উত্তমকুমার চট্টোপাধ্যায়
হারিয়ে যাওয়া দিনগুলি মোর
দুই
আত্মজীবনী লিখতে যাওয়া ভারী বিপদ। অনেক কথা ভিড় করে আসে মাথায়। সেগুলোকে বেছে বেছে, একের পর এক, পাঠকের সামনে উপস্থিত করতে হবে। তার মধ্যে কাহিনিকারকে আগে ভেবে নিতে হয়, কোনটা আগে কোনটা পরে। যেন না কখনও মিথ্যের আশ্রয় নিতে হয়। এই বাছাবাছির মধ্যে সবচেয়ে কঠিন নিজের শৈশবের কথা লেখা।
ছেলেবয়েস থেকে কোনও ডায়ারিও লিখে রাখিনি যা থেকে আজ এই কাহিনি লিখতে সাহায্য পাব।
নিজের স্মৃতি ঘেঁটে তাই আমার শৈশবের এক একটা ঘটনা আজ খুঁজে বার করতে হচ্ছে—আপনাদের কাছে নিবেদন করব বলে।
যাক, যা বলছিলাম।
আমি শুনেছি, আমি নাকি আহিরীটোলায় আমার মামার বাড়িতে ৩ সেপ্টেম্বর জন্মেছিলাম। আমার বাবার১ বাড়ি কিন্তু ভবানীপুর অঞ্চলে গিরিশ মুখার্জি রোডে। বাবার বাড়ি বলছি বলে একথা কেউ মনে করবেন না, সেই বাড়িতে কেবল আমার বাবাই থাকতেন। সেটা ছিল, ও অঞ্চলের চট্টোপাধ্যায় পরিবারের যৌথ সংসার।
মা’র মুখ থেকে গল্প শুনেছি, আমার মা২ যখন বধূবেশে এ বাড়িতে আসেন, তখন তাঁর অত্যন্ত অল্প বয়স। চট্টোপাধ্যায় পরিবারের তখন উঠতি সময় নয়। ভাঙন শুরু হয়েছে। বন্যার টানে ভেসে যাচ্ছেন অনেকেই। অর্থের অভাব সংসারে দেখা দিয়েছে।
আমার মা’কেও তাই গৃহের কাজে খাটতে হত উদয়াস্ত। লোকজন রাখবার সামর্থ্য আমার বাবার তখন ছিল না। নিশ্বাস ফেলবার সময়ও তাঁর ছিল না। রান্নাবান্না; এককথায় গৃহস্থালীর যাবতীয় কাজ, তিনি নিজে হাতেই করতেন। আর আমার বাবা? সকাল থেকে ঘুরতেন, অর্থের চিন্তায়। কী যে তিনি করতেন তা অবশ্য খবর রাখার বয়স তখন আমার হয়নি। অদ্ভুত ছিলেন এই মানুষটি। সংসারে কারোর ওপর কোনও দাবি রাখতেন না। সকলকে দিতেই তিনি যেন এসেছিলেন। দিয়েই তিনি চলে গেলেন।
আমি তাঁর বড়ো ছেলে হয়েও তাঁর দুঃখের লাঘব এতটুকু করতে পারলাম না।
মেট্রো কোম্পানি কলকাতায় বায়োস্কোপ৩ খোলার সঙ্গে সঙ্গে তিনি সেখানে যোগদান করেছিলেন ‘চীফ অপারেটর’ হিসাবে। তাই বেশিরভাগ দিনই তিনি বাড়ি আসতেন আমরা যখন ঘুমিয়ে পড়তাম। আমাদের সঙ্গে সম্বন্ধ ছিল তাঁর কম।
কিন্তু একটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ করেছি। আমরা কী করছি, তা তাঁর থাকত নখদর্পণে।
সাধারণ বাপ মা’র মতন আমাদের গায়ে তিনি কখনও হাত তোলেননি।
চেঁচামেচি করে বাড়িতে যে বকাবকি করেছেন, এমন কথাও মনে পড়ে না। কিন্তু ওই মানুষটিকে আমরা চিরদিন ভয় পেয়েছি। শুধু ভয় নয়, সত্যিকারের ভালোবেসেছিলাম। সে ভালোবাসা যে কতখানি, তা আজ মর্মে মর্মে অনুভব করছি—তাঁকে হারিয়ে।
তিনমাস আগে আমাদের ছেড়ে যখন তিনি চলে গেলেন, তখন মনে হয়েছিল আমি এ সংসারে যা হারালাম তা বুঝি কোনোদিন পূর্ণ হবে না।
শ্মশানঘাটে চিতার ধোঁয়ার দিকে চেয়ে খালি ভেবেছি—উপযুক্ত পুত্র হয়েও আমি করতে পারলাম না কিছুই আপনার। কেবল দু’হাত পুরে আমি নিয়েই গেলাম। বিনিময়ে দিলাম কী?
আমার উন্নতি, প্রতিষ্ঠা; আজ সংসারে যা কিছু পেয়েছি তা আপনারই দয়ায়।
এই সমস্ত কথা ভাবতে ভাবতে, তাঁর শেষ কাজ করে ফিরে এলাম আমাদের পুরোনো বাড়িতে।
মা’র দিকে চেয়ে দেখি, তাঁর অঙ্গে উঠেছে তখন বিধবার সাজ। কোথায় গেল তাঁর লালপাড় শাড়ি, কোথায় গেল বা তাঁর সিঁথির সিঁদুর!
ঘর থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যাচ্ছিলাম। মা ডাকলেন, ‘খোকা শোন।’
এতক্ষণ ধৈর্য ধরে ছিলাম, কিন্তু এ স্নেহস্পর্শে আমার সব ধৈর্যের বাঁধন যেন টুটে গেল। স্বার্থপরের মতো একবারও সেদিন চিন্তা করতে পারিনি যে এই দুঃখ মায়ের বুকেও কম ব্যথা দেয়নি। তবুও তিনি, আমাদের মুখ চেয়ে নিজেকে প্রাণপণে শক্ত করে রেখেছেন।
মা’র কাছে গিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাম। বললাম—‘মা, কী হবে? আমি তো কিছুই ভাবতে পারছি না।’
অভয়দায়িনীর মতো আমাকে অভয় দিয়ে তিনি বললেন—‘ভয় কী! আমি তো আছি। আর রয়েছে তাঁর আশীর্বাদ।’
আমি বললাম—‘বাবার তো কিছুই আমি করতে পারলাম না। জীবনের শেষদিন অবধি তিনি কাজই করে গেলেন। বিশ্রাম যে কী জিনিস তা তো তিনি জানলেন না। এমন কি এই বাড়ি থেকে আমার নতুন বাড়িতে উঠে যেতে তোমাদের বললাম, তাও তোমরা যেতে রাজি হলে না। তোমাদের সেবা করবার সুযোগ আমাকে দিলে না, কেবল অপরাধীই করে রাখলে।’
আমাকে দু’হাত দিয়ে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে মা বললেন — ‘দুঃখ পাসনে বাবা, জীবনে কখনও তিনি কারুর কাছ থেকে আশা করতেন না। তাই অসুস্থতা সত্ত্বেও শেষ দিন অবধি তিনি কাজ করে গেলেন। তাই বলে মনে ভাবিস না—তিনি তোদের ভালোবাসতেন না। কতখানি যে তোদের ভালোবাসতেন তিনি, তা কেবল জানি আমি। তোদের ভার সমস্ত আমার ওপর দিয়ে তিনি আজ চলে গেলেন।’
কথাগুলো বলতে বলতে তাঁরও দু’চোখ বেয়ে অশ্রুধারা নেমে এলো আমার মাথার ওপর।
শ্রাদ্ধশান্তি চুকে যাবার পর মাকে নিয়ে আসতে চেয়েছিলাম আমার নতুন বাড়িতে। কিন্তু মা বললেন—তাঁর শ্বশুর আর স্বামীর ভিটে ছেড়ে কোথাও তিনি থাকতে পারবেন না। কারণ তাহলে ভিটেতে প্রদীপ দেবে কে?
তাই আমি ভাবছি আমার নতুন বাড়ি ছেড়ে দিয়ে চলে যাব আমার মায়েরই কাছে। জীবনের বাকি ক’টা দিন তাঁরই সেবায় জীবন উৎসর্গ করব। কারণ বিবেক আমাকে নিয়ত দংশন করছে যে আমার বাবার আমি কিছুই করতে পারিনি।
সূত্রনির্দেশ ও টীকা
- উত্তমকুমারের বাবা সাতকড়ি চট্টোপাধ্যায়। মেট্রো সিনেমাহলের চীফ অপারেটর ছিলেন। সংসারের হাল ধরে মধ্যবিত্ত পরিবারটিকে দাঁড় করানোর ব্যাপারে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। ছেলে উত্তমের, ছবিতে অভিনয়ের বিষয়ে আপত্তি তো করেনই নি, উপরন্তু এক বন্ধু মারফত উত্তমকে ছবিতে সুযোগের ক্ষেত্রেও সাহায্য করেছিলেন।
- উত্তমকুমারের মা চপলা দেবী। প্রধান অনুপ্রেরণাদাত্রী হিসেবে ছেলে উত্তমের জীবনে সবসময় ছিলেন। উত্তমকুমারেরও প্রধান ভরসাস্থল ছিলেন তাঁর মা। অত্যন্ত দূর্ভাগ্যজনকভাবে, প্রিয় পুত্রের প্রয়াণের সময় জীবিত ছিলেন চপলা দেবী।
- চলচ্চিচত্রের আদি যুগে যে পদ্ধতিতে ছবি দেখানো হত, তাকে ‘বায়োস্কোপ’ বলা হয়। একইসঙ্গে এই চলচ্চিচত্র দেখানোর গৃহটিকেও বলা হত ‘বায়োস্কোপ’। আগেকার দিনের মানুষরা অনেকদিন পর্যন্ত সিনেমাকে ‘বায়োস্কোপ’ বলতেন।