উত্তমকুমার চট্টোপাধ্যায়

হারিয়ে যাওয়া দিনগুলি মোর

এক

দ্বিজেন্দ্রলালের দিলদার এক জায়গায় বলেছেন— “আমি পারিষদ, দার্শনিকের পদে এখনও উন্নীত হইনি। তবে ঘাস খেতে খেতে মুখ তুলে চাওয়ার নাম যদি দর্শন হয় তাহলে আমি দার্শনিক।”

ঠিক তেমনি, আমিও অভিনেতা। অভিনয়ই আমার জীবন। সাহিত্যিক আমি নই।

তবুও আমাকে অনুরোধ করেছেন লেখবার জন্য।

প্রথমটা ভেবেছিলাম লিখব না। শেষকালে কলম ধরতে বাধ্য হলাম এই ভেবে যে আমারও আপনাদের কাছে কিছু বলবার আছে। সেই না-বলা বাণীকেই আজ আমি ভাষায় রূপ দিতে চলেছি।

কারণ ইলেকট্রিকের আলোর সাহায্যে রুপালি পর্দার ওপর আমার ছবি দেখে অনেকেই আমার সম্বন্ধে বিভ্রান্তিকর ধারণা করতে শুরু করেছেন। আর সেই ভ্রান্তি আমাকে নিয়ে যাচ্ছে পৃথিবী থেকে তুলে আর এক কল্পলোকে—যেখানকার অধিবাসী আমি নই, হবার যোগ্যতাও রাখি না।

যেমন, আমার বাড়ি নাকি বিরাট একটা বাগানের মাঝখানে। রাত্তিরবেলা সেইখানে নাকি আলো জ্বলে। ঘণ্টায় ঘণ্টায় রংও তার বদলায়। সুইজারল্যান্ড থেকে নাকি আমার জন্যে এসেছে স্পেশাল একধরনের দম দেওয়া পাখি, যাতে দম দিয়ে দিলে সুন্দর গান ভেসে আসে। আর সেই গান শুনতে শুনতে আমি নাকি রাত্তিরে ঘুমোই। Studio থেকে ফেরার সময় একটা ঝোলানো electric hanging bridge-এর সাহায্যে আমার গাড়ি নাকি উঠে যায় বাড়ির তেতলার ছাদে। আমি যেন কোনো রূপকথার রাজপুত্র।

তবে এখন প্রশ্ন হতে পারে এ সব কাহিনি রটল কী করে? আমার যতদূর বিশ্বাস এসব কাহিনি রটেছে—কারণ দীর্ঘদিন দর্শকরা আমাকে পর্দার ওপরে দেখেছেন নায়কের ভূমিকায়। সিনেমার নায়ক অধিকাংশ সময় বড়োঘরের ছেলে কিংবা গরীবের ছেলে হলেও একটা বড়োলোক আত্মীয় বা বড়োলোক নায়িকা তার থাকেই। কিন্তু এ ধরনের গল্প আমার সম্বন্ধে যাঁরা রটান তাঁরা ভুলে যান, পর্দার গায়ে আমাকে যার বেশে দেখছেন তার সঙ্গে বাস্তব ক্ষেত্রে আমার সম্বন্ধ একেবারেই নেই। আমি নায়ক। যেমন বড়োলোক সাজি, তেমনি গরীব চাকরও মাঝে মাঝে সাজতে হয়। সবচেয়ে মজার কথা এই যে, অনেকে ভাবেন গরীবের চরিত্রে অভিনয় করাটাই আমার সত্যিকারের অভিনয়, আর শেষেরটা আমার জীবন।

কিন্তু আপনারা বিশ্বাস করুন রূপকথার রাজপুত্তুর আমি নই। আপনাদেরই মতো সাধারণ রক্তমাংসে গড়া মানুষ। শোকে দুঃখে আমারও জীবন আপনাদেরই মতন গড়ে উঠেছে—আর সেই কথা বলবার জন্যে আপনাদের দরবারে হাজির হয়েছি।

হাজির হয়েছি এই জন্যে যে, আমি ভালোবেসেছি আপনাদের। আপনাদের আনন্দ দিয়ে সেবা করতে চেয়েছিলাম আমার মনপ্রাণ ঢেলে। জানিনা সে কাজে আমি কতদূর সফলতা লাভ করেছি। তবে আমার এই কাজের বিনিময়ে আমি পেয়েছি আপনাদের শুভেচ্ছা আর আশীর্বাদ—যা আমার জীবনের যাত্রাপথে ধ্রুবতারা হয়ে অন্ধকার রাত্রে পথনির্দেশ করবে।

ছেলেবয়সে একদিন স্বামী বিবেকানন্দের কথা পড়তে পড়তে একটা ঘটনা আমাকে স্তম্ভিত করে দিয়ে যায়। তখন তার মানে ভালো করে বুঝতে পারিনি। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার অর্থ কিছু উপলব্ধি করতে পারি।

ঘটনাটা এইরকম।

স্বামী বিবেকানন্দ একদিন গিয়েছিলেন এ যুগের অবতার ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে দক্ষিণেশ্বরে দেখতে।

ফিরে আসছেন তিনি সেখান থেকে। সঙ্গে হরি মহারাজ বা তুরীয়ানন্দ।

স্বামীজি প্রশ্ন করলেন—‘কেমন দেখলে ঠাকুরকে?’

উত্তরে তুরীয়ানন্দ অনেক কথাই বললেন। অবশেষে প্রশ্ন করলেন—‘তুমি কেমন দেখলে তাঁকে?’

পথ চলতে চলতে গম্ভীর কণ্ঠে স্বামীজী উত্তরে বললেন–‘L–o–v–e, personified.’

পরে বুঝেছি ঘনীভূত ভালোবাসাই ভগবানের প্রকৃত রূপ এবং তাঁকে পেতে গেলে বা তাঁর কাজ করতে গেলে মানুষের অন্তরেও চাই ভালোবাসা। সুতরাং সেইদিন থেকে এই সহজ পথই বেছে নিলাম নিজের আদর্শরূপে। ভালোবাসলাম নিজের বাবা, মা, আত্মীয়স্বজনকে। ভালোবাসলাম পাড়ার ছেলেদের। ভালোবাসলাম আপনাদের।

কাজের ফাঁকে ফাঁকে অনেক চিন্তা করেছি, আমি কি প্রকৃতই আমার উদ্দেশ্যপথে এগিয়ে যেতে পারছি, না লক্ষ্যহারা হয়ে আমি জীবনের আদর্শ থেকে বহুদূরে সরে যাচ্ছি? তেমন যুক্তিপূর্ণ উত্তর পেতাম না। উত্তর পেলাম সেইদিন যেদিন আমি ভিক্ষাপাত্র হাতে বেরিয়েছিলাম আপনাদের দরজায় দরজায়। সেইদিন আমি বুঝতে পেরেছিলাম কতখানি ভালোবাসা আমি আপনাদের কাছ থেকে পেয়েছি।

কিন্তু আমার এমনি দুর্ভাগ্য যে সেদিন আপনাদের প্রত্যেকের সঙ্গে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আলাপ করার সুযোগ আমার ছিল না।

আপনারা সকলেই জানেন কলকাতার লোকের জীবন ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে থাকে বাঁধা। যদি কোনো কারণে ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে যায় তাহলে সেই কয়েকটা মিনিট পূর্ণ করবার জন্য কী প্রাণান্তকর পরিশ্রমই না মানুষকে করতে হয়!

তেমনি আমার জীবনও বাঁধা রয়েছে ওই ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে।

চিত্রনির্মাতারা আমার অধিকাংশ সময়ই কিনে নিয়েছেন। আমাকেও তাই পাল্লা দিয়ে দ্রুত ছুটতে হয় ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে। ইচ্ছে থাকলেও আপনাদের সঙ্গে বসে আলাপ-আলোচনা করবার সময় আমি পাই না।

বিশ্বাস করুন, কত রাত বিছানায় শুয়ে আমি ভেবেছি, এ আমার অন্যায়। কিন্তু পরমুহূর্তে এই ভেবে আশ্বস্ত হয়েছি, মুখোমুখি আপনাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে না পারলেও আপনাদের আনন্দ আর সেবার জন্যে আমার অধিকাংশ সময় ব্যয়িত হয়। এইটুকুই আমার একমাত্র তৃপ্তি।

অনেকে আমাকে প্রশ্ন করেছেন, আমার ছেলে বয়সের অরুণকুমার নাম আমি কেন পরিবর্তন করলাম। কী-সে এমন ঘটনা ঘটেছিল, যার জন্যে এই নাম পরিবর্তন!

আপনারা অনেকেই জানেন আমার নাম ছিল অরুণকুমার— অর্থাৎ সূর্যের পুত্র।

সূর্যদেব হচ্ছেন সেই সে দেবতা যাঁর দয়ায়, জগৎ আর তাঁর সৃষ্টি রক্ষা পায়। কিন্তু আমি তো তা নই।

এ যুগের কবিগুরুর নামও তাই।

মধ্যাহ্ন ভাস্করের মতন তিনি সাহিত্যজগতে বিরাজিত। তাঁর মৃত্যুতে আমার যতদূর স্মরণ আছে— Sir Morris Gayer বলেছিলেন— ‘গত দু’হাজার বৎসরের মধ্যে এমনি প্রতিভাবান ব্যক্তির জন্ম হয়নি। আর আগামী দু’হাজার বৎসরের মধ্যে এমন কবির জন্ম হবে কিনা সন্দেহ।’

তাই আমি ভেবে দেখলাম তাঁরই সাজে ‘রবীন্দ্র’ নাম নেওয়া। কিন্তু আমি? আমি তো সামান্য মানুষ! ও নাম বা তাঁর পুত্র হবার যোগ্যতা আমার কোথায়? তাই আমার নিজের নাম বদল করে রাখলাম উত্তমকুমার। অর্থাৎ আমি হচ্ছি উত্তম-মানুষের পুত্র।

অবশ্য এ বিষয়ে আপনারাও আমার সঙ্গে একমত হবেন। নিজের পিতাকে সব পুত্রই শ্রেষ্ঠ পুরুষ মনে করে। তা সে নিজে যাই হোক। কারণ বাবা-মা যে কোনও ছেলেমেয়ের সাক্ষাৎ উপাস্য দেবতা। তাই আমি নাম বদল করে হলাম উত্তমকুমার।

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. ১৮৬৩—১৯১৩। বাংলা গানের অন্যতম যুগ প্রবর্তক। এছাড়াও, একাধারে কবি, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক। কৃষ্ণনগরে জন্ম। বাবা দেওয়ান কার্তিকেয়চন্দ্র রায় ছিলেন একজন ওস্তাদ গাইয়ে। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ভাবধর্মী সংগীতের ধ্যানধারণা পোষণ করতেন। ইংলন্ডে গিয়েছিলেন কৃষিবিদ্যা পড়তে। সেখানেই পাশ্চাত্য সংগীতের সঙ্গে পরিচয়। ফিরে এসে সরকারি চাকরিতে যোগদান, এবং অনবরত বদলির আক্রমণ। বিদেশ যাওয়ার আগেই ‘আর্যগাথা ১ম ভাগ’ নামে প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ পায়। তারপর ‘আর্যগাথা ২য় ভাগ’, ‘মন্দ্র’, ‘আষাঢ়ে’ ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়।
    বাংলা গানে প্রথম সার্থকভাবে পাশ্চাত্যসংগীতের প্রয়োগ ও হাসির গান সৃষ্টি করেন। জীবনের শেষ দিকে পরপর অনেকগুলি নাটক (পরপারে, মেবার পতন, দুর্গাদাস, সীতা ইত্যাদি) লেখেন। এর মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ‘সাজাহান’ (১৯০৯) ও ‘চন্দ্রগুপ্ত’ (১৯১১) উত্তমকুমার এখানে সাজাহান নাটকের অন্যতম আকর্ষণীয় চরিত্র ‘দিলদার’ এর সংলাপ উল্লেখ করেছেন। বিভিন্ন সময়ে শক্তিমান অভিনেতারা এই চরিত্রে রূপদান করেছেন। প্রখ্যাত সংগীতব্যক্তিত্ব ও বিদগ্ধ মানুয দিলীপকুমার রায় ছিলেন দ্বিজেন্দ্রলালের পুত্র।
  2. Sir Morris Gayer ছিলেন OXFORD UNIVERSITY -র প্রধান। ১৯৪০ সালে যখন এই বিশ্ববিদ্যালয় রবীন্দ্রনাথকে ডি. লিট সম্মান প্রদান করেছিল, তা নিজের হাতে কবির হাতে সমর্পণ করতে শান্তিনিকেতনে আসেন Sir Gayer। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত একটি ‘গেস্ট হাউস’—এর নামও Sir Morris Gayer-এর নামে নামাঙ্কিত। উত্তমকুমার তাঁর রচনায় এই প্রাজ্ঞ মানুষটির নাম উল্লেখ করে বুঝিয়ে দিয়েছেন, তিনি রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে কতখানি ওয়াকিবহাল ছিলেন। (Sir Morris Gayer সংক্রান্ত উপরিল্লিখিত তথ্যটি পাওয়া গেছে শ্রদ্ধেয় কবি শ্রীশঙ্খ ঘোষের কাছ থেকে। স.)।