উত্তমকুমার চট্টোপাধ্যায়
হারিয়ে যাওয়া দিনগুলি মোর
একুশ
তুলসীদার সম্বন্ধে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেছি। তাঁর অভিনয়ে বহুমুখী প্রতিভার সম্বন্ধে দু’একটা কথা বলা দরকার মনে করছি।
বহুদিন আগে, খুব সম্ভব সেটা ১৯৪৪ সাল, রঙমহলে হয়েছিল ‘রামের সুমতি’।
শরৎচন্দ্রের এই ‘রামের সুমতি’-তে তুলসীদা অভিনয় করেছিলেন ‘ভোলা’-র চরিত্রে।
আপনারা সকলেই জানেন ‘ভোলা’ কিশোর। তুলসীদা তখন ৪০ পার হয়ে গেছেন। দর্শকের সামনে তিনি কেমন করে অভিনয় করবেন? অবশ্য তখন তাঁকে দেখেছিলাম কেবল দর্শকের আসনে বসে। প্রাণের চঞ্চলতা দিয়ে তিনি এমন নিখুঁত করে চরিত্রের রূপদান করেছিলেন, যেকোনো দর্শকের চোখেই তা খারাপ বলে বোধ হয়নি। তার কারণ তিনি ছিলেন প্রকৃত অভিনেতা। শুধু তাই নয়, তিনি ভালো গানও গাইতে পারতেন। এছাড়া প্রয়োজন হলে, নেচেও লোককে আনন্দ দিতেন। এর ভেতরে আমরা জানি, তিনি ভালো তবলা বাজাতে পারতেন। কোনো কিছুতেই তাঁকে পেছপা হতে দেখিনি।
আমাকে তিনি বলেছিলেন— ‘যদি ভালো অভিনেতা হতে চাও, তাহলে, কেবল অ্যাকটিং করলেই হবেনা, তার সঙ্গে গান শেখো।’
গানটাও অবশ্য ছেলেবয়স থেকেই আমার ভালো লাগত। শেখবার চেষ্টাও আমি করেছিলাম। কিন্তু, ইদানীং বিশেষ আর চর্চা ছিল না। তিনি বললেন— ‘অমন করে হবে না। নিয়ম করে লেগে যাও। ঘুম থেকে উঠে অন্তত এক ঘণ্টা গলা সাধো হে! তাহলেই দেখবে একদিন তুমি বেশ ভালো গান শিখেছ।’
একরকম তাঁরই কথায় নতুন উৎসাহে গানের চর্চা শুরু করলাম। আর একটা কথা তিনি বলেছিলেন—এটা তখন বুঝিনি, আজ বুঝছি। সেটা হল আর কিছুই নয়। গান গাইলে মনের সমস্ত অবসাদ কেটে যায়। নতুন করে আবার মনে আসে আনন্দ। বোধহয় তুলসীদা সেইজন্যেই ছিলেন অতখানি হাস্যমুখর।
যাক সেকথা। কথায় কথায় এসে পড়েছি কাহিনির শেষ দিকে। এবারে বলি আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পের দু’একটা কথা। আমাদের এখানে ছবি তোলা হয়। ল্যাবরেটরির দোষেই তা অনেকসময় খারাপ হয়ে যায়। কথাটা বোধহয় আরেকটু বুঝিয়ে বললে ভালো হয়।
ক্যামেরাম্যান ছবি তুললেন সেলুলয়েডের ওপর। শব্দযন্ত্রী শব্দ রেকর্ড করলেন সেই সেলুলয়েডের ওপর। এখন এই নেগেটিভকে ভালো করে রাসায়নিক পদ্ধতিতে ধুয়ে শুকিয়ে নিয়ে তাকে নতুন করে প্রিণ্ট করতে হয় পজিটিভ ফিল্মে। এখন আপনার সুবিধে মতো যত কপি ইচ্ছে তত কপি আপনি নেগেটিভ থেকে প্রিণ্ট করে নিতে পারেন। এই সমস্ত প্রক্রিয়াই ঘটে থাকে ল্যাবরেটরিতে। ধরুন আপনি অনেক কষ্ট করে মুখের বিভিন্ন অভিব্যক্তি করেছেন ছবিতে। কিন্তু, ল্যাবরেটরির দোষে আপনার মুখের সে ভাব পর্দায় প্রতিফলিত হল না। কিংবা ধরুন, আপনার গলার আওয়াজ ছবি দেখবার সময় হয়েছে খ্যানখেনে কিংবা অস্পষ্ট। আপনারা ছবি দেখবার সময় অনেকবার লক্ষ্য করেছেন সময় সময় কথা কী রকম অস্পষ্ট হয়। অবশ্য এর দ্বারা আমি এই মানে করছি না যে সবসময়ই এর কারণ ল্যাবরেটরি। অনেকসময় প্রেক্ষাগৃহের যন্ত্রে গোলমাল থাকলেও এমনটি হতে পারে। তবে ল্যাবরেটরির পদ্ধতি আজকাল বৈজ্ঞানিক যুগে দিন দিন বদলে যাচ্ছে। সেইজন্যেই আমার মনে হয় ল্যাবরেটরির কর্মীদেরও সে সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল থাকা দরকার। কিন্তু, তেমন কর্মী কোথায় যিনি এ কাজে নিজেকে সম্পূর্ণ উৎসর্গ করবেন? আমার বন্ধু শ্রীতাপস মজুমদার তেমন কাজে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। ১৯৫৭ সালে আমি নায়ক হিসেবে আপনাদের কাছ থেকে স্বীকৃতি পেয়েছি। অনেকেই আসছেন আমার কাছে তাঁদের ছবিতে নায়কের ভূমিকায় অনুরোধ নিয়ে। তাঁদের চুক্তিপত্রে সই করবার জন্যে। কিন্তু, কার, চুক্তিপত্রে কী আছে, কোন কথার আইনঘটিত কী অর্থ হতে পারে, এইসমস্ত দেখতেই আমার অনেকখানি সময় নষ্ট হত। তার ফলে, আমার শিল্পীজীবনের অনেকখানি ক্ষতি হচ্ছিল। আমি শিল্পী, শিল্প দিয়ে কী করে আপনাদের আনন্দ দিতে পারি, তাই আমার লক্ষ্য হওয়া উচিৎ। কিন্তু, আমার হয়ে এ সমস্ত কাজ কে করে দেবে? একদিন হঠাৎ সকালবেলায় এলেন এক ভদ্রলোক আমার সঙ্গে দেখা করতে। তাঁকে দেখেই যেন মনে হল, কত আপনার। আমার বহুদিনের পরিচিত। এ যে কেবল আমার জীবনেই ঘটে তা নয়, আপনাদের জীবনেও দেখবেন, হঠাৎ কোনো বিশেষ ভদ্রলোককে দেখে আপনাদের মনে হবে, তিনি যেন আপনাদের কত পরিচিত। তাপসবাবুকে দেখেও ঠিক আমার তেমনি মনে হয়েছিল। কিন্তু, প্রথম দর্শনেই সেকথা তো বলা যায় না। নমস্কার বিনিময়ের পর তাপসবাবু আমাকে বললেন— ‘আধুনিক বিজ্ঞানসম্মতভাবে একটা ল্যাবরেটরি তিনি করতে চান। আমিও রাজি হয়ে গেলাম তাঁর কথায় এবং যুক্ত হলাম ইণ্ডিয়ান ফিল্ম ল্যাবরেটরির সঙ্গে।
তাপসবাবুর সঙ্গে সেই হল আমার বন্ধুত্বের শুরু। তিনি কাজের লোক দেখে, তাঁকে একদিন সব কথা খুলে বললাম। তিনি রাজি হয়ে গেলেন আমার কাজের ভার নিতে। এইরকমভাবে ধীরে ধীরে গড়ে উঠল তাঁর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব।
বাবা তখন মারা গেছেন। স্টুডিওতে যাই আর আসি। কিছু ভালোও লাগে না। প্রিয়জনকে হারানোর ব্যথা মানুষকে যে এমনভাবে অভিভূত করে, তা আমার জানা ছিল না। কাজের মধ্যে যখন থাকি, তখন একরকমভাবে কাটে। কিন্তু, বাড়িতে যখন থাকি, তখন কাটে অন্যভাবে। বুকের মধ্যে যেন সদাসর্বদা হু হু করে। রবিবাবুর ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয়—
‘কার যেন এই মনের বেদন, কার? চৈত্র মাসের উতল হাওয়ায়?’ মন যেন কিছুতেই ভরতে চায় না। এমনসময় একদিন তাপসবাবু এসে, বললেন— ‘আপনাকে নিজের কথা লিখতে হবে।’
আমি চমকে উঠলাম— ‘বলেন কী! অন্য লোকের লেখা সংলাপ চিরদিন ক্যামেরার সামনে আবৃত্তি করে আসি। স্টেজে যখন অভিনয় করি, তখনও অন্য লোকের সংলাপই আমার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে। আমি লিখলে পাঠকরা নেবে কেন?’ তিনি বললেন— ‘দীর্ঘদিন অভিনয় করার দরুন দর্শকরা আপনাকে জানতে চায়। তার কারণ, পর্দার অন্তরালে যে মানুষ বাস করে, তার স্বরূপ জেনে তারা আনন্দ পাবে, এইজন্যেই আপনার লেখা দরকার।’
গৌরী সেখানেই বসেছিল। সে বললো— ‘লেখো না কেন, মজুমদারদা যখন বলছেন।’
তখনকার মতো কথাটা চাপা পড়ে গেল। তার পরেরদিন এসে তাপসবাবু আবার আমাকে তাগাদা করেন। সেইদিন রাত্রে বসলাম কাগজ কলম নিয়ে। কিন্তু, একদিনেই তো লেখা যায় না। তাপসবাবুকে বলি— ‘আমি লিখব, কিন্তু বেশ বড়ো হয়ে যাচ্ছে যে! তিনি বলেন, ‘ক্ষতি কী, ধারাবাহিকভাবে বেরোবে।’ ইতিপূর্বে ধীরাজবাবু আর অহীন্দ্রবাবুর আত্মকথা১ বেরিয়েছে। ধীরাজবাবু দীর্ঘদিন ধরে বাংলা ছবির নায়ক ছিলেন। নির্বাক যুগ থেকেই তিনি নায়কের ভূমিকা পেয়েছিলেন, এবং তাতে অধিষ্ঠিতও ছিলেন অনেকদিন ধরে। ভরসা পেলাম তাপসবাবুর কথায়। লিখতে শুরু করলাম। তিনিই নিয়ম করে প্রতি মাসের প্রথম দিকে আমায় তাগাদা দিতে শুরু করেন এবং তাঁর অনুপস্থিতিতে তাগাদা দেয় গৌরী।
সকালবেলায় গলা সেধে ওঠবার পরই, হাতের কাছে কাগজ কলম এগিয়ে দিয়ে গৌরী বলে— ‘লেখো’। লিখতে আরম্ভ করি।
দীর্ঘ দুটো বছর ধরে, আমার জীবনের বহু ঘটনা আপনাদের কাছে উপস্থাপিত করেছি। বহু চিঠিও আপনাদের কাছ থেকে পেয়েছি। তাতে উৎসাহও পেয়েছি প্রচুর। আর, আমাকে এ কাজে উৎসাহ দিয়েছেন, আমার স্নেহময়ী জননী। যেদিন প্রথম লেখা বেরোলো, সেদিন লেখাটা মার কাছে নিয়ে গিয়ে বলেছিলাম, ‘মা, এই দ্যাখো, কেমন লিখেছি বলো তো?’ ভেবেছিলাম মা বলবেন— ‘কিছুই হয়নি।’ কিন্তু, মা বললেন— ‘বেশ হয়েছে। তুই লিখে যা। ভালোই হবে।’
তাঁর কাছ থেকে সেদিন আশার বাণী শুনে উৎসাহিত হয়েছিলাম, যেমন উৎসাহিত হতাম, প্রথম দিকে ছবি করার পর মা দেখে এসে যখন বলতেন— ‘খোকা, ভালোই হয়েছে। আরও, ছবি করবার চেষ্টা কর…’
সূত্রনির্দেশ ও টীকা
- পাঁচের দশকে প্রথম জীবনে পুলিশ ও পরে অভিনয়—এই দুটি ভিন্নধর্মী জীবনের স্মৃতিকথা যথাক্রমে, ‘যখন পুলিশ ছিলাম’ ও ‘যখন নায়ক ছিলাম’ এই শিরোনামে ধারাবাহিকভাবে লিখেছিলেন প্রখ্যাত অভিনেতা ধীরাজ ভট্টাচার্য। যা প্রকাশিত হতো ‘দেশ’ পত্রিকায়’। পরে, দুটি রচনাই পৃথকভাবে পুস্তকাকারে প্রকাশ পায়। পরবর্তীকালে, এর নতুন সংস্করণও প্রকাশিত হয়। একইভাবে, ‘নটসূর্য’ অহীন্দ্র চৌধুরি তাঁর আত্মজীবনী লিখেছিলেন। ‘নিজেরে হারায়ে খুঁজি’ শিরোনামে ধারাবাহিকভাবে, এই রচনাটি প্রকাশিত হত, ‘অমৃত’ পত্রিকায়। পরে, দু’খণ্ড বই আকারেপ্রকাশ পায়। বিশাল আকারের এই আত্মজীবনীটিকে একটি সময়ের দলিল বলা যায়। বর্তমানে, এটি পুনর্মুদ্রিত হয়েছে।