উত্তমকুমার চট্টোপাধ্যায়

হারিয়ে যাওয়া দিনগুলি মোর

এগার

আমার জীবনে তখন নেমে এসেছে হতাশা। একদিকে গৌরী, অপর দিকে ফিল্ম। গৌরীর কাহিনি আগেই বলেছি। অবস্থার বিশেষ কোনো পরিবর্তন হয়নি। তাই সেজন্যে হতাশাও কমেনি।

অপরদিকে ‘দৃষ্টিদান’-এর হবু নায়কের চরিত্রে অভিনয় করার পর আর কোনো নতুন সুযোগ আমার জীবনে তখনও আসেনি।

অথচ ফিল্মে অভিনয় করবার আশা আমার দুরন্ত।

এইরকম সময় যখন মনের দোলায় আমি দুলছি, তখন হঠাৎ একদিন বড়োমামা এসে আমাকে বললেন— ‘কী রে, কোথায় যাচ্ছিস?’

আমি বলি— ‘ন’টা বেজে গেছে, অফিসে।’

আমার মুখের দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে বড়োমামা বললেন— ‘পরের গোলামি আর কতদিন করবি?’

এইখানে বলে রাখা ভালো আমার বড়োমামা জ্যোতিষ নিয়ে চর্চা করেন। তাই ভাগ্নের কুষ্ঠীও তিনি মা’র কাছ থেকে আগেই চেয়ে নিয়ে বিচার করেছেন।

আমি সন্ন্যাসীর কথার খানিকটা প্রতিধ্বনি তাঁর মুখ থেকে শুনে জিজ্ঞেস করলাম— ‘কী করব বড়োমামা যদি চাকরি ছেড়ে দিই?’

বড়োমামা বলেন— ‘তুই শিল্পী!’

মনটা আশায়, আনন্দে দুলে উঠল। শিল্পী! তবুও ঠাট্টা করে বলি— ‘আমি তো ছবি আঁকি না।’

বড়োমামা আমার উপহাসটা বোধহয় বুঝতে পেরেছিলেন। তাই একটু গুরুগম্ভীর চালে বললেন— ‘যতসব জ্যাঠা ছেলে!’

খোঁচালে ফল আর ভালো হবে না। ওদিকে আমার অফিস যেতেও দেরি হয়ে যাচ্ছে—তাই জামাটা গায়ে ফেলে দিয়েঅফিসে যাবার জন্যে তৈরি হয়ে নিলাম। তাড়াতাড়ি নাকেমুখে গুঁজে আবার সেই বাস ধরা, অফিস, সন্ধে নাগাদ বাড়ি ফেরা। সেই একঘেয়ে জীবন, এতে নেই কোনো পরিবর্তন, নেই কোনো আকর্ষণ।

কিন্তু পরের দিন সকালবেলায় সত্যিই আমাকে বিস্মিত হতে হল, যখন বুড়ো (বর্তমানে তরুণকুমার) এসে আমায় খবর দিল, বাবার বসবার ঘরে আমার ডাক পড়েছে।

চোরের মন সদাসর্বদা যেমন বোঁচকার দিকে থাকে, তেমনি আমারও হঠাৎ বাবা ডাকছেন শুনে মনে হল, আমার লুকিয়ে প্রেম করার কথা বাবা কি জেনে ফেলেছেন নাকি?

সর্বনাশ! যদি তাঁর কানে ওঠে তবে কী জবাব দেব? মিথ্যে কথা বলব? কখনও তো বাবার কাছে মিথ্যে কথা বলিনি। তার ওপর এক্ষেত্রে যদি এখন মিথ্যে কথা বলি, পরে সত্যি কথা বলবার সুযোগও পাবোনা। তখন উপায়?

বুড়ো তাড়া মেরে বলে— ‘দাদা, কী ভাবছ এতো, বাবা ডাকছে না!’

একটু খোশামোদ করেই তাকে জিজ্ঞেস করি— ‘কেন বাবা ডাকছে রে?’

বুড়ো উত্তরে বলে— ‘তা তো জানি না, একজন কে লোক এসেছে তাই তোমায় ডাকছে।’

সর্বনাশ! গৌরীদের বাড়ির কেউ আসেনি তো! যদি এসে থাকে তাহলে উপায়?

আমার শেষ অস্ত্র প্রয়োগ করে বুড়োকে বলি— ‘লোকটা কে রে?’

বুড়ো বলে— ‘গিয়েই দেখোনা, আমি কী জানি!’

সে তো বলেই খালাস। কথা শেষ করে বুড়ো ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

কিন্তু আমি তো অত সহজে খালাস হতে পারলাম না। ভাবলাম একবার—বাড়ি থেকে পালিয়ে যাব! কিন্তু সেখানে ভয় আছে, বুড়ো আমায় দেখে গেছে ঘরে, বাবাকে এক্ষুনি গিয়ে বলে দেবে। তাতে ফল ভালো হবে না। তাই ভগবানের নাম স্মরণ করে কাঁপতে কাঁপতে গেলাম বাবার বসবার ঘরের দিকে।

গিয়ে দেখলাম, এতক্ষণ যা ভেবে এসেছি তা মোটেই নয়। গৌরীদের বাড়ি থেকে বাবার কাছে আমার নামে নালিশ করতে কেউ আসেননি। তার বদলে সেখানে বসে রয়েছেন বাবারই বাল্যবন্ধু পুলিনবাবু।

বাবা আমাকে দেখেই বললেন— ‘এই যে খোকা, পুলিন তোমায় অনেকক্ষণ ধরে ডাকছে।’

আমি তাঁকে অভিবাদন জানিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকি।

পুলিনবাবু বললেন— ‘আমি একটা ছবি করছি। নামবে আমার ছবিতে?’

ছবি! ভেতরের হিম রক্তটা হঠাৎ যেন উষ্ণ হয়ে উঠল।

আমি বলি— ‘কী ছবি করছেন?’

পুলিনবাবু বলেন— ‘ওরে যাত্রী’ বলে একটা ছবি তুলব ভাবছি।

— ‘আমাকে কী করতে হবে?’

— ‘তোমাকে?’—আমার আপাদমস্তক ভালো করে লক্ষ্য করে নিয়ে তিনি বলেন— ‘সেকেণ্ড হিরোর পার্ট।’

যাক, এবারে আর হবু নায়কের পার্ট নয়, একেবারে উপনায়কের পার্ট। দর্শকদের কিছু দেখাবার মতন একটা সুযোগ হয়তো এবার পাব। ‘উপ’ শব্দটার মধ্যে বোধহয় একটা মাধুর্য আছে। কারণ এই ‘উপ’দের নিয়েই শুনেছি রচিত হয়েছে বহু কাব্য। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ একজায়গায় বলেছেন—ভগবানকে ভালোবাসতে হবে ওই উপস্ত্রীর মতো বা উপপতির মতো। তাই সেকেণ্ড হিরো বা উপনায়কের পার্টের কথা শুনে আশায় আর আনন্দে আমার মন দুলে উঠল। আমি জিজ্ঞেস করি— ‘কবে থেকে আমাকে যেতে হবে?’

পুলিনবাবু বলেন— ‘তাহলে তুমি রাজি?’

রাজি! মনে মনেই ভাবি। শোনামাত্রই আমি যে প্রস্তুত। সেই যে কথায় আছে না— ‘ভাত খাবি আয়, না হাত ধোবো কোথা’। আমারও মনের অবস্থা তখন ঠিক তাই।

মনে মনে বেশ একটু রাগ হল। দূর ছাই! আমার চেহারাটা যদি আর একটু মোটা হত, তাহলে পুলিনবাবুকে ধরে করে হিরোর চান্সটা আমিই হয়তো পেতাম। কিন্তু উপস্থিত তা তো হবার উপায় নেই।

যাক, যা পাওয়া যাচ্ছে, ঠিকমতো বলতে গেলে ভাগ্যে যা জুটছে তাকে অবহেলা করা উচিত নয়।

অনেকক্ষণ চুপ করে আছি। আমি কথা বলছি না বলে তিনিও বিশেষ কথা বলছেন না, তাই নীরবতা ভঙ্গ করে প্রশ্ন করলাম— ‘ছবিটা পরিচালনা করবেন কে?’

পুলিনবাবু বলেন— ‘রাজেন চৌধুরী’।

একটু আমতা আমতা করে বলি— ‘নায়কের পার্ট করবেন কে?’

— ‘দীপক মুখার্জি। তুমি বোধহয় তার অভিনয় দেখেছ।’

— ‘দীপকবাবুর অভিনয়’,—আমি বলি— ‘হ্যাঁ দেখেছি’।

আমার কৌতূহল দেখে বোধহয় পুলিনবাবু আমার মনের কথাটা বুঝতে পেরেছিলেন। তাই বললেন— ‘হিরোর পার্ট করতে পারলে বড়ো খুশি হতে, না?’

আমি সুযোগ পেয়ে বলি— ‘আজ্ঞে! আমি কী পারব?’

আমাকে একরকম আশ্বাস দিয়েই তিনি বলেন— ‘দেখো, বই যদি ভালো চলে, তাহলে আমার next ছবিটায় তোমাকে হিরো করতে আর আপত্তি থাকবে না। অবশ্য যদি তোমাকে দর্শক নেয়।’

সেদিন প্রবীন প্রযোজকের মুখে যে-কথা শুনেছিলাম সে কথার অর্থ বুঝতে পারিনি তখন। ভেবেছিলাম পুলিনবাবু ইচ্ছা করলেই তো আমাকে একটা চান্স দিতে পারেন। দর্শকের নেওয়া বা না নেওয়া—সে তো প্রযোজক আর পরিচালকের হাতে। সে কথার অর্থ বুঝলাম আরও কিছুদিন পর।

যাক, সময়মতো সেকথা বলব।

আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে পুলিনবাবু বলেন— ‘তুমি একদিন এসো আমার ধর্মতলার অফিসে, চুক্তিপত্রটা সেইখানেই সই করে দিও। আর দেখো, আমি তোমায় এমনিতে খাটাব না, পারিশ্রমিক কিছু দেব।

বাবা বলেন— ‘ছেলেটার বড়ো শখ ফিল্মে নামবার। দেখো শিখিয়ে পড়িয়ে যদি নিতে পারো। তারপরে ওর ভাগ্য।’

আমি বলি— ‘কবে যাব, কালই যাব?’

পুলিনবাবু কী একটা ভেবে নিয়ে বলেন— ‘বেশ, কালই এসো আমার ধর্মতলার অফিসে, সেইখানেই কথাবার্তা হবে। আচ্ছা, তুমি এখন যেতে পারো।’

যেতে আমার মোটেই ইচ্ছা ছিল না সে জায়গা ছেড়ে, তবু আমাকে যেতে হল ভদ্রতার খাতিরে। মনের মধ্যে তখন আর হতাশা নেই, সব মনটা জুড়েই তখন উঠেছে আর একটা রঙিন স্বপ্ন।

পরের দিন চুক্তিপত্র সই হয়ে গেল যথানিয়মে।

পুলিনবাবু আমাকে বললেন— ‘এই ছবিটার জন্যে তোমাকে আমি ৭০০ টাকা দিতে পারি। কেমন, রাজি?’

রাজি! এর আগের ছবি দৃষ্টিদানে পেয়েছি মাত্র ১৩০ টাকা। তার ওপর উপনায়কের পার্ট। এ কি আমি ছাড়তে পারি! যাইহোক, কিছু না দিলেও আমি করতে প্রস্তুত। টাকা যেটা আমায় নিতে হয় সেটা আমার নিজের জন্য নয়, মা আর বাবার কিছুটা সুখ-সুবিধা করে দিতে পারব বলে।

মাকে দেখেছি, সংসারের জন্য কী অমানুষিক পরিশ্রম করেন। আমি তাঁর ছেলে হয়েও তাঁর সে কষ্ট এখনও ঘোচাতে পারিনি। তাই এই টাকা নেওয়ার প্রশ্ন।

চাকরি যা করি তাতে কি আর হয়। সেকথা আমিও বুঝি। সংসারের জন্যে চাই আমার টাকা। আমার ছোটো দুটি ভাই তখনও নাবালক।

যাক সেসব কথা।

চুক্তিপত্রে সই করার পরেই মনে প্রশ্ন উঠল, এখন স্যুটিং-এর দিনে কী করে স্টুডিওতে উপস্থিত হওয়া যায়? এ তো একদিন বা দু’ দিনের কাজ নয়। এ একেবারে পনেরো কুড়ি দিন যেতে হবে, তাও রোজ নয়—যেদিন ‘সেটে’ আমার পার্ট থাকবে সেদিন। ক্যাজুয়াল লীভগুলো নষ্ট করব? না, ‘earned leave’ নিয়ে একমাসের ছুটি নেব?

কিন্তু earned leave-এ ছুটি নিলে নির্দিষ্ট তারিখে আবার অফিসে যোগ দিতে হবে। কিন্তু তখন যদি আমার স্যুটিং শেষ না হয়, তাহলে?

সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে গিয়ে বসলাম অফিসে আমার নির্দিষ্ট জায়গায়।

আরও দিন দুই কেটে গেল। কিন্তু সমস্যার সমাধান আর কিছু হল না।

এদিকে নিয়মমতো পার্ট মুখস্থ করে যাচ্ছি অথচ মনে জুৎ পাচ্ছি না।

এমনি সময় হঠাৎ একদিন অফিসে আমায় ধরে বসলেন আমাদেরই অফিসের বড়োবাবু গোরাচাঁদবাবু।

জিজ্ঞেস করলেন— ‘অরুণ, তোমার মুখটা ক’দিন ধরে কেন ভার ভার দেখছি ভাই? কী হয়েছে বলো তো।’

আমি তাঁকে অকপটে সব কথা বলি।

গোরাচাঁদবাবু শুনে বললেন— ‘আরে, এই ব্যাপার? তা এতদিন কেন বলোনি? মিথ্যে মুখ ভার করে বসে আছ কেন? আরে আমি কি তোমার পর? একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবেই। আর ওপরওয়ালাকে ম্যানেজ করার ভার তো আমার ওপর! তোমার জন্যে আর এটুকুও করতে পারব না!’

কৃতজ্ঞতায় আমি গলে গিয়ে বলি— ‘দেখুন, ফিল্মে নামার আমার বড্ড শখ। কিন্তু চাকরি ছেড়ে দিয়ে এদিকে যেতেও সাহস হচ্ছে না। কারণ জানেন তো আমার অবস্থা।’

হেসে বড়োবাবু বললেন,— ‘কুছ পরোয়া নেই ব্রাদার, তুমি এগিয়ে যাও, তোমাকে দেখার ভার আমার ওপর ছেড়ে দাও। আর ছবিটা উঠলে আমাকে দেখাতে ভুলো না।’

এই প্রসঙ্গে আরও দু’জনার নাম উল্লেখ না করে পারি না, যাদের অকৃত্রিম স্নেহ আর বন্ধুত্বের জোরেই আমি আরও তিন বছর চাকরি করতে পেরেছিলাম। তাঁরা হলেন লালচাঁদবাবু আর শ্যামবাবু।

অভিনেতা উত্তমকুমারকে হয়তো আপনারা কোনোদিনই দেখতে পেতেন না যদি না সেদিন অফিস থেকে এঁরা আমাকে সাহায্য করতেন।

তাঁদের স্নেহ, ভালোবাসা আর বন্ধুত্বের কথা আমি আমরণ স্মরণ রাখব।

অফিসের ব্যবস্থা একরকম হয়ে গেল। এইবারে স্যুটিং এর দিনের জন্যে আমি প্রস্তুত হতে লাগলাম।

দিনও একদিন পড়ল। গেলাম ইন্দ্রপুরী স্টুডিওতে। কারণ ওখানেই আমাদের তখন ‘ওরে যাত্রী’ তোলা হচ্ছে।

কিন্তু তখন স্টুডিওর পরিবেশ আজকের মতন ছিল না। একদল লোক সদাসর্বদা সেটের মধ্যেই বসে থাকতেন। তাঁরা না শিল্পী না টেকনিশিয়ান।

অথচ তাঁদের সঙ্গে পরিচয় থাকত সব পরিচালক আর প্রযোজকদের।

শুধু তাই নয়, বড়ো বড়ো শিল্পীদের সঙ্গেও তাঁদের ঘনিষ্ঠভাবেই পরিচয় থাকতো।

নতুন কোনো ছেলে বা মেয়েকে স্টুডিওর মধ্যে আসতে দেখলেই তাঁরা তাঁদের সমস্ত শক্তি নিয়ে পরিচালক আর প্রযোজককে বোঝাবার চেষ্টা করতেন, নতুন ছেলে বা মেয়েটার কিছু হবে না। পত্রপাঠ যেন তাকে বিদায় দেওয়া হয়।

এক্ষেত্রে একটা কথা না বলে পারি না। বর্তমানের বিখ্যাত অভিনেত্রী চিত্রতারকা রমা বা সুচিত্রা সেন কেও এঁরা বাদ দেননি।

একজন মন্তব্য করেছিলেন, এ মেয়ের দ্বারা কিছু হবে না। তাঁর কথাকে মিথ্যা প্রমাণ করে আজ সুচিত্রা গৌরবের আসনে বসেছেন। এইসমস্ত লোকেরা জানেনও না তাঁদের ওই ধরনের কথাবার্তা তরুণ-তরুণীদের মনে কতখানি হতাশা এনে দেয়।

আমার জীবনেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। পরিচালকের নির্দেশে মেকআপ-ম্যানের কাছ থেকে মেকআপ নিয়ে গেলাম ফ্লোরে।

করছি এক ডাক্তারের পার্ট। স্টেথিসকোপ গলায় জড়ানো। অপরদিকে আমার রোগিণী সেজেছেন মঞ্চ ও পর্দার বিখ্যাত অভিনেত্রী প্রভা দেবী।

প্রথম সীনেই আমি তাঁর নাড়ি পরীক্ষা করব। মুখে আলো ফেলা হল। ওদিকে ‘মনিটার’ শুরু হবে, অর্থাৎ ক্যামেরা চালাবার পূর্বে ক্যামেরাম্যান, পরিচালক এবং সাউণ্ডম্যান দেখে নেবেন দৃশ্যটা কেমন উঠছে।

যতক্ষণ না ওঁদের মনঃপূত হবে ততক্ষণ এই ধরনের মনিটার চলতেই থাকবে, আর অভিনেতা-অভিনেত্রীদের তাঁদের নির্দেশ মেনে বার বার একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি করে যেতে হবে।

আগেই বলেছি, আমার চেহারা ছিল রোগা। তার ওপর এই ধরনের একটা অভিনয়ের উত্তেজনাও কম নয়। ভেতর ভেতর বেশ নার্ভাস হয়েছিলাম। মুখে আলো পড়তেই, সেই অবাঞ্ছিত দলের মধ্যে থেকে একজন বলে উঠলেন— ‘রাজেনদা, এ কলির ভীমকে কোথা থেকে পেলেন? পায়ে পাথর বেঁধে না রাখলে ঝড় দিলে উড়ে যাবে যে!’ কথাটা শাণিত ছুরির মতো গিয়ে বিঁধল আমার মনের ওপর।

আর একজন মন্তব্য করলেন— ‘একেবারে নতুন আমদানি হয়েছে যে গাঁ থেকে!’

একেই নার্ভাসনেস আর উত্তেজনায় আমার আগেই হাত পা ঠাণ্ডা হতে আরম্ভ করেছিল, এ ধরনের মন্তব্য শুনে শুরু হল কাঁপুনি।

ঠিক এমনি সময় পরিচালক নির্দেশ দিলেন— ‘অর্ডার! Now you boy, এগিয়ে গিয়ে তোমার patientকে examine করো।’

অগত্যা গেলাম এগিয়ে। জলতেষ্টায় তখন আমার গলা শুকিয়ে গেছে।

নাড়ি দেখবার জন্যে প্রভা দেবীর হাত ধরলাম। আমার ঠাণ্ডা হাতের স্পর্শ পেয়ে প্রভা দেবী চোখ তুলে আমার মুখের দিকে চাইলেন। তারপর বললেন— ‘এ ছেলে অভিনয় করবে কী! এর তো এখনই হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে জমে এসেছে। এ তো কাঁপছে ভয়ে।’

বলতে বাধা নেই, তখন আমার হাত এত বেশি কাঁপছিল যে প্রভা দেবীও তা পরিষ্কার বুঝতে পেরেছিলেন।

ভিড়ের মধ্যে থেকে মন্তব্য হল— ‘চেহারা দেখেই আমাদের মালুম হয়েছে। আগেই বলেছিলুম এর দ্বারা কিসসু হবে না।’

আমার দ্বারা হবে না! কথাটা শুনে আমার সারা মন প্রাণ হতাশায় ভরে গেল। কিন্তু কেন হবে না, তা তো কেউ কিছু বললেন না।

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. ১৯১৯ সালে কলিকাতায় দীপক মুখোপাধ্যায়ের জন্ম। বাবার নাম দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। দীপক মুখার্জির আসল নাম কানাইলাল মুখোপাধ্যায়। জ্যাঠতুতো ভাই পরিচালক অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায় তাঁর ভাই দীপককে প্রথম নায়ক চরিত্রে সুযোগ দিলেন, তাঁর ‘পূর্বরাগ’, ছবিতে। এরপর ‘স্বপ্ন ও সাধনা’, ‘শাঁখা সিঁদুর’, ‘জ্যোতিষী না ৪২০’, ‘দাসীপুত্র’, ‘ওরে যাত্রী’, ‘হারানো সুর’, ইত্যাদি আরো কিছু ছবিতে দীপকবাবুকে দেখা গেছে। শুরু করেছিলেন নায়ক হিসেবে, শেষে ভিলেন হলেন। ‘শরৎ’ নামে একটি হিন্দি ছবিতেও অভিনয় করেন। ১৯৫৪ সালে অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় রঙমহলে ‘উল্কা’ নাটকে প্রথম মঞ্চে নামেন। ‘অরুণাংশু’-র বীভৎস মেক-আপসহ প্রায় আড়াই বছরের বেশি সময় ধরে অসাধারণ অভিনয় করেন ‘উল্কা’ নাটকে। এরপর, ১৯৫৬ সালে ‘শেষলগ্ন’ নাটকে শেষবারের জন্য মঞ্চে নামেন। অপেশাদার মঞ্চে ‘বৌবাজার ওল্ড ক্লাব’ প্রযোজিত ও নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত ‘সাহেব বিবি গোলাম’ নাটকে ‘ভূতনাথ’ চরিত্রে মনে রাখার মতো অভিনয় করেন দীপক মুখোপাধ্যায়। সম্ভবত, ৫০-এর দশকের শেষের দিকে অকাল প্রয়াত হন এই অভিনেতা।
  2. ‘রমা’ হচ্ছেন সুচিত্রা সেন। জন্ম ১৯২৯ সালে পাটনায় মামারবাড়িতে। আসল নাম ‘রমা’। ডাকনাম ‘কৃষ্ণা’। উত্তমকুমারের সঙ্গে জুটিতে সুচিত্রা অভিনীত ছবিগুলি বাংলা তোলপাড় করে দিয়েছিল। আজও এর রেশ বর্তমান। সুচিত্রা সেন প্রথম বীরেশ্বর বসুর ‘শেষ কোথায়’ ছবিতে অভিনয় করেন ১৯৫২ সালে। কিন্তু তা মুক্তি পায়না। যা ১৯৭৪ সালে কিছুটা অংশ নতুন করে অভিনয় করে কিছুটা পুরোনো অংশ রেখে ‘শ্রাবণসন্ধ্যা’ নামে মুক্তি পায়। প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি সুকুমার দাশগুপ্ত পরিচালিত ‘সাত নম্বর কয়েদী’ (১৯৫৩)। একই বছরে প্রথম ‘উত্তম-সুচিত্রা’ জুটির প্রথম ছবি ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ মুক্তি পায়। ১৯৫৪ সালে অগ্রদূত পরিচালিত ‘অগ্নিপরীক্ষা’ ছবিতে এই জুটির জনপ্রিয়তা তুঙ্গে ওঠে। ‘শাপমোচন’, ‘সবার উপরে’, ‘চাওয়া-পাওয়া’, ‘বিপাশা’, ‘ইন্দ্রাণী’ একের পর এক ছবিতে উত্তম-সুচিত্রা জুটিতে রোম্যাণ্টিক সম্পর্কজাত গল্পসমৃদ্ধ চিত্ররূপ বাঙালি সমাজে আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল। অন্যান্য ছবির মধ্যে ‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য’, ‘স্মৃতিটুকু থাক’, ‘দীপ জ্বেলে যাই’, ‘উত্তর ফাল্গুনী’ ইত্যাদি ছবিতে অবিস্মরণীয় অভিনয় করেছিলেন সুচিত্রা। অজয় কর পরিচালিত ‘সাতে পাকে বাঁধা’ ছবির জন্য ১৯৬৩ সালে মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে ‘শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী’-র সম্মান পান। ‘মুসাফির’, ‘দেবদাস’, ‘বোম্বাই কা বাবু’, ‘মমতা’, ‘আঁধি’, ইত্যাদি হিন্দি ছবিতেও অভিনয় করেন সুচিত্রা সেন। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় ও রবীন চট্টোপাধ্যায়ের সুরে ১৯৫৯ সালে একটি রেকর্ডে দুখানি বাংলা গান গেয়েছিলেন সুচিত্রা সেন। গত শতকের ৫-এর দশকে একবারই কলকাতা বেতার কেন্দ্রে বিষ্ণুপ্রিয়া চরিত্রে বেতার নাটকে অংশ নিয়েছিলেন। ‘পদ্মশ্রী’ সম্মান পেয়েছেন। এই কিংবদন্তি নায়িকা ১৯৭৮ সালে ‘প্রণয় পাশা’ ছবিতে অভিনয় করে, নিজেকে অন্তরালে নিয়ে চলে যান।
  3. প্রভা দেবী ( ১৯০৩-১৯৫২) ছিলেন বাংলা নাট্যমঞ্চের এক বিরাট মাপের অভিনেত্রী। মা বিন্ধ্যবাসিনী দেবী থাকতেন প্রখ্যাত অভিনেত্রী তিনকড়ির কাছে। ইনিই নৃত্যশিক্ষক ললিত গোস্বামীর কাছে ছোট্ট প্রভাকে নাচ শিখতে পাঠান। মিনার্ভা থিয়েটারে প্রথম এক বালকের চরিত্রে ‘জয়দেব’ নাটকে অভিনয় করেন। ম্যাডান কোম্পানির হয়ে সখির দলে নাচ ও গান করেন। ১৬ বছর বয়সে প্রথম ‘রত্নেশ্বরের মন্দির’ নাটকে বাণীবিনোদ নির্মলেন্দু লাহিড়ির বিপরীতে নায়িকা চরিত্রে রূপদান করেন। এরপর ‘আলমগীর’ নাটকে প্রথম নাট্যাচার্য শিশির ভাদুড়ির সঙ্গে অভিনয় করেন। এরপর, নাট্যাচার্যের সঙ্গে একের পর এক নাটকে অভিনয়। ১৯৩০ সালে এই দলের সঙ্গে আমেরিকায় নাটক করতে যান। শিশিরবাবুর দল ছাড়াও অন্যান্য দলেও অভিনয় করেন। প্রভা দেবী শেষবারের মতো রঙমহলে ‘সেই তিমিরে’ (৬/১/১৯৫২) নাটকে মঞ্চে নামেন। ‘ম্যাডান থিয়েটার’-এর জ্যোতিষ বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত ‘মাতৃস্নেহ’ (১৯২৩), ‘পাপের পরিণাম’ (১৯২৪), ‘বিষবৃক্ষ’ (১৯২৮)- তিনটি নির্বাক ছবিতে অভিনয় দিয়ে চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করেন। এরপর, সবাক যুগের ‘পল্লীসমাজ’, ‘টকি অব টকিজ’ ইত্যাদি বেশ কয়েকটি ছবিতে প্রভা দেবী অভিনয় করেন। তাঁর শেষ ছবি সম্ভবত ঋত্বিক ঘটক পরিচালিত ‘নাগরিক’, যা তাঁর মৃত্যুর পর মুক্তি পায়। প্রভা দেবী গানও লিখেছেন। তাঁর লেখা একটি গানের সংকলন ‘গীতায়ন’, গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় অ্যাণ্ড সন্স থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। শিশিরবাবুর ভাই অভিনেতা তারাকুমার ভাদুড়িকে বিয়ে করেন প্রভা দেবী। প্রভা দেবীর সুযোগ্য পুত্র ও কন্যা যথাক্রমে অভিনেতা চপল ভাদুড়ি ও অভিনেত্রী কেতকী দত্ত।