দস্যু বনহুরের আস্তানা।

একটা সুউচ্চ আসনে দস্যু বনহুর উপবিষ্ট। সম্মুখে সারিবদ্ধভাবে দণ্ডায়মান তার অনুচরবৃন্দ। মাঝখানে খানিকটা ফাঁকা জায়গা, সেখানে স্তূপাকার করে রাখা হয়েছে সেদিনের লুণ্ঠিত দ্রব্যাদি।

বনহুর গম্ভীর কণ্ঠে বলে—আজ তোমরা যা লুট করে এনেছে তা গরীব-দুঃখীর মধ্যে বিতরণ করে দাও।

একজন বলে ওঠে—সর্দার, এসব বহুমূল্য দ্রব্য।

হুঙ্কার ছাড়ে বনহুর—আমি যা বললাম তাই করবে।

আচ্ছা সর্দার।

বনহুর উঠে দাঁড়ালো— নিয়ে যাও সব।

সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত অনুচর এক একটা ঝোলা কাঁধে তুলে নিয়ে বেরিয়ে গেল।

বনহুর সোজা চললো বিশ্রামকক্ষে।

কক্ষে প্রবেশ করতেই নূরী এসে দাঁড়ালো পাশে, অভিমানভরা কণ্ঠে বলে—হুর, আজকাল সব সময় তুমি শহরেই পড়ে থাক কেন বলতো?

যখন যেখানে কাজ, সেখানেই থাকি।

তা বলে তুমি আমাকে একা ছেড়ে—

তাছাড়া তো কোন উপায় নেই, নূরী।

হুর, তুমি না থাকলে আমি বড় কষ্ট পাই।

মিছেমিছি কষ্ট পাও কেন বলতো? নাসরীন আছে, সায়রা আছে, রুখসানা আছে…

হাজার জন থাক, তবু তোমার অদর্শন অসহনীয় হুর।

নূরী!

হুর তুমি আমার, বলো তুমি আমাকে ভালবাস? বলো, চুপ করে রইলে কেন, বলো?

বাসি।

সত্যি! আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে খুশির আবেগে উঠে দাঁড়ায় নূরী, তারপর হেসে বলে—হুর, অনেকদিন হলো তুমি আমার নাচ দেখতে চাওনা, আজ দেখবে?

যদি তোমার ইচ্ছে হয়, নাচো।

নূরী মনের আনন্দে নাচতে শুরু করলো।

বনহুর আনমনে তাকিয়ে রইলো নূরীর দিকে।

এমন সময় দরজার বাইরে থেকে ডাকলো একজন অনুচর—সর্দার।

কে রহমান? এসো।

নূরীর নাচ থেমে যায়, কক্ষে প্রবেশ করে রহমান-সর্দার!

বলো কি খবর?

সর্দার, পুলিশবাহিনী রহমতকে গ্রেপ্তার করেছে।

বলো কি!

হ্যাঁ সর্দার। আমরা যখন বন্ধনী সেতু পার হচ্ছিলাম, তখন পুলিশ ফোর্স আমাদের ঘেরাও করে ফেলে এবং তুমুল লড়াইয়ের পর আমাদের একজনকে নিহত আর রহমতকে গ্রেপ্তার করে। পুলিশবাহিনীর দু’জন নিহত হয়েছে।

হুঁ বুঝতে পেরেছি, কিন্তু তোমরা যে ঐ পথে যাবে, একথা পুলিশবাহিনী জানতে পারলো কি করে?

সে কথা আমি জানি না সর্দার।

এবার গর্জে উঠলো বনহুর—তোমরা রহমতকে উদ্ধার না করে ফিরে এলে কেন?

সর্দার, প্রত্যেকটা পুলিশের হাতে গুলিভরা রাইফেল ছিল। তাছাড়া—

আমি কোন কথা শুনতে চাইনে, কেন তোমরা তাকে না নিয়ে ফিরে এলে, বলো?

সর্দার! ভীত কণ্ঠস্বর রহমানের।

এখন কি তারা রহমতকে নিয়ে শহরে পৌঁছে গেছে?

সর্দার, এখনও তারা পৌঁছতে পারেনি, রহমত গ্রেপ্তার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমি ঘোড়া নিয়ে ছুটে এসেছি।

যাও তাজকে প্রস্তুত করো, আমি এক্ষুণি যাব।

বেরিয়ে যায় রহমান।

নূরী ছলছল চোখে বনহুরের পাশে ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ায়—তুমি একাই যাবে?

মাথায় পাগড়ী জড়াতে জড়াতে বলে বনহুর—হ্যাঁ।

কিন্তু পুলিশ ফোর্স রয়েছে আর রয়েছে গুলিভরা রাইফেল—

বনহুর কাপুরুষ নয়।

হুর!

এমন সময় পুনরায় রহমান কক্ষে প্রবেশ করে—সর্দার, তাজ প্রস্তুত।

নূরী রিভলবারখানা বনহুরের হাতে তুলে দিয়ে অস্ফুট কণ্ঠে বলে—খোদা হাফেজ।

পুলিশ ফোর্স রহমতকে বন্দী করে নিয়ে চলেছে। লাশগুলোও তাদের গাড়িতে উঠিয়ে নিয়েছে। গাড়ি উল্কা-বেগে ছুটে চলেছে।

পেছনে ছুটে আসছে তাজের পিঠে দস্যু বনহুর।

একে অন্ধকার রাত, তার ওপর ঝুপঝুপ করে বৃষ্টি পড়ছে, সে সঙ্গে বইছে দমকা হাওয়া। বনহুরের অশ্বপদশব্দ পুলিশদের কানে পৌঁছে না।

অতি নিকটে পৌঁছে যায় বনহুর!

বনহুর মোটরের আলো লক্ষ্য করে এগুচ্ছে। মাত্র কয়েক মিনিট। বনহুরের অশ্ব খুব কাছে এসে গেছে। হাওয়ার বেগটাও যেন আরও বেড়েছে। সাঁ সাঁ করে শব্দ হচ্ছে। সে শব্দ ভেদ করে বনহুরের অশ্ব এগিয়ে আসছে।

মোটরের পাশ কেটে চলে যায় তাজ, বনহুর লাফিয়ে পড়ে ড্রাইভ আসনে। সঙ্গে সঙ্গে বনহুরের গুলিতে ড্রাইভারের রক্তাক্ত দেহটা মুখ থুবড়ে পড়ে যায় গাড়ির মধ্যে। পুলিশরাও অন্ধকারে গুলি ছুঁড়তে থাকে, কিন্তু নিজেদের গুলিতে নিজেরাই মরতে লাগলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভয় পেয়ে সমস্ত পুলিশ এদিকে ওদিকে পালিয়ে গেল।

বনহুর রহমতের হাত পায়ের বাঁধন কেটে দিয়ে তুলে নিলো তাজের পিঠে। তারপর ছুটে চললো হাওয়ার বেগে।

পরের দিন এই ঘটনা নিয়ে সারা দেশে হুলস্থুল পড়ে গেল। পুলিশমহলে ভীষণ চাঞ্চল্য সৃষ্টি হলো। মাত্র একজন দস্যু এতগুলো পুলিশকে পরাজিত করে বন্দীকে নিয়ে পালাতে সক্ষম হলো, অথচ কেউ তাকে গ্রেপ্তার করতে পারলো না।

মি. হারুন এবং আরও অন্যান্য পুলিশ অফিসার মিলে শংকর রাওয়ের সঙ্গে গোপন আলোচনা চালাতে লাগলেন, কি করে এ দস্যুকে পাকড়াও করা যায়।

শংকর রাও ছদ্মবেশে বেরিয়ে ছিল, সঙ্গে গোপাল বাবুও চললেন। শংকর রাও গ্রাম্য বৃদ্ধের বেশে, গোপাল বাবুর শরীরে ছেড়া জামা-কাপড়, ঠিক একজন গ্রাম্য যুবক যেন। শহরের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেফিরে বেড়াতে লাগলেন তাঁরা।

সারাটা দিন ঘোরাফেরা করে ক্লান্ত হয়ে ছিল। সম্মুখে একটা হোটেল দেখে উঠে ছিল তারা সে হোটেলে।

হোটেলে প্রবেশ করতেই একজন চিৎকার করে উঠলো—ভাগো হিয়াসে।

শংকর রাও বৃদ্ধের অনুকরণে গলার স্বরকে বদলে নিয়ে বলেন–দু’কাপ চা খাব বাবু সাব।

অন্য হোটেল দেখো গে, ভাগো এখান থেকে।

শংকর রাও মনে মনে ভীষণ রেগে গেল। গোপাল বাবুকে সঙ্গে করে হোটেল থেকে বেরুতে যাবে, ঠিক সে মুহূর্তে কয়েকজন লোক প্রবেশ করলো হোটেলে।

শঙ্কর রাও থমকে দাঁড়ালেন, লোকগুলোর চেহারা যেন সন্দেহজনক বলে মনে হলো তার কাছে।

শঙ্কর রাও গোপাল বাবুর গা টিপে দিল। তারপর পকেট হাতড়ে দশ টাকার একখানা নোট বের করে এগিয়ে দিল হোটেলের ম্যানেজারের দিকে—শুধু দুকাপ চা।

ঐ চেয়ারে বসো। হোটেলের ম্যানেজার এক কোণের দুটি চেয়ার দেখিয়ে বলল।

শঙ্কর রাও আর গোপাল বাবু বসে ছিল এক পাশের দুটো চেয়ারে।

যে লোকগুলো কিছু পূর্বে হোটেলে প্রবেশ করেছিল, তারা ওদিকে কয়েকখানা চেয়ারে গোলাকার হয়ে বসে পড়ে।

বয় তাদের সম্মুখে কয়েকখানা মদের বোতল আর পেয়ালা রেখে যায়। মদ পান করতে করতে কি যেন সব আলাপ চলে তাদের মধ্যে। শঙ্কর রাও চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে কান পাতেন। কে একজন বলছে—কাজ হাসিল করতে পারলে বহুৎ টাকা মিলবে। এরপর আরও কি কি যেন কথাবার্তা চললো, বুঝা গেল না।

শঙ্কর রাও আর গোপাল বাবু সেদিনের মত পথে নেমে ছিল। সে হোটেল সম্বন্ধে সন্দেহ তাদের ঘনীভূত হলো।

পরদিন দু’জনে ভিখারীর বেশে এসে বসলেন, হোটেলের অদূরে বটতলায় একটা কম্বল বিছিয়ে ভিক্ষে শুরু করলেন শঙ্কর রাও ও গোপাল বাবু— কিন্তু দৃষ্টি তাদের রইলো সে হোটেলের দিকে।

সন্ধ্যে হয় প্রায়। চারদিক ঝাপসা হয়ে এসেছে। লাইটপোস্টগুলো জ্বলে উঠবে একটু পরে, ঠিক সে সময় একটা কালো রঙের মোটর এসে থামলো হোটেলের সম্মুখে।

গাড়ি থেকে নেমে এলো এক কাবুলিওয়ালা। হোটেলে প্রবেশ করতেই হোটেলের ম্যানেজার লোকটাকে সাদর সম্ভাষণ জানালো। আরও কয়েকজন বলিষ্ঠ চেহারার লোক তাকে কুর্ণিশ জানিয়ে হোটেলের ভিতরে নিয়ে গেল।

শঙ্কর রাও আর গোপাল বাবু বটতলা থেকে সব দেখলেন। গোপাল বাবু চোখ টিপে বলেন—শঙ্কর, তুমি যাই বলল, ঐ বেটাই দস্যু বনহুরের লোক।

সত্যি?

আমার সে রকমই মনে হচ্ছে।

আজকাল মুরাদকে আর দাওয়াত করতে হয় না। প্রতিদিন একবার করে চৌধুরীবাড়িতে আসা চাই-ই। যদিও মনিরা তাকে বেশ এড়িয়ে চলে, তবু মুরাদ মনে কিছু করে না, বরং কিসে মনিরা তাকে ভালবাসবে তাই করে। মুরাদ এলে অত্যন্ত খুশি হন চৌধুরী সাহেব এবং মরিয়ম বেগম। মনিরাকে মিশার সুযোগ দিয়ে সরে থাকেন তাঁরা, কিন্তু মনিরা সে সুযোগ চায় না, মনে মনে ভীষণ বিরক্ত হয় সে।

মনিরাকে নিয়ে প্রায়ই বেড়াতে যাবার প্রস্তাব করে মুরাদ। চৌধুরী সাহেব এবং মরিয়ম বেগম খুশিভরা কণ্ঠে সম্মতি জানান, কিন্তু মনিরাকে কিছুতেই রাজি করাতে পারেন না তাঁরা।

একদিন মনিরা নিজের ঘরে শুয়ে আছে।

মুরাদের গাড়ি এসে থামলো বারান্দায়। চৌধুরী সাহেব তাকে সাদর সম্ভাষণ জানালেন। মুরাদ জিজ্ঞেস করলো—মনিরা কোথায়?

ব্যস্তকণ্ঠে বলেন চৌধুরী সাহেব—দেখি উপরে আছে বুঝি? তুমি বসো।

আজ বসবো না চৌধুরী সাহেব। কাল আমি বলে গেছি মনিরাকে একটা ফাংশনে নিয়ে যাব। দেখুনতো ওর কাপড়-চোপড় পরা হয়েছে কিনা?

আচ্ছা বাবা—আমি দেখছি। চৌধুরী সাহেব ব্যস্ততার সঙ্গে উপরে উঠে যান। সম্মুখে স্ত্রীকে দেখতে পেয়ে বলেন—মনি কই? মুরাদ এসেছে, ওকে নাকি কোন ফাংশনে নিয়ে যাবে, কালই বলে গেছে বেচারা, দেখতো তৈরি হয়েছে কিনা!

তাই নাকি, সে কথা তো তুমি আমাকে বলেনি, কি যে মেয়ে বাবা মরিয়ম বেগম মনিরার কক্ষের দিকে চলে যান, কিন্তু কক্ষে প্রবেশ করে অবাক হন, বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বলেন—এ ভরসন্ধ্যায় বিছানায় শুয়ে আছিস কেন মনিরা?

কেন, শুতে দোষ আছে নাকি?

মুরাদ এসেছে!

তাতে আমার কি মামীমা?

সেকি, কাল নাকি সে তোকে বলে গেছে, আজ কোন ফাংশনে যাবে।

কোন ফাংশনে যাবার সখ আমার নেই।

মুরাদ যখন বলছে তখন যা না বাছা।

তা হয় না মামীমা, সে আমার কে যে তার সঙ্গে যাব?

পাগলী মেয়ে! দুদিন পর সে তোর স্বামী……

মামীমা…চিৎকার করে মরিয়ম বেগমকে থামিয়ে দেয় মনিরা।

মরিয়ম বেগম থ’ মেরে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন মনিরার মুখের দিকে, তারপর ধীরে ধীরে বেরিয়ে যান!

চৌধুরী সাহেব উন্মুখ হৃদয় নিয়ে প্রতীক্ষা করছিল, স্ত্রীকে বিষণ্ণ মুখে। ফিরে আসতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন-কি হলো? মনিরা….

ও কথা আমাকে আর বলো না।

সেকি! মুরাদ যে দাঁড়িয়ে আছে।

তাকে যেতে বলো, মনিরা যাবে না।

কি মুস্কিল! হঠাৎ আবার কি হলো তার?

মাথাটা নাকি বডড় ধরেছে, কয়েকবার বমিও হয়েছে।

তাই নাকি, তাহলে তো ডাক্তার ডাকতে হয়!

ডাক্তার ডাকার আগে মুরাদকে বিদায় করে দাও।

আচ্ছা বলছি। নিচে নেমে যান চৌধুরী সাহেব।

মুরাদ ঘন ঘন পায়চারী করছিল, চৌধুরী সাহেবকে দেখে এগিয়ে আসে—মনিরা কই?

বড় দুঃখের কথা বাবা, মনিরার ভয়ানক জ্বর এসেছে। যেমন বমি তেমনি নাকি মাথাধরা…

হঠাৎ কেমন জ্বর তার?

খুব বেশি।

আমি তাকে একটু দেখতে পারি কি?

হ্যাঁ…না না, তুমি আবার কষ্ট করে…

এতে আর কষ্টের কি আছে, কই চলুন তো একবার দেখে আসি।

তোমার ফাংশনের বিলম্ব হয়ে যাবে।

তা হউক।

চৌধুরী সাহেব কিছু বলার পূর্বেই সিঁড়ি বেয়ে উপরে চললো মুরাদ।

মরিয়ম বেগম আড়ালে থেকে সব শুনছিল। তিনি ব্যস্ত-সমস্ত হয়ে বেরিয়ে আসেন-কাল ভোরে এসে দেখে যেও বাবা, এখন একটু ঘুমাচ্ছে।

তা হউক, আমি ওকে জাগাবো না। উপরে উঠে মরিয়ম বেগমকে জিজ্ঞেস করলো মুরাদ-মনিরা কোথায়?

একটা ঢোক গিলে বলেন মরিয়ম বেগম—ঐ যে ঐ ঘরে।

কক্ষে প্রবেশ করে এগিয়ে যায় মুরাদ মনিরার বিছানার দিকে—মনিরা, তোমার নাকি অসুখ? মাথায় হাত দিতে যায় মুরাদ। আজকাল মুরাদ মনিরাকে তুমি বলে সম্বোধন করে।

মনিরা চট করে সরে বসে বলে—খবরদার, গায়ে হাত দেব না।

তোমার নাকি অসুখ?

কে বলেন আমার অসুখ?

দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে চৌধুরী সাহেব আর মরিয়ম বেগমের মুখ অন্ধকার হয়ে যায়।

মুরাদের গলা শোনা যায়—তোমার মামুজান আর মামীমা বলেন।

মিছে কথা! আমার কোন অসুখ করেনি!

থ্যাঙ্ক ইউ, ভেরী গুড। তাহলে তৈরি হয়ে নাওনি কেন?

আমি আপনার সঙ্গে কোথাও যাব না।

মনিরা!

আমি না গেলে আপনি কি করতে পারবেন?

তোমার মামুজান আর মামীমা এর জবাব দেব।

মামুজান আর মামীমার মতে আমার মত নয়—একথা ভুলে যাব না মি. মুরাদ।

মনিরা, এত সাহস তোমার?

হ্যাঁ, আমি…কিছু বলতে যাচ্ছিলো মনিরা। সে মুহূর্তে কক্ষে প্রবেশ করেন চৌধুরী সাহেব—মনিরা কি হচ্ছে, এসব পাগলামি..

মুরাদ রাগতভাবে বলে ওঠে—চৌধুরী সাহেব, আমি বুঝতে পেরেছি আপনাদের চালাকি। এত মিথ্যাবাদী আপনারা!

মুরাদের অশালীন কথা শুনে ভীষণ রেগে গেল চৌধুরী সাহেব, বলেন—মুরাদ, বিয়ে দেব বলে কথা দিয়েছিলাম, বিয়ে তো আর দেইনি। এখানে তোমার কোন অধিকার নেই। তুমি যেতে পারো।

বেশ, আমিও দেখে নেব, কথা দিয়ে কি করে কথা পাল্টান। বলেই খট খট করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল মুরাদ।

তখনকার মত মুরাদ চলে গেলেও বাইরে থেকে বিষধর সাপের মত ফোঁস ফোঁস করতে লাগলো, সুযোগ পেলেই ছোবল মারবে। গুণ্ডাদের আস্তানা হলো তার সম্বল। শয়তানদের সঙ্গে চললো তার গোপন আলোচনা। হাজার হাজার টাকা সে ছড়িয়ে দিতে লাগলো গুণ্ডাদের মধ্যে, যেমন করে হউক মনিরাকে তার চাই।

সেদিন মনিরা কোন এক ফাংশন থেকে ফিরছিল। নিজেদের গাড়ির বিলম্ব দেখে অন্য একটা ভাড়াটিয়া গাড়ি নিয়ে রওনা দিল সে।

গাড়ি ছুটে চলেছে, মনিরা জনমুখর রাস্তার দিকে তাকিয়েছিল। ভাবছিল মুরাদের কথা, জীবন থাকতে অমন অভদ্র লোককে সে স্বামী বলে গ্রহণ করতে পারবে না। এজন্য মামুজান আর মামীমা খুশি নন, তবু কি করবে মনিরা? নিজেকে তো আর বলি দিতে পারে না! ঐশ্বর্যের কাঙ্গাল সে নয়! হঠাৎ মনিরার চিন্তাজাল ছিন্ন হয়ে যায়। গাড়িখানা থেমে পড়েছে।

মনিরা বাইরের দিকে তাকিয়ে আশ্চর্য হয়ে যায়, এ তো শহরের পথ নয়। কখন যে গাড়িখানা তাকে নিয়ে এক নির্জন গলির মধ্যে এসে পড়েছে, সে খোয়াল নেই মনিরার।

মনিরা জিজ্ঞেস করলো—ড্রাইভার, এ তুমি কোথায় আনলে?

ড্রাইভার কেমন ধরনের একটা বিদঘুটে হাসি হেসে বলেন—ঠিক জায়গায় এসে গেছি, এখন নেমে পড়ন দেখি।

ড্রাইভারের কণ্ঠস্বর এবং মুখের ভাব লক্ষ্য করে শিউরে উঠলো মনিরা। বিবর্ণ মুখে সে কিছু বলতে গেল, কিন্তু বাইরে নজর পড়তেই আড়ষ্ট হয়ে গেল তার কণ্ঠ। ভয়ঙ্কর চেহারার কয়েকজন বলিষ্ঠ লোক দাঁড়িয়ে আছে তার দিকে চেয়ে। কেমন যেন দুষ্টমির হাসি.তাদের সকলের মুখে।

একজন লোক এগিয়ে এলো গাড়ির পাশে। গম্ভীর কণ্ঠে বলেন সেনেমে আসুন চট করে।

মনিরার দেহে তখন প্রাণ আছে কি না সন্দেহ। কি করবে এখন সে? এদের হাত থেকে পরিত্রাণের তো কোন উপায় নেই। তবু কন্ঠে সাহস সঞ্চার করে নিয়ে বলেন—তোমরা আমাকে এখানে নিয়ে এলে কেন? কি তোমাদের উদ্দেশ্য?

তোমার বদলে টাকা চাই। নেমে এসো।

নামবো না, কিছুতেই আমি নামবো না। আমাকে তোমরা বাড়িতে পৌঁছে দাও, যত টাকা চাও দেব।

হা-হা করে হেসে উঠলো লোকটি—আমরা অত বোকা নই, টাকা আমরা তোমার মামুজানের নিকট হতে চাই না। তোমাকে পেলে টাকার অভাব হবে না।

মনিরা দাঁতে দাঁত পিষে বলে—শয়তান কোথাকার! শিগগির আমাকে বাড়ি পৌঁছে দাও, নইলে পুলিশে ধরিয়ে দেব। মনিরা নিজকে বাঁচাবার জন্য নানা উপায় অবলম্বন করে। কিন্তু দুর্বল অসহায়া একটা রমণীর কথায় ভয় পাবার বান্দা ঐ লোকেরা নয়।

লোকটা পুলিশের নাম শুনে আরও জোরে হেসে ওঠে। তারপর হাসি থামিয়ে বলে—আমি পুলিশের বাবা, পুলিশ আমার কি করবে।

মনিরা চমকে উঠলো, বিস্ময়ভরা ভয়ার্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো–তুমি কে, দস্যু বনহুর?

হ্যাঁ, তুমি দেখছি সহজেই আমাকে চিনে ফেলেছ।

দস্যু বনহুর! বদমাইশ কোথাকার। বহুদিন থেকে তুমি আমার পেছনে লেগেছ। আমি মরবো, তবু তোমার হাতে নিজকে সঁপে দেব না।

দেখি কেমন করে না দাও। বলিষ্ঠ লোকটা গাড়ির দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করলো এবং জোরপূর্বক মনিরাকে টেনে নামিয়ে ফেললো।

মনিরা ভয়ার্ত কণ্ঠে চিৎকার করে উঠলো-বাঁচাও, বাঁচাও, বাঁচাও…..

ঠিক সে মুহূর্তে আর একখানা ট্যাক্সি এসে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে এবং সংগে সংগে একটা যুবক ট্যাক্সি থেকে নেমে এসে ঝাঁপিয়ে ছিল বলিষ্ঠ লোকটার ওপর। গুণ্ডার দল হঠাৎ এই বিপদের জন্য প্রস্তুত ছিল না, যে যেদিকে পারলো ছুটে পালালো। বলিষ্ঠ লোকটা আর যুবকে চললো ভীষণ ধস্তাধস্তি। বেশ কিছুক্ষণ লড়াইয়ের পর বলিষ্ঠ লোকটা কাবু হয়ে এলো, সে পরাজিত হয়ে অন্ধকারে গা ঢাকা দিল।

গলিটার মধ্যে অন্ধকার তখন জমাট বেঁধে উঠেছে। মনিরা গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে ঠক ঠক করে কাঁপছিল, আর যুবকটার মঙ্গল কামনা করছিল। ঠিক এই সময়ে যুবকটা যদি এসে না পড়তো তবে কি হত, ভাবতে পারে না সে।

ভয়ঙ্কর লোকটা পরাজিত হয়ে পালিয়ে যেতেই মনিরা ছুটে গেল যুবকের পাশে। বিনীতকণ্ঠে বলেন–আপনার শরীরে আঘাত লাগেনি তো?

যুবক সোজা হয়ে দাঁড়াতেই মনিরা বিস্ময়ে শুদ্ধ হয়ে গেল। পাশের লাইটপোস্টের আলোতে সে দেখলো—প্যান্ট কোট টাই পরা একটা যুবক-অদ্ভুত অপূর্ব সুন্দর তার চেহারা।

যুবক অন্য কেউ নয় দস্যু বনহুর। সে দূর থেকে মনিরার গাড়িখানাকে লক্ষ্য করছিল, কিন্তু পথের মধ্যে হঠাৎ একটা এক্সিডেন্ট হয়, সে কারণে কিছু বিলম্ব হয় তার। তবু ঠিক সময়ে পৌঁছতে পেরেছে বলে মনে খুশি হয়েছে। বনহুর বিষ্ময়ভরা নয়নে তাকিয়ে আছে মনিরার মুখের দিকে।

মনিরা সম্বিৎ ফিরে পায়। দৃষ্টি নত করে নিয়ে বলে–কি বলে যে আপনাকে ধন্যবাদ দেব ভেবে পাচ্ছিনে, আপনি আমার জীবন রক্ষা করেছেন!

হেসে বলে বনহুর–আপনাকে শয়তানের কবল থেকে রক্ষা করতে পেরে নিজেও কম আনন্দিত হইনি।

ভয়ার্ত দৃষ্টি নিয়ে চারদিকে তাকালো মনিরা। তারপর চাপাকণ্ঠে বলেন–জানেন ওরা কে?

না তো, আমি কি করে জানবো?

দস্যু বনহুর আমাকে আক্রমণ করেছিল!

সত্যি!

হ্যাঁ, আপনি না এলে আমার উদ্ধার ছিল না, জানেন তো দস্যু বনহুর কত ভয়ঙ্কর!

হেসে বলে বনহুর–হ্যাঁ, দস্যু বনহুরের নাম শুনেছিলাম, আজ তার সঙ্গে লড়াই হলো।

আপনার বীরত্বে আমি মুগ্ধ হয়েছি। আপনি কি করে যে অমন ভয়ঙ্কর দস্যুটাকে পরাজিত করলেন।

আর এখানে বিলম্ব করা ঠিক নয়, দস্যু বনহুর আবার হানা দিতে পারে। চলুন, আমার গাড়িতে আপনাকে পৌঁছে দি।

চলুন।

বনহুর নিজের গাড়ির দরজা খুলে ধরে–উঠুন।

মনিরার মাথাটা শ্রদ্ধায় নত হয়ে আসে–কত দ্র, মহৎ এই যুবক! গাড়িতে উঠে বসে মনিরা।

বনহুর ড্রাইভ আসনে বসে গাড়িতে স্টার্ট দেয়।

গাড়িতে বসে মনিরা এই যুবকটির কথা ভাবছে। তার জীবনে এই যুবকটি যেন খোদার একটি দান। বারবার যুবকের মুখখানা দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে তার।