উত্তমকুমার চট্টোপাধ্যায়
হারিয়ে যাওয়া দিনগুলি মোর
বার
সেই ‘কেন’র জবাব আমায় কেউ দিল না বটে, অথচ ফ্লোর ছেড়ে যাওয়াও আমার চলল না। যাব বলে তো আসিনি। এত দীর্ঘদিন ধরে যা কল্পনা করেছি, যে স্টুডিও ছিল আমার ধ্যান, জ্ঞান, স্বপ্ন, সেই স্টুডিওর ফ্লোর আমায় ছেড়ে যেতে হবে!
কিছুতেই না। সুযোগ যখন পেয়েছি তখন তাকে ছাড়া, কিছুতেই চলবে না। যাক, সেদিনে ঘেমে গিয়েও পরিচালকের নির্দেশমতো ছবির কাজ করে গেলাম। কাজের শেষে সেই ভিড়-করা লোকেরা আমাকে প্রশ্ন করলেন— ‘আর কোনো ছবিতে কাজ করেছ? না, এই প্রথম?’
আমি বলি— ‘না, আরও দুটো ছবিতে কাজ করেছি।’
তার মধ্যে থেকে আর একজন বললেন— ‘কিন্তু মানিক, দেখে যে মনে হচ্ছে একেবারে নতুন। মা’র কাছে মামার বাড়ির গল্প! আমরা যে বাবা রোজ সেই বারোটা থেকে এখানে বসে থাকি, প্যাক আপ (স্টুডিওর কাজ শেষ হয়ে গেলে জিনিসপত্র গুছিয়ে নেওয়াকে ‘প্যাক আপ’ বলে) না হওয়া অবধি।’
আমি বলি— ‘ইচ্ছে না হয় বিশ্বাস করবেন না। তবে দেখুন, পরিচালক রাজেনদা কিন্তু বিশ্বাস করেন, তাঁকেই একবার জিজ্ঞেস করে দেখবেন।’
এবারে বোধহয় কাজ হল।
তাঁদের মধ্যে একজন বললেন— ‘আরে, অত করে জিজ্ঞেস করার কী আছে! ছোঁড়াটা বলছে যখন, তখন কি ভুল কথা বলছে! নিশ্চয় দু’একবার নেমেছে।’
সেদিনকার মতো ব্যাপারটা সেখানে চুকে গেলেও, চুকল না পরের দিন।
আবার স্টুডিওতে গিয়ে দেখি, সেই তাঁরাই সকলে বসে রয়েছেন ‘সেটে’।
মনে মনে বেশ বিরক্ত হলাম। ভাবলাম, পরিচালক বা প্রযোজক এদের কেন ‘সেটে’ আসতে দেন! তাড়িয়ে দিতে পারেন না!
কিন্তু আমি মনে করলেই তো, তা হবে না।
আমাকে দেখেই একজন বলে উঠলেন— ‘হিয়ার কামস নিউ দুর্গাদাস!’
দুর্গাদাসবাবুর অপূর্ব অভিনয়ের কথা শুনেছি। ‘পরশমণি’, ‘প্রিয়বান্ধবী’ প্রভৃতি দু একটা ছবিও দেখেছি। দেখে বুঝেছিলাম কী অপূর্ব নিষ্ঠার সঙ্গে তিনি অভিনয় করতেন। দর্শকদের মন কেড়ে নেবার কতখানি তাঁর ক্ষমতা ছিল!
একজন সেটাকে ঠিক করে বললেন— ‘দুর্গাদাস, না না, তার চেয়ে বরং বল, ছবি বিশ্বাস। ভবিষ্যতে ও-তো ওনারই পদ নেবে।’
মনে হল থাক আমার অভিনয়। থাক আমার সবকিছু পড়ে। আমি ফিরে যাই আমার সেই পোর্ট কমিশনার্স অফিসে।
কিন্তু, কেন বার বার এই উপহাস! পাড়াতে অভিনয় করে বা একবার দুবার এক্সট্রার মধ্যে থেকে স্টুডিওর সম্বন্ধে আমার যে ধারণা হয়েছিল, তা তো একেবারে পাল্টে গেল। অভিনয় করা যতটা সোজা মনে করেছিলুম ততটা সোজা তো নয়!
অভিনয় সোজা হলেও পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিকে আমাকে এখন জয় করতে হবে। তাই মনে মনে বিরক্ত হয়েও মুখে ভাব দেখাই অন্যরকম।
পকেট থেকে একটা সিগারেটের প্যাকেট বার করে বলি— ‘আসুন, নিন!’
অমনি চোখের পলক ফেলতে না ফেলতে আমার সিগারেটের প্যাকেট গেল শূন্য হয়ে। তা যাক, তাতে দুঃখ নেই।
সিগারেট ধরিয়ে যে ক’জন সেখানে বসেছিলেন তাঁরা ধোঁয়া ছেড়ে বলেন— ‘না হে ছোকরা, নার্ভাস হয়ো না। তোমার এলেম আছে। হলেও হতে পারে।’
আমি তাঁদের আরও আপ্যায়িত করে বলি— ‘আপনাদের বুঝি সকলের সঙ্গে আলাপ আছে?
ওঁদের মধ্যে একজন জবাব দিলেন কথার।
— ‘আলাপ মানে? অহীন্দ্রবাবু, ছবিবাবু থেকে সকলের সঙ্গেই আমাদের বন্ধুত্ব। খাতিরও আছে। সব পরিচালকদের সঙ্গে আমাদের আলাপ আছে। যদি ছবির চান্স চাও তাহলে আমাদের সঙ্গে খাতির রাখো—আমরা যা বলি তাই করো। তারপরে তুমি স্রেফ লক্ষ করো তোমার কী হয়ে গেছে।
বুঝলাম আমার প্রথম ওষুধ কাজে লেগেছে। মুখে বলি— ‘তা তো নিশ্চয়! আচ্ছা, কতদিন ধরে আপনারা এরকম স্টুডিওতে যাতায়াত করছেন?’
এক ভদ্রলোক বলেন— ‘অনেকদিন ধরে। এই যাতায়াত আছে বলেই আমাদের সকলকার সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হয়েছে কিনা।’
একটু আগেই সেদিন স্টুডিওতে গিয়েছিলাম। ‘মেকআপ-ম্যান’ তখনও এসে পৌছোয়নি। তাই হাতে খানিকটা সময়ও ছিল। সেই ভদ্রলোককে লক্ষ্য করে বলি— ‘চলুন না, একটু চা খাওয়া যাক।’
তাঁদের মধ্যে আর একজন বলেন— ‘চা খাওয়াবে, তা বেশ চলো।’
আমি বলি— ‘আমার মতো লোক আপনাদের আর কী করতে পারে বলুন! তবে হ্যাঁ, ওই চা খাওয়ার ফাঁকে আলাপটা একটু জমিয়ে নেব। কারণ বুঝতেই তো পারছি এ লাইনে উন্নতি করতে গেলে আপনাদের সাহায্য ছাড়া হবে না।’
একজন আমার কথায় সায় দিয়ে বললেন— ‘বিলক্ষণ, ছোকরাকে যতটা বোকা বলে মনে হয়েছিল, ততটা বোকা নয় হে হরিশ!’
এই হরিশ বা হরিশদা ছিলেন এই দলের পাণ্ডা-গোছের লোক।
আমার আপাদমস্তক ভালো করে লক্ষ করে তিনি বললেন— ‘হ্যাঁ, হতে পারে।’
আমি বলি— ‘যাক ওসব কথা, চলুন না চা খাওয়া যাক।’
চা, টোস্ট, ডিমের ওমলেট, পাশেরই একটা ক্যানটিন থেকে তাঁদের খাওয়ালাম। আরও দু প্যাকেট সিগারেট কিনে তাদের পরিতুষ্ট করলাম।
এইসমস্ত করতে গিয়ে আমার পকেটে যা ছিল তা একেবারেই নিঃশেষ হয়ে গেল। স্টুডিও থেকে ফেরবার বাসভাড়াটুকুও পর্যন্ত রইল না।
না থাক ক্ষতি নেই, হেঁটেই ফিরব। বড়ো জোর এক ঘণ্টা থেকে দেড় ঘণ্টা সময় যাবে। তাতে কী হয়েছে। এই ধরনের লোকগুলোর হাত থেকে তো অব্যাহতি পাওয়া যেতে পারে। আর তাছাড়া আমার সম্বন্ধে অনবরত বিরুদ্ধ মন্তব্য শুনলে পরিচালক প্রযোজকরাই বা কী ভাববেন! যদি রাগ করে আমাকে তাঁরা বাদ দিয়ে দেন!
তাই আমাকে করতেই হবে এঁদের মনতুষ্টি!
সেদিন কিন্তু স্যুটিং-এর সময় দেখলাম একটা অদ্ভুত ব্যাপার। যাঁরা আগের দিন বলেছিলেন—আমার দ্বারা এতটুকু অভিনয় করা সম্ভবপর হবে না, আমি নাকি একেবারে গেঁইয়া,—তাঁরাই মনিটারের সময় ‘বাঃ চমৎকার’, ‘বেস্ট অ্যাকটিং’ বলে আমাকে উৎসাহিত করলেন।
উৎসাহের আতিশয্যে কেউ কেউ বা পরিচালককে লক্ষ্য করে বললেন— ‘এ ছেলে আপনার বইতে বেস্ট অ্যাকটিং করবে দেখবেন। বই যদি চলে ওরই জন্যে চলবে।’
আমি মনে মনে বুঝলাম—এ আর কিছুই নয়, সকালবেলার চা, টোস্ট আর সিগারেটের ফল।
যাইহোক, সেদিনটাও ভালোয় ভালোয় স্যুটিং হয়ে গেল।
আমি কিন্তু চা আর সিগারেট উপহার দিতে ভুলি না। অবশ্য একদিন ‘ওরে যাত্রী’র স্যুটিং শেষ হয়ে গেল। বই তখন দেখানোর জন্য প্রস্তুত হতে লাগল।
ভেবেছিলাম, প্রথম ছবির থেকেই আমি দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারব। কিন্তু আমার এমনি দুর্ভাগ্য, ‘ওরে যাত্রী’ দর্শকরা নিলেন না, দু তিন সপ্তাহ চলবার পর ছবি হল বন্ধ।
আমারও হয়ে গেল মন খারাপ। আবার যাই অফিসে। মন বসাবার চেষ্টা করি কাজে। কিন্তু মন আর বসে কই!
দুপুরবেলায় কাজ করতে করতে অলস মুহূর্তে নিজের কানে যেন শুনতে পাই স্টুডিওর ‘ক্ল্যাপাস্টিক’ টানার আওয়াজ, ডিরেক্টারের ‘রেডি’ বলার শব্দ। চমকে উঠে সামনের দিকে চেয়ে দেখি কোথায় বা স্টুডিওর ফ্লোর, কোথায় বা কী! আমি বসে রয়েছি আমাদেরই অফিসের চেয়ারে।
ওপরওয়ালার কাছ থেকে একটা স্লিপ নিয়ে বেয়ারা এসে ডাকছে — ‘অরুণবাবু, এ অরুণবাবু!’
মুহূর্তের মধ্যেই স্টুডিওর উত্তমকুমার হয়ে যায় পোর্ট কমিশনার্সের ‘অরুণবাবু’।
শ্লিপটা হাতে নিয়ে বলি— ‘তুই যা, আমি দেখছি।’
এরপরে আমার জীবনে সুযোগ আসে ‘কামনা’১ ছবিতে একেবারে নায়কের পার্টে। সুযোগ অবশ্য করে দেন ছবির পরিচালক শ্রীনবেন্দুসুন্দর ব্যানার্জি।
আমার অপর দিকে নায়িকার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন ছবি রায়।২
আগেকার মতনই এবারেও অফিসে ব্যবস্থা করেছিলাম। ছবি তোলবার সময় অফিস থেকেও সাহায্য পেয়েছিলাম প্রচুর। তাই নির্বিঘ্নে ছবিটাও তুলে ফেললাম।
ছবিতে এবারে পারিশ্রমিক পেলাম ১৫০০ টাকা। ভেবেছিলাম, ছবিটা হয়তো দর্শকরা নেবেন, কিন্তু এবারেও ভাগ্য খারাপ, ছবি চলল না। নায়ক সেজে আমার অভিনয় করার স্বপ্ন, স্বপ্ন হয়েই মিলিয়ে গেল। মনে হল কি আর হবে ছবি করে! নাম তো করতে পারলাম না! দর্শকের মনে রেখাপাতই যদি না করতে পারি, তাহলে আমার অভিনয় করে লাভ!
কিন্তু একটা কথা আছে, স্বভাব মলেও যায় না! তাই বার বার বাইরে থেকে আঘাত এলেও, আমার মনের ইচ্ছে বোধহয় ম্লান হল না। কেবলই মনে হয়, একটা ভালো ছবিতে যদি কাজ করতে পেতাম! কিন্তু তেমন ভালো ছবি পাই কোথায়? তাছাড়া, যাঁরা ছবি তুলবেন তাঁদেরও আমায় পছন্দ হওয়া চাই!
আবার সেই একটানা হতাশা আমাকে পেয়ে বসতে লাগলো। এমনি সময় খবর পেলাম, সরোজবাবু অর্থাৎ সরোজ মুখার্জি৩ নায়ক খুঁজছেন। ওঁরা প্রথমে প্রদীপবাবু৪ কে এই বই-এর নায়ক মনোনীত করেছিলেন। কিন্তু অন্য একটা ছবির কাজে প্রদীপবাবু আটকে যাওয়ায়, তাঁকে তখন পাওয়া গেল না। তাই তাঁদের এখন একজন নায়ক প্রয়োজন।
আমি গিয়ে দেখা করলাম। বললাম আমার সব কথা। ওরা শুনলেন। শুনে কী ভেবে রাজিও হয়ে গেলেন আমায় নিতে। কেবল একটা শর্ত হল আমি এই ছবিতে উত্তমকুমার নামে অভিনয় করতে পারব না।
এ ছবিতে আমার নামকরণ হলো অরূপকুমার। ছবির কাজ পুরোদমে চলছে। ঠিক সেইসময় ‘এম. পি.’র৫ ম্যানেজার বিমল ঘোষ মহাশয় ‘এম. পি.’র জন্য নতুন নায়ক খুঁজছেন।
ওঁরা অসিতদাকে নিয়ে একটা ছবি করবার মনস্থ করেছিলেন কিন্তু কী জানি কেন সেটা আর সফল হয়নি।
বিমলবাবু একদিন এলেন স্টুডিওতে। আমাকে দেখে ওঁদের পছন্দও হয়েছিল। কিন্তু উনি যে আমাকে দেখেছিলেন, সেকথা আমি তখন জানতে পারিনি। জেনেছিলাম পরে। ছবিতে পাহাড়ীদাও কাজ করছিলেন, তাঁকেই আড়ালে নিয়ে গিয়ে বিমলবাবু প্রশ্ন করেন— ‘ছেলেটি কেমন অভিনয় করে? চলতে পারে কি?’
উত্তরে নাকি সেদিন পাহাড়ীদা বলেছিলেন— ‘আমার তো মনে হয় ঘষলে মাজলে ভালোই হতে পারে।’
বিমলবাবু যেমন নীরবে এসেছিলেন সেইরকম নীরবেই আমাকে দেখে চলে গেলেন। আমি জানতেও পারিনি তাঁর উপস্থিতি।
সরোজবাবুর ‘মর্যাদা’ ছবির কাজও শেষ হয়ে গেল। ভাগ্যে অবশ্য এবারেও আমার সেই একই ফল। ছবি ‘ফ্লপ’ করল, দর্শকে নিল না।
ভাবলাম ফিল্ম লাইন ছেড়েই দেব। অবশ্য সংসারে তখন টানাটানি বেড়েছে। রোজগার করবার মধ্যে বাবা আর আমি। জিনিসপত্রের দাম তো হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে। বরুণ, তরুণ দুজনেই তখন স্কুলে পড়ে। আমার আয় বাড়ানোর দরকার। তাহলে মা একটু শান্তি পান। মুখ বুজে কী অমানুষিক পরিশ্রমই না করেন!
কিন্তু আয় বাড়াবার উপায় কিছু খুঁজে পাই না। আমার মতন বিদ্যেতে যা করা সম্ভব তা আমি করছি।
টেনেটুনে বি. এ. টা যদি পাস করতে পারি, তাহলে কাজের আর একটু উন্নতি হতে পারে। কিন্তু বি. এ. পাস! সেও তো সোজা নয়!
এমনি যখন আমার মনের অবস্থা তখন হঠাৎ এল মুরলীবাবুর ‘এম. পি.’ থেকে একখানা চিঠি। তাঁদের ধর্মতলা অফিসে আমায় গিয়ে দেখা করতে বলা হয়েছে। ভাবলাম, কী হবে গিয়ে। সেই একই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। এতগুলি ছবি করলাম। কী হল। এমনি সময় তরুণ আর বন্ধু তারাপদ একরকম জোর করেই আমাকে পাঠিয়ে দিলেন ‘এম. পি.’র অফিসে।
সেদিন তরুণ আমাকে বলেছিল— ‘দাদা, এম. পি.তে যখন চান্স পাচ্ছ ছেড়ো না। ভালো কোম্পানি, দেখোই না একবার গিয়ে, কী হয়!
সেদিন একরকম ওরই উৎসাহে দুপুরবেলা অফিস থেকে ছুটি নিয়ে গিয়েছিলাম ‘এম. পি.’র অফিসে। গিয়ে দেখি, একটা ঘরের মধ্যে একদঙ্গল ছেলে আর মেয়ে বসে রয়েছে। তার মাঝখানে একজন ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে উচ্চৈঃস্বরে কী যেন বলছেন।
পরিবেশ দেখেই আমার স্টুডিওর কথা মনে পড়ে গেল। আবার সেই ‘ফড়ের’ দল! চা আর সিগারেট দিয়ে যাদের সন্তুষ্ট করতে হবে! কিন্তু ইনি কে? চিঠিখানা দিলাম তাঁর হাতে।
চিঠিখানা পড়ে ভদ্রলোক আমার আপাদমস্তক ভালো করে আবার দেখলেন। তারপর একরকম তিক্তকণ্ঠেই প্রশ্ন করলেন— ‘আপনার নামই উত্তমকুমার?’
আমি জবাবে বলি— ‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’
— ‘অভিনয় করা নেশা, না পেশা?’
বিরক্তিতে ভরে গেল মন। তবুও সংযত হয়ে জবাব দিলাম— ‘আপাতত নেশা, পরে সুবিধে হলে পেশা করতে আপত্তি নেই।’
— ‘আচ্ছা দেখা যাক, আপনাকে নিয়ে কী করা যায়, আসুন এ ঘরে।’
আমিও ধীরে ধীরে ভদ্রলোকের সঙ্গে গেলাম।
সূত্রনির্দেশ ও টীকা
- ১৯৪৯ সালের ৪ মার্চ পূর্ণশ্রী, প্রাচী, আলেয়াসহ অন্যান্য প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় নব্যেন্দুসুন্দর বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত ‘কামনা’ ছবিটি। এই ছবিতেই প্রথম নায়ক হিসেবে অবতীর্ণ হন উত্তমকুমার। কয়েকজনকে দিয়ে পরীক্ষা করে, অবশেষে উত্তমকে নির্বাচিত করা হয়। উত্তমের আগে ছবিটিতে অধীর বিশ্বাস নামে এক অভিনেতা কিছুদিন নায়ক চরিত্রে স্যুটিং করেন। পরে, তাঁকে বাতিল করে উত্তমকুমারকে বাছা হয়। এই ছবিতে উত্তম তাঁর আসল ভালো নাম ‘অরুণকুমার’ নামে অভিনয় করেছিলেন। উত্তমের বিপরীতে নায়িকা ছিলেন ছবি রায়।
- উত্তমকুমার যে ছবিতে প্রথম নায়ক হিসেবে নির্বাচিত হন, সেই ‘কামনা’ ছবিতে তাঁর বিপরীতে নায়িকা ছিলেন ছবি রায়। বয়সে তিনি উত্তমকুমারের চেয়ে বড়ো থাকার সুবাদে, সারাজীবন তাঁকে ‘ছবিদি’ বলে ডাকতেন উত্তমবাবু। নিউ থিয়েটার্সের ‘মাই সিস্টার’ ছবিতেই প্রথম অভিনয় ছবি রায়ের। এরপর, ‘স্পর্শমণি’, ‘কামনা’, ‘ওগো শুনছো’, ‘মিথুন লগ্ন’, ‘শ্রাবণ সন্ধ্যা’, ‘সহযাত্রী’, ‘অপরাজিতা’, ‘পহেলা আদমি’, ‘মন্ত্রমুগ্ধ’, ‘রামের সুমতি’ ইত্যাদি বেশকিছু ছবিতে অভিনয় করেন ছবি রায়। জীবনে মাত্র একটি ছবিতে ছবি রায়ের সঙ্গে অভিনয় করলেও এবং নিজে একজন অত বড়ো স্টারে পরিণত হওয়া সত্ত্বেও, উত্তমকুমার তাঁর ছবিদি’-র সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছিলেন। ২০০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ছবি রায় প্রয়াত হন। ঘটনাচক্রে ছবি রায়ের প্রয়াণের দিনটি, উত্তমকুমারের জন্মদিনও বটে।
- প্রযোজক ও চিত্র-পরিচালক সরোজ মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯২৪ সালে কলকাতায়। পিতা ছিলেন রায়বাহাদুর সত্যেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। এনার প্রথম ছবি ‘অলকানন্দা’ (প্রযোজক সরোজবাবু)। এরপর, ‘মনে ছিল আশা’, ‘শ্যামলীর স্বপ্ন’, ‘অভিমান’, ‘জিপসী মেয়ে’, ‘অপবাদ’, ‘অনুরাগ’, ‘মহিষাসুর বধ’, ‘না’, ‘জওয়ানি কি রাত’ (হিন্দি), ‘প্রশ্ন’ ইত্যাদি আরো কিছু ছবির পরিচালক ছিলেন সরোজবাবু।
- ‘প্রদীপবাবু’ হলেন একসময়ের প্রখ্যাত চিত্রাভিনেতা ‘প্রদীপকুমার’। পুরো নাম প্রদীপকুমার বটব্যাল। কন্দর্পকান্তি চেহারা ছিল এই অভিনেতার। আসল নাম ‘শীতল’। ১৯২৫ সালে কলকাতায় জন্ম। ১৯৪৭ সালে দেবকীকুমার বসু পরিচালিত ‘অলকানন্দা’ ছবিতে প্রথম চিত্রাবতরণ, প্রযোজক ছিলেন সরোজ মুখোপাধ্যায়। মন্মথ রায়ের কাহিনিনির্ভর এই ছবির সংলাপ লিখেছিলেন ঋত্বিক ঘটক। এরপর ‘৪২’, ‘ভুলি নাই’, ‘সন্দীপন পাঠশালা’, ‘দেবী চৌধুরানী’, ‘বিষ্ণুপ্রিয়া’, ‘স্বামী’, ‘অপবাদ’, ‘স্পর্শমণি’ ইত্যাদি বাংলা ছবিতে অভিনয় করে, ১৯৪৯ সালে পরিচালক হেমেন গুপ্ত-র আহ্বানে মুম্বাই গিয়ে ‘ফিল্মিস্তান’ প্রযোজিত ‘ঝাঁসি কি রানী’ ছবিতে প্রথম হিন্দি ছবির জগতে প্রবেশ করেন প্রদীপকুমার। এরপর ‘আনন্দমঠ’, ‘আনারকলি’, ‘নাগিন’, ‘তাজমহল’, ‘এক ঝলক’, ইত্যাদি অসম্ভব জনপ্রিয় ছবিতে অভিনয় করে হিন্দি ছবির জগতে আসন পাকা করে নেন। কলকাতায় এসে আবার ‘দস্যুমোহন’, ‘অভিশপ্ত চম্বল’, ‘গৃহদাহ’, ‘ত্রয়ী’, ইত্যাদি আরো কিছু বাংলা ছবিতে অভিনয় করেন প্রদীপকুমার।
- ১৯৪১ সালের ২৮ জুন ‘মায়ের প্রাণ’ নামে যে ছবিটি মুক্তি পায়, তার প্রযোজক সংস্থা হিসেবে দেখা গেল ‘এম. পি. প্রোডাকসন্স’ নামটি। মালিক মুরলীধর চট্টোপাধ্যায়। সংস্থার পুরো নাম ‘মায়ের প্রাণ’ (এম. পি) প্রোডাকসন্স’। প্রথম ছবিটির (উপরিল্লিখিত) নামও তাই। ছবিটির পরিচালক ও ক্যামেরাম্যান ছিলেন প্রখ্যাত প্রমথেশচন্দ্র বড়ুয়া। নায়ক চরিত্রেও তিনি। মুরলীধরবাবু সাউথ সিঁথি রোডের মোড়ে স্টুডিওসহ প্রোডাকসন ইউনিটটিকে উন্নতমানে প্রতিষ্ঠিত করেন ১৯৪৮ সালে। এরপর, এম.পি-র প্রযোজনায় ‘আভিজাত্য’, ‘সঙ্কল্প’, ‘ইন্দ্রনাথ’, ‘কাঁকনতলা লাইট রেলওয়ে’, ‘সহযোগী’, ‘বিদ্যাসাগর’, ‘বাবলা’, ‘সঞ্জীবনী’, ‘বসু পরিবার’, ‘কার পাপে’, ‘বিদ্যাসাগর’ (হিন্দি), ইত্যাদি অজস্র ছবি মুক্তি পায়। উত্তম-সুচিত্রা-র ঐতিহাসিক জুটির শুরু এই সংস্থার দ্বারা প্রযোজিত ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ থেকেই।