উত্তমকুমার চট্টোপাধ্যায়

হারিয়ে যাওয়া দিনগুলি মোর

বিশ

সময় সময় এমন সব অঘটন ঘটে যা বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয় না। তবুও তা ঘটে এবং সেইসব ঘটনাই বোধহয় মানুষকে ঠেলে নিয়ে যায় তার নিজের লক্ষ্যে, অথবা ফেলে দেয় বিস্মৃতির অন্তরালে, যেখান থেকে সে শত চেষ্টায়ও ফিরে আসতে পারে না নিজের জায়গায়।

তেমনি ঘটনা ঘটেছিল আমাকে নিয়ে ওই ‘বসু পরিবার’ ছবিকে কেন্দ্র করে।

আপনারা জানেন না, জানবার কথাও নয়, তবু ঘটনাটা ঘটেছিল সবার অলক্ষ্যে। এর পর থেকে, চেষ্টা করে কিছু হয়, এ বিশ্বাস আমার একেবারে চলে গেছে। যিনি দেবার মালিক তিনি ঠিক সময় প্রার্থিত বস্তু হাতে পৌঁছে দেন।

আপ্রাণ চেষ্টা করেও ‘বসু পরিবার’ এর নায়কের ভূমিকায় যখন আমার পরিবর্তে অন্য অভিনেতা মনোনীত হল, তখন হতাশ হয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। সিনারিও (চিত্রনাট্য) লেখা হল। ফ্লোরে ছবি যাবার জন্যে সব ঠিকঠাক। যাঁর নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করবার কথা ছিল, তিনি সেই সময় অন্য ছবির স্যুটিং-এ ব্যস্ত থাকার ফলে সময় দিতে পারলেন না।

এদিকে ছবি তুলতেও দেরি হয়ে যাচ্ছে। তাই নির্মলবাবু) আমাকে দিয়েই ছবির কাজ শুরু করলেন। আমি যথাসাধ্য অভিনয় করবার চেষ্টা করলাম। ঠিকই করে ফেলেছি, যদি এ ছবিতেও দর্শকের মনোরঞ্জন না করতে পারি, তাহলে এ লাইন ছেড়ে দেবো জন্মের মতন।

এই ছবিতেই আমার বোনের ভূমিকায় অভিনয় করতে আসেন বর্তমানের বিখ্যাত নায়িকা সুপ্রিয়া চৌধুরী। সেই তাঁর দ্বিতীয় কি তৃতীয় ছবি।

ছবির কাজ শেষ হয়ে গেল। আমার মনে হচ্ছে এ ছবি বোধহয় জনসাধারণ নেবে। বিজ্ঞাপন দেওয়া হল। আমার ছবি কাগজে কাগজেও বেরোলো।

এই ছবিতে ঠিক আমার বিপক্ষে কোনো নায়িকা ছিলেন না, কারণ নায়ক অবিবাহিত।

প্রধান স্ত্রী-ভূমিকায় অবতীর্ণা হয়েছিলেন বিখ্যাত অভিনেত্রী সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়।

এইবার ছবি দেখার পালা।

একটা ব্যাপার এই লাইনে আমি লক্ষ্য করেছি যেটা অনেক সময় আমার মর্মবেদনার কারণ হয়েছে। সেটা আর কিছু নয়, আমাদের নিজেদের মধ্যে সমালোচনা করার স্পৃহা। তাতে মনে উৎসাহ আসে না, আনন্দ আসে না, আসে হতাশা।

বোধহয় এরই প্রভাবে প্রভাবান্বিত হয়ে সেদিন যাঁরা ‘প্রোজেকশান শো’ দেখেছিলেন, তাঁরা সমালোচনা করলেন—ছবি মোটেই সুবিধের হয়নি। পাহাড়ী, সাবিত্রী, উত্তম সকলেই লাউড অভিনয় করেছেন। এখন জনসাধারণের কানের পর্দা থাকলে হয়!

মনটা বড়ো খারাপ হয়ে গেল। এত খেটেখুটে পরিণামে এই! গোরাচাঁদবাবুকে বললাম— ‘আর ফিল্ম লাইন নয় দাদা, যথেষ্ট হয়েছে—এইবার নিয়ম করে দশটা পাঁচটা অফিস।’

ঠিক এমনি সময় একদিন একটা শুক্রবার ‘বসু পরিবার’ মুক্তি পেল। মুক্তি বোধ হয় কেবল সেদিন ‘বসু পরিবার’ পায়নি, তার সঙ্গে সঙ্গে মুক্তি পেয়েছিল আমার অভিনয় করার বন্দীসত্তা।

দর্শক আমাকে নিয়েছেন। যত শুনি তত আনন্দ পাই। কারণে অকারণেই যেতাম সেই সমস্ত ছবি-ঘরের সামনে যেখানে ‘বসু পরিবার’ দেখানো হচ্ছে। চেয়ে দেখতাম দর্শকদের ভিড়। আত্মগোপন করে শুনতাম আমার প্রশংসা। কেউ যাতে না চিনতে পারে, তার জন্যে পরতাম কালো চশমা। শুনতে এতো ভালো লাগত যখন দর্শকরা বলতেন— ‘উত্তম বেশ অভিনয় করেছে।’

এ লাইনের মজা, যদি আপনার একটা ছবি ‘হিট করে’ তা হলেই আপনি পরের পর চান্স পাবেন। আর দর্শক ছবি যদি না নেন তাহলেই, শত ভালো অভিনয় করা সত্ত্বেও আপনাকে থাকতে হবে যবনিকার অন্তরালে।

আর একটা ব্যাপার আছে। সেটা ভয়ংকর মারাত্মক। ছবি তৈরি হয় সমবেত চেষ্টায়। তার থেকে সিনারিও-লেখক, প্রযোজক, এমনকি যাঁরা আলোর কাজও করেন তাঁদের কারোর অবদান কোনো অংশে কম নয়। কিন্তু ছবি যদি কোনো কারণে দর্শক না নেন, তাহলে সব দোষ এসে পড়বে অভিনেতা আর অভিনেত্রীদের ওপর। তার কারণ আমার মনে হয়, তাঁদের ছায়াছবি থাকে ফিল্মের ওপর, আর দর্শকরা তাঁদেরই কণ্ঠস্বর শুনতে পান।

কিন্তু ঠিক তেমনি, ছবি যখন ভালো হয়, তেমনটি হয় না। তখন অবশ্য সকলেই সম্মান ভাগ করে পান। তবে এ ক্ষেত্রেও দেখেছি, অভিনেতা অভিনেত্রীরা পান প্রধান অংশটুকু।

যাক সে কথা। ডাক এল অনেকগুলো ছবির। হ্যাঁ, একসঙ্গে। মনটা বেশ খুশি হয়ে উঠল। তাহলে এতদিন পরে অভিনেতা হিসাবে স্বীকৃতি আমি পেলাম!

গোরাচাঁদবাবু হঠাৎ একদিন এসে বললেন— ‘হ্যাঁরে, তুই যে অফিসে মন দিয়ে কাজ করবি বললি, তার কী হল?’

আমি হেসে বলি— ‘বোধহয়, দাদা, এবার শিকে ছিড়ল। আর অফিসে জয়েন করা হল না।’

— ‘ছুটি তোমার পাওনা নেই। আগে তবু এক-আধবার যেতে অফিসে সইটা করতে, আজকাল তাও যাও না। বলি, এদিক যখন ভালো হয়েছে তখন চাকরিটা ছাড়ো। নইলে কোম্পানি থেকে ছাড়িয়ে দেওয়াটা কি ভালো!’

সেইদিনই একটা রেজিগনেশন লেটার লিখে দিই গোরাচাঁদবাবুর হাতে, আর বলি— ‘আপনার এ ঋণ জীবনে শোধবার নয়।’

আজ তাই তো আত্মকথা লিখতে বসে গোরাচাঁদবাবু আর আমার সহকর্মীদের কথা স্মরণ করলাম। কারণ সেদিন তাঁরা সাহায্য না করলে, অরুণকুমার চট্টোপাধ্যায় অধমকুমার হয়েই থাকত, কোনোদিনই উত্তমকুমারে পরিবর্তিত হতে পারত না।

যাইহোক, আরও দু’ একখানা ছবি পরে পরেই দর্শকরা নিলেন, তার ফলে আমিও ভালো অভিনেতা হিসাবে স্বীকৃতি পেলাম।

ঠিক এমনি সময় এম. পি. তোলা ঠিক করলেন ‘সাড়ে চুয়াত্তর’। আমার বিপক্ষে নতুন নায়িকা চাই। তখন মালা সিনহা থাকতেন এই ভবানীপুর অঞ্চলে জগুবাবুর বাজারের কাছে।

আমি তাঁদের পরিবারের সঙ্গে আগে থেকেই পরিচিত ছিলাম। তাঁর বাবাকে বলেছিলাম আমাদের এই নতুন ছবিতে কাজ করবার জন্য। কিন্তু তিনি রাজি হলেন না। তাই ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ এ তাঁর অভিনয়ও করা হল না।

পরে ‘ঢুলি’ ছবিতে অভিনয় করে তিনি খ্যাতি অর্জন করেন।

খোঁজাখুঁজি চলল। অবশেষে একদিন আমাদেরই অফিসে এলেন আজকের বিখ্যাত অভিনেত্রী ‘সুচিত্রা’ বা ‘রমা সেন’। সেই প্রথম আমরা এক ছবিতে কাজ করি।

কথাপ্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো, ফ্লোরে ফ্লোরে যারা ঘুরে বেড়ায় অথচ ছবির প্রযোজনার সঙ্গে যাদের কোনো সম্বন্ধই নেই, তেমন লোকেরা তাঁকেও একদিন বলেছিল, এঁর অভিনয়ের কোন দক্ষতা নেই।

তাঁর দক্ষতা আছে কি না তার স্বীকৃতি দিয়েছেন আপনারা। বিশেষ করে, কোন টাইপ চরিত্রে অভিনয় করতে তিনি অদ্বিতীয়।

প্রায় এই সময়েই স্টার থিয়েটার নতুনভাবে শুরু করেন তাঁদের অভিযান।

যুদ্ধের সময় বা যুদ্ধের আগে এঁদের এখানে রোজই অভিনয় হত। সে অভিনয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হতো ঐতিহাসিক, পৌরাণিক বা ধর্মমূলক।

একমাত্র স্টার থিয়েটারেই তখন প্রতিদিন অভিনয় হত। কিন্তু কলকাতার অন্য প্রেক্ষাগৃহে অভিনয় হত সপ্তাহে তিনদিনে চারবার। বৃহস্পতি, শনি, রবি ছিল তাদের অভিনয়ের দিন।

স্টার থিয়েটারের স্বত্বাধিকারী শ্রীসলিলকুমার মিত্র ঠিক করলেন, অন্য প্রেক্ষাগৃহের মতো তিনিও সপ্তাহে চারবার অভিনয় করাবেন।

পুরোনো দলকে বিদায় দিয়ে তিনি আবার নতুন করে দল তৈরি করলেন। এই দল গড়তে তাঁকে সাহায্য করেছিলেন থিয়েটারের বিশেষজ্ঞ শ্রদ্ধেয় যামিনী মিত্র এবং শিশির মল্লিক।

এঁরা ঠিক করলেন নিরুপমা দেবীর‘শ্যামলী’কে নতুনভাবে নাট্যরূপ দিয়ে, তাকেই মঞ্চস্থ করবেন। নায়ক অনিলের চরিত্রে অভিনয় করবার জন্য একজন নতুন অভিনেতা চাই। নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করছেন বিখ্যাত অভিনেত্রী সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। তাঁর মূক অভিনয় অদ্ভুত। ওই দলেতে আরও ছিলেন বিখ্যাত অভিনেতা রবি রায়<, জহর গাঙ্গুলি বা সুলালদা।

সুলালদা আমাকে একদিন বললেন— ‘থিয়েটার করবি?’

আমিও ভাবলাম, মন্দ কী! পাড়ায় তক্তা ফেলে অভিনয় করেছি। তাতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দর্শক ছিলেন আমার পরিচিত ব্যক্তিরা। সুযোগ যখন পাচ্ছি, কেন জানাব না আমার অভিবাদন, আমার দর্শকদের!

বিখ্যাত নাট্যকার শ্রীদেবনারায়ণ গুপ্ত মহাশয় ‘শ্যামলী’র নাট্যরূপ দিয়েছিলেন।

রিহার্সাল শুরু হল। একদিন অভিনয়ের জন্যে তা প্রস্তুতও হল।

আজ ঠিক সাল আর তারিখ মনে নেই, তবে এইটুকু মনে আছে সময়টা ছিল পুজোর আগে।

বাতাস হয়েছে শিশিরে ভেজা, আকাশ হয়েছে মেঘমুক্ত। চারিদিকে খেলে যাচ্ছে একটা সুন্দর আলোর প্রবাহ। লোকে ব্যস্ত পুজোর বাজারের জন্য।

এমনি এক পরিবেশের মধ্যে ইলেকট্রিক বেল জানিয়ে দিল, অভিনয় আরম্ভ হতে আর দশ মিনিট দেরি আছে।

ধীরে ধীরে দর্শকরা নিজেদের আসন গ্রহণ করলেন। হ্যাঁ, সাজঘরে থেকেই জানতে পারলাম প্রচুর দর্শক সমাবেশ হয়েছে।

মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন নাট্যসম্রাজ্ঞী সরযূবালা হঠাৎ মনে হল এত লোকের ভিড়ে দর্শকরা বোধহয় আমাকে মনেও রাখতে পারবেন না। সত্যি কথা কেমন যেন ভয় ভয় করতে লাগল।

স্টারেতেও সেই প্রথম শুরু হয়েছে ঘূর্ণায়মান রঙ্গমঞ্চ।

আবার বেল পড়ল। দরজা বন্ধ হল। যবনিকা সরে গেল। তীব্র আলো এসে পড়লো মুখে। এ ক্যামেরার সামনে অভিনয় নয় যে ভুল করলে ফিল্ম কেটে বাদ দিলেই চলবে। দর্শকরা জানতেও পারবেন না আমার ত্রুটির কথা। এখানে যদি ভুল হয় বা অভিনয়ে ক্রটি ধরা পড়ে তাহলে বিচার করবেন ওই দর্শকরা আর তখনই হাততালি বা শিস দিয়ে রায়ের ছাপ দিয়ে দেবেন আমার ললাটে, পাশ না ফেল!

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. প্রখ্যাত অভিনেতা রবি রায়ের (১৮৯৫—১৯৫৬) পুরো নাম রবীন্দ্রমোহন রায়। নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ি এনাকে অভিনয়জগতে নিয়ে আসেন। ১৯২২ সালে একইদিনে দুটি নির্বাক ছবি যথাক্রমে ‘কমলে কামিনী’ ও ‘আলমগীর’-এ অভিনয় করেন। সেই ‘চন্দ্রগুপ্ত’ থেকে পরবর্তীকালের ‘শ্যামলী’—এক দীর্ঘসময় ধরে থিয়েটার-মঞ্চ সমৃদ্ধ হয়েছে রবি রায়ের অভিনয়ে। ‘শ্রীগৌরাঙ্গ’, ‘রজনী’, ‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য’, ‘হরিভক্তি’ (হিন্দি) ইত্যাদি বেশকিছু ছবিতেও অভিনয় করেন। প্রখ্যাত অভিনেতা ভূমেন রায়ের আপন দাদা ছিলেন রবি রায়।
  2. বিশিষ্ট অভিনেত্রী সুপ্রিয়া চৌধুরির জন্ম ১৯৩৮ সালে বার্মায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে পায়ে হেঁটে বার্মা থেকে ভারতে আসেন। নীরেন লাহিড়ি পরিচালিত ‘নাগপাশ’ ছবিতে (১৯৫০) নায়িকা চরিত্রে প্রথম অভিনয় করেন। এরপর, উত্তমকুমারের বোনের চরিত্রে করেন ‘বসু পরিবার’ ছবিতে। তারপর, ‘প্রার্থনা’, ‘মধুরাতি’ এই দুটি ছবিতে ঐ ১৯৫২ সালেই পরপর অভিনয় করেন সুপ্রিয়া দেবী। এর অনেকদিন পর ‘আম্রপালী’ ছবিতে এক সাহসী চরিত্রে নায়িকা হিসেবে ভালো মানের অভিনয়ের সাক্ষ্য রেখে অচিরেই চিত্রজগতে প্রতিষ্ঠা পেয়ে যান। এরপর, ‘স্বরলিপি’, ‘সোনার হরিণ’, ‘স্বয়ম্বরা’, ‘অগ্নিসংস্কার’, ‘জীবন মৃত্যু’ ইত্যাদি প্রায় ২০০-র বেশি ছবিতে তিনি অভিনয় করেছেন। আজও বেশকিছু ছবিসহ নানা টেলিভিশন-সিরিয়াল ইত্যাদি অনেক জায়গায় অভিনয় করে চলেছেন এই বর্ষীয়ান অভিনেত্রী। ঋত্বিক ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’-য় সুপ্রিয়া দেবীর অভিনয় অবিস্মরণীয়। উত্তমকুমারের বিপরীতে নায়িকা হিসেবে সম্ভবত সর্বাধিক ছবিতে অভিনয় করেন তিনি। সারাজীবন অনেক পুরস্কার ও সম্মান পেয়েছেন। যার মধ্যে সদ্য পাওয়া ‘বঙ্গবিভূষণ’ সম্মানও আছে।
  3. ১৯৩৭ (মতান্তরে ১৯৩৯) সালে বর্তমান বাংলাদেশের কুমিল্লায় সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম। দেশে থাকতেই গুরুর কাছে তালিমসহযোগে ক্ল্যাসিক্যাল নৃত্যে দক্ষতা অর্জন করেন। অল্পবয়সে কলকাতায় চলে আসেন। প্রখ্যাত কৌতুকাভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় হাত ধরে নিয়ে এসে সাবিত্রীকে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন থিয়েটারে— ‘নতুন ইহুদি’। ছিন্নমূল উদ্বাস্তু পরিবার নিয়ে সলিল সেনের এই নাটকটি মঞ্চস্থ করতেন ‘উত্তর ফাল্গুনি নাট্য সংস্থা’। এই সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল বিনু বর্ধনের। তাঁর উদ্যোগে ১৯৫১ সালে সুধীর মুখোপাধ্যায় পরিচালিত সুপারহিট ছবি ‘পাশের বাড়ি’-তে নায়িকা হিসেবে সুযোগ মেলে সাবিত্রীর। আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। এরপর, ‘বসু পরিবার’, ‘শুভদা’, ‘কাজরী’, ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’, ‘বালুচরী’, ‘নিশিপদ্ম’, ‘মৌচাক’, ‘ধন্যি মেয়ে’, ‘মঞ্জরী অপেরা’, ‘ডাকহরকরা’, ‘ক্ষুধা’ ইত্যাদি অসংখ্য ছবিতে তাঁর সীমাহীন অভিনয়-নৈপূণ্য প্রদর্শন করেছেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। আটপৌরে বাংলার দুখিনী নারী থেকে আরম্ভ করে, কমেডি অভিনয়—সমস্ত কিছু অনায়াসলব্ধ এই বরেণ্য অভিনেত্রীর। নাটক তিনি সারাজীবনে ভোলেননি। ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’, ‘শ্যামলী’ (উত্তমকুমারের সঙ্গে সেই বিখ্যাত নাটক), ‘মল্লিকা’, ‘রাজকুমার’ ইত্যাদি অনেক নাটকে অভিনয় করেছেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। উত্তমকুমারের বিপরীতে নায়িকা হিসেবে অনেকগুলি ছবিতে তাঁকে দেখা গেছে, যার মধ্যে বেশির ভাগই জনপ্রিয় হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই অবিস্মরণীয়া অভিনেত্রীকে ‘বঙ্গবিভূষণ’ সম্মানে ভূষিত করেছেন। এছাড়া, ‘বি. এফ. জে. এ’-র তরফে কয়েকবার সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়কে পুরস্কৃত করা হয়েছে।
  4. মালা সিনহার জন্ম ১৯৩৬ সালে কলকাতায়। ছোটোবেলা থেকে নিষ্ঠাভরে সংগীতশিক্ষা করেন। গানই ছিল তাঁর সবচেয়ে প্রিয়। প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করার পর, চলচ্চিত্রে অভিনয়ের নেশায় পায় মালা সিনহাকে। ১৯৫৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘রোশেনারা’ ছবিতে প্রথম অভিনয় করলেন। এরপর, ‘যোগ বিয়োগ’। তারপর, ‘ঢুলি’ (১৯৫৪) ছবিতে জনপ্রিয়তার সন্ধান পেলেন। এরপর, একে একে ‘কৃষ্ণলীলা’, ‘বিল্বমঙ্গল’, চিত্রাঙ্গদা’, ‘সাথীহারা’, ‘বন্ধু’, ‘পৃথিবী আমারে চায়’, ‘স্বর্ণশিখর প্রাঙ্গণে’, ‘অভয়া ও শ্রীকান্ত’, ‘কবিতা’ ইত্যাদি আরো বেশকিছু বাংলা ছবিতে দীর্ঘদিন ধরে মালা সিনহা অভিনয় করে গেছেন, যার মধ্যে উত্তমকুমারের সঙ্গে নায়িকা হিসেবে অনেকগুলি ছবি আছে। এছাড়া, বাংলা থেকে মুম্বই গিয়ে এক প্রথম সারির নায়িকা হিসেবে নিজেকে হিন্দি ছবির জগতে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। ‘বাদশাহ’ ছবি দিয়ে হিন্দি জগতে শুরু করে, ‘রিয়াসত’, ‘হ্যামলেট’, ‘পয়সা হি পয়সা’, ‘রঙিন রাতেঁ,’ ‘অপরাধী কৌন’, ‘চাহত’, ‘আনপড়’, ‘নাইট ইন লণ্ডন’ ইত্যাদি সহ অনেক পরবর্তীকাল পর্যন্ত বহু হিন্দি ছবিতে মালা সিনহা দাপটের সঙ্গে অভিনয় করেছেন। প্রসঙ্গত, চলচ্চিত্রে অভিনয়জগতে আসার আগে, কয়েকটি ছবিতে নেপথ্য গায়িকা হিসেবে এবং বেতারেও গান করেছিলেন মালা সিনহা।
  5. পিনাকী মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ‘ঢুলি’ ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৫৪ সালে। অসম্ভব জনপ্রিয়তা পায় ছবিটি। বিশেষ করে, এই ছবির গান মাতিয়ে দিয়েছিল সারা বাংলাকে। সংগীত পরিচালক রাজেন সরকারের অসামান্য সুররচনায় জন্ম নিয়েছিল বেশকিছু চিরকালীন জনপ্রিয় গান। ‘নিঙাড়িয়া নীল শাড়ি…’ (প্রতিমা), ‘এই যমুনারি তীরে…’ (যূথিকা), ‘ভাঙনের তীরে…’ (ধনঞ্জয়), ‘ত্রিনয়নী দুর্গা…’ (ধনঞ্জয়) ইত্যাদি গান, আমাদের মনে আজও গাঁথা হয়ে আছে। প্রশান্তকুমার, সুচিত্রা সেন, মালা সিনহা ও আরো বরেণ্য অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অভিনয়ে সমৃদ্ধ হয়েছিল ‘ঢুলি’ ছবিটি।
  6. এখন যেখানে বিডন স্ট্রিট ও চিত্তরঞ্জন এভিন্যু (পূর্বতন সেণ্ট্রাল এভিন্যু) মিশেছে, সেখানে ১৮৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘স্টার থিয়েটার’ (৬৮,বিডন স্ট্রিট)। গিরিশচন্দ্র ঘোষ, অমৃতলাল বসু, অমৃতলাল মিত্র ইত্যাদি আরো কয়েকজনের উদ্যোগে তৎকালীন কলকাতার এক ধনী বাবু গুর্মুখ রায় মুসাদ্দি নিজ অর্থ ব্যয়ে এই থিয়েটার তৈরি করেন। কিন্তু, সংগীত-নৃত্য-অভিনয়ে পটিয়সী প্রখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব বিনোদিনী দাসীর নিজেকে গুর্মুখের হাতে সঁপে দেবার শর্তে রাজি না হলে, এ থিয়েটার তৈরিই হত না। শুধু তাই নয়, বিনোদিনীর নাম অনুযায়ী, এই থিয়েটারের নাম ‘বি-থিয়েটার’ হওয়ার কথা প্রথমে হলেও, পরে তা হল ‘স্টার থিয়েটার’। তাও বিনোদিনীকে মেনে নিতে হয়। গিরিশচন্দ্র-র ‘দক্ষযজ্ঞ’ নাটক দিয়ে থিয়েটারের উদ্বোধন হয়। এরপর, অনেক নাটক চলার পর, ১৮৮৮ সালে এই থিয়েটার উঠে আসে, হাতিবাগানের মোড়ে। উত্তমকুমার এই মঞ্চেই ১৯৫৩ সালের ১৫ অক্টোবর থেকে একটানা ৪৮৪ রাত্রি অভিনয় করেন, ‘শ্যামলী’ নাটকে। ১৯৯১ সালের ১৩ অক্টোবর মাঝরাতে, এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ‘স্টার থিয়েটার’-এর বেশিরভাগ অংশ পুড়ে ছাই হয়ে যায়। পরবর্তীকালে, কলকাতা পৌর প্রতিষ্ঠান, এই থিয়েটারকে নতুন করে তৈরি করলেও, আজ এটি প্রধানত মূলত চলচ্চিত্র-প্রেক্ষাগৃহে পরিণত হয়েছে।
  7. সাহিত্যিক নিরুপমা দেবী (১৮৮৩—১৯৫১) বহরমপুরে জন্মান এবং তাঁর বাল্যজীবন কাটে বিহারের ভাগলপুরে। তাঁর অকালবৈধব্যের পর দাদা বিভূতিভূষণ ভট্ট ও প্রখ্যাত সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অনুপ্রেরণায় এঁদেরই পরিচালিত হাতে লেখা পত্রিকায় সাহিত্যকর্ম শুরু করেন নিরুপমা দেবী। এনার রচিত প্রথম উপন্যাস ‘উচ্ছৃঙ্খল’। স্বদেশি যুগে বেশ কিছু গানও লেখেন। ১৩১৯-২০ সালে, ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় নিরূপমা দেবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস ‘দিদি’ প্রকাশিত হয়। ১৯৩৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এনাকে ‘ভুবনমোহিনী স্বর্ণপদক’ প্রদান করেন। এছাড়াও, নিরুপমা দেবী আরো কিছু সম্মানে সম্মানিত হয়েছিলেন। নিরুপমা দেবীর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হল— ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’, ‘দেবত্র’, ‘শ্যামলী’, ‘বন্ধু’, ‘বিধিলিপি’, ‘অনুকর্ষ’ ইত্যাদি। এই সাহিত্যিকের বহু রচনা চিত্রায়িত ও মঞ্চায়িত হয়েছে।
  8. বিশিষ্ট নাট্যকার ও পরিচালক দেবনারায়ণ গুপ্ত-র জন্ম ১৯১০ সালে। নাট্যজগতে আসার আগে, ‘ভাণ্ডার’, ‘ভারতবর্ষ’ ইত্যাদি অনেক নামী পত্র-পত্রিকার সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। একটানা ২৩ বছর স্টার থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। যেমন নাট্যরূপ তেমনি মৌলিক নাটকরচনা এবং নাট্য পরিচালনা— সবকিছুতেই নিজের প্রতিভাকে চিনিয়েছেন দেবনারায়ণ গুপ্ত। ‘শ্যামলী’, ‘শর্মিলা’, ‘প্রেয়সী’, ‘সীমা’ ইত্যাদি এরকমই কিছু নাটক। চলচ্চিত্র-পরিচালনার ক্ষেত্রেও দেবনারায়ণ গুপ্তকে দেখা গেছে।
  9. সরযূবালা দেবী (১৯১৩-১৯৯৪) ছিলেন ‘নাট্যসম্রাজ্ঞী’। ১৯২৮ সালে মঞ্চজগতে এসে দীর্ঘ ৬০ বছর এখানে রাজত্ব করেছেন। বাণীবিনোদ নির্মলেন্দু লাহিড়ির সংস্পর্শে আসার পর তাঁর অভিনয়প্রতিভার বিকাশ ঘটে। এছাড়া, শিশিরকুমার ভাদুড়ির সঙ্গেও অভিনয় করেন। মনমোহন থিয়েটারে এক রাত্তিরের জন্যে ‘মীরাবাঈ’ নাটকে কৃষ্ণ চরিত্রে অভিনয় করলেও, ‘বিষবৃক্ষ’ নাটকে ‘কুন্দনন্দিনী’-র ভূমিকায় অভিনয়ের মাধ্যমেই যথাযথভাবে পেশাদার রঙ্গমঞ্চে তাঁর যাত্রা শুরু করেন, সরযূবালা দেবী। ‘সাজাহান’, ‘চন্দ্রশেখর’, ‘গৈরিক পতাকা’, ‘বিষ্ণুপ্রিয়া’—এরকম অজস্র নাটকে অবিস্মরণীয় অভিনয় করেন। নির্বাক ছবি ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ থেকে আরম্ভ করে সবাক যুগের ‘শাপমুক্তি’, ‘শ্রীদুর্গা’, ‘দাসীপুত্র’, ‘যার যেথা ঘর’ ইত্যাদি বেশকিছু চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেন। প্রখ্যাত কৌতুকাভিনেতা জহর রায়ের সঙ্গে অন্যতম সত্ত্বাধিকারী হিসেবে দীর্ঘকাল ‘রঙমহল’ থিয়েটারের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন সরযূবালা দেবী। এবছর, এনার জন্মশতবর্ষ।