উত্তমকুমার চট্টোপাধ্যায়

হারিয়ে যাওয়া দিনগুলি মোর

সতের

গত মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে আমাকে চলে যেতে হয়েছিল কলকাতার বাইরে। যদিও এটা নিছক দেশভ্রমণ নয়, কাজের তাগিদেই যেতে হয়েছিল সুদূর রাজপুতানার উদয়পুরের পাহাড়ে পাহাড়ে। ঘোড়ায় চড়ে তরোয়াল হাতে ছবি তোলবার সময় কেবলি মনে হচ্ছিলো, এই সেই দেশ, যেখানে জন্মেছিলেন বাপ্পা, প্রতাপ, রাজসিংহ। যে দেশের লোকেরা তরোয়াল আর ঘোড়া সম্বল করে বেরিয়ে পড়ত দেশদেশান্তরে। সেই দেশেই আমি এসেছি, তরোয়াল খেলার আর ঘোড়ায় চড়ার অভিনয় করতে। কতদূর সার্থক হয়েছি, তার বিচার করবেন আপনারা। ইচ্ছে ছিল মাউণ্ট আবু অবধি যাব, কিন্তু তার আগেই ফিরে আসতে হল কলকাতায়।

আজ এক বছরের ওপর ধরে আমার ক্ষুদ্র জীবনের কাহিনি আপনাদের বলতে শুরু করেছি। একসঙ্গে লিখে দিতে পারলেই ভালো হতো কিন্তু তার সময় কোথায়? তাছাড়া, আমি এতবড়ো লেখক নই যাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে আপনাদের ধরে রাখতে পারি। তবুও লিখছি এ কাহিনি, যাতে ছবিতে রাজপুত্রের ভূমিকায় আমায় দেখে কেউ না আমায় মনে করেন, আমি সত্যিকারের রাজপুত্র। ঘোড়া আর তরোয়াল নিয়ে আমি নেমে পড়েছি আমার জীবনযুদ্ধে। তাঁদের কাছে আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ তাঁরা যেন মনে রাখেন এটা ঘোড়া আর তরোয়ালের যুগ নয়, এ যুগটা এরোপ্লেন আর হাইড্রোজেন বোমার যুগ।

যাক সেসব কথা। কথায় কথায় যুদ্ধের কথা যখন উঠে পড়ল তখন আমার জীবনের একটা যুদ্ধের কাহিনি বলবার লোভ আর সংবরণ করতে পারছি না।

সালটা বোধহয় ১৯৪৭ হবে। গৌরীর সঙ্গে বেশ প্রেম জমে উঠেছে, আবার বিচ্ছেদও হয়েছে। বিচ্ছেদ মানে, ঘটনাটা জানাজানি হওয়ার পর বাড়িতে সে আটকা পড়েছে।

আমার জীবনের কাহিনি লিখতে গিয়ে সেকথা আপনাদের আগেই নিবেদন করেছি।

আমার মনমেজাজও বিশেষ ভালো নয়। একটুতেই তিরিক্ষে হয়ে উঠি। এমনি সময় আমাদের পাড়ার কাছে ঘটল একটা ঘটনা।

গোটাকতক ট্যাক্সি ড্রাইভার আমাদের ওই গলির মোড়টায় রাতে সাড়ে আটটা ন’টা থেকে তখন ভিড় জমাত। তখনও বেবী ট্যাক্সির প্রচলন হয়নি। কলকাতার অধিকাংশ ট্যাক্সি ড্রাইভার ছিল অবাঙালি।

যুদ্ধ কিছুদিন আগে থেমেছে। রেশ তখনও কমেনি।

তারপর কলকাতার বুকে কিছুদিন আগেই ঘটে গেছে সেই সর্বনাশা ৪৬ সালের ১৬ অগস্টের ঘটনা। এখানে সেখানে লোক জমায়েত হলেই, লোকে ভাবে, বুঝি তারই পুনরাবৃত্তি ঘটছে। ব্যাপার কী কেউ অনুসন্ধান করে না। সকলেই মারামারি থেকে দূরে থাকতে চায়। খানিকটা এরই সুযোগ নিয়ে ওদের আড্ডাটা জমলও ভালো। রাতের অন্ধকারে যা হয় তা হতেও দেরি হল না। চড়চাপড় মেরে এর কাছ থেকে পয়সা কেড়ে নেওয়া, ওকে অপমান করা, এ তো প্রায়ই ঘটত। শুধু এই নয়, মেয়েরা ভয়ে ও রাস্তা দিয়ে চলাই বন্ধ করল। কারণ দু’একজন রাত্রে ফেরবার সময় বেশ অপমানিত হয়েছিলেন।

খবরটা আমাদের কানে এল। গোলমাল আর পুলিস হাঙ্গামার ভয়ে, কেউ গায়ে মাখল না। থানাতে জানিয়েও কোনো লাভ নেই। কারণ তাঁরা তখন অন্য ব্যাপারে ব্যস্ত। এদিকে ওই দলকে সাহস করে চটাতেও কেউ চাইছে না। কারণ কলকাতায় যদি আরও গণ্ডগোল বাধে তখন ভরসা তো ওদেরই বাহুবল!

কিন্তু আমার যেন ব্যাপারটা অসহ্য মনে হল। একদিন আমি রাত্তির বেলায় আরও দু তিন জন বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে একরকম ইচ্ছে করেই রাত্তির করে বাড়ি ফিরলাম। মাকে আমার উদ্দেশ্যের কথা আগে বলিনি। কী জানি, জানতে পারলে হয়তো বাড়ি থেকে বেরোতেই দেবেন না কিংবা বকুনি দিয়ে হয়তো নিজের কাছে বসিয়ে রাখবেন। রাত্তিরবেলায় যখন ফিরছিলাম, ওই দলের একজন একটু মত্ত অবস্থাতেই আমার কাছে এসে বলল— ‘অ্যাই, কিধার যাতা?’

গলার স্বরটাকে নকল করে আমি বললাম— ‘যিধার খুশ।’

লোকটা অপমানিত বোধ করল। সুরটা একটু চড়িয়ে আমাকে বলল— ‘পাঁচঠো রূপেয়া দে যাও!’

আমি এই সুযোগেরই অপেক্ষা করছিলাম। সজোরে এক ঘা বসিয়ে দিয়ে বললাম— ‘লিজিয়ে!’

লোকটা এরজন্য প্রস্তুত ছিল না। আচমকা আঘাতে, পড়ে গেল রাস্তার ওপর। তার দলের দশ-বারো জন সঙ্গীকে পড়ে যেতে দেখে, আমাদের চার পাঁচ জনের ওপর বাঘের মতো লাফিয়ে পড়ল। কিন্তু ওই পর্যন্তই।

বিশেষ দ্রব্যের প্রভাবে আমাদের সামনে তারা বেশিক্ষণ আর দাঁড়াতে পারল না। হোক না কেন তারা আমাদের চেয়েও লম্বাচওড়া আর বিশেষ শক্তিশালী।

মিনিট দশেকের মধ্যেই ওদের রণে ভঙ্গ দিয়ে পালাতে হল। ততক্ষণে কিন্তু আমাদের সকলকারই গায়ে, মুখে, মাথায় ওরা খানিকটা করে চিহ্ন এঁকে দিয়ে গেছে। পায়ে পা লাগিয়ে আমিই প্রথম ঝগড়া বাধাতে গিয়েছিলাম বলে, আমি পড়েছিলাম ওদের মাঝখানে। আমার বন্ধুর দল না থাকলে ওরা আমাকে হয়তো মেরেই ফেলত সেদিন। কিন্তু বন্ধুরা থাকার দরুন আমার মাথাটাই সেদিন ফেটেছিল। জামাকাপড়ের অবস্থাও সেইরকম। বেশ ছিঁড়ে গেছে। দরদর করে রক্ত কপাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। পুলিসের ভয়ে তাড়াতাড়ি ঢুকতে হল বাড়িতে।

ভেবেছিলাম কলে মুখ-হাত ধুয়ে জামাকাপড়টা বদলে নেব। তারপরে মাথায় একটা ব্যাণ্ডেজ করলেই হবে। আমার জামাকাপড়ের ওই অবস্থা আর রক্ত দেখেই, বুড়ো খবরটা মাকে গিয়ে দিল। ব্যস, আর যায় কোথায়! কলঘরের মধ্যেই ছুটে এলেন তিনি। জোর করে রক্ত ধুয়ে দিয়ে নিজের শাড়ির আঁচলা ছিঁড়ে ফেলে কপালে ব্যাণ্ডেজ করে দিলেন। তারপর, সে রাত্রে কাছে বসিয়ে খাইয়ে, নিজের কাছে নিয়ে শুলেন তিনি। আমার কোনো ওজর-আপত্তি তাঁর কাছে সেদিন টিঁকল না। সারারাত কেবল মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছেন।

আমি যত তাঁকে বোঝাবার চেষ্টা করি— ‘মা, আমার কিছুই হয়নি, তুমি ঘুমোও।’—উত্তর শুনি কেবল একটা কথা— ‘তুই আগে ঘুমো, তারপরে আমি ঘুমোবো।’

আমি বলি— ‘কেন তুমি এত ভাবছ, আমি ভালো আছি, আমার কিছু হয়নি।’

উত্তরে কেবল তিনি বললেন— ‘তোর কী হয়েছে না হয়েছে তা কী আমায় বলে দিতে হবে?’

অত বয়সেও তিনি আমার সঙ্গে ব্যবহার করতে লাগলেন যেন আমি একটা দু’বছরের ছেলে। নিজের আঘাতের গুরুত্বটুকুও বোঝবার ক্ষমতা যেন আমার নেই।

মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। ভেবেছিলাম দেখব, মা ঘুমিয়ে পড়েছেন। তার বদলে দেখলাম, তন্দ্রার কোলে ঢলে পড়েও তিনি জোর করে জেগে থেকে আমার শুশ্রূষা করবার চেষ্টা করছেন।

আমি মাকে বলি— ‘মা, তুমি শুয়ে পড়ো, আমি ভালোই আছি।’

আমাকে উত্তরে তিনি কেবল বললেন— ‘হুঁ, তুমি যে কেমন আছো তা আমার আর জানতে বাকি নেই! এখন জ্বর না এলে বাঁচি!’—কথাগুলো বলতে বলতে তাঁর দু চোখ ভরে এল জল।

আমি বলি— ‘লাগল আমার, ব্যথা পেলে তুমি? আমার কী হয়েছে, আমি কি কচিখোকা যে কিচ্ছু বুঝতে পারি না?’

মা একটু রাগতভাবে বললেন— ‘না তুমি খুব বুড়ো হয়েছ! এখন ঘুমিয়ে আমাকে উদ্ধার করো।’

সেইদিনই প্রথম বুঝতে পারলাম, আমি এতটুকু ব্যথা পেলে তা কতখানি হয়ে মা’র বুকে গিয়ে লাগে। কতখানি স্নেহ আর মমতা দিয়ে তিনি আমাদের ঘিরে রেখেছেন! আর বিনিময়ে আমি মাকে কী দিতে পারলাম!

সেরে উঠলাম দিন তিনেকের মধ্যে। ওই ঘটনাতে আর একটা ব্যাপার দেখতে পেয়েছিলাম। জানি না কেমন করে কথাটা পৌঁছেছিল গৌরীর কানে। সেও কেঁদে কেঁদে হয়েছিল সারা। ও-তো ভেবেইছিল গুণ্ডারা বুঝি আমায় মেরেই ফেলেছে।

১৯৪৮ সালের প্রথম দিকে গৌরী শুরু করল অনশন। কারণ ওর বাড়ি থেকে তখন ওর জন্য পাত্র স্থির করা হয়েছে। বিয়েরও আর বেশি দেরি নেই, একরকম উপায়হীন হয়েই প্রতিবাদস্বরূপ সে খাওয়া বন্ধ করল।

অগত্যা ওর বাবা মাকে রাজি হতে হল ওরই কথায়। ছাড়া পেল গৌরী, এল আমাদের বাড়ি। আমার হাত ধরে বলল— ‘চলো আমার বাবার কাছে, গিয়ে বলো সব কথা তাঁকে। উনি নিশ্চয়ই রাজি হবেন। আমাদের বিয়ে দেবেন।’

দুরুদুরু বুকে গৌরীর সঙ্গে এগিয়ে গেলাম ওদের বাড়িতে। বাড়ির সামনে গিয়ে কেমন যেন ভয়ে গলা শুকিয়ে আসতে লাগলো। পরে শুনেছি প্রেমের ধর্মই নাকি সন্দেহ করা।

আমার হঠাৎ মনে হল, যদি গৌরী আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে, যদি ওর বাবাকে দিয়ে দরোয়ান ডেকে মারের ব্যবস্থা করে থাকে, তাহলে?

সব সাহস কোথায় আমার চলে গেল। যেই গৌরী গেল তার বাবাকে ডাকতে, অমনি আমিও সেখান থেকে পত্রপাঠ গেলাম পালিয়ে।

আমায় খুঁজে না পেয়ে গৌরী আবার এল আমার কাছে। বললো— ‘পালিয়ে এলে যে? বলতে হবে না?’

আমি বলি— ‘না মানে, একা গিয়ে বলব ওঁর সামনে, তাই এসেছিলাম বুড়োকে ডাকতে। ওকেও সঙ্গে নিয়ে যাই না।’

আমার একার সাহসে যে কুলোচ্ছেনা তা বোধহয় বুঝেছিল গৌরী। তাই বোধহয় রাজি হল আমার কথায়।

আমি বুড়োকে সঙ্গে নিয়ে আবার গেলাম ওদের বাড়িতে। বিশেষ কিছু বলতে হল না। গৌরীর বাবা নিজের থেকে বললেন— ‘ও আমার আদরের মেয়ে, ওকে অযত্ন কোনোদিন করবে না তো?’

আমি বলি— ‘দেখুন, আমার সাধ্যমতো’—

কথাটা একরকম মুখ থেকে কেড়ে নিয়েই বললেন তিনি— ‘করো তো পোর্ট কমিশনারে চাকরি, ফিলিমে নামবারও চেষ্টা করছ শুনেছি। যাহোক, তোমরা সুখী হও। তবে এইটুকু কথা দাও, জীবনের কোনো অবস্থাতেই আমার গৌরীর অনাদর করবে না। এইটুকুই তোমার কাছে আমার অনুরোধ। আমি যাব তোমার বাবার কাছে, তিনি মত দেবেন তো এ বিয়েতে?

আমি বলি— ‘মাকে আমি বলে রাখব। আশাকরি উনিও মত দেবেন।’

কথাটা বোধহয় ইতিপূর্বে মা কানাঘুষোয় শুনেছিলেন। তাছাড়া গৌরীকে মা’র বরাবরই পছন্দ হয়েছিল।

মাকে কথাটা বিশেষ করে বলতে হল না। অনুমতি চাইবার ভূমিকা করতে না করতেই তিনি আমায় বললেন— ‘খোকা, বিয়ের ব্যাপার, ভালো করে ভেবে বল, তুই সুখী হবি তো?’

আমি বলি— ‘হ্যাঁ মা, যদি তুমি আশীর্বাদ করো।’

মা বললেন— ‘আশীর্বাদ! তোর সুখই আমার সব সময় লক্ষ্য! তোর বাবাকে আমি রাজি করাবোই।’

এদিকে গৌরীর বাবাও এলেন আমাদের বাড়িতে। কথাবার্তাও হল পাকাপাকি। ১ জুন সকালবেলায় আমাদের বাড়িতে বেজে উঠল শুভ সানাই। অবসান হতে চলল দীর্ঘ প্রতীক্ষার।

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. কলকাতার রাস্তায় একসময় ছোটো আকারের একধরনের ট্যাক্সি চলত। এতে মাত্র দু’জন সওয়ারি হতে পারতেন। খুব দ্রুতগামী ছিল এই ট্যাক্সি। ভাড়াও ছিল প্রচলিত বড়ো ট্যাক্সির চেয়ে তুলনামূলকভাবে কম।
  2. স্বাধীনতার একবছর আগে ১৯৪৬ সালের ১৬ অগস্ট থেকে কলকাতায় হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে এক ভয়াবহ দাঙ্গা শুরু হয়। প্রায় একমাস এক নারকীয় হত্যালীলা চলতে থাকে। কলকাতার জনজীবন সম্পূর্ণভাবে বিপর্যস্ত হয়ে যায়। এর জের চলতেই থাকে এবং তা তীব্র আকার নিয়ে আবার শুরু হয় ১৯৪৭ সালের মে মাসে। মহাত্মা গান্ধী ১৯৪৭-এর এই সময় দাঙ্গা থামানোর উদ্দেশ্যে এসে অবস্থান করেন কলকাতার বেলেঘাটায়। ১৯৪৬-এর শুরু হওয়া দাঙ্গার নৃশংস রূপ ‘The great Calcutta killing’ নামে চিহ্নিত হয়ে আছে।