তার পোলা হইছে?

ঈশম বলল, হ।

—তবে কাইল যামু, একটা গরমা মাছ লইয়া যামু। মাছ দিয়া একটা পিরান চাইয়া নিমু। বলে সে পাটাতন তুলে অন্ধকারে একটা বড় মাছ টেনে বের করল। ইশম লণ্ঠনের আলোতে নীল রঙের তাজা মাছটা পাটাতনে লাফাতে দেখল। চোখ দুটো বড় অবলা। যেন এক পাগল মানুষ নিরন্তর এইসব মাঠে ঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ফুল-ফল পাখি দেখে বেড়াচ্ছে—এই চোখ দেখলে, পাগল মানুষটার চোখ শুধু ভাসে। বড়মামি বড় বড় চোখ নিয়ে প্রত্যাশায় বসে আছে, কখন ফিরবে মানুষটা। সে বলল, বড়মামারে দ্যাখছ?

মানুষটা বলল, বড়কর্তারে আইজ দেখি নাই।

ঈশম আর কোনও কথা বলল না। এইসব মাঠে পাগল মানুষ দিনরাত ঘুরে বেড়ান। কোন অন্ধকারে,কোথায় তিনি কার উদ্দেশে হেঁটে যান ঈশম টের করতে পারে না। তাকে খাল পার করে দিলে, সে মাঠ ধরে হাঁটতে থাকল শুধু।

এখন সে পাটের জমি ভাঙছে। এখানে এখন কোনও ফসল নেই। কলাই, খেসারি এসব থাকার কথা—কিন্তু কিছুই নেই। শুধু ফসলহীন মাঠ। শুধু খোঁচা খোঁচা দাড়ির মতো পাট গাছের গোড়া উঁকি মেরে আছে। যোগী-পাড়াতে এত রাতেও তাঁত বোনা হচ্ছে। মাঠেই সে তাঁতের শব্দ পেল। সে গ্রামে উঠে যাবার মতলবে কোনাকোনি হাঁটছে। জেলেদের নৌকাগুলি এখন আর দেখা যাচ্ছে না। শুধু খড়া জালের মাথায় বাঁশের ডগাতে লণ্ঠনের আলো প্রায় যেন এক ধ্রুবতারা—ওকে পথের নির্দেশ দিচ্ছে। সে কতটা পথ হেঁটে এল, এবং কোনদিকে উঠে যেতে হবে—অন্ধকারে সেই এক আলো তাকে সব বাৎলে দিচ্ছে। এ মাঠের শেষেই সেই বুড়ো শিমুল গাছটা যেন ক্রমে অবয়ব পাচ্ছে। দিনের বেলাতে এ-জমি থেকে গাছটা স্পষ্ট দেখা যায়। সেই গাছটার পাশের গ্রামে একবার মড়ক লেগেছিল—ঈশম কেমন ভয়ে ভয়ে হাঁটছে! শিমুলগাছটার দূরত্ব ঈশমকে কিছুতেই ভয় থেকে রেহাই দিচ্ছে না। সে যত দূর দিয়ে যাচ্ছে তত মনে হচ্ছে গাছটা ওর দিকে হেঁটে আসছে। ডান পাশে প্রায় আধ ক্রোশ হেঁটে গেলে সেই গাছ এবং নিচে তার কবরভূমি—যেহেতু টিলা জমি থেকে একবার সে গাছটাকে দেখতে পেয়েছিল, একদিন হাট ফেরত রাতে গাছটার মাথায় সে আলো জ্বলতে দেখেছিল—সেজন্য ঈশম ভয়ে ভয়ে দ্রুত পা চালিয়ে যোগীপাড়াতে উঠে এল। কেউ দেখে ফেললেই বলবে, এলাম সেই কবর ভেঙে—কারণ ঈশমের মতো সাহসী পুরুষ হয় না—এ তল্লাটে সে এমন একজন সাহসী মানুষ। কিন্তু ঈশম কোনওকালে তার ভয়ের কথা খুলে বলে না। সাহসী বলে সে রাতেবিরেতে পরাণের ভিতরে ভয় লুকিয়ে রেখে চোখ বুজে চলে যেতে থাকে। যোগীপাড়াতে উঠতেই মানুষের শব্দে, চরকার শব্দে এবং শানা মাকুর শব্দে ভয়টা কেটে গেল। তারপর পরিচিত মানুষের গলা পেয়ে বলল, আমীর চাচার গলা পাইতাছি।

—তুমি……?

—আমি ঈশম।

—এত রাইতে!

—যামু মুড়াপাড়া। ধনকর্তার পোলা হইছে—খবর লইয়া যাইতাছি। আপনার শরীর ক্যামন?

—ভাল নারে বাজান। ভাল না। একটু থেমে বলল, বড়কর্তার মাথাটা আর ঠিক হইল না?

—না চাচা।

—শোনলাম বুড়া কর্তা চক্ষে দেখতে পায় না।

—না। সারাদিন ঘরে বইসা থাকে। বড়মামি, বুড়া ঠাইরেন দেখাশুনা করে।

—পোলাটা পাগল হইল আমার কর্তার-অ চক্ষু গেল।

—হ চাচা।

—তা একটু বইস। তামাক খাও।

—আর একদিন চাচা। আইজ যাইতে দ্যান। ঈশম কথা বলতে বলতে সৈয়দ মিস্ত্রির শোলার মাচান অতিক্রম করে রামপদ যোগীর আমবাগানে ঢুকে গেল। তারপর গ্রামের মসজিদ পার হয়ে মাঠে পড়তেই শিমুল গাছটার কথা মনে হল। সে জোরে জোরে মনের ভিতর সাহস আনার জন্য বলল, এলাহী ভরসা। গাছটা যেন ক্রমে শয়তান হয়ে যাচ্ছে। শয়তানের মতো পিছু নিয়েছে। মাঝে-মাঝে হাতের লাঠিটা লণ্ঠনটা ভয়ানক ভারী-ভারী মনে হচ্ছে। সে ভাবল—এমন তো হবার কথা নয়। সে ভাবল, অনেক রাত, অনেক দূরে সে কত মানুষের সুসংবাদ, দুঃসংবাদ বয়ে নিয়ে গেছে—অথচ আজ এখনও সে ফাওসার চক ভাঙতে পারেনি। শিমুল গাছটা বড় কাছে মনে হচ্ছে। কখনও পেছনে তাড়া করছে, কখনও সামনে! সে দু’বার লাঠিটা মাথার উপর বন বন করে ঘোরাল। ওর পাইক খেলার কথা মনে হল-লাঠি খেলায় ওস্তাদ ঈশম এই মাঠে গাছটাকে প্রতিপক্ষ ভেবে মাঝে মাঝে লাঠি ঘোরাতে থাকল। লণ্ঠনটা সে বাঁ হাতে রেখে ডান হাতে লাঠি মাথার উপর ঘোরাচ্ছে এবং নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। যখন ধানগাছগুলো পা জড়িয়ে ধরেছে, সে লাঠি দিয়ে ধানগাছ সরিয়ে ফের হাঁটছে। সে লাঠি দিয়ে মাঝে মাঝেই ধান গাছ সরাচ্ছিল—কিছুটা নিজেকে অন্যমনস্ক করার জন্য, কিছুটা পথ পরিষ্কার করার জন্য। মাঠে নেমেই শরীরটা ঠাণ্ডা মেরে যাচ্ছে। ভয়ানক শক্ত সমর্থ শরীর ঈশমের। এই বুড়ো বয়সেও সে `ঘাড়-গলা শক্ত রাখতে পেরেছে। অথচ এই রাত, অন্ধকার, বিশাল বিলেন মাঠ এবং যে শিমুল গাছটা এতক্ষণ ওকে তাড়া করছে—এই সব মিলে তাকে কেমন গোলমালের ভিতর ফেলে দিয়েছে। ঈশম লণ্ঠনের আলোতে যেন পথ দেখতে পাচ্ছে না। এই বিল ভেঙে উঠতে পারলেই ফের গ্রাম, ফের গ্রামের পথ, গোলাকান্দালের ভূতুড়ে পুল এবং পুরীপূজার মাঠ। ফের গ্রামের পর গ্রাম, তারপর বুলতার দিঘি এবং নমশূদ্রপাড়া-পেড়াব পোনাব, মাসাব গ্রাম।

অন্ধকার বলেই আকাশে এত বেশি তারা জ্বলজ্বল করছিল। বিলেন জমি নিচে নামতে নামতে যেন পাতালে নেমে গেছে। আলপথগুলি এখনও ঠিক মতো পড়েনি, অঘ্রান গেলে, পৌষ এলে এবং ধানকাটা হলে পথগুলি স্পষ্ট হবে। এই বিলে পথ চিনে অন্য পারে উঠে যাওয়া এখন বড় কষ্টকর।

অনেকক্ষণ ধরে ঈশম একটি পরিচিত আলপথের সন্ধান করল। যারা মেলাতে যায়, অথবা বান্নিতে, তারা এই আলপথে বিলের অন্য পাড়ে উঠে যায়, ধানজমির ফাঁকে ফাঁকে কোথায় যেন পথটা লুকিয়ে আছে। সে সন্তর্পণে গাছ তুলে তুলে দেখছে আর এগুচ্ছে। এই বুঝি সেই পথ, কিছু দূরে গেলেই মনে হচ্ছে, না সে ঠিক পথে আসেনি-পথটা ওকে নিয়ে বিলের ভিতর লুকোচুরি খেলছে। তারপর ভাবল, বিলের জমির ধারে ধারে হাঁটতে থাকলে সে নিশ্চয়ই পাশের গ্রামে গিয়ে উঠতে পারবে। মনে মনে আবার উচ্চারণ করল, এলাহী ভরসা। তাকে এ-রাতে, এ-বিল, এ-মাঠ অতিক্রম করতেই হবে। অন্ধকারে পথ যত অপরিচিত হোক, শয়তানের চোখ যত ভয়ঙ্কর হোক—সে এ-মাঠ ঠেলে অন্য মাঠে গিয়ে পড়বেই। ধনকর্তাকে খবর দেবেই।

সে কখনও দৃঢ় হল। অথবা কখনও সংশয়ে ভুগে সে কেমন দুর্বল হয়ে পড়ছে। সে যেন ক্ৰমে এই বিলের ভিতর ডুবে যাচ্ছে। এবং মনে হচ্ছে তার, সে একই জায়গায় ঘুরে ঘুরে ফিরে আসছে। সে আদৌ এগুতে পারছে না। সে এবার বলল, খুদা ভরসা। সে যে ঘুরে ফিরে একই জায়গায় ফিরে আসছে পরখ করার জন্য হাতের লাঠিটা ধানগাছ সরিয়ে কাদামাটিতে পুঁতে দিল। সে সেই নির্দিষ্ট স্থানটি চিনে রাখার জন্য কিছু গাছ উপড়ে ফেলল। একটা কাকতাড়ুয়ার মতো করে গাছগুলিকে বেঁধে রাখল লাঠিতে। তারপর গোলমতো চারপাশে একটা দাগ দিল।

অনেকক্ষণ ধরে এই বিল এবং পথ ওর সঙ্গে রসিকতা করছে। সে একটু সময় বসল। বিশ্বচরাচর নিঝুম। মনে হয় ঠিক যেন এই বিল সেই পাগল ঠাকুরের মতো রহস্যময়। সে নিজের মনে হাসবার চেষ্টা করল। অথচ গলা শুকনো। ওর সামান্য কাশি উঠে এল গলা থেকে। দ্রুত সেই শব্দ বিলের চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছিল। অপরিচিত শব্দ কোথাও। সে কান পেতে রাখল। এখন এই মাঠ আর তার কাছে পাগল ঠাকুরের মতো রহস্যময় নয়, নিঃসঙ্গ মাঠ অঘ্রানের শিশিরে ভিজে ওর পঙ্গু স্ত্রীর মতো ঘুমাচ্ছে অথবা রাতের কীটপতঙ্গ সকল, ঝিঁঝিপোকা সকল শীতের মরসুমের জন্য আর্তনাদ করছে। কবে শীত আসবে, কবে শীত আসবে, মাঠ ফাঁকা হবে, শস্যদানা মাঠে পড়ে থাকবে, আমরা উড়ে উড়ে খাব, ঘুরব-ফিরব, নাচব-খেলব। সে যত এইসব শুনতে থাকল, যত এইসব চিন্তায় বিষণ্ণ হতে থাকল তত সেই ভয়াবহ শিমুল গাছটা মাথায় আলো জ্বেলে ওর দিকে যেন এগিয়ে আসছে।

শিমুল গাছটার মাথায় আলোটা জ্বলছে আর নিভছে। অথবা নিভে গিয়ে আলেয়া হয়ে যাচ্ছে। দূরে দূরে যেন বিলের এ-মাথা থেকে অন্য মাথায় আলেয়াটা ওকে নেচে নেচে খেলা দেখাচ্ছে। সে বলল, ভালরে ভাল! এভাবে বসে থাকলে ভয়টা ওকে আরও পঙ্গু করে দেবে। সে দ্রুত উল্টো মুখে ছুটতে পারলেই কোন-না-কোন গ্রামে উঠে যেতে পারবে।

সুতরাং সে হাতের লণ্ঠন নিয়ে দ্রুত ছুটতে থাকল। হাতের লণ্ঠনটা দু’বার দপদপ করে জ্বলে উঠল। লণ্ঠনটা নিভে যাবে ভয়ে সে দ্রুত ছুটে যেতে পারল না। সে দু’হাঁটুতে আর শক্তি পাচ্ছে না। বার বার কেবল পিছনের দিকে তাকাচ্ছে। সে এবার দেখল, স্পষ্ট দেখতে পেল, শিমুল গাছটা যথার্থই এগিয়ে আসছে। সে দেখল গাছের মাথায় আলো আর ডালে ডালে মড়কের মৃতদেহ ঝুলছে। সে ধানখেত পার হয়ে কাকতাড়ুয়া জায়গাটায় ফিরে এসেছে। শিমুল গাছটা সহসা জীবন্ত হয়ে গেল। এতক্ষণে তবে সে একই বৃত্তে ঘুরছে! ভয়ে বিবর্ণ ঈশম দস্যুর মতো লাথি মারল কাকাতাড়ুয়াকে। উপড়ানো গাছগুলি অন্ধকারে বিলের প্রচণ্ড হাওয়ায় উড়তে থাকল।

সে বলল, শয়তানের পো ভাবছটা কি শুনি! বিলের পানিতে আমারে ডুবাইয়া মারতে চাও! বলেই সে লাঠিটা তুলে উপরের দিকে ঘোরাল। যেমন সে মহরমের দিন বাজনার সঙ্গে সঙ্গে সামনে-পিছনে অথবা উপরে-নিচে, ডাইনে-বাঁয়ে লাঠি ঘোরাতো, লাঠি এগিয়ে দিত, পিছিয়ে আনত, সে উপরের দিকে উঠে যাবার সময় তেমন সব খেলা দেখাতে থাকল। এই বিলের জমি এবং শিমুল গাছটার ভয়ে সে এখন মরিয়া। কিন্তু খেলা দেখালে হবে কি—কারা যেন ওকে পেছনে টানছে। চারপাশে হাঁটছে কারা। মনে হচ্ছে সারা বিলে মানুষের পায়ের শব্দ ভেসে বেড়াচ্ছে। একদল অবয়বহীন শয়তান ওর সঙ্গে হাঁটছে অথচ কথা বলছে না। অন্ধকারে সে কেবল উপরে ওঠার পরিবর্তে নিচে নেমে যাচ্ছে। এবারে সে চিৎকার করে উঠল, খুদা এইটা কি হইল! ধনকর্তাগ, আমারে কানাওলায় ধরছে। সে লণ্ঠন ফেলে লাঠি ফেলে বিলের আলে আলে ঘুরতে থাকল। ধানপাতা লেগে পা কেটে যাচ্ছে। সে বার বার একই জায়গায় ঘুরে ঘুরে এসে হাজির হচ্ছে। আর এ সময়ই সে দেখল ভুতুড়ে আলোটা একেবারে চোখের সামনে জ্বলছে নিভছে। সেই আলোর হাজার চোখ হয়ে গেল, অন্ধকারের ভিতরে ভূতের মতো চোখগুলো জ্বলছে। ঈশম আর লড়তে পারল না, ধীরে ধীরে আলের উপর সংজ্ঞাহীন হয়ে গেল।

.

আগে সুন্দরআলি লণ্ঠন হাতে। পিছনে ধনকর্তা। তিনি চারদিন আগে ধনবৌর চিঠি পেয়েছেন। ধনবৌ লিখেছে—শরীরটা আমার ভাল যাচ্ছে না, এ সময় তুমি যদি কাছে থাকতে। ধনবৌর চিঠি পেয়ে চন্দ্রনাথ আর দেরি করেন নি। বড় কাছারি বাড়িতে মেজদা থাকেন, তাঁর কাছে গিয়ে বললেন, দাদা, আমি একবার বাড়ি যামু ভাবছি। আপনের বৌমা চিঠি দিছে। অর শরীর ভাল না—একবার তবে ঘুইরা আসি। ভূপেন্দ্রনাথ তার সঙ্গে সুন্দরআলিকে দিয়েছেন। রাত হয়ে যাবে যেতে। সেরেস্তায় কাজের চাপ পড়েছে—নতুবা তিনি নিজেও বাড়ি যেতেন। ছেলে হয়েছে এমন খবর জানা থাকলে চন্দ্ৰনাথ এতটা বোধহয় উদ্বিগ্ন হতেন না। তিনি দ্রুত পা চালিয়ে হাঁটছেন। সুন্দরআলিকে নিয়ে লণ্ঠন হাতে নেমে এসেছেন। শীতলক্ষ্যার পাড়ে পাড়ে এসে বাজার বাঁয়ে ফেলে মাসাব পোনাব হয়ে বুলতার দিঘি ধরে ক্রমশ এগিয়ে চলেছেন। পেয়াদা সুন্দরআলি মাঝে মাঝে কাশছিল। নির্ভয়ে নিঃশব্দে তাঁরা এ মাঠে এসে নেমেছেন। মাঠ পার হলেই ফাওসার খাল, তারপর দু’ক্রোশ পথ। বাড়ি পৌঁছাতে দেরি নেই। এমন সময়ে সুন্দরআলি চিৎকার করে উঠল, নায়েব মশাই, খুন। হাত থেকে লণ্ঠনটা পড়ে যাবে ভাব হল সুন্দরআলির। সুন্দরআলি পেছনের দিকে ছুটে পালাতে চাইল।

ধনকর্তা হকচকিয়ে গেলেন, এখানে খুন-ডাকাতি!

সুন্দরআলি বলল, মাঠের উপর দিয়া আসেন কর্তা। নিচ দিয়া আমি যামু না।

ধনকর্তা এবার জোরে ধমক দিলেন, আয় দ্যাখি, কি খুন কে খুন দ্যাখি। ধনকর্তা লণ্ঠন তুলে সন্তর্পণে মানুষটার মুখের উপর ধরলেন। মানুষটা বড় চেনা যেন। তিনি নাড়তে থাকলেন ওকে। দেখলেন শ্বাস-প্রশ্বাস পড়ছে। তিনি ডাকলেন, ঈশম, তর কি হইল? ঈশম, অঃ ঈশম! ঈশমের শরীরে কোনও আঘাতের চিহ্ন নেই—তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন সব।

ঈশমের পাশে বসে ধনকর্তা চোখ টেনে দেখলেন। না সবই ঠিকঠাক আছে। এবার মনে হল–বিলেন মাঠে এমন আঁধারে ঈশম পথ হারিয়েছে। তিনি বিল থেকে জল আনলেন। রুমালে ভিজিয়ে ভিজিয়ে জল দিলেন চোখেমুখে এবং একসময় জ্ঞান ফিরলে বললেন, কিরে তর ডরে ধরছে। আমি তর ধনমামা।

ঈশম চোখ মেলে ধীরে ধীরে দেখল। প্রথমে বিশ্বাস করতে পারল না। তারপর কেমন অবিশ্বাসের গলায় ডাকল, ধনমামা! আপনে ধনমামা! ধনকর্তাকে দেখে সে কেঁদে ফেলল। মামাগ, আমারে কানাওলায় ধরছে! সারাটা মাঠ, বিল, জমি ঘুরাইয়া মারছে। শরীরটা আর শরীর নাইগ মামা।

—আস্তে আস্তে হাঁট। বিলে তুই আইছিলি ক্যান?

এতক্ষণ পর ঈশমের সব মনে হল। কেন এসেছিল এই মাঠে, কোথায় যাবে, কী করবে, কী খবর দিতে হবে সব এক এক করে মনে পড়ল। ধনমামা, আপনের পোলা হইছে। আমিও আপনের কাছে যামু বইলা বাইর হইছি। পথে এই কাণ্ড—কানাওলা।

ধনকর্তা বিশাল বিলেন মাঠে আলো-আঁধারে দাঁড়িয়ে কি জবাব দিতে হবে ভেবে পেলেন না। আকাশে তেমনি হাজার নক্ষত্র জ্বলছে। ঠাণ্ডা হাওয়া ধানের গন্ধ বয়ে আনছে। ঈশম সে সময় বলল, চলেন মামা আস্তে আস্তে হাঁটি। যেতে যেতে খুব সংকোচের সঙ্গে বলল, আমারে একটা তফন দিতে হইব।

ওরা হেঁটে হেঁটে একসময় ট্যাবার পুকুর পাড়ে এল। অশ্বত্থ গাছ পার হতে গিয়ে ঈশম ডাকল, বড়মামা আছেন, বড়মামা! কোনও উত্তর এল না। পুকুর পাড়ে গভীর ঝোপ-জঙ্গল। এত রাতে এই জঙ্গলে বসে থাকলে কিছুতেই কেউ টের পাবে না। ভিতরে কেউ আছে কি নেই—দিনের বেলাতেও টের পাওয়া যায় না। ঈশম অথবা চন্দ্রনাথ বৃথা আর ডাকাডাকি করল না। করলা খেত পার হয়ে ধানের জমিতে নেমে আসতেই টের পেল যেন খেতের ভিতর খচখচ শব্দ হচ্ছে। ধান খেতে সামান্য জল। পায়ের পাতা ডোবে কি ডোবে না। ঈশম লণ্ঠন তুলতেই দেখল—বড়কর্তা। ধান খেতের ভিতর বড়কর্তা কেমন উবু হয়ে বসে আছেন। ঈশম খেতের ভিতর ঢুকে বলল, উঠ্যান। বাড়ি যাইতে হইব। বড়মামি আপনের লাইগা জাইগা আছে। কিন্তু বড়কর্তার মুখে কোনও কথা ফুটে উঠল না। যেমন বসেছিলেন তেমনি বসে থাকলেন। কিছুতেই উঠছেন না। কিসের উপর চেপে বসে আছেন। পায়ের নিচে অন্ধকার এবং ধান গাছ। খচখচ শব্দ। গাছগুলি নড়ছে। সে লণ্ঠনটা নিচে নামাতেই দেখল একটা বড় কাছিম। একটা প্রকাণ্ড কাছিমকে চিৎ করে তিনি তার উপরে বসে আছেন। কাছিমটা পা’গুলি বের করে মুখ বের করে কামড়াতে চাইছে। কিন্তু তাঁর হাত পা নাগাল পাচ্ছে না। কেবল গাছগুলি নড়ছে। ঈশম কি বলতে যাচ্ছিল, সঙ্গে সঙ্গে কাছিমের বুকে বসে বড়কর্তা হেঁকে উঠলেন, গ্যাৎচোরেৎশালা।

ঈশম বলল, বড়মামা, এইটা আপনে কি করছেন? এতবড় একটা কাছিম ধইরা বইসা আছেন? তারপর সে বলল, আপনে বাড়ি যান। ধনমামায় আইছে। ধনমামার পোলা হইছে।

ধনকর্তা বললেন, উইঠা আসেন বড়দা। কাছিমটা ঈশম লইয়া যাইবখন।

বড়কর্তা ভাল মানুষের মতো ধনকর্তাকে অনুসরণ করলেন। বড়কর্তা কখন ছুটতে থাকবেন, কখন হাতে তালি বাজাবেন—এই সব ঘটনার সম্মুখীন হওয়ার জন্য ধনকর্তা সন্তর্পণে পিছনে পিছনে হাঁটতে থাকলেন। বড়কর্তা অন্ধকারে ছুটতে চাইলে ধনকর্তা বললেন, আমার হাতে লাঠি আছে বড়দা। ছুটবেন ত বাড়ি মারমু। ঠ্যাঙ ভাইঙ্গা দিমু।

চন্দ্রনাথের মুখে এমন কথা শুনে বড়কর্তা ঘুরে দাঁড়ালেন। আমাকে তুমি ভর্ৎসনা করছ চন্দ্ৰনাথ! এমন এক করুণ মুখ নিয়ে চন্দ্রনাথকে দেখতে থাকলেন। তিনি যেমন কোনও কথা বলেন না, এখনও তেমনি কোনও কথা না বলে অপলক চেয়ে থাকলেন। এমন চোখ দেখলেই মনে হয় এই উত্তর চল্লিশের মানুষ বুঝি এবার আকাশের প্রান্তে হাত তুলে তালি বাজাবেন। চাঁদের কাকজ্যোৎস্না এখন আকাশের সর্বত্র। যথার্থই এবার বড়কর্তা দুহাত উপরে তুলে হাতে তালি বাজাতে থাকলেন, যেন আকাশের কোন প্রান্তে তাঁর পোষা হাজার হাজার নীলকণ্ঠ পাখি হারিয়ে গেছে। হাতের তালিতে তাদের ফেরানোর চেষ্টা। আর ধনকর্তা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব কিছু নতুন করে লক্ষ করলেন—বড়দার বড় বড় চোখ, লম্বা নাক, প্রশস্ত কপালের পাশে বড় আঁচিল, সবচেয়ে সেই সূর্যের মতো আশ্চর্য রঙ শরীরের এবং সাড়ে ছয় ফুটের উপর শরীরে ঋজুতা। দেখলে মনে হবে মধ্যযুগীয় কোন নাইট রাতের অন্ধকারে পাপ অন্বেষণ করে বেড়াচ্ছেন! চন্দ্রনাথ দেখলেন, বড় এবং গভীর চোখ দুটো সারাদিন উপবাসে কোটরাগত। দুঃখে চন্দ্রনাথ চোখের জল রোধ করতে পারলেন না। বললেন, বড়দা আপনে আর কত কষ্ট পাইবেন, সবাইরে আর কত কষ্ট দিবেন!

বড়কর্তা ওরফে মণীন্দ্রনাথ শুধু বললেন, গ্যাৎচোরেৎশালা। ফের তিনি আকাশের প্রান্তে তালি বাজাতে থাকলেন। সেই তালির শব্দ এত বড় মাঠে কেমন এক বিস্ময়কর শব্দ সৃষ্টি করছে। এইসব শব্দ গ্রাম মাঠ পার হয়ে সোনালী বালির চর পার হয়ে তরমুজ খেতের উপর এখন যেন ঝুলছে। মণীন্দ্রনাথের বড় ইচ্ছা, জীবনের হারানো সব নীলকণ্ঠ পাখিরা ফিরে এসে রাতের নির্জনতায় মিশে থাক—কিন্তু তারা নামছে না—বড় কষ্টদায়ক এই ভাবটুকু। তিনি এবার চন্দ্রনাথকে অনুসরণ করে ঘরের দিকে চলতে চলতে যেন বলতে চাইলেন, চন্দ্র, তোমার ছেলে হয়েছে, বড় আনন্দ! অথচ কথার অবয়বে শুধু এক প্রকাশ, গ্যাৎচোরেৎশালা। এবার তিনি নিজের এই অপ্রকাশের দুঃখে কেমন দুঃখিত হলেন—এত নক্ষত্র আকাশে অথচ তাঁর পাগল চিন্তার সমভাগী কেউ হতে চাইছে না। সকলেই যেন তাঁর ঠ্যাঙ ভেঙে দিতে চাইছে। মণীন্দ্রনাথ আর কোনও কথা না বলে সেজভাইকে শুধু অনুসরণ করে হাঁটতে থাকলেন।