উত্তমকুমার চট্টোপাধ্যায়

হারিয়ে যাওয়া দিনগুলি মোর

নয়

রাজি তো হয়ে গেলাম ধীরেনবাবুর কথায়। তখন কি জানতাম এই ‘দৃষ্টিদান’ ছবিকে উপলক্ষ্য করেই আমার জীবনেও আরম্ভ হয়ে যাবে আর একটা অধ্যায়!

আজ সেই কথাই বলবো আমার পাঠকদের কাছে। অবশ্য এই ছবি থেকেই আমি বিখ্যাত হইনি, প্রচুর টাকাও পাইনি। সম্মান? সে আর আমি কি পাবো বলুন? কারণ, আমি তো তখনও নায়কের পার্ট করিনি! করেছিলাম হবু নায়কের পার্ট। হবু নায়ক বলতে আমি এই কথাই মনে করছি, ছবি আরম্ভর পর দুটি ছোটো কিশোর কিশোরী বা ছোটো দুটি শিশুকে আপনারা পর্দার ওপর দেখতে পেলেন। কিছুক্ষণ তারা আপনাদের সামনে এলো, কথা বললো, খানিকটা আপনাদের আনন্দও দিলো। তারপরেই ক্যামেরাম্যানের কায়দায় হঠাৎ পর্দার ওপরে লেখা হয়ে গেল ‘বিশ বছর পরে’। তারপরে বেশীক্ষণ ধরে যাঁরা পর্দার ওপর রইলেন তাঁরাই কেড়ে নিলেন দর্শকের মন। সিনেমা হল থেকে যখন দর্শকরা বেরিয়ে আসেন তখন ছোট শিশুদুটি বা কিশোর-কিশোরীরা দর্শকের মন থেকে একেবারে মুছে গেছে।

অসিতদা (অসিতবরণ) আর সুনন্দা দেবী ছিলেন এই ছবির নায়ক-নায়িকা। আমাকে অভিনয় করতে নেওয়া হয়েছিল ঐ অসিতদারই ছোটোবয়সের চরিত্রে। তাই নিজেকে নায়ক না বলে বললাম—হবু নায়ক। আমারই সঙ্গে হবু নায়িকার পার্ট করেছিলেন কেতকী

ইতিপূর্বে শ্রীরঙ্গমে শিশিরকুমারের পরিচালনায় ‘বিন্দুর ছেলে’ তে অসিতদা বিন্দুর ছেলে অর্থাৎ অমূল্যর পার্ট করতেন। যাহোক, তাঁর জীবনে তবুও দর্শকের হাততালি পাবার একটা চান্স তিনি পেয়েছেন, আমি পাইনি।

পাড়াতে অভিনয় করা এক জিনিস আর দর্শকশূন্য স্টুডিওর সেটে ক্যামেরার সামনে অভিনয় করা আর এক জিনিস। শুধু তাই নয়, আমার পরবর্তী জীবনে, দীর্ঘদিন ধরে, স্টার থিয়েটারের পাদপ্রদীপের সামনে পুর্ণ প্রেক্ষাগৃহে ‘শ্যামলী’ অভিনয় করতে গিয়ে দেখেছি, সে অভিনয় সম্পূর্ণ আলাদা।

এখন বলি, কেন এ কথা আমি বলছি। পাড়ায় বন্ধুবান্ধব মিলে স্টেজ তৈরি করে অভিনয় আমরা করেছি, একথা সত্যি। সে অভিনয় কেমন? তাতে থাকে না দায়িত্ববোধ। দর্শকরা অভিনেতাদের বেশিরভাগ স্থানেই হন বন্ধুস্থানীয়। ভুল-ক্রটি আপনি যাই করুন না কেন, সকলেই তা নেবেন ক্ষমার চোখে আর হাসির মাধ্যমে।

যেমন ধরুন, আপনি হয়তো কোনো বৃদ্ধের পার্ট করছেন।

গোঁফ দাড়ি খুব ভালো করে লাগিয়েছেন; মেক-আপে আপনাকে চেনবার জো নেই। নির্দিষ্ট সময়ের এক ঘণ্টা বা দেড় ঘণ্টা পরে অভিনয় যখন হল তখন আপনি দেখলেন ভীষণ মুশকিল হয়ে গেছে। সাজসজ্জার সময় মুখ বন্ধ করে সেজেছেন। পেন্টার তাড়াতাড়িতে গোঁফের চুলগুলো বড়োই রেখেছেন, কেটে দিতে ভুলে গেছেন। এখন আপনি যেই কথা বলতে যাচ্ছেন, ঠোঁটটা ওপর দিকে উঠে যাচ্ছে, ওপর দিকে উঠতেই, নিঃশ্বাসের সঙ্গে চুলগুলো গিয়ে ঢুকছে আপনার নাকের ভেতর। আর আপনি তখন কথা বলবেন কী, তার আগেই আপনার হয়ে যাচ্ছে প্রচণ্ড হাঁচি।

দু’চারবার এইরকম হবার পর আপনার দর্শকরা আপনাকে দেখে হাসতে আরম্ভ করলেন, কিংবা আপনার অনুকরণে হাঁচতে আরম্ভ করলেন।

পরের দৃশ্যে আপনি যখন গোঁফের চুল কেটে আবার স্থিত হয়ে এলেন, তখন আপনার পূর্ব দৃশ্যের অপরাধ অনেকেই ভুলে গেছেন। পাড়ার কয়েকটা বখাটে ছেলে অবশ্য আপনাকে দেখে হাঁচল। তাদের অবশ্য তখুনি থামিয়ে দেন বয়োজ্যেষ্ঠ লোকেরা। সুতরাং আপনার অভিনয় জমেও গেল।

পরের দিন সকালবেলা যখন রকে রকে বা জানলায় জানলায় আপনার অভিনয়ের সমালোচনা শুরু হল, তখন আপনার অস্বাভাবিক হাঁচির কথা তাঁরা ভুলে গেছেন।

এ তো গেল শখের দলের অভিনয়ের কথা। এখন বলি পেশাদার রঙ্গমঞ্চে অভিনয়ের কথা।

অভিনয় করতে যাবার আগেই আপনার মনে হবে, যাঁরা আপনার অভিনয় দেখতে এসেছেন তাঁদের কাউকেই আপনি চেনেন না। আপনার দোষ-ত্রুটি ধরবার জন্যে তাঁরা ওঁত পেতে বসে আছেন। অথচ তাঁদেরই সামনে অভিনয় করে আপনাকে তাঁদের খুশি করতে হবে। যদি খুশি করতে পারেন তাহলে আপনার সুনামের অবধি থাকবে না। আর আপনার সুনাম হলেই নাট্যপরিচালক, রঙ্গমঞ্চের মালিক, সকলেই খুশি হবেন আপনার ওপর। কারণ তাদের নাটক শুধু চলবেই না, বক্স-অফিসও হিট করবে।

ক্যামেরার সামনে অভিনয় করাটা স্বতন্ত্র। এ প্রম্পটারের কথা শুনে অভিনয় করা নয়। ঠিক যতগুলি কথা আপনাকে বলতে হবে ততগুলি সংলাপ আপনাকে মুখস্থ করতে হবে। পরিচালক যেমনটি দেখিয়ে দিয়েছেন ঠিক তেমনটি আপনাকে করতে হবে। একটু ভুল বা ত্রুটি হলেই অন্যদিক থেকে আওয়াজ আসবে— ‘কাট’। তাতে প্রযোজকের মুখ হবে গম্ভীর, কারণ আপনার সামান্য ভুলের জন্য অতখানি নেগেটিভ তাঁর নষ্ট হল।

শুধু এই নয়। ঘণ্টা আড়াই কি তিন, গোছগাছ আর রিহার্সাল দেওয়ার পর আপনি হয়তো ক্যামেরার সামনে অভিনয় করলেন দু’মিনিট। ঠিক যেন টেস্ট পরীক্ষায় allow হয়ে তিনমাস পরে পরীক্ষা দিলেন তিন ঘণ্টায়। কেমন হয়েছে তা জানবার উপায় নেই, যতক্ষণ না ইউনিভার্সিটি ফল বার করছে। এখানেও ঠিক তাই। অভিনয় করে আপনি বসে রইলেন। ছ’মাস কি সাত মাসের পর যখন ছবি মুক্তি পেল, তখন যদি দর্শকরা নিলেন সে ছবি তাহলে বুঝলেন আপনার অভিনয় ভালো হয়েছে। আর যদি ছবি flop করে তাহলে বুঝলেন অভিনয় ভালো হয়নি।

যা হোক, যে কথা বলছিলাম। স্টুডিওতে গেলাম। স্যুটিং হল দু’দিন। দক্ষিণা নিতে গেলাম। শুনলাম আমার ভাগ্যে এবারের দক্ষিণা হচ্ছে সাতাশ টাকা। কমিশন বাদ দিয়ে আমি পকেটে পেলাম মাত্র সাড়ে তের টাকা। আজকে ‘মাত্র’ বলছি কিন্তু সেদিন মনে হয়েছিল যেন অনেকখানি। আরও আনন্দ হয়েছিল, খুব শিগগির এর যা হয় একটা কিছু ফলাফল জানতে পারব।

আবার ফিরে গেলাম আমার সেই পুরোনো জীবনে। অফিস আর বাড়ি, বাড়ি আর অফিস। গৌরী আসে। আজকাল অবশ্য বেশ সয়ে গেছে। আমার ঘরে বসে কথাও বলে। অবশ্য অন্য লোকের অসাক্ষাতে।

‘সয়ে গেছে’ বলছি এই অর্থে,—মা আর অন্নপূর্ণা বা আমার বাড়ির অন্য লোকেরা এ ব্যাপার নিয়ে আর মাথা ঘামান না। কিন্তু আমার কি সত্যি সয়ে গিয়েছিল? আজ স্বীকার করতে বাধা নেই নিভৃতে গৌরীর সঙ্গে যখনই কথা বলবার সুযোগ পেতাম তখন আমার বুকের স্পন্দন যেন বন্ধ হয়ে যেত। তারপরে গৌরী চলে গেলে কিছুক্ষণ আনন্দে সেই চিন্তায় বিভোর হয়ে থাকতাম। পরক্ষণেই মনের মধ্যে আসত কেমন একটা হতাশা। কিছুক্ষণ আগেকার ঘটনা মন যেন বিশ্বাস করতেই চাইত না। মনের মধ্যে কেবলই উঠত একটিমাত্র প্রশ্ন—এ সত্যি ভালোবাসা না অভিনয়?

মাঝে মাঝে হতাশা কাটাবার জন্যে ভাবতাম অভিনয় যদি হবে তাহলে গৌরী কেন আমাদের বাড়ি আসবে। আবার মনে হত, গৌরী বোধহয় আমায় নিয়ে কেবল খেলা করছে। ও জানে সময় হলে ওর বিয়ে হবে কোনো বড়োলোকের ছেলের সঙ্গে। তখন আমার মতো অবস্থার ছেলেকে ভুলতে ওর এতটুকু সময় লাগবে না।

যাক, এইরকম করতে করতে কেটে গেল আরও কয়েকটা মাস। ‘দৃষ্টিদান’ মুক্তি পেল। ছবিটা দেখেও এলাম। মনটাও খুশি হল। কিন্তু হঠাৎ দেখলাম আমাদের বাড়িতে গৌরীর আসা বন্ধ হয়ে গেছে। এ বন্ধ হওয়ার অর্থ কিছু বুঝতে পারলাম না। ওদের বাড়িতে যেতেও সাহস হয় না। কী জানি যদি কেউ কিছু ভাবে! মনটা কেমন যেন খারাপ হয়ে গেল।

অন্নপূর্ণাকে বলি— ‘তোর বন্ধু গৌরীর কী হয়েছে রে? একবার খোঁজ নিস তো!’

অন্নপূর্ণা বোধহয় ব্যাপারটা আঁচ করেছিল। বিকেলবেলায় আমি অফিস থেকে আসতেই সে আমাকে বলল— ‘শুনেছ কী হয়েছে?’

আমি সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করি, ‘কী রে?’

— ‘গৌরী তার ঠাকুমার সঙ্গে গিয়েছিল ”দৃষ্টিদান” দেখতে। ঠাকুমা বায়োস্কোপ দেখতে দেখতে হঠাৎ নাকি গৌরীকে জিজ্ঞেস করেছিলেন— “হ্যারে গৌরী, তুই কাকে বিয়ে করবি বল তো? এই সমস্ত ছেলেদের মধ্যে কাউকে পছন্দ হয়?” ঠাকুমা হয়তো ভেবেছিলেন—লজ্জায় ভেঙে পড়ে গৌরী বলবে—বাবা কী বলছ ঠাকুমা! ঠাকুমাও নাতনিকে ঠাট্টা করবার একটা সুযোগ পাবেন। কিন্তু গৌরী সে দিক দিয়েও গেল না। হঠাৎ ঠাকুমাকে নাকি তোমার ছবিটা দেখিয়ে দিয়ে গৌরী বলেছে— “ঐ, ঐ, ওকে।” নাতনির উত্তর শুনে ঠাকুমার চোখ তো ছানাবড়া। বাড়িতে ফিরে এসেই সে খবর দিয়েছেন তাঁর ছেলেকে। ফলে গৌরীর স্কুলে যাওয়া, এমনকি বাড়ি থেকে বের হওয়াও বন্ধ।’

স্তম্ভিত হয়ে গেলাম অন্নপূর্ণার কথা শুনে। গৌরী তাহলে সত্যিই আমায় ভালোবাসে! আমার জন্যে সে এতখানি দুঃখবরণ করেছে! তার দুঃখের কথা শুনে আমার কোথায় দুঃখ হওয়া উচিত, তা না হয়ে, আমার মনে প্রাণে খেলে গেল একটা আনন্দের হিল্লোল—গৌরীর ভালোবাসার মধ্যে কোন মেকি নেই জেনে।

অন্নপূর্ণা আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে বলল— ‘কী ভাবছ দাদা?’

একটু ঢোঁক গিলে নিয়ে বলি— ‘না, এমন কিছু নয়!’

একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস বুক ঠেলে বের হয়ে আসতে চায়। সেটাকে চাপবার প্রাণপণ চেষ্টা করি।

হঠাৎ সচকিত হয়ে অন্নপূর্ণা বলে— ‘হ্যাঁ, আসবার সময় তাড়াতাড়িতে গৌরী যেন কী তোমায় লিখে দিয়েছে। পড়ে দেখো।’—বলে সে একটা ভাঁজকরা কাগজ আমার হাতে দিলো।

সেটা নিয়ে গিয়ে নিজের ঘরে বসে দরজা বন্ধ করে বারবার পড়তে থাকি। তাতে লেখা রয়েছে : ‘অন্নপূর্ণার মুখে আমার সব কথা হয়তো শুনেছ। এই আমাদের জীবনের পরীক্ষা শুরু। ভয় পেয়ে পিছিয়ে যেও না বীরপুরুষ। আমি জানি, এ খবর শুনে তোমার কষ্ট হবে। তার সঙ্গে এ-ও জানি, আমার ভালোবাসাই তোমায় টেনে আনবে আমার কাছে একদিন!

ইতি—তোমারই গৌরী’

অদ্ভুত, ছোট্ট অথচ মিষ্টি চিঠি। বারবার পড়েও যেন তৃপ্তি হয় না।

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. ‘অসিতদা’ অর্থাৎ বিশিষ্ট অভিনেতা অসিতবরণ (১৯১৬-১৯৮৪)। পুরো নাম অসিতবরণ মুখোপাধ্যায়। অভিনয় ছাড়াও, যেমন গান গাইতে পারতেন, তেমনটি ছিলেন একজন দক্ষ তবলাবাদক। প্রথম জীবনে আকাশবাণীর তবলাবাদক ছিলেন। গানও গাইতেন। এক সংগীতের আসরে পাহাড়ী সান্যালের নজরে পড়ার ফলে, ১৯৪১ সালে হেমচন্দ্র পরিচালিত ‘প্রতিশ্রুতি’ ছবিতে একটি ছোটো চরিত্রে অভিনয় করার সুযোগ মিলে যায় অসিতবরণের। এরপর, নায়ক-গায়ক হিসেবে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ‘কাশীনাথ’, ‘কবি জয়দেব’, ‘নিরুদ্দেশ’, ‘দৃষ্টিদান ইত্যাদি ছবি-এর উজ্জ্বল উদাহরণ। প্রসঙ্গত, নীতিন বসু পরিচলিত ‘দৃষ্টিদান’, (১৯৪৮) ছবিতেই নায়ক অসিতবরণের ছোটোবেলার চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে চলচ্চিত্র জগতে আবির্ভাব ঘটে উত্তমকুমারের। পরবর্তীকালে, অসিতবাবু গান গাওয়া বন্ধ করে শুধুই অভিনেতা হয়ে ওঠেন। পূর্বোক্ত বাদে, ‘বন্ধু’, ‘পলাতক’, ‘চলাচল’, ‘অ্যান্টনী ফিরিঙ্গি’, ‘স্মৃতিটুকু থাক’, ইত্যাদি আরো কিছু অসিতবরণ অভিনীত ছবির কথা উল্লেখ করা যায়। অসিতবরণ একজন বিশিষ্ট মঞ্চাভিনেতাও ছিলেন। ‘পরিণীতা’, ‘কথা কও’, ‘সেতু’, ‘ডাঃ শুভঙ্কর’, ইত্যাদি বেশকিছু নাটকে তাঁর অভিনয়ের সাক্ষ্য রেখেছেন তিনি। এই সবকিছুর পাশাপাশি অসিতবরণের ছিল অসম্ভব ঘুড়ি ওড়ানোর নেশা। ডাকনাম ‘কালো’ নামে পরিচিতমহলে জনপ্রিয় ছিলেন।
  2. বিশিষ্ট অভিনেত্রী সুনন্দা দেবীর জন্ম ১৯২১ সালের অগস্ট মাসে কলকাতায়। বাবা জগদীশ মুখোপাধ্যায় ছিলেন কমলালয় কোম্পানীর ম্যানেজার। সুনন্দা দেবীর আসল নাম ‘ইলা’। মাত্র সাত বছর বয়সেই ‘ইলা’ নামে নির্বাক ছবি ‘নিদ্রিত ভগবান’-এ অভিনয় করেছিলেন। ১৩ বছর বয়সে ব্যানারম্যান স্টোরের মালিক সুধীরকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ইলা তথা সুনন্দার বিয়ে হয়। কিছুদিন পরে স্বামীর ব্যবসায় হঠাৎ বিপর্যয় নেমে এলে চিত্রজগতে পা রাখতে হয় সুনন্দা দেবীকে। প্রথম ছবি, ‘কাশীনাথ’ (১৯৪৩)-এ নায়ক অসিতবরণের বিপরীতে নায়িকা হলেন। নিউ থিয়েটার্স প্রযোজিত প্রথম ছবিতেই বাজিমাত। এরপর, ‘দম্পতি’, ‘দুই পুরুষ’, ‘সমাপিকা’, ‘দৃষ্টিদান’, ‘অঞ্জনগড়’ ইত্যাদি অনেক ছবিতে তাঁকে দেখা গেছে। তবে ‘বিরাজ বউ’ ছবিতেই তিনি সবচেয়ে মনকাড়া অভিনয় করেন। সুনন্দা দেবী ‘এস. বি. প্রোডাকসন্স’ নামে একটি চিত্র প্রযোজকসংস্থা খুলেছিলেন এবং ‘নীহারিকা ‘ নামে একটি পত্রিকাও কিছুদিন সম্পাদনা করেন। অকালেই তিনি প্রয়াত হন।
  3. কেতকী দত্ত ১৯৩৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন। শিশির ভাদুড়ির ছোটোভাই তারাকুমার ভাদুড়ি ছিলেন বাবা এবং অবিস্মরণীয়া অভিনেত্রী প্রভাদেবী ছিলেন মা। কেতকী দত্ত নাচ-গান এবং অবশ্যই অভিনয়, সবেতেই অসম্ভব পটু ছিলেন। ‘শ্রীরঙ্গম’ তৈরির সময় প্রভা দেবী তাঁর মেয়েকে নিয়ে আসেন শিশিরকুমারের কাছে। ঐ ৮/৯ বছর বয়সেই ‘মায়া’ নাটকে অভিনয় প্রতিভার নমুনা রাখলেন কেতকী। এরপর ‘সিরাজদ্দৌল্লা’, ‘কামাল আতাতুর্ক’, ‘দুঃখীর ইমান’, ‘ধাত্রীপান্না’, ‘আত্মদর্শন’, ‘অ্যান্টনী কবিয়াল’ ইত্যাদি অজস্র নাটকে বিচ্ছুরিত হয়েছে কেতকী দত্ত-র অভিনয় দীপ্তি। এমনকি, প্রৌঢ় অবস্থায় গ্রুপ থিয়েটার মঞ্চে যে অসামান্য একক-অভিনয়ের নৈপুন্য তিনি ‘কমল কামিনী’ নাটকে দেখিয়েছিলেন, তা ভোলা যায় না। ‘গরবিনী’, ‘যার যেথা ঘর’, ‘পঞ্চায়েত’, ‘ইন্দ্রাণী’, ‘হসপিটাল’, ‘হার মানা হার’ ইত্যাদি বেশ কিছু চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন কেতকী দত্ত। ঋত্বিক ঘটক পরিচালিত ‘নাগরিক’ ছবিতে অসামান্য অভিনয় করেন এই অভিনেত্রী। প্রসঙ্গত, অভিনেতা চপল ভাদুড়ি হলেন কেতকী দত্ত-র আপন ভাই। ২০০৩ সালে কেতকী দত্ত প্রয়াত হন।
  4. নিরুপমা দেবীর রচনা অবলম্বনে দেবনারায়ণ গুপ্ত-র নাট্যরূপে শিশির মল্লিক ও যামিনী মিত্রের নির্দেশনায় ১৯৫৩ সালের ১৫ অক্টোবর ‘স্টার’ থিয়েটারে মঞ্চস্থ হয় ‘শ্যামলী’ নাটক। এই নাটক অসম্ভব জনপ্রিয় হয় এবং ৪৮৪ রজনী একটানা অভিনীত হয়ে শেষবারের জন্য মঞ্চস্থ হয় ১৯৫৫ সালের ১৩ জানুয়ারি। এই নাটকে ‘অনিল’ চরিত্রে নায়কের ভূমিকায় সবকটি রজনীতে অভিনয় করেন উত্তমকুমার। নামভূমিকায় ‘বোবা’ মেয়ে ‘শ্যামলী’-র চরিত্রে রূপদান করেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। এছাড়া, এই নাটকে অভিনয় করেন জহর গঙ্গোপাধ্যায়, সরযূবালা দেবী, রবি রায়, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, অনুপকুমার, তুলসী চক্রবর্তী প্রমুখ প্রথিতযশা শিল্পীরা। এর আগে ‘বসু পরিবার’ ছবিতে উত্তমকুমারের অভিনয় প্রশংসিত হওয়ায়, এই নাটকে তিনি সুযোগ পান এবং তাঁর মঞ্চাভিনয় অচিরেই দর্শককুল গ্রহণ করেন। সম্ভবত, এই একটিবারই উত্তমকুমার পেশাদার নাট্যমঞ্চে অভিনয় করেছিলেন।