উত্তমকুমার চট্টোপাধ্যায়

হারিয়ে যাওয়া দিনগুলি মোর

ষোল

তুলসীদার মৃত্যুর পর থেকেই বুঝতে পেরেছি মৃত্যু কত সত্য। বাবার মৃত্যুতে শোকে অভিভূত হয়েছিলাম। তাই জীবনকে বোঝবার বা দেখবার সুযোগ তখন পাইনি। দিদির মৃত্যুতে শিশুসুলভ চপলতায় মনে করেছিলাম, দিদি আবার ফিরে আসবে। কিন্তু, আজ বুঝতে পারছি, ও পথে যে যায়, সে আর ফেরে না। জীবনের যবনিকা পড়লে আর ওঠে না। সেখানে শুরু হয় নতুন নাটক।

আমাদের বাড়িতে একদিন উপনিষদ পড়তে পড়তে একজন বলেছিলেন, ‘নান্যঃ পন্থা মৃতুরেতি,’ মৃত্যু ছাড়া অন্য পথ নেই। ভেবেছিলাম, তবে এই যে বাড়ি, এই গাড়ি, জীবনের যে রঙিন স্বপ্ন, এর সবটাই মিথ্যে? যদি মিথ্যেই হয় তবে কোটি কোটি মানুষ কেন ছুটছে এর পেছনে! হাসি পেয়েছিল কথাটা ভেবে। কবিগুরুর লেখা ‘পথের শেষ কোথায়,’ যেদিন পড়েছিলাম সেদিন তার আসল মানে বুঝতে পারিনি। আজ ভাবছি সত্যিই তো, ‘কী আছে শেষে।’ এত প্রীতি, এত ভালোবাসা, মুহূর্তের মধ্যে জীবনের সবকিছু শেষ হয়ে যায়! তাই বোধহয় গীতায় ভগবান বলেছেন, ‘সর্বধর্মান পরিত্যাজ্য মামেক্য শরণং ব্রজ’— সবকিছু ত্যাগ করে, তুমি শুধু আমাকেই ভজনা করো।

আজ বুঝছি, ব্যাপ্ত মনকে যদি তুলে কোনোকিছু অসীমের ওপর দেওয়া যায়, তাহলে বোধহয় জীবনের দুঃখ এত তীব্র হয়ে ওঠে না। উন্মাদ করেও দেয় না। মনে পড়ে যায় শ্রীশ্রীসারদা মায়ের কথা, ‘তাঁতে মন দিলে খাঁড়ার ঘা—ও প্রবল হয়ে আঘাত করে না। প্রবল আঘাতও নরুনের আঘাতের মতন তুচ্ছ হয়ে যায়।’ কিন্তু, কে তা পারার ক্ষমতা রাখে…।

একটা প্রবাদবাক্য আছে ভগবান যখন দেন তখন ছাদ ফুটো করেই দেন।

মানুষ নিজের চেষ্টায় কী করতে পারে? এ প্রত্যক্ষ সত্য আমি নিজের জীবন দিয়েও সেদিন অনুভব করেছিলাম। আমাদের মনের ইচ্ছেগুলোকে যদি তীব্রভাবে আমাদের মনে আমরা জাগিয়ে রাখতে পারি, এবং তাকে ধরে বাকি জীবনটা চেষ্টা করতে থাকি, তাহলে হয়তো একদিন-না-একদিন তা সফল হবেই।

রবার্ট ব্রুসের দৃষ্টান্ত টানতে চাই না। Try, Try, Try again বলে আপনাদের মনও ভারী করতে চাই না। তবে আমার জীবনে সেদিন যে, এ জিনিসের ব্যতিক্রম হয়নি, তাই আপনাদের বলছি।

তীব্র ইচ্ছা ছিল ফিল্মের ‘হিরো’ হবার। সেকথা আগেই বলেছি।

সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও আপনাদের জানিয়েছি, টাকার অভাবও ছিল আমার প্রচুর, সংসারের চাহিদা সামান্য চাকরি করে মিটতও না। তাই, এদিকে আর একটা রোজগারের পথ পাব বলেই আশা করেছিলাম।

শখের যাত্রাদলে আর থিয়েটারে অভিনয় করে, নাম-যশের আশাও কম ছিল না। কিন্তু আগেকার সব ক’টা ছবি আমার জন্যে নিয়ে এসেছিল হতাশা। তাই নিজের আত্মবিশ্বাস তখনও গড়ে ওঠেনি।

নিজের ওপর বিশ্বাস ছিল না বলেই বোধহয় সেদিন ‘এম. পি.’র আমন্ত্রণে যেতে মোটেই ইচ্ছা ছিল না।

যাই হোক, এসে যখন পড়েছি, তখন এঁরা যা বলেন তা আমার শোনা উচিত।

বিমলবাবুর পেছনে পেছনে গিয়ে ঢুকলাম একটা ঘরে। ঘরে বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা ছিল,— ‘বিভূতি লাহা’

বুঝলাম এ ঘরটা তখনকার বিখ্যাত পরিচালকগোষ্ঠীর অন্যতম বিভূতি লাহার ঘর।

ঘরের মধ্যে তখন ‘সহযাত্রী’ ছবির রিহার্সাল হচ্ছে। রিহার্সাল দেওয়াচ্ছিলেন বিখ্যাত অভিনেতা সন্তোষ সিংহ মহাশয়।

বিমলবাবু আমাকে ঘরের মধ্যে নিয়ে গিয়ে সন্তোষবাবুকে উদ্দেশ্য করে বললেন— ‘দেখুন তো, এ ছেলেকে দিয়ে কিছু হয় কি না? ওপরের চেহারাটা তো মন্দ নয়। এখন মাকাল ফল না হলেই বাঁচি!’

সন্তোষবাবু আমাকে পরীক্ষা করতে শুরু করলেন। এদিকে আমারও বুকের ভেতর কে যেন হাতুড়ি পিটতে গুরু করল।

সন্তোষবাবু আমাকে বললেন— ‘আপনার নাম কী?’

আমি বলি— ‘আজ্ঞে, উত্তমকুমার।’

বয়সে কম বলেই বোধহয় তিনি বললেন— ‘হুঁ, চেহারাটা তো উত্তমের মতনই মনে হচ্ছে, এখন গলার আওয়াজ আর অভিনয়টা উত্তম হলেই তো বাঁচি!’

এতক্ষণ বুকের ভেতর বোধহয় স্যাকরার হাতুড়ি পড়ছিল, সন্তোষবাবুর কথা শুনে সেটা হঠাৎ কামারের হয়ে গেল। ভয়ে আমার গায়ে ঘাম দিল। সব রাগ পড়লো গিয়ে বুড়োটার ওপর। কেন আমাকে জোর করে এখানে পাঠাল? আমি তো অভিনয় ছেড়েই দেব ভেবেছিলাম। পাড়াতে শখের দলে যা যাত্রা থিয়েটার করছি তাই করতাম। ফিল্ম করে কী হবে? খানিকটা পরেই তো এঁরা তাড়িয়ে দেবেন। সে অপমানিত আর হতে হত না।

যাক, এসে যখন পড়েছি, তখন তো আর ফেরা যায় না। একটা ভদ্রতা, একটা চক্ষুলজ্জা তো আছে। দেখাই যাক না, শেষ পর্যন্ত কী হয়!

সন্তোষবাবু আমাকে বললেন— ‘কী ভাবছ হে ছোকরা? একটু অভিনয় করে দেখাও!’

আমি বলি— ‘কী অভিনয় করব?’

সামনে রাখা খাতায় লেখা ‘সহযাত্রী’র পাণ্ডুলিপিটা আমার হাতে তিনি তুলে দিলেন। একটা ‘সীন’ বার করে দিয়ে বললেন— ‘এইটা পড়ো।’

‘সীন’টা ছিল কান্নার।

মনকে শক্ত করে নিয়ে আমি পড়ে ফেললাম। বলা বাহুল্য, ভাব দিয়েই পড়বার চেষ্টা করেছিলাম। পড়া শেষ করে চাইলাম সন্তোষদার মুখের দিকে।

বড়ো অভিনেতা তিনি। মুখ দেখে তাঁর মনের ভাব বোঝা ভারী শক্ত।

তাই আমিও ঠিক বুঝতে পারলাম না আমার অভিনয়টা কেমন হয়েছে।

তাড়াতাড়ি তিনি পাতা উলটে পাণ্ডুলিপির আর একটা জায়গা আমাকে পড়তে বললেন।

একই দৃশ্যের ধারা মনে করে পড়তে গিয়ে দেখি কোথায় কান্না, এ যে সম্পূর্ণ বিপরীত— হাসির দৃশ্য!

খানিকটা দাঁড়িয়ে দম নিয়ে নিলুম। তারপর, গলাটা নামিয়ে বেশ ইয়ার্কির ছলেই হাসির দৃশ্যটা পড়তে লাগলাম।

পড়া হয়ে গেলে সন্তোষদা এবারে বললেন— ‘বাঃ মন্দ পড়োনি তো হে! আচ্ছা তুমি এইখানটা এইবার একটু পড়ো!

আগেকার অভিজ্ঞতাতেই বুঝতে পেরেছি সন্তোষদা আমাকে বিভিন্ন ভাবের দৃশ্য পড়তে দিচ্ছেন।

উদ্দেশ্য—কোন ভাবটা আমার ভেতর ভালো ফোটে, তাই দেখা। তাই চেঁচিয়ে পড়বার আগে মনে মনে একবার সেটাকে পড়ে নিয়ে দেখে নিলাম, সেটা কী দৃশ্য। আরে! এটা যে একেবারে নায়িকার সঙ্গে নায়কের প্রেম। যাকে বলে—love scene!

প্রবীণ অভিনেতার সামনে কেমন যেন লজ্জা লজ্জা করল। যা হোক, কুছ পরোয়া নেহি,—নাচতে নেমে ঘোমটা টানলে তো চলে না!

আবেগের সঙ্গে পড়ে ফেললাম দৃশ্যটা। বিমলবাবু সন্তোষদাকে জিজ্ঞেস করলেন— ‘উত্তমকে দিয়ে চলবে তো?’

সন্তোষদা বললেন—হ্যাঁ ঘষলে মাজলে চলে যাবে।

সেইদিনই বিমলবাবু আমার হাতে দিলেন কোম্পানির একটা চুক্তিপত্র। যার অর্থ এম. পি.র নিজস্ব অভিনেতা হিসাবে আমি তিন বছরের জন্য নিযুক্ত হলাম।

এর প্রথম বছরে আমাকে দেওয়া হবে মাসে ৪০০ টাকা করে, দ্বিতীয় বছর দেওয়া হবে ৬০০ টাকা করে, আর তৃতীয় বছরে আমি পাব মাসিক ৭০০ টাকা করে।

এত টাকা! নিজের চোখকেও যেন ভালো করে বিশ্বাস করতে পারলাম না।

চুক্তিপত্রে সেইদিনই সই করে দিলাম আমি। এইখানে বলে রাখা ভালো ‘নিউ থিয়েটার্স’ একসময় বহু অভিনেতা, অভিনেত্রীকে এইভাবে মাইনে করে রেখে দিতেন।

তারপর শ্রদ্ধেয় মুরলীধর চট্টোপাধ্যায় মহাশয় তাঁর এম. পি. প্রতিষ্ঠানে এই রীতির প্রবর্তন করেন।

‘সহযাত্রী’ ছবি উঠবে, নায়ক মনোনীত হয়েছেন অসিতদা। কিন্তু আর একটা ছবির কাজের জন্যে, তিনি এ কাজ করতে পারলেন না।

সুতরাং শিকে ছিঁড়ল আমার। আমিই মনোনীত হলাম নায়কের পার্ট করবার জন্যে। আমার বিপরীতে অভিনয় করবেন তখনকার দিনের প্রখ্যাতা অভিনেত্রী ভারতী দেবী।

ভারতী দেবী প্রথম চিত্রজগতে অভিনয় করেন নিউ থিয়েটার্সের ‘ডাক্তার’ ছবিতে। তাঁর সে ছবি যখন মুক্তি পায় তখন আমি স্কুলের ছেলে। তবে সে অভিনয় আমার মনে রেখাপাত করেছিল। তার কথা আজও আমি ভুলতে পারিনি।

ওই নিউ থিয়েটার্সেরই ‘প্রতিশ্রুতি’ছবিতে অসিতদা প্রথম অভিনয় করেন, এবং তাঁর বিপরীতে তখন ছিলেন ভারতী দেবী।

রোম্যাণ্টিক নায়ক আর নায়িকা হিসেবে তাঁরা তখন নামও করেছিলেন প্রচুর।

সেই ভারতী দেবী অভিনয় করছেন আমারই বিপরীতে।

যাইহোক, রিহার্সাল হল। স্টুডিওর সেটে গেলাম স্যুটিং করতে। স্যুটিং-এর ফাঁকে ভারতী দেবীকে বললাম, ‘দেখুন, অভিনয়ে ভুল-ক্রটি হলে একটু সংশোধন করে নেবেন। তবেআমি আপ্রাণ সুঅভিনয় করবার চেষ্টা করব।’

অভিনয় হল। ছবিও তৈরি হয়ে নানা প্রেক্ষাগৃহে দেখানো হল। কিন্তু এবারেও সেই আমার ভাগ্য এক। ছবি চলল না।

অভিনেতার জীবনে ছবি না-চলা যে কতখানি দুঃখের তা লিখে বোঝানো যায় না।

ভাবলাম কাজ নেই আর অভিনয় করে। ফিরে যাই আমি আমার সেই পোর্ট কমিশনার্স অফিসে।

অগ্রদূতের বিভূতিবাবুকে একদিন জিজ্ঞাসা করলাম— ‘কী করা যায় বলুন তো? চাকরিতে ফের ফিরে যাব?’

বিভূতিবাবু একটু বিস্মিত হয়ে গিয়ে বললেন— ‘চাকরি এখনও রেখেছ?’

আমি আমতা আমতা করে বলি— ‘আজ্ঞে, কী হবে তা তো ঠিক বুঝতে পারছি না, তাই বন্ধুবান্ধবের সাহায্যে কোনোরকমে চাকরিটা টিঁকিয়ে রেখেছি।’

বিভূতিবাবু শুনে বললেন— ‘মনে হচ্ছে, চেহারার জোরে তুমি টিঁকে যেতে পারো। তবে আর একটু চেষ্টা করা দরকার। কারণ চাকরি ছাড়লে, এ বাজারে আর একটা চাকরি জোগাড় করা বড়ো শক্ত। তার ওপর তোমার পোর্ট কমিশনারের চাকরি! চাকরিটাও কিছু খারাপ নয়।’

আমি বলি— ‘কিন্তু চাকরি রাখতে গেলে’—

বিভূতিবাবু বলেন— ‘সেটা অবশ্য তুমি বোঝো, কী করে রাখবে?’

মনটা তখন আমার সত্যিই খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কারণ চেহারার ওপর যেটুকুও আস্থা ছিল, সেটুকুও আমার তখন চলে গেছে, তখনকার দিনের একখানা বিখ্যাত সাপ্তাহিক পত্রিকায় একটা কার্টুন ছবি দেখে। ছবিটার নামকরণ করা হয়েছিল ‘বাংলার নায়ক’।

আমাকে সাজানো হয়েছে একটা ছ’মাসের ছেলে। অপরদিকে একটি মেয়ের কোলের ওপর একটি শিশুকে শোয়ানো হয়েছে। শিশুটি মেয়েটির গলা লক্ষ্য করে দুটি হাত তুলেছে ওপর দিকে। নিচে লেখা আছে— ‘আমি তোমায় ভালোবাসি’।

হায়, এইকি আমার ভাগ্য! আমার চেয়েও বয়সে বড়ো যদি কোনো নায়িকার সঙ্গে আমাকে অভিনয় করতে হয়, সে দোষ কি আমার? সে দোষ যাঁরা পার্ট ঠিক করেছেন তাঁদের। কিন্তু মাঝখান থেকে বেশ খানিকটা বিদ্রূপ আর গালাগালি এসে পড়ল আমার ওপর।

আজকে অবশ্য সেকথা মনে পড়লে হাসিই পায়। সেদিন অবশ্য হাসির বদলে চোখে দেখা দিয়েছিল জল, পরাজয়ের চিহ্ন হিসেবে।

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. এম.পি. প্রোডাকসন্স (৩৮ নং টীকা দ্রষ্টব্য) ছিল ‘অগ্রদূত’ পরিচালিত উত্তমকুমার-ভারতী দেবী অভিনীত ‘সহযাত্রী’ (১৯৫১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত) ছবিটির প্রযোজক। এই প্রযোজনা সংস্থার ম্যানেজার ছিলেন বিমলবাবু ওরফে বিমল ঘোষ। উক্ত ছবিতে অভিনয়ের বিষয়ে উত্তমকুমারের সঙ্গে প্রথমে এই বিমল ঘোষেরই কথা হয়।
  2. প্রখ্যাত চিত্রপরিচালক বিভূতি লাহার জন্ম ১৯১৫ সালে। ১৯২২ সালে প্রথম চিত্রজগতে আসেন। ক্যামেরাম্যান হিসেবে প্রথম কাজ করেন ‘কচি-সংসদ’-এর চিত্রগ্রহণের মাধ্যমে। ক্যামেরাম্যান হিসেবে কাজ করেন প্রখ্যাত চিত্রপরিচালক পশুপতি চট্টোপাধ্যায়ের ছবিতে। ইনি শব্দযন্ত্রী যতীন দত্ত, ব্যবস্থাপক বিমল ঘোষ এবং রসায়নাগারিক শৈলেন ঘোষালের সঙ্গে গড়ে তোলেন ‘অগ্রদূত’ গোষ্ঠী। এই সংস্থার প্রথম প্রযোজিত ছবি: ‘সঙ্কল্প’, প্রথম পরিচালিত ছবি: ‘স্বপ্ন ও সাধনা’। যতীন দত্ত ও বিমল ঘোষের পরপর প্রয়াত হওয়া আর শৈলেন ঘোষালের সরে যাওয়ার ফলে, বিভূতি লাহা একাই ‘অগ্রদূত’ নামে চিত্রপরিচালনার কাজ করতে থাকেন। ‘অগ্রদূত’ গোষ্ঠী উপহার দেয় একের পর এক জনপ্রিয় ছবি। উত্তম-সুচিত্রা অভিনীত জনপ্রিয় ছবিগুলির মধ্যে বেশিরভাগই ‘অগ্রদূত’ পরিচালিত ছবি। এরমধ্যে ‘অগ্নিপরীক্ষা’, ‘সবার উপরে’, ‘ত্রিযামা’, ‘পথে হল দেরী’, ‘সূর্যতোরণ’, ‘বিপাশা’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও, উত্তমকুমারসহ আরো অন্যান্য অনেক অভিনেতা অভিনেত্রী অভিনীত বেশকিছু জনপ্রিয় ছবির পরিচালক ছিলেন ‘অগ্রদূত’ নামের আড়ালে বিভূতি লাহা।
  3. বীরেন্দ্রনাথ সরকার প্রতিষ্ঠিত একসময়ের বাংলার সর্ববৃহৎ ফিল্ম নির্মাণ-সংস্থা ছিল, ‘নিউ থিয়েটার্স’। ১৯৩০ সালে একটি বিশাল স্টুডিওসহ এই সংস্থার পত্তন করেন মি. বি.এন. সরকার। ‘চোরকাঁটা’ ও ‘চাষার মেয়ে’ নামে দুটি নির্বাক ছবির পর, এই সংস্থা নির্মিত প্রথম সবাক ছবি ‘দেনা পাওনা’ মুক্তি পায় ১৯৩১ সালের ২৪ ডিসেম্বর। এরপর ‘দেবদাস’, ‘বিদ্যাপতি’, ‘চণ্ডীদাস’, ‘মুক্তি’, ‘অধিকার’, ‘উদয়ের পথে’ ইত্যাদি বাংলা ছবি, আর, ‘দুশমন’, ‘ধরতি মাতা’, ‘মাই সিস্টার’, ‘যাত্রিক’ ইত্যাদি হিন্দি ছবি প্রযোজনা করে, ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতে আলোড়ন ফেলে দেয় এই সংস্থা। প্রমথেশ বড়ুয়া, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, রাইচাঁদ বড়াল, পঙ্কজ মল্লিক, কানন দেবী, কে. এল. সায়গল, নীতিন বসু, বিমল রায় ইত্যাদি উজ্জ্বল প্রতিভাকুল এসে জড়ো হয়েছিলেন এখানে। কয়েকদশক জুড়ে বাংলা ও হিন্দি ছবির জগতে রাজত্ব করে গেছে ‘হাতি’ মার্কা চিহ্নসংবলিত ‘নিউ থিয়েটার্স’-এর ছবিগুলি।
  4. মুরলীধর চট্টোপাধ্যায় (১৮৯৩-১৯৭৩) ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রজগতের এক উজ্জ্বল মানুষ। বহু অবদান ছিল তাঁর। যশোর জেলার কাশীপুর গ্রামে জন্ম মুরলীবাবুর। উত্তরপাড়া সরকারি ইস্কুল থেকে এণ্ট্রান্স পাশ করে, সেণ্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে আই.এ, ঢাকায় গিয়ে বি.এ ও এম.এ পাশ করেন। এরপর নানা ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। এভাবেই ১৯১৯ সালে প্রখ্যাত চিত্র-নির্মাণ সংস্থা ম্যাডান কোম্পানিতে যোগ দেন। এই সংস্থার প্রিয়নাথ গাঙ্গুলি ছিলেন মুরলীবাবুর মাসতুতো দাদা। ১২ বছর এখানে কাটানোর পর ‘রীতেন অ্যাণ্ড কোম্পানি’ হয়ে অবশেষে তৈরি করলেন প্রখ্যাত ‘এম.পি. প্রোডাকশন’ (৩৮ নং টীকা দ্রষ্টব্য)। এর মাঝে অবশ্য ‘কমলা টকীজ’ নামক প্রযোজক সংস্থা তৈরি করে, ‘রাজকুমারের নির্বাসন’ ও ‘স্বামী-স্ত্রী’ নামক দুটি ছবি করেন মুরলীবাবু। এরপর মূলত এনারই উদ্যোগে এবং মহারাজ প্রদ্যোতকুমার ঠাকুর, দাশরথী চট্টোপাধ্যায়, প্রিয়নাথ গাঙ্গুলি প্রমুখের সহায়তায় পূর্বতন ‘কর্ণওয়ালিশ’ ও ‘ক্রাউন সিনেমা’ যথাক্রমে ‘শ্রী’ ও ‘উত্তরা’-য় পরিণত হয়। এছাড়াও, ‘পূরবী’, ‘উজ্জ্বলা’, ‘রূপম’ (বর্তমানে বিলুপ্ত), ‘নবরূপম’ (বর্তমানে বিলুপ্ত), ‘ওরিয়েণ্ট’ ইত্যাদি চলচ্চিত্র-প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণে মুখ্য ভূমিকা নেন মুরলীধর চট্টোপাধ্যায়। বাংলা চলচ্চিত্রজগতে ইনি একজন নমস্য মানুষ।
  5. ভারতী দেবী (১৯২২-২০১১) ছিলেন ‘নিউ থিয়েটার্স’ যুগের এক বিশিষ্ট নায়িকা। পরে, দীর্ঘদিন এক শক্তিশালী অভিনেত্রী হিসেবে চলচ্চিত্রজগতে বিরাজ করেছেন। বাবা হরেকৃষ্ণ দাসের ব্যবসায় হঠাৎ বিপর্যয় নেমে এলে, অর্থোপার্জনের চেষ্টায় মেয়ে ভারতী চলচ্চিত্রে অভিনয়ের সুযোগ খুঁজতে থাকেন। কাশী হিন্দু বিদ্যালয়ের ব্যায়ামশিক্ষক মণি রায়ের সঙ্গে ভারতী দেবীর বিয়ে হয়। অচিরেই মনান্তরের কারণে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। এই বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটানোর জন্য ভারতী দেবীকে মুসলিম ধর্ম পর্যন্ত গ্রহণ করতে হয়। পরে আবার হিন্দু ধর্মে তিনি ফিরে আসেন। ভারতী দেবীর ছোটো থেকেই ব্যায়ামের কসরতের বিষয়ে আগ্রহ ছিল। ফলে, প্রখ্যাত ব্যায়ামবীর বিষ্ণু ঘোষের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ নিবিড় হয়। পরে, বিষ্ণুবাবুই তাঁকে ‘নিউ থিয়েটার্স’-এর সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন। ‘ডাক্তার’ (১৯৪০) ছবিতে প্রথম চিত্রাবতরণ ঘটে ভারতীর। প্রথম ছবিতেই বাজীমাত। এরপর, ‘প্রতিশ্রুতি’, ‘সৌগন্ধ’ (হিন্দি), ‘কাশীনাথ’, ‘ওয়াপস’ (হিন্দি), ‘চন্দ্রশেখর’, ‘দুর্গেশনন্দিনী’, ‘সমাপ্তি’ (হিন্দি), ‘বাগদাদ’ (হিন্দি), ‘নির্জন সৈকতে’, ‘আলো, ‘নায়ক’ ইত্যাদি অজস্র ছবিতে তাঁকে দেখা গেছে। মুম্বইয়ের কিছু হিন্দি ছবি, হাল আমলের টেলিভিশন-সিরিয়াল, বেতার-নাটক, সর্বত্র বিচরণ করেছেন। উত্তমকুমারের একেবারে প্রথম দিকের ছবি ‘সহযাত্রী’-র, তিনি ছিলেন নায়িকা। তপন সিংহের ‘নির্জন সৈকতে’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য ছায়া দেবী, রেণুকা রায় ও রুমা গুহঠাকুরতার সঙ্গে ভারতী দেবীও ভারতসেরা অভিনেত্রী হিসেবে সরকারি পুরস্কার পান। একসময়ে চলচ্চিত্রে নিজকণ্ঠে তাঁর গানও শোনা গেছে। চলচ্চিত্রজগতের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব অমর মল্লিকের সঙ্গে পরবর্তীকালে ভারতী দেবীর বিবাহ হয়।
  6. ১৯৪০ সালের ৩১ অগস্ট ‘চিত্রা’ (বর্তমানে ‘মিত্রা’), ‘পূর্ণ’ ইত্যাদি আরো কিছু প্রেক্ষাগ্রহে মুক্তি পায় শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের কাহিনি নির্ভর এবং ফণী মজুমদার পরিচালিত ‘ডাক্তার’ ছবিটি। পঙ্কজ মল্লিক সুরারোপিত এই ছবির গান বাংলা মাতিয়ে দিয়েছিল। যার মধ্যে বেশিরভাগই ছিল স্বয়ং পঙ্কজবাবুর কণ্ঠে এবং এ ছবির নায়কও ছিলেন তিনিই। এছাড়াও, পান্না দেবী, অহীন্দ্র চৌধুরি, জ্যোতিপ্রকাশ, ভারতী দেবী, ইন্দু মুখোপাধ্যায়, শৈলেন চৌধুরি, অমর মল্লিক, কমলা ঝরিয়া প্রমুখ আরো অনেকে অভিনয় করেন এই ছবিতে। প্রসঙ্গত, ‘ডাক্তার’ ছবির হিন্দি সংস্কারণটিও মুক্তি পায় ১৯৪২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ‘নিউ সিনেমা’ (বর্তমানে বিলুপ্ত) সহ আরো প্রেক্ষাগৃহে।
  7. ১৯৪১ সালের ১৪ অগস্ট ‘চিত্রা’ সহ আরো কিছু প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় বিনয় চট্টোপাধ্যায়ের কাহিনিনির্ভর ও হেমচন্দ্র চন্দ্র পরিচালিত ‘প্রতিশ্রুতি’ ছবিটি। সংগীত পরিচালনা করেন রাইচাঁদ বড়াল। এ ছবিতে অভিনয় করেন অসিতবরণ, ভারতী দেবী, ছবি বিশ্বাস, পাহাড়ী সান্যাল, জহর গাঙ্গুলি, বিনয় গোস্বামী, চন্দ্রাবতী দেবী, সুপ্রভা মুখোপাধ্যায়, অপর্ণা দেবী, তুলসী চক্রবর্তী, শৈলেন চৌধুরি ও আরো অনেকে। ‘ওয়াপস’ নামে এ ছবির হিন্দি সংস্করণটি মুক্তি পায় ১৯৪৪ সালের ২৮ এপ্রিল ‘নিউ সিনেমা’, ‘ চিত্রা’, ‘রূপালী’ সহ আরো কিছু প্রেক্ষাগৃহে।
  8. প্রখ্যাত চিত্রপরিচালক বিভূতি লাহার জন্ম ১৯১৫ সালে। ১৯২২ সালে প্রথম চিত্রজগতে আসেন। ক্যামেরাম্যান হিসেবে প্রথম কাজ করেন ‘কচি-সংসদ’-এর চিত্রগ্রহণের মাধ্যমে। ক্যামেরাম্যান হিসেবে কাজ করেন প্রখ্যাত চিত্রপরিচালক পশুপতি চট্টোপাধ্যায়ের ছবিতে। ইনি শব্দযন্ত্রী যতীন দত্ত, ব্যবস্থাপক বিমল ঘোষ এবং রসায়নাগারিক শৈলেন ঘোষালের সঙ্গে গড়ে তোলেন ‘অগ্রদূত’ গোষ্ঠী। এই সংস্থার প্রথম প্রযোজিত ছবি: ‘সঙ্কল্প’, প্রথম পরিচালিত ছবি: ‘স্বপ্ন ও সাধনা’। যতীন দত্ত ও বিমল ঘোষের পরপর প্রয়াত হওয়া আর শৈলেন ঘোষালের সরে যাওয়ার ফলে, বিভূতি লাহা একাই ‘অগ্রদূত’ নামে চিত্রপরিচালনার কাজ করতে থাকেন। ‘অগ্রদূত’ গোষ্ঠী উপহার দেয় একের পর এক জনপ্রিয় ছবি। উত্তম-সুচিত্রা অভিনীত জনপ্রিয় ছবিগুলির মধ্যে বেশিরভাগই ‘অগ্রদূত’ পরিচালিত ছবি। এরমধ্যে ‘অগ্নিপরীক্ষা’, ‘সবার উপরে’, ‘ত্রিযামা’, ‘পথে হল দেরী’, ‘সূর্যতোরণ’, ‘বিপাশা’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও, উত্তমকুমারসহ আরো অন্যান্য অনেক অভিনেতা অভিনেত্রী অভিনীত বেশকিছু জনপ্রিয় ছবির পরিচালক ছিলেন ‘অগ্রদূত’ নামের আড়ালে বিভূতি লাহা।