সোনা সারারাত ঘুমের ভিতর স্বপ্ন দেখল, সেই এক বড় সমুদ্র যেন, বালিয়াড়িতে কারা একটা বড় কাঠের ঘোড়া টানতে টানতে নিয়ে এল। কি উঁচু আর লম্বা ঘোড়া! মানুষগুলি চলে গেলেই সে দেখতে পেল, ঘোড়াটা কাঠের নয়, ঘোড়াটা তাজা ঘোড়া—ওর দিকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাচ্ছে। সে একা ছিল না, কমলা অমলা যেন সঙ্গে আছে। ঘোড়াটা ওর কাছে এসে ঠিক পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে পড়ল—যেমন মুড়াপাড়ার হাতিটাকে সেলাম দিতে বললে অথবা হেঁট-হেঁট বললে হাঁটু ভেঙে শুয়ে পড়ে তেমনি ঘোড়াটা এসে ওর সামনে এসে দু পা তুলে খাড়া হয়ে গেল। সে, কমলা এবং অমলা পিঠে চড়তেই ঘোড়াটা ছুটতে থাকল। ঠিক বালিয়াড়ির শেষে সমুদ্রের প্রায় হাঁটু জলে নেমেই ঘোড়াটা আবার কেমন কাঠের হয়ে গেল—নড়ছে না! সে, অমলা কমলা নামতে পারছে না। ক্রমে ঘোড়াটা উঁচু হতে হতে একেবারে আকাশ সমান হয়ে গেল। মেঘ ফুঁড়ে এত উঁচুতে উঠে গেছে যে, নিচের কিছুই ওরা দেখতে পাচ্ছে না। সে মুঠো মুঠো মেঘ ছিঁড়ে খেতে থাকল, কি মিষ্টি আর সুস্বাদু। ঠিক মেলাতে সে যেমন আঁশ-আঁশ চিনির তৈরি তুলোর বল ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেত, সে ঘোড়ার পিঠে উঠে তেমনি সেই মেঘ ছিঁড়ে, মোয়ার মতো হাতে নিয়ে গোল গোল করে অমলা কমলাকে দিতে থাকল। আর তখন নিচের দিকে তাকাতেই মনে হল, কারা যেন সেই হাজার লক্ষ হবে, পিলপিল করে ঘোড়ার পা বেয়ে উঠে আসছে। ঠিক যেন ওদের স্বর্গে ওঠার সিঁড়ি মিলে গেছে। সে এখন কী করবে ভেবে পেল না। হাতের কাছে আকাশ চিরে মাথা গলিয়ে দিতে পারবে, এবং দেব-দেবীদের রাজত্বে কার্তিক গণেশ অথবা শিবঠাকুর কীভাবে হেঁটে বেড়াচ্ছেন, দেখতে পাবে। কিন্তু কী আশ্চর্য, যেই না এমন ভাবা, ঘোড়াটা আবার ছোট হতে হতে একটা ছোট খেলনা হয়ে গেল! সে, কমলা অমলা এখন সেই খেলনার ঘোড়া বুকে নিয়ে সমুদ্রের বালিয়াড়িতে উঠে আসছে এবং উঠে আসার মুখেই মনে হল, জ্যাঠামশাই আশ্বিনের কুকুর নিয়ে হেঁটে হেঁটে নদীর পাড়ে চলে যাচ্ছেন। সহসা জ্যাঠামশাই বিরক্তিতে চিৎকার করে উঠলেন, গ্যাৎচোরেৎশালা। সঙ্গে সঙ্গে সোনার সুন্দর স্বপ্নটা ভেঙে গেল। ওর মাথার কাছে, ঠিক জানালায় শরতের সূর্য সোনালী জলের রঙ যেন, ওর পায়ের নিচে সূর্যের আলো। সে ধড়ফড় করে উঠে বসল।
প্রথম সে বুঝতে পারল না কোথায় সে আছে। ওর মনে হচ্ছিল সে বাড়িতে আছে। এবং বিছানায় শুয়ে স্বপ্ন দেখছে। এখন মনে হল, এটা কাছারিবাড়ি। এটা মেজ-জ্যাঠামশাইর বিছানা। সে মেজ-জ্যাঠামশাইর পাশে শুয়ে ঘুমিয়েছে। সে এবার ভালো করে চোখ মুছল। অমলা কমলার কথা মনে হল। ওরা এখন কোথায়? তারপর রোদ উঠলে সে দরজা দিয়ে বের হয়ে গেল। জ্যাঠামশাই কোথায়? এত বড় কাছারিবাড়িতে কেউ নেই। সকলেই যেন নদীর পাড়ে চলে গেছে। দরজা পার হলে বারান্দা। বারান্দার পর সবুজ মাঠ। আর দীঘির দক্ষিণ পাড়ে বড় মঠ। সোনা গতকাল মঠ দেখতে পায়নি। সোনা বস্তুত রাত হলে এদিকটায় এসেছে। অমলা কমলা ওকে জ্যাঠামশাইর কাছে দিয়ে গেছে। বাড়ির উত্তরে থাকলে বোঝাই যায় না দিঘির পাড়ে এত বড় এক মঠ আছে। শুধু ছাদের উপর যখন সে দাঁড়িয়েছিল, অমলা কমলা বলেছে, মঠের সিঁড়িতে একটা শ্বেতপাথরের ষাঁড় আছে। ষাঁড়ের গলায় মোতি ফুলের মালা। আর সেই ছাদের অন্ধকারটা এখন যেন ওর কাছে এক রহস্যময় জগৎ। ঘুম থেকে উঠেই পূজার বাজনা কানে আসছিল। অর্জুন নায়েব নদী থেকে স্নান করে ফিরছে। রামসুন্দর কাঁধে লাঠি নিয়ে কোথাও যাবে বোধহয়। লালটু পলটু এখন কোথায়? এ-বাড়িতে এসে মেজদাকে সে দেখতেই পাচ্ছে না। ওরা কোথায় আজ শিকারে যাবে। সকাল সকাল হয়তো নদীর চরে শিকারের জন্য বের হয়ে গেছে। আর তখনই মনে হল মাঠ পার হলে দীঘি, দীঘির ওপারে এক মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। সে যেন চিনতে পারছে মানুষটাকে, কিন্তু বিশ্বাস করতে পারছে না। অস্পষ্ট লম্বা এবং স্থির, প্রায় যেন সমুদ্রের বালিয়াড়িতে ট্রয় নগরীর কাঠের ঘোড়া, শহরের দিকে মুখ করে তাকিয়ে আছে। সোনা দাঁড়াল না। ঠিক স্বপ্নের মতো, যেন স্বপ্নটা হুবহু মিলে যাচ্ছে। সে পাগলের মতো ছুটতে থাকল। অর্জুন নায়েব বলল, সোনা, কোন্খানে যাইতাছ? তোমার জ্যাঠামশাই নদীতে স্নান করতে গ্যাছে। কে কার কথা শোনে এখন। সে মাঠ পার হয়ে, হরিণেরা যেখানে থাকে, তাদের নিবাস পার হয়ে, ময়ূরের ঘর ডাইনে ফেলে, ফুল-ফলের গাছ পার হয়ে এক ছায়াস্নিগ্ধ ঝাউ গাছের নিচে এসে দাঁড়াল। আবার ঘাড় তুলে দেখল। ঠিক মিলে যাচ্ছে কি না। কারণ, সে বিশ্বাসই করতে পারছে না। এদিকটায় বিচিত্র সব দেশী-বিদেশী ফুলের গাছ, ঝোপ-জঙ্গলের মতো জায়গা, সে গাছের ডালপাতা ফাঁকা করে দেখল সব ঠিকই আছে। দীঘির পাড় থেকে যা স্পষ্ট দেখতে পায়নি, এখানে এসে স্পষ্ট হয়ে গেল। সে আবেগে ছুটতে ছুটতে ডাকল, জ্যাঠামশয়! বড় জ্যাঠামশয়! আমি সোনা, জ্যাঠামশয়, জ্যাঠামশয়। কি আকুল আবেগ! সে পড়ি-মরি করে ছুটছে। তার সেই আপন মানুষ মিলে গেছে! সে দেখল কুকুরটা পর্যন্ত সোনাকে দেখে আনন্দে লেজ নাড়ছে। জ্যাঠামশাই কিছুতেই তাকাচ্ছেন না। হাতে-পায়ে ধানপাতার কাটা দাগ। জলে জলে হাত পা সাদা হয়ে গেছে। কখনও ঘুরে ঘুরে, কখনও জলে জলে কুকুর নিয়ে তিনি একলাই বের হয়ে পড়েছেন।
সোনা কাছে যেতেই কুকুরটা ডেকে উঠল, ঘেউ। এই সেই কুকুর, কবে থেকে বাড়ি উঠে এসেছে, বাড়ির চারপাশে ঘুরে বেড়ায়, বড় অবহেলাতে এই কুকুর সংসারে বড় হচ্ছে। যা-কিছু উচ্ছিষ্ট থাকে, এই কুকুর খায়। বাড়িতে যে কুকুরটা থাকে বোঝাই যায় না। কেউ আদর করে না, কিন্তু এখন এই আশ্বিনের কুকুর সোনার কাছে কত মূল্যবান। তার কত নিজের জিনিস এসে গেছে। সে আর এখন কাকে ভয় পায়! সে, যেমন ট্রয় নগরীর বালকেরা কাঠের ঘোড়া টানতে টানতে শহরের ভিতর টেনে নিয়ে গিয়েছিল, তেমনি সে এই মানুষটাকে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে। এত দূরে এসেই পাগল মানুষের কেমন যেন লজ্জা এসে গেছে প্রাণে। তিনি যেতে চাইছেন না ভিতরে। কারণ, এত বড় বাড়ি দেখে বুঝি তাঁর সেই দুর্গের কথা মনে পড়ে গেছে। একবার তিনি একটা কালো রঙের টাই পরেছিলেন। পলিনের উক্তি, তুমি কালো রঙের টাই পরবে না মণি, তুমি সাদা অথবা কমলা রঙের টাই পরবে, কালো রঙ দেখলে তোমার মতো মানুষকে কেমন নিষ্ঠুর মনে হয়। অথবা যেন এই যে তার বসন-ভূষণ এমন প্রাসাদের মতো বাড়িতে তা মানায় না। তিনি চারিদিকে তাকাতে থাকলেন। গায়ে জলের লাল মতো শ্যাওলা, যেন মানুষ নন তিনি, এক জলের দেবতা, নানারকম শ্যাওলা এবং গাছ লতাপাতা জলের, শরীরে গজিয়ে উঠেছে। সোনা টানতে টানতে নিয়ে যাবার সময় দিঘির সিঁড়িতে জ্যাঠামশাইকে বসাল। সে অঞ্জলিতে জল তুলে এনে শরীর থেকে শ্যাওলা, লতাপাতা পরিষ্কার করে দিতে থাকল। পাগল মানুষ যেন এই সিঁড়িতে পাথরের এক মূর্তি, বসে বসে আকাশ দেখছেন। চোখে না দেখলে বোঝাই যায় না মানুষটার ভিতর প্রাণ আছে।
দীঘির অন্য পাড়ে কমলা বৃন্দাবনীর সঙ্গে পূজার ফুল তুলছে। ফুল তুলতে তুলতে দেখল, সিঁড়িতে সোনা কি যেন করছে। সোনা লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ি ভাঙছে আবার উঠে যাচ্ছে। সিঁড়ির শানে এক মানুষ, সোনা মানুষটার শরীরে জল ছিটিয়ে দিচ্ছে। পাশে এক কুকুর। সে সোনার সঙ্গে ঘাটে বার বার নামছে আবার সোনার সঙ্গে সিঁড়ি ধরে উঠে যাচ্ছে। কী এত কাজ করছে নিবিষ্ট মনে সোনা! কমল ছুটতে থাকল, সে সেইসব হরিণ অথবা ময়ূরের ঘর পার হয়ে সবুজ গালিচা ঘাসের পাতার ওপর দিয়ে ছুটল। তারপর ঘাটের সিঁড়িতে এসে দেখল, সোনা হাঁটু গেড়ে মানুষটার শরীর থেকে কি সব বেছে দিচ্ছে। সে দেখল, সোনা শ্যাওলা বেছে দিচ্ছে। শাপলা-শালুকের পাতা বেছে দিচ্ছে। মাানুষটা কে! কমলা যে এসে পাশে দাঁড়িয়ে আছে, উঁকি দিয়ে দেখছে, আশ্চর্য চোখে কুকুর এবং এই পাথরের মতো মানুষকে দেখছে—সোনা তা দেখেও কোনও কথা বলছে না। কমল বাধ্য হয়ে বলল, কে রে সোনা?
—আমার জ্যাঠামশয়।
—তোর জ্যাঠামশয়?
—আমার বড় জ্যাঠামশাই।
—কথা বলে না?
—না।
—বোবা?
—না।
—তবে কথা বলে না কেন?
—কথা বলে—শুধু বলে গ্যাৎচোরেৎশালা।
—আর কিছু বলে না?
—না।
—এ মা, একি কথা রে! শুধু গ্যাৎচোরেৎশালা বলে!
সোনা আর উত্তর করল না। সোনা নিবিষ্ট মনে হাত পা থেকে শেষ শাপলা-শালুকের পাতা, দাম এবং জলজ ঘাস তুলে বলল, ওঠেন জ্যাঠামশয়।
কমল বলল, জলে ভিজে গেছে কেন?
সোনা বলতে পারত সাঁতার কেটে জ্যাঠামশাই এসেছেন। ওরা ওঁকে নিয়ে আসেনি। তিনি কুকুর নিয়ে চলে এসেছেন।
—তোর জ্যাঠামশাই পাগল।
সোনা রেগে গেল। বলল, হ হ, কইছে! পাগল কে কইছে!
—তবে কথা বলে না কেন?
সোনার কেন জানি ভীষণ রাগ হচ্ছিল। জ্যাঠামশাইকে পাগল বললে সে স্থির থাকতে পারে না। সে যেন তাড়াতাড়ি কমলের কাছ থেকে জ্যাঠামশাইকে নিয়ে দূরে সরে যেতে চাইল। তখন কমল বলল, আসুন দাদু। আমি সোনার পিসি হই। সোনা, আমি তোর পিসি হই না রে?
এবার যেন সোনা খুব খুশি। বলল, আমার কমল-পিসি জ্যাঠামশয়।
মণীন্দ্রনাথ কমলকে দেখলেন। চোখ নীল কেন এ মেয়ের! সে হাঁটু গেড়ে বসল। যেন কোনও দৈত্য এখন হাঁটু গেড়ে বসে পুতুলের মতো ছোট্ট এক মেয়েকে দু’হাতে তুলে চোখের কাছে নিয়ে এল। বলতে চাইল, তুমি কে মেয়ে! তোমাকে যেন চিনি!
এমন যে ডাঁহাবাজ মেয়ে তার চোখ পর্যন্ত আতঙ্কে এতটুকু হয়ে গেল। সোনা ভিতরে ভিতরে মজা পাচ্ছিল। সে প্রথম কিছু বলল না, কিন্তু দেখল কমল কেঁদে দেবে, সে বলল, ভয় নাই কমল। বলে সে জ্যাঠামশাইর দিকে তাকাল। আর তক্ষুনি সেই মানুষ, যেন মন্ত্রের মতো চোখ সোনার, চোখে রাগ, এতটুকু ছেলের এমন চোখ দেখে মণীন্দ্রনাথ কমলাকে নামিয়ে দিলেন। হয়তো কমল ছুটে পালাত, কিন্তু সোনা কি নিৰ্ভীক, এখন কমল নিজেকে খুব ছোট ভাবল সোনার কাছে। সোনা এতটুক ভয় পাচ্ছে না, সে টেনে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এতবড় মানুষ সোনার একান্ত বশংবদ, সোনার ভয়-ডর নেই, কমলরেও ভয়-ডর থাকল না। সে বাঁ হাতটা ধরল, সোনা ডান হাত ধরেছে। কুকুরটা আগে আগে যাচ্ছে।
ট্রয়ের ঘোড়া নিয়ে নাটমন্দিরের সামনে ঢুকতেই প্রায় একটা শোরগোল পড়ে গেল। সেই মানুষ এসেছেন আবার এই দেশে। পাগল মানুষ মণীন্দ্রনাথ হাবাগোবা মুখ নিয়ে নাটমন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে দুর্গাঠাকুর দেখতে থাকলেন। আর বাড়ির আমলা কর্মচারী, বালক-বালিকা এমনকী মেজবাবু এসে গেলেন। তিনি ভূপেন্দ্রনাথকে ডাকতে পাঠিয়েছেন।—বল গিয়ে ভুঁইঞা কাকাকে, ওঁর বড়দা এসেছেন। শান্তশিষ্ট বালকের মতো মানুষটা এখন দাঁড়িয়ে দুর্গাঠাকুর দেখছেন। উপরে ঝাড়লণ্ঠন ঝুলছে। তিনি ঘুরে-ফিরে সব দেখতে থাকলেন।
সোনা বলল, দুগগাঠাকুররে নম করেন।
মণীন্দ্রনাথ একেবারে সটান হয়ে শুয়ে পড়লেন। কেউ যেন ওঁকে আর এখন তুলতে পারবে না। দু’হাত সামনে সোজা। সবাই হাসাহাসি করছে। সোনার এসব ভাল লাগছে না। সে এখন পারলে এখান থেকেও নিয়ে সরে পড়তে চায়। মেজবাবু অর্থাৎ অমলা কমলার বাবা ধমক দিলেন। সামনে কেউ দাঁড়িয়েছিল বোধহয়, কর্মচারী কেউ হবে—মেজবাবু সকলকে চেনেন না—এই পূজার সময়ে দূর দেশের সব কাছারিবাড়ি থেকে নায়েব গোমস্তারা চলে আসে, সঙ্গে পূজা-পার্বণের জন্য আখ, কলা, দুধ, মাছ যে অঞ্চলে যা কিছু শ্রেষ্ঠ, পূজার সময় সব নিয়ে হাজির হয়। ওদের একজনকে বললেন, ভুঁইঞাকাকা এখনও. আসছেন না কেন দেখ তো?
পাগল মানুষ তেমনি সোজা সটান। প্রণিপাতের মতো শরীর শক্ত। সোনা দেখল, জ্যাঠামশাই সোজা হয়ে আছেন। সোনা বুঝতে পারল না, বললে তিনি উঠবেন না। সে এবার নুয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, উঠেন জ্যাঠামশয়। আর নম করতে হইব না। বলে হাত ধরতেই তিনি উঠে পড়লেন। ভিজা কাপড়ে সব কাদা-মাটি লেগে আছে।
ভূপেন্দ্রনাথ এসে তাজ্জব। মণীন্দ্রনাথ ভূপেন্দ্রনাথকে দেখেই সোনার দিকে তাকালেন। কি হবে সোনা! দেখছ মানুষটা আমার দিকে কিভাবে তাকাচ্ছে! সোনার দিকে তাকিয়েই মণীন্দ্রনাথ বিষণ্ণ হয়ে গেলেন। যেন তাঁর মনেই ছিল না এখানে ভূপেন্দ্রনাথ থাকে। এখানে এলে তাঁকে ভূপেন্দ্রনাথের পাল্লায় পড়তে হবে। তিনি এবার হাঁটতে চাইলেন। ভূপেন্দ্রনাথ তাড়াতাড়ি হাত ধরে ফেললেন। কোথায় কোনদিকে আবার চলে যাবেন, ভূপেন্দ্রনাথ হাত ধরে রাখলেন। তিনি এবার সকলকে চলে যেতে বললেন। ভিড় করতে বারণ করে দিলেন। তিনি প্রশ্ন করলেন না কি করে এই মানুষ এত দূরে চলে এসেছেন! বোধ হয় সাঁতার কেটে চলে এসেছেন। কী যে পারেন না এই মানুষ, তা ভাবতে-ভাবতে নিজের ভিতর কেমন বেদনায় আচ্ছন্ন হয়ে গেলেন। দুর্গাঠাকুরের দিকে মুখ তুলে তাকালেন, মা, মাগো, বলার ইচ্ছা। দুর্গাঠাকুরের বড় বড় চোখ দুই ভাইকে দেখতে দেখতে বুঝি হাসছিল। তিনি তাড়াতাড়ি ওখান থেকে সরে পড়তে চাইলেন, কারণ তিনি জানতেন, নাটমন্দিরের দোতলায় জাফরি কাটা অন্দরে এখন শতেক চোখ পর্দার আড়াল থেকে নিশ্চয়ই ওঁকে দেখছে—এমন সুপুরুষ মানুষকে দেখে নিশ্চয়ই ওরা হা-হুতাশ করছে। কি চেহারা তাঁর! গৌরবর্ণ। লম্বা এবং শিশুর মতো সরল। নাবিক যেমন সমুদ্রে পথ হারিয়ে বিষণ্ণতায় ভোগে, এখন এই মানুষের চোখে তেমনি এক বিষণ্ণতা। ভূপেন্দ্রনাথের এসব ভেবে কেন জানি চোখে জল এসে গেল।
.
জোটন সকাল থেকেই মুখ গোমড়া করে বসে আছে। আশমানে চাঁদ দেখছে। নীল আকাশ দেখলেই টের পায় জোটন, শরৎকাল এসে গেছে। এখন দুর্গাপূজার সময়। এই দরগায় বসেও তা টের পাওয়া যায়। দরগা তো নয় য্যান বিশাল বনের ভিতর বনবাসী জোটন। দু’সাল থেকে, কি আরও বেশি হবে—সে বাপের ভিটাতে যেতে পারছে না। ফকিরসাব নিয়ে যাচ্ছে না। শরৎকাল এলেই আকাশে চাঁদ বড় হয়ে দেখা দেয়। সারারাত এই বনের ভিতর জ্যোৎস্না ছড়ায়। আকাশের দিকে তাকালেই মনের ভিতর কেমন করে। প্রতাপ চন্দ্রের বাড়িতে দুগ্গা ঠাকুর, ঠাকুরের মুখ-চোখ এবং নাকে নথ সব সে মনে করতে পারছে। মনে হলেই ভিতরটা কেমন করে। কতবার ফকিরসাবকে বলেছে, দ্যাশে লইয়া যাইবেন? মানুষটা তখন রা করেন না। দিন দিন ফকিরসাবের শরীর ভেঙ্গে আসছে। আর বুঝি সে বাপের ভিটাতে ফিরে যেতে পারবে না। মানুষটার কাছে দরগার এক কোণে ছোট ছইয়ের মতো নিবাসের যেন তুলনা নেই। ছইয়ের ভিতর বসে ফকিরসাব কেবল হুঁকা খান আর কি সব বয়াৎ বলেন, যা জোটন আদৌ বোঝে না। বাংলা করে দিলে জোটন কেবল হাসে।
—ফ্যাক-ফ্যাক কইরা হাসেন ক্যান?
—হাসলাম কই আবার।
—আপনে হাসলেন না?
—ঠিক আছে। হাসি পাইলে আর হাসুম না। বিমর্ষ মুখ নিয়ে সে বসে থাকল।
ফকিরসাব বললেন, মন খারাপ ক্যান?
জোটন উত্তর করছে না।
—কি কথা কন না ক্যান?
—কি কমু কন?
—যা মনে লয়।
—মনে লয় দ্যাশে যাই।
—দ্যাশে গিয়া থাকবেন কই? আপনের ভাইজান ত আবার সাদি করছে। নতুন মানুষ আপনেরে চিনতে পারব?
—চিনতে পারব না ক্যান? গ্যালে ঠিকই চিনতে পারব।
—বড় দূর যে! এতদূর নাও বাইয়া যাইতে পারমু?
—নাও জলে জলে মাঠে পড়লে না হয় আমি লগি ধরমু।
—মাইনসে দ্যাখলে কি কইব? বলেই ফকিরসাব আবার শরীরে অস্বস্তি বোধ করলেন। পেটের ভেতরটা মোচড়াচ্ছে।
শরৎকাল বলে ঝোপ-জঙ্গলে এখন কীট-পতঙ্গ বাড়ছে। শরৎকাল বলে জলে এখন পচা গন্ধ উঠতে থাকবে। কারণ, নদী-নালা, ঝোপ-জঙ্গল থেকে জল নামতে থাকলেই ঘাস শ্যাওলা দাম সব পচে যাবে। দরগার চারপাশে শুধু হোগলার বন। বনের ফাঁকে কোনও পথ নেই এখন।
দরগায় আসতে হলে নৌকা ঠেলে নিয়ে আসতে হয়। দরগার পুবে বড় নদী মেঘনা, মেঘনার পাড়ে-পাড়ে এই বন নিশুতি রাতে নির্জন অরণ্যের মতো চুপচাপ। এমন কি কোনও কীট-পতঙ্গের ডাকও ভয়াবহ লাগে! চারপাশে বড় বড় রসুন গোটার গাছ, অশ্বত্থ গাছ আর নিচে তার হাজার বছর ধরে অঞ্চলের কবরখানা। কোথাও ভাঙা মসজিদ, ভাঙা কুয়ো, বেদি। জীর্ণ অন্ধকূপের মতো সব ছোট-ছোট ইঁটের কোঠা, কোনও কোনওটা মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। আর লতাপাতা, গাছ-গাছালি এত ঘন যে, দু’পা যেতে লতাপাতায় জড়িয়ে যেতে হয়। একটা সরু পায়ে-হাঁটা পথ গ্রীষ্মের দিনে দেখা দেয়। বর্ষাকালে কেউ আর বনের ভিতর ঢুকতে চায় না। জলের কিনারে কবর দিয়ে চলে যায়। মানুষের ইন্তেকালের সময় কিছু মানুষজন চোখে পড়বে, দু’ ক্রোশ পথ হাঁটলে ক’ঘর বসতি আছে। পারতপক্ষে এদিকে কেউ মাড়ায় না। দরগায় এক ফকিরসাব আছেন, দুঃসময়ে শুধু দোয়াভিক্ষার জন্য সাবের কাছে চলে আসে মানুষ। জমিতে দাঁড়িয়ে হাঁক দিলে ফকিরসাব ঝোপ-জঙ্গল ভেঙে নিচে নেমে মালা-তাবিজ যখন যা দরকার প্রয়োজন মতো দিয়ে আসেন। মানুষেরা কেউ বনের ভিতর এক অলৌকিক ভয়ের জন্য ঢুকতে চায় না। পাশে একটা লম্বা খাল আছে। মৃত অজগর সাপের মতো খালটা নিশিদিন শুয়ে থাকে। বর্ষাকাল এলে এই খাল জেগে ওঠে, কিছু উজানি নৌকা পথ সংক্ষিপ্ত করার জন্য এই খালে উঠে আসে। খাল দিয়ে যায় আল্লা অথবা ঈশ্বরের নাম নিতে নিতে। কোনওরকমে এই কবরখানা ভয়ে ভয়ে পার হয়ে যায়।
মানুষ মরলে ফকিরসাবের পরবের মতো উৎসব। ফকিরসাব তখন দু’গণ্ডা মতো পয়সা পান। পান খান। আর মালা-তাবিজ গলায় ঝুলিয়ে আল্লা এক রহমানে রহিম বলতে-বলতে সেই মৃত মানুষটার চারপাশে ঘুরতে থাকেন। কখনও বনের ভিতর লুকিয়ে নানা রকমের খেলা খেলতে ভালোবাসেন অর্থাৎ কবরখানায় মৃত মানুষ এলেই ফকিরসাবের কেরামতি বেড়ে যায়। কালো আলখাল্লাতে পা পর্যন্ত ঢেকে, গলায় লাল নীল হলুদরঙের রসুন গোটার মতো বড় বড় পাথর ঝুলিয়ে, চোখে কালো সূর্যা টেনে এবং মাথায় ফেটি বেঁধে মনে হয় তখন এক পীর এসে গেছেন। সাদা কোঁকড়ানো চুল তাঁর। ঊর্ধ্বমুখী বাহু তাঁর। চাপ দাড়িতে রসুন গোটার তেল চপ চপ করছে। যারা কবর দিতে এল তারা দেখতে পায় এক মুশকিলাসানের লম্ফ হাতে নিয়ে বনের ভিতর কে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। লোকগুলি ভয়ে কাঠ হয়ে যায়। বনের ভিতর থেকে মুশকিলাসানের লম্ফ নিয়ে সহসা উদয়। মনে হবে তখন তিনি যেন মাটি ফুঁড়ে উঠে এসেছেন। তারপর যার যা খুশি—দু’গণ্ডা পয়সা এবং যার ইন্তেকাল হল তার কিছু জিনিসপত্র মিলে গেলে এই মানুষের অন্নসংস্থান। জোটন তখন ছইয়ের ভিতর বসে মানুষটার এই কেরামতি দেখে ফিকফিক করে হাসে। দিনেরবেলাতেও কালো আলখাল্লার নানা জায়গায় তালি মারতে মারতে জোটন মানুষটার নাচন কোদন দেখে। তখন দেখলে কে বলবে এই মানুষ নিরীহ জীব, কে বলবে অকপট সরল মানুষ, প্রকৃতপক্ষে ভীতু লোক। অথচ অন্নসংস্থানের জন্য কবরে মানুষ এলেই এই মানুষ অন্য মানুষ হয়ে যান। পীর বনে যাবার লোভে মানুষটা সকলের চোখে ভিন্ন ভিন্ন অলৌকিক ক্রিয়া-প্রক্রিয়া দেখাতে ভালোবাসেন। এই অলৌকিক ক্রিয়া-প্রক্রিয়ার জন্য ফকিরসাব দিন-রাত উপায় উদ্ভাবন করেন। আর ইন্তেকালের সময় মানুষের চোখে নিজের খেলা দেখান। রাতে বেল-গাছের মাথায় আগুন জ্বালিয়ে বসে থাকেন।
সুতরাং কোথায় যে দুর্গোৎসবের জন্য জোটনের প্রাণে দুঃখ জেগে থাকে, বোঝার উপায় থাকে না ফকিরসাবের। সম্বৎসর এই দরগায় ছইয়ের ভিতর তিনি শুয়ে থাকেন। সময়ে অসময়ে তিনি রসুন গোটা কোঁচড়ে সংগ্রহ করে আনেন। মাচানের নিচে স্তূপীকৃত রসুন গোটা। বড় বড় পিপের মতো হাঁড়িতে সব ভিজানো থাকে। ছেঁচা রসুন গোটা জলে পচলে একরকমের ঘন তেল, সেই তেলে ছইয়ের ভিতর তার আলো জ্বলে, মুশকিলাসানের লম্ফ জ্বলে এবং কিছু তেল পাতিলে পাতিলে গাছের মাথায় বসিয়ে রাখেন। সময়ে অসময়ে ইন্তেকালের সময় যারা আসে, তাদের অলৌকিক কিছু দেখাবার জন গাছের মাথায় আগুন জ্বেলে বসে থাকেন। আরও কি সব কাণ্ড তাঁর। দরগায় নতুন তখন। তাঁর কী যে তখন হাসি পেত। একটা হাড় রেখেছেন। কিছু জড়িবুটি রেখেছেন। মাঠে দাঁড়িয়ে মানুষ হাঁক পাড়লে — হেই কে আছে, আমি এক নাচারি ব্যারামি মানুষ, তখনই ফকিরসাব যেন অন্য মানুষ হয়ে যান। পীর হবার জন্য তিনি তাঁর সেই মুখস্থ বয়াৎ বলতে বলতে জড়িবুটি নিয়ে মাঠে নেমে যান। পয়সা চাই সোয়া পাঁচ আনা। দরগার থানে শিন্নি দেবার জন্য এই পয়সা। সেই ফকিরসাব কী করে বুঝবেন, জোটন, যার নিবাস ছিল হিন্দু পল্লীর পাশে, পরবে পার্বণে চিড়া কুটে দিত, ধান ভেনে দিত, কেন সে ব্যাজার মুখে কাঠ কুড়াতে বনের ভিতর ঢুকে যাচ্ছে।
সূর্য উঠবে উঠবে করছে। গাছপালা এত ঘন যে, সূর্য উঠলেও দেখা যায় না। সূর্যের আলো গাছের ডালপালায় পড়ছে। বড় সন্নিবিষ্ট এই গাছপালা বৃক্ষ। জোটন দু’হাতে বন-ঝোপ লতা-পাতা সরিয়ে ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে। সে অনেকগুলি কবর পার হয়ে খালের পাড়ে নেমে এল। তারপরই সব হোগলার বন। এখন আশ্বিন-কার্তিক মাস বলে জলের কচ্ছপ পাড়ে উঠে আসবে। ডিম পাড়বে। এ-অঞ্চলে গ্রাম মাঠ নেই, ধানের খেত নেই, হিন্দু পল্লী নেই যে জমিতে নেমে শামুকের খোলে কট করে ধানের ছড়া কাটবে, ডিম নিয়ে ঠাকুরবাড়ি উঠে যাবে। ডিমের বদলে পানগুয়া চেয়ে নেবে। এখানে শুধু এই নির্জনে গাছপালা বৃক্ষ। জোটনের জোরে জোরে ফকিরসাবকে শুনিয়ে কাঁদতে ইচ্ছা হচ্ছিল। ফকিরসাব আর নৌকা বাইতে পারেন না। ফকিরসাব ক্রমে লবেজান হয়ে যাচ্ছেন। ফকিরসাব একটা কোড়া পাখি ধরার জন্য বিলের জলে আঁতর পেতে রেখেছিলেন। কোড়া পাখির কলিজা খেলে গায়ে বল ফিরে আসতে পারে। ফিরে এলেই জোটন বাপের ভিটাতে বেড়াতে যাবে ভাবতেই মনটা প্রসন্ন হয়ে উঠল। আর মন প্রসন্ন হতেই দেখল, দুটো সাদা পা যেন। হোগলার জঙ্গলে দুটো সাদা পা, কী সুন্দর আর যেন দুর্গাঠাকুরের পা। ওর বুকটা কেঁপে উঠল। পায়ের ওপর সূর্যের আলো চিকচিক করছে। একটা ফড়িং কোত্থেকে উড়ে এসে বার বার পায়ের ওপর বসছে। উপরে গাছপাতা নড়লে ছায়া পড়ছে পায়ে। ফড়িংটা ভয় পেয়ে তখন উড়ে যাচ্ছে। এই রোদ এবং পাতার ছায়াতে মনে হচ্ছিল, পায়ে মল বাজলে যেমন শব্দ দ্রুত বনের ভিতর হারিয়ে যায়, তেমনি এক শব্দ বুকের ভিতর বাজতে বাজতে কোন্ অতলে ডুবে যাচ্ছে জোটন। জোটন দেখল পা-দুটো এখন যথার্থই দুর্গাঠাকুরের হয়ে গেছে। সেই যেন গৌরী, শিবের জন্য বনবাসে এসে হোগলা বনে লুকিয়ে আছে। অথবা চৈত্র মাসে নীলের উপোসে গৌরী নাচে, নাচের মুদ্রা পায়ে যেন খেলে বেড়াচ্ছিল। জোটন বড় বড় চোখে এসব দেখছে, এখন কী করবে স্থির করতে পারছে না। সে সামনে এগিয়ে যেতে সাহস পাচ্ছে না। এক যুবতী কন্যার পা দেখা যাচ্ছে। শুধু পা-দুটো বাকি শরীর হোগলার জঙ্গলে। খুনটুন হবে হয়তো। কিন্তু এই দরগায়, পীরের থানে কার সাহস আছে খুন করে। জোটন কাঁপতে কাঁপতে দু’হাতে হোগলার বন ফাঁক করে দিতেই দেখল, নদীর জলে প্রতিমা বিসর্জন দিলে, দশ-হাত দুগ্গাঠাকুর যেমন চিৎ হয়ে থাকে, তেমনি মালতী হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে আছে। যেন অসুরনাশিনী মা জননী, তুই, অ-মালতী, তুই চিৎপাত হইয়া পইড়া আছস! চুল খাড়া কইরা চোখ ঊর্ধ্বমুখী কইরা পইড়া আছস! তরে নিয়া আইছে কে! সে প্রায় মায়ের মতো শিয়রে বসে মাথাটা কোলে তুলে নিল। বুকে মুখে এবং শরীরের যেখানে যা-কিছু পুষ্ট সব হাতড়ে দেখল, না প্রাণ আছে। শুধু হুঁশ নেই। নাভির নিচটা কারা সারারাত খাবলে খুবলে খেয়ে গেছে। মৃতপ্রায় ভেবে মালতীকে কারা ফেলে চলে গেছে। শরীরের কোথাও কোথাও দাঁতের চিহ্ন। রক্তের দাগ, সে আর দাঁড়াল না। যেন এক অশ্ব ছুটে যায়, বনের ভিতর দিয়ে জোটন ছুটতে থাকল। আর ডাকতে থাকল, ফকিরসাব, অ ফকিরসাব, দ্যাখেন আইসা পীরের থানে কি হইছে। তাড়াতাড়ি করেন ফকিরসাব। হোগলা বনে কারা দুগ্গাঠাকুর বিসর্জন দিয়া গ্যাছে। যেমন দু’লাফে সে ছুটে এসেছিল ফকিরসাবকে খবর দিতে, তেমনি দু’লাফে সে তার ছইয়ের ভিতর থেকে একটা ডুরে শাড়ি বের করে বলল, আপনে আমার পিছনে আসেন।
জোটন একটু দূরে দাঁড়িয়ে, ফকিরসাবকে বলল, কী দ্যাখা যায়?
—দুই পা দ্যাখা যায়।
—কার পায়ের মতো?
—দুগ্গাঠাকুরের পা য্যান!
—তাহলে আপনে খাড়ন। লে জোটন নিজে প্রথম হোগলার জঙ্গলে ঢুকে শাড়িটা দিয়ে মালতীকে ঢেকে দিল। তারপর বন ফাঁক করে ইশারায় ডাকল, আপনে মাথার দিকটা ধরেন। আমি পা ধরি।
এমন জবরদস্ত লাশ টানতে উভয়ের বড় কষ্ট হচ্ছিল। ওরা একটু গিয়েই গাছের ছায়ায় ঘাসের উপর শুইয়ে রাখছে। আবার টেনে নিয়ে যাচ্ছে। ফকিরসাব বললেন, বিবি, আপনের দুগ্গাঠাকুর দরগাতে আইসা গেল। দ্যাশে গিয়া আর কাম কি!
জোটন হাঁপাচ্ছিল। সে উত্তর দিতে পারল না। ওর হাত এখন রক্তে অথবা পিচ্ছিল এক পদার্থে চ্যাট চ্যাট করছে। পাতা দিয়ে ঘাস দিয়ে সে সব মুছে আবার টেনে নেবার জন্য তুলে ধরছে। মাঝে মাঝে মালতীর শাড়ি লতায়-পাতায় আটকে সরে যাচ্ছে। এমন পুষ্ট শরীর যে সামান্য বাতাস লাগতেই শাড়ি পিছলে পড়ে যায়। জোটন ফকিরসাবের দিকে তাকাল। বলল, না না, এইটা ভাল না, আপনার চোখ গাছপালার দিকে দ্যান! এদিকে না।
ফকিরসাব বলল, আমি ফকির মানুষ আমার চোখে দোষের কিছু থাকে না।
জোটন বলল, আপনে পুরুষমানুষ। চক্ষু আপনের এখন গাছপালা পাখি দ্যাখুক।
—আপনের যখন তাই ইচ্ছা…বলে ফকিরসাব চোখ বুজে থাকলে জোটন বলল, কি কইলাম আপনে কি করলেন!
—কি কইলেন?
—গাছপালা পাখি দ্যাখতে কইলাম।
—তাই দ্যাখতাছি।
—চোখ বুইজা বুঝি দ্যাখা যায়?
—খুইলা রাখলে যা দ্যাখি, বুইজা রাখলে বেশি দ্যাখি।
—তা’হলে খুইলা রাখেন।
এবার জোটন ডেকে উঠল, মালতী অ মালতী, দ্যাখ কই আইছস। আল্লার বান্দার কাছে আইছস। চোখ মেইলা তাকা একবার। মালতী, মালতী! হুঁশ নেই। সুতরাং জোটন তাড়াতাড়ি কিছু জল এনে চোখমুখে ছিটিয়ে দিল। হুঁশ কিছুতেই ফিরছে না। এখানে রোদ নেই, গাছপালা এত নিবিড় যে সামান্য শিশির পর্যন্ত ঘাসের উপর পড়তে পারে না। আর একটু যেতে পারলেই ওদের ছই। মাচানে ফেলে পিঠে পায়ে কোমরে গরম জলের সেঁক দিতে পারলে শরীরের ব্যথা মরে আসবে। তারপর সেই বিশল্যকরণীর মতো ফুলের রস মিশিয়ে মালতীর যেখানে যা-কিছু ক্ষত আছে এবং যেখানে যা-কিছু রক্তপাত ধুয়েমুছে রসুনগোটার তেলে ফুলের রস লাগাতে পারলে মালতী ফের চোখ মেলে তাকাবে।
ফকিরসাবের কিন্তু কিছুতেই এতটুকু ব্যস্তভাব নেই। হচ্ছে হবে ভাব। কেমন নিরিবিলি এই কবরখানায় দুর্গাঠাকুর আইসা গেল ভাব। সাতে নাই পাঁচে নাই, ফকিরসাবের তাড়াহুড়ো নাই। তিনি মালতীকে মাচানে ফেলে রেখে হুঁকোটা খুঁজতে থাকলেন।
—এখন আপনের হুঁকা খাওয়নের সময়!
—পানিটা গরম করেন ইত্যবসরে হুঁকা খাই। হুঁকা খাইলে মাথাটা সাফ থাকে।
হুঁকা খাইলে মাথাটা সাফ থাকে এটা ফকিরসাবের কথার কথা। মনের কথা নয়। হয়তো এমনই মানুষটা। শত বিপদেও মানুষটার মাথা গরম হয় না। বেশ রয়ে-বসে বুঝেসুঝে হাঁকল, কৈ গ, পানি আপনের গরম হইল?
তৈজসপত্র বলতে জোটনের চারটা পাতিল, একটা পিতলের বদনা এবং সামান্য এক ভাঙা আশি। চারটে জালা আছে রসুন গোটা ভেজানোর জন্য। নাহলে তাড়াতাড়ি এক জালা পানি এনে দিতে পারত ফকিরসাবকে। বদনা করে পানি আনছে জোটন। বর্ষার পানি বেশি দূরে নয়। ছইয়ের নিচে জল। উনুনে জল গরম হলে জোটন বলল, এদিকে আর আইসেন না।
—ক্যান? ফকিরসাব হুঁকা খেতে খেতে বলল।
—ক্যান আবার খুইলা কইতে হইব!
—দুগ্গাঠাকুরকে আপনে তবে খালি কইরা একলাই দ্যাখবেন?
জোটন কান দিল না। মানুষটার এই স্বভাব। সব জানবে, বুঝবে এবং এত বড় ইমানদার মানুষ, তবু মানুষটা ক্যান, কি হইব দ্যাখলে—আমি ত ফকির মানুষ, আমার কাছে সব সমান এমন বলবে।
জোটন সমস্ত শরীর ভালো করে গরম জলে ধুইয়ে দিল। জোটন সব ধুয়েমুছে মালতীকে আবার সেই বিধবা মালতী করে দিতে চাইল। সংসারে সব চাইলেই হয় না! কেন জানি বার বার মালতীর জন্য সুন্দর এক যুবা পুরুষের মুখ মনে পড়ছিল জোটনের। কবে থেকে মালতীর শরীর খোদার মাশুল তুলছে না—বড় কষ্ট এই শরীরের। ঈষদুষ্ণ জলে গা ধোয়াবার সময় জোটন মনে মনে নানারকমের কথা বলছিল। কি পুষ্ট শরীর! জোটন হাত দিয়ে মালতীর কোমর থাবড়ে দিচ্ছে। উপুড় করে মালতীর কোমরে জল ঢেলে দিচ্ছে। ডানদিকে বসে ধীরে ধীরে জল উপর থেকে ঢেলে থাবড়ে থাবড়ে মাজাতে যে সারারাত অমানুষের হাড়হালুম গেছে তা ঝেড়ে দিচ্ছে জোটন।
এ-ভাবে মনে হল মালতীর, কারা যেন তাকে একটা বড় জলাশয়ে ভাসিয়ে রেখেছে। শরীরে কে কি যেন মেখে দিচ্ছে। মনে হচ্ছিল, নরম হাত, ভালোবাসার হাত—কিন্তু তাকাতে সাহস পাচ্ছে না। যেন তাকালেই সেইসব নরপিশাচের মুখ ভেসে উঠবে। সে তবু পালাবার জন্য ধড়ফড় করে উঠে বসলে জোটন চিৎকার করে উঠল, ফকিরসাব আসেন। দ্যাখেন আইসা, মালতীর হুঁশ ফিরা আইছে।
মালতী চোখ খুলে দেখল জুটি ওকে ধরে বসে আছে। কি বলতে গিয়ে চোখমুখ কাতর দেখাল মালতীর। সে বলতে পারল না। সে মাচানে যেন কতকাল পর দীর্ঘ এক মরুভূমি পার হয়ে এক মরূদ্যানে উঠে এসেছে। মালতী ফের সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ল।
জোটন এবার ফকিরসাবকে বলল, প্যাটটা পইড়া আছে।
—কি দিবেন খাইতে?
—ইট্টু দুধ নিয়া আসেন। গরম কইরা দেই! যদি খায়।
ফকিরসাব দেরি করলেন না। হুঁকা খাবার পর নানারকমের প্রশ্ন এসে দেখা দিয়েছে। প্রথমত এই যুবতীকে কারা ফেলে দিয়ে গেল! কখন এবং ওরা কতজন ছিল। নানারকমের সন্দেহ দেখা দিতে থাকল। মালতী তার ঘরে ফিরে যাবে কিনা, থানা-পুলিস এবং অনেক ঝামেলা এর পিছনে রয়েছে। তিনি ফকির মানুষ। এখানে কতদিন আছেন। এমন ঘটনা এখানে কোনওদিন ঘটেনি। তবে একবার এক সাধু এসেছিল, ভৈরবী সঙ্গে ছিল। এই দরগায় ক’রাত ওস্তাদের ভোজ খেয়ে বেশ যখন সরগরম, তখন সেই ভৈরবী তিলকচাঁদের সঙ্গে ভিড়ে গেল। ছিল ভৈরবী, হয়ে গেল পদ্মদীঘির ছোটবাবুর বহুরানী। তারপর সাধুবাবাজী বড় একটা রসুনগোটার মগডালে উঠে গলা দিল। ছোটবাবু মাথার উপর ছিলেন বলে সে-যাত্রা ফকিরসাব থানা-পুলিশের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন—কিন্তু এখন, এবারে! ফকিরসাব ঘাবড়ে গেলেন। তবু তিনি মুখ ফুটে কিছু বললেন না। জল ভেঙে বাগের ওপাশে ওঁর দুই ছাগলের দুধ দুয়ে আনার জন্য নেমে গেলেন। জল ভেঙে ওপাড়ে গিয়ে উঠলেন।
জোটন মালতীর মাথা কোলে নিয়ে বসে থাকল। বনের ভিতর ডাহুক পাখি ডাকছে। নিচে সেই জল এবং শরবন। যতদূর চোখ যায় সে দেখল বাতাসে শরবন কাঁপছে। শরৎকালের রোদ পাখ-পাখালির মতো উড়ে এসে দরগায় এখন নেচে খেলে বেড়াচ্ছে। সামান্য হাওয়া ছিল জলে। কতরকমের লাল নীল ফড়িং উড়ছে। কতরকমের বিচিত্র কীট-পতঙ্গের শব্দ কানে আসছে আর কতকাল আগে ইন্তেকাল হয়েছিল তার বড় সন্তানের—এই কবর ভূমিতেই এখন সে সন্তান পাথর হয়ে আছে। যেন মাটি খুঁড়লেই সেই সন্তান বের হয়ে আসবে। জোটন সব ভুলে মালতীকে মায়ের স্নেহে চোখেমুখে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। চুলে বিলি কেটে দিতে থাকল। সন্তানস্নেহে জোটনের চোখ ফেটে জল আসছিল।