উত্তমকুমার চট্টোপাধ্যায়
হারিয়ে যাওয়া দিনগুলি মোর
দশ
যে কখনও চিনি খায়নি তাকে যেমন মিষ্টির স্বাদ বোঝানো যায় না, তেমনি যে কখনও প্রেম করেনি তাকে, প্রেমে পড়লে মানুষের মনে যে কী অনুভৃতি হয়, তাও বোঝানো যায়না।
রোম্যান্টিক ‘হিরো’ বলে আমার একটা নাম আছে। অনেকে খুশিও হয়েছেন আমার সে অভিনয় দেখে। কারণ আমি তাঁদের কাছে প্রশংসাপত্র পেয়েছি এবং ‘বাহবা’ ধ্বনি শুনেছি।
নানাধরনের রোম্যান্টিক চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে দেখেছি বাংলা ছবির নায়ককে যেন সবসময় বোকা বোকা হয়ে থাকতে হয়। তার সাজগোজটা হবে careful অথচ careless, অর্থাৎ সব ব্যাপারটাই সে বোঝে অথচ উদাসীন। তারপরে এই ধরনের চরিত্রগুলোতে বেশিরভাগ সময় দেখতে পাওয়া যায় নায়কের বাবার থাকে প্রচুর টাকা। সে একটা ক্রাইসলার গাড়ি বা ওই জাতীয় কিছুতে চড়ে বেড়াচ্ছে।
নায়িকা তার জন্যে জানলায় অপেক্ষা করছে। কিংবা ডিনারে, পার্টিতে তাদের প্রথম সাক্ষাতেই প্রেম হল। অথবা প্রেম হবার পর নায়িকা রয়েছেন ঘরের মধ্যে বন্দী। নায়কের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ অনেকদিন নেই। মন অত্যন্ত খারাপ নায়কের জন্যে। সেকেন্ড ‘হিরো’ বা ‘ভিলেন’ নায়িকার সঙ্গে বিয়ে একরকম পাকাপাকি করে ফেলেছে—এমনি সময় বসন্তের কোকিলের ডাকের মতন রেডিওতে ভেসে এল নায়কের কণ্ঠস্বর। নায়িকা বুঝল নায়ক বেঁচে আছে। উত্তেজিত কণ্ঠস্বরে ‘ভিলেন’কে তখন প্রত্যাখ্যান করল। বলল— ‘এ বিয়ে আমি করব না’, কিংবা মোটর নিয়ে ছুটল নায়ককে ধরবার উদ্দেশ্যে।
কিন্তু আমার জীবনের ঘটনা, ঠিক এপথে চলেনি। ‘ক্রাইসলার’ গাড়ি তো দূরে থাক, সামান্য বাস-ট্রামেই ঘুরে বেড়াতাম। সামান্য কেরানি আমি অথচ প্রাণে শখ অনেক। প্রেম করলাম তো করলাম—ওই অবস্থাপন্ন মেয়ের সঙ্গে! এখন আমার উপায়?
বাড়িতে গৌরী বন্দী। সে-ই আবার আমাকে চিঠি লিখল তার সমস্ত কথা জানিয়ে। বর্তমানে ‘অ্যাটম বম্ব’ কিংবা ‘হাইড্রোজেন বম্ব’ কী তা দেখিনি, কিন্তু আমার মনে হল এই চিঠি তার চেয়েও ভীষণ সাংঘাতিক।
এর কিছুদিন আগে গত মহাযুদ্ধের শেষে ‘হিরোসিমা’ আর ‘নাগাসাকি’র ওপর ‘অ্যাটম বম্ব’ পড়েছিল। কাগজে পড়েছিলাম শহর দুটোই নাকি সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল তাছাড়া আরও অনেক কথা।
চিঠিটা পেয়ে আমারও তেমনি অবস্থা হল, কিছুই ভালো লাগে না।
কিন্তু ভালো লাগে না বললে সংসার ছাড়বে কেন? ন’টার পর মুখ ভার করে অফিস যেতে হত বৈকি। খেলাধুলা, যাত্রা, থিয়েটার সবই একরকম বন্ধ করে দিলাম। বন্ধুরা ডাকতে এলে বলতাম—ভালো লাগে না ভাই।
ভালো তো লাগে না, করিটা কী? কেবল নিজের ঘরে বসে বসে গৌরীকে চিন্তা করছি। শুনেছি শিবকে পাবার জন্যে গৌরী নাকি তপস্যা করেছিলেন বরফের মতো ঠান্ডা জলে গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে।
এ যুগে আমার গৌরী কী করেছিল জানি না, আমি প্রায় ‘তপস্যা’র মতো করে ফেলেছিলাম আর কি! দিনরাত কেবল একই চিন্তা—কী হবে, কী হবে!
মা’কে রাজি করানো শক্ত নয়। মা মত দিলে বাবাও মত দেবেন এ বিয়েতে। কিন্তু গৌরীর বাড়িতে? শুধু তখন আমার শ্বশুরমশাই একা নন, তাঁরও পিতা অর্থাৎ আমার দাদাশ্বশুর নগেন গাঙ্গুলি মহাশয় তখনও জীবিত। তিনি যখন শুনবেন আমি ফিল্ম করি, তার ওপর অফিসেও একটা সামান্য চাকরি করি, তখন তিনি কি এ বিয়েতে রাজী হবেন? তাঁর আদরের ছোটো নাতনিকে কিছুতেই আমার মতো পাত্রের হাতে সঁপে দেবেন না।
মনে মনে চিন্তা করতাম, সাহসে ভর করে আমি একদিন চলে গেছি গৌরীদের বাড়িতে, সকলের সামনে বুক চিতিয়ে বলছি, গৌরীকে আমার চাই, নইলে আমার জীবন একেবারে ব্যর্থ হয়ে যাবে।
ঠিক সেইসময়ে মনে হত, ওদের বাড়ির দারোয়ানদের কথা। সঙ্গে সঙ্গে একা বসে আমার ঘণ্টা দু’তিন ধরে ভাবনার গতিটা যেন হঠাৎ ধাক্কা খেয়ে অন্য দিকে চলে যেত। ভাবতাম—যদি ওরা অপমান করে? যদি ওরা আমার কথা না শোনে? তাহলে?
অপমানটা আমার তো কেবল একার হবে না! হবে আমার বাবা, মা, সকলকার। তাহলে? না না, এ কাজ আমি কখনও করতে পারব না। নিজের জন্য কোনোদিন ভাবি না, ভাবতে চাই-ও না। কিন্তু আমি এমন কাজ করতে পারি না যাতে আমার মা-বাবার অপমান হয়। এজন্যে যদি গৌরীকে আমি না-ও পাই সেও ভালো। মৃত্যু অবধি যদি তার জন্য আমাকে অপেক্ষা করতে হয়, তাও করব। প্রাণ থাকতে আমি এ কাজ করতে পারব না।
আবার সেই একটানা হতাশা। একঘেয়ে জিজ্ঞাসা—কী হবে, আর কী হবে!
বন্ধুবান্ধব কাউকে একথা বলতে পারি না, কারণ কে কোন চোখে দেখবে কে জানে! বুদ্ধি দেওয়া দূরে থাক, হয়তো ঠাট্টা করে আমাকে পাগল করবে। আমি খারাপ হতে পারি, কিন্তু আমার প্রেম আমার ভালোবাসা—এত খারাপ নয়! আমার মনের এই পবিত্র জিনিসকে নিয়ে কেউ যে ঠাট্টা করবে তা আমার সহ্য হবে না। তাহলে এমন কী উপায় করা যায়? অথচ সন্ন্যাসী তো বলেছেন, ‘ওকে’ আমি পাবই।
প্রথম দিনকতক তো গেল এইভাবে। ভগবানকে যে কোনোদিন খুব একটা বিশ্বাস করতাম তা নয়। কিন্তু ব্রাহ্মণের ছেলে, একটা সংস্কার তো ছিল। আর কিছু না হোক গলায় উপবীত তো আছে। তাই সকাল সন্ধ্যায় যখনই কোনো দেব বা দেবীর মন্দিরের সামনে দিয়ে যাই, অমনি তাঁকে ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম জানাই। বলি— ‘ভগবান, একটা ব্যবস্থা করো’। সে তীব্র অনুভূতি লিখে বোঝানো যায় না। হয়তো মুখে বললেও লোকে আমাকে পাগল আখ্যা দেবে। তবুও বিশ্বাস করুন, সেই তুষের জ্বালা আমি অহোরাত্র সহ্য করেছি! তখন রেকর্ডে গাওয়া কানন দেবীর একটা গান কেবলই মনে পড়তো। গানটি হল—
‘সখি! কে বলে পিরিতি ভালো। হাসিতে হাসিতে পিরিতি করিয়া কাঁদিতে জনম গেল।’
কারোর সামনে কাঁদিনি বটে, কিন্তু কাঁদতে বাকি ছিল কতটুকু? যত দিন যায় তত মনের জ্বালা যেন তীব্র হয়ে ওঠে। তীব্রভাবে সে যেন আমাকে পোড়াতে চায়। ভেতরটা তখন সত্যিই আমার তুষের আগুনের মতো জ্বলে যাচ্ছিল। খেতে ভালো লাগে না, রাত্রে চোখে ঘুম আসে না। দিনের বেলায় ক্লান্তিতে বিছানায় শুয়ে যখন সামান্য তন্দ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়তাম তখন দেখতাম কত মজার স্বপ্ন। কখনও দেখতাম গৌরী আমার কাছে এসেছে, কখনওবা দেখতাম ও যেন কোথায় চলে যাচ্ছে, আমি প্রাণপণ চেষ্টা করেও ওর নাগাল পাচ্ছিনা।
বেশিরভাগ, রাত্রেই এ সমস্ত স্বপ্ন দেখার পর ঘুম ভেঙে যেত। তারপর সারারাত জেগে কাটাতে হত। সে কল্পনাও যেন অপূর্ব সুখের তীব্র অনুভূতি দিয়ে যেত। কিন্তু তারপর?
রাত্রির পরে ভোর হলেই আবার সেই একটানা হতাশা।
আমার এইরকম অবস্থা মা’র চোখ এড়ায়নি। তিনি একদিন হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন— ‘হ্যাঁরে খোকা, তোর কী হয়েছে রে? ভালো করে খাস না, রাত্রেও লক্ষ করেছি, খুব ভালো করে ঘুমোতে পারিস না, ছটফট করে কেবল দরজা খুলে বের হোস। কী হয়েছে বল তো?’
বুঝলাম মা’র কাছে ধরা পড়ে গেছি। তবুও প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে বলি— ‘নাঃ কিছু তো হয়নি!’
মা বলেন— ‘না হলেই ভালো।’
দিন পনেরো এইভাবে কাটাবার পর হঠাৎ একদিন অফিস থেকে বাড়ি এসে শুনলাম গৌরী এসেছে আমাদের বাড়ি। বুকের রক্ত ছলাৎ করে উঠল। কান মাথা যেন গরম হয়ে উঠল। সমস্ত পৃথিবীর শব্দ যেন কেবল একসুরে বলে উঠল— ‘ওরে পাগল চেয়ে দেখ, গৌরী এসেছে।’