উত্তমকুমার চট্টোপাধ্যায়

হারিয়ে যাওয়া দিনগুলি মোর

পনের

>শীতটা প্রচণ্ড পড়েছে। ‘শিউলি বাড়ি’ ৫২র স্যুটিং—এর দরুন যেতে হয়েছিল এই ঠাণ্ডাতেও, রাঁচির কাছে একটা শহরে। সারাদিন স্যুটিং—এর পর রাত্রিতে ফিরে এসেছি যে যার আস্তানায়। পাহাড়ি ঠাণ্ডা। সোয়েটার, গরম কোট পরে অবসর সময় কাটাবার জন্যে রেডিওটা খুলে দিলাম। রেডিও—ঘোষক ঠিক সেইসময় ঘোষণা করছেন— ‘বিখ্যাত অভিনেতা তুলসী চক্রবর্তী পরলোকগমন করেছেন।’ নিজের কানকে যেন বিশ্বাস হল না। কিন্তু সেই নির্মম সত্য, আমায় বিশ্বাস করতে হল। পরের দিন খবরের কাগজ পৌঁছতেই দেখলাম সেই একই ব্যাপার—তুলসীদা আর নেই। মনে পড়ল অতীত দিনের কথা।

‘কামনা’ ছবির নায়কের পার্ট করবার জন্য আমি মনোনীত হয়েছিলাম। ইতিপূর্বে ছবিতে অনেককে দেখেছি, কিন্তু আলাপ হয়নি কারোর সঙ্গে। হঠাৎ দেখি তুলসীদা তাঁর সুপরিচিত টাকটিকে নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছেন।

প্রশ্ন করলেন—’তোমারই নাম উত্তমকুমার, এই ছবির নায়ক?’

সলজ্জভাবে নমস্কার করে বললাম—‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

আমার মুখের দিকে চেয়ে তিনি বললেন—‘দেখে তো মনে হচ্ছে বয়স বেশি হয়নি। লেখাপড়া, অফিস, এসব ছেড়ে এ লাইনে কেন? বলি, ফুর্তি করবার ইচ্ছা আছে নাকি?’

প্রবীণ অভিনেতার মুখে এ কী কথা! সলজ্জভাবে বলি —‘আজ্ঞে না, অভিনয়কে ভালোবাসি আমি।’

—‘অভিনয়কে ভালোবাসো? তা হলে স্টেজে যাওনি কেন?’

কী জবাব দেব?

বলি—‘আমাকে নেবেই বা কেন?’

সরাসরি বলতে পারলাম না আমাকে এই ফিল্ম লাইনে ঢুকতে যা বেগ পেতে হচ্ছে তা তো দেখছি। তাতে এ লাইনে আসার শখ বুঝি মিটে যায়!

মুখে কিন্তু বলতে পারলাম না সেকথা। মনের কথা আঁচ করে নিয়ে তুলসীদা বললেন—‘অভিনয় যদি ভালো লাগে তাহলে অভিনয়কে সাধনা করে নিয়ো হে উত্তম। তবেই জীবনে প্রতিষ্ঠা পাবে।’

শুরু করলেন তাঁর জীবনের কাহিনি বলতে। তিনি বললেন— ‘মাত্র ন’বছর বয়সে তিনি অভিনয় করতে পারবেন বলে কেমন করে ভিড়ে গিয়েছিলেন একটা সার্কাসের দলে। আউট্রাম ঘাটে তিনি আর তাঁর বন্ধু একদিন দেখলেন একটা দল বর্মা মুলুকে যাবে জাহাজে করে। সঙ্গে তাদের প্রচুর জিনিসপত্র। বর্মা কোথায়, কলকাতা থেকে কতদূর, কিছুই জানা নেই। তবু জানেন দলে ভিড়তে পারলে দর্শকদের অভিবাদন করবার সুযোগ তিনি পাবেন।

এই আশাতেই তিনি একদিন দেখা করলেন ম্যানেজারের সঙ্গে। মনোনীত হলেন সার্কাসে খেলা দেখাবার জন্যে। জাহাজে উঠে পড়লেন। ঘাট থেকে জাহাজ ছেড়ে দিল।

ঝোঁকের মাথায় কাজটি করবার সময় তার গুরুত্ব বোঝেননি। বুঝলেন, যখন কলকাতার মাটি ধীরে ধীরে চোখের সামনে থেকে সরে যেতে লাগল। তাও মিলিয়ে গেল দিকচক্রবালে। ক্রমশ জাহাজ এসে পড়ল সমুদ্রের মাঝখানে।

এ যেন রবীন্দ্রনাথের ‘দেবতার গ্রাস’ এর রাখালের অবস্থা।—

‘জল, জল, জল,

দেখে দেখে চিত্ত তার হয়েছে বিকল।’

কিন্তু ফিরে যাবার উপায় নেই, সার্কাসের ম্যানেজারের ভয় রয়েছে।

এলেন বর্মা মুলুকে। তাঁবুতে খেলাও দেখালেন। খেলা দেখাতে গিয়ে বুঝলেন তিনি যা মনে মনে চেয়েছিলেন এ, তা নয়। কী করেন অনেক কষ্টে এলেন কলকাতায়। স্টার থিয়েটারে যোগ দিয়ে পূর্ণ হল তাঁর মনের বাসনা।

তারপর বললেন—’জানলে, কত কষ্ট করেছি থিয়েটার করবার জন্যে। তবুও তো একটা বড়ো পার্ট পেলাম না আজ পর্যন্ত। বলি, তোমরা তো একেবারেই হিরো হয়ে এসেছো হে! যেদিন প্রথম একটু বড়ো পার্ট পেলুম,—তাও নতুন বইতে নয়, একজন আসেনি তার জায়গায়, এক রাত্তিরের জন্যে—সেদিন আমার ড্রেসারের কাছে গেলুম মোজা চাইতে। ড্রেসার বলল— ভাগ, একদিনের জন্য পার্ট করবে, তার জন্যে আবার মোজা পায়ে দেবে। সবেদা দিয়ে এঁকে নে।’

আমি বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলাম— ‘তাই করলেন?’

তুলসীদা বললেন— ‘উপায় কি, চান্স মিস করব ভাই? আর যদি না চান্স পাই! সবেদা আর আলতা দিয়ে বর্ডার এঁকে নেমে গেলাম স্টেজে। তারপর সাতদিন লাগলো পায়ের আলতার দাগ তুলতে।

যখনই আলতা ধুয়েছি, তখনই মনে মনে আনন্দ হয়েছে যে একটা বড়ো পার্ট করবার সুযোগ পেয়েছি।’

ওনার কথা শুনে বুঝলাম, কতখানি ভালোবোসেন উনি অভিনয়কে।

তারপর বললেন—’শুনবে আর একটা গল্প? সেবারে পার্ট পেয়েছিলাম হাকিমের। কথা ছিল নায়িকার নাড়ি টিপে বলব— আর চিন্তার কারণ নেই, রক্ষা পেয়ে যাবেন।’

মনে মনে কত আশা। ভাবছি ভালোভাবে পার্টটা করতে পারলে চাই কি একদিন হিরোর চান্সও হয়ে যাবে।

কিন্তু কপাল আমার মন্দ। স্টেজে গিয়ে দারুণ ভয় পেয়ে গেলুম। কারণ নায়ক বা নায়িকা যাদের সঙ্গে পর্দায় অভিনয় করতে হবে, তাঁরা দুজনাই সে যুগের শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বা অভিনেত্রী। হাত পা কাঁপতে লাগলো, মাথাটা কেমন যেন ঘুরে উঠলো। তবুও মনটাকে জোর করে রেখেছি— এই অভিনয়ের উপর আমার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে।

আমার কথা বলার সময় এলো। কথাগুলো উলটে বলে ফেললাম— “রক্ষার কারণ নেই, চিন্তা পেয়ে যাবেন।” কথাটা বলে ফেলে নিজেও ভালো বুঝতে পারিনি যে ভুল বলেছি।

প্রশংসা পাবার আশায় নায়িকার মুখের দিকে চেয়ে আছি, সেখানে অসুস্থতার লক্ষণ নেই, চোখে ফুটে উঠেছে আগুন। নায়কের মুখও বিরক্তিপূর্ণ।

বুঝলাম কোথায় একটা গোলমাল করে ফেলেছি।

তাড়াতাড়ি স্টেজ থেকে ভেতরে আসতেই প্রম্পটার আমাকে এই মারে তো ঐ মারে।

সীন পড়তে নায়কও খোঁজ করলেন আমাকে। ভয়ে পালিয়ে গেলাম সেদিনকার মতো গ্রীনরুম থেকে। তারপর সাতদিন একেবারে থিয়েটারমুখোই হইনি।’

প্রথম আলাপেই তিনি জয় করে নিলেন আমার হৃদয়। আমাদের বন্ধুত্ব শুরু হল এইভাবে। যদিও মুখে ওকে ‘দাদা’ বলতাম, স্নেহ পেতাম পুত্রের। আমাদের সম্বন্ধ হতে লাগল নিবিড়তর।

আজ তুলসীদার কথা লিখতে বসে কত কথা মনে পড়ছে। মনে পড়ছে আমার প্রথম গাড়ি কেনার কথা। গাড়িটা ছিল হিন্দুস্থান—১৪।

‘চাঁপাডাঙ্গার বৌ’ স্যুটিং হচ্ছে। গাড়িটা চড়ে গেলাম স্টুডিওতে।

আমার গাড়ি দেখে তুলসীদার সে কী আনন্দ! বারবার মুছছেন গাড়িটাকে। সকলকে ডেকে বলছেন— ‘উত্তম আজ গাড়ি কিনেছে।’

তখনও গাড়ি চালাতে শিখিনি।

আমাকে বললেন— ‘একবার আমাকে ঘুরিয়ে আনবি?’

ড্রাইভারকে বললাম তুলসীদাকে ঘুরিয়ে আনতে। একপাক টালিগঞ্জ অঞ্চল ঘোরা হল ।

গাড়ি আবার স্টুডিওতে ফিরে এলো। তুলসীদার মন তখনও তৃপ্ত হয়নি।

আমাকে বললেন— ‘চ আরেকবার ঘুরে আসি লেকের ধার থেকে।’

সেদিন তুলসীদার মুখে যে কী আনন্দর চিহ্ন আমি দেখেছিলাম অতি আত্মীয় ছাড়া তেমনটি আর দেখা যায় না। সে মুখ আমার স্মৃতিপটে চিরদিন আঁকা থাকবে।

আর একবার বুড়ো (তরুণকুমার) নিয়ে গিয়েছিল গৌতমকে, স্টুডিওতে।

গৌতমের পরিচয় তুলসীদা যেই পেলেন, সঙ্গে সঙ্গে তাকে কোলে নিয়ে তাঁর কী আনন্দ!

মেক—আপ করছিলেন তুলসীদা। বন্ধ হল তাঁর মুখের রং মাখা। ছোটো ছেলের মতো তিনি গৌতমকে নিয়ে নাচতে লাগলেন।

আমি বলি— ‘তুলসীদা, পরিচালক যে এখুনি ডাকবেন, মেকআপটা শেষ করে নিন।’

উনি বললেন— ‘তুই থাম। অনেক অভিনয় করেছি জীবনে, বাঁচলে অনেক অভিনয় করবও ভবিষ্যতে। কিন্তু গৌতম এমন ছোট্টটি থাকবে না, সে বড়ো হয়ে যাবে। তখন হয়তো আমাকে এমন অবাক চোখে আর দেখবে না।’

মুহূর্তের মাঝে দেখি বয়সের ব্যবধান ছুটে গেছে। তুলসীদাকে দেখে, কে বলবে তিনি তখন পঞ্চাশের ওপরে বৃদ্ধ। তখন মনে হচ্ছে তিনি যেন গৌতমেরই সমবয়সি।

আর একবার তুলসীদা আর আমি গাড়িতে যাচ্ছি আশুতোষ মুখার্জি রোডের ওপর দিয়ে।

বেলা তখন কতইবা! চারটে বাজে। ঠিক এমনি সময় একটা মেয়ে—স্কুলের ‘বাস’ আমাদের পাশ দিয়ে চলে গেল। নায়ক হিসেবে তখন আমার কিছু নাম হয়েছে। তাই ছাত্রীরা আমার দিকে বিস্ফারিত চোখে চেয়েছিল।

ব্যাপারটাকে আমি তত গুরুত্ব দিইনি। কারণ তখন আমি গাড়ি চালাতেই ব্যস্ত।

তুলসীদা হঠাৎ আমাকে বললেন—’দেখো, উত্তম, ওরা বিস্ফরিত দৃষ্টিতে তোমার দিকে চাইল। তোমার উচিত ছিল হাত নেড়ে ওদের অভিনন্দন জানানো।’

আমি বলি —’কেন তুলসীদা?’

তুলসীদা বললেন— ‘যদি তোমাকে কেউ নায়ক করে থাকে, জানবে সে হচ্ছে ওই ছোটো ছোটো আমাদের বোনেরা। পরিচালক নন, প্রযোজকও নন। ওরা খোঁজে বলেই তোমার এত দাম। নইলে আমাদের আর দাম কী!’

ভেবে দেখলাম কথাটা নিদারুণ সত্য। যতদিন দর্শকের কাছ থেকে সংবর্ধনা পাইনি ততদিন তো আমাকে কেউ খোঁজেনি! আমাকে নায়ক করেছেন, প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন আমার দর্শকরা। আমার যা—কিছু সব তাঁদেরই। সুতরাং সতর্ক হয়ে তাঁদের অভিবাদন জানানো উচিত আমার।

তুলসীদার কথা লিখতে বসলে লেখার শেষ হয়না কোনোদিন। তাই জোর করেই নিজেকে সংবরণ করছি। তুলসীদার একটা কথা ছিল — ‘সূর্যতোরণ’—এ উত্তম আমাকে চাকর রেখেছে। ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’—এ আমি উত্তমকে চাকর রেখেছি।

ইদানীং আমার সঙ্গে দেখা হলেই তিনি ‘সূর্যতোরণ’—এর সংলাপ বলতেন। আগামী ছবি ‘বিপাশা’য় আবার দেখবেন তাঁর ‘পানওয়ালা’র অদ্ভুত পার্ট।

তুলসীদা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। খবরটা পেয়ে আমি বুড়োকে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম তাঁকে দেখতে। বলেছিলাম, ‘বলবি, সুবিধে পেলেই আমি তাঁকে দেখতে যাবো।’

আমি যাব শুনে তাঁর সে কী আনন্দ! বলে পাঠালেন, ‘উত্তমকে বোলো, তাকে আসতে হবে না। আমি ডাক্তারের অনুমতি পেলেই নিজে যাব তার কাছে।’

যাব যাব করে আমারও যাওয়া হল না। গেলাম ‘শিউলিবাড়ি’র স্যুটিং করতে। সেখানেই শুনলাম এই নিদারুন ঘটনা।

স্মৃতির ঝুলি খুলে ভাবছিলাম আমার হারিয়ে যাওয়া দিনের কথা। তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ মনে হল তুলসীদা সামনে এসে মুখে সেই সুপরিচিত হাসি ফুটিয়ে আমাকে বলে যাচ্ছেন বহুবার শোনা ‘সূর্যতোরণ’—এর সংলাপ।

ঘুম ভেঙে গেল। চেয়ে দেখলাম ঘরে কোথাও কেউ নেই। মনে হল তিনি তো আজ সব ধরাছোঁয়ার বাইরে।

প্রণাম জানালাম মনে মনে। বললাম, তুলসীদা আশীর্বাদ করুন, যেন আপনার মতো প্রকৃত অভিনেতা হতে পারি।

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. পীযূষ বসু পরিচালিত ‘শিউলিবাড়ি’ ছবিটি শ্রী, ইন্দিরা, প্রাচীসহ অন্যান্য প্রেক্ষাগৃহে ২৩/২/১৯৬২ তারিখে মুক্তি পায়। ছবিটির নায়ক-নায়িকা ছিলেন উত্তমকুমার ও অরুন্ধতী (দেবী)।
  2. রবীন্দ্রনাথের লেখা একটি বিখ্যাত কবিতা। যা অনেক প্রখ্যাত আবৃত্তিকারের কণ্ঠে স্মরণীয় হয়ে আছে।
  3. উত্তমকুমারের একমাত্র সন্তান পুত্র গৌতম চট্টোপাধ্যায়। ১৯৫০ সালের ৭ সেপ্টেম্বর জন্ম। কয়েকবছর আগে প্রয়াত। গৌতমবাবুর অভিনয় জগতের সঙ্গে কোনো যোগ ছিল না। কিন্তু এনার পুত্র গৌরব চট্টোপাধ্যায় বর্তমানে টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র দুনিয়ায় এক সুপরিচিত অভিনেতা হয়ে উঠেছেন।
  4. ১৯৫৮ সালের ২১ নভেম্বর মিনার, বিজলী, ছবিঘরসহ অন্যান্য প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় ‘অগ্রদূত’ পরিচালিত ‘সূর্যতোরণ’ ছবিটি। নায়ক ও নায়িকা ছিলেন যথাক্রমে উত্তমকুমার ও সুচিত্রা সেন। ছবিটির সংগীত পরিচালক ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। প্রসঙ্গত, এই ছবির গানগুলির গীতিকার ছাড়াও ছবিটির কাহিনিকারও ছিলেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার।
  5. উত্তরা, পূরবী, উজ্জ্বলাসহ অন্যান্য প্রেক্ষাগৃহে ১৯৬০ সালের ২৮ এপ্রিল মুক্তি পায় রবীন্দ্রনাথের কাহিনিনির্ভর ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’ ছবিটি। ছবিটিতে চাকর ‘রাইচরণ’-এর মতো একটি ব্যতিক্রমী চরিত্রে রূপদান করেন উত্তমকুমার। সংগীত পরিচালক ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।