বর্ণাকার

ক্রুসেডারদের নৌ-বহর ও সেনাবাহিনীকে রোম উপসাগরে ডুবিয়ে মেরে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী এখনও মিসরের উপকূলীয় অঞ্চলেই অবস্থান করছেন। সাতদিন কেটে গেছে। সুলতান সালাহুদ্দীন খৃষ্টানদের থেকে জরিমানাও আদায় করে নিয়েছেন। কিন্তু রোম উপসাগর এখনও একের পর এক নৌ-জাহাজ গলাধঃকরণ করে চলছে আর উদগীরণ করছে মানুষের লাশ। মাঝি-মাল্লা ও সৈন্যরা আগুন ধরে যাওয়া জাহাজ থেকে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এখন এক এক করে ভেসে উঠছে তাদেরই মৃতদেহ।

দূরে মাঝ দরিয়ায় সাতদিন পরও আজ কয়েকটি জাহাজের পাল বাতাসে ফড় ফড় করছে। কোন মানুষ নেই তাতে। ছেঁড়া পাল জাহাজগুলোকে সমুদ্রের দয়ার উপর ছেড়ে দিয়েছে।

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী সেগুলোর তল্লাশী নেওয়ার জন্য কয়েকটি নৌকা প্রেরণ করেন। বলে দেন, যদি কোন জাহাজ বা কিশতী অক্ষত থাকে, কাজে আসার মত হয়, তাহলে রশি বেঁধে টেনে নিয়ে আসবে। আর যেগুলো অকেজো, সেগুলোর মাল-পত্র বের করে আনবে।

খৃষ্টানদের ভাসমান জাহাজগুলোর তল্লাশী নেওয়া হল। যা পাওয়া গেল, তন্মধ্যে বেশীর ভাগ অস্ত্র, খাদ্যদ্রব্য আর মানুষের লাশ।

ভাসমান লাশগুলোকে সমুদ্রের ঊর্মিমালা তুলে তুলে তীরে ছুঁড়ে মারছে। লাশগুলোর কতিপয় আগুনেপোড়া। কিছু মাছেখাওয়া। অসংখ্য লাশ এমন যে, সেগুলোর গায়ে একটি বা একেরও অধিক তীর গাঁথা।

কাঠ-তক্তা ও ভাঙ্গা কিশতী অবলম্বন করে সাঁতার কেটে কেটে এখনও কিছু লোক কূলে এসে উঠছে। ক্ষুধার্ত, পিপাসার্ত, ক্লান্ত-অবসন্ন সেই ভাগ্যাহত লোকগুলোকে ঢেউ যাকে যেখানে ছুঁড়ে মারছে, লাশের মত সেখানেই পড়ে থাকছে আর মুসলমানরা তাদের তুলে আনছে। সমুদ্রতীরে মাইলের পর মাইল এই একই দৃশ্য বিরাজ করছে।

সুলতান সালাহুদ্দীন তার বাহিনীকে মিসরের সমগ্র উপকূলীয় অঞ্চলে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন এবং যেখানেই কোন শত্রুসেনা সমুদ্র থেকে তীরে উঠে আসবে, সঙ্গে সঙ্গে তাকে শুকনো পোশাক আর পুষ্টিকর খাবার সরবরাহ করার এবং আহত হলে ব্যাণ্ডেজ—চিকিৎসারও ব্যবস্থা করে রেখেছেন। তারপর একস্থানে জড় করছেন বন্দীদের।

ঘোড়ায় চড়ে উপকূলীয় এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন সুলতান সালাহুদ্দীন। তার ছেড়ে কয়েক মাইল দূরে চলে গেছেন তিনি। সম্মুখে ছোট-বড় অনেকগুলো টিলা। টিলার একদিকে সমুদ্র আর পিছনে ধু ধু মরু-প্রান্তর। এই সবুজ-শ্যামল মরুদ্যানে সারি সারি খেজুর বৃক্ষ ছাড়াও আছে নানা প্রকার মরুজাত গাছ-গাছালী, ঝোঁপ-ঝাড়, বৃক্ষ-লতা।

সুলতান সালাহুদ্দীন ঘোড়া থেকে নামলেন এবং পায়ে হেঁটে টিলার পাদদেশ বেয়ে এগিয়ে চললেন। সঙ্গে তাঁর রক্ষী বাহিনীর চার অশ্বারোহী। সুলতান নিজের ঘোড়াটা রক্ষীদের হাতে দিয়ে তাদের সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে বললেন। তিন সালারও আছে তাঁর সঙ্গে। তার মধ্যে একজন হলেন সুলতান সালাহুদ্দীনের অন্তরঙ্গ বন্ধু বাহাহুদ্দীন শাদ্দাদ। এই যুদ্ধের মাত্র একদিন আগে তিনি আরব থেকে এসেছেন। ঘোড়াটা রক্ষীদের হাতে দিয়ে সুলতানের সঙ্গে হাঁটা দেন তিনিও।

এখন শীতের মওসুম। শান্ত সমুদ্র। সুলতান সালাহুদ্দীন হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে গেলেন অনেক দূর। দৃষ্টির আড়াল হয়ে গেলেন রক্ষীদের। এখন তার সামনে-পিছনে-বাঁয়ে উঁচু-নীচু টিলা। ডানে বালুকাময় সমুদ্রতীর। দু আড়াই গজ উঁচু এক খণ্ড পাথরের উপর উঠে দাঁড়ান সুলতান। দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন রোম উপসাগরের প্রতি। তাঁর ঈমান-আলোকিত অবয়বে বিজয়ের আনন্দ-দীপ্তি। এক নাগাড়ে তাকিয়ে আছেন শান্ত-সমাহিত নীলাভ সমুদ্রপাণে। হঠাৎ নাকে হাত রেখে তিনি বলে উঠলেন— ‘কেমন উকট একটা দুর্গন্ধ আসছে, না?’

সমুদ্রোপকূলে এদিক-ওদিক ঘুরতে শুরু করে সুলতান সালাহুদ্দীন ও তার সালারদের দৃষ্টি। কিসের যেন ফড় ফড় শব্দ কানে ভেসে আসে তাদের। তারপর হালকা চেঁচামেচি ও কন্‌কন্ শব্দ। উপর থেকে তিন-চারটি শকুন ডানা মেলে নীচে নামতে দেখা গেল। টিলার আড়ালে সমুদ্রের তীরের দিকে অবতরণ করল শকুনগুলো। সুলতান সালাহুদ্দীন বললেন— ‘লাশ আছে।’

ওদিকে হেঁটে গেলেন তারা। পনের-বিশ গজের বেশি যেতে হল না। তিনটি লাশ। শকুনগুলো ভাগাভাগি করে খাচ্ছে লাশগুলো। পাঞ্জা করে একটি মানবমুণ্ড নিয়ে উড়ে গেল এক শকুন। উঠেই চক্কর কাটে আকাশে। হঠাৎ পা থেকে ছুটে নীচে পড়ে যায় মুখটি। পতিত হয় সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর ঠিক সামনে।

মুণ্ডটির চোখ দুটো খোলা। যেন চেয়ে আছে সুলতানের দিকে। মুখমণ্ডলের আকৃতি ও মাথার চুল বলছে, এটি কোন খৃষ্টানের মাথা। সুলতান সালাহুদ্দীন অনিমেষ নয়নে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকেন মুণ্ডটির প্রতি। তারপর সালারদের প্রতি দৃষ্টিপাত করে বললেন— ‘এদের মুণ্ড সেইসব বিশ্বাসঘাতক ঈমান-বিক্রয়কারী মুসলমানদের মুণ্ড অপেক্ষা অনেক ভাল, যাদের ষড়যন্ত্রে আমাদের খেলাফত আজ নারী ও মদের চিতায় বলি হতে চলেছে।’

‘খৃষ্টানরা ইঁদুরের ন্যায় আমাদের সালতানাতে ইসলামিয়াকে কুরে কুরে খেয়ে চলেছে।’ বললেন এক সালার।

‘আর আমাদের বাদশাহ তাদেরকে কর দিচ্ছেন। ফিলিস্তীন আজ খৃষ্টানদের কব্জায়। মহামান্য সুলতান! আমরা কি আশা রাখতে পারি যে, ফিলিস্তীন থেকে আমরা ওদেরকে বিতাড়ন করতে পারব?’ বললেন বাহাহুদ্দীন শাদ্দাদ।

‘আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না শাদ্দাদ!’ জবাব দেন সুলতান সালাহুদ্দীন।

‘আল্লাহর রহমত থেকে নয়—আমরা আমাদের ভাইদের থেকে নিরাশ হয়েছি।’ বললেন অপর এক সালার।

‘তুমি ঠিকই বলেছ। যে আক্রমণ বাইরে থেকে আসে, তা আমরা প্রতিহত করতে পারি। তোমরা কেউ কি ভেবেছিলে, কাফিরদের এত বিশাল নৌ-সেনাবহরকে এত সামান্য শক্তি দিয়ে এত সাফল্যের সাথে আমরা সমুদ্রে ডুবিয়ে মারতে পারব। তোমরা হয়ত অনুমান করতে পারনি, এই বহরে যে পরিমাণ সৈন্য আসছিল, তারা সমগ্র মিসরে মাছির মত ছেয়ে যেত! মহান আল্লাহ আমাদেরকে সাহস দিয়েছেন। আর আমরা একটু কৌশল করে তাদের গোটা বহরকে সমুদ্রতলে ডুবিয়ে দিয়েছি। কিন্তু আমার বন্ধুগণ! যে আক্রমণ ভিতর থেকে আসছে, অত সহজে তোমরা তা প্রতিহত করতে পারবে না। তোমার ভাই যখন তোমার উপর আঘাত হানবে, তখন তুমি আগে ভাববে, সত্যিই কি এ-কাজ আমার ভাই করেছে, নাকি অন্য কেউ। তোমার মনে সংশয় জাগ্রত হবে, আমি ভুল বুঝছি না তো! বাহুতে তুমি তার উপর তরবারীর আঘাত হানার শক্তি পাবে না। আর যদি সাহস করে তরবারী উত্তোলন করেও ফেল, তখন সুযোগ বুঝে দুশমন তোমাকে ও তাকে দুজনকেই খতম করে দেবে।’ গম্ভীর কণ্ঠে বললেন সুলতান সালাহুদ্দীন।

সঙ্গীদের নিয়ে টিলার গা ঘেঁষে ঘেঁষে সুলতান সালাহুদ্দীন সমুদ্রতীরের দিকে এগিয়ে চললেন। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ থেমে গেলেন। মাথা নুইয়ে বালি থেকে একটা কী যেন তুললেন। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বস্তুটি হাতের তালুতে নিয়ে সকলকে দেখালেন।

কাঠের তৈরি একটি ক্রুশ। শক্ত একখণ্ড সুতায় বাঁধা। শকুনরা যে লাশগুলো খাচ্ছিল, সুলতান সালাহুদ্দীন সেগুলোর বিচ্ছিন্ন অঙ্গগুলো দেখলেন। তারপর চোখ ফেললেন মুণ্ডটির প্রতি, যা শকুনের পাঞ্জা থেকে ছুটে তাঁর সামনে এসে পড়েছিল। দ্রুত হেঁটে আবার মুণ্ডটির কাছে গেলেন। মুণ্ডটির মালিকানা নিয়ে লড়াই করছে তিনটি শকুন। সুলতান সালাহুদ্দীনকে দেখে আড়ালে চলে যায় শকুনগুলো। সুলতান মুণ্ডের উপর কুশটি রাখলেন এবং দৌড়ে সালারদের নিকট চলে গেলেন। বলতে শুরু করলেন। ‘আমি একবার খৃষ্টানদের এক কয়েদী অফিসারের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। তার গলায়ও ক্রুশ ছিল। সে আমাকে বলেছিল, যেসব খৃষ্টান সেনাবাহিনীতে ভর্তি হয়, ক্রুশে হাত রেখে তাদের থেকে শপথ নেওয়া হয় যে, ক্রুশের নামে তারা জীবনবাজি রেখে লড়াই করবে এবং ভূপৃষ্ঠ থেকে সর্বশেষ মুসলমানটি খতম না করে ক্ষান্ত হবে না। এই হলফের পর প্রত্যেক সৈন্যের গলায় একটি করে ক্রুশ ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। এখানে বালির মধ্যে আমি একটি ক্রুশ কুড়িয়ে পেয়েছি। কার ছিল জানি না। রেখে দিয়েছি ঐ খুলিটির উপর, যাতে, তার আত্মা, ক্রুশবিহীন না থাকে। লোকটা ক্রুশের জন্য নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছে। একজন সৈনিককে তার শপথের মর্যাদা দেওয়া উচিত।’

‘মাননীয় সুলতান! আপনার অবশ্যই জানা আছে, খৃষ্টানরা জেরুজালেমের মুসলিম নাগরিকদেরকে কী পরিমাণ কষ্ট দিচ্ছে। স্ত্রী-সন্তান ও পরিবার-পরিজন নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে ওখানকার মুসলমানরা। লুণ্ঠিত হচ্ছে আমাদের মেয়েদের ইজ্জত-সম্ভ্রম। আমাদের বন্দীদেরকে ওরা এখনও মুক্তি দেয়নি। তারা মানবেতর জীবন যাপন করছে। খৃষ্টানদের থেকে কি আমরা এর প্রতিশোধ নেব না?’ বললেন বাহাহুদ্দীন শাদ্দাদ।

প্রতিশোধ নয়—নেব ফিলিস্তীন। কিন্তু ফিলিস্তীনের পথ যে আগলে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের শাসকগোষ্ঠী!’ বললেন সুলতান সালাহুদ্দীন।

হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে সুলতান সালাহুদ্দীন আরও বললেন, ‘কুশে হাত রেখে সালতানাতে ইসলামিয়াকে ধ্বংস করার প্রতিজ্ঞা নিয়েছে খৃষ্টানরা। আমি আল্লাহর সম্মুখে দাঁড়িয়ে বুকে হাত রেখে শপথ নিয়েছি, ফিলিস্তীন উদ্ধার আমি করবই। আমি সালতানাতে ইসলামিয়ার সীমানা পৃথিবীর শেষ প্রান্ত পর্যন্ত নিয়ে যাবে। কিন্তু আমার বন্ধুগণ! আমার কাছে আমাদের ভবিষ্যত উজ্জ্বল বলে মনে হয় না। এক সময় এমন ছিল যে, খৃষ্টানরা ছিল রাজা, আমরা ছিলাম যোদ্ধা। আর এখন আমাদের বুজুর্গরা পরিণত হচ্ছেন রাজায় আর খৃষ্টানরা হচ্ছে যোদ্ধা। উভয় জাতির গতি-প্রকৃতি দেখে আমার মনে হচ্ছে, একটি সময় এমন আসবে, যখন মুসলমানরা রাজায় পরিণত হয়ে যাবে ঠিক; কিন্তু তাদের উপর শাসন চালাবে খৃষ্টানরা। মুসলমানরা রাজা হওয়ার আনন্দেই বিভোর হয়ে থাকবে। তারা বলবে, আমরা স্বাধীন। কিন্তু প্রকৃত অর্থে তাদের স্বাধীন সত্ত্বা বলতে কিছুই থাকবে না। তারা কাফিরদের দাসত্ব ছাড়া এক পাও চলতে পারবে না। আমি ফিলিস্তীন উদ্ধার করার সংকল্প গ্রহণ করেছি বটে, কিন্তু মুসলমানদের গাদ্দারী ঠেকাবে কে? খৃষ্টানদের মস্তিষ্ক বড় উর্বর। পঞ্চাশ হাজার সুদানী সৈন্যকে পুষছিল কারা? আমাদের খেলাফত নিজের আঁচলে পুষেছিল নাজি নামক একটি বিষধর সাপকে। আমিই বোধ হয় মিসরের প্রথম গভর্নর, যে দেখতে পেয়েছে, এই বাহিনী দেশের জন্য অনর্থকই নয়—ভয়ঙ্করও বটে। নাজির চক্রান্ত যদি ফাঁস না হত, তাহলে আমরা এই বাহিনীটির হাতেই নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিলাম।

হঠাৎ হাল্কা একটা শো শব্দ ভেসে আসে সকলের কানে। একটি তীর এসে গেঁথে যায় সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর দু পায়ের মাঝে বালিতে। সুলতান সালাহুদ্দীনের পিঠের দিক থেকে ছুটে আসে তীরটি। সেদিকে দৃষ্টি ছিল না কারুর।

তীরটি যেদিক থেকে ছুটে আসে, হঠাৎ চমকে উঠে সেদিকে চোখ তুলে তাকায় সকলে। উঁচু-নীচু কয়েকটি টিলা ছাড়া দেখা গেল না কিছুই। সবাই উঠে দাঁড়ান। দৌড়ে গিয়ে দেয়ালের মত উঁচু একটি টিলার আড়ালে গিয়ে আশ্রয় নেন। আরও তীর আসার আশঙ্কা আছে। খোলা ময়দানে তীরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বাহাদুরী নয়। মুখে আঙ্গুল রেখে বিশেষ প্রক্রিয়ায় সজোরে শিস দেন শাদ্দাদ। রেকাবে পা রেখে প্রস্তুত হয়েই ছিল রক্ষী বাহিনী। সঙ্গে সঙ্গে ছুটে চলে তাদের ঘোড়াগুলো। তার সঙ্গে তিনজন সালার ছুটে যান সেদিকে, যেদিক থেকে তীরটি এসেছিল। তিনজন তিন পথে উঠে যায় টিলায়। সালাহুদ্দীন আইউবীও ছুটে যান তাদের পিছনে। দেখে এক সালার বলল, ‘সুলতান! আপনি আসবেন না।’ কিন্তু তার বাধা মানলেন না সুলতান সালাহুদ্দীন।

ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছে রক্ষী বাহিনী। সুলতান সালাহুদ্দীন তাদের বললেন, ‘ঘোড়াগুলো এখানে রেখে টিলার পিছনে যাও। ওদিক থেকে একটি তীর এসেছে। যাকেই পাবে, ধরে নিয়ে আসবে।’

একটি টিলার উপরে উঠে যান সুলতান। চারদিক দূর-দূরান্ত পর্যন্ত ছোট-বড়, উঁচু-নীচু অসংখ্য টিলা চোখে পড়ে তার। সালারদের নিয়ে পিছন দিকে নেমে পড়েন তিনি। চারদিক ঘুরে-ফিরে দেখে আবার উঠে আসেন। টিলায় চোখ বুলিয়ে চতুর্দিক তাকালেন। কিন্তু নাম-গন্ধও নেই কোন মানুষের।  পাথুরে এলাকার ভিতরে, উপরে-নীচে, ডানে-বাঁয়ে সর্বত্র পাতিপাতি করে খুঁজে বেড়ায় রক্ষীরা। কিন্তু কিছুই দেখতে পেল না তারা।

নীচে নেমে সুলতান সালাহুদ্দীন সে স্থানে চলে আসলেন, যেখানে বালিতে তীরটি বিদ্ধ হয়েছিল। সহকর্মীদের ডাকলেন এবং তীরটির গায়ে হাত রাখলেন। পড়ে গেল তীরটি। সুলতান বললেন— ‘দূর থেকে এসেছে, তাই পায়ের পাশে পড়েছে। অন্যথায় ঘাড়ে কিংবা পিঠে এসে বিদ্ধ হত। আর বালিতেও বেশী গাঁথেনি।’ তীরটি হাতে তুলে নিয়ে সুলতান সালাহুদ্দীন দেখলেন এবং বললেন, ‘হাশীশীদের নয়—খৃষ্টানদের তীর।’

‘সুলতানের জীবন হুমকীর সম্মুখীন।’ বললেন এক সালার।

‘আর আজীবন হুমকীর মধ্যেই থাকবে’ —মুখে হাসি টেনে সুলতান বললেন— ‘আমি রোম উপসাগরে কাফিরদের সেসব জাহাজ-কিশতী দেখার জন্য বের হয়েছিলাম, যেগুলো মাঝি-মাল্লাবিহীন ভাসছিল। কিন্তু আমার প্রিয় বন্ধুগণ! খৃষ্টানদের কিশতী সমুদ্রে ভাসছে ভাববেন না। তারা আবার আসবে। আসবে বজ্রের মত গর্জন করতে করতে। বর্ষিবেও। তারা আঘাত হানবে মাটির নীচ আর পিঠের পিছন থেকে। এখন থেকে খৃষ্টানদের সঙ্গে আমাদের এমন লড়াই লড়তে হবে, যা শুধু সৈন্যরাই লড়বে না। সামরিক প্রশিক্ষণে আমি নতুন এক মাত্রা যোগ করছি। তা হল গোয়েন্দা লড়াই।’

তীরটি হাতে নিয়ে ঘোড়ায় সওয়ার হলেন সুলতান সালাহুদ্দীন। রওনা দিলেন ক্যাম্পের দিকে। তাঁর সালারগণও ঘোড়ায় সওয়ার হলেন। একজন নিজের ঘোড়া নিয়ে এলেন সুলতানের ডান দিকে। একজন আসলেন বাঁ দিকে। একজন অবস্থান নিলেন সুলতানের পিছনে, ঠিক তার সন্নিকটে, যাতে কোন দিক থেকে তীর এলে তা সুলতানের গায়ে আঘাত হানতে না পারে।

* * *

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে তীর ছোঁড়া হল। কিন্তু সে জন্য বিন্দুমাত্র উৎকণ্ঠা নেই তার। খৃষ্টান গুপ্তচর ও কমাণ্ডোরা কিরূপ ক্ষতিসাধন করছে, নিজের তাঁবুতে বসে সালারদের কাছে তারই বিবরণ দিচ্ছেন তিনি। সুলতান সালাহুদ্দীন বললেন— ‘আলী বিন সুফিয়ানকে আমি একটি পরিকল্পনা দিয়েছিলাম। কিন্তু এখনও তা বাস্তবায়িত হয়নি। বিলম্ব না করে তোমরা নিজ নিজ সিপাহী ও কমাণ্ডারদের মধ্য থেকে এমন কিছু লোক বেছে নাও, যারা হবে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী, বুদ্ধিমান, সূক্ষ্মদর্শী, দূরদর্শী ও উপস্থিত সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম। তাদের মধ্যে থাকবে উটের ন্যায় দিনের পর দিন ক্ষুৎপিপাসা সহ্য করার শক্তি, সিংহের ন্যায় ঝাঁপিয়ে পড়ার দক্ষতা। যাদের দৃষ্টি হবে ব্যাঘ্রের ন্যায় সূক্ষ্ম, যারা দৌড়াতে পারে খরগোশ ও হরিণের মত। যার বিনা অস্ত্রে লড়াই করতে পারে সশস্ত্র দুশমনের সঙ্গে। সর্বোপরি তাদের মধ্যে থাকবে না কোন প্রকার মদ-মাদকতার অভ্যাস। তারা লোভে পড়ে নীতি-নৈতিকতা ত্যাগ করবে না। যত রূপসী নারীই তাদের হাতে আসুক, যত সোনা-দানা, অর্থ-বৈভব তাদের পায়ে নিক্ষিপ্ত হোক, সবকিছু উপেক্ষিত হয়ে দৃষ্টি থাকবে তাদের কর্তব্যের প্রতি।

তোমরা তোমাদের অধীন সকলকে বলে দাও, বুঝিয়ে দাও যে, গুপ্তচরবৃত্তি, সেনাদের মধ্যে অশান্তি-অস্থিরতা বিস্তার এবং চেতনার দিক থেকে সৈন্যদের অখর্ব করে তোলার জন্য খৃষ্টানরা সুন্দরী মেয়েদের ব্যবহার করছে। আমি মুসলমানদের মধ্যে একটি দুর্বলতা লক্ষ্য করছি, তারা নারীর প্রলোভনে অল্প সময়ে অস্ত্র ত্যাগ করে। এমন কাজে আমি মুসলিম নারীদের কখনও দুশমনের এলাকায় প্রেরণ করব না। আমরা নারীর ইজ্জতের মোহাফেজ। সেই ইজ্জতকে আমরা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারি না। আলী বিন সুফিয়ানের হাতে কয়েকটি মেয়ে আছে। কিন্তু ওরা মুসলমান নয়, খৃষ্টানও নয়। তারপরও আমি এর পক্ষপাতি নই।’

তাঁবুতে প্রবেশ করে রক্ষীবাহিনীর কমাণ্ডার বলে, ‘আমার বাহিনীর লোকেরা কয়েকজন পুরুষ ও কয়েকটি মেয়ে ধরে নিয়ে এসেছে।’ সুলতান সালাহুদ্দীন বাইরে বেরিয়ে আসেন। তিন সালারও বেরিয়ে আসেন তাঁর সঙ্গে। বাইরে পাঁচজন লোক দণ্ডায়মান। লম্বা চোগা, পাগড়ী আর ধরণ-প্রকৃতি বলছে, লোকগুলো বণিক। সঙ্গে তাদের সাতটি মেয়ে। সব ক’টিই যুবতী এবং একজন অপেক্ষা অপরজন অধিক রূপসী।

রক্ষীদের একজন—যে সুলতান সালাহুদ্দীনের উদ্দেশ্যে নিক্ষেপ করা তীরের উৎসের সন্ধানের গিয়েছিল, বলল, ‘আমরা সমগ্র এলাকা তন্ন তন্ন করে অনুসন্ধান করলাম; কিন্তু কোন মানুষের সন্ধান পেলাম না। পিছনে আরও দূরে চলে গেলাম। হঠাৎ দেখলাম, এরা তাঁবু খাঁটিয়ে অবস্থান করছে। সঙ্গে তিনটি উট।’

‘এদের তল্লাশী নেওয়া হয়েছে কি?’ এক সালার জিজ্ঞেস করলেন।

‘হ্যাঁ, হয়েছে। বলছে, এরা ব্যবসায়ী। আমরা এদের জিনিসপত্র সব খুলে দেখেছি। দেহ-তল্লাশীও নিয়েছি। কিন্তু এই খঞ্জরগুলো ছাড়া আর কোন অস্ত্র পাওয়া যায়নি।’ বলেই পাঁচটি খঞ্জর সুলতান সালাহুদ্দীনের পায়ের কাছে রেখে দেয় এক রক্ষী।

‘আমরা মারাকেশের ব্যবসায়ী। যাব ইস্কান্দারিয়া। দুদিন আগে আমাদের অবস্থান ছিল এখান থেকে দশ ক্রোশ পিছনে। পরশু সন্ধ্যায় এই মেয়েগুলো আমাদের হাতে আসে। তখন তাদের পরিধানের পোশাক ছিল ভেজা। তারা আমাদের জানাল, তারা সিসিলির বাসিন্দা। খৃষ্টান সৈন্যরা এদের ঘর থেকে উঠিয়ে এনে একটি জাহাজে তুলে নেয়। এরা গরীব পিতা-মাতার সন্তান। এরা বলছে, বিপুলসংখ্যক জাহাজ ও নৌকা রওনা হয়েছিল। এদেরকে যে জাহাজে তোলা হয়েছিল, তাতে কমাণ্ডার গোছের কয়েকজন লোক এবং বেশ কজন সৈন্যও ছিল। তারা নিজেরা মদ খেয়ে, এদেরও মদ খাইয়ে আমোদ করতে থাকে। সমুদ্রের এপারের নিকটবর্তী হলে জাহাজগুলোতে আগুনের গোলা নিক্ষিপ্ত হতে শুরু করে। আগুন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মানুষগুলো জাহাজ থেকে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়তে থাকে। এদেরকে তারা একটি নৌকায় বসিয়ে জাহাজ থেকে সমুদ্রে নামিয়ে ভাসিয়ে দেয়। এরা বলছে, এদের কেউ নৌকা বাইতে জানে না। তাই মাঝি-মাল্লাবিহীন নৌকাটি সমুদ্রে হেলে-দুলে ভাসতে থাকে। পরে একদিন আপনা-আপনিইনৌকাটি কূলে এসে ভীড়ে। আমরা কূলের কাছাকাছিই অবস্থান করছিলাম। এরা আমাদের কাছে চলে আসে। বড় বিপন্ন অবস্থায় ছিল মেয়েগুলো। আমরা এদের আশ্রয় প্রদান করি। এই অসহায় নারীদেরকে তাড়িয়েও দিতে পারছিলাম না; আবার বুঝেও আসছিল না যে, এদেরকে আমরা কী করি। অগত্যা এদেরকে নিয়ে আমরা সম্মুখে রওনা হই এবং একস্থানে এসে ছাউনি ফেলি। হঠাৎ এই আরোহীগণ এসে পড়েন এবং আমাদের তল্লাশী নিতে শুরু করেন। আমরা তাদের নিকট এই তল্লাশীর কারণ জানতে চাই। তারা বললেন, এটা মিসরের গভর্নর সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর নির্দেশ। আমরা অনুনয়-বিনয় করে বলি, আমাদেরকে তোমরা সুলতানের কাছে নিয়ে চল; তাঁকেই আমরা নিবেদন করব, যেন এই অসহায় মেয়েগুলোকে তিনি তাঁর আশ্রয়ে নিয়ে নেন। চলার পথে আমরা এদেরকে কোথায় নিয়ে ফিরব।

মেয়েদের সঙ্গে কথা বললে তারা সিসিলী ভাষায় জবাব দেয়। বড় ভীত-সন্ত্রস্থ মনে হল তাদের। দু তিনজন একত্রেই কথা বলতে শুরু করে। সুলতান সালাহুদ্দীন বণিকদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের কেউ এদের ভাষা বুঝ কি? একজন বলল, শুধু আমি বুঝি। এরা নিবেদন করছে, সুলতান যেন এদেরকে তার আশ্রয়ে নিয়ে নেন। এরা বলছে, আমরা বণিক কাফেলার সঙ্গে যেতে রাজি নই। এমনও হতে পারে, পথে দস্যুরা আমাদের তুলে নিয়ে যাবে। তাছাড়া এখন যুদ্ধ চলছে। সর্বত্র খৃষ্টান ও মুসলিম সেনারা গিজগিজ করছে। আমরা সৈন্যদের অনেক ভয় পাই। ঘর থেকে যখন আমাদেরকে অপহরণ করা হয়, তখন আমরা কুমারী ছিলাম, খৃষ্টান সৈন্যরা জাহাজে আমাদেরকে গণিকায় পরিণত করেছে।

এক মেয়ে কিছু বললে বণিক তার তরজমা করে বলল, ‘মেয়েটি বলছে, আমাদেরকে মুসলমানদের রাজার নিকট পৌঁছিয়ে দিন; হয়ত তিনি আমাদের প্রতি সদয় হবেন।’

মুখ খুলল অপর এক মেয়ে। বণিক বলল, ‘এই মেয়েটি বলছে, আমাদেরকে আর যাই করুন, খৃষ্টান সৈন্যদের হাতে তুলে দেবেন না। কোন সম্ভ্রান্ত মুসলমানের স্ত্রী হতে পারব এই নিশ্চয়তা পেলে আমি মুসলমান হয়ে যাব।’

পিছনে দাঁড়িয়ে মুখ লুকাবার চেষ্টা করছে দু তিনটি মেয়ে। মুখে তাদের ভীতির ছাপ। ভয়ে কিংবা লজ্জায় কথা বলতে পারছে না তারা।

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী বণিককে বললেন, ‘এদেরকে বলুন, এরা খৃষ্টানদের কাছে ফিরে যাক আর না যাক আমরা কিন্তু এদেরকে মুসলমান হতে বাধ্য করব না। এই যে মেয়েটি একজন সম্ভ্রান্ত মুসলমানের স্ত্রী হওয়ার নিশ্চয়তার শর্তে মুসলমান হওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করল, তাকে বলুন, আমি তার প্রস্তাব গ্রহণ করতে পারছি না। কেননা, মেয়েটি এক অপারগ অবস্থায় ও বিপদের মুহূর্তে মুসলমান হতে চাইছে। তাদের বলুন, যদি আমার প্রতি তাদের আস্থা থাকে, তাহলে মুসলিম নারীর ন্যায় তাদেরকে আমি আমার আশ্রয়ে নিয়ে নেব। রাজধানীতে পৌঁছে আমি তাদেরকে জেরুজালেমে খৃষ্টান পাদ্রীদের নিকট পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করব।’

দোভাষী বণিকের মুখে সুলতান সালাহুদ্দীনের সিদ্ধান্তের কথা শুনে মেয়েরা উৎফুল্ল হয়ে উঠে। আনন্দের ঝিলিক ফুটে উঠে তাদের চোখে-মুখে। তারা সুলতান সালাহুদ্দীনের এই সিদ্ধান্তের প্রতি সম্মতি জ্ঞাপন করে। সুলতান সালাহুদ্দীন মেয়েদের জন্য স্বতন্ত্র তাঁবুর ব্যবস্থা করেন এবং বাইরে সর্বক্ষণ একজন প্রহরী নিয়োজিত থাকার নির্দেশ দেন।

বন্দী মেয়েদের তাঁবু কোথায় স্থাপন করা হবে বলতে যাচ্ছিলেন সুলতান সালাহুদ্দীন। এমন সময় তাঁর সম্মুখে নিয়ে আসা হয় ছয়জন খৃষ্টান কয়েদী। লোকগুলোর পরনের কাপড় ভেজা। স্থানে স্থানে রক্তের দাগ ও বালিমাখা। মড়ার মত ফ্যাকাশে চেহারা, বিধ্বস্ত শরীর।

কমাণ্ডার জানায়, এরা এখান থেকে দেড়-দু মাইল দূরে সমুদ্রতীরে বিপর্যস্ত অবস্থায় পড়েছিল। এরা সমুদ্র মাঝে একটি ভাঙ্গা নৌকায় ভাসছিল। ভিতরে পানি ঢুকে একদিন নৌকাটি ডুবে যায়। এরা সাঁতার কেটে বহু কষ্টে কূলে এসে উঠে। ছিল বাইশজন। এখন জীবিত আছে মাত্র এই ছয়জন।

তারা খৃষ্টান বাহিনীর সদস্য। সুলতান সালাহুদ্দীনের সামনে এসে বসে পড়ে ধড়াস্ করে। একজনের চেহারা বলছে, লোকটি সাধারণ সৈনিক নয়। সে কোঁকাচ্ছে। পোশাকে তার রক্তের দাগ নেই; আহতদের চেয়ে বেশী কষ্টে আছে বলে মনে হল তাকে। মেয়েগুলোর প্রতি এক নজর দৃষ্টিপাত করে আবার কোঁকাতে শুরু করে লোকটি।

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর নির্দেশ ছিল, যখন যে ধরা পড়বে, তাকেই যেন তার সামনে হাজির করা হয়। সমুদ্রে খৃষ্টান বাহিনীর নৌ ও সেনাবহর ধ্বংস হওয়ার পর এখন জীবনে রক্ষা পাওয়া খৃষ্টান সেনারা একের পর এক বন্দী হচ্ছে আর নীত হচ্ছে সুলতান সালাহুদ্দীনের দরবারে। সুলতান সালাহুদ্দীন এ বন্দীদের প্রতিও চোখ তুলে তাকালেন; কিন্তু বললেন না কিছুই। তবে অফিসার গোছের যে লোকটি বেশী কোঁকাচ্ছিল এবং যার পোশাকে রক্তের দাগ নেই, তাকে খুটিয়ে খুটিয়ে নিরীক্ষা করে দেখলেন তিনি। ক্ষীণকণ্ঠে সালারদের বললেন, আলী বিন সুফিয়ান এখনও এল না! এই বন্দীদের তো অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করার ছিল, এদের কাছ থেকে তথ্য নেওয়ার প্রয়োজন ছিল। এ কয়েদীর প্রতি ইঙ্গিত করে সুলতান বললেন— ‘এ লোকটিকে কমাণ্ডার বলে মনে হয়। একে চোখে চোখে রাখতে হবে। আলী বিন সুফিয়ান এলে বলবে, এদেরকে যেন ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করে তথ্য নেয়। সম্ভবত এ লোকটা ভিতরে আঘাত পেয়েছে, হাড়-গোড় ভেঙ্গে গেছে। এদের এখনি আহত কয়েদীদের তাঁবুতে পাঠিয়ে দাও। খাবার-পানি দাও, ব্যাণ্ডেজ-চিকিৎসা করাও।’

ছয় পুরুষ বন্দীকে নির্ধারিত তাঁবুর দিকে নিয়ে যাওয়া হল। মেয়েগুলো একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে তাদের প্রতি। তারপর নিয়ে যাওয়া হয় মেয়েদেরও।

* * *

ফৌজি ক্যাম্পের সামান্য দূরে মেয়েদের জন্য তাঁবু স্থাপন করা হচ্ছে। সেখান থেকে কয়েকশ গজ দূরে আহত বন্দীদের তাঁবু। নতুন একটি তাঁবু স্থাপন করা হচ্ছে সেখানেও। পার্শ্বে মাটিতে পড়ে আছে ছয় নতুন আহত বন্দী। মেয়েগুলো তাকিয়ে আছে তাদের প্রতি।

তাঁবু দুটো দাঁড়িয়ে গেছে। মেয়েরা চলে গেছে তাদের তাঁবুতে। আহত বন্দীদের নিয়ে যাওয়া হয় নতুন তাঁবুতে। মেয়েদের তাঁবুর বাইরে দাঁড়িয়ে যায় একজন প্রহরী। অল্পক্ষণের মধ্যে খাবার চলে আসে। মেয়েরা আহার করে নেয়। একটি মেয়ে তাঁবু থেকে বেরিয়ে নতুন আহত বন্দীদের তাঁবুর দিকে তাকিয়ে থাকে। এখন আর তার চেহারায় ভীতির ছাপ নেই। প্রহরী তার দিকে দৃষ্টিপাত করে। সেও প্রহরীর দিকে তাকায়। চোখাচোখি হয় দুজনের। মেয়েটি মুখে হাসি টেনে ইঙ্গিতে বলে, আমি একটু ঐ আহত লোকগুলোর তাঁবুতে যেতে চাই। প্রহরীও ইশারায় তাকে বারণ করে। মেয়েদের তাঁবু থেকে বের হয়ে কোথাও যাওয়ার বা কারও সঙ্গে সাক্ষাৎ করার অনুমতি নেই। মেয়েদের ও আহত বন্দীদের তাঁবুর মাঝে অনেকগুলো বৃক্ষ। বাঁ দিকে মাটির একটি টিলা। টিলাটি ঝোঁপ-ঝাড়ে আচ্ছন্ন।

সূর্য ডুবে গেছে। রাত আঁধার হতে চলেছে। নিদ্রার কোলে ঢলে পড়েছে প্রকৃতি। রাতের নিস্তব্ধতায় আহত বন্দীদের কোঁকানির শব্দ ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। দূরবর্তী রোম উপসাগরের কুলকুল রবও চাপা গুঞ্জনের ন্যায় কানে আসতে আরম্ভ করেছে। কিন্তু সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর নিজের তাঁবুতে বিরাজ করছে দিনের পরিবেশ। কারও চোখে ঘুম নেই সেখানে। তিন সালার উপবিষ্ট সুলতানের কাছে।

সুলতান সালাহুদ্দীন পুনরায় বললেন— ‘আলী বিন সুফিয়ান এখনও এল না?’ কণ্ঠে তার অস্থিরতার সুর। একটু থেমে আবার বললেন— ‘তার দূতও এল না, না?’

‘কোন অসুবিধা হলে তো সংবাদ পেতাম। আশা করি সেখানে সব ঠিক আছে।’ বললেন এক সালার।

‘আশা তো এমনই থাকা উচিত। কিন্তু পঞ্চাশ হাজার সৈন্যই যদি বিদ্রোহ করে বসে, তবে তো সামলানো কঠিন হয়ে পড়বে। আমাদের সৈন্য মাত্র সাড়ে তিন হাজার। দেড় হাজার অশ্বারোহী আর দু হাজার পদাতিক। তাদের মোকালোয় সুদানী সৈন্যরা সংখ্যায় অনেক বেশী, অভিজ্ঞও বটে।’ বললেন সুলতান সালাহুদ্দীন।

‘নাজি ও তার কুচক্রী সহচরদের নির্মূল করার পর বিদ্রোহ করা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ছাড়া সেনাবিদ্রোহ হয় না।’ বললেন অপর এক সালার।

‘আগাম প্রস্তুতি নিয়ে রাখা প্রয়োজন। কিন্তু এর জন্যে যে আলীকে দরকার!’ বললেন সুলতান সালাহুদ্দীন।

ক্রুসেডারদের প্রতিরোধ অভিযানে সুলতান সালাহুদ্দীন নিজেই এসে পড়েছিলেন এখানে। সুদানী সৈন্যদের বিদ্রোহের আশঙ্কা থাকায় আলী বিন সুফিয়ানকে রেখে এসেছিলেন রাজধানীতে। এতক্ষণে ফিরে এসে সুলতানকে সেখানকার পরবর্তী পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করার কথা। কিন্তু আলী এলেন না এখনও । তাই সুলতান অস্থির। ধীরে ধীরে বেড়ে চলেছে তার উৎকণ্ঠা।

সালারদের সঙ্গে কায়রোর পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলছেন সুলতান সালাহুদ্দীন। গোটা ক্যাম্প গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। জেগে আছে শুধু সেই সাতটি মেয়ে, সুলতান সালাহুদ্দীন যাদেরকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। পর্দা ফাঁক করে তাঁবুর ভিতরে উঁকি দিয়ে দেখে প্রহরী। ভিতরে বাতি জ্বলছে। টের পেয়ে জাগ্রত মেয়েগুলো ঘুমের ভান করে নাক ডাকতে শুরু করে। মেয়েগুলোকে গুণে দেখে প্রহরী। ঠিক আছে—সাতজন। ঘুমিয়ে আছে সবাই। পর্দাটা ছেড়ে দিয়ে সরে আসে প্রহরী। বসে পড়ে তাঁবুর কাছ ঘেঁষে।

তাঁবুর পর্দাসংলগ্ন শায়িত মেয়েটি নীচ থেকে পর্দাটা উঁচু করে সতর্কতার সাথে বাইরে তাকায়। পার্শ্বের মেয়েটির কানে কানে বলে, ‘বসে পড়েছে।’ পার্শ্বের জন তার পার্শ্বের জনকেও বলে, ‘বসে পড়েছে।’ এভাবে এক এক করে সব কটি মেয়ের কানে খবর পৌঁছে যায়, ‘প্রহরী বসে পড়েছে।’

তাঁবুর অপর দরজার কাছে শুয়ে আছে যে মেয়েটি, সাবধানে উঠে বসে সে। মাটিতে বিছানো শয্যা। একটি কম্বল বিছানায় এমনভাবে ছড়িয়ে রাখে যে, দেখতে মনে হয়, কম্বলের নীচে একজন মানুষ শুয়ে আছে।

পা টিপে টিপে দরজার নিকটে চলে যায় মেয়েটি। পর্দা সরিয়ে বেরিয়ে পড়ে তাঁবু থেকে। অপর ছয়জন ধীরে ধীরে নাক ডাকতে শুরু করে।

প্রহরী জানে, এরা সমুদ্রের বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়া আশ্রিতা—কোন বিপজ্জনক বন্দী নয়। তাই নিরুদ্বেগ বসে বসে ঝিঁমুচ্ছে সে।

পা টিপে টিপে টিলা অভিমুখে হাঁটা দেয় মেয়েটি। প্রহরীর দৃষ্টি এড়িয়ে টিলার কাছে পৌঁছে মোড় নেয় আরেকটি তাঁবুর দিকে। নতুন বন্দী ছয়জন অবস্থান করছে এ তাঁবুতে। অন্ধকার রাত। বেশ কিছু গাছ-গাছালিও আছে এখানে। প্রহরীরা মেয়েটিকে দেখে ফেলার কোনই জো নেই এখন।

মেয়েটি বসে পড়ে। পা পা করে এগিয়ে চলে সম্মুখে। বালির টিপির মত কতগুলো কি যেন দেখা যাচ্ছে সামনে। সেগুলোর আড়ালে আড়ালে পা টিপে টিপে তাঁবুর নিকটে চলে আসে মেয়েটি। দরজার সামনে টহল দিচ্ছে একজন প্রহরী।

একটি টিপির আড়ালে শুয়ে পড়ে মেয়েটি। কালো ছায়ার মত তাকে দেখে ফেলে প্রহরী। মেয়েটি এখন দুই প্রহরীর মাঝে। একজন নিজের তাঁবুর প্রহরী। অপরজন অন্য জখমীদের তাঁবুর। তার আশঙ্কা, জখমীদের তাঁবুর প্রহরী এদিকে এলে নিশ্চিত ধরা খেয়ে যাবে।

ইতিউতি দৃষ্টি ফেলে, দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করে প্রহরী চলে যায় অন্য জখমীদের তাঁবুর দিকে। এ সুযোগে হামাগুড়ি দিয়ে তাঁবুর সন্নিকটে পৌঁছে যায় মেয়েটি। পর্দা তুলে ঢুকে পড়ে ভিতরে।

তাঁবুর ভেতরটা অন্ধকার। ক্ষীণ কণ্ঠে কোকাচ্ছে দু তিনজন জখমী। সম্ভবত তাঁবুর পর্দা ফাঁক হওয়া দেখে ফেলেছে এদের একজন। তাই অস্ফুট স্বরে জিজ্ঞেস করে— ‘কে?’

‘কে?’ প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে মেয়েটি ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘রবিন কোথায়?’ জবাব আসে, ‘ঐ ওদিকে, তৃতীয়জন।’

গুণে গুণে তৃতীয় ব্যক্তির কাছে চলে যায় মেয়েটি। পা ধরে নাড়া দেয় তার। আওয়াজ আসে— ‘কে?’ মেয়েটি জবাব দেয়— ‘মুবী।’

ধড়মড় করে উঠে বসে রবিন। হাত বাড়িয়ে বাহুবন্ধনে টেনে নেয় মেয়েটিকে। শুইয়ে দেয় নিজের বিছানায়। নিজের ও তার গায়ে একটি কম্বল ছড়িয়ে দিয়ে বলে— ‘প্রহরী এসে পড়তে পারে, আমাকে জড়িয়ে শুয়ে থাক।’

রূপসী কন্যা মুবীর দেহের উষ্ণতা গ্রহণ করে রবিন। মৌনতায় কাটে কিছুক্ষণ। তারপর রবিন বলে, ‘তোমার-আমার এই মিলনে আমি বিস্মিত। এ এক অলৌকিক ঘটনা। এতে প্রমাণিত হয়, যীশুখৃষ্ট আমাদের সাফল্য মঞ্জুর করেছেন।’

ছয় আহত কয়েদীর যাকে সুলতান সালাহুদ্দীন ব্যতিক্রমী এবং উচ্চপদস্ত সেনা বলে অনুমান করেছিলেন, রবিন সেই ব্যক্তি। সুলতান সালাহুদ্দীন বলেও দিয়েছিলেন একে সাধারণ সিপাই বলে মনে হয় না, এর প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখতে হবে। আলী বিন সুফিয়ান এসে তদন্ত নেবে।

‘তোমার জখম কেমন? হাড়-গোড় ভেঙ্গে যায়নি তো?’ জিজ্ঞেস করে মুবী।

‘আমি সম্পূর্ণ ঠিক আছি। একটি আঁচড়ও নেই দেহের কোথাও। সালাহুদ্দীনের সামনে ভান করেছিলাম মাত্র।’ জবাব দেয় রবিন।

‘তাহলে এখানে এসেছ কেন?’ জিজ্ঞেস করে মেয়েটি।

‘মিসর প্রবেশ করে সুদানী বাহিনীর সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য আমি অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু ইসলামী ফৌজ সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে। তাদের দৃষ্টি এড়িয়ে ঢুকবার কোন পথ পেলাম না। অবশেষে কৌশলের আশ্রয় নিলাম। এই পাঁচজন জখমীকে খুঁজে জড় করে জখমীর ভান ধরে এদের সঙ্গে আমিও ঢুকে পড়লাম। এখন তো পালাবারও কোন পথ পাচ্ছি না।’ জবাব দেয় রবিন।

এবার ক্ষুব্ধ কণ্ঠে রবিন বলে, ‘তুমি আমার দুটি প্রশ্নের জবাব দাও। প্রথম প্রশ্ন, সালাহুদ্দীনকে আমি জিন্দা দেখেছি। কারণটা কি? তীর নিঃশেষ হয়ে গেল, নাকি হারামখোরটা কাপুরুষ হয়ে গেল? আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন, তোমরা সাতটি মেয়ের সব কজন মুসলমানদের হাতে বন্দী হলে কেন? ওরা পাঁচজন কি মরে গেছে, নাকি পালিয়ে গেছে?’

‘না, তারা জীবিত আছে। তুমি বলছ, যীশুখৃষ্ট আমাদের বিজয় মঞ্জুর করেছেন। কিন্তু আমি বলছি, আমাদের খোদা আমাদেরকে কোন একটা পাপের শাস্তি দিচ্ছেন। আর সালাহুদ্দীন আইউবীও এখনও জীবিত থাকার কারণ, তীরটা তার দুপায়ের মাঝে বালিতে গিয়ে বিদ্ধ হয়েছিল।’ বলল মুবী।

‘তীর কি কোন মেয়ে ছুঁড়েছিল? ক্রিস্টোফর ছিলেন কোথায়?’ জানতে চায় রবিন।

‘না, তীর ছুঁড়েছিলেন ক্রিস্টোফর নিজেই। কিন্তু…’

‘কিন্তু ক্রিস্টোফরের তীর ব্যর্থ গেছে, তাই না? যার তীরন্দাজী দেখে শাহ অগাস্টাস অভিভূত হয়েছিলেন, এখানে এসে তার নিশানা এতই ব্যর্থ হয়ে গেল যে, ছয় ফুট দীর্ঘ আর তিন ফুট চওড়া একটা সালাহুদ্দীন তার তীর থেকে বেঁচে গেল! অভাগার হাতটা ভয়ে কেঁপে উঠেছিল বোধ হয়।’ বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বলল রবিন।

‘ব্যবধান ছিল অনেক। তাছাড়া ক্রিস্টোফর বললেন, ধনুক থেকে তীরটি বের হবে হবে অবস্থায় একটি পোকা এসে তার চোখে পড়ে এবং সে অবস্থায়ই লক্ষ্যহীনভাবে তীরটি বেরিয়ে যায়।’

‘তারপর কী হল?’

‘যা হওয়ার ছিল, তাই হল। সালাহুদ্দীন আইউবীর সঙ্গে ছিল তিনজন কমাণ্ডার এবং চারজন দেহরক্ষী। তারা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। আমাদের ভাগ্য ভাল ছিল। ক্রিস্টোফর টিলার আড়ালে নিরাপদে ফিরে আসেন। আমরা তীর-ধনুকগুলো বালিতে পুঁতে ফেলে উপরে উট বসিয়ে রাখি। সালাহুদ্দীনের সিপাইরা এসে পড়লে ক্রিস্টোফর জানালেন, তারা পাঁচজন মারাকেশী বণিক আর আমরা ছয়টি মেয়ে সমুদ্র থেকে উদ্ধার পেয়ে তাদের কাছে আশ্রয় নিয়েছি। মুসলিম সৈন্যরা আমাদের সামান-পত্র অনুসন্ধান করে ব্যবসার পণ্য ছাড়া আর কিছুই পেল না। তারা আমাদের সবাইকে সালাহুদ্দীন আইউবীর নিকট নিয়ে যায়। আমরা ভাবে বুঝালাম যে, আমরা সিসিলি ভাষা ছাড়া অন্য কোন ভাষা জানি না। ক্রিস্টোফর সালাহুদ্দীনকে বললেন, তিনি আমাদের ভাষা বুঝেন। আমরা মেয়েরা চেহারায় ভীতি ও শঙ্কার ভাব ফুটিয়ে তুললাম।’

সালাহুদ্দীন আইউবীর সঙ্গে আরও যেসব কথা হল, রবিনকে সবিস্তার সব শোনালো মুবি। এই সাতটি মেয়ে এবং মারাকেশী বণিকবেশী পাঁচজন পুরুষ আক্রমণের দুদিন আগে কুলে অবতরণ করেছিল। বণিকবেশী পুরুষ পাঁচজন ক্রুসেডারদের অভিজ্ঞ গুপ্তচর ও সেনাকমাণ্ডার। মেয়েগুলোও গুপ্তচর। তারা অত্যন্ত রূপসী। গুপ্তচরবৃত্তি ও মনন ধ্বংসের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে তাদের। গোপনে হত্যাকাণ্ড সংঘটনেও তারা বেশ পারদর্শী। পুরুষ পাঁচজনের মিশন ছিল সালাহুদ্দীন আইউবীকে হত্যা করা আর নাজির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা। মিসরের ভাষা অনর্গল বলতে পারত মেয়েগুলো। কিন্তু সালাহুদ্দীন আইউবীর সামনে তা গোপন রাখে তারা। রবিন ছিল এ মিশনের প্রধান। নাজির সঙ্গে সাক্ষাত করার পরিকল্পনা ছিল তার। কিন্তু সালাহুদ্দীন আইউবী ও আলী বিন সুফিয়ানের সতর্ক কৌশলের সাথে পেরে উঠল না তারা।

‘তোমরা কি সালাহুদ্দীন আইউবীকে ফাঁদে ফেলতে পার না?’ জিজ্ঞেস করে রবিন।

‘এখানে সবেমাত্র প্রথম রাত। আমাদের ব্যাপারে তিনি যে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, যদি তা সত্যমনে দিয়ে থাকেন, তাহলে তার অর্থ হল, তিনি মানুষ নন পাষাণ। আমাদের কারও প্রতি তার আকর্ষণ থাকত, তাহলে তিনি রাতে কাউকে না কাউকে নিজের তাঁবুতে অবশ্যই ডেকে পাঠাতেন। লোকটাকে হত্যা করাও অতটা সহজ নয়। একবারই তিনি উপকূলে এসেছিলেন। তীর ছোঁড়া হল। ব্যর্থ গেল তীর। সব সময় তিনি সালার ও রক্ষীদের প্রহরা বেষ্টনীতে থাকেন। এদিকে একজন মাত্র প্রহরী আমাদের মাথার উপর দাঁড়িয়ে আছে আর তার তাঁবুটি ঘিরে রেখে আছে গোটা রক্ষী ইউনিট।

‘ওরা পাঁচজন কোথায়?’ জিজ্ঞেস করে রবিন।

‘এই তো সামান্য দূরে। আপাতত ওরা সেখানেই থাকবে।’ জবাব দেয় মুবী।

‘শোন মুবী! এই পরাজয়টা আমাকে পাগল করে তুলেছে। এ ব্যর্থতার সব দায়-দায়িত্ব যেন চাপছে এসে আমার ঘাড়ে। ক্রুশের উপর হাত রেখে শপথ তো আমরা সকলেই নিয়েছি। কিন্তু সাধারণ সৈনিকদের শপথ আর আমার মত একজন দায়িত্বশীলের শপথে পার্থক্য অনেক। তুমি আমার মর্যাদার প্রতি লক্ষ্য কর। আমার কর্তব্যসমূহকে সামনে রেখে বিবেচনা কর। যুদ্ধের অন্তত অর্ধেকটা আমাদের মটির নীচ থেকে আর পিঠের পিছন থেকে আক্রমণ করে জয়লাভ করার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু আমি, তোমরা সাতজন এবং অরা পাঁচজন নিজেদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছি। এই ক্রুশ আমার থেকে জবাব চাইছে।’

গলায় ঝুলন্ত ক্রুশটা হাতে নিয়ে রবিন বলল— ‘এটিকে আমি আমার বুক থেকে আলাদা করতে পারি না।’

রবিন মুবীর বুকে হাত বুলিয়ে তার ক্রুশটাও হাতে নিয়ে বলল, ‘তুমি তোমার পিতা-মাতাকে ধোকা দিতে পার, কিন্তু এই ক্রুশের মর্যাদা রক্ষায় উদাসীন হতে পার না। তোমার উপর যে দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়েছে, তা তোমাকে পালন করতেই হবে। খোদা তোমাকে যে রূপ দিয়েছেন, তাই তোমাকে পাথর চিড়ে পথ করে দেবে। আমি তোমাকে আবার বলছি, আমাদের এই আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত মিলন প্রমাণ করে, সফল আমরা হবই। আমাদের বাহিনী রোম উপসাগরের ওপারে সংগঠিত হচ্ছে। যারা মারা গেছে, তারা তো মারা গেছে। যারা জীবিত আছে, তারা জানে, এটি কোন পরাজয় নয়—ছিল এক প্রতারণা। তুমি তোমার তাঁবুতে ফিরে যাও; সঙ্গী মেয়েদের বল, তারা যেন তাঁবুতেই পড়ে না থাকে। বারংবার যেন সালাহুদ্দীন আইউবী ও তার সালারদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তার মন জয় করার চেষ্টা করে এবং মুসলমান হওয়ার ভান ধরে। তারপর কী করতে হবে, তা তাদের জানা আছে।’

‘সর্বাগ্রে আমাদের জানা দরকার, ঘটনাটা ঘটল কী? সুদানীরা কি আমাদেরকে ধোকা দিল?’ বলল মুবী।

‘তা আমি নিশ্চয়তার সাথে বলতে পারছি না। হামলার অনেক আগে আমি মিসরে কর্তব্যরত আমার গুপ্তচরদের মাধ্যমে তথ্য পেয়েছিলাম, সুদানী সৈন্যদের উপর সালাহুদ্দীন আইউবীর আস্থা নেই। অথচ তারা মিসরে মুসলমানদের নিজস্ব বাহিনী। সালাহুদ্দীন এসে যখন মিসরী বাহিনী গঠন করলেন, তখন তারা এই বাহিনীতে শামিল হতে অসম্মতি জানায়। তাদের কমাণ্ডার নাজি আমাদের সাহায্য প্রার্থনা করল। আমি নিজে তার পত্র দেখেছি এবং সত্যায়ন করেছি যে, হ্যাঁ, এটি নাজিরই পত্র এবং এতে কোন প্রতারণা নেই। এখন আমার জানতে হবে, এমনটি কেন ঘটল এবং কে ঘটাল। তথ্য সন্ধান নিয়ে নিশ্চিত না হয়ে আমি ফিরছি না। আমাকে লক্ষ্য করে শাহ আগাস্টাস বড় গর্ব করে বলেছিলেন, আমি মুসলমানদের ঘর থেকে একান্ত ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করে তাদের ভিত্তিমূলে আঘাত হানতে পারব। এখন চিন্তা কর মুবী! এ ঘটনায় শাহ অগাস্টাস কত মারাত্মক আঘাত পেয়েছেন। তিনি কি আমাকে মৃত্যুদণ্ড অপেক্ষা লঘু শাস্তি দিয়ে রক্ষা করবেন? উপরন্তু ক্রুশের অভিশাপ তো আছেই।’ বলল রবিন।

‘আমি সবই জানি রবিন। আবেগ ছেড়ে কাজের কথা বল। এখন আমার করণীয় কী তাই বল।’ বলল মুবী।

শোচনীয় পরাজয়ের কথা স্মরণ করে অবচেতন মনে কথা বলছে রবিন। মুবীর মত চিত্তাকর্ষক এক রূপসী তরুণী যে তার বুকের সঙ্গে জড়ানো, একটি তন্বী-তরুণীর রেশম-কোমল এলোকেশগুচ্ছে যে তার মুখমণ্ডলের অর্ধেকটা আচ্ছন্ন, সে খবরই নেই তার। হঠাৎ মেয়েটার কোমল চুলের পরশ অনুভব করে রবিন বলে ওঠে, ‘মুবী! তোমার এই চুল এমনই শক্ত শিকল যে, সালাহুদ্দীন আইউবীকে এ শিকলে একবার বাঁধতে পারলেই দেখবে, বেটা তোমার গোলামে পরিণত হয়ে গেছে। কিন্তু সর্বাগ্রে তোমাকে যে, কাজটি করতে হবে, তাহল, ক্রিস্টোফর ও তার সঙ্গীদের বলবে, তারা যেন বণিকের বেশ ধরে নাজির নিকট যায় এবং তথ্য সংগ্রহ করে, তার বাহিনী কেন বিশ্বাসঘাতকতা করল এবং আমাদের গোপন তথ্য কিভাবে ফাঁস হয়ে গেল যে, সালাহুদ্দীন গুটিকতক সৈন্য দিয়ে কমাণ্ডো আক্রমণ চালিয়ে আমাদের তিন তিনটি সেনাবহর ধ্বংস করে দিল। তাদেরকে এ বিষয়টিও জেনে নিতে বলবে, নাজি তলে তলে সালাহুদ্দীন আইউবীর সঙ্গে মিলে গেল কিনা। আমাদের এভাবে ধ্বংস করার জন্যই। প্রতারণামূলক পত্র লিখল কিনা। তাই যদি হয়ে থাকে, তাহলে আমাদেরকে আমাদের যুদ্ধ-পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনতে হবে। আমি একটি বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছি, ইসলামপন্থীরা সংখ্যায় যত নগণ্যই হোক, সম্মুখসমরে সহজে আমরা তাদেরকে পরাজিত করতে পারব না। তাই তাদের শাসকমণ্ডলী ও সামরিক অধিনায়কদের ঈমানী চেতনা ধ্বংস করতে হবে আগে। এ লক্ষ্যে আমরা তোমার মত বেশ কিছু মেয়েকে আরব শাসকদের হেরেমে ঢুকিয়ে রেখেছি।’

‘আবারও তুমি কথা লম্বা করছ’ —বাধা দিয়ে মুবী বলল— ‘আমরা নিজ বাসভবনে এক শয্যায় শুয়ে নেই। আমরা এখন দুশমনের হাতে বন্দী। বাইরে প্রহরীরা টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। রাত কেটে যাচ্ছে। হাতে সময় বেশী নেই। মিশন ব্যর্থ হয়ে গেছে। এখন ভবিষ্যত পরিকল্পনা কী হবে, তাই বল। আমরা সাতটি মেয়ে এবং পাঁচজন পুরুষ। বল কী করব। এক তো বুঝলাম, নাজির কাছে যেতে হবে, তার প্রতারণার সন্ধান নিতে হবে। তারপর তোমাকে সংবাদ জানাব কী করে? তোমাকে পাব কোথায়?’

আমি এখান থেকে পালিয়ে যাব। তার আগে আমি এই ক্যাম্প, ক্যাম্পের লোকসংখ্যা এবং সালাহুদ্দীনের ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য নেব। এই লোকটি সম্পর্কে আমাদের অনেক সতর্ক থাকতে হবে। বর্তমানে মুসলিম বিশ্বে ক্রুশের জন্য একমাত্র বিপদ এই লোকটি। অন্যথায় ইসলামী খেলাফত আমাদের জালে আটকা পড়ে গেছে। শাহ এম্লার্ক বলতেন, মুসলমানরা এতই শক্তিহীন হয়ে পড়েছে যে, এখন চিরদিনের জন্য তাদেরকে আমাদের গোলামে পরিণত করতে প্রয়োজন একটিমাত্র ধাক্কা। কিন্তু তার এই প্রত্যয় আত্মপ্রবঞ্চনা বলেই প্রমাণিত হল। এখানে অবস্থান করে আমাকে সালাহুদ্দীনের দুর্বল শিরাগুলো চিহ্নিত করতে হবে। তোমাদের পুরুষ পাঁচজনকে সঙ্গে নিয়ে সুদানী বাহিনীকে ক্ষেপিয়ে তুলতে হবে, তাদের দিয়ে বিদ্রোহ করাতে হবে। তরে মনে রাখবে, সবচে বেশী প্রয়োজন হল, সালাহুদ্দীন যেন জীবিত থাকতে না পারে। থাকেও যদি থাকবে আমাদের জিন্দানখানার সেই অন্ধকার প্রকোষ্ঠে, যেখানে জীবনের শেষ মুহূর্তটি পর্যন্ত কখনও সূর্য চোখে দেখবে না, নজরে আসবে না আকাশের একটি তারকাও। তুমি আগে তোমার তাঁবুতে যাও এবং সহকর্মী মেয়েদেরকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দাও। তাদের বিশেষভাবে জানিয়ে দাও, একটি লোককে তোমাদের এই রেশম-কোমল চুল, মায়াবী চোখ আর হৃদয়কাড়া দেহ দিয়ে এমনভাবে অথর্ব করে দিতে হবে, যেন সে সালাহুদ্দীনের আর কোন কাজেই না আসে। সম্ভব হলে তার ও সালাহুদ্দীনের মাঝে এমন ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি করতে হবে, যেন তারা একজন অপরজনের শত্রুতে পরিণত হয়ে যায়। ভাল করে মনে রেখো, লোকটার নাম আলী বিন সুফিয়ান।’

‘দুজন পুরুষের মধ্যে কিভাবে দুশমনি সৃষ্টি করতে হয়, তা তোমরা ভাল করেই জান। যাও, সহকর্মী মেয়েদের ভাল ভাবে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে ক্রিস্টোফরের নিকট পৌঁছে যাও। তাকে আমার সালাম জানিয়ে বলবে, তোমার তীর বুঝি সালাহুদ্দীনের উপর এসেই ব্যর্থ হল? এবার সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত্ব দাও আর তোমার উপর যে দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে, তা কড়ায় গণ্ডায় আদায় কর।’

মুবীর চুলে চুমু খেয়ে রবিন বলল— ‘ক্রুশের জন্য প্রয়োজনে তোমাদের সম্ভমও বিলিয়ে দিতে হবে। তারপরও যীশুখৃষ্টের দৃষ্টিতে তোমরা মা মরিয়মের মত কুমারীই থাকবে। ইসলামকে মূল থেকে উপড়ে ফেলতে হবে। আমরা জেরুজালেম দখল করেছি, এবার মিসর জয় করার পালা।’

* * *