গোটারাত মনিরার অদ্রিায় কাটলো। পরদিন ভোরে চায়ের টেবিলে বসে কন্যা সমতুল্যা ভাগনীর চেহারা লক্ষ্য করে চৌধুরী সাহেব বিশেষ উদ্বিগ্ন হয়ে ছিল। তিনি জানেন, মনিরা জামানকে কত ভালবাসতো। চৌধুরী সাহেব নিজেও কম ভালবাসেন কি! অমন চেহারা; অমন ব্যবহার, কে না তাকে ভালবেসে পারে! কিন্তু সে যে সে ডাকাত শুধু। ডাকাত নয়, দুর্দান্ত দস্যু বনহুর যার ভয়ে আজ গোটা দেশবাসী কম্পমান। না না, তাকে কিছুতেই ক্ষমা করতে পারেন না চৌধুরী সাহেব। যতই সে ভাল হউক, যতই সে মহৎ হউক তবু সে দস্যু। শাস্তি তার পাওয়া উচিত।

চৌধুরী সাহেব মনিরার মনকে প্রফুল্ল করার জন্য হেসে বলেন–মনি, চল মা সকাল বেলাটা কোথাও থেকে ঘুরে আসি। আজ ক’দিন থেকে তোমার মামীমাও বেড়াতে যাব বলছেন।

মনিরা চায়ের খালি কাপটা টেবিলে নামিয়ে রেখে গম্ভীর কণ্ঠে বলেনমামুজান, আজ আমার যে এক বান্ধবীর বাড়ি যাবার কথা আছে। হাতঘড়ির দিকে তাকায় মনিরা, তারপর উঠে দাঁড়ায়।

চৌধুরী সাহেব বুঝতে পারলেন, মনিরা নিশ্চয়ই সে দস্যু বনহুরের সঙ্গে দেখা করতে যাবে। একদিন কথায় কথায় তিনি মনিরার নিকটে শুনেছিল শহরের শেষ প্রান্তে জামানের বাড়ি। রাস্তার নাম এবং নম্বরটাও তার স্পষ্ট মনে আছে। মনে মনে হাসলেন চৌধুরী সাহেব। এমন একজন দস্যুকে গ্রেপ্তার করিয়ে দিতে পারলে শুধু তার সুনাম হবে না, এতে কৃতিত্ব আছে অনেক।

মনিরা কক্ষ থেকে বেরিয়ে যেতেই চৌধুরী সাহেব স্ত্রীকে লক্ষ্য করে বলেন–জানো মরিয়ম, মনি এখন কোথায় গেল?

মরিয়ম বেগম বলেন—মনি তো বলেই গেল তার কোন বান্ধবীর বাড়ি যাবে সে।

না গো না, মনি গেল সে দটার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে।

তুমি জানলে, অথচ বাধা দিলে না?

না, আমি বাধা দেব না; বরং তার সাক্ষাতে আমি দস্যু বনহুরকে পুলিশের হাতে তুলে দেব!

এসব তুমি কি বলছো?

হ্যাঁ মরিয়ম, মনিরা ছদ্মবেশী দ্ৰযুবক দস্যু বনহুরকে ভালবেসে ফেলেছে। শুধু ভালবেসেছে নয়, তাকে সে গোটা অন্তর দিয়ে কামনা করে আসছে।

দেখ শুধু কি মনিরাই তাকে ভালবেসেছিল। কি জানি, আমার গোটা মনটাও যেন সে অধিকার করে বসেছিল। সত্যি সে যে দস্যু, একথা আমি এখনও ভাবতে পারিনে। আমার মনটা কেমন যেন ব্যথায় গুমড়ে কেঁদে উঠছে। বাষ্পরুদ্ধ হয়ে আসে মরিয়ম বেগমের কণ্ঠ।

চৌধুরী সাহেবের হদয়ে ব্যথার আঁচ লাগে। তিনি গম্ভীর গলায় বলেন–কি যাদু জানে সে, কে জানে। কেন যে ওকে এত ভালো লাগতো আমি নিজেও বুঝি না। যাক শুনো মরিয়ম, আমি এক্ষুণি পুলিশ অফিসে যাব।

কেন? আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করেন মরিয়ম বেগম।

দস্যুকে আমি কিছুতেই ক্ষমা করতে পারিনে, যতই মহৎ, যতই উদার হউক সে, যতই গুণ তার থাক, তবু সে দস্যু। আমার কর্তব্য তাকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেয়া।

কি হবে তাকে পুলিশে দিয়ে! তাছাড়া তোমার তো এতে কোন স্বার্থ নেই? আমি জানি সে যত বড় দস্যু হউক, আমাদের কোন ক্ষতিই সে করবে না কোনদিন।

আমাদের ক্ষতি সে নাও করতে পারে। তবু চোর-ডাকাত এদের কোন বিশ্বাস নেই। বিশেষ করে দেশবাসীকে ঐ দস্যুর হাত থেকে আমাকে

বাঁচাতেই হবে। উঠে দাঁড়ালেন চৌধুরী সাহেব।

মরিয়ম বেগম বলেন–কোথায় চললে?

ঐ তো বললাম পুলিশ অফিসে। মি. হারুন এবং পুলিশ ফোর্স নিয়ে এক্ষুণি আমি জামানের বাড়ি যাব।

কিন্তু—

মনিরা সেখানে আছে, এই তো?

হ্যাঁ।

সে কথা আমি সব বলে নেব হারুন সাহেবকে। মনিরাকে পাঠিয়ে আমি যেন তাকে গ্রেপ্তারের সুযোগ করে নিয়েছি।

ওগো, আমিও যাব তোমার সঙ্গে। মনিরাকে আমি নিজে গিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে আসবো।

তবে তৈরি হয়ে নাও। এক্ষুণি বেরুবো, আমার মনে হয় সে এখনও বাড়িতে আছে। কারণ সে মনিরার জন্য অপেক্ষা করবেই।

মনিরা কক্ষে প্রবেশ করতেই বনহুর উঠে দাঁড়ালো। মনিরা গম্ভীর দৃষ্টি নিয়ে তাকালো বনহুরের মুখের দিকে। বনহুর এগিয়ে এলো মনিরার পাশে। কিছুক্ষণ উভয়েই নীরবে কাটলো।

বনহুরই প্রথমে কথা বলেন আমি জানি তুমি আসবে, তাই আমি এতক্ষণ তোমার প্রতীক্ষায় আছি।

মনিরা নীরব।

বনহুর ওর চিবুক উঁচু করে ধরলো–মনিরা কি ভাবছো? খুব ঘৃণা হচ্ছে বুঝি?

এতক্ষণে মনিরা কথা বলেন–আমি তোমাকে ঘৃণা করি না, ঘৃণা করি বনহুরকে। ছিঃ ছিঃ ছিঃ, এ আমি ভাবতেও পারি না জামান, তুমি দস্যু বনহুর।

মনিরা, মনিরা–রুদ্ধ নিঃশ্বাসে বনহুর মনিরাকে টেনে নিল কাছে।

মনিরা বনহুরের বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে সরে দাঁড়ালো তুমি আমাকে স্পর্শ করো না।

মনিরা!

হ্যাঁ, তুমি অপবিত্র ঘৃণিত একটা মানুষ–

মনিরা, তুমি বিশ্বাস করো আমি অপবিত্র ঘৃণিত নই। আমি দস্যু নই। দস্যুতা আমার পেশা নয়। মনিরা তুমি আমাকে ঘৃণা করো না। পুনরায় বনহুর মনিরাকে টেনে নেয় কাছে।

না না, তুমি আমাকে ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও–তোমার সঙ্গে আমার আর কোন সম্পর্ক নেই, আমি চললাম।

না, তোমাকে আমি যেতে দেব না। মনিরাকে দক্ষিণ হাতে শক্ত করে ধরলো বনহুর। আরেক হাতে এক ঝটকায় নিজের জামার নিচে গলা থেকে সে হারছড়া টেনে বের করে মেলে ধরলো মনিরার সামনে চিনতে পার এই ছবি দুটি কাদের?

বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠলো মনিরা–এ ছবি তোমার গলায় এলো কি করে? এ যে আমার আর মনিরের ছবি।

বনহুর তখন মনিরাকে ছেড়ে দিয়ে সরে দাঁড়িয়েছে। বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলেন–তোমাদের সে হতভাগ্য মনির আর কেউ নয়–দস্যু বনহুর।

মনিরা আর্তনাদ করে উঠলো–জামান, তুমিই মনির? কেন–কেন তুমি এসব করতে গেলে?

বনহুর মনিরাকে নিবিড়ভাবে বুকে চেপে ধরলো, তারপর বলেন–এই আমি তোমাকে স্পর্শ করে বলছি মনিরা, আর আমি দস্যুতা করবো না।

ঠিক সে মুহূর্তে মি. হারুনসহ চৌধুরী সাহেব কক্ষে প্রবেশ করলেন। তাঁদের পেছনে পুলিশ ফোর্স।

সঙ্গে সঙ্গে মনিরাকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো বনহুর। বুঝতে পারলো সে, তার পিতাই আজ তাকে পুলিশের হাতে সপে দেয়ার জন্য আয়োজন করেছেন। পালালে সে এক্ষুণি পালাতে পারে। তার পায়ের তলাতে আছে এক চোরা সুড়ঙ্গ। এখনই সে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে, কিন্তু এ যে তার পিতাকে অপমান করা হবে।

মনিরার চোখেমুখেও বিস্ময়, হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে।

মি. হারুন এগিয়ে গেল বনহুরের দিকে। বনহুর হাত দু’খানা বাড়িয়ে দিল।

মি. হারুন নিজ হাতে বনহুরের হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিল।

মনিরা আর্তনাদ করে চৌধুরী সাহেবের জামার আস্তিন চেপে বলেনমামুজান, এ তুমি কি করলে? এই দেখো–মালাছড়া চৌধুরী সাহেবের হাতে দিন মনিরা।

এমন সময় চৌধুরী সাহেবের গাড়ি থেকে নেমে এলেন মরিয়ম বেগম। কারণ মনিরার আর্তচিৎকার তার কানে পৌঁছে ছিল, ভাগ্নীর কোন অমঙ্গল আশঙ্কা করেই তিনি ছুটে এলেন।

চৌধুরী সাহেব মালাছড়া হাতে নিয়েই চিনতে পারলেন। এ মালা যে তার অতি পরিচিত। তিনি কিছুক্ষণ শুদ্ধ হয়ে মালার লকেটের ছবি দুটির দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন—এ মালা তুই কোথায় পেলি, মনিরা।

মনিরা আংগুল দিয়ে বনহুরকে দেখিয়ে বলেন–ওর গলায়।

অবাক হয়ে তাকান চৌধুরী সাহেব বনহুরের দিকে।

মনিরা বাষ্পরুদ্ধ গলায় বলে–মামুজান, ঐ তোমাদের সন্তান মনির।

চৌধুরী সাহেব এবং মরিয়ম বেগম স্থির নয়নে দেখতে লাগলেন বনহুরকে। তাদের চোখের সামনে বনহুরের মুখ মিশে গিয়ে সেখানে ফুটে উঠলো একটা শিশু মুখ।

মরিয়ম বেগম ছুটে গিয়ে বনহুরকে জড়িয়ে ধরলেন বুকে বাবা মনির। আমার মনির–

চৌধুরী সাহেবের গণ্ড বেয়ে ঝর ঝর করে তখন ঝরে পড়ছে অশ্রুধারা। মনকে তিনি কিছুতেই প্রবোধ দিতে পারছেন না।

মরিয়ম বেগম উচ্ছ্বসিত কান্নায় ভেংগে ছিল, স্বামীকে লক্ষ্য করে তিনি বলেন–ওগো, কি করলে তুমি? হারানো রত্ন ফিরে পেয়ে আবার তুমি হারালে। না না, আমি মনিরকে কিছুতেই দূরে নিয়ে যেতে দেব না। দেব

–মনির আমার মনির–পুত্রের বুকে মাথা ঠুকে কাঁদতে লাগলেন মরিয়ম বেগম।

মি. হারুন কঠিন কণ্ঠে বলেন—বড্ড দেরী হয়ে যাচ্ছে।

বনহুরের শান্ত ধীরস্থির গলায় বলেন–চলুন, ইন্সপেক্টার সাহেব।

সঙ্গে সঙ্গে চৌধুরী সাহেব পুত্রের হাত চেপে ধরে কেঁদে উঠলেন–বাবা মনির।

বনহুর হেসে বলেন–আব্বা, আপনার কর্তব্য আপনি পালন করেছেন।

একবার মা ও মনিরার দিকে তাকায় বনহুর, উভয়ের চোখেই পানি, বনহুরের চোখ দুটোও অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠলো।

মনিরা বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলে উঠলো–মনির, আমি তোমার প্রতীক্ষায় থাকবে!