বনহুর ড্রাইভ আসন থেকে হাত বাড়িয়ে পেছন সীটের দরজা খুলে ধরলো–চৌধুরীবাড়ি এই শহরের সবাই চেনে। নামুন, বাড়িতে যান।
আপনি নামবেন না?
আজ নয়, আর একদিন।
গাড়ি-বারান্দার উজ্জ্বল আলোতে মনিরা ভালো করে দেখলো বনহুরকে। মন যেন ওকে ছেড়ে দিতে চাইলো না, কিন্তু অপরিচিত এক যুবকের কাছে কি অধিকার আছে তার।
বনহুর গাড়িতে স্টার্ট দিল, মনিরা তখনও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে বনহুরের মুখের দিকে।
গাড়িখানা দৃষ্টির আড়ালে চলে যেতেই মনিরা হলঘরে প্রবেশ করলো।
চৌধুরী সাহেব একটা পত্রিকা দেখছিল, মনিরার পদশব্দে কাগজখানা রেখে মুখ তুলেন—একি মা, এত রাত হলো যে?
মনিরা তার পাশের সোফায় বসে পড়ে বলেন–মামুজান, জীবনে যে বেঁচে ফিরে এসেছি, এই ভাগ্য।
কেন মা, কোন এক্সিডেন্ট–
না মামুজান, দস্যু বনহুর আমাকে আক্রমণ করেছিল।
বলিস কি মনি দস্যু বনহুর।
হ্যাঁ, ভাগ্যিস এক ভদ্র যুবক আমাকে বাঁচিয়ে নিলেন, নইলে আর কোনদিন তোমরা আমাকে ফিরে পেতে না।
ওগো শুনছো? শুনো, শুনো–চৌধুরী সাহেব স্ত্রীকে ডাকাডাকি শুরু করলেন।
মরিয়ম বেগম এবং চৌধুরী সাহেব মনিরার মুখে সমস্ত ঘটনা শুনে আড়ষ্ট হয়ে গেল, মুখে যেন তাদের কথা নেই।
কিছুক্ষণ লাগলো তাদের নিজেদের সামলাতে। কি ভয়ঙ্কর কথা! প্রকৃতিস্থ হয়ে বলেন চৌধুরী সাহেব মনি, যে তোমাকে রক্ষা করলে তাকে ঘরের দরজায় এসে ওভাবে ছেড়ে দেয়া তোমার উচিত হয়নি মা।
মরিয়ম বেগম স্বামীর কথায় যোগ দিল—শুধু রক্ষা নয়, মনিরার জীবন আমাদের মান-ইজ্জত সব বাঁচিয়েছে সে। মনিরা, তুমি শিক্ষিত মেয়ে, কি করে বিদায় দিলে? মনে একটু বাঁধলো না?
আমি তাকে নামতে অনুরোধ করেছিলাম, কিন্তু উনি বলেন আজ নয়, অন্য দিন আসবেন।
পাগলী মেয়ে, তাই বুঝি তুই তাকে ছেড়ে দিলি? জিদ করলে নিশ্চয়ই সে না নেমে পারতো না।
ভুল হয়েছে মামীমা।
এবার চৌধুরী সাহেব বলেন–তার পরিচয়টা জেনে নেয়াও কি তোমার উচিত ছিল না? কি তার নাম, কোথায় থাকে–
মামুজান, আমি যেন কেমন হয়ে গিয়েছিলাম।
সত্যি, গো, দস্যু বনহুরের কবলে–এ যে কী সাংঘাতিক ব্যাপার, ভাবলেও আমার গা কাঁটা দিয়ে উঠছে। মনিরা, কোনদিন তুই একা বাইরে যাবিনে।
হ্যাঁ মামীমা, আর অমন কাজ করবো না।
সেদিন মনিরা একটা বইয়ের দোকানে প্রবেশ করলো কতকগুলো বইয়ের অর্ডার দিয়ে দাঁড়িয়েছে, এমন সময় তার পাশে দাঁড়ালো এক যুবক, মনিরা মুখ তুলে তাকাতেই তার চোখ দুটো আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, হেসে বলেন–আপনি?
বনহুর বলে ওঠে–আপনি দেখি আমাকে মনে রেখেছেন?
কি যে বলেন, কোনদিনই আপনাকে ভুলবো না। কি বাঁচাই না সেদিন পনি আমাকে বাঁচিয়েছেন! আজ কিন্তু আর আপনাকে ছাড়ছিনে।
তার মানে?
মানে অতি স্বচ্ছ। মামুজানের হুকুম, আপনাকে তার নিকটে ধরে নিয়ে যেতে হবে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ, সেদিন আপনাকে বিদায় দিয়ে কি বকাটাই না খেলাম। যেমন বকলেন মামুজান, তেমনি মামীমা।
তাহলে তো এক বিপদ থেকে উদ্ধার পেয়ে আর এক বিপদে পড়েছিল?
মিথ্যে নয়। হ্যাঁ একটা কথা, মনে কিছু নেবেন না?
বলুন?
আপনার পরিচয়টা?
ওঃ হ্যাঁ, পরিচয়টা এখনও আপনাকে দেয়া হয়নি। আমার নাম মনিরুজ্জামান চৌধুরী, ঠিকানা ৩৬/৩, বাগবান রোড চলুন না আজ আমার বাড়িতে, এই তো এখান থেকে একটু দূরে।
না, তা হয় না। আপনিই আজ চলুন, পরে একদিন নিশ্চয়ই আপনার ওখানে যাব।
কিন্তু আমি তো আজ যেতে পারছিনে মিস মনিরা!
অবাক হয়ে তাকায় মনিরা বনহুরের মুখে। বিষ্ময়ভরা কণ্ঠে বলে–আপনি আমার নাম জানলেন কি করে?
হেসে বলে বনহুর কারও নাম জানতে ইচ্ছে থাকলে অমনি জানা যায়। সেদিন আমি জেনে নিয়েছি।
বেশ লোক কিন্তু আপনি।
বনহুর আর মনিরা একসঙ্গে হাসতে থাকে।
বইগুলো প্যাক করে মনিরার সম্মুখে রাখে দোকানদার।
মনিরা ক্যাশমেমো দেখে টাকা মিটিয়ে দেয়, তারপর বনহুরকে লক্ষ্য করে বলে আজ কথা দিতে হবে, কবে তাহলে আসছেন?
আমার বাড়ির এত নিকটে এসে যখন চলে যাচ্ছেন তখন আমার যাওয়া–তা যাব একদিন।
না, তা হবে না।
তাহলে—
আচ্ছা চলুন।
মনিরা বনহুরের গাড়িতে চেপে বসে।
ড্রাইভ আসনে ওঠে বনহুর। গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে বলে–অজানা অচেনা একজনের সঙ্গে যেতে মনে ভয় হচ্ছে বুঝি?
কি যে বলেন–আপনার সঙ্গে ভয়, আপনি তো ডাকাতের বাবা!
তাহলে ভরসা আছে আমার ওপর?
খুব।
আরও অনেক হাসিগল্প চলে।
বিরাট একটা বাড়ির সম্মুখে এসে বনহুরের গাড়ি থেমে ছিল।
মনিরা বাড়িখানার দিকে তাকিয়ে অবাক হলো–এ যেন রাজ প্রাসাদ।
বনহুর ড্রাইভ আসন থেকে নেমে গাড়ির দরজা খুলে ধরলো–নেমে পড়ুন।
মনিরা নেমে দাঁড়ালো।
বনহুর মনিরাকে নিয়ে এগুতেই দারোয়ান সেলুট ঠুকে সরে দাঁড়ালো।
মনিরা অবাক হয়ে চারদিকে দেখতে দেখতে এগুতে লাগলো। সেকি প্রকাণ্ড বাড়ি! গেটের পর গেট, ঘরের পর ঘর। প্রত্যেকটা ঘরে বেলওয়ারীর ঝাড় ঝুলছে। মূল্যবান সরঞ্জামে ঘরগুলো সাজানো, কিন্তু মনিরা আশ্চর্য হলো, এত বড় বাড়িটায় শুধুমাত্র ঐ একটা যুবক।
অনেকগুলো ব্যালকনি পেরিয়ে একটা সুসজ্জিত কক্ষে প্রবেশ করলো মনিরাকে নিয়ে বনহুর। মনিরা তখনও অবাক হয়ে চারদিকে দেখছে। তার মামুজানও মস্ত বড়লোক, কিন্তু এত বড় বাড়ি তো তাদের নয়। রাজ-রাজার বাড়ি যেমন হয়, এ বাড়িটাও ঠিক তেমনি।
বনহুর হেসে বলেন–বসুন।
মনিরা বসে পড়ে বলে–এত বড় বাড়ি অথচ লোকজন তো দেখছিনে? আপনার বাবা-মা?
কেউ নেই।
আপনার স্ত্রী, ছেলেমেয়ে?
ওসব ঝঞ্চাটও নেই আমার।
এত বড় বাড়িটায় আপনি একা থাকেন?
চিরদিন যে একা, সে কোথায় পাবে সঙ্গী, বলুন। আপনি বসুন, আমি একটু চা-নাস্তার ব্যবস্থা–
না না, ওসব কিছু লাগবে না, বরং আপনি বসুন।
তা হয় না মিস মনিরা, আপনি আমার অতিথি। বনহুর বেরিয়ে যায়।
মনিরা অবাক হয়ে ভাবে, অদ্ভুত এই যুবক। যার এত আছে, তার আবার সঙ্গীর ভাবনা? রূপ-গুণ-ঐশ্বর্য সর আছে এর কিন্তু কেন সে একা নিঃসঙ্গভাবে জীবন কাটায়? ইচ্ছে করলেই যে কোন মেয়েকে সে গ্রহণ করতে পারে। যে নারী ওকে স্বামীরূপে পাবে সে ধন্য হবে, সার্থক হবে তার জীবন কিন্তু কেন সে এতদিনও বিয়ে করেনি?
মনিরা আনমনে উঠে দাঁড়ায়। ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসে কক্ষ থেকে। ওপাশে রেলিংয়ের ধারে দাঁড়াতেই আশ্চর্য হয়। কত রকমের ফুলগাছ শোভা পাচ্ছে বাগানে। ফুরফুরে হাওয়া আর অজানা ফুলের সুরভি তাকে সাদর সম্ভাষণ জানালো। মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে মনিরা।
কখন যে তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে বনহুর, খেয়াল করতে পারেনি মনিরা। বনহুর হেসে বলে কি দেখছেন অমন করে?
কি সুন্দর অপূর্ব! আচ্ছা জামান সাহেব, আপনি ফুল বুঝি খুব পবাসেন?
হ্যাঁ চলুন, চা-ঠাণ্ডা হয়ে গেল।
কেন আপনি ওসব ঝামেলা করতে গেল! পায়ে পায়ে এগিয়ে চলে মনিরা আর বনহুর।
চা-নাস্তার সঙ্গে সঙ্গে বনহুর আর মনিরার গল্প চলে। মনিরা এখন অনেকটা স্বচ্ছ হয়ে এসেছে। বনহুরের দৃষ্টির মধ্যে নিজেকে যেন হারিয়ে ফেলেছে সে। বনহুরের হাসির মধ্যে বিলিয়ে দিয়েছে নিজকে। কথায় কথায় সন্ধ্যা হয়ে আসে, সেদিকে খেয়াল নেই মনিরার। বনহুর স্মরণ করিয়ে দেয়–মিস মনিরা, আপনার ফেরার সময় হয়েছে, বিলম্ব হলে আপনার মামুজান নিশ্চয় চিন্তিত হবেন।
উঠে দাঁড়ায় মনিরা সত্যি আমার যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না।
বনহুর একটু হাসলো।
মনিরা আর বনহুর গাড়ির পাশে এসে দাঁড়ালো। মনিরা বলেনজামান সাহেব, আপনি আমাকে পৌঁছে দিচ্ছেন তো?
আমি ড্রাইভার দিচ্ছি, সে আপনাকে ঠিক জায়গায় পৌঁছে দেবে।
না, তা হবে না! আমি কোন ড্রাইভারকে বিশ্বাস করি না।
হো হো করে হেসে ওঠে বনহুর খুব ভয় পেয়ে গেছেন দেখছি। কিন্তু আমাকেই বা আপনার এত বিশ্বাস কেন? আমি যদি আপনাকে নিয়ে পালাই?
পৃথিবীর কাউকে বিশ্বাস না করলেও আপনার ওপর আমার অবিশ্বাস হবে না। সত্যি জামান সাহেব, আপনি কত মহৎ!
বুঝেছি, আপনি আমাকে আজই আপনার মামুজানের নিকটে হাজির করতে চান।
তাহলে আপনি বুঝতে পেরেছেন আমার মনোভাব, চলুন।
বনহুর আর বিলম্ব না করে ড্রাইভ আসনে উঠে বসে।
চৌধুরীবাড়ি।
চৌধুরী সাহেব, পুলিশ ইন্সপেক্টার মি. হারুন, মি. শঙ্কর রাও ও গোপাল বাবু মিলে আলোচনা চলছিল। কয়েকদিন পূর্বে মনিরার সে আক্রমণ ব্যাপার নিয়েই আলোচনা চলছিল। দস্যু বনহুর যে হঠাৎ ওভাবে মনিরার ওপর হামলা করে বসবে, এ যেন একটা অদ্ভুত ব্যাপার। চৌধুরী সাহেব কন্যা-সমতুল্যা ভাগনীকে নিয়ে খুব চিন্তায় ছিল। দস্যু বনহুরের দৃষ্টি যে তার ওপর পড়েছে, এ বিষয়ে তিনি নিঃসন্দেহ। কি করে এ দস্যুর কবল থেকে মনিরাকে রক্ষা করা যাবে, এ নিয়ে আজ কদিন হলো পুলিশ অফিসে ঘোরাফেরা করছেন। আজ নিজে যেতে না পারায় ফোনে মি. হারুন সাহেবকে চৌধুরীবাড়িতে ডেকে পাঠিয়েছিল। যখন চৌধুরী সাহেব পুলিশ অফিসে ফোন করেন, তখন মি. হারুনের পাশে রাও এবং গোপাল বাবু উপস্থিত ছিল।
শঙ্কর রাও মি. হারুনের নিকট ঘটনাটা শুনে থাকতে পারলেন না, তিনিও’গোপাল বাবুকে নিয়ে মি. হারুনের সঙ্গে চৌধুরীরাড়িতে উপস্থিত হলেন।
সবাই মিলে আলোচনা চলছে, এমন সময় কক্ষে প্রবেশ করে মনিরা আর বনহুর। মনিরা আনন্দভরা কণ্ঠে বলে ওঠে–মামুজান, ইনিই সেদিন আমাকে দস্যু বনহুরের কবল থেকে রক্ষা করেছিল।
সকলেই একসঙ্গে বনহুরের মুখে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে।
চৌধুরী সাহেব উঠে দাঁড়িয়ে বনহুরকে জড়িয়ে ধরেন বুকে। তারপর আনন্দভরা কণ্ঠে বলেন–আপনাকে কি বলে যে আমি কৃতজ্ঞতা জানাবো ভেবে পাচ্ছিনে। আপনি আমার মান-ইজ্জত রক্ষা করেছেন, আপনার কাছে আমি চিরঋণী।
পিতা-পুত্রের অপূর্ব মিলন। বনহুরের চোখ দুটো অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে। কেউ না জানলেও সে জানে চৌধুরী সাহেবই তার পিতা। মনে মনে পিতাকে হাজার সালাম জানায় বনহুর।
চৌধুরী সাহেবও হৃদয়ে একটা আলোড়ন অনুভব করেন, বনহুরকে কিছুতেই বুক থেকে সরিয়ে দিতে ইচ্ছে করে না তার।
মামুজান আর জামান সাহেবের মিলনে মনিরার চোখ দুটো আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, খুশির আবেগে বেরিয়ে যায় সে।
এবার চৌধুরী সাহেব বনহুরকে পাশের সোফায় বসিয়ে দিয়ে নিজেও বসে পড়েন।
বনহুরের অপূর্ব সৌন্দর্য সকলকে মুগ্ধ করে ফেলে। মনিরা বয়ের হাতে চায়ের সরঞ্জাম দিয়ে কক্ষে প্রবেশ করে। চৌধুরী সাহেব কিছু জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলেন বনহুরকে, কিন্তু মনিরাই সকলের সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দিল।
বনহুর সকলের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে আসন গ্রহণ করলো।
মনিরা হেসে বলেন–মামুজান, উনি কিন্তু মস্ত বড়লোক।
বনহুর লজ্জিতকণ্ঠে বলেন–মিছেমিছে বাড়িয়ে বলছেন মিস মনিরা।
না মামুজান, আমি এতটুকু বাড়িয়ে বলিনি।
হাসিগল্পের মধ্য দিয়ে চা-নাস্তা চলে।
চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে বলেন শঙ্কর রাওমি. মনিরুজ্জামান, আমি আপনাকে একটু বিরক্ত করবো। কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করবো।
স্বচ্ছন্দে করুন।
শঙ্কর রাও একটু কেশে গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে বলেন–আচ্ছা মি. জামান, আপনি মিস মনিরাকে উদ্ধারের জন্য যখননজের গাড়ি থেকে দস্যুদলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন, তখন তাদের দলে কত, জন ছিল বলে আপনার মনে হয়?
বনহুর ভূকুঞ্চিত করে একটু চিন্তা করলো, তারপর বলেন-—পাঁচ ছ’জন হবে।
ওরা কি সকলেই আপনাকে আক্রমণ করেছিল?
না, আমাকে দেখামাত্র সবাই সরে পড়ে। শুধু একজন, দলের সর্দার হবে হয়তো, সে আমাকে আক্রমণ করেছিল।
মি. হারুন বলে ওঠেন–মি. জামান, আপনার কি মনে হয়, সে লোকটাই দস্যু বনহুর?
বনহুর একটা চিন্তার ভান করে বলে আমি তো আর দস্যু বনহুরকে দেখার সৌভাগ্য অর্জন করিনি, তবে অনুমানে এবং তার ভয়ঙ্কর চেহারা দেখে মনে হলো বনহুর ছাড়া আর কেউ সে নয়। ইস, কি শক্তিই না তার শরীরে!
চৌধুরী সাহেব হেসে বলেন আপনার কাছে হার মানাতে সে বাধ্য হলো। পরাজিত হলো আপনার নিকট।
আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ মি. জামান, দস্যু বনহুরকে পরাজিত করে মিস মনিরাকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছেন। কথাটা বলে বনহুরের পিঠ চাপড়ে দেন মি. হারুন। একটু থেমে পুনরায় বলেন–আশা করি দস্যু বনহুরের গ্রেপ্তারে আপনি আমাকে সাহায্য করবেন।
নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই, প্রয়োজন মত আমাকে পাবেন।
মি. শঙ্কর রাও বলেন–হ্যাঁ মি. জামান, আপনি যদি দ্য বনহুরকে গ্রেপ্তারে আমাদের সাহায্য করেন, তবে আমরা চিরকৃতজ্ঞ থাকবো।
মনিরা তন্ময় হয়ে তাকিয়ে ছিল বনহুরের মুখের দিকে। বনহুর সকলের অলক্ষ্যে একবার তাকালো মনিরার মুখে। দৃষ্টি বিনিময় হলো। দু’জনের অন্তর যেন দু’জনকে দেখতে পেল। অভূতপূর্ব আকর্ষণ অনুভব করলো মনে তারা।
বনহুর মৃদু হেসে উঠে দাঁড়ালো–আজ তাহলে চলি।
চৌধুরী সাহেবও উঠে দাঁড়ালেন। তিনি যেন হৃদয়ে একটা ব্যথা অনুভব করলেন। শান্ত মিষ্টি গলায় বলেন–আবার কবে আসবেন কথা দিন?
ঠিক বলতে না পারলেও, আসবো। আর একবার তাকালো বনহুর মনিরার দিকে। মনিরা দৃষ্টির মাধ্যমে ওকে বিদায় সম্ভাষণ জানালো।
এরপর হতে প্রায়ই আসে বনহুর।
চৌধুরী সাহেব, মরিয়ম বেগম সবাই বনহুরকে ভালবেসে ফেলেছেন। বনহুর এলে তারা যেন মনে শান্তি অনুভব করেন, মনিরার তো আনন্দ ধরে না। যেদিন বনহুর আসার কথা থাকে, সেদিন মনিরা নিজেকে মনের মত করে সাজায়, সকাল থেকে গুন গুন করে গান গায়।
চৌধুরী সাহেব এবং মরিয়ম বেগম বুঝতে পারেন ভাগ্নীর মনোভাব। তারা উভয়ে উভয়ের মুখে তাকিয়ে হাসেন, অজ্ঞাত এক বাসনা উঁকি দিয়ে যায় তাদের মনের কোণে।
মুরাদ সেদিন রাগ করে চলে যাবার পর থেকে চৌধুরী সাহেব ভিতরে ভিতরে ভয়ানক অস্বস্তি বোধ করছিল, বনহুরের আবির্ভাব আবার তার হৃদয়ে শান্তির প্রলেপ এনে দেয়। চৌধুরী সাহেব ধীরে ধীরে ভুলে যান মুরাদকে।
একদিন বিকেলে বনহুরের সঙ্গে মনিরা বেড়াতে বেরুলো। সে লেকের ধারে গিয়ে গাড়ি থেকে নামলো তারা। পাশাপাশি এগিয়ে চললো মনিরা আর বনহুর। কি নিয়ে যেন দু’জন বেশ হাসছিল।
মুরাদ দূর থেকে মনিরা আর বনহুরকে লক্ষ্য করলো। হিংসায় জ্বলে উঠলো তার অন্তরটা, কটমট করে তাকিয়ে রইলো ওদের দিকে।
বনহুর বলেন–মিস মনিরা, চেয়ে দেখুন ঐ অস্তগামী সূর্যের দিকে।
হেসে বলেন মনিরা—অপূর্ব!
ঠিক আপনার রক্তিম. গণ্ডের মত–তাই না?
যান!
মিস মনিরা, সত্যি আপনার মত মেয়েকে আমার বড় ভালো লাগে চোখে লজ্জা, মনে ম্রতা, মিষ্টিমধুর কণ্ঠস্বর—অপরূপ!
মনিরার মন তখন চলে গেছে পেছনের একটি দিনে। মুরাদ আর সে পাশাপাশি বসে আছে এমনি এক সন্ধ্যায়। মুরাদ বলছে, মনিরা তুমি বড্ড লাজুক, একদম সেকেলে ধরনের কি বিশ্রী, কি কুৎসিত ইঙ্গিতপূর্ণ কণ্ঠস্বর মুরাদের।
কি ভাবছেন মিস মনিরা?
মিস নয়, শুধু মনিরা বলুন।
তুমি যদি খুশি হও তাহলে তাই হবে। এবার বলো কি ভাবছো?
বনহুর মনিরাকে তুমি বলে সম্বোধন করে। মনিরাও বনহুরকে তুমি বলে সম্বোধন করে। কারণ ওরা দুজন দুজনের মনে গভীরভাবে দাগ কেটেছে। দুজন দুজনকে গভীরভাবে ভালবেসে ফেলেছে।
নাই বা শুনলে সে কথা!
যদি না বলার মত হয়, তাহলে আমি শুনতে চাইনে মনিরা।
ঠিক সে মুহূর্তে মুরাদ মনিরার পেছনে এসে দাঁড়ালো, কঠিন কণ্ঠে বলেন–মিস মনিরা, কে এই যুবক?
মনিরা উঠে দাঁড়ালো, সেও কঠিন কণ্ঠে বলেন–আপনি সে কথা জিজ্ঞাসা করার কে?
তোমার আব্বা একদিন আমার সঙ্গে তোমাকে বিয়ে দেবেন কথা দিয়েছিল একথা এরই মধ্যে ভুলে গেলে? সেই অধিকারে–
খবরদার, আর কথা বলবেন না, চলে যান এখান থেকে।
ওঃ আজ দেখছি বড় সাহস বেড়েছে? চলো, তোমার আব্বার কাছে নিয়ে এর জবাব দেব–মনিরার হাত ধরতে যায় মুরাদ।
সঙ্গে সঙ্গে বনহুর প্রচণ্ড এক ঘুসি বসিয়ে দেয় মুরাদের নাকে। মুরাদ পড়ে যায়, নাক দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ে। ধূলো ঝেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে হাতের পিঠে নাকের রক্ত মুছে, তারপর বনহুর আর মনিরার দিকে কটমট করে তাকিয়ে চলে যায়।
হেসে ওঠে মনিরা, বনহুরের প্রতি কৃতজ্ঞতায় ভরে ওঠে তার মন।
বনহুর বসতে যায়। মনিরা বলে ওখানে বসে আর কাজ নেই, চলো এবার ফেরা যাক।
কেন, ভয় হচ্ছে?
না, তুমি পাশে থাকলে আমার কোন ভয় নেই। তবু চলো এখানে বসতে মন আর চাইছে না।
চলো তাহলে।