» » তিন

বর্ণাকার

পরদিন গোটা দেশময় হৈ চৈ পড়ে গেল। কাগজে কাগজে বেরুলো দস্যু বনহুরের অদ্ভুত দস্যুতার কথা।

মি. শঙ্কর রাও মাথায় হাত দিয়ে বসে ছিল। কি করতে কি ঘটে গেল! এত বড় ফন্দিটাও তাঁর টিকলো না। বরং বেচারা রায়বাহাদুর শ্যামাচরণ এত বড় একটা ক্ষতিগ্রস্ত হলেন। লজ্জায় ক্ষোভে মরিয়া হয়ে উঠলেন শঙ্কর রাও।

পুলিশ মহলে আতঙ্কের সৃষ্টি হলো! মি. বশীর আহমদ পর্যন্ত বোকা বনে গেলেন! কারও মুখে যেন কোন কথা নেই।

সমস্ত পথে-ঘাটে-মাঠে, অলিগলিতে পুলিশ পাহারা রইলো। সন্দেহজনক কাউকে দেখলেই তারা তাকে গ্রেপ্তার করবে। পুলিশমহল থেকে ঘোষণা করে দেয়া হলো, যে দস্যু বনহুরকে জীবিত কিংবা মৃত অবস্থায় ধরে এনে দিতে পারবে, তাকে লাখ টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে।

অর্থের লোভে যে যাকে সন্দেহ হলো, ধরে নিয়ে এলো থানায়। একদিন গভীর রাতে কয়েকজন পুলিশ রাস্তায় পাহারা দিচ্ছিলো, এমন সময় একটা পাগল ছেঁড়া জামাকাপড় পরে আবোল-তাবোল বকতে বকতে চলে যাচ্ছিলো। পুলিশের দৃষ্টি আড়াল হয়ে যাবে, এমন সময় দু’জন পুলিশ ধরে ফেললো তাকে—এ বেটা, কোথায় যাচ্ছিস?

পাগল লোকটা মাথা চুলকাতে আরম্ভ করলো। পুলিশদের সন্দেহ আরও বাড়লো, একজন লাঠি উঁচিয়ে বসিয়ে দেবে আর কী, এমন সময় একটানে মুখ থেকে দাড়ি আর গোঁফ খুলে ফেলে বলেন পাগল লোকটা—আমি পুলিশ ইন্সপেক্টার মি. হারুন।

সঙ্গে সঙ্গে পুলিশরা ‘বেকুফ’ বনে গেল। লম্বা সেলুট ঠুঁকে সোজা হয়ে দাঁড়ালো সকলে। হৃৎপিণ্ড তখন ধক ধক করতে শুরু করেছে ওদের। না জানি এর জন্য কপালে কি আছে, এত কষ্টের পুলিশের চাকরিটা না খোয়া যায়।

মি. হারুন হেসে বলেন—হ্যাঁ, এই রকম সতর্ক থাকবে। পাগল কিংবা ভিখারী বলেও কাউকে খাতির করবে না। কথা ক’টি বলে চলে গেলেন ইন্সপেক্টার।

এতক্ষণে পুলিশগুলো হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।

নূরী একটা খবরের কাগজ হাতে নিয়ে চিন্তিত মনে বসে আছে।

এমন সময় বনহুর এসে দাঁড়ালো তার পাশে। নূরীকে বিষণ্ণ মুখে বসে থাকতে দেখে হেসে বলে—কি এত ভাবছো বসে বসে?

তোমার যেন কোন ভাবনা নেই! এই দেখ দেখি। খবরের কাগজের একটা জায়গা মেলে ধরলো বনহুরের চোখের সম্মুখে—দেখেছো?

ওঃ তাই বুঝি এত ভাবনা? পরক্ষণেই হেসে ওঠে হাঃ হাঃ করে বনহুর, তারপর বসে পড়ে নূরীর পাশে।

নূরীর চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে দু’ফোটা অশ্রু। বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলে—তোমার কি জীবনের এতটুকু ভয় নেই?

ভয়! কিসের ভয় নূরী?

তোমাকে যে জীবিত কী মৃত ধরে দিতে পারবে, সে লাখ টাকা পাবে।

নূরী, আমার ইচ্ছে হচ্ছে আমি নিজেকে নিজেই ধরিয়ে দিয়ে এক লাখ টাকা গ্রহণ করি।

ছি! তোমার এত টাকার মোহ? টাকা? বনহুর টাকার পাগল নয় নূরী! সে চায় দুনিয়াটাকে দেখতে।

বেশ হয়েছে, অনেক দেখেছো, এবার মানুষ হবার চেষ্টা কর।

কেন, আমি কি মানুষ নই?

মানুষ যদি হতে তবে এমন সব আজগুবি কথা বলতে না। থাক, চল দেখি এবার কিছু খাবে।

বনহুর উঠে দাঁড়ায়—উঁহু, কিছু খাবো না, নূরী।

কোথায় যাবে এই ভর সন্ধ্যায়?

প্যান্টের পকেট থেকে কয়েক তোড়া নোট বের করে নূরীর সামনে ধরে—এগুলো মালিককে পৌঁছে দিতে।

তার মানে?

প্যান্টের পকেটে টাকার তোড়াগুলো রাখতে রাখতে বলে বনহুর—ঐ যে সেদিন রায় বাহাদুর শ্যামাচরণ মহাশয়ের নায়েবের কাছ থেকে টাকাগুলো নিয়ে এসেছিলাম তা এখনও মালিকের নিকটে পৌঁছে দেয়া হয়নি।

তুমি আশ্চর্য মানুষ।

কেন?

টাকা আনলেই বা কেন, আবার ফিরিয়ে দেবারই কী প্রয়োজন আছে?

নূরী, বনহুর সব পারে। ছলনা বা কৌশলে বনহুরকে বন্দী করা এত সহজ নয়, সেটাই জানিয়ে দিলাম। আর অযথা বৃদ্ধ, নায়েব মহাশয়কে বিপদগ্রস্ত করতে চাইনে। শ্যামাচরণ মহাশয় কিছুতেই এই তিন লাখ টাকা ছাড়বে না, বৃদ্ধ নায়েব বাবুকেই পরিশোধ করতে হবে, নয়তো হাজত বাস।

তাতে তোমার কী, যা হয় হউকগে।

তা হয় না নূরী, অযথা কাউকে কষ্ট দেয়া আমার ইচ্ছে নয়, আচ্ছা চলি, ভোরে ফিরে আসবো।

নিস্তব্ধ প্রান্তরে জেগে ওঠে বনহুরের অশ্ব-পদশব্দ। নূরী দু’হাতে বুক চেপে ধরে উঠে দাঁড়ায়, বুকের মধ্যে ধক্ ধক্ করে ওঠে, না জানি সে কেমনভাবে ফিরে আসবে।

রায়বাহাদুর শ্যামাচরণের বাড়ির পেছনে গিয়ে বনহুর তাজের পিঠ থেকে নেমে দাঁড়ালো, তারপর প্রাচীর টপকে প্রবেশ করলো অন্তঃপুরে। একে গভীর অন্ধকার, তার উপরে বনহুরের শরীরে কালো ড্রেস থাকায় অন্ধকারে মিশে গেল সে।

অতি সহজেই রায়বাহাদুর শ্যামাচরণ মহাশয়ের কক্ষের বাইরে গিয়ে দাঁড়ালো।

কক্ষে ডিমলাইট জ্বলছে। বনহুর পকেট থেকে একটা যন্ত্র বের করে অল্পক্ষণের মধ্যেই জানালার কাঁচ খুলে ফেললো, তারপর প্রবেশ করলো কক্ষে।

খাটের ওপর রায়বাহাদুর শ্যামাচরণ শায়িত। গোটা রাত অনিদ্রায় কাটিয়ে এতক্ষণে একটু ঘুমিয়েছেন। তিন লাখ টাকার শোক কম নয়, টাকার শোকে তিনি অস্থির হয়ে পড়েছেন। যত দোষ ঐ নায়েব বাবুর। তিনি না জেনেশুনে অপরিচিত একটা লোককে বিশ্বাস করলেন, এত টাকা ছেড়ে দিলেন তার হাতে। না, এর একটা বিহিত ব্যবস্থা করতে হবে। বৃদ্ধ পুরানো নায়েব বলে খাতির করলে চলবে না, জেল খাটাবেন। কিছুতেই রায়বাহাদুর শ্যামাচরণ তাঁকে রেহাই দেবেন না…এতসব ভাবতে ভাবতে কেবলমাত্র ঘুমিয়েছেন।

বনহুর শ্যামাচরণ মহাশয়ের খাটের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। তারপর গায়ে মৃদু আঘাত করে ডাকলো—উঠুন।

রায়বাহাদুর ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসে তাকালেন সামনের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করতে যাবেন, অমনি বনহুর রিভলবার চেপে ধরলো তাঁর বুকে—খবরদার, চিৎকার করবেন না।

বনহুরের কালো অদ্ভুত ড্রেস, মুখে, গাল পাট্টা রায়বাহাদুরকে আতঙ্কিত করে তুললো। তিনি একটা ঢোক গিলে বলেন—তুমি কে?

বনহুর গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দিল—দস্যু বনহুর!

রায়বাহাদুর রাগে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে গিয়েছিলেন, চিৎকার করে বলেন—তুমিই দস্যু বনহুর!

হেসে বলে বনহুর—হ্যাঁ।

আবার কি জন্য এসেছো? আমার তিন লাখ টাকা নিয়েও তোমার লোভ যায়নি?

ভুল বুঝেছেন রায়বাহাদুর মহাশয়, আপনার টাকা নেইনি, আপনার নিকটে পৌঁছে দেবার জন্যই আপনার নায়েব বাবুর কাছ হতে নিয়ে এসেছি। কারণ আপনি যেভাবে টাকা নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেছিলেন, সেভাবে আনাটা নিরাপদ নয়, তাই আমি—

ওঃ তাহলে তুমি টাকাটা অন্য কেউ লুটে নেবার পূর্বেই লুটে নিয়েছে, শয়তান কোথাকার!

দেখুন আমি শয়তান নই, শয়তানের বাবা। যাক বেশি বিরক্ত করতে চাইনে আপনাকে এ দুপুর রাতে। বুঝতেই পারছি আপনি এ তিন লাখ টাকার শোকে মূহ্যমান হয়ে পড়েছেন। সে কারণেই আমি তাড়াতাড়ি এলাম, এ নিন আপনার টাকা। প্যান্টের পকেট থেকে তিন লাখ টাকার তোড়া বের করে রায় বাহাদুর শ্যামাচরণ মহাশয়ের হাতে দিয়ে বলে—গুণে নিন।

রায়বাহাদুর শ্যামাচরণ মহাশয়ের চোখে মুখে একরাশ বিস্ময় ঝরে পড়ে। একবার হস্তস্থিত টাকা আর একবার বনহুরের কালো গালপাট্টা বাধা মুখের দিকে তাকান তিনি। একি অবিশ্বাসের কথা, বনহুর তবে কি তাকে হত্যা করতে এসেছে? ভয়ে বিবর্ণ হয়ে ওঠে তার মুখমণ্ডল।

বনহুর পুনরায় বলে ওঠে—নিন, টাকা গুণে নিন। এক পা পাশের চেয়ারে রেখে সোজা হয়ে দাঁড়ায় সে।

রায়বাহাদুর শ্যামাচরণ কম্পিত হাতে টাকার তোড়াগুলো গুণে নিলেন।

বনহুর বলেন—ঠিক আছে তো?

হ্যাঁ, ঠিক আছে।

বনহুর এক টুকরা কাগজ আর কলম বাড়িয়ে ধরলো রায়বাহাদুর মহাশয়ের সামনে—একটা রসিদ লিখে দিন, আমি তিন লাখ টাকা বুঝে পেলাম।

শ্যামাচরণ কাগজ আর কলমটা হাতে নিয়ে লিখলেন।

বনহুর হেসে বলেন—নিচে নাম সই করুন।

শ্যামাচরণ মহাশয় নাম সই করে কাগজখানা বনহুরের হাতে দিলেন।

বনহুর কাগজখানা হাতে নিয়ে আর একবার পড়ে দেখলো, তারপর পকেটে রাখলো। রিভলবার উঁচিয়ে ধরে পিছু হটতে লাগলো সে, পরমুহূর্তে যে পথে এসেছিল সে পথে অদৃশ্য হলো।

এবার বনহুরের অশ্ব রায় মহাশয়ের দেশের বাড়ির সদর গেটে গিয়ে থামলো, অতি সতর্কতার সঙ্গে প্রাচীর টপকে অন্তঃপুরে প্রবেশ করলো সে। নায়েব বাবুর কক্ষ সেদিন চিনে নিয়েছিল বনহুর, আজ সে কক্ষের দরজায় আঘাত করলো।

নায়েব বাবুর চোখে ঘুম নেই, তিন লাখ টাকা যেমন করে হউক তাকে পরিশোধ করতেই হবে, না হলে নিস্তার নেই। কিন্তু কোথায় পাবেন তিনি অত টাকা। মাথার চুল ছিঁড়ছেন তিনি বিছানায় শুয়ে শুয়ে— ঠিক সে মূহুর্তে কক্ষের দরজায় মৃদু শব্দে নায়েব বাবু বিছানায় উঠে বসে বলেন—কে?

বনহুর পুনরায় শব্দ করে ঠুক ঠুক ঠুক…

এবার নায়েব বাবু শয্যা ত্যাগ করেন। দরজা খুলে দিয়ে সম্মুখে বনহুরকে দেখেই চিৎকার করতে যান, সঙ্গে সঙ্গে বনহুর চেপে ধরে তাঁর মুখ—ভয় নেই, আজ টাকা নিতে আসিনি। রায় বাহাদুর মহাশয়ের নিকটে টাকা পৌঁছে দিয়েছি, এই নিন রসিদ।

বৃদ্ধ নায়েব কম্পিত হাতে রসিদখানা হাতে নিয়ে হাবা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন, তিনি বিশ্বাস করতে পারেন না এ কথা।

বনহুর যেমনি এসেছিল, তেমনি বেরিয়ে যায়।

রাতের ঘটনা নিয়েই পুলিশ অফিসে আলোচনা চলছিল। রায়বাহাদুর শ্যামাচরণ মহাশয়কে দস্যু বনহুর সে তিন লাখ টাকা ফেরত দিয়ে গেছে, এটাই আলোচনার বিষয়বস্তু।

পুলিশ ইন্সপেক্টার মি. হারুন, মি. শঙ্কর রাও, মি. গোপাল বাবু, রায়বাহাদুর শ্যামাচরণ মহাশয় এবং বৃদ্ধ নায়েব বাবু সকলেই উপস্থিত আছেন।

মি. হারুন বলে ওঠেন—আশ্চর্য এই দস্যু বনহুর।

মি. শঙ্কর রাও বলেন—শুধু আশ্চর্য নয়, ইন্সপেক্টার, অদ্ভুত সে।

গোপাল বাবু হঠাৎ বলে বসে—সত্যি আশ্চর্য বলে আশ্চর্য। কেনই বা সে টাকা নিল, আবার কেনই বা ওভাবে ফিরিয়ে দিয়ে গেল! নিশ্চয়ই দস্যু বনহুর ভয় পেয়েছে।

শঙ্কর রাও একটা সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করে বলেন—ভয় পাবার বান্দা সে নয়। সে দেখিয়ে দিল, আমি সব পারি। কিন্তু বাছাধন জানে না শঙ্কর রাও কম নয়, আমি একবার দেখে নেব দস্যু বনহুরকে।

এমন সময় কক্ষে প্রবেশ করেন চৌধুরী সাহেব। সহাস্যমুখে বলেন—গুড মর্নিং।

সকলেই উঠে দাঁড়িয়ে চৌধুরী সাহেবকে সাদর সম্ভাষণ জানালেন, তারপর তিনি আসন গ্রহণ করার পর সবাই আসন গ্রহণ করলেন।

ইন্সপেক্টার সাহেব বিনীতভাবে জিজ্ঞেস করলেন—ব্যাপার কি চৌধুরী সাহেব, হঠাৎ যে?

কেন, আসতে নেই নাকি? হেসে বলেন চৌধুরী সাহেব।

ইন্সপেক্টার মি. হারুন বলেন—এখানে কি মানুষ সহজে আসতে চায়?

তার মানে?

মানে যখন একটা কিছু অঘটন ঘটে, তখনই লোকে আমাদের এই পুণ্যভূমিতে পদধূলি দেন।

মি. হারুনের কথায় হেসে ওঠেন সবাই।

চৌধুরী সাহেব বলেন—সে কথা মিথ্যা নয় ইন্সপেক্টার সাহেব। তবে আমি অঘটন ঘটিয়ে আসিনি। এসেছি একটা সামান্য কথা নিয়ে।

একসঙ্গে সকলেই চোখ তুলে তাকালেন। মি. হারুন জিজ্ঞেস করলেন—সামান্য কথা? বলুন, আপনার সামান্য কথাটাই আগে শোনা যাক। কিন্তু তার পূর্বে এদের সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দি। ইনি রায়বাহাদুর শ্যামাচরণ মহাশয় আর ইনি তাঁর নায়েব শঙ্কর বাবু আর ইনি প্রাইভেট ডিটেকটিভ মি. শঙ্কর রাও। উনি মি. রাওয়ের সহকারী গোপাল বাবু। এবার চৌধুরী সাহেবের পরিচয় দেন—আর উনি চৌধুরী মাহমুদ খান, হাসানপুরের জমিদার।

চৌধুরী সাহেব আনন্দভরা কণ্ঠে বলে ওঠেন—আপনাদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে অত্যন্ত খুশি হলাম। যদিও আপনাদের নামের সঙ্গে আমার বেশ পরিচয় আছে।

রায়বাহাদুর শ্যামাচরণ মহাশয় উঠে দাঁড়িয়ে চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে হাত মিলান—আমিও অত্যন্ত খুশি হলাম, চৌধুরী সাহেব। আপনার সুনাম অনেক শুনেছি, কিন্তু দেখা হয়নি কোনদিন। আজ এখানে আমরা একসঙ্গে মিলিত হয়ে আনন্দিত হলাম।

চৌধুরী সাহেব বলেন—খবরের কাগজে যে সব ঘটনা পড়লাম এ সব কি সত্য রায়বাহাদুর সাহেব?

আজ্ঞে হ্যাঁ, সব সত্য। কথাটা অতি গম্ভীর কণ্ঠে বলেন রায়বাহাদুর শ্যামাচরণ মহাশয়।

মি. হারুন হেসে বলেন—না হলে কি আর রায়বাহাদুর মহাশয়ের পুলিশ অফিসে পদধূলি পড়ে।

চৌধুরী সাহেবই বলে ওঠেন—আমি প্রথমেই বুঝতে পেরেছিলাম। আশ্চর্য এই দস্যু বনহুর। টাকাটা ফিরিয়ে দিয়ে সে মহৎ হৃদয়ের পরিচয় দিয়ে গেছে।

এবার মি. রাও কথা বলেন—কাকে আপনি মহৎ হৃদয় বলছেন, চৌধুরী সাহেব? শয়তান বদমাশ। দস্যুতার এটা একটা নতুন চাল।

কিন্তু শুনা গেছে, সে নাকি অনেক দীন দুঃখীকে মুক্তহস্তে দান করছে।

মিথ্যে কথা চৌধুরী সাহেব, সব আজগুবি কথা। কেউ স্বচক্ষে দেখেছে? দস্যু বনহুর কাকে টাকা দিয়েছে? শয়তানটা যে অতি ধূর্ত—এ কথা মিথ্যে নয়।

মি. হারুন বলে ওঠেন—পুলিশকে একেবারে হন্তদন্ত করে মারছে। আমরা তো একেবারে নাজেহাল হয়ে উঠেছি, থাক সে কথা। এবার বলুন চৌধুরী সাহেব, আপনার কি কথা?

হ্যাঁ, এতক্ষণ আসল কথাটাই বলা হয়নি। দেখুন আপনারা সকলেই যখন এখানে উপস্থিত আছেন, তখন ভালোই হলো। আমি আপনাদের দাওয়াত করছি। আমার ভাগনী মনিরা বেগমের জন্ম উৎসব। অনুগ্রহ করে আজ সন্ধ্যায় আমার ওখানে যাবেন। এই নিন কার্ড। কার্ড বের করে নাম লিখলেন। তারপর প্রত্যেককে একখানা করে দিয়ে বলেন—মনে কিছু করবেন না। আপনাদের দাওয়াত করতে পেরে আমি অত্যন্ত আনন্দবোধ করছি।

রায়বাহাদুর শ্যামাচরণ মহাশয় হেসে বলেন—এটা তো খোশখবর। এলাম কোন কাজে, পেলাম দাওয়াত। সত্যি আজকের দিনটা আমার বড় শুভ যাচ্ছে।

মি. হারুন বলে ওঠেন—মিথ্যে নয় রায়বাহাদুর সাহেব। শুধু আজকের দিন নয়, কালকের রাত থেকে আপনার শুভরাত্রি শুরু হয়েছে।

চৌধুরী সাহেব এবার মি. রাওকে লক্ষ্য করে বলেন—আপনারা নীরব রইলেন যে? গরীবালয়ে আসছেন তো?

নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই, এতবড় একটা লোভ সামলানো কি সহজ কথা! নিশ্চয়ই আসবো।

ধন্যবাদ! একটু থেমে কি যেন চিন্তা করলেন চৌধুরী সাহেব। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বলেন—আমি নিঃসন্তান। ঐ ভাগনীটাই আমার পুত্র এবং কন্যা। অনেক আশা, অনেক বাসনা নিয়েই ওকে আমি মানুষ করেছিলাম…যাক সে সব কথা, আপনারা মেহেরবানি করে আসবেন কিন্তু।

রায়বাহাদুর শ্যামাচরণ মহাশয় বলে ওঠেন—চৌধুরী সাহেব, শুনেছিলাম আপনার নাকি একটি পুত্রসন্তান ছিল?

ছিল,—বিশ বছর আগে তাকে হারিয়েছি। ইন্সপেক্টার, আপনাকে কি বলবো, আট বছরের সে বালকের স্মৃতি আজও আমরা ভুলতে পারিনি। বাষ্পরুদ্ধ হয়ে আসে চৌধুরী সাহেবের কষ্ট— আমার মনির ছিল অপূর্ব, অদ্ভুত ছেলে।

অনুতপ্ত কণ্ঠে বলে ওঠেন মি. হারুন—চৌধুরী সাহেব না জেনে কথাটা বলে ভুল করেছি।

না না, আপনি কোন ভুল করেননি ইন্সপেক্টার সাহেব। আপনি না বললেও সদাসর্বদা তার স্মৃতি আমার হৃদয়ে আঘাত করে চলেছে। অনেক কষ্টে ঐ ভাগনীটাকে চোখের সামনে রেখে তাকে ভুলে আছি। আচ্ছা আজকের মত উঠি তাহলে—কথাটা বলে উঠে পড়েন চৌধুরী সাহেব।

সবাই তাকে বিদায় সম্ভাষণ জানান।

বাগানে বসে একটা মালা গাঁথছিল নূরী, গুন গুন করে গান গাচ্ছিলো। এমন সময় পেছনে এসে দাঁড়ায় রহমত, নূরীকে জিজ্ঞেস করলো—নূরী সর্দার কোথায়?

ফুলের মালা গাঁথতে গাঁথতেই বলেন নূরী—কি জানি কোথায় সে? আচ্ছা রহমত, শহর থেকে কখন এলে?

এই তো আসছি।

নতুন কোন খবর আছে তাহলে?

খবর না থাকলে কি আর অমনি ছুটে এসেছি।

শহরের বিভিন্ন জায়গায় দস্যু বনহুরের অনুচর ছড়িয়ে থাকতো। নতুন কোন খবর হলেই এসে জানাতো তারা রহমতের কাছে। রহমত খবর নিয়ে ছুটতো বনহুরের নিকট।

নূরী হেসে বলে—কি খবর রহমত, একটু বল না শুনি?

তুমি আবার শুনবে?

হ্যাঁ, বল?

শহরে এক ধনবান লোক আছেন, ভদ্রলোকের নাম চৌধুরী মাহমুদ খান। আজ সন্ধ্যার পর তাঁর কন্যার জন্ম উৎসব হবে।

তাতে কি হলো? এ আবার নতুন খবর কি?

শুনোই না, চৌধুরী সাহেব তাঁর কন্যাকে বহুমূল্যের একটা হীরার আংটি উপহার দেবেন।

তাই বল। নিশ্চয় খুব সুন্দর হবে সে আংটিটা?

আমি কি আর দেখেছি! তবে নিশ্চয়ই খুব সুন্দর হবে। এ আংটিটা যদি তোমার আংগুলে পরো, কি সুন্দর মানাতো!

সত্যি রহমত, আমি হুরকে বলবো, ঐ আংটি আমার চাই। মালা গাঁথা শেষ করে মালাটা ঘুরিয়ে দেখতে দেখতে কথাটা বলে নূরী।

রহমত বলে—যাই, সর্দার কোথায় দেখি।

চলে যায় রহমত। নূরী মালা হাতে উঠে দাঁড়ায়। মালা হাতে ঝরণার দিকে এগিয়ে চলে সে। হঠাৎ ওর নজরে পড়ে ঝরনার পাশে একটা পাথরখণ্ডে বসে আছেন বনহুর।

নূরী পা টিপে টিপে বনহুরের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো। তারপর চট করে মালাটা ওর গলায় পরিয়ে দিয়ে বসে ছিল পাথরখণ্ডটার একপাশে। হেসে বলে—খুব চমকে দিয়েছি, না?

চমকাবার বান্দা বনহুর নয়। মালাটা হাতে নিয়ে নাড়াচড়া করতে থাকে সে।

নূরী আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে, একটা খবর আছে।

বল!

রহমত এসেছে।

তারপর?

শহরে কোন এক চৌধুরী-কন্যার নাকি জন্ম উৎসব।

হ্যাঁ, সে উৎসবে আমারও দাওয়াত আছে।

আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করে নূরী—তার মানে?

মানে আমি যাব সে উৎসবে।

তাহলে তুমিও সে হীরার আংটির কথা জানতে পেরেছ? হুর, ঐ আংটি আমার চাই। বল দেবে আমাকে?

হ্যাঁ নূরী, সে হীরার আংটিটা তোমার ঐ সুন্দর আংগুলে অপূর্ব মানাবে।

হুর, সত্যি তুমি কত ভালবাস আমাকে।

উঠে দাঁড়ায় বনহুর। মালাটা খুলে অন্যমনস্কভাবে নূরীর হাতে দেয়। তারপর চলে যায় সে দরবার কক্ষের দিকে, যেখানে অনুচরবৃন্দ দাঁড়িয়ে আছে তার প্রতীক্ষায়।