» » চার

বর্ণাকার

চৌধুরী বাড়ি।

আজ মনিরার জন্ম উৎসব। সকাল থেকে বাড়ির সবাই ব্যস্ত। ঘরের যাবতীয় জিনিসপত্র ঘসে-মুছে পরিষ্কার করা হচ্ছে। কয়েকজন পরিচারিকা নিয়ে মরিয়ম বেগম নিজেই এসব করেছেন।

আজ মনিরার মা নেই, রওশন আরা বেগম থাকলে তাকে এসব দেখতে হতো না, আজ থেকে দু’বছর আগে তিনি কন্যার মায়া ত্যাগ করে জান্নাতবাসিনী হয়েছেন। ননদিনীর কথা স্মরণ হতেই মরিয়ম বেগমের মনটা ব্যথায় টন টন করে উঠলো। দু’চোখ ছাপিয়ে গড়িয়ে পডলো দু’ফোটা অশ্রু।

মনিরার মনে আজ আনন্দের উৎস। তার সহপাঠিনীরা আসবে। বান্ধবীদের নিয়ে আমোদ-প্রমোদ করবে, হাসিগানে ভরে উঠবে আজকের সন্ধ্যাটা। মনিরা গুন গুন করে গান গাইছিল আর ঘুরে বেড়াচ্ছিল, হঠাৎ কক্ষে প্রবেশ করে থমকে দাঁড়ায়।

মরিয়ম বেগম তাকে দেখতে পেয়েই গোপনে চোখের পানি মুছে ফেলেন। তারপর হেসে বলেন—মনিরা, এদিকে শুনো।

মনিরা এসে দাঁড়ায় তাঁর পাশে—আমাকে ডাকছো, মামীমা?

হ্যাঁ মা শুনো। বিকেলে কোন শাড়ি পরবে ঠিক করে গুছিয়ে রাখোগে, নইলে তখন তাড়াহুড়া করবে।

মামীমা, আমি তোমার একটা শাড়ি পরবো।

সেকি মা, আমার শাড়ি যে সব সেকেলে ধরনের।

হউক না, সে আমার ভালো। আজ আমার জন্ম উৎসব। তোমার শাড়ি হবে আমার আশীর্বাদ।

পাগলী মেয়ে কোথাকার, যদি সখ হয়েই থাকে, তবে এই নাও চাবি, আমার ট্রাঙ্ক খুলে যে শাড়িটা তোমার পছন্দ হয় বের করে নাও।

মনিরা চাবির গোছা হাতে নিয়ে মামীমার কক্ষে চলে যায়। ট্রাঙ্কের ঢাকনা খুলে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায় সে। ঝকঝক করছে নানা রঙবেরঙের শাড়ি। কোনটা জরীর বুটিদার, কোনটা জরী পেড়ে, কোনটা গোটাটাই জরীর তৈরি, বেনারসী, টিস্যু, নানারকমের শাড়িতে ট্রাঙ্ক ভর্তি।

মনিরা এক-একখানা শাড়ি বের করে অবাক হয়ে দেখতে লাগলো। ট্রাঙ্কের সমস্ত শাড়ি বের করে ফেললো মনিরা। হঠাৎ তার দৃষ্টি চলে গেল ট্রাঙ্কের তলায়। সুন্দর একখানা ছবি। মনিরা সব ফেলে ফটোখানা তুলে নিল হাতে। বিস্ময়ভরা নয়নে তাকিয়ে রইলো। পাশাপাশি দুটি মুখ। একটা বালক আর একটা বালিকা। শুভ্র জ্যোৎস্নার মত নির্মল দুটি মুখ। মনিরা ফটোখানা হাতে নিয়ে ছুটলো মামীমার কক্ষে। মরিয়ম বেগমের সম্মুখে ফটোখানা মেলে ধরে বলে মনিরা—মামীমা, এ কাদের ছবি?

মরিয়ম বেগমের দৃষ্টি ছবি খানার ওপর পড়তেই চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো, অতি কষ্টে নিজকে সংযত রেখে বলেন তিনি—ও ছবি আবার বের করলি কেন মা?

আগে বল এ ছবি কাদের?

ও ছবি তোর আর মনিরের।

মনির। সে আবার কে, মামীমা?

ওরে, সে যে আমাদের সাত রাজার ধন, হৃদয়ের মণি ছিল, আমাদের ছেলে মনির।

হঠাৎ মনে পড়ে মনিরার একটা কথা, অনেকদিন আগে মা একদিন গল্পের ছলে বলেছিল—মনিরা, তোর মামুজান আর মামীমা তোকে যে আমার কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছিলোরে। বড় আশা ছিল, তোকে একেবারে নিজের করে নেবে, কিন্তু সে আশা পূর্ণ হলো না।

আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করেছিল মনিরা—সে কি মা, আমি কি তাদের নিজেরই নই?

মা বলেছিল—তা নয়, তা নয়। থাক, আর শুনে কাজ নেই, তুমি পড়গে যাও।

মনিরাও কম জেদী মেয়ে নয়! আব্দার ধরে বসলো—তোমাকে বলতেই হবে মা, আমি না শুনে ছাড়ছিনে।

অগত্যা বলেছিল রওশন আরা বেগম—তোর মামুজান আর মামীমার একটা ছেলে ছিল—মনির! তারই জন্য ওরা তোকে আমার কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছিল, আমি কথা দিয়েছিলাম, কিন্তু আমাদের সকলেরই দুর্ভাগ্য সে রত্ন রইলো না।

মনিরা অস্ফুট কণ্ঠে উচ্চারণ করলো—মনির। মামীমা, মনির ভাই খুব সুন্দর ছিল বুঝি?

মরিয়ম বেগম বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলেন—হ্যাঁ, অপূর্ব সুন্দর ছিল আমার মনির, যেমন তুই। তাইতো তোর মায়ের কাছ থেকে তোকে চেয়ে নিয়েছিলাম।

মামীমা, তার কি হয়েছিল?

অসুখে সে মারা যায়নি, আমার মণি নৌকাডুবি হয়ে কোথায় ভেসে গেছে।

—তার লাশ তোমরা পেয়েছিলে?

না, অনেক খোঁজাখুজি করেও তার কোন চিহ্ন আমরা পাইনি।

—গলা ধরে আসে মরিয়ম বেগমের।

মনিরা কিছুক্ষণ স্তব্ধ নয়নে ছবিখানার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে—মামীমা, এই ছবি আমার ঘরে টাঙ্গিয়ে রাখবো।

তোর যদি ভালো লাগে রাখ মা, কিন্তু ও ছবি যেন আমার চোখে না পড়ে।

মনিরা ছবিখানাকে বুকে আঁকড়ে ধরে মামীমার কক্ষ থেকে বেরিয়ে যায়।

নিজের কক্ষে প্রবেশ করে অনেকক্ষণ তাকিয়ে দেখলো মনিরের ছোট্ট ফুটফুটে মুখখানা। মাথায় কোঁকড়ানো চুল, সুন্দর নীল বুদ্ধিদীপ্ত দু’টি চোখ, উন্নত নাসিকা। ছোট বালক হলেও তার সমস্ত মুখে ছড়িয়ে আছে অপূর্ব এক প্রতিভা। তন্ময় হয়ে তাকিয়ে থাকে মনিরা। নিজের শয্যার পাশে টাঙ্গিয়ে রাখলো ছবিখানা।

আলোয় আলোময় হয়ে উঠেছে চৌধুরীবাড়ি। গাড়ি বারান্দায় অগণিত গাড়ি এসে ভীড় জমেছে। মনিরা মামার পাশে দাঁড়িয়ে অতিথিদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছিল। বান্ধবীরা আসছে—কেউ বা ফুলের মালা, কেউ বা ফুলের তোড়া নিয়ে মালাগুলো পরিয়ে দিচ্ছে মনিরার গলায়।

অতিথিরা প্রায় সবাই এসে পড়েছেন। পুলিশ ইন্সপেক্টার মি. হারুন, মি. শঙ্কর রাও, গোপালবাবু, রায়বাহাদুর শ্যামাচরণ মহাশয় এবং তাঁর নায়েব বাবু পর্যন্ত উৎসবে উপস্থিত হয়েছেন। এই উৎসবে শ্রেষ্ঠ অতিথি হবেন খান বাহাদুর হামিদুল হক এবং তাঁর পুত্র মুরাদ। কিন্তু এতক্ষণেও তাঁরা এসে পৌঁছলেন না। ভিতরে ভিতরে কিছুটা চিন্তিত হয়েছিলেন চৌধুরী সাহেব।

খান বাহাদুর হামিদুল হক একজন ধনবান ব্যক্তি, তেমনি সম্মানিত ব্যক্তিও বটে। তাঁর একমাত্র পুত্র মুরাদ বহুদিন লণ্ডনে শিক্ষালাভ করার পর সম্প্রতি দেশে ফিরে এসেছে। চৌধুরী সাহেবের ইচ্ছা মুরাদের সঙ্গে মনিরার বিয়ে দেবেন। হামিদুল হক সাহেবেরও এ ইচ্ছা। মনিরার অপূর্ব সৌন্দর্য এবং মহৎ ব্যবহার তাকে মুগ্ধ করেছিল। খান বাহাদুর সাহেবের বিপুল ঐশ্বর্য। ভবিষ্যতে নিঃসন্তান চৌধুরী সাহেবের সমস্ত ধনসম্পদ মনিরারই হবে। এই কারণেই খান বাহাদুর সাহেব পুত্র লণ্ডন থেকে ফিরে না আসতেই চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে কথাবার্তা অনেকটা পাকা করে রেখেছিলেন।

চৌধুরী সাহেব এবং তাঁর আত্মীয়স্বজন যদিও মুরাদকে স্বচক্ষে দেখেননি, তবু কথা দিয়েছিলেন। এহেন অতিথিদের আগমনে বিলম্ব দেখে অত্যন্ত চিন্তিত হয়েছিলেন চৌধুরী সাহেব। তিনি মনিরাকে বলেন—মা, তুমি এখন ওদিকে গিয়ে দেখাশুনা করো। আমি আরও কিছুক্ষণ এখানে অপেক্ষা করি।

মাথা দুলিয়ে বলে মনিরা—আচ্ছা আমি যাচ্ছি।

মনিরা চলে যায়।

চৌধুরী সাহেব গাড়ি বারান্দায় পায়চারী করতে থাকেন।

মনিরা হলঘরে প্রবেশ করে। সম্মানিত অতিথিগণ, যে যার আসনে বসে বসে গল্প করছেন। মনিরার কয়েকজন বান্ধবী অর্গানের পাশে বসে গানবাজনা করছে। অনেকেই হাসি গল্পে মেতে উঠেছে। মাঝখানের টেবিলের ওপর স্তূপাকার প্রেজেন্টের জিনিসপত্র। কক্ষে নীল বৈদ্যুতিক আলো জ্বলছে। হাসিগল্পে আর অর্গানের শব্দে স্বপ্নময় হয়ে উঠেছে। একটু পরেই টেবিলে খাবার দেয়া হবে।

শহরের এক প্রান্তে খানবাহাদুর হামিদুল হক সাহেবের বাড়ি। লণ্ডন ফেরত পুত্র মুরাদ সাজগোজ করে বেরুতেই রাত প্রায় আটটা বাজিয়ে দিল। নিজেই ড্রাইভ করে চললো মুরাদ, পেছনের আসনে হামিদুল হক সাহেব বসে রইলেন।

নির্জন পথ বেয়ে গাড়ি ছুটে চলেছে।

ঠিক সে মুহূর্তে পথের ওপাশের ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো দুটো অশ্ব, একটাতে বনহুর স্বয়ং, অন্যটাতে বনহুরের প্রধান অনুচর রহমান। দু’জনের শরীরেই অদ্ভুত কালো ড্রেস, মুখে কালো গালপাট্টা বাধা। মোটরের সম্মুখে এসে পথ আগলে দাঁড়ালো তারা।

মুরাদ সামনে বাধা পেয়ে গাড়ি রুখতে বাধ্য হলো।

বনহুর রিভলবার উদ্যত করে বলেন—নেমে এসো।

ভয়ে বিবর্ণ হয়ে উঠেছে খানবাহাদুর সাহেবের মুখমণ্ডল। মুরাদের অবস্থাও তাই। হঠাৎ এই বিপদের জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না তারা। অগত্যা গাড়ি থেকে নেমে আসতে বাধ্য হলেন খান বাহাদুর সাহেব এবং মুরাদ।

বনহুর রিভলবার ঠিক রেখে রহমানকে ইঙ্গিত করলো।

রহমান দ্রুত মুরাদের শরীর থেকে কোটপ্যান্ট-টাই খুলে নিল।

রাগে, ক্ষোভে অধর দংশন করতে লাগলো মুরাদ। সেও কম নয়, হাতে একটা অস্ত্র থাকলে দেখিয়ে দিত মজাটা—কিন্তু কি করবে, নীরব থাকা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। খান বাহাদুর সাহেব ভয়ার্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন—তোমরা কে?

দস্যু বনহুর!

এ্যাঁ বল কি! কি চাও বাবা তোমরা? আমাদের নিকট তো কোন অর্থ নেই।

অর্থ চাই না। শুধু আপনারা গাড়িটা কিছুক্ষণের জন্য নেব। বনহুর তাদের বেঁধে ফেলার ইঙ্গিত করলো।

অল্পক্ষণের মধ্যেই রহমান মুরাদ এবং খান বাহাদুর সাহেবকে মজবুত করে বেঁধে ফেললো, তারপর একটা ঝোপের আড়ালে নিয়ে বসিয়ে দিলো।

বনহুর ক্ষিপ্রহস্তে মুরাদের পোশাক পরে নিল, এক জোড়া গোঁফ লাগিয়ে নিল নাকের নিচে। কালো একটা চশমা চোখে পরলো, মাথার ক্যাপটা টেনে লুকিয়ে নিল সামনের দিকে বেশি করে। বনহুরের চেহারা একেবারে পাল্টে গেল। বনহুর এবার রহমানকে লক্ষ্য করে বলে—আমি যতক্ষণ না ফিরে আসি, ততক্ষণ তুমি এদের পাহারায় থাকবে।

ড্রাইভ আসনে উঠে বসে গাড়িতে স্টার্ট দেয় বনহুর।

বনহুরের অজানা কিছু নেই, সে অশ্বচালনা থেকে সব কিছুই চালনা করতে জানতো। বনহুরের একটা বুইক গাড়ি ছিল, সে গাড়ি বনহুর নিজেই চালাতো। শহরে বনহুরের একটা বাড়ি ছিল। সে বাড়িতেই গাড়িখানা থাকতো। মাঝে মাঝে বনহুর দরকার হলে সে বাড়িতে থাকতো।

বনহুর গাড়ি নিয়ে ছুটে চললো।

বনহুরের গাড়ি পৌঁছতেই চৌধুরী সাহেব চিনতে পারলেন, এ গাড়ি খান বাহাদুর সাহেবের। শশব্যস্তে এগিয়ে এলেন তিনি গাড়ির পাশে— কিন্তু একি, খানবাহাদুর সাহেব কই? অপরিচিত এক যুবক বসে আছে ড্রাইভ আসনে। চৌধুরী সাহেব বুঝতে পারলেন এই যুবকই খান বাহাদুর সাহেবের লণ্ডন ফেরত পুত্র মুরাদ। চৌধুরী সাহেব সহাস্যে বলেন—নেমে এসো বাবা।

মুরাদ বেশি বনহুর মাথার ক্যাপটা আরও কিছুটা সামনের দিকে এগিয়ে দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে ছিল।

মুরাদবেশী বনহুরের চালচলন দেখে কিছুটা আশ্চর্য হলেন চৌধুরী সাহেব, তবু হেসে জিজ্ঞেস করলেন—তোমার আব্বা এলেন না কেন?

বনহুর বলে ওঠে—হঠাৎ তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ায় আসতে পারলেন না।

ব্যথিত কণ্ঠে বলেন চৌধুরী সাহেব—বড় আফসোসের কথা। তিনিই যে আজ আমার এই উৎসবে শ্রেষ্ঠ অতিথি।

দুঃখিতভাবে বলে বনহুর—আব্বার অসুস্থতার জন্যই এত বিলম্ব হলো।

এসো বাবা।

চৌধুরী সাহেব মুরাদবেশী বনহুরকে নিয়ে হলঘরে প্রবেশ করলেন এবং দুঃখের সাথে বলেন—একটা দুঃসংবাদ, আমার বিশিষ্ট বন্ধু খান বাহাদুর সাহেব হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় তিনি আসতে পারলেন না। তাঁর পুত্র মুরাদ এসেছে।

কক্ষের সকলেই মুরাদবেশী বনহুরের মুখে তাকালেন। মনিরাও তাকালো, বান্ধবীরা তাকে নিয়ে আলাপ-ঠাট্টা শুরু করলো, কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করতে লাগলো মনিরা।

চৌধুরী সাহেব সকলের সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দিতে লাগলেন। পুলিশ ইন্সপেক্টার মি. হারুনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেন—উনি পুলিশ ইন্সপেক্টার মি. হারুন।

বনহুর হাত বাড়িয়ে হ্যাণ্ডশেক করলো।

আর ইনি প্রাইভেট ডিটেকটিভ মি. শঙ্কর রাও, দস্যু বনহুরকে গ্রেপ্তারের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছেন।

বনহুর তাঁর সাথে হ্যাণ্ডশেক করে বলেন—আপনার সঙ্গে পরিচিত হবার সৌভাগ্য লাভ করে নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করছি, মি. রাও।

আর ইনি রায়বাহাদুর শ্যামাচরণ মহাশয়।

রায়বাহাদুরের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে বনহুর—উনি আমার পরিচিত।

বিস্ময়ভরা কণ্ঠে রায়বাহাদুর শ্যামাচরণ বলে উঠেন—এ্যাঁ। এই কণ্ঠ যেন তাঁর কাছে পরিচিত বলে মনে হলো, কিন্তু স্মরণ করতে পারলেন না, এ কণ্ঠ কোথায় তিনি শুনেছিলেন।

বনহুর রায় বাহাদুর শ্যামাচরণ মহাশয়কে ভাববার সময় না দিয়ে বলে ওঠে—মানে আপনার সঙ্গে আমি বিশেষভাবে পরিচিত—আব্বার মুখে প্রায়ই আপনার কথা শুনেছি।

রায়বাহাদুর শ্যামাচরণ আশ্বস্ত হন।

চৌধুরী সাহেব সম্মানিত ব্যক্তিদের সঙ্গে মুরাদবেশী বনহুরের পরিচয় করিয়ে দেন। তারপর মনিরার সঙ্গে—এটা আমার ভাগনী মনিরা।

মনিরা! নামটা শুনতেই চমকে উঠলো বনহুর। এ নামটা যেন তার বহু পরিচিত। ভাল করে তাকালো সে মনিরার দিকে। মনিরার অপূর্ব সৌন্দর্য বনহুরকে মুগ্ধ করে ফেললো। মোহগ্রস্তের মত তাকিয়ে রইলো সে।

চৌধুরী সাহেবের কণ্ঠস্বরে সম্বিৎ ফিরে এলো বনহুরের—বসো বাবা, বসো।

বনহুর আসন গ্রহণ করলো, কিন্তু মনের কোণে একটা ধাক্কা খেতে লাগলো—মনিরা কে এ মনিরা—সে মনিরা…যার ছবি এখনও তার গলায় লকেটে রয়েছে। না, না, তা হতে পারে না, কত মেয়ের নামই তো মনিরা হতে পারে।

মনিরাকে বান্ধবীরা ধরে বসলো গান শুনাবার জন্য। অগত্যা মনিরা অর্গানের পাশে গিয়ে বসলো।

গান শেষে করতালিতে ভরে উঠলো উৎসব কক্ষ। চৌধুরী সাহেব হীরার আংটি পরিয়ে দিল মনিরার হাতে।

সকলের অজ্ঞাতে বনহুরের চোখ দুটো ধক করে জ্বলে উঠলো। অল্পক্ষণের মধ্যেই টেবিলে খাবার দেয়া হলো।

খাওয়া-পর্ব শেষ হবার পর বিদায়ের পালা। মুরাদবেশী বনহুর উঠে দাঁড়ালো। চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে হ্যাণ্ডশেক করার পর হাত বাড়ালো পুলিশ ইন্সপেক্টার হারুনের দিকে, তারপর মি. শঙ্কর রাওয়ের সাথে হ্যাণ্ডশেক করে নিজের গাড়িতে চেপে বসলো।

তারপর সকলেই এক এক করে বিদায় গ্রহণ করলেন। চৌধুরী সাহেব সকলকে বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে হলঘরে ফিরে এলেন। হঠাৎ নজর গিয়ে ছিল সম্মুখের টেবিলে। একটা নীল রঙের খাম পড়ে রয়েছে। চৌধুরী সাহেব খামখানা হাতে উঠিয়ে নিয়ে ছিড়ে ফেলেন। একখানা নীল রঙের কাগজের টুকরো বেরিয়ে এলো। তিনি আলোর সামনে কাগজখানা মেলে ধরতেই চমকে উঠলেন, সেটাতে লেখা রয়েছে মাত্র ক’টি শব্দ।

“আপনাদের উৎসবে আমি এসেছিলাম।”

—দস্যু বনহুর

মুহূর্তে চৌধুরী সাহেবের মুখমণ্ডল বিবর্ণ হয়ে উঠলো। মনিরা এসে দাঁড়িয়েছে তাঁর পাশে। ব্যগ্রকণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো—ওটা কি মামুজান?

কাগজখানা মনিরার হাতে দিয়ে বলেন চৌধুরী সাহেব—পড়ে দেখ।

মনিরা কাগজখানা হাতে নিয়ে দৃষ্টি ফেলতেই অস্ফুট শব্দকরে উঠলো—দস্যু বনহুর।

হ্যাঁ, সে এসেছিল!

দস্যু বনহুর তাহলে সত্যিই এসেছিল, মামুজান?

না, এলে এ চিঠি এলো কোথা থেকে…

চৌধুরী সাহেবের কথা শেষ হতে না হতে গাড়ি-বারান্দা থেকে মোটরের শব্দ ভেসে এলো। ব্যস্তসমস্ত হয়ে ছুটলেন চৌধুরী সাহেব। না জানি এত রাতে আবার কে এলো? গাড়ি-বারান্দায় পৌঁছতেই আশ্চর্য হলেন। এ যে খান বাহাদুর সাহেবের গাড়ি। তাড়াতাড়ি পাশে গিয়ে দেখলেন, গাড়ির মধ্যে বসে রয়েছেন খান বাহাদুর হামিদুল হক এবং ড্রাইভার আসনে একটা যুবক।

চৌধুরী সাহেব আনন্দভরা কণ্ঠে বলেন—হক সাহেব আপনি এসেছেন? আসুন, আসুন।

খানবাহাদুর ও তাঁর পুত্র মুরাদ গাড়ি থেকে নেমে এলেন।

চৌধুরী সাহেব ব্যস্তকণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন—হঠাৎ আপনার কি অসুখ হয়েছিল?

খানবাহাদুর সাহেব বলেন—চলুন সব বলছি।

চৌধুরী সাহেব ওদের সঙ্গে করে হলঘরে প্রবেশ করলেন। খানবাহাদুর সাহেব ধপাস করে একটা সোফায় বসে পড়েন। মুরাদও বসে পড়ে আর একটা সোফায়।

চৌধুরী সাহেব বলেন—আপনি হঠাৎ নাকি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। কি হয়েছিল?

কে বলেন আমি অসুস্থ হয়েছিলাম?

আপনার পুত্র মুরাদের মুখে জানতে পারলাম…

বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বলে ওঠেন হক সাহেব—আমার পুত্র মুরাদ?

জ্বি হ্যাঁ, কিছু পূর্বে সে চলে গেছে।

আপনি এসব কি বলছেন চৌধুরী সাহেব? আমার পুত্র মুরাদ এই তো আমার পাশে বসা, ও তো এর আগে এ বাড়িতে কোনদিন আসেনি।

একসঙ্গে চৌধুরী সাহেব আর মনিরা চমকে উঠে তাকালো পাশের সোফায় উপবিষ্ট যুবকের মুখের দিকে চেয়ে।

চৌধুরী সাহেব ঢোক গিলে জিজ্ঞেস করলেন—কিছুক্ষণ পূর্বে আপনার গাড়ি নিয়ে যে যুবক এসেছিল, সে তবে আপনার পুত্র মুরাদ নয়?

না, সে আমার পুত্র নয়, সে ডাকু…

অস্ফুট আর্তনাদ করে ওঠে চৌধুরী সাহেব—ডাকু। সে যুবকই তাহলে দস্যু বনহুর।

হ্যাঁ, সে যুবকই দুস্য বনহুর—তারপর হক সাহেব সমস্ত ঘটনা খুলে বলেন।

সব শুনে চৌধুরী সাহেবের কণ্ঠতালু শুকিয়ে এলো। এখন তাহলে উপায়, নিশ্চয়ই দস্যু হানা দেবার পূর্বে অনুসন্ধান নিয়ে গেল। চিন্তিতকণ্ঠে বলেন—এক্ষুণি পুলিশ অফিসে ফোন করে দিই, সমস্ত কথা তাঁদের জানানো উচিত।

চৌধুরী সাহেব আর বিলম্ব না করে তখনই পুলিশ অফিসে ফোন করলেন।

অল্পক্ষণের মধ্যেই মি. হারুন কয়েকজন পুলিশসহ পুনরায় চৌধুরীবাড়িতে উপস্থিত হলেন। এসে সমস্ত ঘটনা শুনে থ’ মেরে গেলেন। এত বড় কথা। যে দস্যুর সন্ধানে পুলিশমহলের কারও চোখে ঘুম নেই, অহরহ যার খোজে তাঁরা হন্তদন্ত হয়ে শহরময় ছুটাছুটি করে মরছেন, সে দস্যু বনহুর তাঁদের পাশে বসে একসঙ্গে খাবার খেয়ে গেল, এমন কি হাতে হাত মিলিয়ে হ্যাণ্ডশেক পর্যন্ত করে গেল। ছিঃ ছিঃ, এর চেয়ে লজ্জার কথা কি হতে পারে। প্রখ্যাত ডিটেকটিভ শঙ্কর রাওয়ের চোখে পর্যন্ত ধূলি দিয়ে ছেড়েছে সে। এখন আর কি আছে, কয়েকজন পুলিশকে কড়া পাহারার ব্যবস্থা রেখে ফিরে গেলেন।

নিশীথ রাত।

গোটা বিশ্ব সুপ্তির কোলে ঢলে পড়েছে।

বনহুরের অশ্ব চৌধুরীবাড়ির পেছনে এসে থামলো। তার শরীরে কালো ড্রেস, মাথায় পাগড়ী, মুখে কালো রুমাল বাঁধা।

আজ কদিন থেকে চৌধুরীবাড়ির কারও চোখে ঘুম নেই। চৌধুরী সাহেব স্বয়ং গুলিভরা রিভলবার হাতে হলঘরে পায়চারী করে করে রাত কাটান। মরিয়ম বেগমের চোখেও ঘুম নেই। গোটা রাত তাঁর অনিদ্রায় কাটে। শুধু বিছানায় শুয়ে শুয়ে এপাশ-ওপাশ করেন। হীরার আংটির জন্য তার কোন চিন্তা নেই, চিন্তা যত মনিরাকে নিয়ে দস্যু বনহুর হঠাৎ কিছু না অমঙ্গল ঘটিয়ে বসে।

মনিরা নিজের কক্ষে শুয়ে আতঙ্কে শিউরে ওঠে। ঘুমাতে গিয়ে চমকে ওঠে সে। না জানি কোন মুহূর্তে তার হীরার আংটি লুটে নেবে, হয়ত তাকে জীবনে মেরে ফেলতেও পারে। দস্যুর অসাধ্য কিছু নেই। ভয়ভীতি নিয়ে প্রহর গুণে মনিরা, তারপর এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে।

মনিরা হীরার আংটি আংগুলে রাখার সাহস পায়নি। আলমারীতে রেখে তালাবন্ধ করে দিয়েছে। দস্যু হানা দিলে হীরার আংটি নিয়ে যাবে, তবু তার শরীরে যেন আঘাত না পায়।

আজ ক’দিন হলো মনিরা ঘুমায়নি, তাই গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়েছে আজ মনিরা।

হলঘর থেকে চৌধুরী সাহেবের জুতোর শব্দ ভেসে আসছে। পাশের ঘর থেকে ভেসে আসছে মরিয়ম বেগমের চুড়ির টুনটান শব্দ। সদর গেটে সশস্ত্র পুলিশ দণ্ডায়মান।

জানালার শার্শী খুলে কক্ষে প্রবেশ করে বনহুর। ধীরে ধীরে অতি লঘু পদক্ষেপে মনিরার বিছানার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। প্যান্টের পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে মনিরার নাকের সামনে ধরলো তারপর মনিরার বালিশের তুলা থেকে চাবির গোছা বের করে নিয়ে এগিয়ে চলে আলমারীর দিকে। অল্পক্ষণেই আলমারী খুলে বের করে আনে সে বহু মূল্যবান হীরার আংটি।

কক্ষে একটা নীলাভ ডিমলাইট জ্বলছিল, সে আলোতে বনহুরের হাতে হীরার আংটিটা ঝকঝক করে উঠে। আংটিটা প্যান্টের পকেটে রেখে এগিয়ে যায় সে মনিরার বিছানার পাশে। ছিন্নলতার ন্যায় মনিরার সুকোমল দেহখানা বিছানায় লুটিয়ে আছে। এলোমেলো চুলগুলো ছড়িয়ে আছে ললাটের চারপাশে। অপূর্ব দেখাচ্ছিল মনিরাকে। বনহুর নির্নিমেষ নয়নে কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে রইলো, তারপর চলে যাবার জন্য যেমনি সে ফিরে দাঁড়াতে যায়, অমনি নজর গিয়ে পড়ে তার দেয়ালের ওপর। বিস্ময়ে চমকে ওঠে বনহুর। একী! এ তারই লকেটের ছবি। পাশাপাশি দুটি মুখ, সে আর মনিরা। আশ্চর্য! এ ছবি এখানে এলো কী করে? বনহুর নিজের গলার মালাছড়া জামার নিচে হতে টেনে বের করলো, তারপর লকেটের ঢাকনা খুলে ফেললো। একবার তাকালো সে দেয়ালের ছবিখানার দিকে তারপর পকেটে। এ যে একই ছবি! না, কোন ভুল নেই। তবে কি এই তার সে মনিরা, যে মনিরা শিশুকালে তার হৃদয় জয় করে নিয়েছিল? বনহুর ঝুঁকে ছিল মনিরার মুখের ওপর। এইতো সে তিলটা এখনও রয়েছে তার চিবুকের একপাশে। লকেটের ছবিখানার দিকে লক্ষ্য করে আশ্বস্ত হলো সে, এই তার সে মনিরা। আনন্দে বনহুরের চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ফিরে পেয়েছে সে, তার মনিরাকে তাহলে ফিরে পেয়েছে। বনহুর বসে ছিল মনিরার পাশে, সযত্নে মনিরার ললাট থেকে চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে ভাল করে দেখতে লাগলো। কতদিন, কত যুগ পরে সে যেন ফিরে পেল তার মনিরাকে। বনহুরের ঠোঁট দু’খানা মনিরার ললাট স্পর্শ করলো।

এবার বনহুর মনিরার সুকোমল হাতখানা তুলে নিল হাতে, তারপর প্যান্টের পকেট থেকে বের করে আনলো হীরার আংটিটা, অতি যত্নে পরিয়ে দিল সে মনিরার আঙ্গুলে।

একটুকরা কাগজ বের করে তাতে লিখল—

 “আমি এসেছিলাম”

—দস্যু বনহুর।

কাগজখানা মনিরার বিছানার পাশে রেখে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল সে।

বনহুরের অশ্ব গিয়ে থামতেই ছুটে এলো নূরী। বনহুরকে হাত ধরে নামিয়ে নিল সে। তারপর হেসে বলেন—এনেছো আমার হীরার আংটি?

চলতে চলতে বলে বনহুর—আনতে পারলাম না, একজন কেড়ে নিল।

মিথ্যা কথা। দস্যু বনহুরের কাছ হতে কেউ যে কিছু কেড়ে নিতে পারবে—এ আমি বিশ্বাস করতে পারিনে।

কেন? আমার চেয়ে কেউ কি বীরপুরুষ নেই?

না, আমার কাছে সব পুরুষের চেয়ে তুমিই শক্তিমান।

নূরীর কথায় হাসলো বনহুর। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বলে—তোমার এ বিশ্বাস অটুট রইলো কই! হীরার আংটি হাতে পেয়েও তোমার নিকট পৌঁছাতে পারলাম না।

নূরী বনহুরের দক্ষিণ হাত চেপে ধরলো— সত্যি তুমি হীরার আংটি হাতে পেয়েও—

হ্যাঁ নূরী, আমি পরাজিত হয়েছি।

না, এ আমি বিশ্বাস করি না হুর, এ আমি বিশ্বাস করি না—

নূরী, সামান্য একটা হীরার আংটি তোমাকে এতখানি মোহগ্রস্ত করে ফেলেছে?

না হুর, শত শত হীরার আংটি আমার কাছে তুচ্ছ। আমি কিছুতেই ভাবতে পারিনে দস্যু বনহুরকে কেউ পরাজিত করতে পারে। তুমি সত্যি করে বল, কারও কাছে তুমি হেরে যাওনি?

নূরী, তোমার বিশ্বাস যেন অটুট থাকে। ইনশাআল্লাহ বনহুর কারও কাছে শক্তির দিক দিয়ে পরাজিত হবে না।

নূরী আনন্দে অস্ফুটধ্বনি করে ওঠে—হুর!

নিজের কক্ষে প্রবেশ করলো বনহুর। নূরী তার শরীর থেকে দস্যুর ড্রেস খুলে নেয়, তারপর উভয়ে বসে পড়ে পাশাপাশি। নূরী বনহুরের চুলে আংগুল বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, তুমি সত্যি বীরপুরুষ। তোমার শক্তির কাছে সমস্ত লোক পরাজিত, তোমার বুদ্ধির কাছে সবাই হেয়! হাজার হাজার লোকের চোখে ধুলো দিয়ে তুমি তোমার সাধনা পূর্ণ করে চলেছে। শত শত পুলিশবাহিনী তোমাকে পাকড়াও করার জন্য অহরহ ক্ষিপ্তের ন্যায় ছুটাছুটি করছে। কেউ তোমাকে আজও পাকড়াও করতে সক্ষম হলো না। তোমার এই অভূতপূর্ব বীরত্বকে আমি শ্রদ্ধা করি। খোদা তোমাকে চিরদিন এমনি করে জয়ী করুন।

নূরী, তুমিই শুধু আমার হিতাকাক্ষী। আর কেউ আমার মঙ্গল কামনা করে না। সবাই চায় দস্যু বনহুরের পতন!

ছিঃ! ও কথা মুখে এনো না হুর; আমার প্রাণে বড় ব্যথা লাগে, তোমার অমঙ্গল আমার কাছে মৃত্যুর চেয়েও কষ্টদায়ক।

বনহুর অবাক নয়নে তাকালো নূরীর অশ্রুসিক্ত চোখ দুটির দিকে। নূরী তাকে এত ভালবাসে কিন্তু ধীরে ধীরে নূরীর মুখ খানা মিলিয়ে গিয়ে সেখানে ভেসে ওঠে একটা সুন্দর ফুলের মত কোমল ঘুমন্ত মুখ। বনহুর দৃষ্টি নত করে কি যেন ভাবতে লাগলো।

নূরী বলেন—হুর, আজ তোমাকে যেন কেমন ভাবাপন্ন লাগছে। কি হয়েছে তোমার?

বললাম তো কিছু না। তুমি যাও নূরী, আমি এখন বিশ্রাম করবো।

কেন, আমি থাকলে তোমার কি খুব অসুবিধা হচ্ছে? আমি যাই। অভিমান ভরে উঠে দাঁড়ায় নূরী।

অন্যদিন হলে বনহুর ওর হাত চেপে ধরে পুনরায় বসিয়ে দিত কিংবা নিজেও উঠে দাঁড়িয়ে বলত—চলো আমিও যাই তোমার সঙ্গে, কিন্তু আজ বনহুর নীরব থেকে যায়।

নূরীর চোখ দুটো ছলছল করে ওঠে, দ্রুত পায়ে বেরিয়ে যায় সে।

বনহুর বিছানায় গিয়ে গা এলিয়ে দেয়, তারপর ধীরে ধীরে বুজে আসে ওর চোখের পাতা।

আড়ালে দাঁড়িয়ে নূরী তাকিয়ে থাকে বনহুরের মুখে। বনহুরকে নিয়ে সে রচনা করে চলেছে এক স্বপ্নসৌধ। নূরীর মন চলে যায় দূরে, অনেক দূরে—সেখানে শুধু সে আর বনহুর। কিন্তু বনহুরকে সে যতই আঁকড়ে ধরতে চায়, ততই যেন সে সরে পড়ে দূরে। কিছুতেই নূরী বনহুরের নাগাল পায় না। বিগত দিনের স্মৃতি হাতড়ে চলে নূরী। কিন্তু সেখানেও ফাঁকা লাগে, বনহুরের নাগাল সে কোনদিন পায়নি। কোথায় যেন ব্যবধান আছে দু’জনের মধ্যে।

আর ভাবতে পারে না নূরী, সমস্ত ভাবনা যেন তার খেই হারিয়ে ফেলে। ধীরে ধীরে চলে যায় সে নিজের ঘরে।

বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবে নূরী কত কথা, সে ছোট্ট হতে এত বড় পর্যন্ত। সব সময় সে বনহুরকে দেখে আসছে। এক সঙ্গে খেলা করেছে, এক সঙ্গে খেয়েছে, ঝর্ণায় সাঁতার কেটেছে, কিন্তু কৈ, বনহুরকে সে তো কোনদিন নিজের করে পায়নি। ব্যথায় গুমড়ে কেঁদে ওঠে নূরীর মন। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে সে। বিশেষ করে আজকের কথাটা তার হৃদয়ে ভীষণ কষ্ট দিয়েছে।

কখন ঘুমিয়ে পড়েছে নূরী, হঠাৎ একটা শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায় তার, দেখতে পায় তার কক্ষের জানালার শিক বাঁকিয়ে কক্ষে প্রবেশ করতে যাচ্ছে একটা হিংস্র বাঘ। অন্ধকারে বাঘের চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। মাত্র আর একটা শিক বাঁকাতে পারলেই বাঘটা তার কক্ষে প্রবেশ করতে সক্ষম হবে।

নূরী ভয়ার্ত কণ্ঠে আর্তনাদ করে উঠলো।

পাশের কক্ষে ঘুম ভেঙ্গে গেল বনহুরের। নূরীর কক্ষ লক্ষ্য করে ছুটে চললো সে। কিন্তু পূর্বেই বাঘটা জানালার শিক ভেঙ্গে কক্ষে প্রবেশ করলো।

বনহুর কক্ষে প্রবেশ করতেই বাঘটা লাফিয়ে পড়লো তার ওপর। সঙ্গে সঙ্গে বনহুর পড়ে গেল মাটিতে। নূরী আর্তনাদ করে দু’হাতে চোখ টাকলো। কিন্তু পরক্ষণেই নিজকে সামলে নিয়ে নিজের কোমর থেকে ছোরা খুলে নিয়ে ছুঁড়ে দিল বনহুরের দিকে। বনহুর ছোরাখানা লুফে নিয়ে বসিয়ে দিল বাঘটার বুকে। কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তি চললো বাঘ আর বনহুরের মধ্যে।

ততক্ষণে কক্ষে আরও বহু দস্যু এসে জড়ো হয়েছে। বাঘটা তখন ঢলে পড়লো মেঝেতে। বনহুর গায়ের ধূলো ঝেড়ে উঠে দাঁড়ালো, কিন্তু তার শরীরে কয়েকটা স্থান ক্ষতবিক্ষত হয়ে রক্ত ঝরছে দরদর করে।

নূরী এ দৃশ্য সহ্য করতে পারলো না, ছুটে এসে দু’হাতে নিজের ওড়নার কাপড় ছিঁড়ে বেঁধে দিতে লাগলো ওর ক্ষত স্থানগুলো। অন্যান্য দস্যু বনহুরের এই বীরত্বে আশ্চর্য হয়ে যায়। তারা ভাবতেও পারেনি তাদের সর্দার এত বড় একটা বাঘকে একাই সাবাড় করতে পারবে। সবাই বনহুরের জয়ধ্বনি করে ওঠে।