» » পাঁচ

বর্ণাকার

ভোরে ঘুম ভাঙতেই চোখ মেলে তাকালো মনিরা। মুক্ত জানালা দিয়ে ভোরের মিষ্টি হাওয়া তাকে সাদর সম্ভাষণ জানালো। হাই তুলে উঠে বসলো সে। হঠাৎ তার নজর গেল হাতের আঙ্গুলে। একি! হীরার আংটি তার আঙ্গুলে এলো কি করে? সে যে আলমারীতে উঠিয়ে রেখেছিল আংটিটা! তাড়াতাড়ি বালিশের তলায় হাত দিয়ে চাবি গোছা নিতে যায়, কিন্তু কোথায় চাবির গোছা! আলমারীর কপাটে চাবির গোছা ঝুলছে!

মনিরার বেশ স্মরণ আছে, শোবার পূর্বেও সে বালিশের তলায় চাবির গোছা হাত দিয়ে অনুভব করে নিয়ে তবেই শুয়েছে। তবে কি ঘরে কেউ এসেছিল? দরজার দিকে তাকালো সে। দরজা যেমন খিল দিয়ে আটকানো ছিল, ঠিক তেমনি আছে। ঘরে তাহলে কেউ আসেনি। মনিরা ধড়মড় করে শয্যা ত্যাগ করে উঠে দাঁড়ালো, অমনি তার নজর গিয়ে পড়ে বিছানার পাশে— একটা কাগজের টুকরা পড়ে আছে। কাগজখানা হাতে উঠিয়ে নিয়ে এলো—দস্যু বনহুর এসেছিল!

ফ্যাকাশে বিবর্ণ মুখে পুনরায় তাকালো সে নিজের আঙ্গুলে। দস্যু বনহুর তাহলে হীরার আংটি গ্রহণ না করে তার আঙ্গুলে পরিয়ে দিয়ে গেছে। এর উদ্দেশ্য কি? অপমান, ঘৃণায় রি রি করে উঠলো মনিরার শরীর। কেন সে হীরার আংটি নিয়ে গেল না, কেন সে তাকে স্পর্শ করলো? এতই ঘুমিয়ে পড়েছিল সে? ছিঃ ছিঃ ছিঃ, কি করে সে এক কথা মামুজান আর মামীমার কাছে বলবে। একটা দস্যু তার আঙ্গুলে আংটি পরিয়ে দিয়ে যাবে—!

মনিরা দরজা খুলে মামীমার কক্ষে প্রবেশ করলো।

মরিয়ম বেগম কন্যা-সমতুল্যা ভাগ্নীকে হন্তদন্ত হয়ে কক্ষে প্রবেশ করতে দেখে বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন—কি হয়েছে মনিরা?

মনিরা ব্যস্তসমস্ত কণ্ঠে বলেন—এই দেখ মামীমা, আমার হীরার আংটি আলমারীতে রেখেছিলাম, কিন্তু রাতে আমার হাতের আঙ্গুলে এসে পড়েছে।

কি আশ্চর্য কথা, এসব কি বলছিস তুই?

সত্যি মামীমা আলমারীতে হীরার আংটি বন্ধ করে রেখে ঘুমিয়েছিলাম, কিন্তু ভোরে দেখি হীরার আংটি আঙ্গুলে, আর চাবির গোছাও বালিশের তলায় নেই, আলমারীর গায়ে ঝুলছে।

সর্বনাশ, এ যে অদ্ভুত কথা!

এই দেখ—বনহুরের লেখা কাগজখানা মরিয়ম বেগমের হাতে দেয় মনিরা—এটা পড়ে দেখ।

কাগজখানা হাতে নিয়ে দৃষ্টি বুলাতেই অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠলেন মরিয়ম বেগম—একি, দস্যু বনহুর এসেছিল।

ততক্ষণে মরিয়ম বেগমের আর্তচিৎকার শুনে ছুটে আসেন চৌধুরী সাহেব—কি হলো, কি হলো?

ওগো, দস্যু হানা দিয়েছিল।

দস্যু!

হ্যাঁ, দস্যু বনহুর মনিরার কক্ষে হানা দিয়েছিল।

হীরার আংটি নিয়ে গেছে?

না গো, না।

তাহলে সে হীরার আংটি নিতে পারেনি?

নিয়েও নেয়নি।

তার মানে?

এবার বলে মনিরা—মামুজান, রাতে শোবার পূর্বে আংটি খুলে আলমারীতে বন্ধ করে চাবির গোছাটা বালিশের তলায় রেখেছিলাম। ভোরে ঘুম থেকে উঠে দেখি, আংটিটা আমার হাতের আঙ্গুলে এসে গেছে, চাবির গোছা যেখানে রেখেছিলাম সেখানে নেই, আলমারীর গায়ে ঝুলছে। বিছানায় পড়ে আছে এই কাগজের টুকরাটা, পড়ে দেখ মামুজান।

কাগজের টুকরাখানায় নজর বুলিয়ে গম্ভীর হয়ে পড়েন চৌধুরী সাহেব। কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে কি যেন ভাবলেন। তারপর বলেন—এত সতর্কতার মধ্যেও সে আসতে পারলো! হলঘরে আমি, বাড়ির ভিতরে বন্দুকধারী পাহারাদার, সদর গেটে সশস্ত্র পুলিশবাহিনী। এর মধ্যেও দস্যু বনহুর হানা দিতে পারলো? হীরার আংটি নেয়নি সে, কিন্তু এমন কিছু নিয়ে গেছে, যা হীরার আংটির চেয়েও মূল্যবান। দেখ দেখি, আমার ঘরের সিন্দুকটা।

সকলে ছুটলো চৌধুরী সাহেবের শোবার ঘরে। সে ঘরের জিনিসপত্র যেটা যেখানে সে রকমই আছে, সিন্দুকের পাশেও কেউ যায়নি। আশ্বস্ত হলেন চৌধুরী সাহেব।

মরিয়ম বেগম বলেন—দস্যু বনহুর হানা দিয়ে কিছু না নিয়েই চলে গেল, সত্যি বড় আশ্চর্যের কথা।

হ্যাঁ, অদ্ভুত ব্যাপার, যাক পুলিশ অফিসে ফোন করছি—বলেন চৌধুরী সাহেব।

মনিরা বলে ওঠে—কি দরকার মামুজান, সে যখন কোন অন্যায় করেনি, তখন অযথা এ নিয়ে কথা বাড়িয়ে আর লাভ কি?

মরিয়ম বেগম বলে ওঠেন—না মনিরা, তা হয় না। বাড়িতে আরও কড়া পাহারার ব্যবস্থা করতে হবে। শয়তানটা সুযোগ বুঝে আবার সর্বনাশ করে বসবে। হায়! একী হলো, দস্যু বনহুরের নজর শেষ পর্যন্ত আমাদের ওপর এসে পড়ল। ওগো, তুমি পুলিশকে সব জানিয়ে আরও পাহারার ব্যবস্থা করো। আমি যে আর ভাবতে পারছি না। মরিয়ম বেগম মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন।

স্বামীকে খেতে দিয়ে বলেন মরিয়ম বেগম—ওগো, সেদিন মনিরার জন্ম-উৎসবে খানবাহাদুর সাহেব আর তাঁর ছেলে মুরাদ ঠিকভাবে যোগ দিতে পারেননি, হঠাৎ এ দস্যুটা কি কাণ্ডই না করেছিল, আর একদিন ওদের দাওয়াত করে এসো না?

খেতে খেতে বলেন চৌধুরী সাহেব—ঠিক বলেছ। সে কথা আমার মনেই ছিল না। আজই আমি ফোন করে দেব, কাল বিকেলে তাঁরা যেন আসেন।

হ্যাঁ, তাই কর। কিন্তু কেবল ফোন করলে হবে না, তুমি নিজে গিয়ে দাওয়াত করে এসো। যা হোক দু’দিন পর মনিরাকে যখন মুরাদের হাতে সঁপে দিতে হবে, তখন আগে থেকে ওদের মধ্যে একটা আলাপ-পরিচয় হওয়া ভাল।

তাহলে আমিই যাব?

আড়ালে দাঁড়িয়ে মনিরা মামুজান আর মামীমার কথা শুনে। কি জানি কেন যেন ভালো লাগে না মনিরার। সেদিন সে মুরাদকে ভালোভাবে লক্ষ্য করেছে, কিন্তু কৈ তার মনের কোণে ওর ছবি তো রেখাপাত করেনি? কোন আকর্ষণ অনুভব করেনি মনিরা হৃদয়ে। ধীরে ধীরে মনিরা চলে যায় নিজের কক্ষে। বিছানায় গিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে, তাকায় সে ছবিখানার দিকে। নিস্পলক নয়নে তাকিয়ে থাকে মনিরা। কি সুন্দর দুটি চোখ, অপূর্ব অদ্ভুত! মনিরার চোখ দুটো ছলছল করে ওঠে, সত্যই কি মনির নদীর স্রোতে ভেসে গেছে, মারা গেছে সে? না না, সে হয়তো বেঁচে আছে, মস্ত বড় যুবক হয়েছে সে, আরও সুন্দর হয়েছে হয়তো কিন্তু কি করে তা হতে পারে। গভীর পানিতে ক্ষুদ্র একটা বালক কি করে বাঁচতে পারে? মনিরার মন যেন ডেকে বলে সে বেঁচে আছে, নইলে তার লাশ পাওয়া যেত। গভীর চিন্তার অতলে তলিয়ে যায় মনিরা।

খানবাহাদুর সাহেব আর মুরাদকে দাওয়াত করে এসেছেন চৌধুরী সাহেব। আজ বিকেলে আসবেন তাঁরা। মরিয়ম বেগম স্বহস্তে পাকশাক করছেন। চৌধুরী সাহেবের ব্যস্ততার সীমা নেই।

মরিয়ম বেগমের পাক শেষ হতে বেলা গড়িয়ে এলো। তিনি ছুটলেন মনিরার কক্ষে। তার চুল বাঁধা, কাপড় পরা শেষ হলো কিনা দেখতে, কিন্তু মনিরার কক্ষে প্রবেশ করে অবাক হলেন তিনি। মনিরা বিছানায় শুয়ে শুয়ে একটা বই পড়ছে। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে আছে বালিশের উপরে! একখানা অপরিপাটি কাপড় পরনে। মরিয়ম বেগম রাগতকণ্ঠে বলেন—মনিরা, একি, এখনও তুমি শুয়ে আছ? ওঁদের যে আসার সময় হলো?

বই থেকে মুখ না তুলেই বলে মনিরা—কাদের আসার সময় হলো মামীমা?

সে কি, খানবাহাদুর সাহেব আর তাঁর ছেলে মুরাদ আসবে যে!

তাতে আমার কি?

আশ্চর্য করলি মনি, তাতে তোর কি, তা জানিসনে?

না তো? বই রেখে উঠে বসে মনিরা।

মুরাদের মত এত উচ্চশিক্ষিত ছেলেকে কেন আমরা এত সমাদর করছি, এ কথা খুলে বলতে হবে তোকে?

বুঝেছি, আমি তোমাদের গলগ্রহ হয়েছি।

ছিঃ ছিঃ! ওসব কী বলছিস মনি?

হ্যাঁ মামীমা, আমি তোমাদের চোখের বালি হয়ে পড়েছি। নইলে তোমরা আমাকে তাড়ানোর জন্য এত উঠে পড়ে লেগেছো কেন?

মরিয়ম বেগম মনিরার পাশে এসে বসে মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে বলেন—আমরা তোমাকে তাড়ানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছি, এসব কী বলছো মনিরা? লক্ষ্মী মেয়ে, তুমি ছাড়া আর কে আছে এই বুড়ো-বুড়ীর?

তবে যে সব সময় বিয়ে আর বিয়ে করে ব্যস্ত হচ্ছ?

পাগলী মেয়ে! এখন বড় হয়েছ, বিয়ে করতে হবে না?

না, আমি বিয়ে করবো না।

তা হয় না মনি, মেয়েছেলে কোনদিন বাপ-মার ঘর আগলে থাকতে পারে না। কথাটা একটু কঠিন কণ্ঠেই বলেন মরিয়ম বেগম।

মনিরাও অভিমানভরা গলায় বলে—মামীমা, তোমাদের ঘর আগলে থাকতে চাইনে। আমি বিয়েও করতে চাইনে।

মনিরা তুমি কচি খুকি নও। বয়সও তোমার কম হয়নি। সব বুঝতে শিখেছ, মুরাদের মত একটা সর্বগুণে গুণবান ছেলেকে হেলায় হারাতে পারি না। তুমি কাপড়-চোপড় পরে নিচে নেমে এসো।

এমন সময় চৌধুরী সাহেব কক্ষে প্রবেশ করেন—একী মা মনি, এখনও তোমার হয়নি। লক্ষী মা আমার, চট করে জামাকাপড় পরে নাও।

মরিয়ম বেগম বেরিয়ে গেল। চৌধুরী সাহেব কন্যা-সমতুল্য ভাগনীকে আদর করে আরও বলেন—তারপর নেমে গেল নিচে।

মামুজান আর মামীমা বেরিয়ে যেতেই পুনরায় বইখানা মেলে ধরে মনিরা চোখের সামনে। কিন্তু মন আর বসে না, কেমন যেন একটা অস্বস্তি বোধ করে। বই রেখে উঠে পড়ে, কিছুক্ষণ মুক্ত জানালায় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকে নীল আকাশের দিকে। শুভ্র বলাকার মত ডানা মেলে সাদা সাদা মেঘগুলো ভেসে বেড়াচ্ছে, সে দিকে তাকিয়ে কত কথা ভাবে সে।

হঠাৎ নিচে গাড়ি-বারান্দা থেকে ভেসে আসে মোটরগাড়ির শব্দ! মনিরা বুঝতে পারে, খান বাহাদুর এবং তার পুত্র মুরাদ পৌঁছে গেছেন। নিজের অনিচ্ছাসত্ত্বেও মনিরা ড্রেসিংরুমে প্রবেশ করে। ড্রেসিংরুম থেকে যখন মনিরা বাইরে বেরিয়ে এলো তখন তাকে অপূর্ব দেখাচ্ছে। নিচে নেমে আসতেই শুনতে পেল চৌধুরী সাহেব বলছেন—ঠিক কথাই বলছেন খান বাহাদুর সাহেব, শুভ কাজ যতো শীঘ্র হয় ততোই ভালো। মনিরাকে যখন আপনার এত পছন্দ— তখন কথা শেষ হয় না চৌধুরী সাহেবের, মনিরাকে দেখতে পেয়েই সহাস্যে বলেন—এই যে মা মনি এসে গেছে। এত বিলম্ব করলে কেন মা?

খান বাহাদুর সাহেবও চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে যোগ দিয়ে বলেন—কখন থেকে আমরা তোমার প্রতীক্ষা করছি মা বসে বসে।

মুরাদ সেদিন এভাবে মনিরাকে দেখার সৌভাগ্য লাভ করেনি, আজ মনিরাকে দেখে মুগ্ধ হলো সে। উঠে দাঁড়িয়ে সাহেবী কায়দায় মনিরাকে সম্ভাষণ জানালো।

মনিরা কোন উত্তর না দিয়ে একটা সোফায় বসে ছিল।

এ কথা সে কথার মধ্য দিয়ে খাওয়া দাওয়া শেষ হলো।

মুরাদ এক সময় বলে বসলো—চলুন না মিস মনিরা, একটু বেড়িয়ে আসি।

চৌধুরী সাহেব বলে ওঠেন—নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই, যাও মা একটু বেড়িয়ে এসো!

মনিরা মৃদুকণ্ঠে বলেন—মামুজান, আজ আমার শরীর ভালো নেই।

খান বাহাদুর সাহেব হেসে বলেন—বাইরের হাওয়াতে শরীর সুস্থ বোধ হবে, যাও মা, যাও।

মরিয়ম বেগমও তাদের সঙ্গে যোগ দিল—মুরাদ যখন বলছে, তখন যাও মনিরা!

মনিরা অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠে দাঁড়ালো।

মুরাদ খুশি হলো। আনন্দসূচক শব্দ করে বলেন—থ্যাঙ্ক ইউ, চলুন মিস মনিরা।

ড্রাইভ আসনের দরজা খুলে ধরে বলে মুরাদ—উঠুন।

মনিরা তার কথায় কান না দিয়ে পেছনের আসনে উঠে বসলো।

মুরাদ মনে মনে একটু ক্ষুন্ন হলেও মুখ ও ভাবে তা প্রকাশ না করে ড্রাইভ আসনে বসে গাড়িতে স্টার্ট দিল।

গাড়ি ছুটে চলেছে।

মুরাদ সিগারেট থেকে একরাশ ধোঁয়া পেছন সিটের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলেন—এখন কি সুস্থ বোধ করছেন?

মনিরা সে কথার জবাব না দিয়ে বলেন—চলুন কোথায় যাব।

মৃদু হাসলো মুরাদ—কোথায় যেতে ইচ্ছে বলুন তো? ক্লাবে, না লেকের ধারে।

ক্লাবে আমি যাই না।

কেন? বাঙ্গালী মেয়েদের যত গোঁড়ামি। বিশ্রী ব্যাপার! বিলেতে কিন্তু এসব নেই। চলুন লেকের ধারেই যাওয়া যাক।

লেকের ধারে এসে মুরাদের গাড়ি থেমে ছিল। নেমে দাঁড়িয়ে দরজা খুলে ধরে বলেন—আসুন।

মনিরা নেমে চলতে শুরু করলো।

লেকের ধারে গিয়ে বসে ছিল মনিরা। মুরাদও বসলো তার পাশে, ঘনিষ্ঠ হয়ে বসলো সে।

মনিরা বিরক্তি বোধ করলো, সরে বসলো সে।

মুরাদ হেসে বলেন—মিস মনিরা, আমি বুঝতে পারিনে এ দেশের মেয়েরা এত লজ্জাশীলা কেন—আমি বিলেতে সাত বছর কাটিয়ে এলাম কিন্তু কোন মেয়ের মধ্যে এমন জড়তা দেখলাম না, ওরা যে কোন পুরুষের সঙ্গে প্রাণখোলা ব্যবহার করতে পারে।

মনিরা গম্ভীর কণ্ঠে বলে ওঠে—মি. মুরাদ, আমি সেজন্য দুঃখিত। মেয়েদের অত স্বাধীনতা আমি পছন্দ করিনে।

ছিঃ! ছিঃ আপনি দেখছি একদম সেকেলে ধরনের! মেয়েরাই তো আজকাল দেশকে উন্নতির পথে এগিয়ে আনছে। তারা এখন পুরুষের সঙ্গে পা মিলিয়ে চলতে শিখেছে, তাইতো দেশ ও জাতির এত…

মুরাদের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে মনিরা—অইতে দেশ ও জাতির এত অবনতি।

অবনতি! এ আপনি কি বলছেন মিস মনিরা?

হ্যাঁ মি. মুরাদ, বিশেষ করে আমার চোখে।

তার মানে?

মানে মেয়েরা আজকাল বিলেতী চাল ধরেছে! বিলেতী চাল চালতে গিয়ে এত অধঃপতনে নেমে গেছে তারা, যা বলার নয়। এমন সব উৎকৃষ্ট পোশাক-পরিচ্ছদ পরতে শুরু করেছে তারা, যা মুসলিম সমাজের কাছে অত্যন্ত হেয়। টেডী পোশাক পরতে গিয়ে মেয়েরা প্রায় উলঙ্গ হয়েই চলাফেরা করছে। আর দু’দিন পর তারা যে আরও কত নিচে নেমে যাবে, ভাবতেও মনে ঘৃণা জন্মে।

মুরাদ আশ্চর্য হয়ে শুনছিল মনিরার কথাবার্তা। হেসে বলেন—মিস মনিরা, আপনি দেখছি বড় নীরস ধরনের মেয়ে। টেডী পোশাক মানুষকে কত মানায়, বিশেষ করে মেয়েদের। মিস মনিরা, আপনি এসব অনুভব করতে পারেন না।

আমি অনুভব করতে চাইনে। চলুন, এবার ওঠা যাক।

সেকি! এরি মধ্যে উঠতে চাচ্ছেন? মিস মনিরা, সত্যি আপনার অপরূপ সৌন্দর্য আমাকে মুগ্ধ করেছে। যদিও আপনার মন সেকেলে ধরনের কিন্তু আপনার চেহারা একেলে মেয়েদের চেয়ে অনেক সুন্দর। বিলেতী মেয়েরা কোন ছার!

দেখুন আমার সৌন্দর্যের প্রশংসার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। কিন্তু পুনরায় আমি একথা শুনতে চাইনে।

মিস মনিরা, অদ্ভুত মেয়ে আপনি। আমি জীবনে বহু মেয়ের সঙ্গে মিশার সুযোগ লাভ করেছি, আপনার মত আশ্চর্য মেয়ে আমি কোনদিন দেখিনি। সে সব মেয়েরা পুরুষের মুখে নিজেদের প্রশংসা শুনার জন্য সর্বদা উন্মুখ হয়ে থাকে।

প্লীজ মি. মুরাদ শুনতে চাইনে। উঠে দাঁড়ায় মনিরা।

মুরাদ চট করে ওর হাত চেপে ধরে—আমি উঠতে দিলে তো উঠবেন! বসুন আমার পাশে।

মনিরা বিরক্ত হয়, তবু বসে পড়ে বলে—সন্ধ্যা হয়ে এলো, মামুজান উদ্বিগ্ন হবেন।

হেসে ওঠে মুরাদ হাঃ হাঃ করে—কি যে বলেন মিস মনিরা, আপনার মামুজান নিশ্চিন্ত আছেন। আসুন, এই সন্ধ্যেটা আমরা লেকের নিরিবিলিতে কাটিয়ে যাই। মনিরার হাত ধরে আকর্ষণ করে মুরাদ।

মুরাদের কণ্ঠস্বর আর মনোভাব বুঝতে পেরে মনে মনে শিউরে ওঠে মনিরা। অস্বস্তি বোধ করে সে। এ জনহীন নির্জন লেকের ধারে একটা জঘন্য যুবকের পাশে মনিরা নিজকে বড় অসহায় মনে করে। সে হাত ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করে।

কিন্তু মুরাদের বলিষ্ঠ হাতের মুঠা থেকে কিছুতেই নিজের হাতখানাকে মুক্ত করে নিতে পারে না মনিরা। ঠিক সে মুহূর্তে কোথা হতে একটা তীরফলক এসে বিঁধে গেল মুরাদের পায়ের কাছে মাটিতে।

মুরাদ মনিরার হাত ছেড়ে দিয়ে তাকালো চারদিকে, কিন্তু কোথাও কোন জনপ্রাণী নজরে পড়ে না।

মুরাদ তীরখানা হাতে উঠিয়ে নিতেই দেখতে পায়, সেটাতে এক টুকরা কাগজ আটকানো রয়েছে। তাড়াতাড়ি কাগজখানা খুলে নিয়ে মেলে ধরে চোখের সম্মুখে। যদিও সন্ধ্যার অন্ধকার ঝাপসা হয়ে এসেছে, তবু বেশ নজরে পড়ে, কাগজখানায় লেখা আছে—

‘সাবধান’

—দস্যু বনহুর

মুরাদের হাত থেকে কাগজখানা খসে পড়ল! ভয়ে বিবর্ণ হয়ে উঠলো তার মুখমণ্ডল।

মনিরা বুঝতে পারে নিশ্চয়ই এই কাগজে এমন কিছু আছে, যা মুরাদের মত শয়তানকেও ভীত করে তুলেছে। মনিরার মুখখানাও বিবর্ণ ফ্যাকাশে হয়ে ওঠে। ভয়-জড়িত কণ্ঠে বলে মনিরা—চলুন এবার ফেরা যাক।

ঢোক গিলে বলে মুরাদ—চলুন।

গাড়িতে বসে ভাবে মনিরা, দস্যু বনহুর তাহলে তার পিছু নিয়েছে। কী ভয়ঙ্কর কথা! তবু মনে মনে বনহুরকে ধন্যবাদ না দিয়ে পারে না সে, বনহুর যদি সে মুহূর্তে ঐ তীর ছুঁড়ে সাবধান করে না দিত তাহলে কি যে হতো! মুরাদের কবল থেকে কিছুতেই নিজকে রক্ষা করতে পারতো না। মনে প্রাণে খোদাকে ধন্যবাদ জানায় মনিরা।

গাড়িতে বসে আর কোন কথা হয় না। কারণ ইতোপূর্বে মুরাদ একবার দস্যু বনহুরের কবলে পড়েছিল। কত ভয়ানক এ দস্যু বনহুর সে জানে। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে কোন রকমে গাড়ি চালিয়ে চলে সে।