উত্তমকুমার চট্টোপাধ্যায়
হারিয়ে যাওয়া দিনগুলি মোর
আট
গৌরী তো বলে গেল সে আসছে। কিন্তু সে ‘আসার’ অর্থ কী? কী করে কথা বলবে? কেমন করে আরম্ভ করবো কথা? কেমন করে আমার ফিল্মে নামার কথাটা পাড়বো? আবার ফিল্মে নামার কথা শুনে যদি ‘না’ বলে? তাহলে কেমন করে তাকে বোঝাবো যে ঐ রুপালি আলোর খেলা আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে তারই মতো!
একটু প্রকৃতিস্থ হতেই প্রশ্নগুলো যেন হুড়মুড় করে আমার মাথার মধ্যে উঠে পড়লো। শুধু কি উঠে পড়া? আমার সমস্ত স্নায়ুতে রক্তে, তারা ছুটোছুটি শুরু করলো। আর তাদের সেই ছুটোছুটিতে আমিও যেন কেমন হয়ে পড়লাম। সমস্ত ধাক্কা কাটিয়ে যখন প্রকৃতিস্থ হলাম, তখন দেখি রমেশ মিত্র রোড থেকে সোজা কেমন করে চলে এসেছি আমাদের গিরিশ মুখার্জী রোডের বাড়ির সামনে। অকারণে বাড়ির সামনে ঘোরাঘুরি করা যায়না, তাই ঢুকে পড়লাম বাড়িতে।
মা’র কাছ থেকে খাওয়াদাওয়া সেরে নিলাম। ঘড়ির কাঁটার দিকে অধীর প্রতীক্ষায় কেবলই চাইছিলাম। কারণ গৌরী আসবে বলেছে।
আজ বলতে বাধা নেই, সেদিন কেবলই মনে হয়েছিল ঘড়িগুলো যেন আমার সঙ্গে শত্রুতা করে একসঙ্গে স্লো হতে আরম্ভ করেছে।
খাওয়াদাওয়া চুকিয়ে আবার সেই অধীর প্রতীক্ষা। তবে আজ আর হারমোনিয়াম নিয়ে নয়। গান শুনিয়ে শব্দভেদী বাণও ছুঁড়তে হবেনা। আজ পরিষ্কার যা হয় একটা হয়ে যাবে। আজ ঠিক বুঝতে পারবো ও আমায় ভালোবাসে, না মাছিমারা কেরানী বলে ঘৃণা করে!
একবার মনে হলো, গৌরী বোধহয় সত্যি আমায় ভালোবাসে না। পরক্ষণে মনে হলো তাহলে ‘তুমি’ বলার অর্থ? আর আমাকে কেনই বা ও বললে—এখুনি আসবে বাড়িতে? খেলা করছে নাতো আমায় নিয়ে? দূর বাপু! আর চিন্তা করতে পারি না, কেমন যেন হতাশা এসে গেল।
তাছাড়া সন্ন্যাসীঠাকুর তো আমাকে বলেইছেন, গৌরীর সঙ্গে আমার—মানে—ইয়ে, বিয়ে হবে। তবে আর কি ভাবনা? তাঁর সব কথা অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাচ্ছে। তবে, গৌরীকে না পাওয়া অবধি সম্পূর্ণ বিশ্বাস করি কি করে?
যাক, আর ভাববো না। আশু মিলনের জন্যে নিজেকে প্রস্তুত করা ভালো।
সূর্য তখন অস্ত গেছে। বাড়িতে বাড়িতে সন্ধ্যার শাঁখও বেজে উঠেছে। প্রতি বাড়িতে ছেলেমেয়েরা তখন বই নিয়ে বসবার উপক্রম করছে।
গৌরী এসেছে আমাদের বাড়িতে প্রায় আধঘণ্টার ওপর। কিন্তু এতক্ষণ তার সঙ্গে কথা বলবার সুযোগ পাইনি। অন্নপূর্ণা আছে। আমি ঘুরঘুর করছি। এমনি সময় অন্নপূর্ণা এসে আমাকে বললো— ‘দাদা, তোমার কোনো কাজ আছে?’
আমি বললাম— ‘কেন রে?’
— ‘গৌরীর দারোয়ানটা এখনও আসেনি, তাই সে যেতে পারছে না, ওকে যদি একটু এগিয়ে দাও।’ গম্ভীর হয়ে গিয়ে বলি— ‘এত ঝঞ্ঝাটও তোরা পাকাতে পারিস! আমি এখন কাজ ছেড়ে যাই কি করে বল তো?’ আমার এ চালটা অন্নপূর্ণা বুঝেছিল কিনা জানি না, তাই সে কেবল উত্তরে বললো— ‘বেশ, তোমার সময় যদি না হয়, তাহলে আমি অন্য কাউকে বলি।’ সর্বনাশ, অন্নপূর্ণাটা বলে কী! মানে, এইটুকুর জন্যে আমি যে এতক্ষণ অধীর প্রতীক্ষা করছি। গৌরীকে একা পাবো। ভালো হোক, মন্দ হোক, দু চারটে কথা তার সঙ্গে বলবো, ইডিয়েটটা বলে কিনা ‘অন্য কাউকে বলবো’। মান সম্মান আর রাখলে না দেখছি! তাই তাড়াতাড়ি গলার আওয়াজ মিষ্টি করে বলি— ‘না, এমন কী কাজ, বলছিস যখন—চল।’
ঠিক এমনি সময় ঘরের মধ্যে ঢোকে গৌরী। আমার দিকে চেয়ে বলে— ‘দেখুন, বড়ো মুশকিলে পড়েছি। এদিকে রাত্তির হয়ে যাচ্ছে। দারোয়ানটা কী জানি কেন, এলোনা এখনও। আপনি যদি একটু পৌছে দেন। নইলে দাদু, ঠাকুমা, বাবা, মা সকলে ভাববেন যে।’
— ‘আমি, মানে ইয়ে, আপনাকে পৌছে দেব?’
বুঝতে পারলাম গৌরী এতক্ষণ দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে আমাদের কথাবার্তা শুনছিল। ভাগ্য সুপ্রসন্ন বলতেই হবে। ঠিক সেই সময় অন্নপূর্ণাকে কে যেন ডাকলো।
— ‘যাই’ বলে সাড়া দিয়ে, ‘আমি এখুনি আসছি’ বলে সে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। ঘরের মধ্যে তখন রইলাম, আমি আর গৌরী। তাড়াতাড়ি চাপা স্বরে গৌরী আমায় প্রশ্ন করে— ‘আমাকে কী যেন বলতে গিয়েছিলে স্কুলে?’
বুকের রক্তটা আমার ছলাৎ করে উঠলো তার সেই ‘তুমি’ ডাক শুনে।
নিজেকে সংযত করে নিয়ে বলি— ‘আমি, মানে, একটা বড়ো বিপদে পড়েছি।’
বিস্মিত হয়ে গিয়ে গৌরী বললো— ‘বিপদ, কী বিপদ?’
নাঃ, আর চেপে রাখা যায় না। বলেই ফেললাম— ‘গৌরী, আমি সিনেমায় নামছি। এ ব্যাপারে তোমার মতটা কী তাই জিজ্ঞাসা করছি।’
— ‘আমার মত? তাতে কী দরকার?’
চোখ তুলে দেখি গৌরী আমার দিকে চেয়ে আছে তীব্রভাবে।
নাঃ, এই সুবর্ণ সুযোগ, যা হবার হোক। বলেই ফেললাম তাকে— ‘কারণ, আমি তো—তোমায় ভালোবাসি।’
গৌরী আমাকে প্রশ্ন করে— ‘তাহলে একটা কথা বলো! সিনেমায় নেমে আমায় ভুলে যাবে না কোনোদিন?’
— ‘তোমায়? তোমায় ভুলবো আমি?’
আবেগে উচ্ছৃসিত হয়ে কী যেন বলতে গিয়েছিলাম সেদিন।
মুখে আঙুল দিয়ে সে আমায় কথা বলতে বারণ করে। ঘরের দরজা দেখিয়ে দিয়ে ইশারা করে বলে— ‘কে যেন আসছে।’
পরমুহূর্তেই অন্নপূর্ণা ঘরের মধ্যে ঢোকে। কী বলতে হবে, না বুঝতে পেরে ভ্যাবাগঙ্গারামের মত চেয়ে থাকি তার দিকে, অপলকদৃষ্টিতে।
তাড়াতাড়ি কথার মোড় ঘুরিয়ে দিয়ে গৌরী বলে— ‘আর দেরি করিসনে অন্নপূর্ণা, তোর দাদাকে বলনা ভাই, আমাকে তাড়াতাড়ি পৌঁছে দিতে।’
বাড়ি থেকে বেরিয়ে আমরা এলাম রাস্তায়। পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে আমি জিজ্ঞাসা করি— ‘কী ব্যাপার বলো তো? আজ তোমাদের দারোয়ান এলোনা যে?’
গৌরী বলে— ‘এটুকুও বুঝতে পারলে না? বাড়িতে যদি তোমার সঙ্গে কথা বলবার সুযোগ না পাই, তাই আমি দারোয়ানকে আসতে বারণ করে দিয়েছি। তাইতো দারোয়ান আজ আসেনি।’
আমি বলি— ‘গৌরী, তুমি কী করে বুঝলে আমি তোমায় ভালোবাসি?’
হাসতে হাসতে গৌরী জবাব দিলো— ‘মেয়েমানুষের কি পুরুষের ভালোবাসা বুঝতে দেরি হয়? আর তারই মধ্যে সে বুঝে নেয় কোনটা আসল আর কোনটা মেকি।’
‘কিন্তু আমার যে এখনও একটা কথা জানা হয়নি!’ শান্ত অথচ গম্ভীর কণ্ঠে গৌরী প্রশ্ন করে— ‘কী বলো?’
— ‘তুমি কি আমায়’—
হাসিতে ফেটে পড়ে সে জবাব দেয়— ‘তা যদি না বুঝতে পেরে থাকো, তা হলে বুঝেও আর দরকার নেই।’
কথাটা শুনে নিজের কানকে নিজেরই বিশ্বাস হল না।
তবুও সন্দেহ দূর করবার জন্যে তার কাছে গিয়ে প্রশ্ন করি— ‘কেরানী বলে তুমি আমায় ঘেন্না করো না?’
আমার হাতটা নিজের হাতের মধ্যে টেনে নিয়ে সে জবাবে বলে— ‘মেয়েমানুষ কি তার প্রিয়তমের আর্থিক অবস্থার কথা কোনোদিন চিন্তা করে? সে সবসময় ভাবে তার স্বামীর ঘরই আপনার।’
স্বামী! কথাটা যেন কানের ভেতর ঘুরপাক খেতে লাগলো।
কিছুদিন আগে কীর্তনে একটা চণ্ডীদাসে১ ২৬র লেখা গান শুনেছিলাম— ‘কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো আকুল করিল মোর প্রাণ’।
তখন ব্যাপারটা বুঝতে পারিনি, আজ হাতেনাতে তা অনুভব করলাম। উঃ কী মিষ্টি ডাক! কল্পনায় যে সম্বন্ধ কতবার মনে মনে স্থাপন করেছি, রাত্রে ঘুমোতে ঘুমোতে যাকে নিজের বুকের ওপর কতবার স্বপ্নে পেয়েছি, সেই গৌরী আমাকে, আমার সেই চির-আকাঙ্ক্ষিত সম্বন্ধ ধরে সম্বোধন করলো?
বাংলা ভাষায় ‘ধরাকে সরা জ্ঞান’ বলে একটা কথা আছে। সেই ধরাকে সরা চোখে দেখা যে কী জিনিস এতদিন জানতাম না।
আজ বলতে বাধা নেই আমিও যেন চোখে সরা দেখতে আরম্ভ করলাম সেই সন্ধের সময়। বাড়ি, ঘর, দোর, রাস্তা, গাড়ি, ঘোড়া সবকিছু মুছে গেল আমার চোখের সামনে থেকে। আমার কল্পনালোকে কেবল রইলাম আমি আর গৌরী, গৌরী আর আমি।
চমক ভাঙলো গৌরীর ডাক শুনে। প্রকৃতিস্থ হয়ে বলি— ‘কী বলছো আমাকে?’
সে বলে— ‘এতো ঢিমে তেতালায় চললে বাড়ি পৌঁছতে যে একমাস লেগে যাবে, একটু জোরে চলো।’
আমিও বলি— ‘চলো।’
তারপরে জিজ্ঞেস করি— ‘গৌরী, তুমি আমায় কবে থেকে ভালোবাসো?’
ফিক করে হেসে ফেলে গৌরী বলে— ‘যবে আমি তোমাদের বাড়িতে প্রথম গিয়েছিলাম। তুমি বাইরে দাঁড়িয়েছিলে, আমি তোমায় জিজ্ঞেস করলাম, অন্নপূর্ণা আছে কি না? তুমি আমাকে উত্তরে বললে—দেখুন না, বাড়ির মধ্যে সে আছে কিনা?’
— ‘সেই দিন থেকে, কী আশ্চর্য!’
কথায় কথায় গৌরীর বাড়ির কাছে এসে পড়েছিলাম।
গৌরী বললে— ‘আজ এই পর্যন্ত।’
আমি জিজ্ঞেস করি— ‘আবার কবে দেখা হবে?’
সে বললো— ‘খুব শিগগিরি। তোমাদের বাড়িতে আমি আবার যাবো।’
গৌরীকে পৌছে দিয়ে সেদিন ফিরে আসতে আসতে কেবলই মনে হয়েছিল, মিথ্যা নয়, কল্পনা নয়, সত্যি গৌরী আমায় ভালোবাসে। তার প্রমাণ আজ আমি হাতে হাতে পেয়েছি। রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে কেবলই মনে হয়েছে, খানিকটা আগে যা ঘটে গেল, তা কল্পনা না বাস্তব। বোধহয় এমন চিন্তা অনেকেরই মনে হয়। কারণ ঘটনার সমাপ্তির পর সুখ, দুঃখ, বেদনার যে অনুভূতিই মানুষের মনে হোকনা কেন, তার ঝঙ্কার থেকে যায় মানুষের মনের মধ্যে। আর সেই ঝঙ্কারের রেশ ধরে মানুষ কখনও কাঁদে, কখনও হাসে।
হাসি-কান্নাটা কিছুই নয়, সেটা হলো তার বহিঃপ্রকাশ। অন্তরের ঝঙ্কারই হল আসল। তাই রাস্তায় চলতে চলতে গুনগুন করে ধরলাম রবিবাবুর সেই গান— “শেষ গানেরই রেশ নিয়ে যাও চলে, শেষ কথা যাও বলে।”
গণেশদার সঙ্গে স্টুডিওর দরজা পার হলাম। মুখে রঙও মাখলাম। বর সেজে ক্যামেরার সামনে বসলাম।
ফটাস করে ‘ক্ল্যাপস্টিক’ টানা হল। ক্যামেরার হাতল ঘুরতে লাগলো ঘরঘর করে। আমারও বুকের ভেতর করতে লাগলো গুড়গুড়।
স্যুটিংএর পর সেদিন মনে হয়েছিল, বায়োস্কোপে ছবি তোলা কী শক্ত রে বাবা! থিয়েটার করেছি, যাত্রা করেছি—এতো শক্ত বলে মনে হয়নি। কিন্তু আজকে এই একটা ছোট্ট সেটের মধ্যে গোটাকতক আলোর সামনে অভিনয় করতে একেবারে ঘেমেনেয়ে গেলুম।
আমার দ্বারা বোধহয় ‘ফিল্মে’ অভিনয় করা আর হবে না।
কিন্তু মন এ কথা মেনে নিতে পারলো না। সন্ন্যাসীঠাকুর যে বলেছেন—আমি বড়ো অভিনেতা হব! তার চিহ্ন তো দেখতে পাচ্ছি না! আমার কেমন যেন তখন ধারণা জন্মে গেছে, তাঁর কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি হবেই। কারণ গৌরী আমাকে বলেছে—ও আমাকে ভালোবাসে। একটা কথা যদি তার সত্যি হয়, আর একটা হবে না কেন? আর যা ঘটবার তা যখন ঘটবেই, তা নিয়ে আমি আর অত মাথা ঘামাই কেন? অপেক্ষা করেই দেখি, সুযোগ আর সুবিধে কীভাবে আসে আমার জীবনে!
একদিন অফিসের পর সাউদার্ন পার্কে যাই ফুটবল খেলতে। খেলাধুলো করা আমার নিত্যকার অভ্যেস তখন। ভালো খেলতেও পারতাম। আজও স্টুডিও ফেরত গাড়ি করে যেতে যেতে, ময়দানে বা পার্কে যখন দেখি ছেলেরা ফুটবল খেলছে, তখন আমারও ইচ্ছে হয় গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে ‘সট’ মারি ঐ বলে। কিন্তু তা আর হয়না। মনের ইচ্ছে আমাকে মনেই চেপে রাখতে হয়—কারণ আজ আর আমি উনিশ কুড়ি বছরের ছেলে নই।
হাতেনাতে প্রমাণও হয়ে গেল সেদিন। আগামী ছবি ‘সপ্তপদী’২ ২৭র একটা ফুটবল খেলার দৃশ্য তুলতে পরিচালক আমায় নিয়ে গিয়েছিলেন ফুটবল গ্রাউণ্ডে।
বাঁধা গরু ছাড়া পেলে যেমন সে ছুটোছুটি করে, আমিও তেমনি বলের সঙ্গে ছুটোছুটি করছিলুম।
পরিচালক অবশ্য অনেকবারই আমায় বারণ করেছিলেন অমনটি করতে, কিন্তু কে শোনে কার কথা। ভুলে গেলাম আমি আমার বয়স, ভুলে গেলাম স্থান, কাল, পাত্র। ভুলে গেলাম আমি উত্তমকুমার, তারাশঙ্করবাবুর লেখা ‘সপ্তপদী’র নায়ক কৃষ্ণেন্দুর চরিত্রে আমি অভিনয় করছি। আমার মনে হল আমি ফিরে গেছি আমার সেই অতীত জীবনে, যখন অফিস, খেলা আর গৌরীর চিন্তাই ছিল আমার একমাত্র লক্ষ্য। সম্বিৎ ফিরলো যখন, অনভ্যাসের ফলে পা মচকালো। মুহূর্তেই পা ফুলে উঠলো। ফিরতে হল বাড়িতে। দুদিন আবার বাড়িতে হলাম বন্ধ। ছেলেবেলাকার দিনগুলোর মতনই মা নিয়ে এলেন চুন আর হলুদ গরম করে। একরকম ধমকে, লাগিয়ে দিলেন প্রলেপ। আমার মনে হল, এখনও মা’র চোখে বোধহয় আমি সেই তেমনি ছোটো ছেলেটিই আছি। এত ভালো লেগেছিল সেই দুটো দিন।
যাক যখনকার কথা বলছিলাম, ফিরে যাই আমার সেই কাহিনিতে।
ছুটোছুটি করে রীতিমতো তখন খেলাধুলো করছি এমনি সময় সেখানে উপস্থিত হলেন ধীরেনবাবু৩। আমাদের যাত্রা থিয়েটারের ‘ড্রেস’ সাপ্লায়ার ছিলেন তিনি।
আজকাল ফিল্মেও ড্রেস সাপ্লাই দিচ্ছেন। কাছে এসে বললেন— ‘অরুণ, শোনো! বায়োস্কোপের ছবিতে নামবে?’
জিজ্ঞেস করলাম— ‘কী বই? কী পার্ট?’
উত্তরে ধীরেনবাবু বললেন— ‘এস. বি. প্রোডাকসনের—রবীন্দ্রনাথের ”দৃষ্টিদান”। পার্ট বিশেষ কিছু নয়! করবে তুমি অভিনয়?’
মত তো আগের থেকে সকলকার নেওয়াই আছে। তাই মাথা নেড়ে জানালাম— ‘হ্যাঁ।’
মাথা তুলে দেখলাম গৌরী দারোয়ানের সঙ্গে পথ দিয়ে কোথায় যাচ্ছে। চোখে চোখ পড়ায় সে ফিক করে হাসল।
তারপর?
সূত্রনির্দেশ ও টীকা
- চণ্ডীদাসের জন্ম বীরভূম জেলার নানুর গ্রামে। সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ একজন বৈষ্ণব মতাদর্শের কবি। তবে, চণ্ডীদাসের অস্তিত্ব নিয়ে নানা মত চালু আছে। চণ্ডীদাস নামে ‘বড়ু’, ‘দ্বিজ’, ‘রামী, ‘দীন’, ইত্যাদি একাধিকজনের কথা উঠে এসেছে। তবে, রামী নামে রজকিনীর সঙ্গে যে চণ্ডীদাসের প্রেমের কথা সর্বজনবিদিত এবং যাঁর কাব্যে বারবার এসেছে বাঁশুলি দেবীর কথা, সেই ‘রামী-চণ্ডীদাস’-ই সর্বাধিক আলোচিত হন। এই চণ্ডীদাসের জীবনকথা নিয়ে নিউথিয়েটার্সের প্রযোজনায় ও দেবকীকুমার বসুর পরিচালনায় ১৯৩২ সালে মুক্তিপায় ‘চণ্ডীদাস’ ছবিটি। এতে মুখ্য চরিত্রে ছিলেন দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, উমাশশী দেবী, কৃষ্ণচন্দ্র দে, প্রমুখ বিশিষ্ট অভিনেতা-অভিনেত্রীবর্গ। সংগীত পরিচালক ছিলেন রাইচাঁদ বড়াল।
- তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘সপ্তপদী’-র চিত্ররূপ দেন পরিচালক অজয় কর। ছবিটি মুক্তি পায় ২০ নভেম্বর ১৯৬২। সুপারহিট হয় ছবিটি। নায়ক-নায়িকা হিসেবে উত্তম-সুচিত্রা ছাড়াও এ ছবিতে অভিনয় করেন ছবি বিশ্বাস, তুলসী চক্রবর্তী, তরুণকুমার, ছায়াদেবী, পদ্মাদেবী, প্রীতি মজুমদার প্রমুখ বিশিষ্ট অভিনেতাবর্গ। উত্তম-সুচিত্রার লিপে হেমন্ত-সন্ধ্যার গাওয়া, ‘এই পথ যদি না শেষ হয়.’ সর্বকালের অন্যতম সেরা জনপ্রিয় বাংলা গানটি এই ছবিতেই ছিল। এ ছবির সংগীত পরিচালক ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। ছবিতে ‘কৃষ্ণেন্দু’ ও ‘রীনা ব্রাউন’-এর চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেন উত্তমকুমার ও সুচিত্রা সেন।
- ‘ধীরেনদা’ হলেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। ইনি সিনেমা ও থিয়েটারে ড্রেস মেটিরিয়াল সরবরাহকারী তৎকালীন প্রখ্যাত দোকান ‘নিউ স্টুডিও সাপ্লায়ার্স’-এর মালিক ছিলেন। অভিনয়মহলে ধীরেনবাবু অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন। এনার দোকানটি ছিল টালিগঞ্জ অঞ্চলের চারু এভিন্যু-এ।