উত্তমকুমার চট্টোপাধ্যায়

হারিয়ে যাওয়া দিনগুলি মোর

আঠার

সানাই তো বাজল। ভৈরবীর সুরে তানের সঙ্গে সানাই সুরের জাল বুনে চলল। ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে আমার মনেও তা শুনে দোলা লাগল।

যাকে পাবার জন্যে এতদিন করেছি প্রতীক্ষা, তাকেই আজ পেতে চলেছি। কিন্তু মন তো বিশ্বাস করে না!

বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আত্মীয় কুটুম এসে বাড়ি ভরিয়ে তুললেন। আমি এদিক ওদিক ঘুরছি। সকলকার লক্ষই আমার ওপর। আমি বর, অর্থাৎ hero of the day.

আজ স্বীকার করছি, জীবনে অনেকবার হিরো সেজেছি, মঞ্চে, পর্দায় কিছুতেই বাদ যায়নি, কিন্তু এমন হিরো আমি কখনও সাজিনি।

প্রেক্ষাগৃহে নায়ক সেজে দর্শকের সামনে বারবার হাততালি পেয়েছি। পর্দার ওপরে আমার ছবি দেখে, অনেকে আমার উদ্দেশে হাততালি দিয়েছেন। অসংখ্য চিঠি আর অভিনন্দনও পেয়েছি আপনাদের কাছ থেকে। কিন্তু সেদিনকার নায়ক হবার অনুভূতি আর ফিরে আসেনি আমার জীবনে।

যিনিই আসেন আমাদের বাড়িতে, তিনিই খুঁজতে থাকেন আমাকে। সকলকার মুখেই সেই একই কথা— ‘কোথায় গেল অরুণ?’

প্রথমটা ভয় ভয় করলেও, তা কাটতেও দেরি হল না। গাত্রহরিদ্রা আর নান্দীমুখের পালা চুকতেই বেলা গড়িয়ে দুপুর হল। দারুণ খিদে পেয়েছিল। মা’র কাছে গিয়ে বললাম— ‘কিছু খেতে দাও মা?’

মা কিছু বলবার আগেই আমার এক বৌদি বলে উঠলেন— ‘ওমা, খাবে কি গো ঠাকুরপো! সন্ধের পর বৌয়ের চাঁদমুখ দেখলেই পেট ভরে যাবে! এখন থেকে খেলে পরে অম্বল হতে পারে।’

রসিকতা করবার সুযোগ আমিও ছাড়ি না, বলি— ‘তোমার মুখখানা দেখে দাদার কি পেট ভরে গিয়েছিল? না অম্বল হয়েছিল?’

বৌদি বলেন— ‘আমার মুখখানা তো আর চাঁদের মতন নয়! আর গৌরীর মতন আমি তো আর না খেয়ে তপস্যা করিনি শিবকে পাবার জন্যে, যে আমার মুখ দেখে তোমার দাদার পেট ভরবে।’

কথা বাড়ালেই বাড়ে, অথচ আসল কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না দেখে মাকে বলি— ‘মা, আজ কি কিছু খেতে দেবে না?’

মা বলেন— ‘খোকা, আজ যে খেতে নেই বাবা! আর কয়েক ঘণ্টা পরে বিয়ে হয়ে গেলে একেবারে খাবি।’

সন্ধেবেলায় জাঁতি হাতে বেনারসি জোড় পরে মাথায় টোপর দিয়ে চললাম গৌরীদের বাড়ির উদ্দেশে।

সোজা রাস্তায় গেলে ওঁদের বাড়ি আমাদের বাড়ি থেকে বেশি দূর নয়। সোজা পথে কেউ যেতে রাজি হল না। ভবানীপুরের এ রাস্তা সে রাস্তা ঘুরে রাত সাড়ে সাতটা-আটটা নাগাদ আমরা পৌঁছোলাম ওদের বাড়িতে। জোড়া শাঁখ, সানাই আর উলুধ্বনিতে ওঁরা আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন।

একটু আড়ষ্ট হয়েই আসরের মাঝখানে বসলাম। কিছুক্ষণ বসবার পর, বাবা, জেঠামশায়ের অনুমতি নিয়ে ওঁরা আমায় নিয়ে গেলেন ভেতরে। দেখলাম সেখানে গৌরীকেও আনা হয়েছে। লাল বেনারসি পরে, কপালে চন্দন দিয়ে ওকে যেন আরও সুন্দর দেখাচ্ছে। হাঁ করে চেয়েছিলাম সেদিকে। তখন ভেবেছিলাম আজ থেকে গৌরীর দিকে চাইতে আর কোনো বাধা নেই।

কিন্তু আমি ভুলে গিয়েছিলাম, সেটা বিবাহ আসর। পরমুহূর্তেই এমন একটা ঘটনা ঘটল যাতে বড়ো মর্মান্তিকভাবে আমাকে মনে করিয়ে দিল বাস্তবের কথা।

গৌরীর ঠাকুমা সকলকার সামনেই আমার ডান কানটা মলে দিয়ে বললেন— ‘ওহে ছোকরা, ওদিকে অত কী দেখছ? এদিকে, আমাদের দিকে একটু চাও। গৌরী তো ও মুখ দেখবেই। আমরা একটু দেখে নিই, এই ফাঁকে!’

আমি বলি— ‘ফিল্মে এই মুখ তো দেখেছেনই। তাছাড়া আমার মুখ কি আপনাদের ভালো লাগবে?’

তিনি বলেন— ‘ফিল্মে দেখেছি বলেই তো চাক্ষুষ দেখবার ইচ্ছে এই মুখখানা। নাতনি আমার হিরে চেনে। খুঁজে খুঁজে বারও করেছে দেখো! কী মিষ্টি দাদার মুখখানা আমার! শুধু গৌরী কেন, বুড়ো বয়সে আমারই ভুলতে ইচ্ছে করছে। মনে হচ্ছে দিদি খাবার আগে আমিই সবটুকু চুষে খাই। কেমন গো দাদা, রাজি?’

কথা শেষ করে ফোকলা মুখে বুড়ির সে কী হাসি!

একে একে বিয়ের সব পর্ব মিটে গেল। ফুলশয্যার রাত্রে গৌরী আর আমার দেখা হল এক নিভৃত ঘরে। সে আর এক অনুভূতি! লিখে বোঝাবার নয়। বোধ হয় চোখে দেখলেও বোঝা যায় না। এ অনুভূতি বুঝতে গেলে চাই মন।

গৌরী প্রথমটা আমার সঙ্গে কথা বলেনি। হাত ধরে তাকে কাছে বসিয়ে আমি প্রশ্ন করি— ‘আমরা তোমাদের মতো বড়োলোক নই। তোমার কষ্ট হবে না এ বাড়িতে?’

আমার বুকের ওপর মুখখানা রেখে গৌরী বলে— ‘তোমার বলছ কাকে? আমি কি তুমি ছাড়া? বড়োলোক বলে আমাকে কেন দূরে ঠেলে দিচ্ছ?’

বেশ খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম গৌরীর কথায়। সত্যিই তো, ও তো আর পর নয়! ও যে আমাদেরই একজন।

নিজের বোকামিতে কথাটা বলে ফেলেছিলাম। তাই তাড়াতাড়ি কথাটা ঘুরিয়ে নিয়ে বলি— ‘আচ্ছা গৌরী, এখন তো ফিল্মে চান্স পাচ্ছি, দু একটা ছবিতে কাজও করছি। এমন দিন যদি আসে যে অফিসের কাজ ছেড়ে দিয়ে খালি ফিল্মের কাজ আমায় করতে হয়? তাহলে তুমি রাগ করবে না?’

— ‘আমি রাগ করব? কেন?’

— ‘অন্য মেয়েদের সঙ্গে আমাকে অনবরত অভিনয় করতে হবে বলে।’

গৌরী আমার কাছে সরে এসে বললো— ‘আমায় বলো তুমি আমায় কোনোদিন ভুলে যাবে না!’

— ‘না, জীবন থাকতে তোমায় ভুলতে পারব না।’

গৌরী বলে— ‘তাহলে জেনে রাখো, কারোর সাধ্য নেই তোমাকে আমার বুক থেকে ছিনিয়ে নেয়। কারণ আমি যে তোমায় ভালোবাসায় বেঁধে ফেলেছি! সে বাঁধন কাটিয়ে তুমি যাও, অতখানি শক্তি তোমার নেই। তুমি এগিয়ে যাও তোমার ইচ্ছেমতো। করো তোমার যা খুশি। তাতে আমি ভয় পাই না।’

শেষের কথাগুলো বলতে বলতে ওর চোখের চাহনি কেমন যেন তীব্র হয়ে গেল। সে দীপ্ত চোখের সামনে আমিও চাইতে পারলাম না, চোখ ঘুরিয়ে নিলাম। জবাব আর দিতে পারলাম না। দু হাত দিয়ে ওকে টেনে নিলাম নিজের বুকে।

ফিল্ম থেকে কিছু টাকা পেয়ে, (অবশ্য তখনও আমি ‘ফ্লপ-মাস্টার জেনারেল’, অর্থাৎ আমি নামলেই ছবি চলে না।) কিনলাম একটা হিন্দুস্তান গাড়ি। প্রথম প্রথম নিজেই সেটা চালাতাম। নতুন গাড়িখানা নিয়ে গিয়েছিলাম একদিন গৌরীদের বাড়ি। নাতজামাই গাড়ি কিনেছে শুনে, ভেবেছিলাম গৌরীর দাদু সুখী হবেন। নাতনিকে গাড়ি চড়িয়ে নিয়ে বেড়াই বলে, আমাকে একটা বাহবা দেবেন। সেই বাহবা পাবার আশায় বলে ফেললাম— ‘দাদু, একটা গাড়ি কিনেছি। চলুন আপনাকে খানিকটা ঘুরিয়ে আনি।’

বৃদ্ধ অমনি ঝংকার মেরে বললেন— ‘হেঃ, গাড়ি কিনে টাকাটা নষ্ট করলে তো! বলি সেটাকে জমিয়ে জমি কেনো না। ভবিষ্যতে কাজে লাগবে।’

আমার উৎসাহ কোথায় উবে গেল। বলি— ‘তা দাদু, মানে আমার একটু দরকার কিনা গাড়ির! তাই এটা কিনলাম।’

বৃদ্ধ মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে বললেন— ‘কিনেছ বেশ করেছ, বাজে খরচ আর না করে, এইবার জমানোর দিকে মন দাও। ভবিষ্যতে ছেলেমেয়ে হলে তখন সামলাবে কী করে?’

বৃদ্ধের উপদেশের মূল্য সেদিন বুঝতে পারিনি, আজ বুঝতে পেরেছি মর্মে মর্মে।