সন্ধ্যা ঘনিয়ে গেছে অনেকক্ষণ। মনিরা সাজগোজ করে ড্রইং রুমে বসে বসে বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছে আর বারবার তাকাচ্ছে দেয়াল ঘড়িটার দিকে।
আজ রাত সাড়ে আটটায় এক বান্ধবীর বাড়িতে তার দাওয়াত আছে। মনিরা বনহুরকে বলে দিয়েছে। অবশ্য অবশ্য সে যেন গাড়ি নিয়ে আসে, তার গাড়িতেই যাবে মনিরা। নইলে সন্ধ্যার পর বাইরে বেরুবার সাহস নেই তার। চৌধুরী সাহেবও বারণ করে দিয়েছেন।
মনিরা উদ্বিগ্নভাবে পায়চারী শুরু করে, হাতঘড়ির দিকে তাকায়–আটটা বেজে গেছে।
এমন সময় গাড়ি-বারান্দায় মোটর থামার শব্দ হয়। পরক্ষণেই কক্ষে প্রবেশ করে বনহুর, হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলে বড় দেরী হয়ে গেছে, না?
মনিরা টেবিল থেকে ভ্যানিটি ব্যাগটা হাতে উঠিয়ে নিয়ে বলে–চলো।
অমনি মরিয়ম বেগম দু’জনের পাশে এসে দাঁড়ান। বনহুরকে লক্ষ্য করে বলেন–দেখ বাবা, তোমার ওপর ভরসা করেই ওকে বাইরে পাঠাচ্ছি। দস্যু বনহুরের ভয়ে আমার তো কণ্ঠনালী শুকিয়ে গেছে, আবার না সে মনির ওপর হামলা করে বসে।
মরিয়ম বেগমের ব্যখাকাতর কণ্ঠস্বর বনহুরের হৃদয়ে আঘাত করলো। তার মা, তার গর্ভধারিণী জননী আজ তারই ভয়ে ভীত। আজ তার নিকটে পুত্র পরিচয় দেবার কোন অধিকার নেই। বনহুরের চোখ দুটো অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠলো। তার অবাধ্য কণ্ঠ দিয়ে হঠাৎ একটা অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে এলো–মা।
মরিয়ম বেগম বিস্ময়ভরা চোখে তাকালেন বনহুরের মুখে। এই মা ডাক তাঁর প্রাণে এক অপূর্ব শিহরণ জাগালো। মাতৃহৃদয় আকুলি বাকুলি করে উঠলো। তিনি আর চুপ থাকতে পারলেন না। জবাব দিল বল বাবা?
বনহুর ততক্ষণে সামলে নিয়েছে। হেসে বলেন–দস্যু বনহুর আপনার কোন অন্যায় করবে না। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।
যাও বাবা, ওদিকে মনিরার সময় হয়ে এলো।
চলো মনিরা।
বনহুর আর মনিরা পাশাপাশি ড্রাইভ আসনে ওঠে বসলো। জনমুখর রাজপথ ধরে গাড়ি ছুটে চলেছে।
মনিরার শাড়ির আঁচলখানা বারবার বনহুরের গায়ে উড়ে উড়ে পড়ছিল। একটা সুমিষ্ট গন্ধ, বনহুরের প্রাণে দোলা লাগে।
বনহুর মৃদু হেসে বলে–মনিরা!
বলো?
এই নির্জন গাড়ির মধ্যে যদি মি. জামান না হয়ে দস্যু বনহুর থাকতো তোমার পাশে?
মনিরা দক্ষিণ হাতে বনহুরের মুখ চেপে ধরে ও নাম তুমি মুখে এনো, ভয়ে আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে।
মনিরা!
বলো?
দস্যু বনহুর কি মানুষ নয়?
মনিরা বনহুরের আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে–ওসব আলোচনা না-ই বা করলে।
মনিরা, ধর বনহুর তোমাকে খুব ভালবেসে ফেলেছে, তার প্রতিদানে তাকে তুমি ভালবাসতে পারো না?
ছিঃ এসব কি বলছো? যে মানুষ নামের কলঙ্ক, তাকে নিয়ে তুমি ঠাট্টা করছো
মনিরা! অস্কুট ধ্বনি করে ওঠে বনহুর।
মনিরা চমকে উঠে বলে–কি হলো?
কিছু না। ব্রেক কষে গাড়ি থামিয়ে ফেলে এসে গেছি।
বনহুর আর মনিরা কক্ষ থেকে চলে যাবার পর মরিয়ম বেগম সোফায় বসতে যাবেন, হঠাৎ সোফার পাশে একখানা নীল রঙের কাগজ পড়ে আছে। দেখতে পান।
কাগজখানা হাতে উঠিয়ে নিয়েই চমকে ওঠেন। তাতে লেখা রয়েছে–
আজ রাতে আমি আসবো
–দস্যু বনহুর
মরিয়ম বেগমের কম্পিত হাত থেকে কাগজখানা পড়ে যায়। ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে যান তিনি।
কিছুক্ষণের মধ্যে চৌধুরী সাহেব এসে পড়েন। স্ত্রীকে বিবর্ণ মুখে বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করেন–অমন গম্ভীর হয়ে বসে আছ কেন?
মরিয়ম বেগম আংগুল দিয়ে কাগজখানা দেখিয়ে দেন।
চৌধুরী সাহেব কাগজখানা হাতে উঠিয়ে নিয়ে দৃষ্টি বুলাতেই থ হয়ে গেছেন, ঢোক গিলে বলেন–তাহলে উপায়?
মরিয়ম বেগম বলেন–এক্ষুণি পুলিশে খবর দাও।
ঠিক বলেছ। চৌধুরীসাহেব কালবিলম্ব না করে পুলিশ অফিসে ফোন করলেন। এইমাত্র দস্যু বনহুরের চিঠি পেয়েছি আমরা তো ভীষণ ভয় পাচ্ছি, মনিরাকে নিয়ে আমাদের যত ভাবনা। মি. হারুন, আপনিই এখন আমাদের ভরসা।
মনিরাকে নিয়ে বনহুর যখন ফিরে এলো, তখন চৌধুরীবাড়ি পুলিশে ভরে গেছে। মি. হারুন উদ্বিগ্নভাবে পায়চারী করছেন আর বলছেন–চৌধুরী সাহেব, এই ঘটনার পরও মনিরাকে সন্ধ্যার পর বাইরে পাঠানো আপনার উচিত হয়নি।
চৌধুরী সাহেব স্বাভাবিক কণ্ঠে জবাব দেন ইন্সপেক্টার সাহেব, মনিরার সঙ্গে জামান আছে, সে সঙ্গে থাকলে ইনশাআল্লাহ-আমাদের আশঙ্কা করার কিছু নেই।
এসব আলোচনা চলছে, ঠিক সে সময় বনহুর আর মনিরা হাস্যোজ্জ্বল মুখে কক্ষে প্রবেশ করলো।
চৌধুরী সাহেব কলকণ্ঠে বলে ওঠেন–ঐ যে মনি এসে গেছে? দেখুন ইন্সপেক্টার সাহেব, আমি বললাম না আমাদের জামান থাকতে ওর কোন চিন্তা নেই।
একথা মিথ্যে নয় চৌধুরী সাহেব। জামান সাহেব সত্যই একজন বীর পুরুষ। কথাটা বলেন মি. হারুন।
মনিরা ব্যগ্রকণ্ঠে প্রশ্ন করে মামুজান, হঠাৎ ইনারা? আমি কিছু বুঝতে পারছিনে?
চৌধুরী সাহেব ভয়ার্তকণ্ঠে বলেন–ভয়ঙ্কর একটা ঘটনা ঘটে গেছে।
বনহুর আশ্চর্য হবার ভান করে বলে–ভয়ঙ্কর ঘটনা! বলছেন কি? হঠাৎ কি ঘটলো?..
এই দেখ! চৌধুরী সাহেব নীল রঙের কাগজখানা পকেট থেকে বের করে বনহুরের হাতে দেন।
বনহুরের মুখে মৃদু হাসি ফুটে ওঠে। কাগজখানা চৌধুরী সাহেবের হাতে দিয়ে বলে ভয় পাবার কিছু নেই।
–তার মানে? বিস্ময়ভরা গলায় বলে ওঠেন মি. হারুন। দস্যু বনহুরের চিঠি, অথচ আপনি বলছেন ভয় পাবার কিছু নেই।
ওটা বনহুরের একটা খেয়াল, বিশেষ করে পুলিশ মহলকে সে নাচিয়ে বেড়াচ্ছে
আপনি দস্যু বনহুর সম্বন্ধে তেমন কিছু জানেন না, তাই ও কথা বলতে পারলেন। দস্যু বনহুর যে কত ভয়ঙ্কর তা শুধুমাত্র একদিনের লড়াইয়ে অনুভব করতে পারেননি সেদিন কোন বেকায়দায় পড়ে আপনার হাতে–
সে কাবু হয়েছে, কি বলেন? কথাটা বলে হাসে বনহুর।
চৌধুরী সাহেব বলে ওঠেন—সে যাই হইক বাবা, আজ আমি তোমাকে কিছুতেই ছেড়ে দেব না, থাকতেই হবে আমাদের এখানে।
তা কি করে হয় বলুন, বাসায় একটা জরুরী কাজ আছে।
তা রাতের বেলা এমন আর কি কাজ। থেকেই যান মি. জামান। কথাটা বিনয়ের সঙ্গে বলেন মি. হারুন।
মনিরার মুখের দিকে তাকায় বনহুর। মনিরার মুখমণ্ডল ফ্যাকাশে বিবর্ণ হয়ে উঠেছে, করুণ দৃষ্টির মাধ্যমে বনহুরকে সে থাকার অনুরোধ জানায়।
অগ্যতা বনহুর থাকবে বলে কথা দেয়।
চৌধুরী সাহেব কতকটা আশ্বস্ত হন। মি. হারুনের মুখেও হাসি ফুটে ওঠে, যাক তবু একজন শক্তিশালী সাহসী ব্যক্তি আজ তাদের সঙ্গী হলো–যদি দস্যু বনহুর এসেই পড়ে, কৌশলে তাকে বন্দী করার সুযোগ হলেও হয়ে যেতে পারে।
গভীর রাত।
সে হোটেল, হোটেলের সম্মুখে একটি গাড়ি এসে থেমে ছিল।
অমনি একটা থামের আড়ালে লুকিয়ে ছিল দুটি ছায়ামূর্তি।
গাড়ি থেকে নামলো সে কাবুলীওয়ালা। অন্ধকারে চারিদিকে একবার তাকিয়ে দেখলো, তারপর দ্রুত হোটেলে প্রবেশ করলো।
ছায়ামূর্তি দুটি অতি গোপনে কাবুলীওয়ালাকে অনুসরণ করলো, হোটেলের বাইরে অন্ধকারে লুকিয়ে রইলো পুলিশ ফোর্স। ছায়ামূর্তি দুটি অন্য কেউ নয়, একজন মি. শঙ্কর রাও, অন্যজন গোপালবাবু। তারা অতি সাবধানে এগিয়ে চলেন।
কিছুদূর এগুতেই শুনতে পেলেন তাঁরা একটা গম্ভীর কণ্ঠস্বর। মি. শঙ্কর রাও কান পেতে চেষ্টা করলেন, কোন এক গোপন কক্ষ থেকে আওয়াজ ভেসে আসছে–একটা লোকের সঙ্গে তোমরা এতগুলো লোক পারলে না, তোমরা কাপুরুষ। যত টাকা লাগে লাগবে, মেয়েটাকে আমার চাই। নইলে মনে রেখ, তোমাদের প্রত্যেককে আমি গুলি করে হত্যা করবো।
একটা ভারী কর্কশ কণ্ঠস্বর–হুজুর, সবাই পালিয়ে গেলেও আমি পালাইনি, শেষ পর্যন্ত আপ্রাণ চেষ্টা করেছি–
পুনরায় পূর্বের কণ্ঠ–আমি কোন কৈফিয়ত শুনতে চাইনে। এবার যদি তোমরা বিফল হও, আমি কাউকে ক্ষমা করবো না।
নির্জন নিস্তব্ধ হোটেলের ভিতরে জেগে উঠলো ভারী বুটের শব্দ। কেউ যেন এগিয়ে আসছে।
জমকালো রিভলবারটা দক্ষিণ হাতে চেপে ধরে দেয়ালে ঠেশ দিয়ে দাঁড়ালেন মি. শঙ্কর রাও।
গোপাল বাবু তার কানে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলেন–দস্যু বনহুর এদিকেই আসছে।
হ্যাঁ, তুমি রিভলবার ঠিক রেখে সাবধানে দাঁড়াও।
অন্ধকারে লক্ষ্য করলেন শঙ্কর রাও, হোটেল থেকে বেরিয়ে আসছে সে কাবুলীওয়ালা। অমনি এক লাফে মি. শঙ্কর রাও কাবুলীওয়ালার সম্মুখে দাঁড়িয়ে রিভলবার বাকিয়ে ধরলেন, খবরদার, নড়বে না, নড়লেই মৃত্যু।
হঠাৎ এ বিপদের জন্য ঘাবড়ে গেল কাবুলীওয়ালা।
গোপালবাবু ততক্ষণে বাঁশিতে ফুঁ দিয়েছেন।
মুহূর্তে হোটেলকক্ষ পুলিশ ফোর্সে ভরে উঠলো।
ধীরে ধীরে হাত তুলে দাঁড়ালো কাবুলীওয়ালা।
একজন পুলিশ অফিসার তার হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিল।
মি. শঙ্কর রাও অন্যান্য পুলিশকে ইঙ্গিত করলেন হোটেলের ভিতরে প্রবেশ করে দস্যুর অনুচরগণকে বন্দী করতে কিন্তু হোটেলে কোথাও কাউকে পাওয়া গেল না, সবাই যেন হাওয়ায় মিশে গেছে।
মি. শঙ্কর রাও এবং গোপাল বাবু পুলিশ ফোর্স নিয়ে বীরদর্পে ফিরে চলেন। তাদের মনে আনন্দ ধরে না। দস্যু বনহুরকে বন্দী করতে পেরেছেন, এটাই সবচেয়ে বড় আনন্দের কথা।
কাবুলীওয়ালাকে হাজতে বন্দী করে কড়া পাহারায় রেখে মি. শঙ্কর রাও যখন বাসায় ফিরলেন, তখন আশ্চর্য হয়ে গেল, পুলিশ ইন্সপেক্টার মি. হারুন তার জন্য অপেক্ষা করছেন।
মি. শঙ্কর রাওকে দেখামাত্র মি. হারুনু বলে ওঠেন—আপনি এসে গেছেন ভালই হলো। এক্ষুণি আপনাকে চৌধুরী বাড়ি যেতে হবে।
কেন?
দস্যু বনহুর চিঠি দিয়েছে, সে নাকি আজ রাতে হানা দেবে।
বলেন কি, দস্যু বনহুর।
হ্যাঁ।
কিন্তু তাকে আমি এইমাত্র হাজতে বন্দী করে রেখে এলাম।
সে কি রকম।
আপনাকে পুলিশ অফিসে না পেয়ে মি. আহমদের নিকট পারমিশন, নিয়ে পুলিশফোর্স সঙ্গে করে সে হোটেলে হানা দিয়েছিলাম। দস্যু বনহুরকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছি। গর্বিতভাবে বলেন মি. শঙ্কর রাও।
মি. হারুন বিস্ময়ভরাকণ্ঠে বলেন–দস্যু বনহুরকে এত সহজেই গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছেন, বড় আশ্চর্যের কথা! চলুন, প্রথমে তাকে
একবার স্বচক্ষে দেখে আসি। উঠে পড়েন ইন্সপেক্টার মি. হারুন।
চলুন।
দেখুন আপনি এইমাত্র ক্লান্ত হয়ে ফিরলেন, পুনরায় কষ্ট করে–না না, এতে আমার কিছু মাত্র কষ্ট হবে না।
গাড়িতে উঠে বসেন মি. হারুন এবং শঙ্কর রাও।
পুলিশ অফিসে পৌঁছতেই শশব্যস্তে এগিয়ে এলেন সাবইন্সপেক্টার মি. কায়সার-স্যার, চৌধুরী বাড়ি থেকে আপনার নিকট ফোন এসেছে। এইমাত্র নাকি দস্যু বনহুরের আর একখানা চিঠি পাওয়া গেছে।
একসঙ্গে বলে উঠেন মি. হারুন এবং শঙ্কর রাও–দস্যু বনহুরের চিঠি!
ইয়েস স্যার!
মি. শঙ্কর রাও বলে ওঠেন–চলুন দেখবেন, আমি দস্যু বনহুরকে বন্দী করতে সক্ষম হয়েছি কিনা।
চলুন।
আরও কয়েকজন অফিসারসহ মি. হারুন এবং মি. শঙ্কর রাও হাজত কক্ষে প্রবেশ করলেন। মি. হারুন ও মি. শঙ্কর রাও এগিয়ে যান কাবুলীওয়ালাবেশী বন্দীর দিকে।
মি. হারুন সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে কিছুক্ষণ তাকালেন.বন্দীর মুখে, তারপর হেসে বলেন–দস্যু বনহুর এ নয়, মি. রাও।
তার মানে?
মানে এই দেখুন। একটানে কাবুলীওয়ালার দাড়ি খুলে ফেলেন মি. হারুন
সকলে বিস্ময়ে চমকে ওঠেন। মি. শঙ্কর রাও অবাক হয়ে বলেন–একি, এ যে খানবাহাদুর সাহেবের ছেলে মি. মুরাদ!
মি. হারুন বলে ওঠেন–শিগগির চলুন, বনহুর হয়তো এতক্ষণে চৌধুরীবাড়িতে হানা দিয়েছে।
আর এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে মি. হারুন, মি. শঙ্কর রাও এবং গোপাল বাবু ছুটলেন চৌধুরীবাড়ির উদ্দেশ্যে। যদিও সেখানে পুলিশ পাহারা রাখা হয়েছে, তবুও তারা নিশ্চিন্ত নন।
কিছুক্ষণের মধ্যে পৌঁছে গেল তারা চৌধুরীবাড়িতে। কিন্তু পৌঁছতেই চৌধুরী সাহেব হস্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন–ইন্সপেক্টার সাহেব, এত কড়া পাহারার মধ্যেও দস্যু বনহুর এসেছিল।
বলেন কি!
হ্যাঁ, আপনি এদিকে পাহারার ব্যবস্থা করে চলে যাবার পর আমি বড় ক্লান্তি অনুভব করলাম। তাই একটু বিশ্রামের জন্য নিজের কক্ষে গেলাম, দরজা বন্ধ করে যেমনি বিছানায় শুতে যাব, অমনি আমার সম্মুখে এসে দাঁড়ালো এক ছায়ামূর্তি! কি ভয়ংকর তার চেহারা, রিভলবার উদ্যত করে বলেন সে ভয় নেই, আমি আপনাকে হত্যা করবো না, কিন্তু আমার একটা কথা আপনাকে রাখতে হবে–একটু থামলেন চৌধুরী সাহেব।
কক্ষের সকলে স্তব্ধ নিশ্বাসে শুনছেন তার কথাগুলো। মি. হারুন একবার কক্ষের চারিদিকে তাকিয়ে নিলেন।
চৌধুরী সাহেবের অনতিদূরেই দাঁড়িয়ে আছে মনিরা, তার ওপাশেই আর একটা সোফায় বসে আছে বনহুর। মি. হারুন কক্ষে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিতেই বনহুরের দৃষ্টি বিনিময় হলো।
চৌধুরী সাহেব বলে চলেন আমি বললাম, তুমিই দস্যু বনহুর? সে জবাব দিল, হ্যাঁ, আমার কথা না রাখলে মৃত্যু আপনার অনিবার্য। আমি ভয়ে কম্পিতকণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম, বলো তুমি কি বলতে চাও? সে বলেন–সাবধান, মনিরার বিনা অনুমতিতে কখনও তাকে বিয়ে দিতে যাবেন না যেন। কথা শেষ করেই সুইচ টিপে ঘর অন্ধকার করে ফেললো। আমি সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে উঠলাম। সবাই যখন ছুটে এলো, আলো জ্বেলে দেখি কোথায় বনহুর, কেউ নেই!
মি. হারুন গম্ভীরকণ্ঠে উচ্চারণ করলেন–হুঁ।
মি. শঙ্কর রাও বলে ওঠেন–আপনার ভাগ্নির বিয়েতে মতামত সম্বন্ধে দস্যু বনহুরের কি স্বার্থ থাকতে পারে?
চৌধুরী সাহেব বলেন–নিশ্চয়ই বনহুরের দৃষ্টি আমার মনিরার উপর পড়েছে।
সে কথা মিথ্যে নয়, চৌধুরী সাহেব। এ না হলে সে এখানে আসতে যাবে কেন? সত্যি আমি বড় দুঃখিত, নিজে থেকেও তাকে গ্রেপ্তার করতে পারলাম না। কথাগুলো বলেন দস্যু বনহুর।
না, না, এতে দুঃখ করার কিছু নেই বাবা! তুমিই বা এ অবস্থায় কি করবে। চৌধুরী সাহেব বনহুরকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করেন।
মি. হারুন হঠাৎ গম্ভীরকণ্ঠে বলে ওঠেন চৌধুরী সাহেব, বনহুরকে আজ আমি গ্রেপ্তার করবোই।
সকলেই বিস্ময়ভরা নয়নে তাকালেন মি. হারুনের মুখে।
মি. হারুন তেমনিভাবেই বলেন সে এ কক্ষেই বিদ্যমান। একসংগে বলে ওঠেন–বলেন কি!
মনিরা ভয়ার্ত চোখে তাকালো কক্ষের চারিদিকে আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ালো বনহুরের পাশে। সবচেয়ে নিরাপদ স্থান যেন ওর ওটা।
মি. হারুন ঠিক সে মুহূর্তে রিভলবার বের করে উদ্যত করে ধরলেন বনহুরের দিকে এবং পুলিশদেরকে বলেন–ঐ ভদ্র যুবককে গ্রেপ্তার কর।
মনিরা স্তব্ধ নিঃশ্বাসে তাকালো বনহুরের মুখে। বনহুরও একবার তাকিয়ে নিল মনিরার মুখের দিকে। তারপর চোখের পলক মাত্র; আচমকা এক ঝটকায় মি. হারুনের হাত থেকে রিভলবার কেড়ে নিয়ে লাফিয়ে ছিল মুক্ত জানালা দিয়ে বাইরের অন্ধকারে।
পুলিশ ফোর্স একসঙ্গে গুলি ছুঁড়লো—গুডুম গুড়ুম। কতকগুলো পুলিশ। ছুটলো অন্ধকারে।
মনিরার মনে তখন ঝড়ের তাণ্ডব বইতে শুরু করেছে। কম্পিত প্রাণে সে আল্লাহকে স্মরণ করলো–হে আল্লাহ, ওকে তুমি বাঁচিয়ে নাও। ওকে বাঁচিয়ে নাও!
চৌধুরী সাহেব মেরে গেছেন। তাঁর শুষ্ক কণ্ঠ দিয়ে বেরিয়ে এলো–এ কি করে সম্ভব হয়? মনে মনে একটা গভীর ব্যথা অনুভব করেন। চোখ দুটো কেমন যেন ঝাপসা হয়ে আসে।
মি. হারুন হাবা হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ঘটনার আকস্মিকতায় তিনি হতভম্ব হয়ে ছিল। এর জন্য তিনি মোটেও প্রস্তুত ছিল না। এত দ্রুত তার হাত থেকে বনহুর রিভলবার ছিনিয়ে নিয়ে জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়ল যে, কিসে কি হলো মি. হারুন বুঝতেই পারলেন না। চেহারা তার বিবর্ণ হয়ে উঠেছে। দস্যু বনহুরকে এত নিকটে পেয়েও হারালেন!
মি. শংকর রাও হেসে বলেন–ইন্সপেক্টার সাহেব, দস্যু বনহুরকে গ্রেপ্তার করা যত সহজ মনে করা যায়, তত সহজ নয়।
মি. হারুন বলে ওঠেন–কিন্তু আমি দেখে নেবো দস্যু বনহুরকে গ্রেপ্তার করতে পারি কিনা! কথাটা বলে কক্ষ থেকে বেরিয়ে যান মি. হারুন। অন্যান্য পুলিশ অফিসার এবং পুলিশগণ তাকে অনুসরণ করে।