ঝরা পালক১
–ওগো ও চক্রবাকী
তোমারে খুঁজিয়া অন্ধ হল যে চক্রবাকের আঁখি!
কোথা কোন লোকে কোন নদী পারে রহিলে গো তারে ভুলে?
হেথা সাথী তব ডেকে ডেকে ফেরে ধরণীর কূলে কূলে।
দিবসে ঘুমালে সব ভুলে যার পাখায় বাঁধিয়া পাখা,
চঞ্চুতে যার আজিও তোমার চঞ্চুর চুমা আঁকা,
‘রোদ লাগে’ বলে যার ডানাতলে লুকাইতে নানা ছলে,
থাকিয়া থাকিয়া উঠিতে কাঁপিয়া তবু কেন পলে পলে;
ভাদরের পারা আদরের ধারা যাচিয়া যাহার কাছে
কায়ার পিছনে ছায়াটির মত ফিরিয়াছ পাছে পাছে,–
আজ সে যে হায় কাঁদিয়া তোমায় দিকে দিকে খুঁজে মরে,
ভীরু মোর পাখি! আঁধারে একাকী কোন বালুচরে?
সাড়া দেয় বন, শন্ শন্ শন্–ঐ শোন মোর ডাকে,
তটিনীর জল আঁখি ছলছল ফিরে চায় বাঁকে বাঁকে,
ফিরায়ে আমার প্রতিধ্বনিরে সান্ত্বনা দেয় গিরি,
ও-পারের তীরে জিরিজিরি পাতা ঝুরিতেছে ঝিরি ঝিরি।
বিহগীর হায় ঘুম ভেঙে যায় বিহগ-পক্ষপুটে,
বলে, ‘বিরহীরে, মোর সুখ-নীড়ে আয় আয় আয় ছুটে!
জুড়াইব ব্যথা কাঁটা বিঁধে যথা সেথা দিব বুক পেতে,
ঐ কাঁটা লয়ে বিবাগিনী হয়ে উড়ে যাব আকাশেতে!’
ঠোঁট-ভরা মধু আসে কুলবধূ, বলে, ‘আঁধারের পাখি,
নিশীথ নিঝুম চোখে নাই ঘুম, কারে এত ডাকাডাকি?
চল তরুতলে, এই অঞ্চলে দিব সুখ-শেজ পাতি,
ভুলে কাননে ফুল তুলে মোরা কাটাইব সারা রাতি!’
অসীম আকাশ আছে মোর পাশ তারার দিপালী জ্বালি,
বলে, ‘পরবাসী! কোথা কাঁদ আসি? হেথ শুরু চোরাবালি!
তোমার কাঁদনে আমার আঙনে নিভে যায় তারা-বাতি,
তুমিও শূন্য আমিও শূন্য, এস মোরা হব সাথী!”…
মানে না পরান, গেয়ে গেয়ে গান কূলে কূলে ফিরি ডাকি,
কোথা কোন কূলে রহিলে গো ভুলে আমার চক্রবাকী?
চাহি ও-পারের তীরে
কভু না পোহায় বিরহের রাতি এতই দীরঘ কি রে?
না মিটিতে সাধ বিধি সাধে বাদ, বিরহের যবনিকা
পড়ে যায় মাঝে, নিভে যায় সাঁঝে মিলনের মরু-শিখা।
মিলনের কূল ভেঙে ভেঙে যায় বিরহের স্রোত-বেগে,
অধরের হাসি বাসি হয়ে ওঠে নিশিথ-প্রভাতের জেগে!
একা নদীতীরে গহন তিমিরে আমি কাঁদি মনোদুখে,
হয়ত কোথায় বাঁধিয়া কুলায় তুমি ঘুম যাও সুখে।
আমাদের মাঝে বহিছে যে নদী এজীবনে শুকাবে না,
কাটিবে যে নিশি, আসিবে প্রভাত–যতেক অচেনা চেনা
আসিবে সবাই; আসিবে না তুমি তব চির-চেনা নীড়ে,
এ-পাড়ের ডাক ও-পার ঘুরিয়া এ-পারে আসিবে ফিরে!
হয়ত জাগিয়া দেখিব প্রভাতে, আমারি আঁখির আগে
তুমি যাচিতেছ নবীন সাথীর প্রেম নব অনুরাগে।
জানি গো আমার কাটিবে না আর এই বিরহের নিশি,
খুঁজিবে বৃথাই আঁধারে তোমায় দশদিকে দশ দিশি।
যখন প্রভাতে থাকিব না আমি এই সে নদীর ধারে,
ক্লান্ত পাখায় উড়ে যাব দূর বিস্মরণীর পারে,
খুঁজিতে আমায় এই কিনারায় আসিবে তখন তুমি–
খুঁজিবে সাগর-মরু-প্রান্তর গিরি দরি বনভূমি।
তাহারি আশায় রেখে যাই প্রিয়, ঝরা পালকের স্মৃতি–
এই বালুচরে ব্যথিতের স্বরে আমার বিরহ-গীতি!
যদি পথ ভুলে আস এই কূলে কোনদিন রাতে রাণী,
প্রিয় ওগো প্রিয়, নিও তুলে নিও ঝরা এ পালকখানি।
সূত্রনির্দেশ ও টীকা
- মূলগ্রন্থে কবিতাটি শিরোনামহীন, কিন্তু ‘চক্রবাক’ কাব্যগ্রন্থের অধিকাংশ সংস্করণে এই কবিতাটি কবিতার প্রথম পঙ্ক্তি ‘ওগো ও চক্রবাকী’ শিরোনামে মুদ্রিত হয়ে থাকে। আমাদের এই সংস্করণে আমরা কবিতাটির ‘ঝরা পালক’ শিরোনাম দিয়েছি কবিতাটির শেষ পঙ্ক্তি ‘প্রিয় ওগো প্রিয়, নিও তুলে নিও ঝরা এ পালকখানি’র আলোকে—যেহেতু কবি প্রিয়কে ঝরা এ পালকখানি তুলে নিতে আহ্বান জানিয়েছেন।