মালতীর দিনগুলি মন্দ কাটছিল না। রঞ্জিত আসার পরই মালতীর মনে হল ওর কী যেন হারিয়ে গিয়েছিল জীবন থেকে, কী যেন নেই, সংসারে কী না থাকলে ফাঁকা ফাঁকা মনে হয় এমন এক জিনিস রঞ্জিত ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে মালতীর জীবনে ফিরে এসেছে।

শীতকাল বলে বেলা তাড়াতাড়ি পড়ে যায়। শীতকাল বলে জলে বাঁশ পচা গন্ধটা তেমন তীক্ষ্ণ মনে হচ্ছে না। আর শীতকাল বলেই গ্রামের সকলে সকাল সকাল জল নিতে চলে আসে কুয়োতে।

চাকের কুয়ো লম্বা। গলা পর্যন্ত দাঁড়ালে দেখা যায়। কুয়োতলা পার হলে বাঁশঝাড়। ঈশম শক্ত বাঁশ খুঁজছে। রঞ্জিত একটা করে কোপ মেরে আলগা করে দিচ্ছে আর ঈশম সেই বাঁশ টেনে বের করে কঞ্চিগুলি ছেঁটে দিচ্ছিল। যারা জল নিতে এসেছিল ওরা বেশিক্ষণ কুয়োতলায় অপেক্ষা করল না। বড়বৌর সেই নিখোঁজ ভাইটি ফিরে এসেছে। সরু গোঁফ, বড় চোখ আর বিদেশ বিভুঁয়ে থাকে বলেই হয়তো শরীরে এক ধরনের শ্যামল লাবণ্য। মালকোঁচা মেরে ধুতি পরেছে, চুল কোঁকড়ানো, মাথার মাঝখানে সিঁথি—লম্বা মানুষ রঞ্জিতকে এখন আর দেখলে চেনাই যায় না, বাপ-মা মরা সেই বালক এত বড় হয়ে এখন মশাই হয়ে গেছে।

যারাই জল নিতে এসেছিল তারা সকলেই প্রায় বালতি ফেলছে কুয়োর ভিতর এবং জল তুলে আনার সময় রঞ্জিতকে দেখছে। সুদর্শন এই যুবকটিকে সকলেই একনজরে চিনতে পেরেছিল, কতদিন আগের কথা যেন, কেউ কেউ ডেকে ওর সঙ্গে কথা বলল, যাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল, সে যাদের দিদি বলে ডাকত, পাড়াপড়শী যারা এক সময় ওকে স্নেহ-ভালোবাসা দিয়েছিল, মা-মরা ছেলে বলে যারা ওকে সামান্য ভালোমন্দ হলে ডেকে খাওয়াত তারা জল তুলে নিচে নেমে গেল এবং ওর সঙ্গে কথা বলে ঘরে ফিরে গেল।

মালতী এল সকলের শেষে। ওর কাঁখে কলসী, পরনে তাঁতের শাড়ী। মালতী যে বিধবা, এ-শাড়ি পরলে মনে হয় না। মনে হয় কুমারী মালতী শখ করে এখন জল তুলতে এসেছে। মনে হয় মালতী এই মানুষের সামনে সাদা থান পরতে লজ্জা পায়। সে এসেই সোজা কুয়োতলায় কলসী রেখে যেখানে রঞ্জিত বাঁশ কাটছিল সেখানে গিয়ে দাঁড়াল—এত বাঁশ! এত বাঁশ দিয়া কি হইব?

রঞ্জিত বলল, জলে ভিজিয়ে রাখব। লাঠি হবে, পাকা বাঁশের লাঠি।

সোনা আশেপাশে ছোটাছুটি করছে। সে এই নতুন মানুষটিকে কখনও ছাড়ছে না। মানুষটি তাকে কত দেশ-বিদেশের সব অদ্ভুত গল্প বলছে। অদ্ভুত সব ম্যাজিকের কথা বলছে।

সোনা বলল, পিসি, রঞ্জিত মামা রাইতের ব্যালা ম্যাজিক দেখায়।

মালতী আর একটু নেমে গেল। যেখানে ঈশম বাঁশের গুঁড়িতে দা রেখে কাটা বাঁশ ঝাড় থেকে টেনে নামাচ্ছে সেখানে গিয়ে দাঁড়াল এবং বলল, তর মামার কথা আর কইস না!

রঞ্জিত মালতীর দিকে তাকাল না। সে বাঁশের কঞ্চি কেটে সাফ করছে কারণ মালতীর কোনও রহস্যজনক কথা শুনলেই শুধু সেই দৃশ্যটা মনে পড়ে। সেদিন মালতী রাগে অথবা ক্ষোভে কিংবা হয়তো উত্তেজনায় কেঁপে কেঁপে উঠেছিল। চোখ মুখ লাল, চোখ ভিজা ভিজা, যেন মালতীর সব সতীত্ব রঞ্জিত কেড়ে নিয়েছে। প্রায় মালতী কেঁদে ফেলেছিল। রঞ্জিতের সেই কথা মনে হয় আর মনে হয়—মালতী তোমার সেই দৃশ্যটা মনে পড়ে না। মালতী তুমি দিদিকে আর কিছু বলনি তো!

রঞ্জিত এবার মালতীর দিকে সহজভাবে তাকাল। বলল, মামার কথা বলতে নেই কেন?

রঞ্জিত এমনভাবে তাকাল, যেন মালতীরও সেই দৃশ্যটা মনে পড়ুক এমন এক ইচ্ছা। সুতরাং মালতী আর দেরি করল না। সে জল ভরে চলে গেল। চলে গেলেই শেষ হয়ে যায় না। যেতে যেতে বড়বৌদির সঙ্গে গল্প করল। বড়বৌ এবং ধনবৌ ঢেঁকিতে ঠাকুর-ভোগের জন্য ধান ভানছে। ভানা ধান ঢেঁকির মাথার কাছে বসে শশীবালা ঝাড়ছিলেন। পাগল ঠাকুর আজ কোনওদিকে বের হয়ে যাননি। তিনি উঠোনে আপন মনে পায়চারি করছেন। মালতী উঠোনে এসেও বাঁশের কোপ শুনতে পেল। এই বাঁশ দিয়ে কী হবে, বাঁশ দিয়ে লাঠি হবে! তার তোড়জোড় হচ্ছে। মানুষটার শরীর হাত পা মুখ, সারাক্ষণ কেন জানি বুকের ভিতর নড়েচড়ে বেড়ায়। এমন মানুষটাকে দেখার জন্য ছলছুতো করে কেবল এ-বাড়িতে চলে আসা। কী আর কাজ মালতীর, নরেন দাস এখন আর বাড়িতে নেই। অমূল্য মাথায় ডুরে শাড়ি নিয়ে বাবুর হাটে গেছে নরেন দাসের সঙ্গে। এখন বাড়িতে শুধু শোভা, আবু, মালতী। আভারানী আছে, কিন্তু এত নিরীহ যে মনেই হয় না একটা মানুষ বাড়িতে আছে। আভারানীকে রঞ্জিত বৌদি বলে ডাকে। রাতের বেলায়, যখন শীত বলে সকলে তাড়াতড়ি শুয়ে পড়ে, যখন বৈঠকখানায় শচীন্দ্রনাথ লালটু পলটুকে পড়াতে বসেন তখন রঞ্জিত নিজের ঘরে বসে সামান্য আলোতে কি সব বড় বড় বই পড়ে। কত পড়ে মানুষটা! মানুষটা এখন কম কথা বলে, বেশি কথা বললে মালতীর দিকে তাকিয়ে একটু হাসে, যেন অজ্ঞ লোকের কথা শুনে হাসছে। তখন অভিমানে মুখটা লাল হয়ে ওঠে মালতীর। মানুষটা তখন অপরাধীর মতো চোখ করে তাকায়। তাকালেই কিছু দৃশ্য, ভয়ে মানুষটা নিরুদ্দেশে চলে গেল।

মালতী একদিন বলেছিল, এত ডর পুরুষ মাইনসের ভালো না।

—আমার আবার ডর কিসের?

—ডর না! মুখে কইলেই কি সব কওয়ন যায়!

—আমার কিন্তু মনে হয়েছিল তুমি দিদিকে সত্যি বলে দেবে।

—আর কিছু মনে হয় নাই ত!

—আবার কি মনে হবে!

—ক্যান, মালতীর নামে কত কথা মনে হইতে পারে।

—আমার আর কিছু মনে হয়নি মালতী। আমি তারপর অনেক দূরে চলে গেছলাম। আসাম চলে যাই। সেখান থেকে ফিরে আসি দু’বছর পর। কলকাতায় লাহিড়ীমশাইয়ের সঙ্গে দেখা। তিনিই আমাকে প্রায় টেনে তুলেছেন। বলতে বলতে থেমে যেত রঞ্জিত। স্বপ্ন দেখতে শিখে গেলাম। এ-সব এখন খুব তুচ্ছ মনে হয়। বোধ হয় বেশি বলা হয়ে গেল। তার গোপন জীবনের কথা বুঝি ফাঁস হয়ে গেল। সে সহসা থেমে আর কিছু বলতে চাইত না। নিজের কথা ভুলে গিয়ে বলত, তুমি কেমন আছ। তোমার সব খবরই আমি রাখতাম। তুমি যে এখানে চলে এসেছ তাও। কিন্তু তারপর?

—তারপর আবার কি! যেন বলার ইচ্ছা, তারপর খা আছে সে তো দেখতেই পাচ্ছ। এই নিয়ে আছি।

—সামুকে আর দেখি না কেন?

—সামু ঢাকা গ্যাছে। লীগ লীগ কইরা দ্যাশটারে জ্বালাইয়া দিল।

—সামু তবে পার্টি করে!

—পার্টি না ছাই। মালতীকে খুব হিংস্র দেখাচ্ছিল। মালতী বলল, লাঠি ত বানাইতেছ মেলা। কিন্তু লাঠিতে মাথা ভাঙতে পার কয়টা?

—লাঠি তো মালতী মাথা ভাঙার জন্য নয়, মাথা রক্ষা করার জন্য। আমি ভেবেছি, এখানেই মূল আখড়া করব। তারপর আরও তিনটে ছোট ছোট আখড়া খুলব। একটা বামন্দিতে, একটা সম্মান্দিতে আর একটা বারদীতে। তারপর সেখানে থেকে যারা শিখে ফেলবে তারা আবার তিনটে করে নতুন আখাড়া খুলবে। গ্রামে গ্রামে আখড়া খুলে আমাদের প্রত্যেককে লাঠি খেলা, ছোরা খেলা সব শিখে নিতে হবে। নিজের মাথা রক্ষা করার জন্য এসব করছি। অন্যের মাথা ভাঙার জন্য নয়।

মালতী কেমন লজ্জা পেল বলে। তারপর বলল, তুমি আমারে দুই চারটে কৌশল শিখাইয়া দ্যাও। আমারে লাঠি খেলা শিখাইলে তোমার আবার জাত যাইব না ত?

—জাত যাবে কেন?

—আমি মেয়েমানুষ। অবলা জীব।

—অবলা জীবদেরই বেশি শিখতে হবে। আরম্ভ হোক, সব গোছগাছ করে নি। খেলা জমে উঠুক।

—খেলা শিখাইবে কে?

—আমি।

—তুমি আবার এইসব শিখলা কবে?

—এক ফাঁকে শিখে ফেলেছি।

—তুমি কত না কিছু জান! কত কিছু না করতে পার!

—আমি কিছুই করতে পারিনি মালতী। কত কিছু করার আছে আমাদের। তুমি সব জানলে অবাক হয়ে যাবে।

—আমারে দলে নাও না।

—দল পেলে কোনখানে?

—এই যে তুমি লাঠিখেলার দল করতাছ।

দল কথাটা বলতেই রঞ্জিত কেমন সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল। দল বলা উচিত নয়। কারণ সে এখানে গোপনে কিছুদিন বসবাস করতে এসেছে। সে বলল, না, কোন দল করছি না মালতী। আমার দল করার কি আছে।

—ক্যান, বৌদি যে কইল তুমি দ্যাশের কাজ কইরা বেড়াও।

—তা হলে দিদি তোমাকে সব বলেছে। বলে সামান্য সময় চুপ করে থাকল রঞ্জিত। সকালবেলার রোদ ওদের পিঠে পড়ছিল। ওরা দীনবন্ধুর বড় ঘরটার পিছনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। লালটু পলটু সোনা সকলেই ওকে ঘিরে আছে। ওরা মালতী পিসিকে দেখছে। মামা, মালতী পিসির মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলছে, মালতী পিসি মাটির দিকে তাকিয়ে কথা বলছে।

মালতী কিছু বলতে যাচ্ছিল। দেখল এইসব ছোট ছোট ছেলেদের সামনে বলা ঠিক না। মালতী আর কথা না বলে চলে গেল।

খুব গোপনে কাজ করছিল রঞ্জিত। সে লাঠি খেলা ভিতর বাড়ির উঠোনে, জ্যোৎস্নায় অথবা মৃদু হারিকেনের আলোতে শেখাবার চেষ্টা করছে। যেন কেউ না জানে। কেবল বড়বৌ, ধনবৌ পাগলা ঠাকুর সাক্ষী থাকত। সোনা, লালটু, পলটু ঘুমিয়ে পড়লে উঠোনে লাঠি খেলা আরম্ভ হতো। কিন্তু একদিন রাতে সোনা পাশে খুঁজতে গিয়ে দেখল মা নেই। মা কোথায়! সে ঘুম থেকে উঠে বসল। দরজা খোলা। উঠোনে লাঠির ঠকাঠক শব্দ পাচ্ছে। জ্যোৎস্না রাত। আবছা আলোতে সে বুঝতে পারল, মা উঠোনের এক কোনায় দাঁড়িয়ে আছেন। সে নেমে দরজা পার হয়ে মায়ের কাছে চলে গেল। আট দশজন গ্রামের জোয়ান লোক রঞ্জিত মামার কাছে লাঠি খেলা শিখছে। অন্য পাশে কারা যেন—বুঝি মালতী পিসি, বুঝি কিরণী দিদি এবং ননী, শোভা, আবু। ওরা কাঠের ছোরা নিয়ে খেলছিল, খেলা শিখছিল। মা এবং জেঠিমা পাশে দাঁড়িয়ে খেলা দেখছিল আর বোধহয় পাহারা দিচ্ছিল। এদিকে কেউ আসছে কিনা লক্ষ রাখছে। লাঠির ঠকাঠক শব্দ উঠছে। শির, বহেরা কটি এমন সব শব্দ। ছোট মামা কেমন মন্ত্রের মতো তালে তালে বলে যাচ্ছেন। মাঝে মাঝে ছোট মামা লাঠি ঘুরাতে ঘুরাতে এত বেগে এদিকে ধেয়ে আসছেন যে টের পাওয়া যাচ্ছে না ছোট মামার হাতে লাঠি আছে, কেবল বনবন শব্দ। তিনি ঘুরে ঘুরে, কখনও ডান পা তুলে, কখনও বাঁ পা তুলে, যেন মানুষটা এই লাঠির ভিতর বেঁচে থাকার রহস্য খুঁজে পেয়েছে, মানুষটা লাঠিটাকে নিজের ডান হাত বাঁ হাত করে ফেলছে, যেমন খুশি লাঠি চালাচ্ছে। সোনা মাঝে মাঝে লাঠির ভিতর ছোট মামার মুখটা হারিয়ে যাচ্ছে দেখতে পেল।

সোনাও খুব উত্তেজনা বোধ করছিল ভিতরে ভিতরে। সামান্য কাকজ্যোৎস্না। কামরাঙা গাছের ওপাশে তেমনি বিস্তৃত মাঠ নিঃসঙ্গ জ্যোৎস্নায় শুয়ে আছে। পাগল জ্যাঠামশাই দাওয়ায় বসে হাত কচলাচ্ছেন আর মাঝে মাঝে ক্ষেপে গিয়ে সেই এক উচ্চারণ। সংসারে যেন আপদ লেগেই আছে। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না। ছোট মামা মাঝে মাঝে ছুটে যাচ্ছিলেন মালতী পিসির দিকে। মালতী পিসি কাঠের ছোরা নামাতে গিয়ে কোথায় ভুল করছে শুধরে দিচ্ছেন। দাওয়ার পাশে সব বড় বড় লাঠি দাঁড় করানো। তেল মাখানো বলে লাঠিগুলি এই সামান্য জ্যোৎস্নায়ও চকচক করছে। কেউ লাঠি ঘুরাতে ঘুরাতে পরিশ্রান্ত হলে, লাঠিটা দাওয়ার পাশে রেখে উঠোনের উপর দু’পা ছড়িয়ে বসে যাচ্ছে। ছোট মামা হাতকাটা গেঞ্জি গায়ে অনবরত দৃষ্টি রাখছেন সকলের উপর। সোনা আর কাফিলা গাছের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। সে ছুটে মায়ের পাশে গিয়ে দাঁড়াল।

ধনবৌ বলল, তুমি সোনা!

—আমার ভয় করতাছে।

ঘরের অন্ধকারে সোনা একা থাকতে ভয় পাচ্ছিল। সে ফের বলল, মা এইটা কি হইতাছে?

—লাঠিখেলা।

রঞ্জিত দেখতে পেল সোনা ঘুম থেকে উঠে এসেছে। সে সোনাকে কাছে ডেকে বলল, তুই খেলা শিখবি?

—শিখমু। খুব আগ্রহের সঙ্গে কথাটা বলল সোনা।

—কিন্তু অনেক সাধনা করতে হয়।

সোনা সাধনা কথাটার অর্থ জানে না। সোনা বলল, মা সাধনা মানে কি মা?

রঞ্জিত বলল, ধনদি কি বলবে। আমার কাছে আয়। সাধনা মানে হচ্ছে তুমি যা করবে, একাগ্রচিত্তে করবে। কেউ তোমার এই ইচ্ছার কথা জানবে না।

—আমি কমু না।

—হ্যাঁ বলতে নেই। যদি না বল, তবে তোমাকে শেখাতে পারি।

—দ্যাখবেন, আমি কমু না

রঞ্জিত জানত এইসব কথার কোনও অর্থ হয় না। এইসব বালকদের রঞ্জিত দলে নিয়ে নিল। বলে দিতে পারে, নাও পারে, তবু ওদের একাগ্রচিত্ত করার জন্য মাঝে মাঝে রঞ্জিত নানাভাবে বক্তৃতা করত। সুতরাং সোনা, লালটু, পলটু এই দলে ক্রমে ভিড়ে গেল। ওরা খেলার চেয়ে ফাইমরমাস খাটায় বেশি উৎসাহ বোধ করত। রাত ঘন হলে কোনওদিন সোনা ঘুমিয়ে পড়ত। ওর খেলার কথা মনে থাকত না। ভোর হলে মামাকে বলত, আমি তোমার লগে কথা কমু না।

—কেন কি হল?

—তুমি কাইল আমারে খেলাতে লও নাই।

—তুমি তো ঘুমিয়ে পড়েছিলে।

.

সোনা মাঝে মাঝে মামার মতো অথবা বড় জেঠিমার মতো কথা বলতে চেষ্টা করত। মামা যেন তার অন্য গ্রহের মানুষ। স্পষ্ট এবং ধীর গলায় কথা বলে। মালতীরও ইচ্ছা হত রঞ্জিতের মতো কথা বলতে। বড়বৌদি এবং এই রঞ্জিতের কথা এত মিষ্টি যে, মনের ভিতর কেবল গুনগুন করে বাজে। ওদের কথা এতটুকু কর্কশ নয়। মালতীর মনে হত ওর কথা কর্কশ। সে সেজন্য যতটা পারে রঞ্জিতের সঙ্গে কম কথা বলে। রঞ্জিত আজকাল কাজের কথা ব্যতিরেকে অন্য কথা বলতেই চায় না। সে তাকে বাড়ি পৌঁছে দেবার সময় বলত, তোমার খুব একাগ্রতার অভাব মালতী। তুমি খুব যেন অন্যমনস্ক, খেলার সময় অন্যমনস্ক হলে মাথায় মুখে কোনদিন লেগে যাবে।

মালতী তখন উত্তর দিত না। কি উত্তর দেবে! এই খেলা যেন নিত্য তার সঙ্গলাভের জন্য। যেন এই মানুষ এসে গেছে তার, এখন আর ভয় কিসের! রঞ্জিতের সব কথা সেজন্য সে চুপচাপ শুনে যেত কেবল। কোনও কোনদিনও মালতীকে স্বাভাবিক করে তোলার জন্য সে এই অঞ্চলের ভাষা ব্যবহার করত। তখন আরও গা জ্বলে যেত মালতীর। এসব গ্রাম্য আঞ্চলিক ভাষা যেমন কর্কশ তেমন শ্ৰীহীন! রঞ্জিত এমন ভাষায় কথা বললে, তার কাছে আর কিছু চাইবার থাকে না। মালতী বিরক্ত হয়ে বলত, তোমার আর ঢং করতে হবে না রঞ্জিত। ইচ্ছা করলে আমিও তোমার মতো কথা বলতে পারি। তুমি যা ভাল করে বলতে পার না, তা বলো না। বড় খারাপ লাগে। তোমার সঙ্গে আমি ছেলেবয়স থেকে বড় হয়েছি।

রঞ্জিত কেমন অবাক হল ওর কথা শুনে। তোমাকে মালতী আর গ্রাম্য বলে ধরাই যায় না।

মালতী বলল, তবু যার যা তার তা। আমার মুখে তোমার ভাষা মানাইব ক্যান। তুমিও যা ভাল কইরা কইতে পার না, তা কইতে যাইয় না। বড় খারাপ লাগে শুনতে।

.

সোনা বলল, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, তুমি ডাকলা না ক্যান?

—ঠিক আছে, আজ রাতে তোমাকে ডেকে তুলব। কিন্তু শর্ত আছে।

—শর্ত! শর্ত কথাটাই শোনেনি সোনা। সে বলে, ছোটমামা শর্ত কি! –তুমি সোনা শুধু মাঠ দেখেছ।

—মাঠ দেখেছি।

—ফুল দেখেছ।

—ফুল দেখেছি। সোনা মামার মতো কথা বলতে চেষ্টা করল।

—আর সোনালী বালির চর দেখেছ।

—চর দেখেছি। তরমুজ দেখেছি।

—কিন্তু শর্ত দ্যাখো নি।

—না।

শর্ত বড় এক দৈত্য। এই দৈত্য কাঁধে চাপলে মানুষ অমানুষ হয়ে যায়। আবার অমানুষ মানুষ হয়ে যায়।

—তোমার দৈত্যটা কি কয় ছোটমামা?

—আমার দৈত্যটা অমানুষকে মানুষ হতে কয়।

—দৈত্যটা আমারে আইনা দ্যাও না।

—বড় হও। বড় হলে এনে দেব। রঞ্জিত এই বলে সোনাকে কাঁধে তুলে ঘোরাতে থাকল। বড় উঠোনে লাঠি খেলা হয়, ছোরা খেলা হয়। চারধারে বড় বড় টিন-কাঠের ঘর। পালবাড়ির উঠোন থেকে কিছু দেখা যায় না ভিতরে। রাত হলেই উঠোনটা মানুষে ভরে যাবে।

.

আতা বেড়ার ওপাশ থেকে একটা চোখ অপলকে দেখছে রঞ্জিতকে। রঞ্জিতের পেশীবহুল শরীর দেখে চোখটা তাজ্জব বনে যাচ্ছে। রঞ্জিতের খালি গা। রঞ্জিত সোনাকে কাঁধে নিয়ে ঘোরাচ্ছে। কখনও সোনাকে দুহাত ধরে ঘোরাচ্ছে। সোনা খুব আনন্দ পাচ্ছিল। ওর মাথা ঘুরছিল। কিছুক্ষণ ঘুরিয়েই সে সোনাকে মাটির ওপর ছেড়ে দিচ্ছে, সোনা টলছিল, দু’হাত বাড়িয়ে আবার আবার করছিল। শচীন্দ্রনাথ উঠোন পার হয়ে যাবার সময় দেখলেন, রঞ্জিত সোনাকে নিয়ে উঠোনে খেলা করছে। শচীন্দ্রনাথ কিছু বললেন না। সকালবেলা পড়ার সময়। কিন্তু সোনার পরীক্ষা হয়ে গেছে। সে পরীক্ষায় খুব ভালো করেছে। সোনার স্মৃতিশক্তি প্রখর। এই সকালে উঠোনের ওপর মামা ভাগ্নেকে নিয়ে এমন মত্ত দেখে মনে মনে খুশি হলেন তিনি। শীতকালে ওদের মামাবাড়ি যাবার কথা। ধনবৌ ওদের পরীক্ষা হয়ে গেলেই বাপের বাড়ি যায়। শীতের সময় খুব কুয়াশা হয় মাঠে। কলাই গাছে কলাই শুঁটি। আর মাঠে মাঠে সর্ষের ফুল হলুদগোলা রঙের মতো।

শীতের দিনেই হত খাবার, রকমারি খাবার। পিঠে-পায়েস তখন বাড়ি বাড়ি। তখন বড় বড় লোকদের বাড়িতে বাস্তুপূজা। ভেড়া বলি, তিলা কদমা আর তিলের অম্বল। নানা রকমের খাবার। তখন বাজারে গেলেই বড় পাবদা মাছ—কি সোনালী রং আর কি বড় বড়! কালিবাউশ, বড় বাগদা চিংড়ি আর দুধ। শীত এলেই অঞ্চলের গাভীরা তাদের সঞ্চিত দুধ সব ঢেলে দেয়। তখন অভাবটাও পল্লীতে পল্লীতে জাঁকিয়ে বসে থাকে না। তখন সংসারে সংসারে আনন্দ উৎসব। সব দিনমজুর তখন কাজ পায় গেরস্থবাড়িতে। জিনিসপত্রের দাম সস্তা হয়ে যায়। আর শীতকাল এলেই লালটু পলটু গ্রামের সব ছেলেদের সঙ্গে মাঠে নেমে গিয়ে গোল্লাছুট খেলে। শুধু মাঠ, ধান কেটে নেওয়া হয়েছে বলে নরম মাটির শুকনো নাড়া, পা পড়লেই খড়খড় শব্দ। তখন যত পারো ছোটো। ছুটে ছুটে পড়ে যাও মাটিতে—কিন্তু শরীরের কোথাও এতটুকু আঘাত লাগবে না।

শচীন্দ্রনাথ আতা বেড়ার পাশ দিয়ে যাবার সময় দেখলেন, মালতী দাঁড়িয়ে আছে। কাফিলা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে কি যেন করছে। শচীন্দ্রনাথ বললেন, তুই এখানে?

—আঠা নিমু। বলে কাফিলা গাছ থেকে আঠা তুলে নেবার মতো অভিনয় করল। বস্তুত মালতী এই গাছের নিচে দাঁড়িয়ে একজন মানুষকে ওপাশে বেড়ার ফাঁকে চুপি চুপি দেখছিল। কেউ এলেই খুঁটে খুঁটে যেন গাছ থেকে আঠা নিচ্ছে এমনভাব চোখেমুখে। সে এই করে প্রাণভরে রঞ্জিতকে দেখছিল। ভোরে উঠেই মালতীর হাতে যা কাজ ছিল, যেমন উঠোন ঝাঁট দেওয়া আর বাসন ঘাটে নিয়ে যাওয়া, তারপর হাঁসগুলি ছেড়ে দেওয়া—এইসব কাজ করে দেখল আর কিছু করণীয় নেই। আভারানী রান্নাঘরে চিঁড়ার ধান ভিজিয়ে রাখছে। চুপি চুপি সে ঠাকুরবাড়ি চলে এল। মালতী আতা বেড়ার পাশে একটু সময় অপেক্ষা করল। প্রথম উঁকি দিতে সাহস পায়নি। একটা কিছু অছিলা দরকার। বেড়ার সঙ্গে কাফিলা গাছ। গাছ থেকে একটু একটু আঠা ঝরছে। সে একটা পাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। কেউ দেখতে পেলে বুঝবে মালতী আঠা নিচ্ছে গাছ থেকে। সে আতা বেড়ার ফাঁকে উঁকি দিল। মরিয়া হয়ে সে উঁকি দিয়ে রঞ্জিতকে দেখতে থাকল। অপমানকর ঘটনা ঘটে যেতে পারে এই নিয়ে, কলঙ্ক পর্যন্ত রটে যেতে পারে এই নিয়ে, সে তাও ভুলে গেল। নরেন দাস বাড়িতে নেই, অমূল্য বাবুর হাটে শাড়ি বিক্রি করতে গেছে, তাঁত এখন ক’দিনের জন্য বন্ধ। সুতরাং মালতীর প্রায় ছুটির দিন এগুলি। সে এইসব দিনে খেলে, বেড়িয়ে, পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে তেঁতুলের আচার মুখে স্বাদ নিতে নিতে বেশ সময় কাটিয়ে দিতে পারবে। তার পর পুরীপূজার মেলা। সে এবার রঞ্জিতকে নিয়ে পুরীপূজার মেলায় চলে যাবে। তারপর সেই মেলার প্রাঙ্গণে সারকাসের হাতি, সিংহ, বাঘ, মাঠে ঘোড়দৌড় এবং মন্দিরের এক পাশে ডোমেদের শুয়োর বলি এসব দেখে, জিলিপি রসগোল্লা মুখে পুরে সারা মাঠ ছুটে বেড়িয়ে—কী যে এক আনন্দ, কী যে এক সুখ বসত করে মনের ভিতর—বুঝি সুখের জন্য এই মানুষ রঞ্জিত এখন তার জীবনের সব কিছু। সে মরিয়া হয়ে বেড়ার ফাঁকে একটা চোখ রেখে দাঁড়িয়ে থাকল।

বিকেলের দিকে যখন বেলা একেবারেই পড়ে এল, যখন বৈঠকখানার উঠোনে আলো মরে গেছে, সোনা, লালটু,পলটু যখন একটা করে বাঁশের লাঠি তুলে নিয়ে পুবের ঘরে সাজিয়ে রেখে দিচ্ছিল—তখনই গলা পাওয়া গেল। পুকুরপাড় থেকে ডেকে ডেকে উঠে আসছে কে!

বৈঠকখানার উঠোনে এসে ডাকল, রঞ্জিত নাকি আইছে?

শচীন্দ্রনাথ সামুকে দেখে সামান্য বিস্মিত হলেন। কিছুদিন আগে জমি সংক্রান্ত ব্যাপারে শচীন্দ্রনাথ সামুকে গালমন্দ করেছিলেন। কথা কাটাকাটি হয়েছে। সেই সামু ফের এ বাড়িতে উঠে এসেছে বলেই বোধ হয় তিনি কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ে গেছেন। তিনি স্বাভাবিক থাকার জন্য অন্য কথা টেনে আনলেন। বললেন, তর মায় নাকি বিছানা থাইকা আর উঠতেই পারে না।

—পারে না কর্তা।

—তারিণী কবিরাজের কাছে একবার যা।

—গিয়া কি হইব কর্তা। বোধ হয় শীতটা আর পার হইব না।

—তবু একবার গিয়া দ্যাখ। যদি তাইন একবার তর মায়েরে দেইখা যান। আমার চিঠি নিয়া যা। সামু বলল, দ্যান চিঠি। পাঠাই। দ্যাখি কি হয়।

—দ্যাখি কি হয় না! তুমি পাঠাইবা। পিসিরে অচিকিৎসায় মারবা সে হইতে দিমু না।

সামুর মুখে সামান্য প্রসন্ন হাসির রেখা ভেসে উঠল। নাকের নিচে ছাঁটা গোঁফ এবং থুতনিতে অতি সামান্য নুর—খুব লক্ষ করলে বোঝা যায় থুতনির নিচে সেই নুরটাকে যেন সামু গোপনে লালন করছে। এক সময় সামুর মুখে বড় বড় দাড়ি দেখে শচীন্দ্রনাথ বলেছিলেন—তরে দেখলে সামু, পিসার কথা মনে হয়। শচীন্দ্রনাথ সামুর বাবার কথা মনে করিয়ে দিয়ে সামুকে মহান করে তুলছিলেন যেন। তারপর কতদিন গেছে, মালতীকে ইচ্ছা করেই গালে বড় দাড়ি দেখিয়ে যেন প্রতিশোধ তুলতে চেয়েছিল। তারপর একসময় মনে হয়েছে, প্রতিশোধ কোথাও কারও জন্য অপেক্ষা করে থাকে না, সময় এলে সব জলের মতো মনে হয়, হাস্যকর মনে হয়। নিজের ছেলেমানুষীর কথা ভেবে লজ্জায় মুখ ঢেকে দিতে ইচ্ছা যায়। সুতরাং এখন সামু আবার ভদ্রগোছের যেন। বিশেষ করে শিক্ষিত, মার্জিত রুচির পুরুষ। যেন এখন সামু রঞ্জিত একরকম। সামুর পরনে তফন, ডোরাকাটা। ধানগাছের মতো রং তফনের। আর গায়ে হাল্কা গেঞ্জি, পুরুহাতা শার্ট। সে এবার শচীন্দ্রনাথের দিকে না তাকিয়েই বলল, শোনলাম রঞ্জিত ফিরা আইছে?

—হ, আইছে। এতদিন কলিকাতায় আছিল, আবার ফিরা আইছে।

সামু আর শচীন্দ্রনাথের জন্য অপেক্ষা করল না। ডাকল, কৈ ঠাকুর, কৈ গ্যালা। একবার এদিকে বাইর হও। দেখি চেহারাটা। তুমি আমারে চিনতে পার কিনা দেখি।

রঞ্জিত বৈঠকখানার উঠোনে এসে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল—তুই সামু না?

—তাহলে দেখছি ভুইলা যাও নাই।

—ভুলব কেন!

—কি জানি বাবা, তুমি কোনখানে চইলা গেলা। কোন চিঠিপত্র নাই। বড় বৌঠাইরেনের লগে দেখা হইলে কইছি, রঞ্জিতের চিঠি পাইলেন নি! একেবারে নিরুদ্দেশে গ্যালা। কোন চিঠিপত্র নাই।

রঞ্জিত বলল, ভিতরে এসে বোস।

—সাঁজ বেলাতে ঘরে বইসা থাকবা? চল না মাঠের দিকে যাই।

এটা মন্দ কথা নয়। মাঠের দিকে বলতে—সেই সোনালী বালির নদীর চর। সেই নদী, এক আবহমানকালের নদী। কথায় কথায় রঞ্জিত সামুকে অনেক কথাই বলল, অনেক দিনের অনেক কথা। এক ফাঁকে মালতীর কথাও।

জ্যোৎস্না উঠে গেলে, পরিচ্ছন্ন আকাশ। ওরা আলের ওপর দিয়ে হাঁটছিল। এই সব যব গম খেত পার হলেই নদীর চর। নদী সাপের মতো বিস্তৃতি নিয়ে এই চর, মাঠ এবং গাঁয়ের মাঝে শুয়ে আছে। তরমুজের লতা খুব ছোট বলে এবং বাতাস দিচ্ছিল বলে অস্পষ্ট জ্যোৎস্নায় দূর থেকে একপাল খরগোশের মতো মনে হচ্ছে। ওরা যেন নিরন্তর সেই বালির চরে ছুটে বেড়াচ্ছিল। নদীর জল নেমে গেছে। কি আর জল—সেই এক রকমের, মনে হয় পার হয় গরু, পার হয় গাড়ি। ওরা নদীর জলে কাপড় হাঁটু পর্যন্ত তুলে নেমে গেল। স্ফটিক জল। নিচে নুড়ি পাথর, মাথার ওপর আকাশ। সাদা জ্যোৎস্না। নদী পার হলে গ্রাম, কিছু ঘন বন, আর পুবে হেঁটে গেলে এক বাঁশের সাঁকো পাওয়া যায়। সেই সাঁকোর ওপর মালতীকে নিয়ে একদিন সামু এবং রঞ্জিত চলে গিয়েছিল। নদীর জল মাঠ ভেঙে চুকৈর ফল, টকটক মিষ্টি মিষ্টি ফল, আনতে ওরা চলে গিয়েছিল। তারপর ওরা ফেরার পথে বড় মাঠ পার হতে গিয়ে পথ হারিয়ে সারাক্ষণ মাঠময়, গ্রামময় ঘুরে ঘুরে সন্ধ্যার সময় বাড়ি ফিরলে নরেন দাস ধমক দিয়েছিল। ওরা বাড়িতে ঢুকলেই মালতীকে কাজ দিয়ে তাঁতঘরে পাঠিয়ে দিত।

তখন সামু বলেছিল, ঠাকুর একটা বুদ্ধি দ্যাও।

রঞ্জিত বলেছিল, নরেন দাস মাছ খেতে ভালোবাসে।

—কি মাছ?

—ইচা মাছ।

সেবার ভাদ্র কি আশ্বিন মাস ছিল। ঠিক এখন মনে পড়ছে না ওদের। বর্ষার জল নেমে যেতে আরম্ভ করেছে। জলের নিচে সব জলজ ঘাস পচতে শুরু করেছে। দুর্গন্ধ জলে। জলের মাছ বড় বিল, নদী অথবা সমুদ্রে পালাতে পারলে যেন বাঁচে। খাল ধরে মাছগুলি নেমে যবে। ঠিক জায়গা মতো জলের নিচে চাই পেতে রাখতে পারলে মাছে চাই ভরে যাবে। চিংড়ি মাছে ভরে যাবে। বড় বড় গলদা চিংড়ি। কিন্তু বড় কষ্ট। বিশেষ করে সাপখোপের ভয়, জোঁক এবং জলজ কীট-পতঙ্গের ভয়। ওরা সব তুচ্ছ করে গায়ে রসুন গোটার তেল মেখে মাছ ধরার জন্য সাঁতরাতে থাকল। পচা জল সাঁতরে খালের বড় বট গাছটার নিচে চাই পেতে সেই বটগাছের ডালে সারারাত পাহারা দিয়ে পরদিন প্রায় দুই ঝুড়ি গলদা চিংড়ি নরেন দাসের উঠোনে এনে ফেলতেই চকিতে যেন বলে উঠেছিল, আরে, তরা করছসটা কি! সেই যে উভয়ে চকিত চোখে দেখেছিল, নরেন দাসের কী যে লোভ! নরেন দাস, বিষয়ী মানুষ নরেন দাস, লোভে আঁকুপাঁকু করছিল—আর কোনওদিন কখনও ছোট মেয়ে মালতীরে ধরে রাখেনি। মালতী প্রায় সমবয়সী বন্ধুদের সঙ্গে এই অঞ্চলের সর্বত্র ছুটে বেড়িয়েছে।

এই মালতীর জন্য ওরা কত দুঃসাহসিক কাজ করে বেড়াত! সেই মালতী এখন কত বড় হয়েছে। রঞ্জিত হাঁটছিল আর ভাবছিল। ভাবতে ভাবতে এক সময় বলে ফেলল, মালতী বড় সুন্দর হয়েছে, কতদিন পর দেখা। মালতী এখন কি লম্বা হয়েছে!

সামু এবার মুখ তুলে তাকাল। বলল অরে নিয়া বড় ভয় আমার। একদিন রাইতে দেখি অমূল্যরে নিয়া আনধাইরে হাঁস খুঁজতে মাঠে বাইর হইছে।

রঞ্জিত বোধ হয় কিছুই শুনছিল না। মালতীকে সে প্রথম দিন দেখে চমকে গিয়েছিল। ওর মুখ থেকে যেন ফসকে বের হয়ে গেছিল—কি সুন্দর তুমি! কিন্তু বলতে পারেনি। কোথায় যেন ওর মনে এক অহঙ্কার আছে, আত্মত্যাগের অহঙ্কার। তবু মনের ভিতর ভালো লাগার আবেগ সময়ে অসময়ে খেলা করে বেড়াচ্ছিল। সামুর সঙ্গে দেখা হতেই মনে হল, এই মানুষ একমাত্র মানুষ যাকে তার ভালো লাগার কথাটুকু বললে কোনও ক্ষতির কারণ হবে না। সে জলের কিনারে হেঁটে যাবার সময় মালতীর কথা বলছিল। নির্মল জলের মতো মালতী পবিত্র হয়ে আছে এমন সব বলার ইচ্ছা। জলে জ্যোৎস্না চিকচিক করছে। জলের শব্দে ছোট ছোট মাছেরা ছুটে আসছে পায়ের কাছে। দাঁড়িয়ে গেলে সেই সব কুঁচো মাছ পায়ে ঠোকর মারছিল। দু’জনই প্রায় সময় সময় একেবারে চুপ মেরে যাচ্ছে আবার কথা উঠলে নানারকমের কথা, কথায় কথায় রঞ্জিত বলল, তুই নাকি লীগের পাণ্ডা হয়েছিস!

সামু এ-কথার কোনও জবাব দিল না। কারণ কথাটার ভিতর বোধ হয় রঞ্জিতের অবজ্ঞা আছে। সে যেন ঠিক এখন শচীন্দ্রনাথের মতো কথা বলছে। শচীন্দ্রনাথ অথবা অন্যান্য হিন্দু মাতব্বর ব্যক্তিরা ওর দল সম্পর্কে যেমন উন্নাসিকতা রক্ষা করে থাকেন ঠিক তেমনি যেন রঞ্জিত ওর পার্টি সম্পর্কে অবজ্ঞা দেখাতে চাইল। সুতরাং সামু অন্য কথায় চলে আসার জন্য বলল, চল উপরে উইঠা যাই। চরে বইসা হাওয়া খাই।

রঞ্জিত চরে উঠে এগিয়ে গেল। তারপর সামনাসামনি দাঁড়িয়ে বলল, কি রে জবাব পেলাম না যে। –ও কথা, বাদ দ্যাও ঠাকুর।

কেন বাদ দেব। আরও কি বলতে যাচ্ছিল। সহসা যেন সামু বলে ফেলল, ওটা আমার ধর্মের কথা। বলেই হাত ধরে রঞ্জিতকে টেনে বসাল। ছুঁইয়া দিলাম। সান করতে হইব না ত! রঞ্জিত এমন কথায় হা হা করে হেসে উঠল। কিন্তু হাসতে হাসতেই কেমন বিষণ্ণ হয়ে গেল রঞ্জিত। সব যেন কেমন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। সামু এবার ধীরে ধীরে বলল,কতদিন আছ ঠাকুর? বলে দূরে নদীর জল দেখতে থাকল।

—ঠিক নেই। যতদিন পারি থাকব! বলার ইচ্ছা যেন, আত্মগোপন করে আছি। যদি ধরিয়ে না দিস তবে বোধ হয় এবার এখানে অনেকদিন পর্যন্ত থেকে যেতে পারব।

সামু এবার ওর দিকে মুখ ফেরাল। এখন সে আর এই বালিয়াড়ি দেখছে না। নদী দেখছে না। এবং এত যে রহস্যময় গ্রাম মাঠ ফসল পড়ে আছে তাও দেখছে না। সে শুধু রঞ্জিতের মুখ দেখছে। সে রঞ্জিতের মুখে সেই ছায়া দেখছে—বোধ হয় আত্মত্যাগের অহংকার এই মানুষের মুখে, অন্য মানুষের ধর্মে কর্মে একেবারেই বিশ্বাস নেই। সে মুখের কাছে মুখ নিয়ে বলল, আমার মাইয়াটারে তোমারে আইনা দ্যাখামু ঠাকুর। মাইয়াটা এখন ঠিক মালতীর ছোট বয়সের মত হইছে। কেবল ছুটে ছুটে বেড়ায় গোপাটে। মাইয়াটারে দ্যাখলে, আমার তোমার কথা মনে হয়। তুমি আমারে ঠাকুর অবিশ্বাস কইর না, অবহেলা কইর না। বলে কেমন মুখ ব্যাজার করে ফেলল সামু।

—মালতী বলল, তুই ঢাকায় থাকিস, সেখানে পার্টি করছিস!

—মালতী বড় অবজ্ঞা করে ঠাকুর। মালতী আমার লগে আর প্রাণ খুইলা কথা কয় না।

—বুঝি অবিশ্বাস করছে?

—জানি না ঠাকুর। বিশ্বাস অবিশ্বাসের কথা জানি না।

ঠিক তখনই জ্যোৎস্নার ভিতর মনে হচ্ছিল এক মানুষ, পাগল মানুষ হেঁটে নদী পার হচ্ছেন। ওপারে গ্রামের ভিতর লণ্ঠন জ্বলছিল, জলে সেই লণ্ঠনের অলো ভাসছে। পাগল মানুষ, মণীন্দ্রনাথ নদী পার হচ্ছিলেন বলে জলে সামান্য ঢেউ উঠছে। আলোর রেখাগুলি ছত্রখান হয়ে গেল।