দস্যু বনহুরের ভয়ে দেশবাসী প্রকম্পমান। পথে-ঘাটে-মাঠে শুধু ঐ এক কথা—দস্যু বনহুর—দস্যু বনহুর! কখন যে কোথায় কার ওপর হানা দিয়ে বসবে কে জানে!

ধনীরা তো সব সময় আশঙ্কা নিয়ে দিন কাটাচ্ছে। তাদের ভয়ই বেশি। দস্যু বনহুরের জন্য কারও মনে শান্তি নেই। দস্যু বনহুর যে কে, কেমন তার আসল রূপ, তা কেউ জানে না। কোথা থেকে আসে সে, কোথায় চলে যায়, তাও কেউ বুঝতে পারে না। গভীর রাতে জমকালো একটা অশ্বপৃষ্ঠে দেখা যায় তাকে। গোটা শরীরে তার কালো পোশাক। মাথায় কালো কাপড়ের পাগড়ি। মুখে একটা কালো রুমাল জড়ানো। কোমরের বেল্টে গুলিভরা রিভালবার। বিশেষতঃ অন্ধকার রাতেই বনহুর হানা দেয়। শহরে-বন্দরে, গ্রামে, পথে-ঘাটে-মাঠে সব জায়গায় হয় তার আবির্ভাব।

বনহুরের নামে মানুষ যতই আতঙ্কিত হউক না কেন, আদতে বনহুর ছিল অত্যন্ত সুন্দর সুপুরুষ। মনও ছিল তার উদার—মহৎ। দস্যুবৃত্তি বনহুরের পেশা নয়—নেশা। খেয়ালের বশে সে দস্যুতা করত। দস্যুতায় বনহুর আনন্দ পেত।

হয়ত এক ধনীর বাড়িতে হানা দিয়ে তার সর্বস্ব লুটে নিয়ে বিলিয়ে দিত সে দীন-হীন গরীবদের মধ্যে। নয় ফেলে দিত সাগরের জলে। অদ্ভুত ছিল বনহুরের চালচলন। বনহুরের প্রাণ ছিল যেমন কোমল, তেমনি কঠিন।

বনহুরের সবচেয়ে প্রিয় ছিল তার অশ্ব তাজ। যেখানে যেত বনহুর, তাজ হত তার সঙ্গী। নিজ হাতে সে তাজকে ছোলা খাওয়াতো, গা ঘষে দিত, এমন কি তাজ যখন ঘাস খেত, বনহুর পাশে বশে খেত রুটি আর মাংস। মাঠে যখন চরতো, বনহুর বসে থাকতো তার পাশে। হয়ত শিস দিয়ে ঘাস খাওয়াতো।

তাজও তেমনি ভালবাসতো বনহুরকে। বনহুরের ইঙ্গিত তাজ বুঝতো। তাজ ছিল অত্যন্ত চালাক ও বুদ্ধিমান অশ্ব। তার গতিও ছিল উল্কার মত দ্রুত। অন্ধকারেও তাজ কোনদিন পথ হারাতো না।

দস্যুতা করতে গিয়ে অনেক সময় বনহুর তাজকে বাইরে রেখে প্রবেশ করতো অন্দরবাড়িতে। হয়ত ধরা পড়ে যাবার ভয়ে বনহুরকে অন্য পথে প্রাচীর টপকে পালাতে হত। বনহুর শুধু একটি শিস দিত, সঙ্গে সঙ্গে তাজ গিয়ে হাজির হত তার পাশে। বনহুর প্রাচীরের ওপর থেকে লাফিয়ে পড়তো তাজের পিঠে। তারপর আর কে পায় তাকে!

তাজের লাগাম ছিল না! বনহুর তাজের কাঁধের কেশ ধরে উবু হয়ে থাকে, তাজ ছুটতো হাওয়ার বেগে।

তাজের পিঠে ছুটে চলেছে বনহুর।

প্রান্তরের বুক চিরে গহন বনে প্রবেশ করলো বনহুরের অশ্ব। এবার তার গতি কিছুটা মন্থর হয়ে এলো। গহন বনের মধ্য দিয়ে সরু একটা পথ ধরে ছুটতে লাগলো তাজ। ভোরের আলো তখন গহন বনকে অনেকটা হাল্কা করে এনেছে।

বনের মধ্যে বহুকালের পুরানো এক রাজপ্রাসাদ। কালের কঠোর নিষ্পেষণে আজ সে প্রাসাদ শুধু ইটের স্তুপে পরিণত হয়েছে। এককালে সেখানে যে বিরাট এক রাজবাড়ি ছিল অনুমানে তা বুঝা যায়। আজ সে প্রাসাদের গায়ে বিরাট বিরাট অশ্বথ বৃক্ষ জন্মেছে। আগাছায় ভরে উঠেছে প্রাসাদের অন্তপুর। সেটা যেন ঐ ভগ্নপ্রাসাদের নিকটে এসে আরও ঘন হয়েছে।

বনটা ছিল শহর ছেড়ে অনেক দূরে। তাই কোন লোকজন এ বনে কোনদিন প্রবেশ করত না। শিকারীরা মাঝে মাঝে শিকারে আসত বটে, কিন্তু তারা বনের খুব ভিতরে প্রবেশ করার সাহস পেত না। কাজেই ভগ্নপ্রাসাদটি ছিল লোকচক্ষুর অন্তরালে।

সেই ভগ্নপ্রাসাদের সম্মুখে এসে বনহুরের অশ্ব থেমে ছিল। লাফিয়ে নেমে দাঁড়ালো বনহুর। সঙ্গে সঙ্গে দু’জন লোক এসে তাজকে ধরল। বনহুর ভগ্নপ্রাসাদের একটা দরজা লক্ষ্য করে এগুতেই দরজা খুলে গেল। ভিতরে প্রবেশ করল বনহুর, অমনি দরজা বন্ধ হয়ে গেল। বাইরে থেকে তখন দেখলে মনে হবে, যেন একটা পাথরখণ্ড বা একটা মরচে ধরা লৌহপাত।

বনহুর দরজার ওপাশে পৌঁছতেই দু’জন সশস্ত্র দস্যু সসম্মানে সরে দাঁড়ালো।

বাইরে থেকে রাজপ্রাসাদটাকে ভগ্নস্তুপ বলে মনে হলেও আদতে ভিতরটা তার ভগ্নস্তুপ ছিল না। সুন্দর ঝকঝকে একটা রাজবাড়ি বলেই মনে হত। বাড়ির ভিতরের পথগুলো সাদা মার্বেল পাথরে গাঁথা। উঠানে সুন্দর সুন্দর ফোয়ারা, তার চারপাশে ফুলের বাগান।

বনহুর সে পথ ধরে সোজা এগিয়ে চলল। কিছুদূর এগুতেই সম্মুখে বিরাট বাঘের মুখের আকারে পাথরের মুখ হা করে রয়েছে। বনহুর বাঘের একটা দাঁতে পা দিয়ে চাপ দিতেই বাঘের জিভটা ভিতরে ঢুকে গেল, সেখানে দেখা গেল একটা সুড়ঙ্গ পথ, সে সুড়ঙ্গপথে দ্রুত এগিয়ে চলল সে।

মাটির নিচে রাজপ্রাসাদের মত আর একটা বাড়ি। পাশাপাশি কয়েকটা কক্ষ। প্রত্যেক কক্ষে বেলওয়ারী ঝাড় ঝুলছে। ঝাড়ের মধ্যে অসংখ্য মোমবাতি জ্বলছে।

মাঝখানের বড় একটা কক্ষে এক বৃদ্ধ শায়িত। শয্যাশায়িত ব্যক্তি যদিও বৃদ্ধ, তবু তার চেহারা বলিষ্ঠ। মস্তবড় গোঁফ, মাথায় ঝাঁকড়া চুল, কানে বালা। হাতে বালা। লোকটা অসুস্থ, মাঝে মাঝে সে কোঁকিয়ে উঠছিল। চোখের রঙ ঘোলাটে হয়ে এসেছে। মাংসপেশীগুলো যদিও শিথিল হয়ে এসেছে, তবু দেখলে বুঝা যায়, এককালে তার শরীরে ছিল অসীম শক্তি। শয্যাশায়িত বৃদ্ধ দস্যু কালু খাঁ।

বনহুর কক্ষে প্রবেশ করলো।

পদশব্দে মুখ তুলে তাকালো কালু খাঁ—কে, বনহুর?

 হ্যাঁ বাপু। এগিয়ে এলো সে কালু খাঁর পাশে।

কালু খাঁ হাত দিয়ে নিজের বিছানায় একটা অংশ দেখিয়ে বলেন—বস্ বাছা।

বনহুর বসে ছিল কালু তাঁর পাশে, বৃদ্ধের একখানা হাত মুঠায় চেপে ধরে বলেন—বাপু, এখন তোমার কেমন লাগছে?

বৃদ্ধ ঘোলাটে চোখে বনহুরকে ভাল করে দেখার চেষ্টা করে বলেন—বনহুর, আমি আর বাঁচবো না।

বনহুরের চোখ দুটো ছলছল করে ওঠে, বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলে—বাপু, আমি তোমার জন্য ভাল ডাক্তার নিয়ে আসব।

না বনহুর, ডাক্তারের আর প্রয়োজন হবে না। একটু থেমে পুনরায় ডাকে কালু খাঁ—বনহুর।

বল বাপু।

বৃদ্ধ কালু খাঁ ভয়ানক হাঁফাচ্ছিল! ঘেমে নেয়ে উঠেছে তার সমস্ত শরীর, অতি কষ্টে বলে সে—বনহুর, আজ বিদায়ের দিনে তোকে একটা কথা বলবো, যা এতদিন বলি বলি করেও বলা হয়নি।

বাপু, তুমি সুস্থ হয়ে ওঠো, আমি সব শুনবো।

না না, তা হবে না, আজ না বললে হয়ত আর কোনদিন বলা হবে না।

বনহুর কালু খাঁর বুকে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে—বাপু, তোমার কি খুব কষ্ট হচ্ছে?

না রে না, কোন কষ্ট হচ্ছে না। বনহুর, একটু পানি দে দেখি বাছা।

বনহুর পাশের সোরাহী থেকে এক গেলাস পানি এনে কিছুটা পানি ঢেলে দিল কালু খাঁর মুখে।

বৃদ্ধ পানি খেয়ে তৃপ্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বলেন—বনহুর, সরে আয়, আরও কাছে সরে আয়।

বনহুর আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে বলেন—এই তো আমি তোমার পাশে বাপু।

বৃদ্ধ কালু খাঁ বলে ওঠে—বনহুর, আমি তোর বাপু নই। আমি তোর বাপু নই, বনহুর। বৃদ্ধ কালু ঘা হাঁফাতে হাঁফাতে বলে—তোকে আমি কুড়িয়ে পেয়েছিলাম। সে প্রায় বিশ বছর আগে—বালিশের তলা থেকে একটা মালা বের করে বনহুরের হাতে দেয়—বিশ বছর আগে যখন তোকে কুড়িয়ে পাই, তখন এই মালাছড়া ছিল তোর গলায়। দেখ বনহুর, এই মালা তুই চিনতে পারিস কিনা?

বনহুর মালাছড়া হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে থাকে। হঠাৎ তার আংগুলের চাপে লকেটের ঢাকনা খুলে যায়। কি আশ্চর্য! লকেটের ভিতর তারই ছোটবেলার ছবি। পাশের ঢাকনায় আর একটা ফুটফুটে বালিকার ছবি, পাশাপাশি দু’খানা মুখ। বনহুর তন্ময় হয়ে তাকিয়ে থাকে লকেটের ছবি দু’খানার দিকে। ধীরে ধীরে তার মানসপটে ভেসে ওঠে বিশ বছর আগের একটা দৃশ্য…

তরঙ্গায়িত নদীবক্ষে দুলতে দুলতে এগিয়ে চলেছে একটা নৌকা। দু’জন মাঝি দাঁড় টানছে, একজন মাঝি বসে আছে হাল ধরে। নৌকার সম্মুখ পাটাতনের ওপর পাশাপাশি বসে খেলা করছে একটা বালক আর একটা বালিকা। বালকের বয়স আট-নয় বছর, আর বালিকার বয়স ছয়-সাত। বালক ছবি আঁকছিল। বালিকা রুল দিয়ে ছবির ওপর আঁচড় কেটে ছবিটা নষ্ট করে দেয়। বালক অমনি মুখটা গম্ভীর করে ফেলে। বালিকা নিজের ভুল বুঝতে পেরে দুঃখিত হয়, বিনীত কণ্ঠে বলে— রাগ করলে? ভুল হয়েছে, মাফ করে দাও, মনির ভাই।

বালক খাতাটা ছুঁড়ে ফেলে দিল নদীর জলে, তারপর গম্ভীর কণ্ঠে বলে—দোষ করে মাফ চাইলেই বুঝি মাফ পাওয়া যায়… বালক আর বালিকা মিলে এমনি ঝগড়া চলছে।

নৌকায় ছৈ-এর মধ্যে বসে রয়েছেন দু’জন মহিলা, তাদের অনতিদূরে একজন ভদ্রলোক বসে বসে বই পড়ছেন। ভদ্রলোক বালকের পিতা চৌধুরী মাহমুদ খান। আর ভদ্র মহিলাদের একজন বালকের আম্মা মরিয়ম বেগম, দ্বিতীয় মহিলা চৌধুরী মাহমুদ খানের বোন রওশন আরা বেগম। বালিকা রওশন আরা বেগমের কন্যা—নাম মনিরা, আর বালকের নাম মনির।

ননদের কন্যার নাম সখ করে মরিয়ম বেগমই রেখেছিল—মনিরা বেগম। ভিতরে ভিতরে ছিল তাঁর এক গোপন বাসনা। নিজের পুত্র মনিরের নামের সঙ্গে মনিরা নাম মিল করে রাখাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য।

দেশের বাড়িতে বেড়াতে এসে শিশু কন্যাটিকে কোলে তুলে নিয়ে বলেছিল মরিয়ম বেগম— রওশন আপা, একটা কথা বলবো?

রওশন আরা বেগম বলেছিল—বলো।

মরিয়ম বেগম বলেছিল—আমার পুত্রকে তোমায় দিলাম, তোমার কন্যাটিকে আমি চাই কিন্তু।

আনন্দের কথা। আমার মেয়ে নিয়ে তুমি যদি সুখী হও এ তো আমার পরম সৌভাগ্য।

তারপর মনিরার এক জন্ম উৎসবে মরিয়ম বেগম দু’ছড়া মালা তৈরি করে পুত্র এবং ননদের কন্যাকে উপহার দেন। সে দিন ভাবী আর ননদের মধ্যে কথা নেয়া-দেয়ার পালা শেষ হয়ে যায়। হেসে বলেছিল মরিয়ম বেগম—এই মালা পরিয়ে দিয়ে আমি কথা পাকা করলাম, মনিরের সঙ্গে বিয়ে দেব মনিরার। সে মালা ছড়াই আজ বনহুরের হাতে। নীরব নয়নে তাকিয়ে আছে সে সম্মুখের দিকে—একটার পর একটা দৃশ্য ভেসে উঠছে তার মনের কোণে। যদিও অস্পষ্ট তবু বেশ মনে আছে, মায়ের সে কথার পর কিছুদিন যেতে না যেতে একদিন মনিরার আব্বা মারা গেল। খবর পেয়ে তার আব্বা চৌধুরী মাহমুদ খান স্ত্রী মরিয়ম বেগম ও পুত্র মনিরকে নিয়ে দেশের বাড়ি গেল। ফিরে আসার সময় শোকাতুরা বোনকে নিয়ে চলেন সঙ্গে করে।

নৌকা চলছে… সন্ধ্যার অন্ধকার ক্রমে ঝাপসা হয়ে আসছে। মনির আর মনিরার ঝগড়া থেমে গেলেও রাগ পড়েনি। মনির উঠে গিয়ে পিতার পাশে বসলো। চৌধুরী মাহমুদ খান হেসে বলেন—এত গম্ভীর কেন মনির? মনিরার সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে বুঝি?

গম্ভীর কণ্ঠে বলে ওঠে মনির—আমি ছবি আঁকছিলাম, মনিরা নষ্ট করে দিয়েছে।

হেসে বলেন চৌধুরী সাহেব—ও এই কথা। মা মনিরা, এদিকে এসো তো!

ভয়ে ভয়ে মনিরা গিয়ে দাঁড়ালো মামুর পাশে। চৌধুরী সাহেব তাকে আদর করে কোলে টেনে নিয়ে বলেন—তোমার মনির ভাইয়ের আঁকা ছবি নষ্ট করে দিয়েছ?

বালিকা মৃদুস্বরে বলে—ভুল হয়েছে মামুজান। আমি মনির ভাইয়ের কাছে কত করে মাফ চাইলাম, মাফ করলো না।

সে কি মনির, ভুল করে মনিরা যদি একটু ক্ষতি করেই থাকে, তবে কি তা ধরতে হয়? এসো মনির, বলো তোমাকে আমি মাফ করে দিয়েছি।

মনির মনিরার মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে বলে—দিলাম ওকে মাফ করে।

ঠিক সে মুহূর্তে নৌকাখানা দুলে উঠলো। মাঝিদের মধ্য থেকে একজনের গলা শুনা গেল—হুজুর ঝড় উঠেছে, ঝড় উঠেছে, হুঁশিয়ার হুঁশিয়ার…

চৌধুরী সাহেব ছৈ-এর ভেতর থেকে বাইরে এসে দাঁড়ালেন।

আকাশের দিকে তাকিয়ে মুখমণ্ডল তাঁর ফ্যাকাশে হয়ে উঠলো।

গোটা আকাশ ঘন মেঘে আচ্ছন্ন হয়ে গেছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, তার সঙ্গে বইছে দমকা হাওয়া।

মনির এসে দাঁড়িয়েছে পিতার পাশে।

অল্পক্ষণের মধ্যেই প্রচণ্ড ঝড় শুরু হল। মনিরাকে বুকে চেপে ধরে আল্লাহর নাম স্মরণ করতে লাগলেন রওশনআরা বেগম। মরিয়ম বেগম পুত্রের জন্য উৎকণ্ঠিত হয়ে ডাকাডাকি শুরু করলেন।

প্রচণ্ড ঝড়ের দাপটে নৌকাখানা মোচার খোলার মত দুলছে, চৌধুরী সাহেব চিৎকার করে মাঝিদের সাবধান হবার নির্দেশ দিচ্ছেন। অন্য কোনদিকে তাঁর খেয়াল নেই।

একে অন্ধকার রাত। তার ওপর প্রচণ্ড দাপট। মাঝিরা মরিয়া হয়ে নৌকাখানা সামলাতে চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নৌকাখানাকে রক্ষা করতে পারলো না তারা। নদীবক্ষে নৌকাখানা তলিয়ে গেল।

খোদার হয়ত রহম ছিল। অল্পক্ষণেই ঝড়ের বেগ কমে এলে চৌধুরী সাহেব বুঝতে পারলেন, তাঁদের নৌকা গভীর নদীতে ডুবে যায়নি। নদীর একেবারে কিনারে এসে ডুবেছিল।

মাঝিদের সাহায্যে চৌধুরী সাহেব সপরিবারে তীরে পৌঁছতে সক্ষম হলেন। কিন্তু একি, মনির কোথায়। চৌধুরী সাহেব, মরিয়ম বেগম, রওশন আরা বেগম, মনিরা সবাই আছে—শুধু নেই মনির।

মরিয়ম বেগম বিলাপ করে কাঁদতে লাগলেন। চৌধুরী সাহেব অন্ধকারেই পাগলের ন্যায় ছুটাছুটি করতে লাগলেন, আর পুত্রের নাম ধরে চিৎকার করে ডাকতে লাগলেন।

এমন সময় ভোর হয়ে এলো। একমাত্র পুত্রের এই ভয়াবহ পরিণতির জন্য চৌধুরী সাহেব এবং মরিয়ম বেগম পাগল-পাগলিনী প্রায় হয়ে ছিল। রওশন আরা বেগমও কেঁদেকেটে আকুল হলেন।

ওদিকে স্রোতের টানে বহুদূর ভেসে গিয়েছিল মনির।

নদীর কিনারে বালির ওপর অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে আছে সে। খোদার মহিমায় জীবন বেঁচে গেছে মনিরের।

এমন সময় নদীর কিনার ধরে এগিয়ে আসছিল দস্যু কাল খাঁ। হঠাৎ তার দৃষ্টি গিয়ে পড়ে মনিরের দিকে। দেখতে পায় সুন্দর ফুটফুটে একটা বালক পড়ে আছে বালির ওপরে। বালকটি মৃত না জীবিত দেখার জন্য কালু খাঁ বসে পড়ে তার পাশে। বুকে কান লাগিয়ে পরীক্ষা করে দেখে। যখন বুঝতে পারে বালক মৃত নয় জীবিত, তখন তার চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। একটা নতুন আশার আলো উঁকি দিয়ে যায় কালু খাঁর মনে। অতি যত্নে কাঁধে উঠিয়ে গহন বনের দিকে পা বাড়ায় সে,…

কালু খাঁ অস্ফুট কণ্ঠে ডেকে ওঠে—বনহুর!

সম্বিৎ ফিরে পায় বনহুর, কালু খাঁর মুখে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে—বাপু!

কালু খাঁ বলতে আরম্ভ করে—বনহুর, তারপর তোকে নিয়ে এসে আমি নিজের ছেলের মতই লালন-পালন করতে লাগলাম। দিন দিন বড় হতে লাগলি তুই। ভুলে গেলি তোর পিতামাতার কথা। একদিন ফিরে এসে দেখি, তুই বনের মধ্যে একটা ঝোপের পাশে খেলা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছিস। ভোরের সূর্যের আলো পড়েছে তোর মুখে। অপূর্ব সুন্দর লাগছিল তোকে। যেন শিশিরস্নিগ্ধ একটা ফুল। কতক্ষণ যে আমি তন্ময় হয়ে তাকিয়েছিলাম জানি না, হঠাৎ আমার কণ্ঠ দিয়ে বেরিয়ে এলো একটা শব্দ—‘বনহুর’!

বনহুর অস্ফুট কণ্ঠে বলে ওঠে—বাপু!

হ্যাঁ, তারপর ধীরে ধীরে মনির মুছে গিয়ে তৈরি হলো আমার বনহুর। আমি তোকে খেলাধুলার মধ্যে দিয়ে অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা দিতে লাগলাম। একদিন দস্যু কালু খাঁ পরাজিত হলো বনহুরের কাছে। জয়ী হলো সে। সেদিন আমার দস্যু-জীবন সার্থক হলো, নিঃসন্তান কালু খাঁ পুত্ররত্ন লাভে সক্ষম হলো… হঠাৎ অদ্ভুতভাবে হেসে ওঠে কালু খাঁ—হাঃ হাঃ হাঃ! আমার সাধনা সার্থক হয়েছে। আমার বাসনা পূর্ণ হয়েছে। দস্যু কালু খাঁ মরে গেছে… দস্যু কালু খাঁ মরে গেছে। সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দস্যু বনহুর। হাঃ হাঃ হাঃ, একদিন কালু খাঁর ভয়ে দেশবাসী প্রকম্পিত হয়ে পড়েছিল, আজ প্রকম্পিত হচ্ছে দস্যু বনহুরের ভয়ে। আমার সাধনা সার্থক হয়েছে, হাঃ হাঃ হাঃ! হঠাৎ উঠে বসতে যায় কালু খাঁ, সঙ্গে সঙ্গে মুখ থুবড়ে পড়ে যায়। বনহুর দু’হাতে তুলে ধরে ডাকে…বাপু… বাপু…

কিন্তু কালু খাঁ তখন চিরতরে স্তব্ধ হয়ে গেছে। বনহুর কালু খাঁর প্রাণহীন দেহটা বিছানায় শুইয়ে দিয়ে আর্তনাদ করে ওঠে—বাপু… বাপু…

অমনি ছুটে এলো নূরী।

নূরী দস্যু কালু খাঁর পালিতা কন্যা। অবশ্য নূরীর পিতা দস্যু কালু খাঁরই একজন অনুচর ছিল। দস্যুতা করতে গিয়ে নিহত হয় নূরীর বাবা। সে হতে নূরী রয়ে যায় কালু খাঁর নিকটে।

বনহুর এই বনে খেলার সাথী হিসেবে নূরীকেই পেয়েছিল পাশে। বনহুরকে ভালবাসতো নূরী। কিন্তু বনহুরের মনে নূরী তখনও দাগ কাটতে পারেনি। বনহুর নিজকে নিয়ে নিজেই ব্যস্ত থাকতো।

নূরী ছুটে এসে কালু খাঁকে বিছানায় ঢলে পড়ে থাকতে দেখে আর্তনাদ করে ওঠে— বাপু! এ কি হয়েছে তোমার!

বনহুর বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলে— নূরী, বাপু চলে গেছে। বাপু চলে গেছে…

বিলাপ করে ওঠে নূরী—বাপু চলে গেছে। হায়, একি হলো! একি হলো—

বনহুর দু’হাতে মুখ ঢেকে ছোট বালকের ন্যায় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো।

আজ ক’দিন হলো কালু খাঁর মৃত্যু হয়েছে। ঘন বনের ছায়ায় কবর দেয়া হয়েছে তাকে। বনহুর দিনরাত সে কবরের পাশে বসে থাকে। এই গহন বনে সে যে ঐ একটা মানুষকেই ভালবাসতো। সে কোনদিন ভাবতে পারেনি—কালু খাঁ তার পিতা নয়। আজ বিশটা বছর ধরে বনহুর তাকেই চিনে এসেছে। জ্ঞান হবার পর থেকে দেখে এসেছে তাকে। তার যে কোন পিতা-মাতা ছিল, সে কথা ভাবতেও কষ্ট হতে লাগলো বনহুরের। সে যে শিক্ষা পেয়েছে সে শিক্ষা সভ্য সমাজের নয়, দস্যু কালু খাঁ তাকে নিজের মনের মত গড়ে তুলেছিল।

এহেন পিতৃসমতুল্য কালু খাঁর শোক সহসা ভোলা বনহুরের পক্ষে কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেদিন বনহুর কালু খাঁর কবরের পাশে বসে নীরবে চোখের পানি ফেলছিল। এমন সময় নূরী এসে দাঁড়ায় তার পাশে। বনহুরের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে—হুর, বাপু চলে গেছে, তার জন্য সবসময় মন খারাপ করে কোন লাভ হবে না।

মুখ তুলে বনহুর—নূরী, আমি যে বড় একা।

এই তো আমি আছি তোমার পাশে।

নূরী!

চলো হুর, সমস্ত অনুচর তোমার প্রতীক্ষায় বসে আছে।

নূরী!

ভুলে যেও না হুর, তুমি দস্যু-সন্তান।

না, আমি দস্যু-সন্তান নই, আমি দস্যু-সন্তান নই…

সেকি! এসব তুমি কি বলছো হুর?

নূরী জানত বনহুর কালু খাঁরই পুত্র, তাই সে অবাক হয়ে কথাটা বলে।

বনহুর বুঝতে পারলো, কথাটা সে ভুল করেছে। কাল তাঁর হাত ধরে সে শপথ করেছে, কোনদিন সে কাউকে বলবে না, সে দস্যু কালু খাঁর পুত্র নয়। না না, সে দস্যু-সন্তান, সে দস্যু-সন্তান, উঠে দাঁড়ায় বনহুর, নূরীকে লক্ষ্য করে বলে—চলো নূরী, আজ হতে আমি ভুলে গেলাম সব।