উত্তমকুমার চট্টোপাধ্যায়
হারিয়ে যাওয়া দিনগুলি মোর
ছয়
সময় সময় মানুষের জীবনে এমন সব ঘটনা ঘটে, যা উত্তরকালে ভাবলেও বিস্ময়ের উদয় হয়। অথচ, তাকে ভোলাও যায় না। কারণ, ভুলতে গেলে ভুলতে হয় জীবনের কয়েকটি চরম মুহূর্ত। এই চরম মুহূর্ত বলতে আমি এই মানে করতে চাইছি যে, মনের সঙ্গে সঙ্গে বাইরেরও পরিবর্তন হয়।
কথাটা পরিষ্কার করেই বলি—
আপনারা অনেক সময় লক্ষ্য করেছেন কিনা জানি না, কিন্তু আমি লক্ষ্য করেছি, যে কাজ আপনার করতে ইচ্ছে নেই, করতে ভালোও লাগে না, সেই কাজই আপনাকে করতে হচ্ছে, ইচ্ছের বিরুদ্ধে। সর্বমন-প্রাণ দিয়ে আপনি যা চাইছেন তা পাচ্ছেন না, আর যা পাচ্ছেন তা চাইছেন না। অথচ তা থেকে বেরিয়ে আসবার যেন কোনো উপায় নেই। ঠিক যেন ছোট্ট একটা পালতোলা নৌকো বন্দী হয়েছে একটা পুকুরের মধ্যে। পালে বাতাস লাগছে না, তর তর করে ছুটে চলবার শক্তিও সে হারিয়ে ফেলেছে। তাকে চালাতে হচ্ছে গুণ টেনে।
হঠাৎ পুকুরের একধারের সঙ্গে যুক্ত হল নদীর খরস্রোত। পালেও লাগল হাওয়া, নৌকোও ছুটে চলল অজানার সন্ধানে। সে জানলও না অন্তরীক্ষ থেকে কে তার যাত্রা পরিচালনা করছে, তাকে যেতে হবে কোথায়! এইটুকু সে জানে তাকে চলতে হবে। ঠিক তেমনি ঘটনা ঘটেছিল আমার জীবনে।
একদিকে ফিল্মে নামবার দুর্দমনীয় আকাঙ্ক্ষা আর অপর দিকে গৌরীকে পাবার তেমনি আকাঙ্ক্ষা।
এই দুই আকাঙ্ক্ষার শত্রুই সেদিন আমাকে পাগল করে তুলেছিল। আমার অবস্থাও হয়েছিল ওই পালতোলা নৌকোর মতো। কানে শুনতে পাচ্ছি নদীর কুলুকুলু শব্দ। সেই শব্দ আমার কানের মধ্যে দিয়ে রক্তে মিশে আমাকে তুলছে মাতাল করে। আমি শুনতে পাচ্ছি কার যেন আহ্বান! কিন্তু যাব কেমন করে? সব পথই যে রুদ্ধ।
গৌরীকে পাবার আকাঙ্ক্ষা আমার পক্ষে দুরাশা। কারণ, সে বড়োলোকের মেয়ে। অপর দিকে রুপালি আলোর খেলা। সেখানেও প্রবেশ আমার নিষিদ্ধ।
স্টুডিওর দরজায় দরজায় ঘুরেছি। পরিচালক প্রযোজকদের সঙ্গে দেখা হওয়া তো দূরের কথা, স্টুডিওর গেটই পার হতে পারিনি।
ছবিতে নামবার আশা আমার কেবল স্বপ্নই থেকে যায়, বাস্তবে রূপ নেয় না। অথচ অফিসও করতে ভালো লাগে না।
অফিস কামাই করে যে ছবিতে নামবার চেষ্টা করব, তারও উপায় নেই। তাতে আয় বন্ধ হবার ভয় আছে। অথচ!
তাই ছুটির পর একে-তাকে বলি; মাঝে মাঝে যে টালিগঞ্জে না যাই, তাও নয়; কিন্তু ওই যাওয়া-আসাই সার হয়।
একটা নিদারুণ হতাশা ও ব্যর্থতা ক্রমশ আমাকে পেয়ে বসতে লাগল! কিছুই ভালো লাগে না, তাই অনেক সময় অফিসের পর একা গিয়ে বসে থাকতাম গড়ের মাঠে অথবা গঙ্গার ধারে। চেয়ে থাকতাম ওই জাহাজগুলোর দিকে। আর মনে মনে ভাবতাম, কী হল আমার?
কর্মমুখর কলকাতার লোক ফিরে যেত তাদের নিজের বাড়িতে। আমি ভাবতাম সকলেই কেমন আনন্দে রয়েছে, আমি কেবল সহ্য করছি এই নিদারুণ, দুঃসহ মনোযন্ত্রণা। রাস্তার বাতিগুলো জ্বালিয়ে দিয়ে যেত কর্পোরেশনের কর্মীরা। তীব্র হেডলাইট ফেলে গাড়িগুলো ছুটে যেত। আমার কথা, আমার খবর কেউ রাখত না। যাকনা চলে, কোনো ক্ষতি নেই। জীবনে প্রতিষ্ঠাই যদি না পেলাম, তাহলে বেঁচে থেকে কী লাভ? একা বসে বসে এইসব কথাই চিন্তা করতাম।
তখন বোধহয় শীতকাল। গঙ্গাসাগর বা ওই ধরনের কোনো একটা মেলা উপলক্ষ্যে লোক আসছে দলে দলে!
হঠাৎ আমার কাছে কে যেন বলল— ‘বাবুজি, কুছ হুয়া?’
চমকে উঠলাম। মুখ ফিরিয়ে দেখলাম, এক গেরুয়া-বসনধারী সন্ন্যাসী! অত ঠান্ডায়ও গায়ে কিছু নেই। ছাই মাখা। মাথা কামানো। মুখে দাড়ি-গোঁফের চিহ্ন নেই। দীর্ঘ চেহারা। কিন্তু চোখের চাহনি অদ্ভুত। আমার চোখের ওপর চোখ পড়ায় যেন মনে হল, আমার সমস্ত মনটাকে সে দেখতে পাচ্ছে। মুখ ঈষৎ রক্তাভ। তার চোখে পড়ায় কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করলাম! বিরক্তও যে হলাম না তাও নয়। কারণ, তখন একটা বিশ্বাসই ছিল, এই গেরুয়ার অন্তরালে যারা থাকে, তারা সকলেই ঠগ আর চোর ছাড়া কিছু নয়। সংসারে কিছু করবার চেষ্টা বা ইচ্ছা তাদের নেই; কেবল পরের ঘাড়ে বসে খাওয়াই তাদের লক্ষ্য।
আমিও বললাম— ‘কিছু হবে না বাবা, সরে পড়ো।’
— ‘হবে না? হবে না মানে কী?’
আবার চমকে উঠলাম, সন্ন্যাসীর এ পরিষ্কার বাংলা শুনে। তবে কি লোকটা বাঙালি? তখন কম বয়স। চপলতা হিসেবে উপদেশ দেওয়ার ইচ্ছাটাও প্রবল। কারণ এ উপদেশ দিতে গেলে খরচ হয় না। যদি তা হত, তাহলে আপনারা আমার মতনই লক্ষ্য করতেন, সংসারে অনেক উপদেশই বন্ধ হয়ে গেছে।
আর একটা আশ্চর্য জিনিস এই যে, যে ব্যাপার আমার জানা নেই, কোনো অভিজ্ঞতাই নেই যার সম্বন্ধে, সেই বিষয়ে আমরা আগে উপদেশ দিই। আর যে উপদেশের পাত্র, আমরা সব সময়ে লক্ষ্য রাখি সে আমার চেয়ে দুর্বল কিনা। তাই দেখি, বড়ো ছোটোকে উপদেশ দেয়, সবল দেয় দুর্বলকে। প্রতিপক্ষ যদি সবল হয়, তাহলে উপদেশ দেবার ইচ্ছা আমাদের চলে যায়, আর চোখের ওপর তাকে ভুল করতে দেখলেও বলি— ‘বাঃ, ঠিক বলেছেন আপনি!’
এক্ষেত্রে সন্ন্যাসী আমার কাছে প্রার্থী। আর আমি ইচ্ছে করলে দুটো বা চারটে পয়সা দিয়ে দাতার আসনে বসতে পারি।
সুতরাং আমার অবস্থা ওর চেয়ে সবল। তাই একটু গলা ঝেড়ে বললাম— ‘বেশ চেহারাটা তো দেখছি তোমার, খেটে খেতে পারো না?’
আমার কথা শুনে সন্ন্যাসী হেসে উঠলেন। তারপরে বললেন— ‘খেটে খাব না বলেই মা বাপের কাছ থেকে পালিয়েছি। তবে খাটব কেন?’
না, এর কথা সাধারণ সন্ন্যাসীর মতন তো নয়! কেমন যেন লাগল! তাই বললাম— ‘কী বলছেন আপনি, কিছু তো বুঝতে পারলাম না!’
সন্ন্যাসী বললেন— ‘আরে এটুকু সোজা কথা বুঝলে না? কয়েকদিন ঘুরেই তুমি হতাশ হয়ে পড়লে? মা বাবা, বাড়ি, ঘরদোর ছেড়ে এই ঠান্ডাতেই বা বসে আছ কেন? তুমি বলবে—আমি ভাবছি, কী করে আমার উদ্দেশ্য সফল হয় সেই কথা। আর আমরা কী করছি জানো? সব কিছু ছেড়েছি, কেবল তাঁকে পাবার জন্যে। কারণ তিনি যে অসীম। তাঁকে লাভ করতে পারলে চরম আনন্দের অধিকারী হওয়া যায়।’
বিস্ময় তখন আমার চরমে পৌঁছে গেছে। আমি ভাবছি এ লোকটা যে দেখছি আমার মনের কথা বলে দিচ্ছে, তবে কি এ লোকটা thought reader? তাই পরীক্ষার জন্য তাকে বলি, ‘আচ্ছা, আমি কী ভাবছি বলুন তো?’
সন্ন্যাসী আমার কাছে বসে পড়ে বললেন— ‘আরে দূর পাগলা, সন্ন্যাসীকে কি পরীক্ষা করতে হয় ওভাবে? এসব কথা বলা কি তাঁর পক্ষে শক্ত কাজ? এসব তো খুব সামান্য জিনিস। সে তো এখুনি বলে দেওয়া যায়। তুমি ভাবছ সেই মেয়েটির কথা। আর ভাবছ, কী করে ফিল্মে অভিনয় করা যায়।’
আমি তখন বেশ অভিভূত হয়ে পড়েছি। পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে তাঁকে বলি— ‘আমি কী করে—’
আর বলতে হয় না। হেসে ফেলে তিনি বলেন— ‘একদিন যে বড়ো অভিনেতা হবে, সেই ভাবছে কী করে ফিল্মে চান্স পাওয়া যায়!’
আমি বড়ো অভিনেতা হব! নাঃ, এ লোকটা নিশ্চয়ই thought reader।
আমার মনের কথা বুঝতে পেরে, আমাকে খুশি করে বেশ কিছু টাকা ও বার করে নিতে চায়। তাই এইসমস্ত কথা বলছে।
আমি বলি— ‘সব বাজে কথা! অভিনয় আমি মোটেই করতে চাই না। আর আমি— ‘
— ‘আর তুমি—কী বলো?’
— ‘কাউকে ভালোওবাসি না। কী তুমি যা-তা বলছ!’
আবার প্রশান্ত হাসিতে ফেটে পড়লেন সেই সন্ন্যাসী।
এইবারে সোজা দাঁড়িয়ে বললেন— ‘অভিনয় করতে চাও আর না চাও, ফিল্মে তোমাকে নামতেই হবে। আর যে মেয়েটিকে এতক্ষণ বসে চিন্তা করছিলে, সেই তোমার স্ত্রী হবে। বাড়ি, গাড়ি, যা চাও সব পাবে। আজকে তুমি ভাবতেও পারবে না আগামীদিনের কথা। বললেও তুমি বুঝতে পারবে না।’
তিনি চলে যাচ্ছিলেন—
খপ করে তাঁকে ধরে ফেলে বলি— ‘একটা কথা শুনে যান। এসব কথা আপনি বললেন কী করে?’
তিনি বললেন— ‘আরে, এতো সন্ন্যাসীর কাছে কিছুই নয়। সব মনই বাঁধা রয়েছে সেই বিরাট একটি মনে। আমি সেই বিরাটেরই ধ্যান করি দিনরাত। তাঁকে লাভ করাই আমার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। তাই আমার পক্ষে এটুকু বলা কিছু শক্ত নয়। তোমার মুখখানা দেখে বড়ো ভালো লেগেছিল। তাই ভাবলাম, তোমার এত কীসের দুঃখ, একা বসে আছ! তাই তোমাকে আশার কথা শুনিয়ে গেলাম। তবে একটা কথা বলি, তুমি উপবীতধারী ব্রাহ্মণের সন্তান। যাই করো না কেন, দুবেলা গায়ত্রী জপতে ভুলো না। জেনো, এই জগতের সবকিছুর ওপরে একজন আছেন, যার ইচ্ছায় এই পৃথিবী চলছে। বিজ্ঞানের সামান্য ভড়কিতে বা পার্থিব নাম, যশ আর টাকায় তাকে কখনও ভুলো না। সংসারে যদি আঘাত আসে, জানবে পেছনেই আছে তোমার সফলতা। দিন আর রাত্রি যেমন পর পর আসা-যাওয়া করে, ঠিক তেমনি আশা আর নিরাশা মানুষের জীবনেও আসে ঘুরে ঘুরে। নিরাশায় ভেঙে না পড়ে এগিয়ে চলো।’
পকেটে হাত দিয়ে দেখি একটা পাঁচ টাকার নোট রয়েছে। তাড়াতাড়ি সেটাকে বার করে তাঁর পায়ের কাছে রাখতেই—কিন্তু কোথায় তিনি? আমার ধারেকাছেও কেউ নেই। তাড়াতাড়ি উঠে তাঁকে খুঁজতে আরম্ভ করলাম। তাঁকে কোথাও দেখতে পেলাম না। সোজা রাস্তা ধরে দুদিকে সন্তর্পণে চাইতে চাইতে, একেবারে ইডেন গার্ডেন অবধি এগিয়ে এলাম। কিন্তু সেই সন্ন্যাসীকে কোথাও দেখতে পেলাম না।
খুঁজতে খুঁজতে এক সন্ন্যাসীর দলের মধ্যে গিয়ে পড়লাম। গিয়ে দেখলাম, তারা শীতের হাত থেকে বাঁচবার জন্যে কাঠ জড়ো করে আগুন লাগিয়েছে। বুঝলাম, এই ধরনের রকম দেখেই মানুষ ভুল বোঝে আসল সন্ন্যাসীকে।
কিন্তু আমি যে ঠকলাম! হাতের কাছে তাঁকে পেয়েও হারালাম। একী নিদারুণ দুঃখ!
ইচ্ছা করলে হয়তো আরও অনেক কথা জানতে পারতাম। ছিঃ ছিঃ, এ কী দুর্মতি আমার ঘাড়ে চাপল! কিন্তু, তখন তো যা হবার তা হয়ে গেছে।
বিশাল কলকাতার মাঝখানে তাঁকে খুঁজে বার করা আমার সাধ্য নয়। বাড়িতে এসে কেবলই ভাবতে লাগলাম সেই সন্ন্যাসীরই কথা।
পরের দিন সকালবেলায় বসলাম গায়ত্রী জপ করতে। হঠাৎ মা কী একটা কাজে ঘরের মধ্যে ঢুকেছিলেন, আমাকে গায়ত্রী জপ করতে দেখে বললেন— ‘এতদিনে সুমতি হল!’
একবার ভাবলাম, মাকে বলি কালকের রাত্রের সব কথা। কিন্তু পরমুহূর্তেই মনে হল এতবড়ো মহাপুরুষকে হাতের কাছে পেয়েও আমার নির্বুদ্ধিতার জন্যে উপদেশ দিতে গিয়েছিলাম, জানতে পারলে মা হয়তো দুঃখই পাবেন। তাই মাকে খুশি করবার জন্যে বলি— ‘কেন মা, তুমিই তো বলেছ গায়ত্রী জপ করতে রোজ!’
মা খুশি হয়ে বলেন— ‘সে কথা যে তুই মনে রেখেছিস তাই ভালো’—বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
এরই কয়েকদিন পর হঠাৎ গণেশদা ওরফে গণেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা হল।
আমাকে দেখেই তিনি বললেন— ‘অরুণ, ফিল্মে নামবার কথা অনেকদিন বলেছিলি। একটা চান্স এসেছে, নামবি ফিল্মে?’
ফিল্ম! নিজের কানকে নিজেরই বিশ্বাস হলো না। গণেশদা এ কী বলছেন! আমি নামব ফিল্মে! জিজ্ঞেস করি, ‘কী ছবি, কী পার্ট?
— ‘আরে তোকে এখন হিরোর চান্স কে দেবে বল? আমাদের একটা হিন্দি ছবি ‘মায়াডোর’-এ বর সাজতে হবে। তেমন বিশেষ কিছু পার্ট নয়। রাজি তো?’