উত্তমকুমার চট্টোপাধ্যায়

হারিয়ে যাওয়া দিনগুলি মোর

পাঁচ

নাঃ, দিন আমার কাটবে না। মেয়েটাই আমাকে পাগল করবে। কেবলই তার চিন্তা। অফিসে যাই, কাজ করতে করতে কেবল মনে পড়ে সেই মুখখানা। অফিস থেকে বাড়ি ফিরে দরজার কাছে বসে থাকি, যদি সে অন্নপূর্ণার সঙ্গে দেখা করতে আসে তাহলে আর কিছু না হোক একবার দেখতে তো পাব!

আঃ, কী অধীর প্রতীক্ষা! কিন্তু যার জন্যে এত, তার মনের ভাবটা কী, তা তো জানতে পারা গেল না! কী বা ভাবে সে আমার সম্বন্ধে! কোনো করুণা, কোনো স্নেহ, কোনো আকাঙ্ক্ষা তার আছে কি আমার জন্যে?

সাজপোশাক দেখে মনে হয় বড়োলোকের মেয়ে। আমাকে তার ভালো লাগবে কেন? আমাদের অবস্থা তো এই! তার ওপর করি তো সামান্য মাইনের চাকরি! এসব জেনেশুনেও— নাঃ,—আর ভাবতে পারলাম না।

তাড়াতাড়ি খাওয়াদাওয়াটা সেরে নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম, যদি সে আসে।

ঝোঁকের মাথায় ভুলেই গিয়েছিলাম, আজ তার আসবার কোনো সম্ভাবনা নেই।

কারণ, অন্নপূর্ণা গেছে গানের স্কুলে গান শিখতে।

বসে থাকাই হল সার— ‘সে ফিরে এল না’। বুকের ভেতরটা কেমন যেন খাঁ খাঁ করে উঠল। কিন্তু আমি নিরুপায়। হঠাৎ মনে হল, আমারই মতো অন্য কোনো বড়োলোকের ছেলে, নতুন একটা ‘অস্টিন’ বা ‘মরিস’ বা ওই ধরনের কোনো গাড়িতে তাকে বসিয়ে সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছে না তো?

আবার সেই হতাশা। কখনওবা সেই কল্পিত ছেলেটির উদ্দেশ্যে নিজের অজান্তে, আমার বক্সিং-করা হাতদুটো মুখের কাছে তুলে ধরেছি ঘুসি বাগিয়ে, তা নিজেই বুঝতে পারিনি।

তখন আমার মনের অবস্থা একেবারে অবর্ণনীয়। আমার অজ্ঞাতে আমার সীতাকে কি রাবণ হরণ করে নিল? তা কিছুতেই হবে না! হতে আমি দেব না।

মনে মনে কতরকম প্যাঁচ কষছি তাকে জব্দ করব বলে। হঠাৎ ও, কী ও? নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস করা গেল না। সে-ই নয়? হ্যাঁ, হ্যাঁ, সে-ই তো! অন্নপূর্ণার সঙ্গে আমাদের বাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে। তাহলে মেয়েটা গানের স্কুলে গান শেখে? হুররে! কোনো রাবণ তাকে হরে নিয়ে যায়নি! আমার চান্স তাহলে এখনও আছে!

কিন্তু না! গম্ভীর হতে হবে। কোনোরকম ছ্যাবলামি করে ফেললে যদি পাগলা বলে পালিয়ে যায়! সব দিক দেখেশুনে, তবে এগোতে হয়।

কিন্তু এগোবো কোথায়! ও যে বড়োলোকের মেয়ে! সঙ্গে রয়েছে বিরাট দারোয়ান!

নিজের অজ্ঞাতসারেই সেদিকে এতক্ষণ চেয়েছিলাম। কিন্তু যেই তার সঙ্গে চোখাচোখি হল, অমনি চোখ ফিরিয়ে নিলাম।

কী জানি আমার কল্পনা কতদূর সত্য হবে তা কে বলতে পারে?

ওরা ততক্ষণে এসে -পড়েছে বাড়ির কাছে। অন্নপূর্ণা ঢুকে পড়ল বাড়ির মধ্যে। সেই মেয়েটাও ফিরে গেল বাড়ির দরজা থেকে। যাবার সময় কয়েকবার পেছন ফিরে চাইল। হঠাৎ আমার মনে হল, আমার চোখে চোখ পড়ায় সে কেমন যেন ফিক করে হেসে ফেলল। আমারও বুকের ভেতরের রক্তটা কেমন যেন ছলাৎ করে উঠল।

তবে?

আজ লজ্জার মাথা খেয়ে অন্নপূর্ণাকে জিজ্ঞেস করলুম— ‘মেয়েটা কে রে তোকে পৌঁছে দিতে এসেছিল?’

অন্নপূর্ণা বলে— ‘কে বলো তো?’

আমি আরও বিস্মিত হয়ে গিয়ে বলি— ‘ওই যে এক্ষুনি এসেছিল!’

অন্নপূর্ণা বলল— ‘ও তো গৌরী!’

— ‘গৌরীটা ক্যা?’

— ‘ওর নাম গৌরীরানী গাঙ্গুলি। ল্যান্সডাউন রোডের বিখ্যাত বড়োলোক চণ্ডীচরণ গাঙ্গুলির মেয়ে।’

— ‘তোর সঙ্গে ভাব হল কী করে?’

— ‘গানের স্কুলে।’

একে বড়োলোকের মেয়ে। তার ওপর—

মনের ভাবটা গোপন করে অন্নপূর্ণাকে জিজ্ঞেস করি— ‘ও-ও গান শেখে?’

— ‘হ্যাঁ। শুধু শেখে নয়, বেশ ভালোই গায়। কিন্তু গৌরীর সম্বন্ধে এত প্রশ্ন করছ কেন?’

কেন করছি—মনে মনেই বলি—মুখে বলি— ‘এমনি,—বসেছিলুম,— দেখলুম —তাই— ‘

অন্নপূর্ণা গৌরীর চেয়ে বয়সে কিছু বড়ো। আমার অভিসন্ধিটা বোধহয় সে বুঝতে পারলে। তাই তার মুখে কেমন চাপা হাসি ফুটে উঠল।

আমি বুঝলাম, গতিক ভালো নয়। দূতীকে ক্ষ্যাপালে ফল হয়তো ভবিষ্যতে খারাপ হবে। তার চেয়ে যেমন চলছে চলুক। পরে সময় বুঝে যা হয় একটা কিছু করা যাবে।

করা তো যাবে! কিন্তু করবটা কী! বহুদিন ধরে ভেবেচিন্তে তেমন কোনো একটা প্ল্যান মাথায় আনতে পারলাম না। মেয়েটার মনোভাব না বোঝা অবধি এগোনোও তো কিছুতে যায় না! যদি অপমান করে!

বোধহয় মানুষমাত্রই বিরহযন্ত্রণা উপস্থিত হলে কবিতা লেখে। কবিতা পড়তেও ভালো লাগে। তাই প্রথমেই আমি বার করে ফেললাম বৈষ্ণব কবি বিদ্যাপতির একখানা গান। আপনাদের কাছে তা অত্যন্ত পরিচিত। সেই—

‘সখি হামারও দুঃখকো

নাহি ওর রে

ই ভরা বাদর, মাহ ভাদর

শূন্য মন্দির মোর’

কবিতা যখন লিখতেই পারি না তখন এই পথ বেছে নিলাম। দেখা যাক আমার শব্দভেদী বাণ কোথায় কেমন করে গিয়ে ঠেকে!

এতো কথা বলছি—ইদানীং সে যেন ঘন ঘন আমাদের বাড়িতে আসতে শুরু করেছে।

বেশ আছি, কিন্তু তাকে দেখলেই বুকের মধ্যে কেমন যেন হু-হু করে উঠতো। তাই আমার শব্দভেদী বাণ ছোড়ার এত প্রয়োজন হল।

বাড়িতে পাহাড়ীদার গাওয়া ওই গানটার পুরোনো রেকর্ড ছিল। বাজিয়ে বাজিয়ে সুরটা তুললাম।

তারপরে একদিন সন্ধের সময় গৌরী আমাদের বাড়িতে আসতেই হারমোনিয়াম নিয়ে বসলাম গানটা গাইতে।

এর আগে কতবার সিনেমায় দেখেছি, নায়িকা হয়তো কোনও একটা বিরাট প্রাসাদের ভেতর বসে নায়কের জন্যে বিরহযন্ত্রণা অনুভব করছে। অপরদিকে বহু দূরে বসে, ঠিক সেই সময়ে নায়ক রেডিওতে গান ধরল। নায়িকা অমনি রেডিও সেটটা চালিয়ে দিল, আর নায়কের কণ্ঠস্বর শুনে একটা হদিশ ঠিক করে নিয়ে আনন্দে চোখ মুছতে মুছতে ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

বোধহয় এই রোম্যান্টিক ঘটনাটা আমার মাথায় ভর করে বসেছিল। ভুলে গিয়েছিলাম আমি তখনও ছবির নায়ক হইনি, নায়ক হবার একটা দুর্বার আকাঙ্ক্ষা আমায় পেয়ে বসেছে।

আমার নায়িকা আমাকে মনে মনে ভাবে কিনা তাও জানা নেই। রেডিও সেটের কথা আর নাইবা তুললাম।

ইংরেজিতে একটা কথা আছে, যার অর্থ ‘ইচ্ছে থাকলেই উপায় হয়’। তাই আমারও একটা উপায় হল। আমার নায়িকা এল আমাদের বাড়িতে, পাশের ঘরে বসে গল্প-গুজবও শুরু করল। আর ঠিক সেইসময় আমি পাশের ঘরে বসে গান ধরলাম।—গানের পর উদগ্রীব হয়ে লক্ষ্য করলাম কোনো পরিবর্তন দেখতে পাই কিনা, কিন্ত হা হতোস্মি! মন্দভাগ্যম! কোনো পরিবর্তনই দেখতে পেলাম না। সিনেমার নায়িকার মতো ছুটে যাওয়া তো দূরে থাক, খানিক পরে হাসতে হাসতে সে বেরিয়ে গেল। আমাকেও কেমন জানি একটা বিশ্রী হতাশা পেয়ে বসল।

ভাবলাম কূলে এসে কি তরী ডুবল। আদৌ বোধহয় মেয়েটা আমায় ভালোবাসে না, তার বদলে সে বোধহয়—না আমি কি বোকারে বাবা! নিজের ওপর নিজেরই রাগ হতে লাগল। কেন মরতে—

বুঝিতো সব, কিন্তু মন বাধা মানে কই।

হঠাৎ সেই সময় অন্নপূর্ণা এসে আমাকে বললো— ‘হঠাৎ তুমি যে বড়ো গান গাইছিলে?’

আমি একটু তাচ্ছিল্যের সুরে বলি— ‘এমনি! রেওয়াজ করতে হবে না!’

অন্নপূর্ণা একটু যেন চাপা হাসিতে ফেটে পড়ে বলে— ‘তা তো হবেই। তবে রোজ তুমি সকালের দিকে গান গাও, আজকে বিকেলের দিকে— ‘

মনে মনে ভাবি, আরে বাবাঃ, ধরে ফেললে নাকি? আমার আসল উদ্দেশ্যটা যদি বুঝতে পেরে থাকে তা হলে?

তাই বেশ একটু গম্ভীর হবার চেষ্টা করে বলি— ‘শিল্পীর ব্যাপারই আলাদা! তাদের কখন কী খেয়াল ওঠে কে বলতে পারে বল? এইতো তুই, এতো দিন ধরে গান শেখবার চেষ্টা করছিস, শিল্পী নয় বলেই কেবল সন্ধের সময় সা-রে-গা-মা সাধাই সার হচ্ছে। কিন্তু যদি প্রকৃত শিল্পী হতিস, তাহলে, গানের ভাব যখন উঠত তখন কি আর চাপতে পারতিস? হারমোনিয়াম নিয়ে তোকে বসতেই হত।’

কথাগুলো অবশ্য বেশ গম্ভীরভাবেই বলেছিলাম। কিন্তু ফলটা ফলল উলটো।

অন্নপূর্ণা হাসিতে ফেটে পড়ে বলল— ‘আমার বন্ধু গৌরী বলছিল— ‘ বলে, সে চুপ করল।

আমি সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করি— ‘কী বলছিল রে?’

— ‘সে বলছিল— “তোর দাদাটা একটু পাগলাটে হলেও গান গায় মন্দ নয়। বেশ গলাটা। কেমন গাইছে দেখ।” তুমি তো ওকে শোনাবার জন্যে গান গাইছিলে, তা আমি বুঝতে পেরেছি।—’

হুররে! তাহলে আমার বাণ লক্ষ্যভেদ করেছে? মুখে গাম্ভীর্য এনে বলি— ‘বড়ো জেঠা হয়ে গেছিস তো!’

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. গৌরীরানী গাঙ্গুলী উত্তমকুমারের স্ত্রী। ১৯৪৫-৪৬ সালে জ্যাঠতুতো বোন অন্নপূর্ণার বন্ধু গৌরীর সঙ্গে নিজেদের গিরিশ মুখার্জি রোডের বাড়িতেই প্রথম পরিচয় উত্তমকুমারের। ধীরে ধীরে প্রেম, অবশেষে সম্পর্কের পরিণতি শুভ-পরিণয়ে। ১৯৫০ সালের ১ জুনে বিয়ে হয়। উত্তমবাবুর প্রয়াণের সময় (১৯৮০) জীবিত ছিলেন গৌরীদেবী।
  2. ল্যান্সডাউন রোডের বর্তমান নাম শরৎ বসু রোড। এই রাস্তাতেই বনেদি গাঙ্গুলি-বাড়ি অবস্থিত। এই বাড়িরই মেয়ে গৌরী দেবীকে বিয়ে করেছিলেন উত্তমকুমার।