উত্তমকুমার চট্টোপাধ্যায়
হারিয়ে যাওয়া দিনগুলি মোর
চোদ্দ
হ্যাঁ, যা বলছিলাম। অভিনয়ের কথা। অভিনয় করতে করতে মনের পরিবর্তনের কথা। তুলসীদার মুখ থেকে যেমন ওই কথা শুনেছি তেমনি ছেলেবয়সে যাত্রা দেখতে দেখতে এর কিছুটা প্রমাণও পেয়েছি।
একবার ছেলেবয়সে যাত্রা দেখতে গিয়েছিলাম, শ্রীগৌরাঙ্গ সম্বন্ধীয় কোনো যাত্রা অভিনয় হচ্ছিল। অভিনয় জমে উঠেছে।
যে ভদ্রলোক ‘বিষ্ণুপ্রিয়া’র পার্ট করছিলেন তিনি নিমাই—এর গৃহত্যাগের দৃশ্যে অঝোরধারায় কাঁদতে লাগলেন। কাঁদতে কাঁদতে তিনি এতটা আত্মহারা হয়ে গেলেন যে, সেই সভাতেই হঠাৎ তিনি অচেতন হয়ে পড়ে গেলেন।
সকলে তো ত্রস্ত,—কী হল কী হল! দলের লোক জানতেন। তাঁরা তাড়াতাড়ি তাঁকে সভা থেকে তুলে নিয়ে গেলেন। শুশ্রূষার পর তাঁর আবার জ্ঞান ফিরে এল। শুনেছিলাম সেইবার প্রথম নয়, এমনটি নাকি তাঁর প্রায়ই হয়। বড়ো আশ্চর্য লেগেছিল তখন। কিন্তু আজ আর কোনো বিস্ময় জাগে না। মনে হয় সবই সম্ভব।
অপরদিকে দেখেছি দীর্ঘদিন স্বামী—স্ত্রীর অভিনয় করতে করতে অভিনেতার মনেও এসেছে লোভ, এসেছে আকাঙ্খা।
যেমন ধরুন, এক নায়িকার সঙ্গে দীর্ঘদিন আপনি ভালোবাসার অভিনয় করছেন। তিনি করছেন আপনার সঙ্গে অভিনয়। পরিচালক আপনাদের অভিনয় দেখে খুশি হয়েছেন।
বললেন— ‘অদ্ভুত জীবন্ত হচ্ছে!’ উৎসাহ আপনার বেড়ে গেল। আপনি লক্ষ করলেন অপর দিকের উৎসাহও কম নয়। সারাদিন অভিনয়ের পর আপনি হয়তো ফিরছেন বাড়িতে। বাড়ি ফেরার পথে এই চিন্তাটা আপনাকে পেয়ে বসল— যার সঙ্গে সারাদিন ধরে ভালোবাসার অভিনয় করলেন সেটা কি শুধু অভিনয়? না তার মধ্যে কিছু সত্যতা আছে?
মনের মধ্যে আবার কল্পনার রং ভেসে উঠল। তার মনের অবস্থা কেমন? জানতে পারলে বড়ো ভালো হয়।
এই প্রসঙ্গে এক বিখ্যাত মনস্তাত্ত্বিকের কথা না বলে পারছি না। তিনি বলেছিলেন— ‘মানুষের দেহই বুড়ো হয়, মন কখনও বুড়ো হয় না। তবে সব মানুষ যে নিজেকে সংযত করে রাখে তার কারণ সামাজিক বন্ধন।’
যখন পড়েছিলাম তখন ওই কথায় গুরুত্ব দিইনি বুঝতেই পারিনি এর অন্তর্নিহিত অর্থ। পরে বুঝেছিলাম এটা কতদূর সত্য।
যাক যে কথা বলছিলাম। আপনার ভেতরের ‘হিরো’,—হিরোই বলুন আর তাকে ‘সেক্স’ই আখ্যা দিন, আমি সে বলতে চাইনা,—সেই সত্তাটা হঠাৎ জেগে উঠবে—’ওকে না পেলে জীবন আমার দুর্বিষহ হয়ে যাবে।’ মনের এই অহরহ তাগাদা আপনাকে অস্থির করে তুলবে। বাস্তবে তার প্রতিফলন চাইবে। আপনি ঠিক করলেন, পরের দিন স্টুডিওতে গিয়েই তাকে এই কথা জিজ্ঞাসা করব— তার মধ্যেও কোনো পরিবর্তন হচ্ছে কিনা। সে—ও এ জিনিসকে অনুমোদন করে কি না!
আপনি ঠিক করেই ফেললেন। পরের দিন আপনি স্টুডিওতে আগে এলেন। সবাই দেখে উৎসাহিত হয়ে বলল, ‘আজ এত সকাল সকাল?’
এসে থেকে আপনার হতে লাগল অস্বস্তি। কী হবে, কী উত্তর পাবেন!
যদি অসংযত কথা বলার জন্য অসম্মানিত হন? তখন আপনি কী করবেন? এইরকম একটা উৎকণ্ঠা নিয়ে আপনি নিয়ে এলেন স্টুডিওতে।
সারাদিন ভাবলেন, জিজ্ঞেস করা যায় কী করে? অনেক ভেবেচিন্তে একটা প্ল্যানও বার করেছেন। কিন্তু আসল সময়ে দেখলেন, আপনার মন চাইছে না সে প্রশ্ন করতে। কারণ সামাজিক বন্ধন।
শুধু সামাজিক বন্ধনই নয়, ঘরে আপনার স্ত্রী আছেন, আত্মীয়স্বজন সকলেই আছেন। তাঁদের চোখের জল আর দীর্ঘদিনের অভ্যাসের কথা ভেবে আপনি আর এগিয়ে যেতে পারলেন না। আসল ব্যাপারটা আমার মনে হয়, যাঁরা সত্যিকারের ভালোবাসা পান, সেবা পান, যত্ন পান, তাঁরা বোধহয় আগের ভালোবাসা কাটিয়ে আর এগিয়ে যেতে পারেন না। তাঁরা অভিনয়টাকে পেশা হিসাবেই দেখে থাকেন। স্ফূর্তি বা আমোদের সুযোগ হিসেবে দেখেন না। শুনেছি, আগেকার দিনে এসব জায়গাকে কেন্দ্র করে নাকি নানারকম ব্যাপার ঘটত। তবে শোনা কথার উপর কোনো কিছু না বিশ্বাস করাই ভালো। কারণ এই শোনা কথাটাই মানুষের জীবনে অনেকরকম ঘটনা ঘটায়। মানুষকে মরীচিকার পিছনে ছোটায়। আকাশেও তোলে, আবার সময় সময় পাতালেও নামায়। তাই বলছিলাম শোনা কথার গুরুত্ব না দেওয়াই ভালো।
ধরুন একজন অভিনেতা নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য নিযুক্ত হলেন।
প্রথম ছবিতে তিনি বেশ সুন্দর অভিনয় করলেন। দর্শকও নিলেন। ব্যস, দু’চারটে প্রশংসার কথা শুনে তাঁর ধারণা হল তিনি মস্ত অভিনেতা। অভিনয়ের অনুশীলন আর তাঁর প্রয়োজন নেই। দম্ভভরে চলতে আরম্ভ করলেন। অভিনয়ের অনুশীলন ছেড়ে দিলেন। তিনি ভাবলেন, আমি যা অভিনয় করব তাই দর্শকরা নেবেন। কিন্তু তারপর দেখা গেল দু’ তিনখানা ছবি দর্শক নিলেন না।
এমনটি ঘটলে ধর্মতলার অফিস১ গুলো তাঁকে আর ডাকবে না। তিনি যখন নিজের ভুল বুঝতে পেরে সচেতন হলেন, তখন আর সময় নেই। সব সুযোগই চলে গেছে।
একথা বলতে পারছি, কারণ প্রথম দিকে দর্শক আমাকে নেননি। তাই অভিনয়ে নিষ্ঠার দাম আমি বুঝেছিলাম।
আজ যত প্রশংসাই শুনি না কেন, অভিনয়ের ব্যাপারে আমি খুব জেনে গেছি, এ ধারণা আমার কখনও হয় না।
কিংবা কোনো নাটক শুধু আমার জন্যই চলছে, এ বিশ্বাসও আমার হয় না। কারণ আমি জানি ফুটবলের একজন খেলোয়াড়ের একলার সাধ্য নেই একটা দলকে জিতিয়ে দেওয়ার, তিনি যত ভালোই খেলুন না কেন। একথা যেমন আমি জানি, তেমনি জানেন আপনারাও। একইভাবে ছবির কাহিনি যদি দুর্বল হয় বা চিত্রনাট্য যদি মানুষের মন স্পর্শ না করতে পারে, তাহলে শত ভালো অভিনেতা হলেও ছবি চলে না। একটা ভালো ছবির সম্পদ, ও দুটোই। ও দুটো একসঙ্গে হলে তবেই ছবি দর্শকরা নেন। তাছাড়া পরিচালক, সাউণ্ড, ক্যামেরাম্যানের কাজও ভালো হওয়া চাই। নইলে কিন্তু ছবি চলা শক্ত।
ওঁদের দেশের ছবির মধ্যে দেখেছি, যতদূর সাধ্য ওঁরা নিখুঁত করার চেষ্টা করেন। ক্যামেরা, সাউণ্ডের কাজ আমাদের চেয়ে অনেক উন্নত ধরনের হয়।
সেইজন্য আমার মনে হয় এ দেশেও যদি ভালো টেকনিশিয়ান তৈরি হয়, তাহলে আরও উন্নত ধরনের ছবি সৃষ্টি করা যেতে পারে।
প্রসঙ্গত আমি কেবল স্টুডিওতেই অভিনয় করি না। এইতো সেদিন পাড়ার ছেলেরা এসে ধরলো আমাকে—যাত্রা করতে হবে।
আমি বলি— কী বই অভিনয় করবে তোমরা?
ওরা বলে —’গয়াসুর’ । আপনাকে নারায়ণের পার্টটা করতে হবে।
—গয়াসুর, নারায়ণ!
মনের ভিতর যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। মনে পড়ে গেল, আমি ছোটো ছেলে, স্কুলে পড়ি। আমার জীবনের প্রথম অভিনয় ‘গয়াসুর’এর ছোটো কৃষ্ণ। সেই প্রথম মুখে রং মেখে এসে মাকে দেখানো।
পাড়ার ছেলেদের কথায় চটকা ভাঙে— ‘উত্তমদা জগদ্ধাত্রী পূজোর কী হবে। তুমি করছ তো?’