উত্তমকুমার চট্টোপাধ্যায়

হারিয়ে যাওয়া দিনগুলি মোর

তিন

অনেকে আমাকে আর সম্পাদকমশাইকে চিঠি দিয়েছেন। তাঁরা আমার পূর্বোক্ত কাহিনির মধ্যে রোম্যান্টিক ঘটনা পাননি বলে অভিযোগ জানিয়েছেন।

পর্দার ওপরে আমাকে তাঁরা দেখেছেন নানারকম রোম্যান্টিক চরিত্রে অভিনয় করতে। কিন্তু তেমন রোম্যান্সের সন্ধান আমি পাই কোথায়? তাও আবার এই বিশেষ ধরনের রোম্যান্সগুলো ঘটে একটা নির্দিষ্ট বয়সে। সেই বয়সে কাহিনিকে না টেনে নিয়ে যাওয়া অবধি, আপনাদের কাছে আমার বিনীত নিবেদন, আপনারা একটু ধৈর্য ধরে আমার কথা শুনুন।

যাক যা বলছিলাম।

আমার জেঠামশাই-এর ছিল ‘সুহৃদ সমাজ’ নামে একটি যাত্রা ক্লাব।

ছেলেবয়সে পড়াশুনা আরম্ভ হবার আগে আদরের ভাইপো বলে, রিহার্সালে যাবার অধিকারটুকু আমার বোধহয় মিলত। সেইসমস্ত যাত্রার বিভিন্ন ভঙ্গী, পার্ট, আবৃত্তি আর গান আমাকে মুগ্ধ করত। তখন থেকে ভাবতাম কবে বড়ো হব, কবে আমিও যাত্রা করবার সুযোগ পাব!

যাত্রার রিহার্সাল দেখতে দেখতে কতদিন যে ক্লাবঘরে ঘুমিয়ে পড়েছি তার আর ইয়ত্তা নেই। দিনের বেলায় রিহার্সাল বসত না। বড়ো ফাঁকা ফাঁকা লাগত। কেবলই মনে হত কখন সন্ধে হয়!

আগেই বলেছি আমরা ছিলাম যৌথ পরিবার। তাই আমার বয়সি আমার সঙ্গীসাথিরও বিশেষ অভাব ছিল না। কিন্তু সকলকার চেয়ে আমার বিক্রম বেশি ছিল আমার নিজের দিদির ওপর।

এইখানে বলে রাখি, আমরা ছিলাম চার ভাইবোন। ছিলাম বলছি, তার কারণ, আজ আমাদের একজন আর ইহলোকে নেই। শৈশবেই তাকে চলে যেতে হয়েছে অপর এক পৃথিবীর ডাকে।

খুব সম্ভব ‘বুড়ো’ (তরুণকুমার) তখনও হয়নি।

একদিন সকালবেলায় খেলতে খেলতে দিদি আমাকে বলে—‘হ্যাঁরে তুই রোজ সন্ধের পর ক্লাবঘরে যাস কেন?’

আমি বলি—‘যাই কেন জানিস? যাত্রা শিখব বলে।’

দিদি বলে—‘ইস, তুই যাত্রা করতে পারবি? যা রোগাপটকা চেহারা তোর!’

আমি রেগে উঠলাম। ক্ষেপে উঠে দাঁড়িয়ে যাত্রার ভঙ্গীতে আবৃত্তি করতে লাগলাম।

দিদি হেসেই খুন? দিদি যত হাসে, আমার যাত্রা করবার উৎসাহ ততই বাড়ে। ভেতর ভেতর রাগও যে হচ্ছিলনা তা নয়।

হঠাৎ পার্ট বলা বন্ধ করে বলি—‘হাসছিস কেন রে?’

দিদি বলে—‘হাসব না? তুই কি যাত্রা করছিস, তুই তো কেবল আমার দিকে চেয়ে পার্ট বলে যাচ্ছিস। যাত্রা বুঝি ওইভাবে করে? যাত্রা করতে গেলে তো ঘুরে ঘুরে অ্যাক্টিং করতে হয়।’

সত্যি তো, ক্লাবঘরে যাদের অ্যাক্টিং করতে দেখেছি তারা তো ঘুরে ঘুরেই বলে। উত্তেজনার মাথায় সেটা তো ভুলেই গিয়েছিলাম।

কিন্তু দিদির কাছে তর্কে হারতে ইচ্ছে হ’ল না। তাই বলি—‘ইস—আমি কি সত্যিকারের যাত্রা করছি নাকি! আমার কি গদা আছে না তলোয়ার আছে! গদা আর তলোয়ার জোগাড় করে দে, তা হলে দেখ আমি যাত্রা করতে পারি কি না। এখন তো আমি থিয়েটার করে তোকে দেখাচ্ছিলাম।’

অকাট্য যুক্তি। এর কিছুদিন আগে মা’র সঙ্গে আমার মামারবাড়ি গিয়েছিলাম। সেখান থেকে মায়ের সঙ্গে একদিন থিয়েটারও দেখতে গিয়েছিলাম। কী থিয়েটার দেখেছিলাম, তা আজ আর মনে নেই। মনে রাখবার বয়সও তখন আমার হয়নি। তবে পর্দা ওঠবার পর পাদপ্রদীপের সামনে কয়েকজন লোক এসে চিৎকার করে কী সব বলছিল। তাদের হাত ঘোরানো, চলে যাওয়া, দেখতে দেখতে কখন যে মায়ের বুকে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তা নিজেই বুঝতে পারিনি।

দিদি ছিল আমার চেয়ে মাত্র দু বছরের বড়ো। তারও পরিণাম ওই একই হয়েছিল।

আমরা দুই ভাইবোন যখন ঘুম থেকে উঠলাম, তখন দেখি কোথায় থিয়েটার, কোথায় বা গদি-আঁটা চেয়ার। তার বদলে আমরা শুয়ে আছি মায়ের দুধারে।

তাই আমার ওই যুক্তিতে দিদি চুপ করে গেল। খানিকটা চুপ করে থেকে বলল—‘কই তুই তো গান গাইলিনি!’

বলা বাহুল্য যাত্রা ক্লাবঘরে গানের রিহার্সাল রোজই সন্ধেবেলায় বসত। কয়েকটা গান, প্রত্যহ শুনে শুনে, একরকম মুখস্থর মতনই হয়ে গিয়েছিল, তাই চেঁচিয়ে গান ধরলাম। তাতে না ছিল সুর, না ছিল কিছু। তারস্বরে চিৎকার করে কয়েকটা লাইন মুখস্থ বলা ছাড়া আর কিছু নয়।

দিদি হয়তো এতটা আশা করেনি আমার কাছ থেকে—তাই সে বড়ো বড়ো চোখ করে কেবল আমার দিকে চেয়ে রইল।

ঠিক এমনি সময় পেছন থেকে চটিজুতোর ফটফট আওয়াজ শুনে দিদি আর আমি সচকিত হয়ে পেছনদিকে চাইলাম। দেখি বাবা আসছেন। আমি থেমে গেলাম।

বাবা কাছে এসে সস্নেহে বললেন—‘কীরে খোকা, গান গাইছিলি?’

আমি অপ্রস্তুত হয়ে গিয়ে বলি—‘না, মানে ইয়ে—‘

সস্নেহে আমার পিঠটা চাপড়ে দিয়ে বাবা বললেন—‘সামনেই সরস্বতী পুজো, সেইদিন তোমার হাতেখড়ি হবে। তারপর তোমায় ভর্তি করে দেব স্কুলে।’

দিদি অবশ্য কাছেরই একটা মেয়ে স্কুলে ভর্তি হয়েছিল। আমি স্কুলে যেতাম না বলে, নিজেকে কেমন দিদির চেয়ে ছোটো ছোটো মনে হত। সেই আমি, আমার হাতেখড়ি হবে, আমি স্কুলে যাব। আনন্দের আর সীমা রইল না।

বাবা কিন্তু কথা বলে আর দাঁড়াননি, চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু হাতেখড়ি জিনিসটা যে কী তা তো বুঝে নেওয়া হয়নি। তাই ছুটে গেলাম মায়ের কাছে। জিজ্ঞেস করলাম—‘হাতেখড়ি কী জিনিস মা?’

মা বললেন—‘সরস্বতী পুজোর দিনই দেখতে পাবে।’

সরস্বতী পুজোর আগে বাবা নিয়ে এলেন আমার জন্যে একখানা ধুতি আর চাদর। অবশ্য দিদির জন্যেও একখানা ছোট্ট শাড়ি এনেছিলেন বাসন্তী রঙের।

মা আমার ধুতি আর চাদরটাকে রঙে চুপিয়ে পরতে দিলেন।

সরস্বতী পুজোর দিন নতুন ধুতি আর চাদর পরে প্রতিমার সামনে উপস্থিত হলাম। সকাল থেকেই মা খেতে বারণ করেছিলেন। বলেছিলেন—খেলে নাকি বিদ্যে হয় না। দারুণ খিদেও তখন পেয়েছিল। বড়ো বড়ো নারকোলে কুল, মাখন, মিছরি, মিষ্টি, সব কিছু সাজানো রয়েছে থালার ওপর। মা, জেঠাইমা আজ সকাল থেকেই পুজোর কাজেই লেগে রয়েছেন।

পুরোহিতমশাই আমার হাত ধরে, মাটিতে খড়ি পেতে লিখতে শেখালেন। কী যে ঘটে গেল ব্যাপারটা তা আমি নিজেও ঠিকমতো বুঝতে পারলাম না। তারপর পুজোর শেষে অঞ্জলি দেওয়া। অঞ্জলিশেষে মা বললেন—‘এবারে প্রসাদ খা খোকা।’

আমাকে, দিদিকে, আলাদা করে তিনি প্রসাদ দিলেন। কিন্তু, কতক্ষণ— আমার সেটাকে শেষ করে ফেলতে।

খাওয়া শেষ করে দেখি দিদির তখনও আদ্দেকও খাওয়া হয়নি।

প্রথমে অনুনয়-বিনয় করলাম দিদিকে, বললাম—‘সকাল থেকে কিছু খাইনি, বড্ড খিদে পেয়েছে, দে ভাই, দে, একটু ভেঙে দে।’

উত্তরে দিদি মুখঝামটা দিয়ে বলল—‘আর আমি বুঝি সকালবেলা একপেট খেয়েছি! অঞ্জলি দেব বলে আমিও যে কিছু খাইনি তা জানিস না!’

সত্যিই দিদিও সকাল থেকে কিছু খায়নি, সেটা আমার অজানা নয়। কিন্তু একটা কিছু বলতে হয়, তাই দিদিকে বলি—‘তোর কি হাতেখড়ি হয়েছে যে তোর খিদে পেয়েছে?’

দিদি বলে—‘নাইবা হ’ল!’

বুঝলাম অনুনয়-বিনয়ে কিছু হবে না। তাই দিদির চুলের মুঠি ধরে পিঠে বসিয়ে দিলাম গুম গুম করে গোটা-কতক কিল। আর তার পাত থেকে সন্দেশটা তুলে নিয়ে পালিয়ে গেলাম সেখান থেকে।

আমার হাতে মার খেয়ে দিদি ভ্যাঁ করে কান্না জুড়ে দিল।

জানতাম ওই রকমই একটা কিছু হবে। তার জন্যে তাই তৈরিই ছিলাম। মা’র কাছে ঘণ্টা দু-তিনের ভেতর না গেলেই হল। তারপর ঘটনাটা মাও ভুলে যাবে, দিদিও ভুলে যাবে। কতক্ষণ সে আর আমার সঙ্গে না কথা বলে থাকতে পারবে?

ক্লাবের ঘরে পুজো হয়েছিল। তাই এদিক সেদিক বেশ খানিকটা ঘুরে ফিরলাম বাড়ি।

আমাকে দেখতে পেয়ে দিদি বলল—‘হ্যাঁরে খোকা, এতক্ষণ ছিলি কোথায়? মা কখন থেকে খুঁজছে তোকে।’

আমি বলি—‘কেন রে দিদি?’

—‘বাঃ, খুঁজবে না? কত বেলা হয়েছে বল তো, খাবি না?’

আমি জিজ্ঞেস করি—‘তুই খেয়েছিস দিদি?’

দিদি একটু যেন আশ্চর্য হয়ে গিয়ে বললো—‘তুই খাসনি, আমি কী করে খাব?’

এই আমার সেই দিদি, যাকে খানিকক্ষণ আগে আমি মেরেছি! যার পাত থেকে আমি তারই মুখের সন্দেশ কেড়ে নিয়েছি? আর বিনিময়ে সেই দিদি আমার, আমারই জন্যে না খেয়ে অপেক্ষা করছে? বড়ো মায়া হল। দিদিকে দু হাতে জড়িয়ে ধরে বলি—‘চল ভাই, খেতে যাই।’

মনে থাকবার নয় তবু মনে আছে, কারণ এরই পরে আমার জীবনে এমন একটা ঘটনা ঘটেছিল যা আমি ভুলতে পারিনি আজও। বোধহয় ভুলতে পারবও না কোনোদিন। আর আমি তা ভুলতেও চাই না। ভুলতে চাই না এই জন্যে, কারণ সেদিনের কথা ভুললে, বিস্মৃতির অতলতলে মিলিয়ে যাবে আমার জীবনের অনেকখানি। কারণ এরই কিছু পরে, মাত্র সাত বছর বয়সে, আমার দিদি ছেড়ে গেছে ইহলোক। মাত্র কয়েক দিনের জ্বরে সে ভুগেছিল।

সব কথা আজ পরিষ্কার মনেও নেই। তবে এইটুকু পরিষ্কার মনে আছে, দিদিকে নিয়ে মা সারাদিন বসে রইলেন।

বাবা সেদিন কাজে বেরোননি। কেবল ঘর আর বার করছিলেন।

মা’র কোলের ওপর শুয়ে দিদি মাঝে মাঝে যন্ত্রণায় কেবল বলছিল—‘উঃ, আঃ!’

ঘরের মধ্যে ঢুকে বড়ো বড়ো চোখ করে আমি তারই দিকে চেয়েছিলাম।

মা’র মুখখানা কেমন যেন থমথম করছে। সাহস করে একবার ডাকলাম—‘দিদি!’

সেই যন্ত্রণার মাঝখানেও দিদি চোখ মেলে একবার আমার দিকে চাইল। বোধহয় কী যেন বলতেও চাইল, কিন্তু বলতে পারল না। ঠোঁট দুটো তার কেঁপে কেঁপে উঠল।

ঘরের মধ্যে বাবা বসেছিলেন। আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। বললেন—‘দিদির অসুখ করেছে, ওকে ডেকে বিরক্ত কোরো না।’

আমার কেন যেন ভয় ভয় করছিল।

কেঁদে ফেলে বলি—‘বাবা, দিদি কথা বলছে না কেন? কালও তো দিদি আমার সঙ্গে কথা বলেছে।’

বাবা খানিক গম্ভীর হয়ে বললেন—‘অসুখটা আজ দিদির বেড়েছে কি না! তাই—’

‘তাই’ যে কী তা বুঝিনি তখন। বুঝলাম খানিক বাদে, যখন দেখলাম, মা দিদির ওপর লুটিয়ে পড়ে আর্তনাদ করে উঠলেন।

আমি বিস্মিত হয়ে গিয়ে বলি—‘মা, ওকী করছ, দিদির লাগবে না!’

বাবাকে বলতে গেলাম। কিন্তু বাবারও চোখে দেখি জল। বাবাকেও বলা হল না কথাটা।

বাড়ির সকলে কাঁদল। সকলের কান্না দেখে আমিও কাঁদলাম। এরপর দিদিকে ওরা নিয়ে গেল।

আমার মনে প্রশ্ন উঠল, দিদিকে ওরা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? ডাক্তারবাবুর বাড়ি?

কাঁদতে কাঁদতে সে রাত্রে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সকালবেলা উঠে প্রতিটি মুহূর্তে ভেবেছি বুঝি দিদি ফিরে আসবে। কিন্তু দিদি তো ফিরল না!

এমন অবস্থা, মুখ ফুটে কাউকে কিছু জিজ্ঞাসাও করতে পারিনা।

মাকে যে জিজ্ঞাসা করব, তারও উপায় নেই কারণ আমি ঘরে ঢুকলেই মা কেবলই ‘খুকি রে’ বলে কাঁদছেন।

অনেকক্ষণ পরে প্রশ্ন করলাম, আমার চেয়ে বয়সে বড়ো আমার এক জেঠতুতো ভাইকে। জিজ্ঞেস করলাম—‘দিদি কোথায়, কবে আসবে?’

গম্ভীর হয়ে গিয়ে আমার সে দাদা বললেন—‘পুতুল আর ফিরে আসবে না।’

—‘ফিরে আসবে না? কেন?’

দাদা বললেন—‘সে মারা গেছে।’

মারা গেলে যে লোকে ফিরে আসে না তা বিশ্বাস হল না। কতবার জিজ্ঞেস করলাম—‘লোকে মরে কোথায় যায়?’

দাদা বললেন—‘ঐ আকাশে!’

তারপর কতদিন নিজের মনেই ওই আকাশের দিকে চেয়ে দিদিকে দেখবার চেষ্টা করেছিলাম।

কতবার ভেবেছি ওই তারার মধ্যে দিদির মুখ বুঝি উঁকি মারছে। অস্পষ্টভাবে দেখতেও যে পাইনি তাও নয়।

মাঝে মাঝে তাকে দেখতেও পেয়েছি। কিন্তু চোখ কচলে ভালোভাবে যেই তাকে অনুভব করতে গেছি সঙ্গে সঙ্গে সে হারিয়ে গেছে ওই আকাশের নীলের মাঝে।

আজও একা থাকলে, রাত্তিরবেলায় আকাশেরদিকে চেয়ে ভাবি—কোথায় সে আমার হারিয়ে যাওয়া বোন! মাঝে মাঝে যেন শুনতে পাই কে যেন আমায় কচি গলায় বলছে—‘তুই এখনও খাসনি, আমি খাব কী করে?’

সংসারে সবই পেলাম, কিন্তু অমন বোনের স্নেহ তো কোথাও পেলাম না!

এই কথাটাই প্রথম প্রথম ভাবতাম। কিন্তু আজ? আজ আমার দিদিকে আমি পেয়েছি বাংলাদেশের প্রতিটি মেয়ের মধ্যে।

আমার অভিনয় দেখে যখনই কোনো ভদ্রমহিলা আমাকে চিঠি লিখেছেন আমার অভিনয়ের সুখ্যাতি করে, তখনই আমি ভেবেছি, আমার দিদি যদি আজ বেঁচে থাকত, তাহলে সে আমার গৌরবে এমনিভাবেই আনন্দ প্রকাশ করত, এমনিভাবেই আমাকে জানাত অভিনন্দন।

তাই আমার মনে হয়, আমার দিদি নেই ওই আকাশে, সে আবার জন্ম নিয়েছে বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে ঘরে। দেশের প্রতিটি মেয়ের মুখে ফুটে উঠেছে তার প্রতিচ্ছবি।

তাই আজ আর আমার দুঃখেরও কোনও কারণ নেই। ভ্রাতৃদ্বিতীয়ায় যখন মঙ্গলশঙ্খের সঙ্গে প্রতিবেশিনীরা ভায়ের কপালে ফোঁটা দেন তখন আমার মনে হয়, একটি নয় দুটি নয়, অগণিত চন্দনের ফোঁটা এসে পড়ছে আমার কপালে।

অগণিত ভগ্নীর দল আমার মঙ্গল কামনা করছেন ভগবানের চরণে।

যাক সে সব কথা। আমি দার্শনিক নই, উচ্চশিক্ষিতও নই। তবে লেখক হিসেবে আত্মকাহিনি লিপিবদ্ধ করতে গিয়ে আমার মনের ভাবটুকু আমি বর্ণনা করেছি এইমাত্র।

আবার ফিরে যাই আমি পুরোনো কাহিনিতে।

এ সংসার কারোর জন্যেই আটকে থাকে না। নিজের গতিতে সে এগিয়ে চলে। অদ্ভুত তার যাত্রা। এর শেষ নেই, বিরাম নেই, ক্লান্তি নেই। সে চলেছে। কেবলই এগিয়ে চলেছে। ভাগ্যবিধাতার নির্দেশে কবে যে তার যাত্রা শুরু হয়েছিল, তা কেবল তিনিই জানেন। মানুষ তার অর্থ কী বুঝবে? তাই সে গতির সঙ্গে তাল রেখে যে না চলতে পারে, সে পড়ে স্মৃতির পর্যায়ে।

আমাদের এই জীবনটাই দেখুন না কেন। স্মৃতি ছাড়া তো আর কিছু নেই! তাই আজকের দিন যা চলে যাচ্ছে, কালকে শত চেষ্টায়ও তাকে ফেরাতে পারা যাবে না। আজকের দিন পড়বে স্মৃতিতে।

তারই মধ্যে কোনোটা থাকবে উজ্জ্বল, কোনোটা থাকবে ম্লান হয়ে। তাই এ জীবনকে যদি আমরা স্মৃতির সমষ্টি বলি তাহলে কি ভুল হয়?

তেমনি আমার দিদির স্মৃতি আমার মনে উজ্জ্বল হয়ে রইল!

মা আবার উঠলেন, আমাদেরই মুখ চেয়ে। সংসার আবার চলতে শুরু হল আগেকারই মতন। বিশেষ কোনো পরিবর্তন দেখা দিল না।

চক্রবেড়িয়া স্কুলে বাবা আমায় ভর্তি করে দিলেন। কিন্তু লেখাপড়া করবে কে? অভিনয়ের নেশা আমার মন থেকে গেল না। অভিনয় যে আমায় করতেই হবে।

মাঝে মাঝে ভাবি—জেঠামশাইকে বলব নাকি? কিন্তু বলবার দরকার আর হল না।

আমার জীবনে অভিনয়ের সুযোগ এসে গেল। স্কুলে প্লে হবে ‘গয়াসুর’। বড়ো ছেলেরাই প্লে করবে। কিন্তু ছোটো গয়াসুর সাজবার ছেলে নেই।

দু চারজন ছেলেকে ওই পার্টের জন্য ট্রায়াল দেওয়া হল, কিন্তু কেউ পারল না। শেষকালে স্যার বিরক্ত হয়ে একদিন ক্লাসে এসে বললেন—‘তোমাদের মধ্যে এমন কি কেউ নেই, যে প্লে করতে পারে?’

কেমন যেন অপমান বোধ হল। সঙ্গে সঙ্গে বেঞ্চি ছেড়ে দাঁড়িয়ে বললাম—‘আমি করব স্যার!’

স্যার আমার দিকে চোখ রেখে বললেন—‘ইউ বয়! তোমার নামটা কী, অরুণ না? পারবে, ভয় পাবে না?’

— ‘না স্যার।’

— ‘বেশ এসো।’

স্যার আমায় নিয়ে গেলেন রিহার্সাল রুমে। ছোটো গয়াসুরের পার্ট দিলেন আমাকে। আমারও মনটা আনন্দে ভরে গেল একটা অভিনয়ের চান্স পেয়েছি বলে।

পার্ট মুখস্থ করতে দেরি হল না। নিয়মিত রিহার্সালে যাই।

আমাদের বাংলা শিক্ষক আমাদের অভিনয় শেখাতেন, দেখতে দেখতে অভিনয়ের দিন এগিয়ে এল।

স্কুলের প্রাঙ্গণে তক্তা ফেলে স্টেজ বাঁধা হলো। গ্রিনরুমে আমরা সবাই সাজগোজ করতে আরম্ভ করলাম। দুচারজন দর্শকও এসে জমায়েত হলেন।

গ্রিনরুম থেকে পোশাক পরে, মেক-আপ নিয়ে চলে এলাম স্টেজের ওপর।

উইংসের ফাঁক দিয়ে লক্ষ্য করলাম স্কুলের উঠোনটা। সেখানে ভরে গেছে কালো মাথায়। কেমন যেন ভয় ভয় করতে লাগল। হঠাৎ অনুভব করলাম, আমার মুখ যেন শুকিয়ে গেছে, ভীষণভাবে জলতেষ্টা পেয়েছে।

গ্রিনরুমে ফিরে গিয়ে মেক-আপ-ম্যানের সামনেই ঢক ঢক করে জল খেতে লাগলাম। মেক-আপম্যানও ‘হাঁ-হাঁ’ করে চেঁচিয়ে উঠে বলল— ‘আরে, মুখের রং উঠে যাবে যে!’

অগত্যা আদ্দেকটা গেলাসের জল শেষ করে আবার গেলাম মেক-আপম্যানের কাছে, মুখের রং ঠিক করতে।

ঠিক এমনি সময় আমাদের হেডমাস্টারমশাই এসে ঢুকলেন আমাদের সাজঘরে। তিনি বললেন— ‘রেডি বয়েজ, আর মাত্র দশ মিনিট সময় আছে। ইউ, অরুণ, তুমি এখনও মেক-আপ নিচ্ছ কেন? হয়নি তোমার?’

আমি কাছে সরে গিয়ে বললাম— ‘কেমন যেন ভয় করছে স্যার!’

আমার পিঠে একটা চাপড় দিয়ে বললেন— ‘ডোন্ট গেট নার্ভাস মাই বয়! ভয় পেও না, ভালো অভিনয় করবে তুমি; আমি দেখেছি তোমার রিহার্সাল। এই ন’বছর বয়সেই সুন্দর অভিনয় করছ তুমি।’

যথারীতি ঘণ্টা পড়ে সীন উঠল। আমিও আবির্ভূত হলাম পাদপ্রদীপের সামনে।

হেডমাস্টার মশায়ের সেই উপদেশ বাণী— ‘সামনের দিকে চেও না।’

চাইলাম না সামনের দিকে। নিজের মনেই অভিনয় করে যেতে লাগলাম।

প্রথমটা একটু আড়ষ্ট লেগেছিল। কিন্তু তারপরেই আমি ভুলে গেলাম যে আমি চক্রবেড়িয়া স্কুলের ছাত্র, ভুলে গেলাম আমি অভিনয় করছি।

আমার তখন মনে হতে লাগল, আমি বুঝি কৃষ্ণভক্ত সেই ‘গয়াসুর’।

অভিনয়শেষে সীন পড়ল। হেডমাস্টারমশাই এসে পিঠ চাপড়ে বললেন— ‘ওয়ান্ডারফুল! চমংকার অভিনয় করেছ তুমি।’

তখনও আমার অভিনয়ের ঘোর কাটেনি। নিজেকে তখনও ভাবছি ‘গয়াসুর’।

হেডমাস্টারমশায়ের কথায় আমার চমক ভাঙল। তা হলে আমি ‘গয়াসুর’ নই।

যা হোক, সে রাত্রে দুটো মেডেল পেলাম। মাস্টারমশাই করলেন আমাকে প্রশংসা। মুখে রং মেখেই, পেন্ট না ধুয়ে ছুটতে ছুটতে চলে এলাম গিরিশ মুখার্জি রোডে আমাদের বাড়িতে। পোশাক পরে আসবার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু আমার পার্ট শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই ড্রেসাররা সেগুলো খুলে নিয়েছে। তাই হাফপ্যান্ট আর শার্ট পরেই ছুটে এলাম মা’র কাছে।

মাকে বললাম সব কথা। অবশ্য একটু আধটু বাড়িয়েই বলেছিলাম। কারণ আনন্দ তখন আমি আর চেপে রাখতে পারছি না।

তারপরে মুখের রং তুলে, খাওয়াদাওয়া সেরে শুয়ে পড়লাম।

এরপর, স্কুলে অভিনয় হলেই সুযোগ পাই অভিনয় করবার। কিন্তু জেঠামশায়ের ক্লাবে যাত্রা করার সুযোগ তখনও হয়নি।

কিন্তু যাত্রা তো করতেই হবে আমাকে। জুড়িদের বাজনা শুনে শুনে তো একরকম মুখস্থই করে ফেলেছি। কিন্তু তেমন সুযোগ তো পাচ্ছি না।

সেবারে যাত্রা ক্লাবে ধরা হল ‘ব্রজদুলাল’। ছোটো কৃষ্ণ সাজবার লোক নেই।

বেশ কিছুদিন খোঁজাখুঁজি চলল, কিন্তু মনের মতন ছেলে পাওয়া গেল না। আবার সেবারে অভিনয় করছেন তখনকার বিখ্যাত অভিনেতা ফণী রায়

তার কিছুদিন আগে ‘অন্নপূর্ণার মন্দিরে’ তিনি এক হাঁপানি রুগীর অভিনয় দেখিয়ে, ছবিতে দর্শকদের মন কেড়ে নিয়েছেন।

তাই আমাদের যাত্রা ক্লাবে, যদি অভিনয় খারাপ হয়, তাহলে আমাদের লজ্জার আর শেষ থাকবে না।

বোধহয় এইজন্যেই জেঠামশাই শেষপর্যন্ত রাজি হলেন আমাকে কৃষ্ণের ভূমিকায় অভিনয় করতে দিতে।

প্রায় মাস দুই রিহার্সালের পর শেষপর্যন্ত আমাদের অভিনয়ের দিন স্থির হল।

কোথায় যে সে রাত্রে অভিনয় হয়েছিল আজ আর তা মনে নেই। তবে এক বিরাট উঠোনে আমাদের সে রাত্রে অভিনয়ের আসর বসেছিল, সেটুকু মনে আছে।

আমি বাঁশি হাতে ‘কৃষ্ণ’ সেজে আসরে এলাম। দেখি চতুর্দিকে লোক। দোতলার বারান্দার ওপরে মেয়েরাও বসে দেখছেন।

শুরুতেই ছিল আমার একটা গান। ওদিকে ঢোল, কনসার্ট বেজে উঠলো, আমিও গান ধরলাম।

হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন বলল— ‘ও খোকা, আমার দিকে ফেরো। আমি কি খালি তোমার—’

আবার সেদিকে ফিরলাম। অভিনয় বেশ জমে উঠেছে। যে রাস্তাটা দিয়ে অভিনেতারা আসরে আসছেন, হঠাৎ সেদিকে চোখ পড়তে দেখি জেঠামশাই স্বয়ং দাঁড়িয়ে আমার দিকে বড়ো বড়ো চোখ করে চেয়ে আছেন।

পার্ট শেষ করে যখন আমি সাজঘরে ফিরে গেলাম তখন তিনি আমার পিঠ চাপড়ে বললেন— ‘চমৎকার অভিনয় করেছিস তো!’

জেঠামশাইকে ফণীবাবু সে রাত্রে বলেছিলেন— ‘তোমার ভাইপো বড়ো অভিনেতা হবে হে!’

থাক সেসব কথা।

অভিনয় যখন পুরোদমে চলছে তখন হঠাৎ বাড়ি থেকে চাকর এসে জেঠামশাইকে বললো— ‘যে ছেলেটি “কৃষ্ণ” অভিনয় করছে, তাকে গিন্নিমা ডাকছেন।’

গিন্নিমা!

জেঠামশাই আমাকে বললেন— ‘ওর সঙ্গে তুমি যাও।’

আমি জিজ্ঞেস করি— ‘এইভাবেই জেঠামশাই?’

জেঠামশাই বললেন— ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, ওই ভাবেই।’

অগত্যা গেলাম বাড়ির ভেতর। একজন স্থুলাঙ্গী, সুন্দর চেহারার ভদ্রমহিলা কাছে ডেকে আমার জিজ্ঞেস করলেন— ‘তোমার নাম কী খোকা?’

আমি বলি— ‘অরুণকুমার চট্টোপাধ্যায়।’

তিনি বললেন— ‘উত্তম অভিনয় করেছ তুমি। এতো রাত হয়েছে, কিছু খেয়েছ কি?’

অভিনয়ের আনন্দেই ভুলে ছিলাম। খিদেতেষ্টার কথা মনেও ছিল না।

তিনি কিছুতেই ছাড়লেন না। জোর করে কাছে বসিয়ে আমাকে নানারকম খাবার খাওয়ালেন।

আমি যত বলি—ওদিকে অভিনয়ের দেরি হয়ে যাচ্ছে, তিনি তত বলেন— ‘হোক দেরি। পাঁচ সাত মিনিটে এমন কিছু হবে না, তুমি কিছু খেয়ে নাও, অনেক রাত্তির হয়ে গেছে।’

সে রাত্রের অভিনয়ে বেশ নাম হল আমার। এদিকে অভিনয়ও করি, লেখাপড়াও বেশ সমানভাবেই চলছে। চক্রবেড়িয়া স্কুল ছেড়ে এসে ভর্তি হলাম সাউথ সুবার্বন স্কুলে। সেখান থেকে ‘৪১ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাসও করলাম। এরপর থেকেই আমার জীবনে শুরু হল আর এক নতুন অধ্যায়।

সারা বাংলাদেশের বুকে নেমে এসেছে তখন পঞ্চাশের ভয়াবহ মন্বন্তর।

সকাল থেকে কলকাতার রাস্তায় কান পাতা যায় না— “একটু ফেন দেবে মা, একটু ফেন দেবে!”

বুকের ভেতরটা আমার যেন সে ডাক শুনলে মোচড় দিয়ে উঠত। করতে পারতাম না কিছুই। এরই কিছু আগে, জাপানি বোমার ভয়ে, কলকাতা থেকে পালিয়ে গিয়েছে বহু লোক। ফিরেও এসেছেন তাঁরা সকলে। তবে বেশিরভাগই এসেছেন রোগ সঙ্গে নিয়ে। কেউবা এসেছেন সর্বস্বান্ত হয়ে।

গভর্নমেন্ট কমার্শিয়াল কলেজে ভর্তি হলাম। কিন্তু ওই, নামেই ভর্তি হওয়া। দুর্গাদাস, অহীনবাবু, ধীরাজ ভট্টাচার্যমহাশয়ের অভিনয় তখন রীতিমতো বায়োস্কোপে দেখছি। ছবিদা(ছবি বিশ্বাস) তখন যথেষ্ট নাম করেছেন সিনেমায়। তাঁর অভিনয় আমায় তখন মুগ্ধ করত।

নাট্যাচার্যের অভিনয়ও শ্রীরঙ্গমে নিয়মিতভাবে দেখছি।

ছবিতে অভিনয় করার আকাঙ্ক্ষা তখন আমার মনে জেগে উঠেছে দুর্দমনীয়ভাবে। কিন্তু সুযোগ পাই না।

দু একজনকে যে বলিনি তা নয়। সকলেই ফচকে ছোঁড়ার কথা শুনে হেসেই উড়িয়ে দেয়। আবার কেউ কেউ বা বলেন, থাক যথেষ্ট হয়েছে, আর ছবিতে অভিনয় করতে হবে না।

ঠিক এমনি সময় আমার জীবনে ঘটল এমন একটা ঘটনা, যার জের আজও টেনে চলেছি।

একদিন আমাদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছি, হঠাৎ একটি মেয়ে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলে— ‘অন্নপূর্ণা আছে বাড়িতে?’

অন্নপূর্ণা আমার জেঠতুতো বোনের নাম। একটু বিরক্ত হয়ে গিয়েই বলি— ‘দেখুন না ভেতরে।’

মেয়েটি ধীরে ধীরে প্রবেশ করল আমাদের বাড়িতে। ক্ষণিক দেখাতেই সে আমার মাথা ঘুরিয়ে দিয়ে গেল। কী একটা আকর্ষণে গেলাম তার পিছু পিছু। মেয়েটি কাদের বাড়ির তা আমাকে জানতেই হবে।

বাড়ির মধ্যে ঢুকে আমার মাকেই সে প্রথম জিজ্ঞেস করল— ‘অন্নপূর্ণা কোথায়?’

মা হাতের কাজ ফেলে চাইলেন তার মুখের দিকে। খানিকটা কী যেন দেখে নিলেন তার মুখের ওপর। তারপরে জিজ্ঞেস করলেন— ‘তোমার নাম কী মা?’ শান্ত অথচ ধীর কণ্ঠে মেয়েটি বলল তার নাম।

মা বলেন— ‘বাঃ, চমৎকার নাম তো তোমার!’

চেঁচিয়ে আমার জেঠতুতো বোনকে ডেকে দিলেন মা।

মেয়েটিকে সেখান থেকে আমার বোন নিয়ে যেতেই আমি এলাম মা’র কাছে।

মা অন্যমনস্ক হয়ে কী যেন ভাবছিলেন। আমি বলি— ‘মা, ও মা, কী ভাবছ? কার সঙ্গে কথা বলছিলে এতক্ষণ?’

মা একরকম যেন চমকে উঠে বললেম— ‘কে, খোকা? কী বলছিলি? মেয়েটি? আমার পুতুল বেঁচে থাকলে—আচ্ছা, ওর মুখখানা ঠিক আমার পুতুলের মতন নয়? সে বেঁচে থাকলে, এত বড়োই হত।’

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. উত্তমকুমারের আপন ছোটোভাই তরুণকুমার। ডাক নাম ছিল ‘বুড়ো’। উত্তমের অসম্ভব স্নেহের ভাই ছিলেন তাঁর আদরের ‘বুড়ো’। সারাজীবন তরুণকুমার সবরকম ঘাত—প্রতিঘাতের সময় তাঁর দাদার পাশেই ছিলেন। তরুণকুমারের জন্ম ১৯৩৩ সালে। উত্তমকুমারের বিস্তৃত প্রভাবের মধ্যে অভিনয় জগতে এসেও সম্পূর্ণ এক নতুন অভিনয়শৈলীকে আশ্রয় করে, নিজেকে পৃথকভাবে তুলে ধরেছিলেন তরুণকুমার, যা খুব সহজ কাজ ছিল না। ১৯৫৪ সালে ‘হ্রদ’ ছবিতে প্রথম অভিনয়, যার নায়ক ছিলেন তাঁর অগ্রজ। এরপর, ‘হাত বাড়ালেই বন্ধু’, ‘অবাক পৃথিবী,’ ‘কাল তুমি আলেয়া’, ‘দাদাঠাকুর’, ‘ন্যায়দণ্ড’, ‘চৌরঙ্গী’ ইত্যাদি মিলিয়ে প্রায় ২০০ ছবিতে অভিনয় করেন। এছাড়া, নিয়মিতভাবে মঞ্চেও অভিনয় করেছেন তরুণকুমার। নাটকের মধ্যে ‘আরোগ্য নিকেতন’, ‘ক্ষুধা’, ‘সেতু’, ‘আসামী হাজির’, ‘নহবৎ’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। অভিনেতা হিসেবে পরবর্তীকালে নিজেকে একজন শক্তিশালী কমেডিয়ান হিসেবে তুলে ধরেন তরুণকুমার। অভিনেতা সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে মিলে তরুণকুমার ‘কল্পতরু গোষ্ঠী’ গড়ে তোলেন এবং উত্তম—প্রয়াণের বেশ কিছু বছর পরে এই গোষ্ঠীই ‘উত্তম মঞ্চ’ প্রতিষ্ঠিত করেন। পরিচালিত নাটক ‘অশ্লীল’। তরুণকুমারের স্ত্রী বিশিষ্ট অভিনেত্রী সুব্রতা চট্টোপাধ্যায়।
  2. ফণী রায় বিশ শতকের প্রথম ভাগের একজন বিশিষ্ট চরিত্রাভিনেতা। নিজেকে কৌতুক অভিনয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। নাটকের মাধ্যমে অভিনয় জীবনের শুরু। প্রথম জীবনে বেশকিছু নারী চরিত্রে অভিনয় করেন। ফণী রায় মহিলাদের সঙ্গে অভিনয় করার বিরোধী ছিলেন। এই কারণে, ‘আর্ট থিয়েটার’ সংস্থার নাট্যাভিনয়ের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। পরে, অবশ্য এই সংকল্প ত্যাগ করে পেশাদারি মঞ্চে অভিনয় করেছিলেন। ১৯৩৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত তিনকড়ি চক্রবর্তী পরিচালিত কালী ফিল্মসের ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’ ছবিতে প্রথম চিত্রাবতরণ করেন ফণী রায়। এ ছবিতে এক হাঁপানি রুগির চরিত্রে মনকাড়া অভিনয়ের নজির রাখেন এই অভিনেতা এবং এই অভিনয়ের কথাই উল্লেখ করেছেন উত্তমকুমার। এরপর, একের পর এক ‘নন্দিনী’, ‘বন্দী’, ‘শহর থেকে দূরে’, ‘মানে না মানা’, ‘নিরক্ষর’, ‘সহসা’ ইত্যাদি বেশকিছু ছবিতে অভিনয় করেন। প্রসঙ্গত ফণী রায়ের আসল নাম পঙ্কজভূষণ কবিরত্ন। এক সম্ভ্রান্ত বংশের সন্তান ছিলেন এই অভিনেতা। ১৯৬৬ সালে ফণী রায় প্রয়াত হন।
  3. প্রিয়নাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের কালী ফিল্মসের প্রযোজনায় ১৯৩৬ সালে মুক্তি পায় ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’ ছবিটি। পরিচালক ছিলেন তিনকড়ি চক্রবর্তী। এই ছবিতেই নায়ক ‘বিশু’—র চরিত্রে অভিনয় করে প্রথম চলচ্চিচত্র জগতে প্রবেশ ঘটে প্রখ্যাত ছবি বিশ্বাসের। একই নামে একটি ছবি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৫৪ সালে নরেশচন্দ্র মিত্রের পরিচালনায়। নায়ক ও নায়িকা ছিলেন যথাক্রমে উত্তমকুমার ও সুচিত্রা সেন।
  4. দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৮৬—১৯৪৩) ছিলেন বাংলা অভিনয় জগতের প্রখ্যাত অভিনেতা। প্রথম ‘স্টার’ তিনি। বর্তমান দক্ষিণ ২৪ পরগণার সোনারপুরের জমিদার বংশের ছেলে ছিলেন। অভিনয়ের নেশায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে প্রথমে গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলে আঁকা শিখে সিন আঁকার কাজ নিয়ে থিয়েটারে ঢোকেন। প্রথম মঞ্চাবতরণ ১৯২৩ সালে ‘কর্ণার্জুন’ নাটকে। স্টার থিয়েটারে এই নাটকের পরিচালক ছিলেন অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। এরপর, ‘চন্দ্রগুপ্ত’, ‘ইরানের রানী’, ‘মেবার পতন’, ‘স্বয়ম্বরা’, ‘মাটির ঘর’, ‘পি.ডব্ল্যু.ডি’ মিলিয়ে প্রায় ৪০—এর বেশি নাটকে দাপটের সঙ্গে অভিনয় করেন দুর্গাদাস। ১৯৪২ সালে মিনার্ভা থিয়েটারে শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত—র ‘কাঁটা ও কমল’ নাটকে শেষবারের মতো মঞ্চে নামেন। প্রসঙ্গত, মঞ্চ থেকেই ‘স্টার’ হয়ে ওঠেন। ১৯২২ সালে নির্বাক ছবিতে অভিনয় শুরু করে, ১৯৩১ সালে ‘নিউ থিয়েটার্স’ প্রযোজিত প্রেমাঙ্কুর আতর্থী পরিচালিত প্রথম সবাক ছবি ‘দেনা—পাওনা’—য় নায়ক চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে সবাক ছবিতে প্রবেশ করেন দুর্গাদাস। এরপর, ‘চণ্ডীদাস’, ‘মীরাবাঈ’, ‘কপালকুণ্ডলা’, ‘দিদি’, ‘দেশের মাটি’ সহ প্রায় ১৬ টি সবাক ছবিতে নায়ক রূপে দুর্গাদাসকে দেখা যায়। ১৯৪৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সৌম্যেন মুখোপাধ্যায় পরিচালিত নিউথিয়েটার্স—এর ‘প্রিয়—বান্ধবী’ ছবিই দুর্গাদাসের শেষ অভিনীত ছবি। বেশকিছু মঞ্চনাটক ও রেকর্ড—নাটক পরিচালনা করেন এবং কয়েকটি বেতার—নাটকেও অংশ নেন দুর্গাদাস।
  5. ‘অহীনবাবু’ হলেন নটসূর্য অহীন্দ্র চৌধুরী (১৮৯৫—১৯৭৪)। বাংলা চিত্র ও নাট্যজগতের অভিনয় দুনিয়ায় একটি যুগের নাম। পড়াশুনার গভীরতা তাঁকে অভিনয়—সম্বন্ধীয় এক প্রাজ্ঞ মানুষে পরিণত করে। ১৯২১ সালে ‘ফটো প্লে সিন্ডিকেট’ প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন। এই প্রতিষ্ঠান—নির্মিত ‘সোল অফ আ স্লেভ’—ই অহীন্দ্র চৌধুরীর প্রথম ছবি। এই প্রতিষ্ঠান তৈরির আগে অহীনবাবু তিনকড়ি চক্রবর্তীর সাহায্যে অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের আর্ট থিয়েটারে যোগ দেন। পেশাদার মঞ্চে ‘কর্ণার্জুন’ নাটকে প্রথম মঞ্চাবতরণ। এছাড়া, ‘চন্দ্রগুপ্ত’, ‘প্রফুল্ল’, ‘মিশরকুমারী’, ‘চরিত্রহীন’, ‘তটিনীর বিচার’, ‘কঙ্কাবতীর ঘাট’ ইত্যাদি অনেক নাটক অহীন্দ্র চৌধুরীর অসামান্য অভিনয়ের সাক্ষ্য বহন করেছে। তবে অহীনবাবু ‘সাজাহান’ নাটকে নাম ভূমিকায় অভিনয়ে জীবন্ত কিংবদন্তীতে পরিণত হন। অন্যদিকে, ‘ডাক্তার’, ‘জীবনসঙ্গিনী’, ‘মানে না মানা’, ‘সোনার সংসার’, ‘বিদ্যাসাগর’ ইত্যাদি প্রায় দুশো—র বেশি ছবিতে দেখা গেছে অহীনবাবুর অভিনয় চাতুর্থ। ভারত সরকারের ‘পদ্মশ্রী’, রবীন্দ্র—ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক ডি—লিট, সংগীত—নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কার ইত্যাদি সম্মানে ভূষিত হয়েছেন অহীন্দ্র চৌধুরী। তাঁর আত্মজীবনী ‘নিজেরে হারায়ে খুঁজি’ এক আকরগ্রন্থ।
  6. বর্তমান বাংলাদেশের যশোহর জেলার পাঁজিয়া গ্রামে ১৯০৫ সালে বিশিষ্ট অভিনেতা ধীরাজ ভট্টাচার্যের জন্ম। ম্যাডান কোম্পানির ‘সতীলক্ষ্মী’ (১৯২৫) নির্বাক ছবিতে একটি ছোট্ট চরিত্রে অভিনয় দিয়ে শুরু। এরপর, মধু বসু পরিচালিত ‘গিরিবালা’ ছবিতে নায়ক গোপীনাথের চরিত্রে প্রথম উল্লেখযোগ্য চরিত্রলাভ। ‘নৌকাডুবি’, ‘মৃণালিনী’ ইত্যাদি নির্বাক ছবিতে অসাধারণ অভিনয় করেন। প্রথমে পুলিশে চাকরি করতেন। পরে ইস্তফা দিয়ে হয়ে গেলেন পুরোপুরি পেশাদার অভিনেতা। ‘পরশমণি’, ‘শহর থেকে দূরে’, ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’, ‘মানে না মানা’, ‘কঙ্কাল’, ‘কালোছায়া’, ‘হানাবাড়ি’ ইত্যাদি প্রায় ২০০-র কাছাকাছি ছবিতে অভিনয় করেন ধীরাজবাবু। মঞ্চেও নিয়মিত তাঁকে অভিনয় করতে দেখা গেছে। ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’ নাটকে ধীরাজ ভট্টাচার্য-র ‘হাজারি ঠাকুর’-এর চরিত্রে অভিনয় চিরস্মরণীয়। বেতার ও রেকর্ডেও অভিনয় করেছেন। বেতারে ‘অলীক’ নাটকে তাঁর অভিনয় ছিল মনে রাখার মতো। ‘যখন পুলিশ ছিলাম’ ও ‘যখন নায়ক ছিলাম’ ধীরাজ ভট্টাচার্য-র লেখা স্মৃতিকথাধর্মী বই দুটি উল্লেখযোগ্য।
  7. ‘ছবিদা’ হলেন প্রখ্যাত ছবি বিশ্বাস (১৯০০-১৯৬২)। অভিনয় জগতের জ্যোতিষ্ক। ভালো নাম শচীন্দ্রনাথ দে বিশ্বাস। বর্তমান উত্তর ২৪ পরগণার জাগুলি (ছোটো)-র জমিদারবংশে জন্ম। ছবির মতো সুন্দর দেখতে হয়েছিল বলে, মা নাম রেখে!ছলেন ‘ছবি’। এই নামেই জগৎবিখ্যাত হন। ‘হাওড়া নাট্য সমাজ’, ‘কাঁকুড়গাছি নাট্য সমাজ’-এর হয়ে ‘নদীয়া বিনোদ’ নাটকে ‘নিমাই’ চরিত্রে সুনাম অর্জন করেন। এরপর ‘মীরকাশেম’, ‘দুই পুরুষ’ ইত্যাদি অজস্র নাটকে অবিস্মরণীয় অভিনয় করেন। ১৯৩৬ সালে তিনকড়ি চক্রবর্তীর পরিচালনায় মুক্তিপ্রাপ্ত ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’ ছবিতে প্রথম নায়ক হিসেবে চিত্রাবতরণ করেন ছবি বিশ্বাস। এরপর, ‘ছদ্মবেশী’, ‘মিলন’, ‘শুভদা’, ‘দুই পুরুষ’, ‘জীবনস!ঙ্গনী’, ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’, ‘জলসাঘর’, ‘কাবুলিওয়ালা’, ‘দাদাঠাকুর’, ‘একদিন রাত্রে’ ইত্যাদি ২০০-র বেশি ছবিতে চলচ্চিত্র-অভিনয়ের এক নতুন অধ্যায় রচিত হয়েছে ছবিবাবুর অবিস্মরণীয় অভিনয়ে। ‘যার যেথা ঘর’ ও ‘প্রতিকার’ দুটি ছবির পরিচালক ছিলেন ছবি বিশ্বাস। এক মর্মান্তিক মোটর দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান এই জ্যোতিষ্কস্বরূপ অভিনেতা।
  8. ‘নাট্যাচার্য’ হলেন বাংলা নাট্যজগতের প্রবাদপুরুষ শিশিরকুমার ভাদুড়ি (১৮৮৯-১৯৫৯) ‘গিরিশ-যুগ’-এর পর বাংলা থিয়েটার জগতে ‘শিশির-যুগ’-এর আবির্ভাব ঘটে। প্রথম জীবনে মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশন (বর্তমান বিদ্যাসাগর কলেজ)-এ অধ্যাপনা করেন। বন্ধু নটশেখর নরেশচন্দ্র মিত্রের অনুরোধে অধ্যাপনা ছেড়ে নাট্যজগতে আসেন। ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট মঞ্চে অ্যামেচার থিয়েটার শুরু করেন। ১৯১২ সালে এই মঞ্চে রবীন্দ্রনাথ তার ‘বৈকুণ্ঠের খাতা’ গল্পের মঞ্চায়নে শিশিরবাবুর ‘কেদার’ চরিত্রে অভিনয় দেখে তাঁর অকুণ্ঠ প্রশংসা করেন। ১৯২৩ সালে ইডেন গার্ডেনে দ্বিজেন্দ্রলালের ‘সীতা’ নাটক মঞ্চস্থ করে, প্রথম নিজস্ব নাট্য দল নিয়ে তাঁর নাট্যাভিনয় শুরু করলেন শিশিরকুমার। এরপর, ‘আলমগীর’, ‘বিজয়া’, ‘যোগাযোগ’, ‘রীতিমত নাটক’, ‘বিপ্রদাস’, ‘বিসর্জন’, ‘রঘুবীর’, ‘প্রফুল্ল’, ‘সাজাহান’, ‘চন্দ্রগু%প্ত’ আরো অজস্র নাটক মারফত মণিমাণিক্য ছড়িয়েছিলেন শিশিরকুমার। শ্রীরঙ্গম (বিশ্বরূপা) মঞ্চে দীর্ঘদিন অভিনয় করেছিলেন। ‘মোহিনী’ (নির্বাক), ‘কমলে কামিনী’ (নির্বাক), ‘সীতা’, ‘পল্লীসমাজ’, ‘টকি অব টকিজ’, ‘চন্দ্রগুপ্ত’, ‘চাণক্য’ ইত্যাদি ছবিতেও শিশিরবাবুকে দেখা গেছে।
  9. ‘শ্রীরঙ্গম’ উত্তর কলকাতাস্থিত একটি নাট্যমঞ্চের নাম। এটির আগে নাম ছিল ‘নাট্যভারতী’। ১৯৪১ সালে শিশিরকুমার ভাদুড়ি, এই মঞ্চটিকে নতুন করে আধুনিকরণ করে, এর নাম দেন দেন ‘শ্রীরঙ্গম’। অনেক পরে, ‘শ্রীরঙ্গম’ পাল্টে হয় ‘বিশ্বরূপা’। বর্তমানে, বিলুপ্ত হয়ে গেছে এই প্রেক্ষাগৃহ।